লেখকঃ আহমেদ শাহাব
খুব চমৎকার এবং অতি প্রয়োজনীয় একটি বিতর্ক সম্প্রতি বেশ জমে উঠেছে। বিতর্কের জন্মদাতা বাংলাদেশের একজন ডাকসাইটে মন্ত্রী জনাব নাসিম সাহেব।নজরুল জয়ন্তীর এক আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নজরুলের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন ‘জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক স্নেহ দিয়ে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। ভীনদেশে কবি নজরুলকে অনাদর করা হয়েছে” ফ্যাকড়া বেঁধেছে এইখানেই। নাসিম সাহেব ভীনদেশ বলতে কী বুঝাতে চেয়েছেন? নিজের জন্মভূমি নজরুলের কাছে ভীনদেশ হবে কেন? নজরুলকে নিয়ে একটি বিতর্ক অনেক আগেই ওঠা উচিৎ ছিল নাসিম সাহেব বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসুলভ কথা বলে সে বিতর্কের সুচনা করে ভালই করেছেন।
বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশেই নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিৎ। মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ঝড় বইছে।অনেক শক্ত শক্ত মন্তব্য পড়েছে। অনেকে মন্ত্রীকে কটাক্ষ করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় সত্তাকেই কটাক্ষ করে বসেছেন। এ কটাক্ষও সম্ভবতঃ আমাদের প্রাপ্য। আমরা এমনই এক জাতি যাদের জাতীয় সংগীত জাতীয় কবি দুটোই বিদেশ থেকে ধার করে আনা সে হিসেবে ওপাড় বাংলা হলো আমাদের দাতা আর আমরা হলাম তার গ্রহীতা। দাতা গ্রহীতার সম্পর্ক চিরকালই অসাম্যময়। বিশেষ করে দাতার সাথে সৌজন্যতা কৃতজ্ঞতাবোধ ইত্যাদি ব্যাপারে গ্রহীতাকেই সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।কিন্তু এই চিরন্তন ব্যাকরণ ভুলে গিয়ে যদি উল্টো গ্রহীতা দাতাকেই করুণা দেখাতে শুরু করে দান সামগ্রী অনাদর অবহেলায় ছিল বলে অভিযোগ তোলে তার প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়া স্বাভাবিক তেমনটিই হয়েছে। তবে ওপাড় বাংলার যারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তারা মন্ত্রী বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখানোর সাথে সাথে তাদের নিজ দেশের সরকারের কাছেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখতে পারেন কোন কারণে কোন পরিপ্রেক্ষিতে একজন বাংলাভাষী ভারতীয় কবিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তাদের নিজ দেশের একজন প্রখ্যাত কবির জীবনবৃত্তান্ত হালচাল ইতিহাস জানার অধিকার এবং দায়িত্ব দুটোই তাদের রয়েছে। কবি যদি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে অভিবাসী হতেন তবে প্রশ্ন উঠতনা কিন্তু নজরুল যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তিনি যেকোন ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহনের উর্ধে বিরল রোগে আক্রান্ত বাক এবং বোধশক্তি রহিত। এমন একজন অসুস্থ কবির সমুদয় দায় দায়িত্বতো রাষ্ট্রেরই নেয়ার কথা কিন্তু তা না করে কেন অন্য একটি দেশে তাকে হস্তান্তর করা হলো ? সেটা কি কবির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে না কি দায় এড়ানোর মানসিকতা প্রসূত ? এ দুটির একটিওতো যুক্তির ধোপে টেকেনা।
ভারততো তখনো ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আরো এক ধাপ এগিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সুতরাং ধর্মপরিচয়ের নিরিখে একজন কবির নাগরিকত্ব নিরুপনতো সেখানে অবাস্তব। এমনকি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত যেখানে একটি ধীর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ সময়েওতো এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবেনা।তবে কি মৈত্রী আর বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ নজরুলকে বাংলাদেশের কাছে সমর্পন করা হয়েছিল ?তাহলেওতো প্রশ্ন উঠবে কবি কি বস্তুবাচক কোনো উপহার সামগ্রী অথবা বিতর্কিত ছিটমহল যে ইচ্ছে হলেই তাকে বন্ধু রাষ্ট্রের হাতে তোলে দেয়া যায়? সব শেষে আসে দায় এড়ানোর প্রশ্নটি।ভারতের মতো একটি দেশ তার দেশের একজন অসুস্থ কবির দায় নিতে অপারগ বা অনিচ্ছুক এ যুক্তিতো আরো বেশী হাস্যকর। তাহলে সঠিক ব্যাখ্যা কোনটি? সেই সঠিক উত্তর দেয়ার দায়িত্ব ভারতীয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আর তা জানার দায়িত্বও ভারতীয়দের।
