রাতের বেলা পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকালে মনে হয় অজস্র তারকা আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। আমাদের অস্তিত্বের সাথে, সভ্যতার সাথে এসব তারকার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আজ থেকে লক্ষ বছর আগেও আমাদের পূর্বপুরুষরা রাতে আকাশের তারকাদের দিকে তাকিয়ে হয়ত নিজেদের কল্পনার ফানুশ মেলে দিতেন। আধুনিক যুগে এসে দিক নির্ধারণ, কৃষি কাজের উপযুক্ত সময় বের করা, জাহাজ চালানো ইত্যাদি ক্ষেত্রে নক্ষত্রদের উপর নির্ভরতা কমে গেছে। কিন্তু আমাদের পূর্ব-পুরুষরা খালি চোখেই অসংখ্য নক্ষত্র এবং এদের প্যাটার্ণ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। একসময় বিভিন্ন প্রাণী ও পরিচিত ব্যবহারিক সামগ্রীর সাথে মিল দেখে সেই অনুযায়ী তারা নাম দেন বিভিন্ন তারকা মণ্ডলীর। এদের ঘিরে অসংখ্য মিথ এখনো প্রচলিত আছে। আমরা ধীরে ধীরে জানতে পেরেছি এদের সম্পর্কে, প্রকৃত তথ্য পেরেছি উদ্ধার করতে। আকাশে যেসব তারা দেখতে পাই এদের সবগুলো কিন্তু সত্যিকার অর্থে ‘তারা’ নয়। যেগুলো মিটিমিটি করে না এবং উজ্জ্বলতার পরিবর্তন হয় প্রতিনিয়ত সেগুলো আসলে গ্রহ যা কোনো একটি নক্ষত্রকে প্রদক্ষিণ করছে।
আমাদের পৃথিবী সূর্য নামক নক্ষত্রের একটি গ্রহ। সূর্যের মত এরকম ছোট-বড় নানা আকৃতির অসংখ্য নক্ষত্র এক সাথে মিলে গ্যালাক্সি তৈরী করে। নক্ষত্রগুলো গ্যালাক্সির অভ্যন্তরে নিয়ত ভ্রমণশীল। আমাদের সূর্য যে গ্যালাক্সিতে অবস্থান করছে সেটা খুবই মনোহর। তার নাম মিল্কিওয়ে বা আকাশগঙ্গা, যার ব্যাস অন্তত এক লক্ষ আলোকবর্ষ(আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে সেটাকে আলোকবর্ষ বলা হয়। আলো এক সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার অতিক্রম করে)।এই সর্পিলাকার গ্যালাক্সিতে মোটামুটি ২০০ থেকে ৪০০ বিলিয়নের মত বিভিন্ন আকারের নক্ষত্র আছে।
আমাদের পাশের গ্যালাক্সির নাম হচ্ছে এন্ড্রোমিডা, যা আমাদের থেকে সাড়ে বিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এটিও সর্পিলাকার আর এতে তারকা রয়েছে প্রায় এক লক্ষ কোটি।
মিল্কিওয়ে
এন্ড্রোমিডা
এন্ড্রমিডা গ্যালাক্সি প্রতি সেকেন্ডে ১১০ কিলোমিটার গতিতে মিল্কিওয়ে এর দিকে ধাবিত হচ্ছে। ধারণা করা হয় ৪০০ কোটি বছরের মধ্যে গ্যালাক্সিদ্বয় প্রলয়ঙ্করী সংঘর্ষের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে গিয়ে মিল্কোমেডা নামক গ্যালাক্সি গঠন করবে।চারশত কোটি বছর অনেক সময়, এর মধ্যে আমরা হয়ত আন্ত:গ্যালাকটিক সভ্যতা গড়ে তুলব এবং এ ধরণের ঘটনা কোনো প্রভাবই ফেলবে না আমাদের মাঝে!
