হ্যাঁ, এখন চারদিকে একটা খবর, একটাই কথা। টাকার কথা। কী হল, কেন হল, এবার কী হবে, ইত্যাদি। এই যে আচমকা ৯ নভেম্বর ২০১৬-এর শুরুতেই, রাত বারোটা থেকে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল বলে ঘোষণা করা হল, এর উদ্দেশ্যই বা কী, এতে কার কতটা লাভ বা ক্ষতি হবে। লোকজন সকাল থেকে ব্যাঙ্কের শাখায় গিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন, এটিএম-এর বুথের সামনে ধর্না দিচ্ছেন, সরকারি ঘোষণা বা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কোথাও টাকা মিলছে না। অথবা যেটুকু মিলছে তা দিয়ে প্রতিদিনের কাজ মিটছে না! বাজারে দোকানে একটা হাহাকার। তার উপর আবার ব্যাঙ্ক দিচ্ছে শুধু দুহাজার টাকার নোট। তার নীচের অঙ্কের কোনো টাকার নোট ছাপা হচ্ছে না, সরবরাহ হচ্ছে না। ফলে সাধারণ ক্রেতার হাতে পণ্য কেনার মতো যথেষ্ট টাকা নেই, খুচরো নেই। একশ টাকার নোটের দুর্ভিক্ষ! ব্যবসা বাণিজ্য ক্ষতবিক্ষত। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে বেচাকেনা বেশ অনেকটা কমে গেছে। জিডিপি নেমে যাচ্ছে। টাকার দাম ডলার সাপেক্ষে ৬৬ থেকে ৬৮ হয়ে গেছে। হয়ত, আরও কমবে। জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে কর্মী ছাঁটাই। বিপুল বেকার বাহিনীতে আরও কত নতুন সদস্য যোগ হতে চলেছে! সব এক কলমের খোঁচায়!

এত বড় একটা ঘোষণার উদ্দেশ্য হিসাবে দুটো প্রধান কথা উঠে এসেছে: যেখানে যত কালো টাকা জমানো হবে, সমস্তই এবার এক টানে উদ্ধার হবে, আর বাজারে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা সমস্ত জাল টাকার নোটগুলো রাতারাতি খতম হয়ে যাবে। কিন্তু শুধু এই দুটো উদ্দেশ্যর কথা বললে দেশের আপামর জনসাধারণ এতে খুব একটা আমল দিত না। মন থেকে আদৌ বিশ্বাস করত না। ভারতের স্বাধীনতার প্রভাত বেলায় চাচা নেহরুর বজ্রস্বরে বিঘোষিত মজতদার কালোবাজারিদের ধরে ধরে রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দেবার রূপকথা থেকে শুরু করে অনেক বার এই সব হাবিজাবি শুনে শুনে কথাগুলো পুরনো এবং ক্লিষ্ট (ফরাসি ভাষায় ক্লিশ) হয়ে গেছে। নরেন্দ্র মোদীর ভক্তজনেরা এটা কম বেশি জানে। তাই এর সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আরও কিছু লেবেঞ্চুস। পাকিস্তান, কাশ্মীর, জঙ্গি, মাওবাদী, ইত্যাদি নাকি এবার বেশ বেকায়দায় পড়বে। হুঁ হুঁ, বাবা, এখন তো আর কংগ্রেসের দুর্বল রাজত্ব নয়। এ হল গিয়ে নরেন্দ্র দামোদর মোদীর রাজ। এখানে ওসব চলবে না। পাকিস্তান জাল নোটের বান্ডিল ছাপিয়ে ভারতের বাজারে ঢুকিয়ে দেবে, জঙ্গিরা সেই সব জাল টাকায় দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেবে, মাওবাদীরা ব্যাঙ্কের টাকা লুট করে জঙ্গলে নিজেদের রাজত্ব চালাবে—এসব আর হচ্ছে না বাপধন! এক ঘোষণায় সব একেবারে শেষ! দ্যাখো—কেমন দিলাম?

হ্যাঁ, এই একটা জিনিস মোদী অ্যান্ড কোং খুব ভালো বুঝেছে। কংগ্রেসি আমল থেকেই দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে এই রকম একটা রুগ্ন মানসিকতার চাষ হয়েছে, সরকারের যে কোনো অসভ্য পদক্ষেপের পেছনেই সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে যাবে, যদি তার সঙ্গে এই রকম কিছু মুদ্দা জুড়ে দেওয়া হয়। পাকিস্তান, চিনের চক্রান্ত, কাশ্মীর, জঙ্গি, মাওবাদী, ইত্যাদি। তখন ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতার মতোই তাদের মগজে সাধারণ বোধ ভাষ্যি যুক্তি তক্ক আর একেবারেই কাজ করে না। মোদী এবং মোদীর ভক্তরা এখন ঠিক এই কথাগুলিই বিভিন্ন মাত্রায় সুর চড়িয়ে দেশপ্রেম চাড়িয়ে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছেন! আম জনতা এই সবের দ্বারা অনেকটা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। চারদিকে এরকম কিছু বাণী ভেসে বেড়াচ্ছে: “হ্যাঁ, কয়েকটা দিন একটু তো অসুবিধা হবেই। কী আর করা যাবে! ভালো কিছু পেতে হলে আমাদের কষ্ট তো পেতে হবেই। এতদিন কেউ কিছু করেনি। এখন এই একটা প্রধান মন্ত্রী কিছু করার চেষ্টা করছেন। সাহস করে একেবারে মোক্ষম জায়গায় হাত দিয়েছেন। এই জন্যই চারদিকে এতটা গেল-গেল রব উঠেছে। কালো টাকার পাহাড়ে আর জাল টাকার মৌরসি পাট্টার গায়ে হাত পরেছে, তারা ফোঁস করে তো উঠবেই।”

আসুন, আমরা একটু তলিয়ে দেখবার চেষ্টার করি।

[১] নোট বাতিল করলে কী হয়?

অনেকেই এই সব বলার এবং ঘাড় নেড়ে শোনার সময় ভুলে যাচ্ছেন, আমাদের দেশে বড় অঙ্কের নোট এই প্রথম বাতিল হল, তা নয়। কালো আর জালের কথাও এই প্রথম কেউ উচ্চারণ করলেন—তাও সত্য নয়। এর আগে অনেকবার এই কাজ করা হয়েছে। প্রায় একই উদ্দেশ্য ঘোষণা দিয়ে। মাত্র দু বছর আগেই মনমোহন সিং সরকার চলে যাওয়ার ঠিক আগে ঠিক করেছিল, ২০০৫ সালের আগেকার ছাপানো সমস্ত নোট বাজার থেকে তুলে নেবে। আর কী আশ্চর্য! সেই সময় বিজেপি-র মুখপাত্র এবং বর্তমানে একজন সাংসদ শ্রীমতী মীনাক্ষী লেখি সাংবাদিক সম্মেলন করে যা বলেছিলেন, এখন আবার রাহুল গান্ধী প্রমুখ সেই সব কথাই বলছেন! “সাধারণ মানুষের চূড়ান্ত অসুবিধা হবে, কালো টাকা আর জাল নোটের কেশাগ্রও ছোঁওয়া যাবে না,” ইত্যাদি।

মনে হচ্ছে, কোন চেয়ারে বসলে কী বলতে হবে, তার যেন কোথাও একটা অদৃশ্য নাট্যসংলাপ আগে থেকেই লেখা আছে। যারা যেমন বসে, তারা সেই অনুযায়ী কথা মুখস্থ করে নিয়ে বলতে থাকে।

প্রথমে কালো টাকার কথা।

নোট বাতিল করে কালো টাকা ধরা যাবে—এই কথা যাঁরা বলেন তাঁরা ধরে নেন, কালো টাকার কারবারিরা বুঝি মোগল আমলের মতো এখনও টাকার নোটের বান্ডিল পেতলের কলসিতে ভরে মাটিতে পুঁতে রাখে। এটা যাঁরা বলেন, তাঁরা নিজেরা সকলে সত্যিই এতটা বোকা, নাকি, আম আদমিকে এক্কেবারে বুদ্ধু ঠাওরান—বলা মুশকিল। এই বিশাল দেশে . . .। তবে এটুকু বলা যেতেই পারে, কালো টাকার কারবারিরা এত বোকা নয়। যে কারণে তারা বাজার থেকে টাকা সংগ্রহ করে, আসলে অন্যায় ও অনৈতিক উপায়ে উপার্জন করে, সেটা নিশ্চয়ই শুধু কড়কড়ে নোটের গন্ধ শোঁকা নয়। তারা এটাও জানে, বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাপেক্ষে প্রতিদিন টাকার দাম কমতে থাকে। অব্যবহৃত জমা টাকার পরিমাণ অঙ্কের ভাষায় এক থাকলেও আসলে তার কার্যকরী মূল্য কমে যায়। ফলে বিপুল পরিমাণ টাকা জমিয়ে কেউ বাড়িতে ফেলে রাখে না। সোনা রুপো কিনে রাখে, জমি কেনে, শেয়ার বাজারে খাটায়, ব্যক্তিগত স্তরে সুদের কারবার করে, এই রকম আরও অনেক কিছু করতে পারে। যত বড় ব্যবসাদার, যত বেশি কালো টাকার মালিক, তত তার সঞ্চিত টাকার ভ্রমণ সুখ বেশি।

