প্রথম ও দ্বিতীয় পর্ব:: যেভাবে জীবনের শুরুঃ পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি
চতুর্থ পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরুঃ প্রোটনের শক্তি
পঞ্চম পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরুঃযেভাবে কোষের জন্ম
শেষ পর্ব: যেভাবে জীবনের শুরুঃ সব পথ এসে মিলে গেল শেষে (শেষ পর্ব)
মূল প্রবন্ধ: The secret of how life on earth began
১৯৬০ সালের পরে বিজ্ঞানীগণ প্রাণের উৎস অনুসন্ধানে তিনটি মতবাদে বিভক্ত হয়ে গেলেন। কারো ধারণা জীবন শুরু হয়েছিল প্রাথমিক পর্যায়ের জৈবিক কোষ গঠনের মাধ্যমে। অন্য একদল বিজ্ঞানী মনে করেন জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল রাসায়নিক বিপাক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কিন্তু আরেক দল বিজ্ঞানী বংশগতি এবং আপন কোষের প্রতিলিপি সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। শেষ দলের বিজ্ঞানীগণ, যে কোষটি নিজেই নিজের অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে তাদের স্বরূপ কেমন ছিল সেটা অন্বেষণের চেষ্টা করেন। এই বিজ্ঞানীগণ প্রথম থেকেই জোর দিয়ে প্রচার করেন জীব-কোষ আরএনএ দিয়ে তৈরি।
১৯৬০ দশকের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা করার যথেষ্ট কারণ ছিল যে আরএনএ হল সকল প্রাণের উৎস। বিশেষত আরএনএ এমনকিছু করতে পারে যেটা ডিএনএ করতে পারে না। আরএনএ হল একটা নমনীয় সুতো সদৃশ মলিকিউল। অন্যদিকে ডিএনএ হল দুইটা সুতো যারা নিজেরা পেঁচিয়ে স্তরে স্তরে বিভিন্ন আকারে সাজানো থাকে। আপনি এনজাইম ছাড়া বাঁচতে পারবেন না। আরএনএ এর ভিতরে কাগজের মত ভাজ করা একটা বস্তু দেখা গেল যেটা প্রোটিনের মত আচরণ করে। প্রোটিন দেখতে সাধারণত অনেকটা লম্বা সুতোর মত। প্রোটিন নিউক্লিওটাইড নয় বরং অ্যামাইনো এসিড দিয়ে তৈরি এবং তারা বিশদ জটিল অবয়ব সৃষ্টিতে সাহায্য করে। আরএনএ হল প্রোটিন উৎপাদনের সবচেয়ে আশ্চর্য দক্ষতা। কিছু আরএনএ রাসায়নিক বিক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে অনুঘটকের কাজ করে। এই সমস্ত প্রোটিনকেই এনজাইম বলে।
আপনার মেরুদণ্ডের হাড়ের মজ্জায় বিপুল পরিমাণ এনজাইম বিদ্যমান। এনজাইম খাদ্যের জটিল মলিকিউলকে ভেঙে শর্করা বা চিনিজাতীয় সাধারণ সরল খাদ্য উপাদানে পরিণত করে যাতে প্রাণীর দেহকোষ সহজে গ্রহণ করতে পারে।
লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র মনে হচ্ছিল যদি আরএনএ প্রোটিনের মত ভাজে ভাজে থাকে তাহলে আরএনএ এর মধ্যে জীবন্ত মলিকিউল থাকার সম্ভাবনা আছে এবং সেখানে তথ্যগুলো ডিএনএ আকারে সংরক্ষিত থাকে আর কিছু প্রোটিন রাসায়নিক বিক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। লেজলি ওরগেল এবং ফ্রান্সিস ক্রিক’র সন্দেহ ছিল নিছক ধারণা কিন্তু দশক ধরে সেই ধারণার কোন সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি।
টমাস রবার্ট চেক জন্মগ্রহণ করেন আমেরিকার আইওয়া শহরে এবং সেখানেই তার বেড়ে ওঠা। শিশুকাল থেকেই চেক পাথর এবং খনিজ উপাদানের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ অনুভব করেন। তিনি যখন নিম্ন মাধ্যমিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র তখনই সে স্থানীয় একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের গবেষণাগারের দরজায় উঁকি দিয়ে শিক্ষকদের কাছে খনিজ উপাদানের গঠন প্রণালী দেখতে চেয়েছিলেন। টমাস রবার্ট চেক জৈব রসায়নবিদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন এবং তার আগ্রহের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল আরএনএ। এখন দেখা যাচ্ছে জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল আরএনএ দিয়ে এবং এতদিনের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর প্রায় দ্বারপ্রান্তে।
১৯৮০ সালের শুরুর দিকে টমাস রবার্ট চেক এবং তার কিছু সহকর্মী কোলারাডো বোলডার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে এককোষী প্রাণ ‘Tetrahymena thermophila’ নিয়ে গবেষণা করছিলেন। এককোষী প্রাণের অনুষঙ্গের সুতা সদৃশ বস্তুটি আরএনএ দিয়ে গঠিত। চেক আবিষ্কার করলেন আরএনএ’র একটা বিশেষ অংশ কখনো কখনো মূল অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে যেন তাকে কাঁচি দিয়ে কেটে আলাদা করে ফেলা হয়েছে। চেকের গবেষকদল যখন সব এনজাইমকে পৃথক করে ফেললেন তখন অন্যান্য মলিকিউল কাঁচির মত কাটাকুটির কাজ করছিল। এই কাজটি চালিয়ে নিচ্ছিল আরএনএ। তারা খুঁজে পেলেন প্রথম আরএনএ এনজাইম। আরএনএ’র ক্ষুদ্র অংশ যারা নিজেদেরকে বৃহৎ অংশ থেকে দ্বিখণ্ডিত করতে সক্ষম।
চেক তার গবেষণামূলক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করলেন ১৯৮২ সালে। পরের বছর অন্য একটি বিজ্ঞানীদল রাইবোজম নামের দ্বিতীয় আরেকটি আরএনএ এনজাইমের সন্ধান পেলেন। দুইটি আরএনএ পাওয়ার সফলতার দ্রুত ইঙ্গিত দিলো সেখানে আরও অনেক কিছুর অস্তিত্ব আছে। এই আবিষ্কারের ফলে আভাস পাওয়া যাচ্ছিল জীবন সৃষ্টি হয়েছিল আরএনএ থেকে।
ম্যাসাচুচেটস প্রদেশের কেমব্রিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ওয়াল্টার গিলবার্ট প্রথম মানুষের বংশগতি ধারণার গোড়াপত্তন করেন। পদার্থবিজ্ঞানী হলেও গিলবার্ট মলিকিউলার বায়োলজিতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। মানুষের জীনের ক্রমবিবর্তনের ধারা প্রমাণ করতে তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা। বিচ্ছিন্ন বস্তুকণা থেকে আরএনএ জগতে উত্তরণ হল প্রাণের বিকাশে রাজকীয় যাত্রার শুরু। ১৯৮৬ সালে ‘নেচার’ বিজ্ঞান সাময়িকীতে গিলবার্ট প্রস্তাব করেন প্রাণের উৎপত্তি হয়ে আরএনএ’র হাত ধরে।
গিলবার্ট যুক্তি দেখান বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে নিউক্লিওটাইড ঘনতরল থেকে বস্তুকণা থেকে নিজেই নিজের প্রাণ সৃষ্টির কাজকে ত্বরান্বিত করে আরএনএ মলিকিউল। আরএনএ সম্মিলিতভাবে দ্বিভাজিত হয় এবং নিজের স্বরূপ সৃষ্টি করে। আরএনএ মলিকিউল ক্রমান্বয়ে অনেক প্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার জন্ম দিল। আরএনএ খুঁজে পেল প্রোটিন এবং প্রোটিন এনজাইম সৃষ্টির উপায় এবং প্রমাণিত হল তাদের গুরুত্ব এবং তারা যাত্রা শুরু করলো জীবনের পথে যে জীবন আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রাণের বিকাশ প্রথমদিকের নিউক্লিওটাইড আদিম ঘনতরল স্যুপ থেকে একাধিক জৈবরাসায়নিক অণুজীবের গঠনের উপর যুগপৎ নির্ভর করেনি বরং একটা বিশেষ অণুজীব প্রাণ সৃষ্টির সর্বকাজের কাজি। ২০০০ সালে আরএনএ তত্ত্বের সমর্থনে এক নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গেল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবরসায়নের অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ সুদীর্ঘ ৩০ বছর ধরে জীবন্ত কোষে অণুজীবের গঠন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন। ১৯৯০ সালে তিনি রাইবোজোমের গঠনপ্রণালী খুঁজে দেখার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। প্রকৃত ঘটনা হলো প্রাণের প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্ম আরএনএ নির্ভর করে গড়ে উঠেছে এবং আরএনএ কেন্দ্রিক প্রাণের বিকাশ বেশি গ্রহণযোগ্য।
প্রতিটি জীবন্ত কোষে রাইবোজোম আছে। রাইবোজোম আরএনএ থেকে সংকেত গ্রহণ করতে পারে এবং আরএনএ’র অভ্যন্তরীণ সুতোর-মত জালিকা অ্যামাইনো এসিড একত্রিত করে প্রোটিন সৃষ্টি করতে পারে। প্রাণীদেহের বেশিরভাগ কোষ রাইবোজোম দ্বারা গঠিত। রাইবোজোম কোষের আরএনএ বহনকারী হিসেবে পরিচিত। ২০০০ সালে অধ্যাপক স্টিৎজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদল রাইবোজোমের গঠনের বিশদ চিত্র খুঁজে পেলেন এবং আবিষ্কার করলেন রাইবোজোমের অন্তঃস্থলে অনুঘটকের কাজ করছে আরএনএ।
ভাবতেই কেমন জটিল লাগছে, তাই না? কারণ রাইবোজোম হলো জীবনের ভিত্তিমূল এবং একই সাথে প্রাচীন। যেসব বিজ্ঞানীগণ সমর্থন করতেন প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএন থেকে তাদের আনন্দের আর সীমা নাই। এই অসামান্য আবিষ্কারের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৯ সালে অধ্যাপক টমাস আর্থার স্টিৎজ রসায়নে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। কিন্তু সমস্যা ঘটে যায় অন্যত্র। এই আবিষ্কারের ফলে প্রাণ সৃষ্টির রহস্য আবার পিছনের দিকের সেই তিনটি ধারণার মধ্যে সন্দেহ ঘনীভূত হলো। আসলেই কী দিয়ে প্রাণ সৃষ্টি, কীভাবে সৃষ্টি? আরএনএ থেকে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল এই মতবাদের শুরুতেই দুইটা সমস্যা বিদ্যমান ছিল। আরএনএ কী প্রকৃতপক্ষে নিজে নিজেই প্রাণের সবধরনের ক্রিয়াকর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম? পৃথিবীর প্রথম-যুগে কী প্রথমেই আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল?
বিজ্ঞানীগণ তাদের আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে গবেষণাগারে নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তা আরএনএ সৃষ্টির কাজ শুরু করলেন। ৩০ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পরেও গিলবার্ট প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ দিয়ে এই মতবাদের সমর্থনে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারলেন না। গিলবার্ট পেলেন অণুজীব কিন্তু সেটা প্রাণের সৃষ্টি রহস্য সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেল। যদি প্রাণ সৃষ্টি হয় আরএনএ অণুজীব দিয়ে তাহলে আরএনএ অবশ্যই নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারবে। আরএনএ’কে হতে হবে স্বয়ম্ভূ।
কিন্তু আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না। ডিএনএ’র দ্বারাও একাজ সম্ভব নয়। আরএনএ বা ডিএনএ যাকিছুই বলি না কেন নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে হলে তাদের দরকার বিপুল পরিমাণ এনজাইম এবং অন্যান্য অণুজীব। ১৯৮০ দশকের শেষ দিকে কিছু জীববিজ্ঞানী প্রাণ বিকাশের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন কিছু অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নের সমাধান করতে গবেষণা শুরু করেন। তাদের মতবাদের সমর্থনে তারা নেমে পড়লেন নিজেই নিজের প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এমন আরএনএ’র সন্ধানে।
হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের জীনতত্ত্বের প্রফেসর জ্যাক ইউলিয়াম সোসটাক প্রাণের উৎস সন্ধানে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি রসায়নের প্রতি এত মুগ্ধ ছিলেন যে তার বাড়ির বেইজমেন্টে তার নিজস্ব একটা গবেষণাগার ছিল। তার নিজের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়লেও তিনি একবার রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটান। ফলাফলে যা ঘটেছিল তা ছিল বিস্ময়কর। বিস্ফোরণের ফলে একটা গ্লাসের টিউব তীব্র-বেগে ছুটে গিয়ে ছাদের দেয়ালে গেঁথে গিয়েছিল।
১৯৮০ দশকের শুরুতে সোসটাক প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম হন কীভাবে জীন বুড়িয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারে। তার এই গবেষণার ফলাফল তার জন্য নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছিল। তিনি দেখান আরএনএ এনজাইম কতটা শক্তিশালী হতে পারে। কিন্তু তিনি অতি দ্রুতই টমাস রবার্ট চেক’র আরএনএ এনজাইমের গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। সোসটাক বলেন, “আমি মনে করেছিলাম এনজাইম নিয়ে গবেষণা সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মোটের উপর সম্ভবত আরএনএ নিজেই নিজের প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে।”
১৯৮৮ সালে চেক এক বিশেষ ধরণের আরএনএ ইনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা ক্ষুদ্র আরএনএ মলিকিউল বানাতে পারে এবং এই আরএনএ ১০ নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। সোসটাক গবেষণাগারে নতুন ধরণের আরএনএ ইনজাইম সৃষ্টি করে তার আবিষ্কারকে সমৃদ্ধ করতে গবেষণা শুরু করলেন। সোসটাকের গবেষকদল বিপুল পরিমাণ গবেষণার ফলাফল দৈব-চয়ন পদ্ধতিতে আবার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন কোন ধরণের এনজাইম অনুঘটকের কাজ করে। সেই পরীক্ষাগুলো থেকে আবার পরীক্ষা করলেন। একই পদ্ধতিতে ১০ বার পরীক্ষার পর সোসটাক এমন এক আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যার বিক্রিয়ার অনুঘটক ক্ষমতা সাধারণ প্রাকৃতিক পরিবেশের তুলনায় ৭০লক্ষ গুণ বেশি গতিশীল। তারা দেখালেন আরএনএ এনজাইম প্রকৃত অর্থেই প্রভূত শক্তিশালী কিন্তু তারা নিজেরা নিজেদের আরেকটি অনুরূপ সৃষ্টি করতে পারে না। এমনকি অনুরূপ সৃষ্টির ধারে কাছেও যায় না। সোসটাক যেন অসম্ভবের দেয়ালে আঘাত করলেন।
তারপরে সবচেয়ে বড় সাফল্য এলো ২০০১ সালে অধ্যাপক সোসটাক’র সাবেক শিক্ষার্থী কেমব্রিজের ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির জীব বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড বারটেল’র হাত ধরে। বারটেল আর১৮ নামে আরএনএ এনজাইম সৃষ্টি করলেন যা বিদ্যমান আরএনএ জালের সাথে নতুন নিউক্লিওটাইড যোগ করতে পারে। অন্যভাবে বলা যেতে পারে এই সাফল্য শুধু আরএনএ’র সাথে যথেচ্ছ নিউক্লিওটাইড সংযুক্তিই নয় বরং পূর্বের পরীক্ষার ফলাফলের যথাযথ প্রতিফলন।
এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের যা কিছু অর্জন তার কিছুই নিজেই নিজের অবিকল কিছু সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু অগ্রগতি প্রায় উদ্দেশ্যের কাছাকাছি চলে এসেছে। আর১৮ ১৮৯টি নিউক্লিওটাইড সুতোর জাল দিয়ে গঠিত এবং এটা নির্ভরযোগ্য-ভাবে আরও ১১টি নিউক্লিওটাইড আগের আরএনএ সুতোর জালের সাথে যুক্ত করতে পারে যা নিজের দৈর্ঘ্যের প্রায় ৬ শতাংশ। নতুন গবেষণা আশা জাগালো জালের কিছু সুতোর প্রান্ত ১৮৯টি নিউক্লিওটাইডের সমান দীর্ঘ। তবে এটা নিশ্চিত হওয়া গেল প্রাণের সৃষ্টি আরএনএ থেকে সূত্রপাত হয়নি।
২০১১ সালে কেমব্রিজের মলিকিউলার বায়োলজি বিভাগে গবেষণাগারে সবচেয়ে সফল পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন ফিলিপ হোলিগার। তার গবেষকদল আর১৮ আরএনএ’র উন্নতি সাধন করেন তার নাম দিলেন টিসি১৯জেড। এই নতুন আরএনএ যেটা নিজেদের ফলাফলের নিউক্লিওটাইড ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিলিপি করতে পারে। তাদের ৪৮ শতাংশ নিজেদের দৈর্ঘ্য যা আর১৮ আরএনএ থেকেও বড় কিন্তু ১০০ শতাংশ সেখানে অত্যাবশ্যকীয় নয়। ক্যালিফোর্নিয়াতে লা জোলা’তে অবস্থিত ‘স্ক্রিপস রিসার্চ ইন্সটিটিউটে’ বিকল্প আর একটা গবেষণা তখন চলছিল জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন’র নেতৃত্বে। ২০০৯ সালে তারা আর একধরণের এনজাইমের সন্ধান পেলেন যারা নিজেদের অগোচরেই নিজেদেরকে অবিকল প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে। নতুন সৃষ্ট এনজাইম দুইটা ক্ষুদ্র আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে দ্বিতীয় আরেকটা এনজাইমের জন্ম দেয়। এই এনজাইম আর দুইটা আরএনএ’র সাথে যুক্ত হয়ে আবার নতুন এনজাইম সৃষ্টি করে। প্রয়োজনীয় উপাদান এবং উপযুক্ত পরিবেশ পেলে এনজাইম সৃষ্টির এই সরল চক্র অনির্দিষ্টকালের জন্য চলতেই থাকে। কিন্তু এনজাইম শুধু তখনই সফলভাবে কাজ করতে পারে যখন তাদেরকে সঠিক আরএনএ সূত্র দেয়া হয়। ঠিক এই পরীক্ষাটাই জেরাল্ড ফ্রান্সিস জয়েস এবং ট্রেসি লিংকন গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দক্ষতার সাথে উপস্থাপন করেন।
অনেক বিজ্ঞানী প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এমন তত্ত্বে সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলেন কারণ আরএনএ নিজেই নিজের আর একটা অবিকল প্রতিলিপি সৃষ্টি করতে পারে না এবং এটাই এই তত্ত্বের প্রধান দুর্বলতা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আরএনএ থেকে জীবনের সূচনা হয়নি। সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল সেখান থেকেই প্রাণের সৃষ্টি। প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে আরও দুর্বল হয়ে পড়ে যখন রসায়নবিজ্ঞানগণ পারস্পারিক সম্পর্কহীন বিচ্ছিন্ন কোন বস্তু থেকে আরএনএ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। ডিএনএ’র তুলনায় অণুজীবকে মনে হল অনেক সাধারণ কিন্তু আরএনএ সৃষ্টি করা ভীষণ কঠিন এবং শ্রমসাধ্য কাজ। সমস্যা দেখা দিলো কোষের শর্করা উৎপাদন করতে গিয়ে এবং যার উপর ভিত্তি করে নিউক্লিওটাইড সৃষ্টি হয় সেখানে বিস্তর ঝামেলা। কোষের এই দুইটা অপরিহার্য উপাদান আলাদা আলাদা উৎপাদন করা সম্ভব কিন্তু এই দুইটা উপাদানের মাঝে কোনভাবেই সংযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সমস্যা ১৯৯০ দশকের শুরুতেই পরিষ্কার জানা গিয়েছিল সুতরাং অনেক বিজ্ঞানীই নাকসিটকিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছে আরএনএ থেকে এই তত্ত্ব শুধুই নিরেট ধারণা মাত্র, বাস্তবের সাথে লেশমাত্র সম্পর্ক নাই। তত্ত্বটা মোটেও সঠিক নয়।