এভাবে অগণিত গ্যালাক্সির সন্ধান পাবেন। এগুলোর নাম দেয়া সংগত কারণেই বেশ জটিল। তাই বিজ্ঞানীরা খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এদের নামকরণের ব্যবস্থা করেছেন। যেমন: NGC 7793। এই তালিকা দেখেন। গ্যালাক্সিগুলোর আঁকারও বেশ বিচিত্র। আমাদের মিল্কিওয়ে সর্পিলাকার, কোনোটা আবার ডিম্বাকার, উপবৃত্তাকার আবার কোনোটি অনিয়ত আকারের।
(এখানে একটি মজার প্রশ্ন করি। আমরা জানি বিগ ব্যং এর পরে প্রায় সমপরিমাণ ম্যাটার ও এন্টিম্যাটার ছিল। এমন হওয়া কি সম্ভব নয় যে বেশ দূরবর্তী কোনো এক গ্যালাক্সি পুরোটাই এন্টিম্যাটার দিয়ে তৈরী?)
অনেকগুলো নক্ষত্র মিলে যেভাবে একটি গ্যালাক্সি গঠন করে সেরকমভাবে গ্যালাক্সিগুলো মিলে কি কোনো বড় আকারের দল বা গুচ্ছ গঠন করে? উত্তর হচ্ছে, হ্যা। পুরো মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে, যেন এক ত্রিমাত্রিক মহাজাগতিক জাল। এর কিছু কিছু অংশকে আমরা তাদের অবস্থান, দূরত্ব ও পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে গ্যালাক্সিগুচ্ছ বলে ধরে নিতে পারি। এই ভিডিও দেখেন।
গোটা পঞ্চাশেক গ্যালাক্সি মিলে গঠন করতে পারে একটি গ্যালাক্সি গ্রুপ। আবার শ´ থেকে হাজার খানেক গ্যালাক্সি মিলে গঠন করতে পারে একেকটি গ্যালাক্সি গুচ্ছ। আমাদের গ্যালাক্সি গ্রুপের নাম লোকাল গ্রুপ। কয়েক দশক আগ থেকে ধারণা ছিল আমাদের লোকালগ্রুপ সহ শ´ খানেক গ্যালাক্সি গ্রুপ আর গ্যালাক্সিগুচ্ছ নিয়ে ভার্গো নামক গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জ গঠিত। পরে ২০১৪ সালের দিকে এসে দেখা গেল এই ভার্গো আসলে তার থেকে শত গুণ বড় লানিয়াকেয়া নামক গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জ এর অংশ। এখন পর্যন্ত গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জই মহাবিশ্বের সবচেয়ে বড় কাঠামো।
লানিয়াকেয়ার গল্প
বেশ মিষ্টি একটা নাম `লানিয়াকেয়া´। হাওয়াই ভাষার এই শব্দের মানে হচ্ছে `অমিত স্বর্গ´। লানি মানে হচ্ছে স্বর্গ আর আকেয়া মানে হচ্ছে মহাকায়, অপরিমাপেয়। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের আর ব্রেন্ট টালি এবং লিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলেনে কোর্টোয়েস এর দল গ্যালাক্সিগুলোর আপেক্ষিক বেগ অনুসারে গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জ নির্ধারণের নতুন পন্থা বের করেন যা প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। আর এর মধ্যে দিয়েই সনাক্ত হয় স্বপ্নের লানিয়াকেয়া, তৈরী হয় এর মানচিত্র।
.