এদের মধ্যে সবচাইতে উপরের থাকে যারা রয়েছে, তাদের টাকা আবার দেশেই থাকে না। বিভিন্ন বিদেশি ব্যাঙ্কে চলে যায়। ডলারের বা অন্য কোনো মুদ্রামানের অঙ্কে। সুইস ব্যাঙ্কে সুইস ফ্রাঁ হয়ে বসে থাকে, নয়ত, মালয়েশিয়ার শাল বাগানে চলে যায়। শাল গাছ হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। ভারতে কত টাকার কী কী নোট বাতিল হল, তাতে এদের কিছুই যায় আসে না। সুতরাং যাঁরা মোদী কোং-এর প্রচারে মোহিত হয়ে ভাবছেন, এইবার সরকারি প্রশাসন বাড়ি বাড়ি হানা দিয়ে লেপ তোশক বালিশের ওয়াড় থেকে লক্ষ লক্ষ কিংবা কোটি কোটি কালো টাকা খুঁজে বের করে নিয়ে যাবে—তারা দেশের সমান্তরাল কালো অর্থনীতি এবং দেশনেতাদের ভণ্ড প্রতারক রাজনীতি বুঝবার ক্ষেত্রে নেহাতই বাল্যখিল্য। এরকম কিছু টাকার বান্ডিল পাওয়া যাবে তাদের ঘরে যাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই, থাকলেও বাড়ি থেকে ব্যাঙ্কের শাখা এত দূরে যে যেতে পারে না, কিংবা, নাম সই করতে এবং ব্যাঙ্কে গিয়ে কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে, ইত্যাদি। অত্যন্ত দীন দরিদ্র পরিবারে। গরিব চাষি, গৃহ পরিচারিকা, দিনমজুর, মুটে, ইত্যাদির কাছে। কয়েকশ বা কয়েক হাজার, বড় জোর। আর একটু বেশি পরিমাণে, এরকম সঞ্চিত দুচার লাখ টাকার সন্ধান পাওয়া যাবে কিছু ছোটখাটো অথচ ব্যস্ত দোকানের ক্যাশ বাক্সে। যেখানে প্রতিদিন নগদে বেচাকেনার জন্য অনেক টাকার লেনদেন হয়।

সকলেই জানেন, বিদেশে পাচার হয়ে বেড়াতে চলে যাওয়া কালো টাকাই আসল সমস্যা। কেন্দ্রীয় সরকারের তখতে বসার আগে অবধি মোদীও তা-ই জানতেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেই মর্মেই তিনি প্রচারও চালিয়েছিলেন। ক্ষমতায় বসার ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত কালো টাকা উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসে দেশবাসীর মধ্যে নাকি বিলিয়ে দেবেন, আর, দেশের প্রত্যেকের কাছে নাকি গড়ে ১৫ লক্ষ করে টাকা চলে আসবে। সেদিনই হবে দেশের “ভালো দিন”, “আচ্ছে দিন”। ইতি মধ্যে মোদীর সহ-সাগরেদ বিজেপি-র সভাপতি অমিত শাহ জানিয়ে দিয়েছেন, পঁচিশ বছরের আগে নাকি আচ্ছে দিন আসবে না। আর বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত কালো টাকাও নাকি দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে না। এমনকি, কাদের কোথায় কত টাকা জমানো আছে, সেই তালিকাও নাকি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট বলা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার এই ব্যাপারে আগেকার কংগ্রেসি জমানার মতোই কালো টাকার ধনার্দন-বান্ধব সরকার হিসাবেই আত্মপরিচয় প্রদানে উদ্গ্রীব হয়ে আছে।

