মিজু নির্ব্বাক নিষ্পলক চেয়ে আছে তার মালিকের দিকে। সদর আলী চেয়ারে বসে আছে। মুখের খিঁচুনি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসম্ভব বকে যাচ্ছে। বকা-ঝকার এসব শব্দ সব সময় উচ্চারণ করে না সে। খুব গুরুতর অনিয়ম ঘটলে, আজ তাই ঘটল।

সকালে কারখানায় এসে শুনলো, একটা হাতুড়ী পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাওয়া যায়নি। বিগড়ে গেল সদর আলীর মেজাজ। ক্ষেপে গেল মিজুর উপর। মিজু ছাড়া এ কাজ আর কেউ করতে পারে না। সবাই পাকা মিস্ত্রী। মিজু তাদের কাজে সাহায্য করে। এটা-ওটা এগিয়ে দেয়। তাছাড়া সদর আলীর বাড়ীর টুকটাক কাজগুলোও তাকে করে দিতে হয়। সদর আলীর হঠাৎ মনে হল, গতকাল মিজু তার মায়ের অসুখের কথা বলে দশটি টাকা চেয়েছিল। টাকা না পেয়ে, সে-ই যে হাতুড়ী চুরি করেছে, এ নিয়ে তার আর কোন সন্দেহ রইল না। ভালয় ভালয় জিজ্ঞেস করেও যখন কোন উত্তর পেল না, তখন খুব করে পিটালো তাকে। কোন কাজ হলো না। সে অবাক হলো মিজুর দুঃসাহস দেখে। মনে মনে ভাবল, এত অল্প বয়সে এ ট্রেনিং পেল কোথায়? আরও অবাক হল, ছেলেটি হাউমাউ করে কাঁদলো তো না-ই, চোখেও এক ফোঁটা পানি নাই, দেখে। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তার বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী টুলুকে বলল, ভাল করে হাত-পা বেঁধে রাখ। আমি ফিরে এসে এর একটা বিহিত করব। তারপর সে জরুরী কাজে বাইরে বেরিয়ে গেল।

সদর আলী চলে যাবার পর মিস্ত্রীরা একে একে সবাই বুঝাতে লাগল, বালায় বালায় আমাগোর কাছে কয়া ফালা, আমরা উনারে বুঝায়া কমুনে।

মিজু প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলল, আমি নেই নাই। তারপর সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

এ বয়সে ছেলেরা যেমন চঞ্চল হয়, মিজু ঠিক তেমনটি নয়। কাজ ছাড়া বাড়তি কথা বলত না সহজে। মিস্ত্রীরা তাকে খুব পছন্দ করত। এই মুহুর্ত্তে কেউ তার কথাটা অবিশ্বাস করতে পারল না। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলল না। সদর আলীর ডান হাত, টুলুর উপস্থিতিতে সবাই সতর্ক।

পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে চেয়ারে বসে, টুলু এমন একখানা ভাব ধরেছে যেন সেই মালিক। বয়স্ক মিস্ত্রী হলে এতক্ষণে হাড়-হাড্ডির খবর করে দিতে পারত সে। মিজু নেহায়েত বালক বলেই, এখনো ধৈর্য্য ধরে আছে। হাত-পা বাঁধা মিজুর দিকে তাকিয়ে একটা সিগ্রেট ধরালো।

বিকাল চারটায় সদর আলী তার কারখানায় ফিরে এল। টুলু দ্রুত চেয়ার এগিয়ে দিল। মিস্ত্রীরা কাজ করতে করতেই আড়চোখে দেখে নিল সদর আলীকে। তার মুখের ভাবসাব আগের চেয়ে আরও কঠিন।

অনর্গল বকে যাচ্ছে। কার উপর এত ক্ষেপে আছে, প্রথমটায় কেউ ঠাহর করতে পারল না। কান খাড়া করে, খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে , বুঝল, কোন এক পার্টির উপর। সবদিক সামলাতে একা সদর আলীকে । একদিকে মনোযোগ একটু কম দিলেই শুরু হয়ে যায় চুরিচামারি। চোর-ডাকাতের নাম শুনতে পারে না সদর আলী। কোথাও কোন চুরির ঘটনা শুনলে চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে গালমন্দ করে। গালমন্দ করেও যখন এদের থামানো যায় না, তখন সদর আলী ওয়াজ মাহফিলে চাঁদার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, হুজুরকে বলে দেয়, ভাল কইরা ওয়াজ নসিয়ত কইরেন, চুরি তো কমে না ; দিন দিন বাড়তাছে।

আজ কিনা তারই কারখানায় চুরি হয়ে গেল একটা হাতুড়ী। তাও একটা পুঁচকে ছেলে। আগামীকাল যে সে বড় ডাকাত হবে না, তাতে আর সন্দেহ কি? সদর আলী এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল। টুলুর এগিয়ে দেয়া চেয়ারটায় বসে, সবার উপর চোখ বুলিয়ে, মিজুকে জিজ্ঞেস করল, কিরে এহনো স্বীকার আবি না ?

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মিজু গোঙাচ্ছিল। সকালের মারর ধকল এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। সদর আলীর কথাটা তার কানে গেল কিনা , বুঝা গেল না।
হুংকার ছাড়ে সদর আলী, অহনো চুপ কইরা আছস?

সবাই ভয় পায়। চাপা আতংক। কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। ফোঁপানো কান্না বন্ধ করে মিজু ভয়ে ভয়ে তাকায় সদর আলীর দিকে। গলা শুকিয়ে আসে। কম্পিত কণ্ঠে বলে , আমি নেই নাই।

নেই নাই ? তর বাপে নিছে? কুত্তার বাচ্চা ।

মিস্ত্রীরা এ ওর মুখের দিকে তাকায়। একজন মিস্ত্রী বিরক্তির সাথ বলল, স্বীকার আইতে পারছ না, স্বীকার আইলে কি অয়?

অন্য একজন বলে উঠল, যা , হাত পাও ধইরা মাপ চা, ক’ ভুল কইরা ফালাইছি।

মিজু সেসব কিছুই করল না। সে পাথরের মত , নিশ্চল বসে রইল। এ মুহুর্ত্তে তার চোখেমুখে ভয়ভীতির কোন লক্ষণ দেখা গেল না। মিজুর এহেন নীরবতা সদর আলীকে ক্ষিপ্ত করে তুলে আরও।

উঠে গিয়ে সজোরে একটা লাথি বসিয়ে দিল পাঁজরে। রাগে গজগজ করতে করতে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, নিমকহারামের বাচ্চা, আমারটা খায়া আমার ঘরে চুরি?
সদর আলীর কথাটা কানে যেতেই চিৎকার থামিয়ে ফুঁসে উঠে, আমি কাম কইরা খাই।

এতবড় সাহস, আমার মুখের উপর কথা !

আবার উঠে গিয়ে পর পর কয়েকটা লাথি বসিয়ে দিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে, তোরে হাত দিয়া মাইরা হাত কালা করুম না।

হাতুড়ীর চালানোর টুকটাক শব্দ হঠাৎ থেমে গেল।সবাই চোখ তুলে তাকাল সদর আলীর দিকে।

একজন মিস্ত্রী আবেদনের সুরে বলল, থাউক, আর মাইরেন না, বাচ্চা মানুষ।

কিন্তু পর মুহুর্ত্তে সে থেমে সদর আলীর হুংকারে। এখান থেকে চলে গিয়েও রক্ষা নেই। সদর আলীর অনেক ক্ষমতা। নির্বচনের সময় অনেক নেতা আসে চাঁদা নিতে। এলাকা সব মাস্তান তার কথায় উঠবস করে। এলাকার কেউ তার সাথে ঝগড়া করার সাহসও পায় না। এসবই মিস্ত্রীদের জানা। কারখানায় নীরবতা। কেউ আর কথা বলতে সাহস করে না। ক্ষুব্ধ মনে হাতুড়ী চালায়। হাতুড়ী চালানোর টুকটাক শব্দ আগের চেয়ে আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধে। মিস্ত্রীদের চোখ বুলিয়ে সদর আলী বলে উঠে, ফের যদি কেউ আমার মুখের উপর কথা ক’স, তো খবর আছে। একদম চুপ থাকবি ।

তার চোখ এখন মিজুর উপর। মিজু আগের চেয়ে আরও কঠিন, সংহত। মার খেয়ে খেয়ে অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে যেন। মালিককে দেখছিল অবাক চোখে। আগেও বকাঝঁকা চড়-থাপ্পড় মেরেছে। কিন্তু যেন অন্য এক মানুষ। ভয়-ভক্তি করা মানুষটাকে আজ যেন ছোট বেলায় শোনা রাক্ষসের মত লাগছে আজ। সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে। সে যেন কাউকে চিনতে পারছে না। এমনকি মিস্ত্রীদেরও না। তার ঠোঁট দু’টো কেঁপে উঠে।

মিজুর ভাব-ভঙ্গী ভাল ঠেকল না সদর আলীর কাছে। কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে । এত মার খাবার পরও পরিবর্ত্তন নেই । এ ছেলে যে আগামীতে ডাকাত হবে – এতে তার মনে কোন সন্দেহ রইল না। কিছুক্ষণ ওত পেতে বসে থাকা বিড়ালের মত সদর আলী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মিজুর দিকে। উত্তেজনায় তার হা-পা কাঁপতে থাকে। বিড়বিড় করে বলল, এতবড় কইলজ্যা!

তারপর জোরে হাঁক দিল, টুলু!

পাথরের মূর্ত্তির মত দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছিল টুলু। মালিকের হাঁক শুনে ব্যাঙের মত লাফিয়ে উঠে ।

আমি আড়তে যাইতাছি। তুই ওরে লয়া আয়। কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেল আসবাবপত্রের কারখানা থেকে । মিস্ত্রীরা হাঁফ ছাঁড়ল। কেউ কপালের ঘাম মুছল। একজন মিস্ত্রী মিজুর দিকে তাকিয়ে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, টুলুর হুংকার শুনে।

পা সোজা কর। মিজু পা সোজা করলে , সে তার পায়ের বাঁধন খুলে দিল। তারপর মিজুকে হেঁচকা টানে দাঁড় করিয়ে বলল, চল।

নদীর পাড় ঘেঁষে অনেকটা জায়গা জুড়ে সদর আলীর লাকরির আড়ত। হিসেব-নিকেশের জন্য একচালা একটা ঘর। স্তূপীকৃত লাকরি ঢাল বেয়ে নদীর পানি ছুঁই ছুঁই করছে । পাশে স মিল। বাইরে থেকে দেখে বুঝার উপায় নেই – সদর আলীর লাখ লাখ টাকার কারবার চলে এ আড়তে।

মিজুকে একটা খুঁটির সাথে শক্ত করে বেঁধে , টুলু তাকাল সদর আলীর দিকে। হুকুমের অপেক্ষায় রয়েছে সে। বিপর্য্যস্ত মিজু হা করে চেয় থাকে। একে প্রচণ্ড মার, তার উপর সারাদিন অভুক্ত – কাঁদবার শক্তিটুকুও তার দেহে নেই।

একটা লাঠি নিয়ে আয় – দাঁতে দাঁত চেপে টুলুকে হুকুম দিল সদর আলী।

টুলুকে হুকুম দিতে গিয়ে তার চোখে পড়ল, চালা ঘরের পেছনে একপাল টোকাই। ভয়ে বিস্ময়ে সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। সদর আলী খেঁকিয়ে উঠল, ঐ খানকির বাচ্চারা তোরা এইহানে কি চাস?

আসবাবপত্রের কারখানা থেকে যখন মিজুকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছিল টুলু, তখন থেকে ওরা পিছু নিয়েছিল। সদর আলীর হুংকার শুনে প্রথমটায় নড়ল না কেউ। টুলু যখন লাকরির চেলা নিয়ে এগিয়ে গেল তখন সবাই দৌড়ে নিরাপদ দূরত্বে চলে গেল।

সদর আলী মিজুর পেটে একটা লাথি মেরে টুলুর দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, দে চেলাটা

ও মা গো ! গগন বিদীর্ণ করা চিৎকার বেরিয়ে এল মিজুর গলা থেকে । আমি বাচুম না রে মা, ওমা—-।

এক মুহুর্ত্তের জন্য থেমে গেল সদর আলী। টুলুর দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু বুঝলি?

কী?

চোখে পানি নাই।

পানি নাই!

চাপা কণ্ঠে সদর আলী বলে, কত চোর পিটায়া ঠিক কইরা ফালাইছি , আর তু তুই তো অহনো মায়ের পেটে।

এবার টুলু সদর আলীর পাশ কেটে মিজুর বাম গালে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় বসিয়ে দিল। তারপর মাথার চুল ধরে প্রবল বেগে ঝাঁকি দিতে দিতে বলল, স্বিকার আ।

কিন্তু মিজুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আমি নেই নাই। আমি নেই নাই।

রাগে ক্ষোভে সদর আলী লাকরির চেলা দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে দিল। আর তখনই মিজুর মুখ থেকে বেরিয়ে এল, আমারে আর মাইরেন না । আমি হাতুড়ী দিয়া দিমু।

ঠেলার নাম বাবাজি।

হাঁপাতে থাকে সদর আলী। বলল, ক, কই রাখছস হাতুড়ী।

উত্তর না দিয়ে গোঙায় মিজু।

কিরে কইবি না?

আমি নেই নাই।– বলেই ফুঁপিয়ে উঠে মিজু। তার বুকের ছাতি সমুদ্রের ঢেউয়ের মত উঠানামা করতে থাকে।

উস্তাদ , থানায় দিয়া দেই – বিরক্তিমাখা কণ্ঠে বলল টুলু।

সে কথার উত্তর না দিয়ে উন্মত্তের মত মারতে শুরু করল সদর আলী, আমার লগে তামাস করছ, কুত্তার বাচ্চা! কাল সাপের বাচ্চা।

মারের এক পর্য্যায়ে মিজুর ঘাড় কাৎ হয়ে পড়ে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সদর আলীর। সে পকেট থেকে টাকা বের করে টুলু হাতে দিয়ে বলল, যা , এক বোতল কেরাসিন তেল কিইন্না লয়া আয়।

টুলুকে বিদায় করে নিজেই ছুটে গেল চালা ঘরে ।অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা চটের বস্তা বের করে নিয়ে এল। খুঁটির কাছে বস্তাটা রেখে, মিজুর হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিল। আর তখনই মিজু তার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে , প্রলাপ বকতে শুরু করল, আমি হাতুড়ী নেই নাই, আমি হাতুড়ী দিয়া দিমু, আমি সবকিছু দিয়া দিমু।

সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই সদর আলীর। মিজুকে বস্তায় ভরে , বস্তার মুখ বেঁধে ফেলল। ততক্ষণে টুলু তৈল নিয়ে উপস্থিত। ক্ষিপ্র গতিতে টুলুর হাত থেকে কেরাসিনের বোতলটা নিয়ে , ঢেলে দিল বস্তার উপর।

বস্তার ভেতর থেকে অর্ধমৃত মিজুর গোঙানির শব্দ বের হয়ে আসে ।

সদর আলী কোনদিকে না তাকিয়ে , পকেট থেকে দিয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে আগুন জ্বালাল। এক মুহুর্ত্ত তাকিয়ে থেকে , জ্বলন্ত কাঠিটা বাড়িয়ে দিল তৈলসিক্ত বস্তার দিকে ।
দপ করে জ্বলে উঠল আগুন এবং দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল।

বস্তার ভিতর থেকে ভেসে আসছিল মিজুর ভয়াবহ আর্তনাদ। ঐ সময় কোথা থেকে কয়েকটা ঢিল এসে পড়ে চালা ঘরের উপর। টুলু উঠে দেখতে গিয়ে , দেখতে পেল, সেই টোকাইয়ের দল। প্রত্যেকের হাতে ঢিল। টুলু ধমক দিল কিন্তু পালাল না কেউ।