লানিয়াকেয়ার ব্যাস ৫০ কোটি আলোকবর্ষ এবং তাতে প্রায় এক লক্ষ গ্যালাক্সি রয়েছে। কিভাবে লানিয়াকেয়াকে সনাক্ত করা হল, এবং এর আকার আকৃতি সম্পর্কে ত্রিমাত্রিক ধারণার জন্য এই ভিডিও দেখতে পারেন
গ্যালাক্সিগুলোকে ছোট ছোট বিন্দু দিয়ে চিহ্নিত করলে তা বিভিন্ন আকারের ত্রিমাত্রিক কাঠামো তৈরী করে, এগুলোকে ছোট পরিসরে দেখার চেষ্টা করলে অসংখ্য ডট বা বিন্দুর সামাহার বলে মনে হবে যেখানে একেকটি ডট বা বিন্দু একেকটি গ্যালাক্সি। নিচে লানিয়াকেয়ার চিত্র ও তাতে আমাদের মিল্কিওয়ের অবস্থান দেখানো হচ্ছে, মিল্কিওয়ে বেশ বাইরের দিকে, তাই না?
এবার প্রশ্ন হচ্ছে অসংখ্য গ্যালাক্সির এই সমাহার থেকে কোন অংশটি লানিয়াকেয়া সেটা কিভাবে নির্ধারণ করা হল।
ধরুন, আমাদের সূর্যকে দেখা সম্ভব নয় কোনো কারণে। তাহলে কি আমরা সূর্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারব? অবশ্যই পারব, শুধু অস্তিত্ব নয় বরং সূর্য কত দূরে আছে এর ভর কত থেকে আরম্ভ করে বেশির ভাগ তথ্যই উদগাটন করা সম্ভব।। প্রথমেই যখন দেখা যাবে গ্রহগুলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটা বস্তুর চারদিকে ঘুরছে, তখনই অতি সহজে আমরা বুঝতে পারব কেন্দ্রে গ্রহগুলোর তুলনায় অনেক ভারী কোনো একটা বস্তু আছে। এভাবে কোনো একটি ভারী বস্তুর প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট সম্পর্কে অনেক তথ্যই জানা সম্ভব এর আশেপাশের বস্তুগুলোর আচরণ পর্যবেক্ষণ করে।
আমাদের মিল্কিওয়ে ঘন্টায় ২২ লক্ষ কিলোমিটার বেগে ছুটছে একটি নির্দিষ্ট দিকে। কিন্তু কোন দিকে ছুটছে আর কেন? বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ থেকে দেখা যায় মহাজাগতিক সস্প্রসারণের তুলনায় এ বেগ বেশ অপ্রত্যাশিত। আরো দেখা গেল আশেপাশের অন্যান্য গ্যালাক্সিগুলোও একই দিকে ছুটছে। পর্যবেক্ষণ ও হিসাব থেকে দেখা গেল আমাদের থেকে ১৫ কোটি আলোক বর্ষ দূরের বিশাল ভরের কোনো বস্তু এদেরকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে। এর নাম দেয়া হল Great-attractor বা মহা-আকর্ষক। এই মহা-আকর্ষকের দিকে ধাবমান সকল গ্যালাক্সি মিলে একটি মহা-পুঞ্জ গঠন করেছে ধরে নেয়া যায়। এটিই লানিয়াকেয়া।
মহা-আকর্ষক কিন্তু নতুন আবিষ্কৃত বিষয় নয়। কয়েক দশক আগ থেকেই বিজ্ঞানীরা এর অস্তিত্ব এমনকি অবস্থান সম্পর্কেও জানেন। ১৯৭০ এর দশকে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। মহা-আকর্ষক লানিয়াকেয়াকে সাথে নিয়ে পাশের বিশাল ভরের গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জ শাপলির দিকে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। অতি সম্প্রতি মহা-আকর্ষক এর উপর কিছু গভীর পর্যবেক্ষণের ফলে বেশ কিছু নতুন গ্যালাক্সির সন্ধান পাওয়া গেছে। যাই হোক, যেসব গ্যালাক্সি মহা-আকর্ষকের দিকে ধাবিত না হয়ে বিপরীত দিকে ধাবিত হচ্ছে তারা নিশ্চয়ই ভিন্ন কোনো মহাপুঞ্জের অংশ। যেভাবে পানির প্রবাহ দুটি ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে ভিন্ন দিকে যাত্রা করে সেভাবেই গ্যালাক্সিগুলো নিজ নিজ মহাপুঞ্জের গন্তব্যের দিকে ছুটে চলছে। এ থেকে আমরা সহজেই আলাদা করতে পারি অগণিত গ্যালাক্সি মেলার কোনগুলো লানিয়াকেয়ার অংশ আর কোনগুলো ভিন্ন গ্যালাক্সিপুঞ্জের অংশ।