তার মানে দাঁড়াল এই যে, যথার্থই যেখানে কালো টাকা আছে, সেখানে এই সরকার হাত লম্বা করছে না। আর, যেখানে সে কালো টাকা উদ্ধারের জন্য হাত বাড়ানোর মূকাভিনয় করে চলেছে, সেখানে যা আছে তার পরিমাণ এত কম যে তার স্বার্থে এত ঢাকঢোল পিটিয়ে সাধারণ মানুষকে এত অসুবিধায় ফেলে দেবার কোনো মানে হয় না।

শুধু এইটুকুই নয়। গত দু বছর ধরেই মোদী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ভারতের সর্বোচ্চ ধনীদের স্বার্থে এমনভাবে কাজ করে চলেছে যে তাদের বিদেশে টাকা পাচার করে ফেলতে সুবিধা হয়। ২০১৪ সালে যেখানে বিদেশে সর্বোচ্চ অর্থ অপসারণের পরিমাণ ধার্য ছিল ৭৫ হাজার ডলার, নরেন্দ্র দামোদর মোদী গত বছর এই অঙ্কটিকে এক লক্ষ পঁচিশ হাজার অবধি বাড়িয়ে দেয়। আর এই বছর এই ঊর্ধ্বসীমা করে দেওয়া হয়েছে দুই লক্ষ আড়াই হাজার টাকা। কৃষ্ণধন উদ্ধারের সর্দারই বটেক!

[২] জাল নোট উদ্ধার

এবার জাল টাকার প্রসঙ্গ।

চালু টাকার নোট বাতিল হয়ে গেলে জাল টাকার কারবারিরা অবশ্যই বিপদে পড়ে যেতে বাধ্য। পুরনো নোট বাতিল হয়ে গেলে সেই নোটের অনুরূপ নকল নোট আর বাজারে চলবে না—অতএব তা সঙ্গে সঙ্গে বাজার থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হবে সেই কারবারের সঙ্গে যুক্ত লোকেরা। আর ব্যাঙ্কেও তারা সেই নোট নিয়ে যেতে পারে না ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে। সেদিক থেকে নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে জাল টাকা বন্ধ করার ক্ষেত্রে সাময়িক সাফল্য আসতে পারে।

সাময়িক কেন?

কারণ, কালো টাকার কারবারি বা কালোবাজারিদের মতো জাল টাকার কারবারিরা সর্বত্র ছড়িয়ে নেই। অল্প কিছু অপরাধী অন্ধকার জগতের লোক জাল টাকা ছাপায়, তারপর তা ধীরে সুস্থে খুচরো বাজারে ছড়িয়ে দেয়, আর আসল টাকা তুলে নিতে থাকে। এইভাবেই তারা দেশ সমাজ ও জনগণকে বঞ্চিত করে নিজেরা লাভ করতে থাকে। জাল টাকার কারবার স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে সেই সব উৎসে পৌঁছনো দরকার। কিন্তু এ পর্যন্ত জাল টাকার ব্যাগ নিয়ে ঘোরা কুরিয়ার দুচারটে ধরা পড়লেও স্বাধীনতা উত্তর কালে ভারতে জাল নোট ছাপানোর কারখানা খুব একটা ধরা পড়েনি। এর জন্য প্রশাসনিক গাফিলতি কতটা দায়ী, আর রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের দায় কতটা, বলা মুশকিল। হয়ত দুটোই কাজ করে চলেছে।

আরও একটা কথা।

ভারতে জাল টাকার পরিমাণ কত?