সম্ভবত নবগঠিত পৃথিবীতে অন্যকোন ধরণের জৈব-কণার উপস্থিতি ছিল যারা আরএনএ থেকে সরল এবং যারা পৃথিবীর আদিম জৈব-কণা ভর্তি ঘন তরল থেকে নিজেদেরকে সংগঠিত করতে পারে এবং নিজেদের অবিকল প্রতিরূপ সৃষ্টি করতে শুরু করে এবং আরএনএ, ডিএনএ এবং অন্যান্য উপাদান সৃষ্টির দিকে ধাবিত করে।
ডেনমার্কের কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পিটার নিলসেন ১৯৯১ সালে দাবী করলেন জীবনের সূচনা সেই আদিম পুকুরের ঘন তরল থেকে। যেখানে অণুজীব নিজের প্রতিলিপি নিজেই সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এটা ছিল বিস্তর বিবর্তিত ডিএনএ। পিটার নিলসেন পূর্বের বিজ্ঞানীদের গবেষণার উপর ভিত্তি করেই এগিয়ে গেলেন নতুন উদ্যমে এবং স্থির থাকলেন ডিএনএ’র মধ্যে প্রাপ্ত এ, টি, সি এবং জি এনজাইমে। নিলসেন অণুজীব গবেষণার মূল ভিত্তি গড়ে দিলেন এবং ডিএনএ’র ভিতরে শর্করার পরিবর্তে পলিএমাইডস অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান পেলেন। তিনি নতুন প্রাপ্ত অণুজীবের নাম দিলেন পলিএমাইডস নিউক্লিক এসিড সংক্ষেপে পিএনএ। যদিও বিভ্রান্তিকরভাবে আমরা এখনো পিএনএ’কে জানি পেপটাইড নিউক্লিক এসিড নামে। আরএনএ’র পিএনএ গঠন এত দুঃসাধ্য নয়, সম্ভবত পৃথিবীর আদিম অবস্থায় পিএনএ গঠিত হয়েছিল।
পিএনএ প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, একে সৃষ্টি করতে হয় এবং আচরণ অনেকাংশে ডিএনএ’র মত। পিএনএ’র সুতার মতো একটা প্রান্ত ডিএনএ’র একটা প্রান্ত দখল করে নিতে পারে। অণুজীবের এই মিলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রে খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তদুপরি পিএনএ, ডিএনএ’র মত দুইটা প্রান্ত পেঁচিয়ে মইয়ের আকার ধারণ করতে পারে। স্ট্যানলি মিলার এখানেই আমাদেরকে মুগ্ধ করে এবং প্রাণ সৃষ্টির রহস্য জগতে কৌতূহলী করে তোলে। তিনি প্রাণের বিকাশ হয়ে আরএনএ থেকে এই তত্ত্বের ঘোরতর অবিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ধারণা করেছিলেন প্রথম প্রাণের উপাদান সৃষ্টিতে পিএনএ বরং অনেক বেশী বিশ্বাসযোগ্য এবং যুক্তিপূর্ণ দাবীদার।
২০০০ সালে স্ট্যানলি মিলার আরও শক্তিশালী প্রমাণ উপস্থাপন করলেন। ইতিমধ্যে তিনি ৭০ বছরের অভিজ্ঞতায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু বিধি বাম, সেই সময়ে তিনি পরপর কয়েকটি ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন ফলে তাকে গবেষণা ছেড়ে নার্সিং হোমে চলে যেতে হয়। তার কাজ আর সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। মিলার তার সেই ক্লাসিকাল ‘স্ট্যানলি মিলার-হ্যারল্ড উরে পরীক্ষা’ পুনরায় করে দেখেন যে পরীক্ষার কথা আমরা ইতিমধ্যেই প্রথম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। এবারের পরীক্ষায় মিলার মিথেন, নাইট্রোজেন, অ্যামোনিয়া, পানির সাথে পিএনএ যুক্ত করে দিলেন।
অন্যান্য রসায়নবিদগণ প্রাণ গবেষণায় এগিয়ে এলেন তাদের নিজস্ব বিকল্প নিউক্লিক এসিড এবং তাদের তত্ত্ব ও গবেষণালব্ধ জ্ঞান নিয়ে। প্রতিটি বিকল্প নিউক্লিক এসিড ব্যবহারের পিছনে ভিন্ন ভিন্ন সমর্থক বিজ্ঞানীদলের বিশেষ করে যারা এই এসিডের উদ্ভাবন করেছেন তাদের পৃথক যুক্তি আছে। ২০০০ সালে আলবার্ট ইসেনমসার কৃত্রিম জেনেটিক পলিমার ‘থ্রেওস নিউক্লিক এসিড’ উদ্ভাবন করেন। থ্রেওস নিউক্লিক এসিড বা টিএনএ মূলত ডিএনএ কিন্তু এর রাইবোজোমে ভিন্ন ধরণের শর্করা আছে। টিএনএ রাইবোজোমের সুতোর প্রান্ত দুইটা দ্বিমুখী কুণ্ডলী বানাতে পারে এবং আরএনএ এবং টিএনএ’র মাঝে পূর্বাপর তথ্যের অবিকল প্রতিলিপি আদান প্রদান করতে পারে। এছাড়াও টিএনএ জটিলতর ভাজে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারে এবং প্রোটিন সংরক্ষণ করতে পারে। এথেকেই বোঝা যায় টিএনএ আরএনএ’র মতই এনজাইমের কাজ করতে পারে। একইভাবে ২০০৫ সালে এরিক মেগারস গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে গ্লাইকল নিউক্লিক এসিড উৎপাদন করলেন যেগুলো প্যাঁচানো কাঠামো তৈরি করতে পারে। এতক্ষণ যতগুলো নিউক্লিক এসিড নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাদের কোনটিই প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টি হয়েছে গবেষণাগারে। সুতরাং যদি প্রথম প্রাণ এইসব নিউক্লিক এসিডের মধ্য থেকে কোন একটিকে ব্যবহার করে থাকে তাহলে বলতেই হবে এতদিনের চলমান বিতর্ক চলে যাবে আরএনএ এবং ডিএনএ’র পক্ষে অর্থাৎ প্রাণের যাত্রা শুরু হয়েছিল আরএনএ এবং ডিএনএ দিয়ে। এই মতবাদ হয়ত সত্য, কিন্তু বিজ্ঞানীদের হাতে এই দাবীর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ নেই।
আর এইসব কিছুর অর্থ দাঁড়ালো, ২০০০ শতকের মাঝামাঝি উপনীত হয়ে আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণ প্রচণ্ড দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন। আরএনএ মতবাদের বিজ্ঞানীগণের চিন্তা, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা পদ্ধতি, পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ খুব যৌক্তিক এবং গোছানো পরিপাটি কিন্তু প্রাণের উৎস সম্পর্কে পুরোপুরি সত্যের কাছে পৌঁছাতে পারেননি।
অন্যদিকে আরএনএ এনজাইম প্রকৃতিতেই বিদ্যমান ছিল এবং সুসংবাদ হলো সেই এনজাইমে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জৈবিক উপাদান রাইবোজোমের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এমন কোন আরএনএ’র সন্ধান পাওয়া গেল না যে নিজেই নিজের অনুরূপ প্রতিলিপি তৈরি করতে পারে এবং কোন বিজ্ঞানীই প্রমাণ করতে পারলেন না যে আদিম ঘন তরল স্যুপ থেকে কীভাবে আরএনএ সৃষ্টি হয়েছিল। বিকল্প নিউক্লিক এসিড হয়ত পরবর্তী প্রশ্নের সমাধান দিতে সক্ষম কিন্তু হতাশার খবর এই যে, প্রাণের এইসব প্রাথমিক উপাদানগুলো প্রকৃতিতে আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল তার কোন নির্ভুল প্রমাণ বিজ্ঞানীগণের হাতে নেই। ঠিক সেই সময়ে ১৯৮০ দশক থেকে আরএনএ মদবাদের বিরোধী আর একটি মতবাদ ধীরেধীরে তাদের যুক্তির স্বপক্ষে প্রমাণ যোগার করতে ব্যস্ত ছিল। নতুন মতবাদে বিশ্বাসী বিজ্ঞানীগণ যুক্তি দেখাতে লাগলেন জীবন আরএনএ বা ডিএনএ বা অন্যকোন বংশগতির বস্তু থেকেও নয় বরং জীবন সৃষ্টি হয়েছিল শক্তির যান্ত্রিক কৌশল ত্বরান্বিত করে। কারণ জীবনকে বেঁচে থাকতে হলে দরকার শক্তি।
চলবে……..
ধন্যবাদ, অনেক কিছু জানলাম
অনেক কিছুই শিখলাম
অত্যন্ত সহজ ভাষায় অনুবাদ। ধন্যবাদ প্রাঞ্জলতা রাখার জন্য।
অনেক কিছু জানলাম । ধন্যবাদ ।
অনুবাদটি অনায়াসে পড়তে পড়তে পারা গেল. কঠিন একটা কাজ এমন সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের জন্য ধন্যবাদ।