বাম দিকের কালো আকৃতির গ্যালাক্সি মহাপুঞ্জই লানিয়াকেয়া, ডানদিকের লাল আকৃতির গ্যালাক্সি মহাপুঞ্জ পারসিয়াস পাইসিজ। ভিডিও লিংক।
লানিয়াকেয়ার নিকঠবর্তী গ্যালাক্সি মহাপুঞ্জগুলোর নাম হচ্ছে শাপলি, পারসিয়াস পাইসিজ, হারকিউলিজ, কোমা ইত্যাদি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, গ্যালাক্সিগুলো মিলে যেভাবে একটি মহাপুঞ্জ তৈরী করে সেভাবে গ্যালাক্সি-মহাপুঞ্জগুলো মিলেও কি আরো বড় ধরণের কোনো কাঠামো তৈরী করে? অন্তত শাপলির দিকে লানিয়াকেয়ার ছুটে চলা এরকম ইঙ্গিত দেয়। সে যাই হোক, এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা এখনো বিজ্ঞানীদের দিকে চেয়ে আছি।
লিংক:
১। http://sciencevibe.com/2016/02/12/mysterious-gravitational-anomaly-dubbed-the-great-attractor-now-being-investigated/
২। http://www.dailygalaxy.com/my_weblog/2016/02/solved-the-great-attractor-mystery-hundreds-of-previously-unknown-galaxies-discovered-hidden-behind-.html
৩। https://public.nrao.edu/news/pressreleases/supercluster-gbt
৪। http://www.iflscience.com/space/what-great-attractor-and-its-pull-our-galaxy
৫। http://www.skyandtelescope.com/astronomy-news/laniakea-home-supercluster-09032014/
এত সুন্দর উপস্থাপন। মুগ্ধ।
এরকম রচনা আরও বেশি করে প্রয়োজন। মহাকাশ এক চির বিস্ময়। লেখককে ধন্যবাদ তিনি ে কথা পুনর্বার মনে করালেন।
পোস্ট ভাল লেগেছে। সম্প্রতি অভিজিৎ রায়-মিজান রহমানের শুন্য থেকে মহাবিশ্ব বইটি পড়ছি। এই বিষয়ে আরো জানার আগ্রহ ছিল। ইউটিউবের ইউ আর এল সংগ্রহে রাখলাম। সময় করে দেখে নেব।
ধন্যবাদ রুশো
:good:
🙂
অসাধারণ। মুক্তমনা তার প্রাণ ফিরে পাক।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
সৈকত চৌধুরীকে লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ। মহাবিশ্বের গঠন ও গতির রহস্য শেষ হবার নয়।
ধন্যবাদ।
অনেক দিন পর আবার সৈকত চৌধুরী আবার সহজ করে বিজ্ঞান নিয়ে বাংলায় লেখা। বেশ অনেক দিন পর আবার স্বতস্ফুর্ত আর আগের মতই শক্তিশালী মনে হচ্ছে মুক্তমনাকে। অনেক ধন্যবাদ সৈকত চৌধুরী এত সুন্দর একটি উপস্থাপনার জন্য।
ধন্যবাদ আপনাকে।
ধন্যবাদ এই তথ্যের জন্য, সত্যি এগুলো জানতাম না, আরো দিন , জ্ঞানের পরিধি বাড়াই নিজের ও পরিচিত লোকেদের।
আবারো জানাই ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলী।