[প্রথম পর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের পরিসংখ্যান দিয়ে একটা ভূমিকা তৈরি করতে চেয়েছিলাম, যে ধর্ষণ মানব সমাজে সর্বত্র বিস্তৃত। এই পর্বে আসুন আরেকটু কাছের বিষয় নিয়ে কথা বলা যাক — আমাদের সমাজে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নিপীড়ন এবং ধর্ষণকামী মানসিকতাগুলো একটু খতিয়ে দেখা যাক; তাহলে হয়ত এর পরের পর্বে ধর্ষণ বিষয়ক সামাজিক, বৈজ্ঞানিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিতর্কগুলো নিয়ে আলোচনা করতে সুবিধা হবে।]
———————————————————————————————————
দুদিন আগে, আমার বাড়িতে এক দুর্ধষ ডাকাতি হয়ে গেল। ডাকাতরা বন্দুক হাতে সদর দরজা ভেঙ্গে ঢুকে বাড়ির সবকিছু লুটপাট করে নিয়ে গেল। এক সময় বাধা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে এখন আমি হাসপাতালে। গতকাল ওরা ফোন করে হুমকি দিয়েছে যে ওদের কাছে নাকি আমার বাসার পুরো ডাকাতিটা ভিডিও করা আছে, আমি আগামী ৩ দিনের মধ্যে ব্যাংকের সমস্ত টাকা ওদের হাতে তুলে না দিলে ওরা সেই ভিডিও বাজারে ছেড়ে দিয়ে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করবে।
হাসছেন?
ভাবছেন, সশস্ত্র এবং সহিংস ডাকাতি তো করেইছে তার উপরে আবার ভিডিও করে, সেটার সাক্ষী রেখে দিয়ে, উল্টো আপনাকেই হুমকি দিচ্ছে — এটা আবার কোন উজবুকে করে? ওই ভিডিও ছাড়ার সাথে সাথেই তো ওরা গ্রেফতার হয়ে জেলের ঘানি টানবে! ঠিক ধরেছেন, পৃথিবীর এমন কোন সমাজ বোধ হয় নেই যেখানে ডাকাতির শিকার হওয়ার জন্য এবং গুলিবিদ্ধ হওয়ার জন্য আমার সম্মানহানি হবে বা উল্টো আমাকেই ব্ল্যাকমেইল করা হবে বা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে।
কিন্তু আমরা কি হেসেছিলাম যখন পত্রিকায় পড়েছিলাম যে বনানীর ধর্ষণের মামলার মেয়ে দুটোকে একমাস ধরে ঠিক এই হুমকিই দেওয়া হচ্ছিল? খবরে বলছে, “ধর্ষণ মামলার দুই আসামি সাফাত ও নাঈম বনানীতে দুই তরুণীকে ধর্ষণের ঘটনাটি ভিডিও করেছিল ধর্ষকরা। এরপর ভিডিও প্রকাশ করে দেওয়ার হুমকি দিয়ে আসছিল তারা” (১)।
আমাদের কী একবারও মনে হয়েছিল যে এটা আবার কিভাবে সম্ভব? না হয়নি — কারণ আমরা জানি যে এটাই বাস্তবতা, এটাই ‘নর্মাল’ — আমাদের সমাজে ধর্ষিত হওয়াটা যেমন ধর্ষিতার জন্য ‘লজ্জাকর’ ঠিক তেমনি সেটা প্রকাশ হয়ে যাওয়াটাও ধর্ষকের জন্য নয় বরং ধর্ষিতা এবং তার পুরো পরিবারের জন্য ‘সম্মানহানিকর’ — কোন ‘ভাল মেয়ে’ তো ধর্ষিত হয়না!
ধর্ষণ পৃথিবীর একমাত্র অপরাধ যেখানে অপরাধের শিকারই উল্টো অপরাধীতে পরিণত হয়।
একবার ধর্ষিত হওয়ার পরও কিন্তু মুক্তি নেই — বাকি জীবনটা ধরেই যেন ‘ধর্ষিত’ হতে থাকতে হবে আপনাকে — প্রথমবার একজন পুরুষের হাতে, তারপর ধর্ষণ শুরু হয় পরিবারের হাতে, সমাজের হাতে, বিচার চাইতে গেলে পুলিশের হাতে, ডাক্তারের হাতে, রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার হাতে … ধর্ষণ যেন দান্তের নরকে প্রবেশের ওয়ান ওয়ে টিকেট, আত্মহত্যা না করলে আমরণ হেঁটে যতে হবে সেই নরকের প্রতিটি স্তরের মধ্য দিয়ে। তাই পৃথিবীর এই জলজ্যান্ত নরক থেকে মুক্তির আশায় অনেক ধর্ষিত মেয়েই আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হন।
ধর্ষণ জানাজানি হয়ে গেলে ধর্ষিত মেয়েটিকেই প্রথমে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয় — সে কি ‘খারাপ’ কাপড় পড়েছিল? সে কি ঢলানি মেয়ে? সে কি অনেক দূর এগিয়ে ছেলেটিকে প্রলোভিত করে তারপর পিছিয়ে গেছে — পুরুষকে প্রশ্রয় দিলে যে এরকম হবে সেটা কি সে জানতো না? সে কি ‘খারাপ’ মেয়ে? কম ‘বেশ্যা’ নাকি বেশী ‘বেশ্যা’? রাতের বেলা সে কেন বাড়ি থেকে বেরুল? একা একা কেন ছেলেটার সাথে দেখা করতে গেল? মেয়ে হয়ে এত রাতে হোটেলে গেল কোন সাহসে? কোন ভাল মেয়ে কি এভাবে ছেলেদের বাসায় চলে যায়? সে কি টাকা পয়সার লোভে বা প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা জন্য ছেলেটিকে ফাঁসাচ্ছে?
পত্রপত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্ষণ নিয়ে লেখাগুলোর নিচে কমেন্টগুলো পড়ে দেখেছেন কখনো? মন্তব্যদাতাদের অনেকেই দিব্যি ধর্ষণের পক্ষে ‘অকাট্য’ যুক্তি তুলে ধরেন — মেয়েরা এরকম বেলেল্লাপনা বন্ধ না করলে ধর্ষণ বন্ধ হবে না, মেয়েরা এভাবে স্বাধীনভাবে যত্রতত্র ঘোরাঘুরি করলে তো ধর্ষণ ঘটবেই, মেয়েদের কাপড়চোপড় শালীন না হলে পুরুষেরা তো প্রলুব্ধ হবেই …। যে সমাজে তেঁতুল হুজুরদের কথায় লাখ লাখ পুরুষ রাস্তায় নামে, যারা নারীশিক্ষা বন্ধ করার পক্ষে থাকে, নারী-পুরুষের একসঙ্গে কাজ করার বিরোধিতা করে, নারীদের দাবিয়ে রাখতে ধর্মঘট হুমকি ধামকি এবং দাবী জানায়, সেই তেতুল হুজুররাই আবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানিত অতিথি হয়ে এক টেবিলে বসে সফল বৈঠক করতে পারে। এমন সমাজে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করাই অন্যায়ই বটে। তারপরও আশা করে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
ধর্ষক যদি বিত্তশালী বা প্রভাবশালী হয় তাহলে তো কথাই নেই। হুমকি ধামকি চলতে থাকবে ঘটনাটাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য। কদিন আগের খবরে দেখলাম মেলান্দহ উপজেলার মাহমুদপুর ইউনিয়নের পাঁচপয়লা গ্রামের হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরী অভিযোগ করেছেন যে, ছেলেটি বিয়ের কথা বলে তাকে একাধিকবার ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে হারুন টালবাহানা শুরু করে। গ্রামের লোকজন বিষয়টি জানলেও হারুন প্রভাবশালী হওয়ায় কেউ এ বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস করেনি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর ওই কিশোরী ছেলেসন্তান জন্ম দিলে তার দিনমজুর পরিবার বিচার চেয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে যান। বিচার তো হয়ইনি, পুলিশ মামলা নেয়নি; উল্টো মেয়েটিকে এবং তার পরিবারকে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য জানিয়েছে যে ধর্ষকের প্রভাবশালী পরিবার থেকে হুমকি-ধামকি দেওয়ার কারণে ব্যাপারটা মীমাংসা করা সম্ভব হচ্ছে না।
সমাজের চাপে ধর্ষকের সাথেই মেয়েটির বিয়ের ব্যবস্থা করার ঘটনাও ঘটে অহরহ। এই ব্যাপারটা আসলে কতখানি অমানবিক চিন্তা করে দেখুন। যে লোকটা আপনাকে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষণ করল তাকেই ডেকে এনে আবার তার হাতে আপনার জীবনটা সঁপে দেওয়া হল। ধরুন উপরে দেওয়া উদাহরণের ওই ডাকাতের দলটাকে মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম “আচ্ছা বাবারা, ডাকাতি যখন করেইছ এবার তাহলে আমার নিরাপত্তার ভারটাও তুমিই নাও।” শুনলাম এবছর দেশে বাল্য বিবাহের বয়স কমিয়ে, বিশেষ পরিস্থিতিতে, নাবালিকা মেয়ের বিয়ের অনুমতি দেওয়ার পেছনে নাকি এটাও একটা বড় কারণ।
এই পর্বত প্রমান বাধা ডিঙ্গিয়ে আপনি যদি পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন তাহলেও রক্ষা নেই। হয় পুলিশ টাকা খেয়ে বা ধর্ষকের প্রভাবের দৌলতে উল্টে ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে অথবা উল্টো মহাদরদী হয়ে আপনাকে বোঝাবে যে এটা নিয়ে হইচই হলে আপনারই ক্ষতি, সমাজে আপনার নিজের এবং পরিবারের লজ্জার সীমা পরিসীমা থাকবেনা। বনানীর ওই ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুলিশ নাকি মামলা নিতেই গড়িমসি করে দুই দিন পার করে দিয়েছিল! সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে আজকাল এরকম কিছু ঘটনার কথা জানাজানি হয়ে গেলে পুলিশ বাধ্য হচ্ছে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু কটা ধর্ষণের ঘটনাই আসলে এ পর্যন্ত গড়ায় আর দেশের কয়টা মেয়েই বা সোশ্যাল মিডিয়ায় জানানোর সুযোগ বা সাহস পায়?
এই সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আপনি যদি মামলা করতে সক্ষমও হন, তারপরেই বিচারের নামে শুরু হবে চিকিৎসা এবং বিচার বিভাগীয় অপমানযজ্ঞ। আপনাকে এবার যেতে হবে পুরুষের দ্বারা নির্ধারিত এবং নিয়ন্ত্রিত, বর্বর, মধ্যযুগয়ীয় দুই আঙ্গুলের পরীক্ষা বা টু ফিঙ্গার টেস্টের মধ্য দিয়ে। আবার, সব হাসপাতালে মহিলা ডাক্তার না থাকার কারণে নাকি পুরুষ ডাক্তার এবং ওয়ার্ডবয়রাই এই পরীক্ষাটা সেরে ফেলেন!
২০১৩ সালের প্রথম আলোর একটি প্রতিবেদন বলছে, “ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে কোনো নারী চিকিৎসক, কোনো নারী নার্স এমনকি কোনো আয়াও নেই। এমনকি নারীর শারীরিক পরীক্ষার জন্য কোনো পৃথক কক্ষও নেই। চিকিৎসকদের বসার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি টেবিল রাখা। পুরুষ চিকিৎসক পুরুষ ওয়ার্ডবয়ের সাহায্যে সেই টেবিলের ওপর ধর্ষণের শিকার নারীকে রেখে তাঁর পরিধেয় কাপড় খুলে শারীরিক পরীক্ষা করেন। সবুজবাগ থানার এসআই বিকাশ কুমার ঘোষ আদালতের নির্দেশে বয়স নির্ধারণের জন্য একটি মেয়েকে ফরেনসিক বিভাগে আনলে খোলা বারান্দার টেবিলের ওপর পুরুষ ওয়ার্ডবয় আগত নারীটির কাপড় খুলতে শুরু করলেই তিনি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।”
বেশীরভাগ সভ্য দেশ থেকেই এই ভিত্তিহীন অসভ্য পরীক্ষাটি উঠিয়ে দেওয়া হলেও বাংলাদেশে এখনো এটা বাতিল হয়নি। ২০১৩ সালে, বাংলাদেশের কয়েকটি নারী আন্দোলন ও মানবাধিকার সংস্থা মিলে এই পদ্ধতির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন হাইকোর্টে। যতদূর জানি, ৪ বছর হয়ে গেলেও এ নিয়ে এখনো কোন রায় দেওয়া হয়নি। জগন্নাথ কলেজের নৃ-বিজ্ঞানের শিক্ষক ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা এ নিয়ে গবেষণা করেছেন, ওনার মুখ থেকেই শোনা যাক, কী এই দুই আঙ্গুলের পরীক্ষা। ফাতেমা সুলতানা ও জোবাইদা নাসরীন প্রথম আলোতে লিখেন,
“ … টু ফিঙ্গার টেস্ট ধর্ষণের সারভাইভার নারীর যোনিপথের ঘনত্ব পরিমাপ করে, তার হাইমেনের (সতীচ্ছদ) উপস্থিতি-অনুপস্থিতি নির্দিষ্ট করে। চিকিৎসাপদ্ধতি অনুযায়ী পরীক্ষার সময় নারীর হাইমেনকে একটি গোলাকার ঘড়ির ফ্রেম হিসেবে দেখা হয়। ঘড়ির কাঁটার ৩ বা ১০-এর অবস্থানে যদি ধর্ষিতার হাইমেন ছেঁড়া থাকে, তবে চিকিৎসক ধরে নেন, এখানে জোরাজুরি বা অসম্মতির সেক্স হয়নি। আর যদি হাইমেন নিচের দিকে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার ৫ অথবা ৮-এর দিকে ছিঁড়ে, তবে চিকিৎসক এটা ঘোষণা করেন যে এই হাইমেন ছেঁড়ায় জোরারোপ করা হয়েছে।
পাশাপাশি টু ফিঙ্গার টেস্টে ব্যবহৃত চিকিৎসকের হাতের আঙুল তাঁর শরীরের আকার, গড়ন ইত্যাদির ভেদে ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। ফলে এই ভীষণ সাবজেকটিভ পরীক্ষণপদ্ধতি কখনোই নারী শরীরের ভিন্নতর গঠন বাস্তবতাকে নির্ণয় করার কোনো ক্ষমতা রাখে না। মেডিকেল পরীক্ষার সময় ধরেই নেওয়া হয় যে ধর্ষণ হতে পারে রাতের আঁধারে, অস্ত্রের মুখে, অচেনা মানুষ কর্তৃক এবং ‘হাইমেন অক্ষত থাকা’ সমাজের ‘কুমারী’ নারীর সঙ্গে, যা কিনা নিচের দিকে, নতুন করে হাইমেন ছিঁড়লে এবং যোনিপথ শক্তপোক্ত হলেই কেবল ঘটতে পারে।”
একজন সদ্য ধর্ষিতা নারীর জন্য এটা কতখানি নিষ্ঠুর সেটা যদি বাদও দেই তাহলেও পরীক্ষাটার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন না তুলে উপায় নেই। অর্থাৎ যে নারীর আগে এই পর্দা ছিঁড়েছে সে কি ধর্ষিত হতে পারে না? শুধুমাত্র কুমারী সতী সবিত্রীরাই ধর্ষিত হলে বিচার পাবে? লেখকদ্বয় তাদের লেখায় সঠিকভাবেই উল্লেখ করেছেন যে,
“যে নারীর হাইমেন আগে ছিঁড়েছে, সে যে কারণেই হোক মেডিকেল এভিডেন্স তার প্রসঙ্গে ‘হাইমেন ওল্ড রেপচার’, ‘হেবিচুয়েট টু সেক্স’ এই বিশেষণগুলো ব্যবহার করবে। আর কোর্টে মেডিকেল পরীক্ষার এই ওল্ড রেপচার, হেবিচুয়েট টু সেক্স বিশেষণগুলো নারীর পূর্বেকার যৌন ইতিহাসের বয়ান হাজির করে, বিচারকক্ষে ধরে নেওয়া হয়, নারীটি আগেও যৌনকাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে তার ‘সতীত্ব’ নেই, পুরুষালি আইনি পরিসর ধর্ষকের তরফ থেকে নারীর ধর্ষণকেন্দ্রিক অসম্মতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়।”
আসুন আগে একটু খতিয়ে দেখে নেই, এই সতীচ্ছদ বা সতীত্ব-পর্দাটা আসলে কী, এর গঠন কিরকম, সব মেয়ের সতীচ্ছদ কি একইরকম থাকে কিনা এবং দুই আঙ্গুলের মাধ্যমে ধর্ষিত নারীর সতীচ্ছদ পরীক্ষাটার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কী।
অতীতে বহু সমাজেই নারীর সতীত্ব নির্ধারিত হতো এই অক্ষত সতীচ্ছদের অস্তিত্ব দিয়ে, এই দুই আঙ্গুলের পরীক্ষা থেকে বোঝা যায় সেটাই আমাদের সামাজে এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে। আমাদের সমাজে আগের মতোই এখনো অনেকেরই এই ভুল ধারণাটা আছে যে, এই পাতলা পর্দাটি যোনির মুখের পুরোটা ঢেকে রাখে এবং প্রথম যৌন সঙ্গমের সময় সেটি টান লেগে ছিঁড়ে যায়।
যোনির মুখে বা কিছুটা ভিতরে অবস্থিত একটি পাতলা পর্দা যা দিয়ে যোনির মুখটা আংশিকভাবে ঢাকা থাকে তাকেই বলে সতীচ্ছদ। প্রত্যেকের যেমন চোখ কান নাকের গঠন ভিন্ন ঠিক তেমনি প্রত্যেকের শরীরের সতীচ্ছদের গঠনও ভিন্ন, এমনকি কারো কারো জন্ম থেকেই সতীচ্ছদ থাকে না (৩)। আর যাদের থাকে তাদের কারো কারো ক্ষেত্রে প্রথম যৌন সঙ্গমের সময় এটা ছিঁড়ে গিয়ে রক্তপাত হলেও অনেকেরই আবার তা নাও হতে পারে। কারণ যেভাবে ভাবা হয়, সেভাবে আদৌ এই পর্দাটি দিয়ে যোনির মুখ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে না। বেশিভাগ ক্ষেত্রেই এর মধ্যে এক বা একাধিক ছিদ্র থাকে, একেক জনের একেক ভাবে। নিচের ছবিতে দেখুন, যোনির মুখের গঠন এবং সতীচ্ছদের গঠন কত রকমের হতে পারে, এখানে গাঢ় রং দিয়ে যোনির ছিদ্রগুলো দেখানো হয়েছে।
ছবিঃ সতীচ্ছদ (৭)
(এখানে ধূসর রঙ দিয়ে যোনির ছিদ্র দেখানো হয়েছে, এবং বিভিন্ন রেখাগুলো দিয়ে যোনির বহির্ভাগের বিভিন্ন স্তর দেখানো হয়েছে। একেবারে ভিতরের রেখাটি দিয়ে সতীচ্ছদের সীমানা বুঝানো হচ্ছে।)
শুধু তাই না, এই পলকা ধরনের পর্দাটা যৌন সঙ্গম ছাড়া আরও অনেকভাবে, খেলাধুলো, জিমন্যাস্টিক, সাইকেল চালানো, আঘাত, এমনকি ট্যাম্পনের ব্যবহার থেকেও, টান লেগে ছিঁড়ে যেতে পারে। আরেকটি ব্যাপার নিয়ে আমরা কখনো কথা বলি না — আমাদের দেশে ট্যাবু হলেও এটা ওপেন সিক্রেট যে বয়ঃসন্ধি থেকেই ছেলেরা স্বমেহন করে থাকে। এটা ছেলেদের জন্য যতটা প্রাকৃতিক বা প্রাসঙ্গিক মেয়েদের জন্যও ততটাই। তাহলে মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বমেহন কেন অকল্পনীয় একটা ব্যাপার হবে? স্বমেহনের সময়েও তো এই সতীচ্ছদ ছিঁড়ে যেতে পারে!
যে সতীচ্ছদ নিয়ে এত কাহিনি, যার সাথে একটা মেয়ের বিয়ে, সংসার, জীবন এমনকি ধর্ষিত হলে তার বিচার পর্যন্ত জড়িত সেইটা আসলে একটা পলকা ধরনের পর্দা জাতীয় বিবর্তনীয় ঝড়তি-পড়তি ছাড়া কিছু না! ভ্রূণে থাকা অবস্থায় যখন আমাদের যৌনাঙ্গ তৈরি হয় তারই এক অবশেষ হিসেবে এই পর্দাটি থেকে যায় — জন্মের পর আমাদের দেহে এই পর্দাটির আর কোন কাজ থাকেনা। মানব সমাজের চরম অজ্ঞতা এবং অশিক্ষা দেখে যেমন হাসি লাগে তেমনি প্রচণ্ড রাগ হয় এটা ভেবে যে এরকম একটা উদ্ভট এবং হাস্যকর জিনিসকে কেন্দ্র করে যুগ যুগ ধরে মানুষ ‘সতীত্বে’র বেসাতি খুলে বসেছে, আর তার জন্য বন্ধক রাখা হচ্ছে হাজার হাজার নারীর জীবন।
এখনো বিবাহ বিচ্ছেদ এমনকি ‘অনার কিলিং’ হয় বিভিন্ন সমাজে কোন মেয়ের সতীত্ব না থাকার দায়ে। ইউরোপে, আমেরিকায় এখনো নাকি মায়েরা ডাক্তারের কাছে মেয়েকে নিয়ে আসে সতীচ্ছদ ঠিক আছে কিনা সেটা পরীক্ষা করানোর জন্য, আবার কোন কোন জায়গায় নাকি এখনো মেয়েরা ডাক্তারের কাছে গিয়ে অপারেশন করে সতীচ্ছদ ঠিকভাবে বসিয়ে নেয় (৩)।
২০০৯ সালে সুইডিশ সেক্সুয়াল রাইটস গ্রুপ নাকি হাইমেনের নাম বদলে একে ‘ভ্যাজাইনাল কোরোনা’ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যাতে করে সমাজ থেকে ধীরে ধীরে এ ধরনের নারী নিপীড়নমূলক ধারণাগুলো দূরীভূত হয়। তারা এক বক্তব্যে বলেছে — অনেক হয়েছে, এই হাইমেনকে যুগে যুগে নারীদের পাপিষ্ঠতা এবং নিষ্কলুষতার বাউন্ডারি হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, আর এই উদ্ভট একটা ধারণার কারণে মেয়েরা অনেক মূল্য দিয়েছে, এবার এটা বন্ধ হওয়া দরকার (৪)।
তাহলে, দেখলাম যে সতীচ্ছদ এবং সতীচ্ছদের পরীক্ষা দিয়ে কোনভাবেই প্রমাণ করা যায় না একটি মেয়ে ধর্ষিত হয়েছে কি না। এবার আসি আসল প্রশ্নে। একটি মেয়ে যৌনভাবে সক্রিয় কি সক্রিয় নয় তার সাথে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে তাকে ধর্ষণ করার কী সম্পর্ক সেটা কি কেউ বলতে পারেন? কোন মেয়ে যদি বিবাহিত না হয় এবং যৌনভাবে সক্রিয় হয় তাহলে কি তাকে ধর্ষণ করা জায়েজ হয়ে যাবে? সমাজ কি তাহলে সেই অনুমতিই দিচ্ছে? যদি তা না হয় তাহলে এই পরীক্ষাটির উদ্দেশ্য এবং কার্যকারিতা কি প্রথমেই নাকচ হয়ে যাচ্ছে না? এ কারণেই পৃথিবীর বেশীরভাগ উন্নত দেশে দীর্ঘ নারী আন্দোলনের ফলস্বরূপ এই পরীক্ষা তো দূরের কথা আদালতে ধর্ষিতার প্রাক্তন যৌন জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
একটু কষ্ট করে খুঁজলেই দেখতে পাবেন যে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বা জীববিজ্ঞানে সতীচ্ছদের সাথে মেয়েদের যৌন সক্রিয়তার কোন সম্পর্ক স্থাপন করা হয়নি। অথচ এই অবৈজ্ঞানিক এবং অমানবিক নিয়মটাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছে ধর্ষণের মত এতবড় একটা অপরাধের পরীক্ষা হিসেবে। আমার তো মনে হয় এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সতীত্ব জিনিসটাকে এতটাই ‘পবিত্র’ হিসাবে দেখা হতো যে এই সতীচ্ছদ পরীক্ষার অকার্যকারিতার কথা জেনেও পুরুষেরা এটা টিকিয়ে রেখেছে ‘ফিয়ার ফ্যাক্টর’ বা আতঙ্ক তৈরির উপাদান/উপায় হিসেবে — পুরুষেরা তো ধর্ষন করবেই, করতে চাইবেই, সেটা তো তাদের প্রাকৃতিক দুর্বলতা, সেখানে কী করার আছে? মেয়ে হিসেবে তুই যদি সদা সাবধান না থাকিস, নিজেকে পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচিয়ে ঘরে লুকিয়ে না থাকিস তাহলে তুইই খারাপ মেয়ে। ধর্ষিত হলে দোষ তো তোরই, তুই খারাপ মেয়ে বলেই তো পুরুষটা তোকে ধর্ষণের সুযোগ পেল। তাই যেভাবেই হোক না কেন ধর্ষিত হলে মেয়েটাকেই দোষী প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে – দরকার হলে সে জন্য সবচেয়ে কিম্ভূতকিমাকার, অযৌক্তিক, হাস্যকর পদ্ধতির আশ্রয় নিতে আমরা দ্বিধা করবনা। এখনো এই দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় – এ ধরণের দুই আঙ্গুলের পরীক্ষাগুলো দিয়ে ধর্ষিতের চেয়ে বরং ধর্ষকের প্রতিই যেন পক্ষপাত দেখানো হয়।
ঐতিহাসিকভাবে, বেশিরভাগ সমাজেই সতীত্বকে এক ‘মহামূল্য’ সম্পদ বলে গণ্য করা হয়ে এসেছে। স্ত্রীরা তার স্বামীকে বিয়ের রাতে এই মহামূল্যবান উপহার দিয়ে নিজেরা ধন্য হতো। বাবার সম্পত্তি মেয়েটাকে ‘বিশুদ্ধভাবে’ কুমারী অবস্থায় স্বামীর হাতে তুলে দেওয়াটাই নিয়ম। সম্পত্তি ঠিকঠাকভাবে এক পুরুষ থেকে আরেক পুরুষে হস্তান্তরের নিয়ম এটাই। পুরুষের বংশের ধারা বিশুদ্ধ রেখে উত্তরাধিকার নিশ্চিত করার এর চেয়ে নিরাপদ উপায় আর কী হতে পারে? প্রাচ্য থেকে প্রতীচ্য যেখানেই যান না কেন বেশিরভাগ সমাজেই এই পুরুষতান্ত্রিক নিয়মটার তেমন কোন হেরফের দেখবেন না। সতীত্ব পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সৃষ্ট একটি হাতিয়ার যা দিয়ে মূলত মেয়েদের যৌনতাকে এবং একজন মানুষ হিসেবে তার স্বাধীনতাকে শৃংখলিত করা হয়েছে।
এই পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রতিফলনই দেখা যায় পুরাণে, মহাকাব্যে, ধর্মগ্রন্থগুলোতেও। সীতার জীবন দিয়ে সতীত্ব পরীক্ষা দেওয়ার কাছে তো এই দুই আঙ্গুলের পরীক্ষাকে ডালভাতের মতো মনে হওয়ার কথা। শুধু রামায়ণই নয়, মহাভারত কিংবা গ্রিক ও রোমান পুরাণগুলোতে পুরুষের মহত্ব, বীরত্ব, এবং নারীর সতীত্বের কাহিনীর অভাব নেই। আব্রাহামিক ধর্মগুলোতেও এই সতীত্বের জয়জয়কার। যিশুকে জন্ম দান করা হয়েছে ভার্জিন এক নারীর জরায়ুতে। মধ্যযুগে ইউরোপে ক্যাথলিকদের মধ্যে আত্মার বিশুদ্ধতার ধারাবাহিকতায় সতীত্বের বিশুদ্ধতাকেও পবিত্র বলে গণ্য করা হতো। কোরান পুরুষদের মৃত্যুর পরেও বঞ্চিত করেনি — ধার্মিকের জন্য সবচেয়ে লোভনীয় উপহার হিসেবে বেহেস্তে ৭২ টা ভার্জিন হুরী পাওয়ার অঙ্গীকার করা আছে সেখানে। এখনো আফ্রিকার বিভিন্ন সমাজে এইচআইভি রোগীদের মধ্যে নাকি প্রচলিত আছে যে কোন কুমারী মেয়ের সাথে যৌন সঙ্গম করতে পারলে তার রোগমুক্তি হবে। এর ফলে অনেক ছোট ছোট মেয়ে এইচআইভি রোগীদের হাতে ধর্ষণের শিকার হয়।
যে সমাজে সতীত্বের এত দোহাই সে সমাজেই আবার সারাক্ষণ মেয়েদের উত্যক্ত করাটা সাধারণ নিয়মের মধ্যে পড়ে। আমাদের সমাজে পুরুষদের মানসিকতাটা হচ্ছে — একজন নারী হিসেবে তুমি যদি আমার সম্পত্তি হও অর্থাৎ মা, বোন, মেয়ে হও তাহলে আমি তোমাকে আগলে রাখবে, নিরাপত্তা দেব। কিন্তু সমাজের বাকি সব মেয়ে এজমালি সম্পত্তি, তাদের পিছনে লাগা যাবে ইচ্ছামত, উত্যক্ত করা যাবে, হয়রানি করা যাবে, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া যাবে, এমনকি ধর্ষণও করা যাবে।
এই যৌন হয়রানির বিষয়টা নিয়ে কথা না বললে আলোচনাটা হয়ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে। আমাদের সমাজে মনে হয় এমন কোন মেয়ে নেই যে প্রতিনিয়ত ঘর থেকে বেরুলেই যৌন হয়রানির শিকার হয় না। শিষ, টিটকারি, টিজিং, ভিড়ের মধ্যে অশ্লীলভাবে যেখানে সেখানে গায়ে হাত — এগুলোতো নিত্য ঘটনা। তসলিমা নাসরিন সেই কবে তার নির্বাচিত কলামে হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। সেখান থেকে কি একটুও এগিয়েছি আমরা?
আমাদের দেশের ছেলেরা কি জানে যে অযাচিত মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া বা গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা, অযাচিত বা অবাঞ্ছিতভাবে কোন মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকাটাই যৌন হয়রানির আওতায় পড়ে? তাহলে ভেবে দেখুন আমাদের সমাজে অহরহ যা ঘটছে সেগুলো কোন ধরনের অন্যায়ের পর্যায়ে পড়বে।
আমি ছোটবেলায় ঢাকায় যে পাড়ায় বড় হয়েছিলাম সেখানে আমরা বহু বছর ধরেই ছিলাম। কিন্তু তাতে কী? রিক্সা বা গাড়ি করে যখনি রাস্তায় ঢুকতাম পাড়ার ছেলেগুলোই কোন না কোন মন্তব্য ছুঁড়ে দিত। অনেক দূর থেকে ওদের দেখেই চোখ ফিরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকতাম, শুনেও না শোনার ভান করতাম। খুব বাড়াবাড়ি করলে আমার মা আবার ওইসব মিন্টু বা মাসুম ‘ভাইদের’ ডেকে এনে বুঝাতেন যে একই পাড়ার ছেলে হয়ে এরকম করা কি ঠিক? অথচ এই ছেলেগুলোই আমাদের বড় ভাই বা বন্ধুর মতো হতে পারতো। এরকম অভিজ্ঞতা কম বেশি সব মেয়েরই আছে।
আমরা কলেজের এক স্যারের কাছে জীববিজ্ঞানের প্রাইভেট কোচিং করতে যেতাম। তিনি সুযোগ পেলেই আমাদের এক বান্ধবীর গায়ে বিশ্রীভাবে হাত দিতেন। সে নিজে তো সবসময় ভয়ে ভয়ে দূরে সরে থাকতোই আমরাও ওকে সেই স্যারের কাছ থেকে যতদূর সম্ভব সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। নিজেদের মধ্যে এ নিয়ে কথা বললেও কোনদিন কাউকে এই ব্যাপারটা নিয়ে অভিযোগ করার কথা মনে আসেনি। মনে আছে, ভিড়ের মধ্যে একটা মার্কেটে এক ছেলে আমার খুব কাছের একজন বান্ধবীর স্তন এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে সে বহুদিন নিজের শরীর থেকে সেই নোংরা অনুভূতিটা দূর করতে পারেনি।
আরেকটা ঘটনার কথা বলি। অভি ছাড়া আর কাউকে এ ঘটনাটা বলেছি বলে মনে পড়ে না। তখন আমার বয়স ২০-২১ এর মতো, একদিন খুব ভিড়ের মধ্যে দোতলা বাসে উঠেছি। বেশি দূর আগাতে পারলাম না, বাসের দরজার কাছাকাছিই একদম স্যান্ডুইচ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পরেই বুঝলাম, পিছনের লোকটা ধাক্কাধাক্কি করে নিজের শরীরের সামনের দিকটা আমার শরীরের পিছনের সাথে চেপে ধরে দাঁড়াল। অস্বস্তি হতে লাগল, ঘাড় ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম, পুরো চেহারাটা দেখতে না পেলেও বুঝলাম মধ্য বয়স্ক একজন লোক। তারপর লোকটি তার পুরুষাঙ্গ দিয়ে আমার পিছনে চাপ দিতে শুরু করল।
আমি সাধারণত খুব একটা ভয় পাওয়ার মানুষ নই, কিন্তু সেদিন আমিও ভয়ে, অস্বস্তিতে নিথর হয়ে গেলাম। নড়ার চেষ্টা করলাম — কিন্তু ডানে বাঁয়ে সামনে পেছনে এক চুল নড়ার জায়গা নেই। পিছন থেকে লোকটি ক্রমাগতভাবে তার পুরুষাঙ্গ ঘষে যাচ্ছে আমার শরীরে। নিজেকে এত নোংরা আর কোনদিন লেগেছে বলে মনে পড়ে না। চিৎকার করার কথা মনেও আসেনি। জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে সারাক্ষণ প্রতিবাদের ঝড় তুললেও এখানে এসে আমার সব প্রতিবাদ যেন হিম হয়ে গেল। এত সুবিধাপ্রাপ্ত একটা শ্রেণীতে বড় হয়েও ছোটবেলা থেকে সমাজ জুড়ে পুরুষতন্ত্রের যে রূপ আমি দেখে এসেছি সেখানে এত মানুষের মধ্যে যে চিৎকার করে বিচার চাওয়া যায় সেটাই আমার মাথায় আসেনি।
মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ওখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, যদিও আমি নিশ্চিত সেটা কয়েক মিনিটের বেশি ছিল না। বাসটা পরের স্টপে থামল, আমি আমার শরীরের সমস্ত শক্তি আহরণ করে হিস্টেরিয়ার রোগীর মতো সবাইকে ধাক্কাটাক্কা দিয়ে নেমে পড়লাম। নামার পর খেয়াল করলাম আমার কাপড়ের পিছন দিকের ভেজা অংশটা — চরম নোংরা, ঘৃণা এবং অসহায়ত্বের সেই অনুভূতি আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি।
আমাদের সমাজে হয়ত এমন একটা মেয়েও নেই যে কম বা বেশি এধরনের কোন যৌন হয়রানির সম্মুখীন হয়নি। প্রতিদিন এভাবে হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হতে থাকলে কার না মনোবল ভেঙ্গে যায়, কার না মনে ভীতির সঞ্চার হয়? তারপরও দেখুন, কোটি কোটি নারী এই ভার কাঁধে নিয়েই প্রতিদিন ঘরের বাইরে বেরাচ্ছেন, সমাজের অচলায়তন ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন। ভেবে দেখুন, যে সমাজে মেয়েরা ঘর থেকে বেরুলেই অহরহ যৌন হয়রানির শিকার হয়, যে সমাজে সারাক্ষণ এরকম ধর্ষণকামী মনোভঙ্গীকে সহ্য করা হয়, সে সমাজে সুযোগ থাকলে, প্রভাব খাটাতে পারলে অহরহ ধর্ষণও যে ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক।
তাহলে এর প্রতিকার কী?
গত কয়েক দশকের নারী অগ্রগতির সবটুকু জলাঞ্জলি দিয়ে, তেঁতুল হুজুরদের আদেশকে শিরোধার্য করে আমরা আবার ঘরে ফিরে যাব? সেটা তো আর সম্ভব না। গত কয়েক দশকে নারীদের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে অগ্রগতি ঘটেছে সেটা থেকে তো পিছু হটতে রাজি না আমরা। লাখ লাখ তেঁতুল হুজুর রাস্তায় নেমে মার্চ করলেও সেটা যেমন আর হবে না, তেমনি নিত্য যৌন হয়রানি এবং ধর্ষণ দিয়েও আর এই সামনে আগানোকে আটকানো যাবে না।
তাহলে তো আমাদের হাতে, নারী, পুরুষ সবার হাতে একটাই উপায় খোলা থাকে। সমাজের এই সিস্টেমেটিক যৌন হয়রানি, নির্যাতন এবং ধর্ষণের অভয়ারণ্য থেকে বের হতে হবে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। নারীকে পুরুষের সমান হিসেবে ভাবতে শিখতে হবে, সমমর্যাদার মানুষ হিসেবে সম্মান করতে শিখতে হবে। কিন্তু সেটা কী ভাবে সম্ভব? হাজার হাজার বছরের মজ্জাগত এই পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে বের হবার উপায় কী?
আজকে আমরা জানি যে, ধর্ষণকে সমাজে যতটা বিরল মনে করা হয় ব্যাপারটা আদৌ তা নয়। ১৯৭৫ সালে আমেরিকায় নারীবাদী লেখক সুজান ব্রাউনমিলার ‘Against Our Will’ নামে ধর্ষণের উপর একটা বই লেখেন। আমাদের দেশে অনেকেই এই বইটির কথা জানেন, কারণ বইটিতে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণধর্ষণের বিষয়টি বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, এই বইটির পরেই ধর্ষণ সম্পর্কে পৃথিবীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে। ধর্ষণ যে সমাজে সর্ব-বিস্তৃত সেটা নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে এ নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা, বিতর্ক, গবেষণার সূত্রপাতও নাকি সেখান থেকেই।
এছাড়া ষাট এবং সত্তর দশকের উত্তাল নারী আন্দোলনগুলোও এ বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল — এই কয়েক দশকে ইউরোপ আমেরিকায় বহু পুরনো পিতৃতান্ত্রিক আইন বদলেছে, নারীদের বাসায়, বাইরে, কাজে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আইন প্রণীত হয়েছে। কিন্তু তারপরও এই দেশগুলোতেও ধর্ষণের মাত্রা দেখলে বুঝি যে এখনো আমাদের কতদূর যাওয়া বাকি! কিন্তু আবার হার্ভি ওয়াইনস্টিনের ধর্ষণের ঘটনা উন্মোচিত হওয়ার পর যেভাবে শত শত মেয়ে এগিয়ে এসে জোর গলায় নিজের ধর্ষণের কাহিনী বলে এর বিচার চাচ্ছেন তাতে আশাণ্বিত না হয়ে উপায় থাকে না। আমাদের দেশেও সাদিয়া এবং রথীরা যখন প্রকাশ্যে ধর্ষণের বিচার চেয়ে যুদ্ধে নামেন, হাজারো হুমকিকে তোয়াক্কা না করে পুলিশকে বাধ্য করেন মামলা নিতে তখন মনে হয় পথটা কঠিন হলেও হয়ত অসম্ভব নয়।
এটা যেমন সত্যি যে আমাদের সমাজে ধর্ষন এবং যৌন হয়রানির মাত্রা অত্যন্ত বেশি তেমনি এটাও সত্যি যে সব ছেলেই সুযোগ পেলেই ধর্ষকে বা নিপীড়কে পরিণত হয় না। বৈশাখী মেলায় দল বেধে একদল ছেলে যেমন মেয়েদের নির্লজ্জভাবে আক্রমণ করে তেমনি আবার কেউ কেউ এগিয়ে আসেন তাদের রক্ষা করার জন্য। সব পুরুষ যে ধর্ষণ করতে পারে না সেটা আমরা জানি। বিবর্তনীয় মনোবিদ্যার অন্যতম বিশেষজ্ঞ, ডেভিড বাস তার ‘Evolutionary Psychology, the new Science of the Mind’ বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে তার বইতে দেখিয়েছেন যে ধরা পড়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না থাকলেও ৩৫% পুরুষ ধর্ষণ তো দূরের কথা কখনই কোন নারীর সাথে জোর করে কিছু করবে না। আর বেশিরভাগ পুরুষও কিছুটা আগালেও ধর্ষণ পর্যন্ত হয়ত যাবে না (৬)। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায় যে ধর্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অনেক পুরুষও শরিক হবেন তাতে কোন সন্দেহই নেই। নারীদের সাথে সাথে পুরুষেরাও এর বিরুদ্ধে সোচ্চার না হলে সমাজের এত বড় একটা ব্যাধি সারানো সম্ভব নয়। আজকে নারী এবং পুরুষ সবার এ নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা দরকার, লেখালেখি করা, আলোচনা করা দরকার, শিক্ষা কারিকুলামে যৌন শিক্ষা যোগ করার জন্য বা দুই আঙ্গুল পরীক্ষার মতো অমানবিক ব্যাপারগুলো বন্ধ করার জন্য চাপ দেওয়া দরকার, নারী অধিকার রক্ষার আইন প্রণয়নের জন্য দাবি জানানো দরকার, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন ধর্ষকদের দৃষ্টান্তস্বরূপ বিচারের জন্য আন্দোলন করা দরকার — পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র সচেতনতা তৈরি করা দরকার।
শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন ‘বুদ্ধি আর আবেগের সমন্বয়ই কবিতার উৎস’ — শুধু কবিতাই নয়, এ দুটোর সমন্বয় না ঘটলে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই অর্জন করা সম্ভব হয় না, আর সেই সাথে দরকার সক্রিয় উদ্যোগেরও। তাই আসুন আমরা আমাদের সমাজে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা, যৌন হয়রানি, নির্যাতন, ধর্ষণের মতো বিশ্রী এবং ভয়ঙ্কর এই রোগগুলো নিয়ে শুধু আবেগ দিয়ে চিন্তা না করে, তাতে সক্রিয় প্রতিবাদ এবং বুদ্ধিবৃত্তির সমন্বয় ঘটাই এবং এ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে উদ্যোগী হই। তাহলেই হয়ত একদিন এগুলো বন্ধ করা সম্ভব হবে।
[এর পরের পর্বে ধর্ষণ বিষয়ে নারীবাদী এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের বহুদিনের বিতর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু করার ইচ্ছা রইল]
তথ্যসূত্রঃ
১) http://www.banglatribune.com/others/news/204599/
২) http://www.prothom-alo.com/opinion/article/60544/
৩) http://www.bwhbc.org/health-info/what-exactly-is-a-hymen/
4) http://www.bwhbc.org/health-info/renaming-the-hymen-vaginal-corona/
৫) Bernau,Anke, 2007, Virgins: A Cultural History; Granta UK
৬) Buss, David, 2016, Evolutionary Psychology: The New Science of the Mind; Pearson Education, Inc
৭) https://en.wikipedia.org/wiki/Hymen#/media/File:Hymen_en.svg
চলবে…
@বন্যা আহমেদ
ধন্যবাদ এই প্রবের জন্যে। আমি যেভাবে বুঝেছি, এই পর্বে মোটামুটি ভাবে চারটি বড় বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেনঃ
১ – নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং পুরুষের প্রতিক্রিয়া
২ – সতীত্ব ধারণা
৩ – ধর্ষণের আলামত পরীক্ষা করার পদ্ধতি, এবং
৪ – সবশেষে ধর্ষণ প্রতিরোধে কি করা উচিৎ এবং এতে পুরুষের ভুমিকাও যে গুরুত্বপূর্ণ সেটা লিখেছেন।
কোনও সন্দেহ নেই, খুব তথ্যনির্ভর লেখা হয়েছে। কিন্তু পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়েছে, আপনি হয়তো লেখাটির কাঠামোটা আরো উন্নত করতে পারেন। অর্থাৎ, আপনি যদি বিষয় বা পয়েন্টগুলোকে আলাদা অংশে উপস্থাপন করতে পারেন, তাহলে হয়তো খুব সুনির্দিষ্ট ভাবে সমস্যা ও তার সম্ভাব্য সমাধানের পথ নিয়ে আরো সুনির্দিষ্ট ভাবনা ও আলোচনার উদ্রেক করতে পারে।
সতীত্ব ধারণাটি আপনি ব্যাখ্যা করেছেন তবে তা সতীচ্ছদের আলোচনার সাথে মিশে গেছে। সম্ভবত ধর্ষণ নিয়ে লেখা বলেই সতীত্ব বিষয়টির সাথে সতিচ্ছদ এবং টু ফিঙ্গার টেস্ট ইত্যাদি একসাথে আলোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে কয়েকটি বিষয় বলা দরকারঃ
১ – সারা দুনিয়াতেই ধর্ষণ প্রমান করার জন্যে কিছু বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স দরকার হয়। আমাদের দেশে কথিত “টু ফিঙ্গার টেস্ট” কিন্তু সেই বায়োলজিক্যাল এভিডেন্স সংগ্রহের একটা পথ, যদিও প্রাচীন, আদিম, অবৈজ্ঞানিক। কিন্তু এর বিকল্প কি? এবং সেই বিকল্পর কথা কে বলবে? এই বিকল্পগুলোতো শুধু মেডিক্যাল সিদ্ধান্ত নয়, আইনী সিদ্ধান্তও বটে। সভ্য বিশ্বে ধর্ষণের ঘটনা কিভাবে ইনভেস্টিগেইট করা হবে তার “টুলকিট” বা গাইডলাইন আছে, যা এই বিষয়ের এক্সপার্টরা মিলে তৈরী করেন এবং সংসদে বসে আইনপ্রনেতারা পাস করেন। সেটা বছর বছর রিভিউ হয় এবং আপডেইট হয়। আমার সামান্য জ্ঞানে আমি জানি এই সকল টুলকিট বা প্রক্রিয়াগুলোকে হতে হয় খুব সিম্পল, সাশ্রয়ী এবং মানবিক। যদি সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের দেশে ধর্ষণ এর মেডিক্যাল ও লিগ্যাল ইনভেস্টিগেশনের প্রক্রিয়া গুলো কি কি বা কেমন তার একটা সম্পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা যেতে পারে এবং তারপরে আলোচনা করা যেতে পারে তার যথার্থতা নিয়ে।আমি জানি এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু একটা পুরনাঙ্গ বিতর্ক, আলোচনা হয়নি। সেক্ষেত্রে আপনার লেখার ও আলোচনার সূত্র ধরে দেশের নারীবাদী ও নারীমুক্তি আন্দোলনের সংগঠনগুলোর একটা ভিত্তি তৈরী হতে পারে আইন প্রনেতাদের সাথে বাহাস করার। যারা আইন তৈরী করেন যারা তাঁদের তো বুঝতে হবে। নারীবাদী ও নারী অধিকার সংগঠনের সাথে এই বিকল্প গুলো নিয়ে আমাদের আইন প্রণেতাদের কোনও বিতর্ক, বোঝাপড়া, বাহাস কোনোদিন দেখেছি বলে মনে পড়েনা। টু ফিঙ্গার টেস্ট এর বদলে নারীর পোশাকের কিছু সামান্য পরীক্ষাও ধর্ষককে ধরিয়ে দিতে পারে অনায়াসেই, কেননা, ধর্ষক তার সকল আলামত রেখে যায় তার প্রাথমিক আক্রমণের সময়েই। এই কথাটা তো বলা দরকার, চিৎকার করে, কান ফাটানো চিৎকার করে।
২ – আমরা জানি সতীত্ব ধারণাটির কোনও বায়োলজিক্যাল ভিত্তি নেই, সেই আলোচনাটি ভিন্ন। ধর্ষণের সাথে তার প্রাসঙ্গিকতা আছে, ধর্ষণ পরবর্তী সময়ের সামাজিক কলংক বা সোশ্যাল স্টিগমা বিষয়ক আলচনায় সতীত্ব নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা জরুরী। সম্ভব হলে আগামী পর্বে সতীত্ব বিষয়টি আরেকটু ব্যাখ্যা করতে পারেন, এর সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিনির্মাণ নিয়ে।“সতীত্ব” ধারণাটিই সম্ভবত সবচাইতে কম সমালোচিত, সবচাইতে কম চ্যালেঞ্জড একটি পিতৃতান্ত্রিক বিনির্মাণ। অথচ এই “সতীত্ব” ধারণাটিই সারা দুনিয়াতে নারীর বন্দিত্ব’র সবচাইতে উঁচু ও শক্ত দেয়াল। বস্তুত, সতীত্ব ধারণাটি নারীর উপরে পুরুষের মালিকানার প্রশ্ন। শুধু যে ধর্ষিত হলেই নারী সতীত্ব হারায় তাতো নয়, নারী প্রেম করলে সতীত্ব হারায়, প্রেম হারালেও সতীত্ব হারায়, নতুন করে প্রেমে পড়লেও সতীত্ব হারায়, ডিভোর্সড নারীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠ্ বিবাহিত নারীর সতীত্ব নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। অর্থাৎ যখন কোনও একজন নারী তার জন্যে সমাজ নির্ধারিত পুরুষের মালিকানা থেকে বেরিয়ে যায় বা অন্য পুরুষের দ্বারা অধিকৃত হয়, বা নারীর যখন কোনও পুরুষের দ্বারাই অধিকৃত হতে চায়না, তখন মনে করা হয় নারীটি আর “সতী” নয়। সতীত্ব ধারণাটি ১০০% একটি পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক বিনির্মাণ। তাই সতীত্ব ধারণাটি শুধু নারীকে নয় এমন কি পুরুষকেও বাধ্য করে ধর্ষণের ঘটনা চেপে যেতে। তাই ধর্ষণের শিকার নারীর পিতা, স্বামী, মা, বোন সকলেরই অবস্থান হচ্ছে আগে “সতীত্ব” রক্ষা করা, ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি ভালোবাসা, মমত্ব ও সহানুভূতি দিয়ে তাকে জীবনে ফিরিয়ে আনা নয়। সতীত্ব ধারণার প্রতি চ্যালেঞ্জ করার কাজটি পুরুষের “মালিকানা” কে চ্যালেঞ্জ করেই করতে হবে। সেই কাজটি আমাদের দেশে, সমাজে কোনোদিনই হয়নি। ধর্ষণ প্রতিরোধের এটাও একটা দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রাম। আগামীতে এই বিষয়ে আপনার মতামত জানার আগ্রহ রইলো।
৩ – আপনি এই পর্বেও সুইডেনের উদাহরণ দিয়েছেন, যদিও খুব সংক্ষেপে। সুইডেনের যৌনশিক্ষা বিষয়ক জাতীয় পরিষদ, “হাইমেন” বা সতীচ্ছদের নাম পরিবর্তন করেছে, এর নাম এখন “ভ্যাজাইনাল করোনা”। কিন্তু বিষয়টি আসলে শুধু নাম পরিবর্তন নয়, বিষয়টি হচ্ছে, “Deconstruction of existing concept on sexuality ” মূলত সুইডেন যা করছে, তা হচ্ছে শুধু সতীত্ব নিয়ে নয়, সমগ্র যৌনতার ধারনাটিকেই পালটে দিতে চাচ্ছে সুইডেন। যৌনতার ধারনাকে পালটে দেবার জন্যে আমাদের কে কি কি করতে হবে? প্রথমত অস্তিত্বমান যৌনতার ধারণাটিকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে তারপর ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে হবে এবং তারপরে আবার নতুন করে এক নতুন যৌনতার সংজ্ঞা তৈরী করতে হবে।
আমরা কিভাবে আমাদের যৌনতার ধারণার অস্তিত্বমান সৌধটিকে চ্যালেঞ্জ করবো? আমরা যদি একে চ্যালেঞ্জ করতে পারি, পাল্টাতে পারি, তাহলে বাসের ভিড়ে কোনও পুরুষ তার পাশে দাঁড়ানো সহযাত্রী নারীর শরীরের স্পর্শে, তার নিজের যৌন হরমোনের কাছে আর পরাস্ত হবেন না।
অনেক ধন্যবাদ আপনার সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য, এ ধরণের মন্তব্যগুলো এই সিরিজটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে।
১) যতদূর বুঝতে পারছি খবরের কাগজ থেকে, ‘টু ফিঙ্গার টেস্ট’ পরীক্ষা পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত জানতে চেয়েছে হাইকোর্ট, তারা ৫ জন্য চিকিৎসকের নামও নির্ধারণ করে দিয়েছেন এ ব্যাপারে মতামত দেওয়ার জন্য। অর্থাৎ ে বিষয়টা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে দেশে। আমি নিজে এ ব্যাপারে কোন বিশেষজ্ঞ নই, তাই এর অলনেটিভ হিসেবে কী আসা উচিত সেটা নিয়ে কথা বলতে চাইনি। আশা করছি দেশের বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন। এর সাথে বিভিন্ন নারীবাদী সংস্থা এবগ আইনজীবীরাও যুক্ত আছেন।
২) আপনি ঠিক ধরেছেন আমি এই চারটি বিষয় নিয়েই আলোচনা করেছি। তবে এর মধ্যে সতীত্বের অংশটুকু নিয়ে আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না, প্রসাঙ্গিকভাবে এই লেখায় কতটুকু আনলে ঠিক হয় সেটা নিয়ে বেশ দ্বিধান্বিত ছিলাম। তবে এ নিয়ে যে বিস্তারিত আলোচনা করা জরুরী সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এর পরের পর্বে পিতৃতন্ত্র নিয়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছে আছে, দেখি সেখানে কতটুকু আনা যায় সতীত্বের বিষয়টি।
৩) যৌনতার সার্বিক ধারণাটা বদলানোর কাজে সুইডেনের যৌনশিক্ষা বিষয়ক জাতীয় পরিষদের ভূমিকার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য ধন্যবাদ। আপনার আপত্তি না থাকলে আমি এই অংশটি আমার লেখার ভিতর যুক্ত করে দিতে চাই।
পিতৃতন্ত্র, নারীর উপর পুরুষের “মালিকানা”, সমাজে নারীর অবস্থান এবং যৌনতার ধারণা, নারীর যৌনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা – এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ছাড়া ধর্ষণের আলোচনা সম্পূর্ণ হতে পারেনা। আবারো ধন্যবাদ বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসার জন্য। আশা করছি ভবিষ্যতে এগুলো নিয়ে আপনার সাথে আরও আলোচনা হবে।
আপনাকেও ধন্যবাদ। নিশ্চয়ই, যুক্ত করে দিন।
ধর্ষণ পরবর্তী প্রসেসগুলো সবই খুবই অমানবিক, ধর্ষণের মেডিকেল টেস্ট ( ২ আঙ্গুল পরীক্ষা তো রীতিমত অবৈজ্ঞানিক) আর এরপর আইনি জটিলতা। এমনকি যেসব দেশের আপাতভাবে আইনের শাসন আছে সেখানেও পুরো প্রক্রিয়া খুবই অমানবিক। মার্টিন স্কোরসিসের Cape Fear সিনেমায় রবার্ট ডি নিরো এক নারী আইনজীবীকে ধর্ষণ করেছিল। খুবই আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই নারী আইনজীবী শেষ পর্যন্ত কোন মামলা করল না। কারণটা এই সংলাপের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ঃ
I think that this guy, beat and raped her, because he knew that she wouldn’t testify, that she wouldn’t press charges. Because she knows, the system. I mean, she works in it. She knows that she’d be on trial. the system’s slow, and skeptical. It’s pathetic, even.
এবং ট্রায়ালে যাওয়া মানেই মেয়েটার অতীত, যৌন সম্পর্ক নিয়ে চূড়ান্ত চুলচেরা বিশ্লেষণ হবে, আর সেটা হবে জনসম্মুখে! আর নিজের যৌন জীবন নিয়ে জনসম্মুখে যাওয়ার চেয়ে আতঙ্কের আর কি থাকতে পারে? এই আতঙ্ক নিয়ে অনেকেই তাই শেষ পর্যন্ত আর আইনি লড়াইএ যেতে চায় না, আর এটা হচ্ছে স্বয়ং প্রথম বিশ্বেই। আর বাংলাদেশের মত জায়গায় তো ধর্ষিত হওয়া পাপ, আর এর পর আত্মহত্যা করে নিজের মানসিক সতীত্ব প্রমাণ দিতে না পারলে সেটা মহাপাপ।
এক্ষেত্রে ধর্ম তো আরেক কাঠি সরেস। ইসলামী আইনে ৪ জন সাক্ষী যোগাড় করতে হবে, ওমুক সময়ে তমুক জায়গায় পরিবারের পুরুষ সদস্য ব্যতীত কেন উপস্থিত ছিল তার জন্য উপযুক্ত ব্যাখ্যা যোগাড় করতে হবে। যেন কোন মেয়েকে সুবিধা মত পেয়ে ধর্ষণ করা একতা ছেলের ন্যাচারাল ইন্সটিঙ্কটের মধ্যেই পড়ে!! এটা তো পুরুষ জাতির জন্যও অপমানজনক, তাই না? চিন্তা করুন বাংলাদেশ বা আরব বিশ্বে একটা মেয়ে এই বিশ্বাস নিয়ে বড় হচ্ছে যে পুরুষ মাত্রই পোটেনশিয়াল রেপিস্ট এবং সেই রেপিস্টের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা না করতে না পারা তার নিজেরই ব্যররথতা!
হিন্দু আইন বলে কিছু না থাকলেও যৌন নির্যাতনে মেয়েদেরকেই সামাজিকভাবে দোষারোপ করা হয়, সতীত্বের পরীক্ষা শুধু মেয়েদের দিতে হয়, আর পুরুষদের কোন কলঙ্ক হয় না!!
Spotlight সিনেমাতে বোস্টন শহরকেন্দ্রিক গীর্জার ফাদারদের বিশাল এই যৌন কেলেঙ্কারি ফাঁস করার দুর্দান্ত ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বোস্টনের যে কার্ডিনাল সাহেব কয়েক দশক ধরে এই যৌন নির্যাতন সম্পর্কে জানত, এবং জেনেও এগুলো প্রশ্রয় দিয়েচজে, সব কিছু জানাজানি হওয়ার পর সে নিয়োগ পেয়েছে স্বয়ং ভ্যাটিকানে, ক্যাথলিক চার্চ সিস্টেমের খুবই উঁচু পদে!!! এবং সেটা হয়েছে এই একুশ শতকে এসে! ধর্ম এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যে কত শক্তভাবে ধর্ষক ও যৌন নির্যাতকদের লালন পালন করে সেটার আরেকটা উদাহরণ এটা!
ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। ঠিক বলেছেন, আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের মামলা করা পর একটা মেয়েকে যে ঝক্কি পোহাতে হয় সেটা চিন্তা করেই অনেকে আর আগানোর সাহস করেনা। ওয়াইন্সটিনই নাকি এক্স-মোসাদ এজেন্টদের ভাড়া করেছিল তার বিরুদ্ধে রিপোর্টটা আটকে দেওয়ার জন্য। এমনকি অনেক ভিক্টিমকে ভয়ভীতি দেখিয়েছে, হয়রানিও করেছে। এখানেই যদি এটা সম্ভব হয় তাহলে দেশে কী হতে পারে সেটা তো বোঝাই যায়।
আমাদের দেশে পারিবারিক আইনের জন্য ধর্মীয় আইন অনুসরণ করলেও ধর্ষণের ক্ষেত্রে কিন্তু তা করা হয়না, তাই ৪ জন সাক্ষী লাগেনা, বা অন্য কোন ধর্মীয় আইনও এখানে প্রযোজ্য নয়। তবে সামজিক নিয়ম কানুন, বাঁধা, ট্যাবগুলো নিয়ে আরও বেশী করে কথা বলা দরকার।
আর চার্চের পেডোফিলিয়া নিয়ে কথা আর নাইবা বললাম। এটা যে কী করে এই শতাব্দীতে এসে মানুষ সহ্য করে সেটা ভাবলেই অবাক লাগে। তবে আমাদের দেশেও কিন্তু অনেক ছেলে বয়স্ক পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়। এই ব্যাপারে আমরা অন্ধ হয়ে থাকার ভান করলেও ব্যাপারটা আসলে তেমন আনকমন নয়। এটা নিয়েও ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছে রইল। আবারো ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।
অন্যায়ের ধরণ পশুর মত। পশুর যৌনাকাঙ্খা জাগলে ওরা খুব একটা বাছবিচার করে না। মানুষ এমন আচরণ করবে কেন? অন্তত মানবাধিকারে সভ্য উন্নত দেশগুলোতে কেউ এই রকমের অস্বস্তিকর বা নোংরা ভাবে তাকালেই তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা যায়। অফিস, আদালত, চাকরির বা কাজের জায়গায় কিংবা সামাজিক ভাবে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনা যায়, শাস্তি হয় আইন মোতাবেক। এজন্য তুলনামূলক হারের এত ব্যবধান। বাংলাদেশে শুধু আধুনিক আইন করলেই হবে না, এর কঠিন প্রয়োগ করতে হবে। তার আগে প্রতিটি অফিস, আদালত, চাকরির বা কাজের জায়গায় কিংবা সামাজিক ভাবে এর বিচার চাওয়াটা জন্য প্রশিক্ষণ দিতে হবে, জানাতে হবে আচরণভঙ্গি কি হয় দরকার। সহজ করতে হবে সবটুকু।
সেটাই তো ঘটছে। শক্ত আইন তো নেই’ই সেই সাথে আছে ধর্মের সমর্থন। এইগুলো নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে। যে দেশে দেশের প্রধান চাকুরের সমালোচনা করাটাই বেআইনি সেখানে কি আশা করা যাবে? নাগরিক জনগণ যাদেরকে দেশ চালাতে চাকুরী দিয়েছে তারা নাগরিক অধিকারকে পদদলিত করে দেশ চালাচ্ছে অথচ তাদের চাকরি যাচ্ছে না। কোন কথাও বলা যাবে না সেই সব বেতনভুক কাজের মানুষদের বিরুদ্ধে। বললেই জেল জরিমানা হয়রানি খুন। এখানে কদ্দুর কি হবে বলা মুশকিল।
উপরের অন্যায়গুলিতে সমাজ ও শাসক জড়িত।
খেয়াল করে দেখবার ব্যাপার হলো যে, এই সব জঘন্য মানসিকতার পুরুষদের কিন্তু আবার সামাজিক মানসম্মান বোধ খুবই প্রখর। যারা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা যদি সমাজকে বলে দেয় যে কারা হয়রানি করছে তা’হলে জোকের মুখে নুন পড়তে পারে। নাগরিক উদ্যোগে বদমাশগুলোর একটা তালিকা’র জন্ম দেওয়া যাক। সেখানে ওদের নাম উঠিয়ে দিয়ে হবে। নিরাপত্তার কারনে নিজের নাম গোপন করে হলেও, ধর্ষক ও যৌন নিপীড়কগুলির নামের তালিকা তৈরী করা খুই দরকার। পাল্টা সামাজিক বিচারটা শুরু অন্তত হোক।
খুবই আন্তরিক, অত্যন্ত খোলামেলা ট্যাবু ভাঙার সত্যিকারের একটা শক্তিশালী তথ্যপূর্ণ উপস্থাপনা। খুব ভালো, বন্যা। এই পর্বটাও শক্তিশালী।
কাজিদা, সেক্স অফেন্ডারদের লিস্ট বানানো খুব জরুরী, কিন্তু সেটা আমাদের দেশে কবে সম্ভব হবে জানিনা, দুঃখজনক হলেও এখনো তার আগের কত কিছুই তো করা বাকি! আর উন্নত দেশগুলোতে চোখের সামনে অহরহ যৌন হয়রানি না ঘটলেও টেবিলের তলায় সারাক্ষণই ঘটছে। গত কয়েকমাসের ঘটনাগুলোই তার প্রমাণ। এখানে অভিযোগ বা মামলা করা গেলেও এখনো বেশীরভাগ ভিক্টিমই বিভিন্ন বাঁধার কারণে সেটা করে উঠতে পারেনা। দেখা যাক এবার সেটা কিছুটা হলেও বদলায় কিনা।
অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আশা করছি ভবিষ্যতেও এই সিরিজটার লেখাগুলো নিয়ে আপনাদের সবার কাছ থেকে এরকম মূল্যবান মতামর পাবো।
গুরুত্বপূর্ণ লেখা। এরকমভাবে না লিখলে অনেক কিছু অজানা থেকে যায়। মাত্র ৩৫% পুরুষ জোর করে কিছু করবে না – এই সংখ্যাটা দেখে মনটা খারাপই হল, কারণ আমি ভেবেছিলাম সংখ্যাটা ৫০% এর ওপরে হয়তো হবে। মাত্র এক তৃতীয়াংশ পুরুষের ওপর ভরসা করে নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি দুরূহ ব্যাপার। ছোটবেলা থেকে নারীর শারীরিক ও মানসিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেবার ব্যাপারে সমাজের প্রতিটি স্তরে নারীর ভূমিকাকে তুল ধরার ব্যাপার আছে। তা না হলে একটি রক্ষণশীল সমাজে ছেলেদের কাছে মেয়েরা হয়ে যায় ভিনগ্রহের অধিবাসী, এই অপরিচিতি মেয়েদেরকে শেষ পর্যন্ত হয়তো একটি যৌন পরিচয়ে পর্যবসিত করে। সামনের লেখাগুলোর অপেক্ষায়।
শুধু রক্ষণশীল সমাজেই নয় দীপেনদা এই ৩৫% এর স্ট্যাটিস্টিক পাশ্চাত্যের দেশগুলো থেকে নেওয়া, এখানেও তো অবস্থা ভয়াবহ। তাহলে আমাদের মত দেশগুলোতে আসল চেহারাটা যে কতটা ভয়াবহ কে জানে! তবে এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া দরকার। এখনো এ নিয়ে অনেক ধরনের পরিসংখ্যান দেখা যায়। যেমন দেখলাম, এখানকার কলেজ ক্যাম্পাসে এক তৃতীয়াংশ ছেলেই বলেছে ধরা পড়ার ভয় না থাকলে ওরা অবশ্যই রেপ করবে। পড়েই কেমন গা শিউরে উঠল। আজকে প্রায় ৫-৬ দশক ধরে নারী আন্দোলনের পরেও এই অবস্থা এখানে, ওয়াইন্সটিন আর স্পেসিদের কথা তো মোটে শুনতে শুরু করেছি। এখন তো মনে হচ্ছে সমাজের সর্বত্রই এমনি অবস্থা, খালি খবরগুলো এখনো বেরিয়ে আসছেনা বলে জানতে পারছিনা। তবে কেন যেন মনে হচ্ছে এবার হয়তো কিছু জিনস বদলাবে, দেখা যাক…
আমাদের মত দেশগুলোতে এখনো অনেক কাজ বাকি, আমরা তো এ নিয়ে এখনো তেমনভাবে কথাই বলতে শুরু করিনি – সেটা শুরু করা খুব দরকার।
এর পেছনের কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা হওয়া উচিত, হয়তো হচ্ছেও। নিঃসন্দেহে সব পুরুষ ডমিনিক স্ট্রস-কান বা রাম-রহিম নন। হতে পারে পুরুষদের জিনগত বৈশিষ্ট্যের এক্ষেত্রে কোন ভূমিকা আছে। তবে আমার মনে হয় পুরুষের বেড়ে ওঠার পরিবেশ, শিক্ষা, আদর্শ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এসবের আরও বড় ভূমিকা রয়েছে। আমরা যদি এই ৩৫% পুরুষের ধর্ষণ-বিমুখতার কারণ বুঝতে পারি তাহলে হয়তো তা একদিন ধর্ষণ প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে সাহায্য করবে।
খুব প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলেছেন। এর পরের পর্বে নারীবাদী এবং বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীদের বিতর্ক নিয়ে লিখতে শুরু করার ইচ্ছে আছে, সেখানে এই প্রসঙ্গগুলো নিয়ে আলোচনা করব বিস্তারিতভাবে। ধন্যবাদ।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট উঠে এসেছে। দুটো বিষয় যোগ করি।
যুদ্ধকালীন সময়ে ধর্ষণ কিন্তু রাষ্ট্রীয় দমননীতির অংশ হয়ে পড়ে। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, বসনিয়া -কসোভো, কাশ্মীরের ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এধরণের পরিস্থিতিতে উগ্র-জাতীয়তাবাদ যেন আমাদের মানবিকতাকে অন্ধ করে না দেয়, তথাকথিত শত্রুপক্ষের নারীদেরকে ধর্ষণের বৈধতা না দেয় ।
অন্যদিকে ভারতের নির্ভয়া ধর্ষণের প্রতিবাদে গণ- আন্দোলনের অনেক পজিটিভ দিক থাকা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত তা শহুরে মধ্যবিত্তদের আন্দোলন। প্রান্তিক জনগণের সম্পৃক্ততা এই আন্দোলনে ছিল না। ভারতে প্রতিদিন চারজন দলিত নারী ধর্ষিত হন। কিন্তু শহুরে-মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা নিজেদের শ্রেণীর সদস্যদের উপর আক্রমণ আসা পর্যন্ত এ নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ করে না। চরম দরিদ্র, প্রান্তিক সমাজের নারীদের উপর ধর্ষণের হুমকি সবচেয়ে বেশি। কারণ এদের নিরাপত্তায় সরকার,মিডিয়া, সুশীল সমাজ কোনো দায়িত্ব পালন করে না। ধর্ম বর্ণ শ্রেণী নির্বিশেষে তৃণমূলে সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বাড়াতে হবে। নাহলে ধর্ষণ-বিরোধি কোনো আন্দোলনই ফলপ্রসূ হবে না।
প্রায় ১৪০ কোটির ভারতে প্রতিদিন ৪ জন নয়, ৪00 জন দলিত (অধিকাংশই সামনে বা খবরে আসে না) ধর্ষিত হয়।
তা তো বটেই, হয়তো ৯৯%ই রিপোর্ট হয়না।
খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো পয়েন্ট উল্লেখ করেছ। যুদ্ধের সময়ের ধর্ষণের ব্যাপারটা নিয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে এর পরের পর্বে, তাই এখন আর বেশী কিছু বলছিনা।
আর দ্বিতীয় প্রসঙ্গটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, নারী নির্যাতন ব্যাপারটা যতটা জেন্ডার বা সেক্স ইস্যু ততটাই শ্রেণী সংগ্রামেরও ইস্যু। খুব নেগেটিভ শোনালেও বলতে বাধ্য হচ্ছি যে বর্তমানের এই পুঁজিবাদী সমাজে এবং বিশেষ করে আমাদের মত দেশে ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে তৃণমূলে সম্পৃক্ততা ও সচেতনতা বাড়ানো কতখানি সম্ভব কে জানে… !
প্রতিবাদ করলে ফুটন্ত তেল থেকে আগুনে গিয়ে পড়ার সম্ভাবনা 100%…এই সত্যটা ভুক্তভোগী দের জানিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ও কিন্তু নিতে হবে ।
একদম ঠিক বলেছেন, সে জন্যই তো বলেছিলাম যে ধর্ষণ পৃথিবীর একমাত্র অপরাধ যেখানে অপরাধের শিকারই উল্টো অপরাধীতে পরিণত হয়, এবং বিচার চাইলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতিটা স্তরে কিভাবে তারা আবার ‘ধর্ষিত’ হতে থাকেন। এটা বন্ধ করার জন্য আমাদের আরও সোচ্চার হওয়া দরকার।
এই পর্বটাও চমৎকার হয়েছে। পরবর্তী পর্বের জন্য অপেক্ষায় থাকব।
ধন্যবাদ সৈকত। তবে শুধু চমৎকার না বলে গতবারের মত কিছু পয়েন্টার দিলে খুব ভাল হয়। তোমার আগের মন্তব্যে দুই আঙ্গুলের টেস্টের উল্লেখ দেখেই আমি এ নিয়ে আরও বিস্তারিত পড়া শুরু করেছিলাম।
প্রাসঙ্গীক মনে করে একটি তথ্য এখানে শেয়ার করতে চাই। আমাদের দেশে অষ্টম শ্রেণির “গার্হস্থ্য বিজ্ঞান” বা “হোম সায়েন্স” বইয়ে মেয়েদের যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য (সপ্তম অধ্যায় ‘যৌন নিপীড়ন’ -পাঠ ৪) আত্মরক্ষার ‘কৌশল’ হিসেবে কিছু উপদেশ দেয়া হয়েছে এই রকম –
• বাড়িতে কখনই একা না থাকা।
• অন্যকে আকর্ষণ করে এমন পোশাক না পরা।
• মন্দ স্পর্শ করলে এড়িয়ে যাবে অথবা পরিত্যাগ করবে।
• পরিচিত অপরিচিত কারোর সাথে ঘুরতে না যাওয়া।
• পাড়ার বখাটে দলের হয়রানিতে সরাসরি প্রতিক্রিয়া না দেখায়ে কৌশল অবলম্বন। যেমন জুতা খুলে দেখানো, চড় দেখানো, গালাগাল না করে বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি সামলানো।
সুক্ষ্ণ দৃষ্টিতে উপরের কথাগুলো বিশ্লেষণ করলে আতংকিত হতে হয়। কী বলছেন তারা, কী শিক্ষা দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মকে?
প্রশ্ন হতে পারে বইটির লেখক কারা? দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লেখা আছে-
“গার্হস্থ্য বিজ্ঞান”
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা। ২০১৩
অষ্টম শ্রেণি
রচনা-
প্রফেসর ইসমাত রুমিনা
সোনিয়া বেগম
গাজী হোসনে আরা
শামসুন নাহার বীথি
সৈয়দা সালিহা সালিহীন সুলতানা
রেহানা ইয়াছমিন
সম্পাদনা –
প্রফেসর লায়লা আরজুমান্দ বানু
প্রফেসর সৈয়দা নাসরীন বানু
পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সমন্বয়ক –
শাহান আরা হুদা
সৈয়দা মেহেরুন নেছা কবীর।
সেদিন টেলিভিশনের এক প্রোগ্রামে দেখলাম একজন শিক্ষিত মহিলা বলছেন, ‘কোরানের সুরা নিসায় আল্লাহ পাক যে,স্বামীদেরকে স্ত্রী প্রহারের আদেশ দিয়েছেন তা নারীদের জন্যে এক বিশেষ নেয়ামত’। আরেকজন মহিলা পর্দার সুফল বর্ণনা করতে গিয়ে উদাহরণ দেখিয়েছেন কিভাবে উন্মুক্ত মাংসের উপর মাছি এসে ভিড় করে আর ঢাকা মাংসে মাছি বসেনা।
পুরুষতন্ত্র টিকিয়ে রাখায় কিছু শিক্ষিত নারীদের অবদান রয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
এটাই আমরা ভুল করি। পুরুষতন্ত্র হাজার বছরের একটা সিস্টেম, এর অংশ নারী, পুরুষ সবাই। এটা জটিল একটা ব্যবস্থা যেটার সাথে সমাজ, জেন্ডার, সেক্স, শ্রেণী, রাজনীতি, অর্থনীতি বহু কিছু জট পাকিয়ে আছে। আপনি এটাকে সমর্থন করেন কি করেন না সেটা অনেক সময়ই আপনার জেন্ডার বা সেক্স দিয়ে নাও নির্ধারিত হতে পারে। অনেক সময়েই দেখি খুব ‘নারীবাদী’ নারীরা ‘নারীরাই নারীদের বেশী ক্ষতি করে’ বলে হাহুতাশ করে – না বুঝেই যে এগুলো আসলে বহুকালের শেখানো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ।
ধন্যবাদ এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলার জন্য।