এ নিয়ে মুনিদের মধ্যে অনেক রকম হিসাব আছে। যাঁরা কমের দিকে বলছেন, তাঁদের মতে এই অঙ্ক গড়ে প্রতি দশ লক্ষ নোট পিছু ২৫০ টি নোট, অর্থাৎ, ০.০২৫ শতাংশ। যাঁদের হিসাবে এই অঙ্কটা আরও অনেক বেশি, তাঁরাও এটা ৪ শতাংশর বেশি বলতে পারছেন না। অর্থাৎ, প্রতি একশটা নোটে চারটে জাল নোট থাকার সম্ভাবনা। আমরা যদি ধরেও নিই, সংখ্যাটা এই দুটো সীমান্তের মাঝামাঝি কোথাও রয়েছে, আনুমানিক ৪০০ কোটি, তাহলেও বোঝা যায়, জাল নোটের সমস্যা কালো টাকার মতো একটা জ্বলন্ত সমস্যা হয়ে এখনও দেখা দেয়নি। হ্যাঁ, একে আটকানো না গেলে যে কোনো সময় এটা একটা বড় বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে।

যাঁরা পাকিস্তান জঙ্গি সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদির নাম জাল নোটের কারবারের সাথে জুড়ে দিচ্ছেন, এই নিয়ে প্রশ্ন তুললেই দেশ প্রেমের দোহাই দিচ্ছেন, তাঁদের একই সঙ্গে জবাব দিতে হবে, সীমান্তে নাকি সেনাবাহিনী ২৪ ঘন্টা নিদ্রাহীন চোখে আমাদের পাহারা দিচ্ছে। তা তারা এই ব্যাপারে কী করছে? হাওয়ায় অদৃশ্য হয়ে ভূতের মতো নিশ্চয়ই জাল নোট নিয়ে পাকিস্তান থেকে কেউ এই দেশে ঢুকে পড়তে পারছে না। তাহলে তারা ঢুকছে কোন পথে? সেই সব পথে পাহারা নেই কেন? প্রতি বছর যে সামরিক খাতে এত বরাদ্দ বাড়ছে তার তো কিছু বিনিময়-সুফল পাওয়া উচিত। মিলিটারি পাহারাও দিচ্ছে, পাকিস্তান জাল নোট সহ জঙ্গি ঢুকিয়েও দিচ্ছে—দুটোই এক সাথে কেমন করে হয়?

আর একটা কথা। যারা মাদক দ্রব্য পাচার করে, বে-আইনি অস্ত্র বেচাকেনা করে, তাদের টাকা হাত বদল করার জন্য নিত্য নতুন কৌশল এসে যাচ্ছে। তাদের আজকাল কোনো নোটই ব্যবহার করতে হচ্ছে না। পাচারীকৃত দ্রব্যের দরদাম ঠিক হয়ে গেলে “বিটকয়েন ডিজিট্যাল ক্রিপ্টোকারেন্সি” (Bitcoin Digital Cryptocurrency) নামক এক ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে চোখের পলকে অর্থ এক দেশ থেকে অন্য দেশে চালান হয়ে যায়। ফলে অন্ধকার দুনিয়ার জালি কারবারিদের আজকাল আর বেশি বেশি করে জাল নোটের কারবার করতেই হচ্ছে না। তারাও ক্রমাগত চালাক চতুর হয়ে উঠছে। নিজেদের কাজের কায়দাকানুন পালটে ফেলছে। ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির উন্নতির মধ্য দিয়ে এরকম আরও নিত্য নতুন ছদ্ম-মুদ্রার আমদানি হচ্ছে পৃথিবীর বুকে। সাধারণ মানুষ না জানলেও উপরমহলের কর্তারা নিশ্চয়ই জানেন। ফলে জাল নোটের বিচরণ ক্ষেত্র এখন স্থানীয় বাজার ভিত্তিক এলাকায় ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে।

সরকার এই সব খবর রাখে না, এমন নয়। দেশের অর্থব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক হিসাবে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তাব্যক্তিরাও এই সব জিনিস ভালোই জানেন। তাই তাঁরা নিঃশব্দে নির্দিষ্ট সময় অন্তর নোটের ছবি বদলে ফেলেন। বাজার থেকে ধীরে ধীরে পুরনো নোট তুলে নেন। কাজটা এমনভাবে চুপচাপ সেরে ফেলেন যে জাল নোটের কারবারিদের ধরতে সময় লাগে। প্রবীন মানুষদের যাঁদের স্মরণ শক্তি খানিকটা প্রখর তাঁরা একটু ভেবে দেখলেই মনে করতে এবং বুঝতে পারবেন, তাঁদের জীবদ্দশাতে পাঁচ দশ বছর বাদে বাদে কীভাবে দশ টাকা, কুড়ি টাকা, পঞ্চাশ টাকা, একশ টাকা, পাঁচশ টাকার নোটের চেহারা ছবি বদলে গেছে।

কিন্তু এই একই কাজ বুক চাবড়ে ঢাক পিটিয়ে করলে কী হয়? জাল নোটের কারবারিরা সঙ্গে সঙ্গে জেনে যায়, পুরনো নোট আর জাল করে লাভ নেই। তারা তাদের কাজ কিছুদিনের জন্য থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে। জাল নোটের অব্যবহৃত সঞ্চয় নষ্ট করে ফেলে। অপেক্ষা করে, কতক্ষণে বাজারে নতুন নোট আসবে। এসে গেলেই তারা কাজ শুরু করে দেয়। নতুন জাল নোট করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুরনো ছাপানো কাগজ কালি বাবদ তাদের যা ক্ষতি হয়, আবার অল্প দিনের মধ্যেই তারা নির্ঝঞ্জাটে নিশ্চিন্তে হিসাব করে তা তুলে ফেলতে পারে। এই দিক থেকে বিচার করলে মোদী যে এদের কতটা সাহায্য করেছেন, প্রচারের আত্মতৃপ্তিতে বোধ হয় এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। তবে ইতিমধ্যেই, চালু হওয়ার দু সপ্তাহের মধ্যেই, গুজরাত ও ওড়িশা থেকে নতুন দুহাজার টাকার জাল নোটের যে সন্ধান মিলেছে তা এই কথার সত্যতাকে অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ করে দিচ্ছে।

[৩] তুঘলক না শ্রেণির দালাল?

অনেকেই নরেন্দ্র মোদীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন এই বলে, উদ্দেশ্য ভালো, কিন্তু কাজটা তুঘলকের মতো হয়ে গেছে। একটু বেশি তাড়াহুড়ো করে করা হয়েছে। কেউ কেউ সমালোচনা করছেন এরকমভাবে, একটা অশিক্ষিত দায়িত্বহীন প্রচার সর্বস্ব লোক দেশের প্রধান মন্ত্রী হলে এরকম হবেই। নতুন নোট আগে ছাপিয়ে রাখার ব্যবস্থা করে, ২০০০ টাকার আগে ৫০০ টাকার নতুন নোট ছাপানোর ব্যবস্থা করে, ইত্যাদি। আমি মনে করি, এতে একটা আসল কথা আড়ালে থেকে যাচ্ছে। সরকার বা মন্ত্রীরা কেউ ব্যক্তিবিশেষ হিসাবে দেশ চালান না। তাঁরা শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করেন। সেই জায়গা থেকে না দেখলে এই নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের আসল উদ্দেশ্য বোঝাই যাবে না।

প্রশ্ন হচ্ছে কোন শ্রেণির।

উত্তর—ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিগোষ্ঠীর।

যেমন মনমোহন সিং তেমনই নরেন্দ্র মোদীও সেই একই শ্রেণির স্বার্থ দেখবার জন্যই ক্ষমতায় এসেছেন, বা বলা ভালো, আনা হয়েছে। কংগ্রেসকে সরিয়ে বিজেপি-কে আনার কারণ হল, দুর্নীতিতে ঠাসা গোষ্ঠী কোন্দলে অতিষ্ঠ কংগ্রেস বুর্জোয়াদের স্কিমগুলো যত তাড়াতাড়ি দরকার সেইভাবে সেরে ফেলতে পারছিল না। মোদীকে বৃহৎ গণ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক ঢাকঢোল পিটিয়ে বিকাশ পুরুষ টুরুষ সাজিয়ে সামনে তুলে আনা হয়েছিল এই উদ্দেশ্যে। গুজরাতে মোদী বীভৎস মুসলিম বিরোধী গণহত্যা চালিয়ে কংগ্রেসের ১৯৮৪ সালের দিল্লি শিখ বিরোধী দাঙ্গার রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সেই থেকেই এক বেপরোয়া চরিত্র হিসাবে মোদী বুর্জোয়াদের ক্রমবর্ধমান প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছেন।

দুটো কাজের কথা মনে রাখলে এটা ধরতে সুবিধা হবে।

পুঁজিপতিদের কর ছাড়। মোট পরিমাণ কত?

পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্ক ঋণ মকুব। মোট পরিমাণ কত?

২০১৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাঙ্কে বড় পুঁজির মালিকদের ঋণের একটা বিশাল অঙ্ক—১, ১৪, ০০০, ০০, ০০, ০০০ টাকা স্রেফ মুছে ফেলা হয়েছে। এই সব ঋণখেলাপিরা সরকারের কাছ থেকে গত কয়েক বছরে যে টাকা নিয়েছিল, নরেন্দ্র মোদীর কঠোর নির্দেশে তাদের আর সেই টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হিসাব মতে ব্যাঙ্কগুলির এইভাবে আরও সম্ভাব্য বিপন্ন সম্পদের পরিমাণ প্রায় সাত লক্ষ কোটি টাকা।

সরকার গত দু বছরে ৫২, ৯১১ টি লাভজনক কোম্পানিকে যে কর ছাড় দিয়েছে তার পরিমাণ প্রায় সমান, অর্থাৎ, এক লক্ষ পনের হাজার কোটি টাকা। দেশের আইন এবং আর্থসামাজিক শৃঙ্খলা অনুযায়ী সরকারের ন্যায্য প্রাপ্য এই অর্থ মোদী-সরকার স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে ছেড়ে দিয়েছে। তার উপর এই বছর সদ্য ৬৩টি বড় কোম্পানিকে তাদের ঋণ বাবদ সুদে ছাড় দেওয়া হয়েছে ৭২০০ কোটি টাকা, যার মধ্যে মহামান্য বিজয় মাল্যও আছে। যে লোকটা রাষ্ট্রীয় সম্পদ চুরি করে, কর্মচারিদের আট মাসের বেতন বকেয়া রেখে, দেশ থেকে (কুলোকের কথায়, সরকারেরই সহযোগিতায়) লন্ডন পালিয়ে গিয়েছে, তাকেও ১২০০ কোটি টাকা সুদে ছাড় দেওয়া হল। লরেল মুদি আমাদিগের কালো টাকার কারবারিদের ধইরবার লেইগ্যে উপযুক্ত লায়েকই বটেক, হ!

এর সাথে যোগ করতে হবে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তরফে গৌতম আদানিকে নিউজিল্যান্ডে খনি ব্যবসা করার জন্য সদ্য প্রদত্ত ঋণ ৬০০০ কোটি টাকা। এই টাকাও জানাই আছে যে ফেরত আসবে না। চার্বাকীয় মতে উবে যাবে। মোদী তাঁর জান থাকতে দেশের কোনো পুঁজির মালিককেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ঋণ শোধ করার সুযোগ দেবেন না বলে ধনুর্ভাঙা পণ করে বসে আছেন যে!

সরকারের আরও ক্ষতি হয়েছে এই সব কৃষ্ণ-ধনার্দনদের হাতে। মোদী সরকারেরই উদ্যোগে! ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের হাত থেকে গ্যাস বিতরণের লাইসেন্স তুলে দেওয়া হয়েছে রিলায়েন্স গ্রুও অফ ইন্ড্রাস্ট্রিজকে। রেলকে ডিজেল সরবরাহের (আসলে বেচবার) বরাত দিয়েছে আম্বানি ও এসার অয়েলকে। একের পর এক।

দেশের কোষাগার থেকে এই রকম বিপুল পরিমাণ টাকা যদি নালা দিয়ে গড়িয়ে যায়, তাহলে সরকার চলবে কী করে? তার বেতন ভাতা ও অন্য অসংখ্য খাতে টাকা চাই। এক মোদীর বিশ্ব ভ্রমণের জন্যই তো প্রতি মাসে অনেক টাকা লাগে। মাঝে মাঝে তাঁর আবার দামি স্যুটও তো বানাতে এবং বদলাতে হয়! গুজরাতে এই বছর নবরাত্রি পালন করতে গিয়ে মোদী ও তাঁরা সাঙ্গপাঙ্গরা নাকি শুধু জলই পান করেছেন দশ কোটি টাকার। এমনই আরও কত জরুরি খরচ আছে! তাই ব্যাঙ্কগুলোকে তো খালি ফেলে রাখা যায় না! অতএব—

অতএব এই নোট বাতিলের ঘোষণা। এ যদি সত্যিই অর্থনীতির নিজস্ব নিয়ম মেনে করা হত, তাহলে গোটা ব্যবস্থা অন্যরকম ভাবে পরিকল্পনা করে নেওয়া হত। অনেক আগেই বিকল্প অর্থের যোগান আয়োজন করে রাখা হত। না বুঝে বা পাগলামি করে নয়, জেনে বুঝেই সেই ব্যবস্থা করা হয়নি। কেন?

কারণ, একবার যদি বলে দেওয়া হয়, অমুক দিনের অমুক পবিত্র ঘ থেকে এই এই নোট বাতিল, সাধারণ লোকে যার কাছে যা কিছু নোট আছে, তা নিয়ে ব্যাঙ্কে দৌড়বে। ঝপাঝপ জমা করে দেবে। ব্যাঙ্কের হাতে যদি বিকল্প নতুন নোটের যোগান না থাকে, গ্রাহকরা বেশি টাকা তুলতে পারবে না। তার মানে সরকারের ঘরে যত টাকা জমা পড়বে, তার তুলনায় অনেক কম টাকা ঘর থেকে বেরবে। এটিএম-এর সামনে লাইন যতই লম্বা হোক, ভেতরে ভোমরা থাকবে কম কম। আদানি আম্বানি মাল্য প্রমুখকে সেবা করতে গিয়ে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, তার বেশ অনেকটাই ভরাট করে ফেলা যাবে।

বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে, দু একটা গল্প বলি তাহলে। ৮ নভেম্বরের আগের দু সপ্তাহে ব্যাঙ্কে মোট জমা পড়েছিল আট হাজার কোটি টাকা। আর দশ এবং এগারই নভেম্বর, এই দুদিনেই শুধু জমা হয়েছে এগার হাজার কোটি টাকা। বাতিল কাণ্ডের পরের দুই সপ্তাহে এ পর্যন্ত জমা পড়ে গেছে পাঁচ লক্ষ কোটিরো বেশি টাকা।

কবিগুরুর গানের ভাষায়, এক তরফে “শুধু যাওয়া”, আর এক তরফে “শুধু আসা”!

সাধারণ মানুষকে এই সব ভেতরের তথ্য বুঝতে হবে। বুঝতে শিখতে হবে। শাসক শ্রেণি ও তাদের দারোয়ানদের মিস্টি মিস্টি মিছে বুলিতে ভুললে চলবে না। ব্যাপমের কারবারিরা সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে পারে কিনা ভেবে দেখতে হবে। বিজয় মাল্য ললিত মোদীকে যারা নিরাপদে দেশের বাইরে পাড় করে দেয় তারা কালো টাকা জাল টাকার বিরুদ্ধে সত্যিই কিছু করতে পারে কিনা ভেবে দেখা দরকার।

[৪] দুর্ভোগ সহজে মিটবে না

জনগণকে দেবার জন্য নতুন ৫০০ টাকার নোট কিন্তু ব্যাঙ্কে এখন সহজে ঢুকবে না। অল্প অল্প করে ছাপা হবে আর ঢুকবে। বন্যাত্রাণে সরকারি চিড়ের প্যাকেটের মতো। কিছু লোক কিছু কিছু টাকা পাবেন। তাঁরা “আর মাত্র কটা দিন” বলে সান্ত্বনা বাতাস ছড়াবেন! অনেকেই পাবেন না। বা, প্রয়োজন মতো পাবেন না। আর একটা জিনিসও লক্ষ করবেন: নতুন ২০০০-টাকার নোটে এক জায়গায় হিন্দি অঙ্কে সংখ্যাটা লেখা ফলে কাজটা সুস্পষ্টভাবে সংবিধান প্রদত্ত নির্দেশের বিরোধী কাজ হয়েছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, কোনো কোনো রাজ্যের হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলাও শুরু হয়েছে। সুতরাং উজ্জ্বল সম্ভাবনা আছে, এই নোটও কিছুদিন পরে বাতিল হয়ে যাবে। আবার তখন জনসাধারণকে একইভাবে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। এই কাজটাও যে মোদী এবং তাঁর ভক্ত উর্জিত প্যাটেল সাহেবরা একেবারে না বুঝে তাড়াহুড়োয় অখেয়াল বশত করে ফেলেছেন—তা বোধ হয় নয়।

ওঁরা ওঁদের কাজ বুঝেশুনেই করেন। আমরাও আমাদেরটা দিকটা এইবার বুঝে নেব কিনা আমাদের ব্যাপার!