ভারতীয়দের সাথে সাথে বাংলাদেশীদেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাওয়া নজরুল কেন এবং কীকরে আমাদের জাতীয় কবি? কোন অধিকার বলে একজন বাক ও বোধশক্তিরহিত কবিকে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি থেকে শিকড় উপড়ে এদেশে নিয়ে আসা হলো? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা শিশুর মতো অসহায় মানুষটি কি এই অনিচ্ছুক অভিবাসনকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন? এর উত্তর আমরা কোনদিনও জানতে পারবনা। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়ার সঠিক ব্যাখ্যা কি তা জনগণকে অবহিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।আমরা আম জনতা অনুমানে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি। তুলে আনতে পারি এর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক। ধর্মীয় দিকটি হয়তো এরকম নজরুলের পূর্বাপর সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আরো পাঁচ ছয়জন প্রবল শক্তিধর কবি বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্রের মতো জ্বলছিলেন যাদের কাব্যকৃতি যথা সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হলে আরো একাধিক বাঙ্গালী কবি নোবেল প্রাইজে সম্মানিত হতে পারতেন। ঘটনাক্রমে নজরুল ব্যতিত এদের সকলেই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নজরুল মুসলমান সমাজের একক প্রতিনিধি হলেও তাঁর ব্যতিক্রমী আবির্ভাবকে সমালোচকরা বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল ধূমকেতুর সাথেই তূলনা করেন। নজরুলের কল্যাণেই অসংখ্য মুসলমানী শব্দ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মিথ বাংলা সাহিত্যে পংক্তিভুক্ত হয়। তাঁর অনেক কবিতা ও গান আমাদের মুক্তি সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূকিকা রাখে। এ দর্শন বাদ দিলেতো আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা পাওয়ার দাবীদার বরিশালে জন্ম নেয়া রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বা যশোরের মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু তা করতে পারলেতো আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি আদর্শ সেক্যুলার জাতি হয়ে যেতাম।বাস্তবেতো আমরা তা নই। এই ধর্মীয় পরিচয়কে মাথায় নিয়েই যদি নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয় তবে বলতে হয় সেটাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেক্যুলার চেতনার বিপরীতে প্রথম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত।
যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ও চেতনার বিরুদ্ধে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিধ্বস্থ বাংলাদেশের দগদগে ক্ষতের উপর দাঁড়িয়ে সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার কাছেই প্রথম আত্নসমর্পনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো। সেক্যুলার চেতনার সদ্য ভাঁজ খোলা চাদরে প্রথম ছিদ্রটিরও উদ্বোধন করা হলো এর মাধ্যমে।বর্তমানে আওয়ামীলীগের ছিদ্রাকীর্ণ সেক্যুলার গিলাপের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের যে স্বরুপ প্রায়শই বেরিয়ে আসে তার শুরু তাহলে সেই বিছমিল্লাহ থেকেই। অথবা বলা যায় এর পেছনে কোনো যুক্তিই কাজ করেনি এ ছিল নিছক মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মুসলমানের একটি যুক্তিহীন আবেগের প্রকাশ। জাতীয় সংগীতের মতো জাতীয় কবির কোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হুট করে ভিন দেশী একজন কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা এবং তড়িঘড়ি করে তাঁকে তাঁর জন্মভূমি থেকে ছিনিয়ে আনার মাঝে এক অদমিত আবেগও কাজ করে থাকতে পারে। সে আবেগ এতই দুর্নিবার ছিল যে একজন বাক-বোধ শক্তি রহিত কবিকে গ্রহণে হস্তান্তরে বাংলাদেশ ভারত দুই দেশই এক অভূতপূর্ব ও অযৌক্তিক ঘটনার জন্ম দিয়ে ফেলল।নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষনার আরেকটি রাজনৈতিক দর্শণও এখানে অনুমান করা যায়। বঙ্গবন্ধু হয়তো তাঁর সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় অনুমান করতে পেরেছিলেন সময়ের সাথে সাথে আবেগপ্রবন বাঙ্গালীর সেক্যুলার চেতনায় একদিন ভাটা পড়বে আর তার স্থান নেবে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি তখন রবীন্দ্রনাথ আর বাঙ্গালী রবীন্দ্রনাথ থাকবেননা হয়ে যাবেন ভারতীয় এবং হিন্দু রবীন্দ্রনাথ সে সাথে জাতীয় সংগীতটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। হিন্দু মুসলমানের ব্যালেন্স রক্ষার জন্যেই কি তাহলে নজরুলকে এক ধরনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? এ যুক্তি সত্য হলে একে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপূর্ণ দূরদর্শী মনে হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তাতে যে আমাদের মুখটি খুব উজ্জ্বল হয়নি তাও দিবালোকের মতো ধরা পড়ে। এতে করে ওপাড়ের কাছে আমাদের ঋণ ভারটা আরেকটু বেড়ে গেল। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতটার দীনতাটুকু আরো বেশী উন্মোচিত হলো। জাতীয় কবির অপশনটাকে ওপেন রেখে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? অতীতের কাউকেই এ আসনে বসাতে হবে এবং নবুয়তির মতো এ চাপ্টারেও সীলগালা লাগিয়ে দিতে হবে এমন বাঁধাধরা নিয়মতো সেখানে ছিলনা। ওপেন রাখলেই বরং আমাদের প্রতিভাবান কবিরা তাদের প্রতিভাকে আরেকটু ঝালাই ফালাই করার অনুপ্রেরণা পেতেন নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন হতো। জাতি হিসেবে তাতে আমরা উপকৃতই হতাম। জাতীয় কবির স্থানটি পূর্ণ হয়ে গেছে বলেই কি না কে জানে এখন দলীয় কবি হওয়ার প্রবনতা হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে।
ধনযবাদ.। আমি west bengal govt কাছে আপনার লেখার উপর ভিতি করে RTI করতে পারি?
দেখুন,মন্ত্রীর যে মন্তব্যের কারণে এই লেখা সেই লিংকতো দিলাম আপনি কিছু করতে চাইলে পত্রিকায় প্রকাশিত সেই খবরকেই ভিত্তি ধরে করতে পারেন।এতে আমার লেখার কোনো অংশ যদি আপনার কাছে সহায়ক মনে হয় তাও উদ্ধৃত করতে পারেন।আমার লেখার সাথে আরও অনেক বিদ্বজ্জনের অনেক মূল্যবান মন্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে তা থেকেও তথ্য নিতে পারেন।অনেক দিন পর আপনার প্রতিক্রিয়ার জন্য ধন্যবাদ।
“জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক স্নেহ দিয়ে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। ভীনদেশে কবি নজরুলকে অনাদর করা হয়েছে”
দযাকরে নাসিম সাহেবের বকতবের কোন লিনক বা তথয পাওয়া যাবে?
এই লিংকে দেখতে পারেন।www.ittefaq.com.bd/wholecountry/2016/05/25/69617.html
মন্ত্রী মহোদয়েরা নিজেদের ওজইন বুঝেন না। এ মন্ত্রী মহোদয়ই গত সপ্তহে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছেন, কোনো ডাক্তার হাসপাতালে ধূমপান করলে তাঁকে বান্দরবান পাঠিয়ে দেওয়া হবে! বান্দরবনকে খারাপ লোকের আখড়া বানানোর মেন্ডেট নিয়েই কি মন্ত্রী হয়েছেন?
খুব ভাল লাগলো
জাতীয় কবির দরকার আছে, আর সে পদের যোগ্য একজনই…..এরশাদ 🙂
এবার বুঝে নিন এ বিষয়ে মতামত দেয়ার যোগ্যতা আমার কতটুকু। তবে যদি সিরিয়াসলি নিজের মতামত দিতে বলেন, তাহলে বলবো জাতীয় কবির দরকার নেই।
প্রসঙ্গান্তরে, নজরুলের লেখায় সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ দেখতে পেয়েছেন কি? বরং তাঁর লেখায় সেসময়ের মুসলিম মানসিকতার সমালোচনাই দেখি; সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে রঙ্গ করতেও ছাড়েন নি। একথা ঠিক কবিতায় তিনি অনেক আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন, কিন্তু তার মানে এই না যে এই শব্দগুলোর অন্তর্ভুক্তির পেছন সাম্প্রদায়িক মনোভাব কাজ করেছে। বরং হতে পারে তিনি নিজের কবিতায় ভিন্ন ভাষার ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে টগবগিয়ে খুন (বিদেশী শব্দ) হাসিয়ে উল্লসিত হয়েছেন (কবিতায় খুন শব্দটি কিন্তু বেশ মানিয়ে গেছে)। আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাঁস গ্যেয়ি গানটির মত পাগলামি নজরুল ছাড়া আর কাকে মানাবে! বাংলা ভাষার জন্য এসব ভাল নাকি মন্দ হয়েছে তা বিদগ্ধ সমালোচকরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে আমাদের বাংলা ভাষায় প্রচুর বিদেশী শব্দ আছে, আরবি, ফারসি তো আছেই। বাংলা ভাষায় ফারসি শব্দের অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী মূলত প্রাক-ইংরেজ যুগে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে এর ব্যবহার। যাহোক, একটি জীবন্ত ভাষা অন্য ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে সমৃদ্ধ হবে এটা মনে হয় অস্বাভাবিক নয়।
হাহা হা এই ফসিল এরশাদ যে কি করে এখনো ধাপ্পাবাজী করেই যাচ্ছে বুঝি না ভাই।
ভালো বলেছেন। প্রগতি সংস্কৃতি পরিবর্তনশীল। যেসব পরিবর্তনগুলো মানুষ ভালোবাসে, চর্চা করে; সেগুলো আবার অনেক কাল টিকেও থাকে। জোর করে চাপাবার কিচ্ছু যেমন নেই আবার জোর করে ফেলে দেবার’ও কিছু নেই।
একদম ঠিক কথা! ভাষার ব্যবহার যারা করেন তারাই (হয়তো কখনও নিজের অজান্তেই) ঠিক করবেন তাদের ভাষায় কি সংযোজিত হবে আর কি বিয়োজিত হবে। কবি-সাহিত্যিকরা তাদের সাহিত্যকর্মে নতুন শব্দের ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু ভাষায় তার ব্যবহার বা জনপ্রিয়তা নিশ্চিত করতে পারেন না। জীবন্ত ভাষার বৈশিষ্টই এই, এখানে চাপিয়ে দেয়ার আসলেই কিছু নেই।
🙂
মনজুর মুর্শেদ, আপনার সাথে একমত
আমি জানি, বাংলার জনগন এরশাদ কে এখনও অনেক ভালবাসে 😉
“নজরুলের কল্যাণেই অসংখ্য মুসলমানী শব্দ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মিথ বাংলা সাহিত্যে পংক্তিভুক্ত হয়।”
তাঁর এই কৃতিত্বকে কল্যাণ না বলে অকল্যাণ বলাই শ্রেয়। সাহিত্যে বিশেষ কোনো ধর্মের শব্দ, ব্যক্তিত্ব ও পংঙতির অনুপ্রবেশ ঘটানো হলো সাম্প্রদায়িকয়ার বীজ বোনা পাঠকদের মনে। নজরুল তা করতে পুরোপুরি সফল হয়েছেন। একজন মানুষ একই সাথে কড়া হিন্দু, কড়া মোসলমান ও কড়া নাস্তিক হতে পারে না। নজরুল সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। এজন্যই এখনো চলছে তাঁকে নিয়ে কড়া হিন্দু ও কড়া মোসলমানদের কাড়াকাড়ি।
দুঃখিত ‘Reply’ ক্লিক করে উত্তর দিতে ভুলে গিয়েছি। আপনার মন্তব্যের উত্তর নীচে।
ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ!
ভুল বললেন।
যেকোন জীবন্ত ভাষাই অপরাপর ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে। এটা সদা চলমান। এতে ভাষা সমৃদ্ধই হয়।
সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত প্রচুর আরবি/ ফারসি শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। এতে উনি কি সাম্প্রদায়িকতা আমদানি করেছেন? মনে হয় না।
তবে জোর করে ‘সাম্প্রদায়িক’ আকাঙ্ক্ষায় কেউ এরকম শব্দ প্রচলনের চেষ্টা করলে তার অবস্থা ফররুখ আহমেদের মতো হওয়াটাই স্বাভাবিক।
আপনার মন্তব্যের সাথে একমত নই। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল বাংলা ভাষার কবি, তাঁদের দেশ-কালের সীমানা দিয়ে মাপা ঠিক হবে না। আর তাছাড়া বাংলা ভাগ হওয়ার বহু আগে থেকেই তাঁদের সাহিত্যকর্ম পুরো বাংলাতেই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, তাঁরা বাঙ্গালী কবি হিসাবেই সার্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। দেশভাগের আগেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হয়; কাজী নজরুল ইসলামও দেশভাগের আগেই স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হয়ে দূরারোগ্য দৈহিক ও মানসিক বৈকল্যের শিকার হন। বেঁচে থাকলে, বা স্বাভাবিক থাকলে, তাঁরা পাকিস্তানের নাগরিকত্ব নিতেন না একথা প্রায় নিশ্চিত। তারপরেও সাতচল্লিশে দেশভাগের প্যাঁচে পড়ে ভৌগলিক সীমানা পরিবর্তনের সাথে সাথে তাঁরা কেবল ভারতীয় কবি হয়ে গেলেন, আর সেই সাথে আমরা পূর্ববঙ্গের বাঙ্গালীরা তাঁদের বা তাঁদের সাহিত্যকর্মের উপর থেকে সব অধিকার হারালাম, এমন ধারনা মোটেই যৌক্তিক নয়।
আমাদের তোষামুদে নেতাদের কেউ কেউ অতি-আবেগায়িত হয়ে হাস্যকরভাবে রবীন্দ্র-নজরুলকে কেবল বাংলাদেশের কবি হিসাবে দাবী করছেন। এতে তাদের অজ্ঞতা আর গায়ের জোরে সত্য বিকৃত করার চলমান প্রবণতাটিই প্রকাশ পেয়েছে। তবে, জীবন সায়াহ্নে পশ্চিমবঙ্গে রোগে কাতর, অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব নজরুলকে দেখার মত কেউ যখন ছিল না, তখন তাঁকে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে পূণর্বাসন করে বঙ্গবন্ধু ঠিক কাজটিই করেছিলেন। আমি ভেবে আশ্চর্য হই যে বঙ্গবন্ধুর এই মানবিক আচরণকে আজ রাজনৈতিক আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, বলা হচ্ছে তিনি নজরুলকে ছিনিয়ে এনেছেন। কেউ যদি একটু বুঝিয়ে বলতেন কিভাবে বঙ্গবন্ধু বাঙ্গালী কমান্ডো পাঠিয়ে নজরুলকে পরিবার আর তাঁর প্রিয় দেশবাসীর কাছ ছিনিয়ে এনেছিলেন আর কিভাবে ভারত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা প্রতিরোধ করতে পারে নি, তাহলে এ বিষয়ে আমার সম্যক জ্ঞান বৃদ্ধি পেত! একজন মানুষের সদিচ্ছা আর ভাল কাজের সমালোচনা করা সহজ; তাঁর মনের গভীরে আসলে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর সাম্প্রদায়িকতার বীজ লুকানো ছিল তা নিয়েও চায়ের কাপে ঝড় তোলা যায়; তবে আসল প্রশ্ন থেকেই যায় যে নজরুলের শেষ জীবনে পশ্চিমবঙ্গে কেন স্বজন, সহকর্মী এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ/ভারত সরকার তাঁর পাশে দাঁড়াতে পারে নি!
নজরুলের জীবনের অসহায় শেষদিনগুলোতে বাংলাদেশ তার সীমিত সাধ্য নিয়ে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে, সম্মান দিয়েছে, তাতে জাতি হিসাবে আমাদের শির চির উন্নত হয়েছে।
আপনার মন্তব্যের অনেকাংশের সাথে সহমত পোষন করছি। অবে একজন কবিকে জাতীয় কবি ঘোষণা করার মানে বা প্রয়োজনীয়তা আসলে কী? আমাদের জাতীয় অন্যান্য অনেক জিনিস যেমন রয়েছে তেমনিই কি একজন জাতীয় কবিও থাকা চাই?
এই পোস্টটি যদি ব্লগের স্বর্ণযুগে লেখা হত তবে তুমুল উপভোগ্য একটি আলোচনা হত। তারপরও এই বিষয়টি যে অনেককেই ছুঁয়ে গেছে তার কারণ কবির প্রতি আমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।
যেই বিষয়টি বলতে চাচ্ছিলাম তা হচ্ছে আপনি কি এতটাই নিশ্চিত যে কবি ভারতে খুব শোচনীয় অবস্থায় ছিলেন? কবি পরিবারকে একটি সরকারী বাসা বিনা ভাড়ায় থাকার জন্য দেয়া হয়েছিল। প্রসংগত ওই সময়ের ভারতে খুব কম লেখককেই সরকারী বাসা দেয়া হত। তদুপরি কবির এক ছেলেকে সম্ভবত সরকারী চাকরিও দেয়া হয়েছিল। হ্যাঁ হয়ত এর কোন্টাই স্বচ্ছন্দেদে জীবনযাপন করার মত যথেষ্ট ছিল না। কিন্তু তখনকার ভারতে এর চেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে কালোবাজারি ছাড়া আর কেউই জীবনধারন করত না। এছাড়া তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল লন্ডন ও ভিয়েনায়। যা অবশ্য কোন ফল বয়ে আনেনি। কারণ এর কোনো চিকিৎসা ছিল না।
তাছাড়া যদি কবির প্রতি প্রকৃতই শ্রদ্ধা পোষণ করা হত তাহলে তাকে তার পরিচিত পরিবেশে রেখেই তা করা যেত। যদিও কবি তখন এর সবকিছুর উর্দ্ধে। উনি অনেকটা জীবন্মৃত হয়েই তখন বেঁচে ছিলেন। উনার জন্য কোন কিছু করা মানে তখন তা তার সন্তানদের জন্যই করা বোঝায়। তার স্ত্রী তখন মৃত এবং এক ছেলের অমতেই তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আদা হয়। কবির তখন কিছু বলবার বা বোঝার ক্ষমতা নেই তাই মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটাকে কি সঠিক বলা যায়? তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে তার পরিবারের একাংশের হয়তবা কিছু পার্থিব সুযোগপ্রাপ্তি হয়েছে। এছাড়া আর কিইবা হয়েছে। নজরুলকে জাতীয় কবি করা না হলেও তার যে বিদ্রোহী মানবিক ভাবমূর্তি তার কি কোনো ক্ষয় হত?
এছাড়া শুধুমাত্র স্বাধীন বাংলা কখনো তার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। সেখানে তাকে জাতীয় কবি বলা কি তাকে ছোট করা নয়? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অনেক ভারতীয় কবি সাহিত্যিকই তাদের লেখনী দিয়ে সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি তদানীন্তন সরকার কতটুকু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন? এ প্রশ্নও কি এখানে এসে যায় না?
কবির মৃত্যর পর কবির এক ছেলে যখন পিতার দেহ ভারতে তার পৈতৃক আবাসে কবরস্থ করার জন্য বাংলাদেশে রওনা দিয়েছেন তখন তাকে না জানিয়েই তড়িঘড়ি করে তাকে কবর দেয়াকেই বা কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায়?
পশ্চিমবঙ্গে শেষ জীবনে নজরুলের দূর্দশার বিষয়টি খুব সম্ভব মুজাফফর আহমেদের কোন লেখায় পড়েছিলাম। লেখাটি পড়ে পশ্চিমবঙ্গে কবির অবস্থা সম্পর্কে যা মনে হয়েছিল তা উপরের মন্তব্যে লিখেছি। নজরুলের রোগের শুরুতে সবাই তাঁকে সারিয়ে তুলতে যথাসাধ্য করেছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে আর কিছু করার নেই জেনে তাঁরা একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশে আনার ফলে তাঁর সেবা আর পরিচর্যায় একটা ধারাবাহিকতা এসেছিল। বঙ্গবন্ধু্র এই মানবিক কাজ আমাদের ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। যদি গবেষণায় বেরিয়ে আসে আমার উপরের কথাগুলো ভুল, তাহলে তা মেনে নিতে আমার অসুবিধা নেই।
একটি দেশের ভৌগলিক সীমা পরিবর্তনশীল। আজ ভারত বা বাংলাদেশের যে মানচিত্র, সময়ের সাথে তার পরিবর্তন হতে পারে। সেই ধারাবাহিকতায় একদিন কোন নতুন রাষ্ট্র তৈরী হলে সেখানকার জনগন নিজেদের সংস্কৃতি বা ভাষার সার্বজনীন প্রতিনিধিত্ব করেন এমন কাউকে নিজেদের জাতীয় কবি হিসাবে নির্বাচিত করতে পারেন। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ কবির কল্পনাতে না থাকলেও এই দেশে জাতীয় কবি বলায় তাঁকে ছোট করা হয় নি। রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাগ হোক তা চাননি, অথচ স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা তাঁর গান আজ আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গাইছি, আমার মতে এতেও তাঁকে ছোট করা হয় নি। তবে আমি এও মনে করি যে আমাদের দেশে একজন জাতীয় কবি থাকার সত্যি কোন দরকার নেই, কারন আমাদের প্রধান কবিদের মধ্য থেকে কেবল একজনকে জাতীয় কবি হিসাবে চিহ্নিত করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এ কেবল অহেতুক বিতর্কের সৃষ্টি করা; পাকিস্তান আমলে যেমন নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি হিসাবে দেখানোর চেষ্টা ছিল, এ যেন তারই ধারাবাহিকতা। অবশ্য বাংলাদেশে কিছুটা দূর্বলভাবে এখনও অনেকেই সেই চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
নজরুলকে ছোট করা হয় তখনই, যখন তাঁর আদর্শ বা দর্শন না বুঝে তাঁকে একটি বিশেষ ধর্মের কবি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, বা ভাষা বা ভৌগলিক সীমারেখায় বেঁধে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
মৃত্যুর পর স্বজনদের কাছে তাঁর মরদেহ ফিরিয়ে দিলেই সবচেয়ে ভাল কাজ হত।
সহমত। :good: তবে নিন্দুকের পোড়া মন ত সবকছুর মধ্যেই খালি খুঁত ধরে বেড়ায়।
মঞ্জুর মোরশেদ, আপনার সুলিখিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।তবে আপনার প্রতিক্রিয়ার প্রসঙ্গেই কিছু তথ্যের উল্লেখ করা এখানে প্রয়োজন মনে করছি।‘ধার করে আনা’ লাইনটি ব্যবহার করাতে আমাকে যতটুকু অসংস্কৃত এবং কট্টর টাইপের মনে হয় আসলে আমি ততটুকু নই।মন্ত্রী মহোদয়ের অসংযত মন্তব্যের কারণে তাকে ধোলাই দিলে কিছু যায় আসেনা কিন্তু যখন পুরো দেশ নিয়ে কটাক্ষ করা হয় তখন এই শব্দ কটি ব্যবহার করা ছাড়া আমার উপায় ছিলনা। পূর্ববর্তি লাইনটি মনযোগ দিয়ে পড়লেই আশা করি এর যথার্থতা বুঝতে পারবেন।আর হাঁ চিনিয়ে আনা ব্যাপারটি আপনাকে কিছুটা সংক্ষুব্ধ করেছে বলেই মনে হয়।চিনিয়ে আনাকে এত নৈনার্থক ভাবে নিচ্ছেন কেন ? ইলেকশন বা প্রতিযোগিতা করে যে জিনিষটি আমরা চিনিয়ে আনি তা সর্বত্র ও সর্বজনে পরম কাংখিত।আর এ চিনিয়ে আনার কাজটি শুধু কমান্ডো পাঠিয়েই করতে হয় কে বলল ? ছল বল কৌশল প্রয়োগ করেও চিনিয়ে আনা যায়। আমরাতো অনেকটা প্রতিযোগিতা করেই নজরুলকে চিনিয়ে এনেছি।তাঁর জন্মভূমিতে তাঁকে যে সেবা দেয়া হচ্ছিল আমরা তাতে সন্তুষ্ট ছিলামনা বলেছিলাম আমরা আরো বেশী দেব।সেটাওতো একটা প্রতিযোগিতা না কি ? অবশ্য এ ক্ষেত্রে নিন্দুকেরা যদি মায়ের ‘চাইতে মাসীর দরদ’ প্রবাদ দিয়ে খুঁচা দিতে চায় দিকনা একটু খানি মোদ্দা কথা চিনিয়েতো এনেছি।নজরুলের শেষজীবনে তাঁর আর্থিক দুরাবস্থা বিষয়ে আপনার বক্তব্য মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের বক্তব্যের সাথে অভিন্ন।পশ্চিম বাংলা তথা ভারত সম্ভবতঃ এতে ভিন্নমতই দেবে। সমকালীন তথ্য উপাত্ত ও তার সত্যতা প্রমান করেনা।কবির জন্য সরকার প্রদত্ত সুযোগ সুবিধা বিষয়ে ইতোপূর্বে উল্লেখিত হয়ে গেছে।আমার এক বন্ধু ফেসবুকে তার প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন নজরুলের চিকিৎসার জন্য পশ্চিম বাংলার কবিভক্তরা ‘নজরুল ট্রিটমেন্ট সোসাইটি’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন।এ সোসাইটির মাধ্যমেই কবির চিকিৎসার ব্যায়ভার বহন করা হতো।ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের অনেক অভিযোগ আছে কিন্তু ভারত গুণীর মর্যাদা দানের ব্যাপারে আমাদের তূলনায় কৃপণ এতবড় অভিযোগ কি আমরা দাঁড় করাতে পারি ?পারলেতো বর্তেই যেতাম।ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব ভারতের মাইহারে দরবার না করে যদি তাঁর জন্মস্থান ব্রাম্মণবাড়িয়াতেই করতেন তবে তাঁর প্রতিভার দ্যুতি কতদুর ছড়াত তা আমরা অনুমান করতে পারি।অতি সম্প্রতি খাঁ সাহেবের সকল স্মারক তাঁর জন্মস্থানেই আমাদের প্রতিভা আর প্রগতিবিরুধী আগুণে ভষ্মীভূত হয়ে গেছে।এটি একটি দৃষ্টান্ত।এরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত আছে। হাঁ এটা আপনি ঠিক বলেছেন কবি আর কবিতার কোনো ভৌগলিক সীমারেখা নেই।রবীন্দ্র নজরুল খন্ডিত নয় সমগ্র বাংলারই কবি।রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটিও সেই খন্ডিত বাংলার বিরুদ্ধে এবং অখন্ড বাংলার স্বপক্ষেই রচিত হয়েছিল।তবু আমরা আমাদের মহত্ব দিয়ে সেই গানটিকেই খন্ডিত বাংলার জাতীয় সংগীত বানিয়েছি।এতটুকু মহত্ব যেহেতু আমরা দেখাতে পারলাম তাহলে রবীন্দ্রনাথকে কেন আমরা জাতীয় কবি ঘোষণা করতে পারলামনা ?এখানে আমি রবীন্দ্রনাথ বড় না নজরুল বড় এরকম বালসুলভ তূলনায় যাচ্ছিনা শুধু স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে আমাদের সমকালীন সমাজ ও রাজনীতিতে দুজনের গুরুত্ব ও অবস্থান বিষয়ে কিঞ্চিত আলোকপাত করতে চাই।স্বাধীনতা পূর্ব রাজনীতির সেই উত্তাল সময়ে আমাদের সংস্কৃতি বলয়ে রবীন্দ্রনাথ যে বেশ বড় একটি ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছিলেন তাতো সর্বজনবিদিত।এজন্য পাকিস্তান ও তার পন্থীদের অবিমৃষ্যকারীতাই প্রধানতঃ দায়ী।একটি স্বাভাবিক রবীন্দ্রচর্চা রবীন্দ্র অনুশীলনের মাঝেও তারা একধরণের জুজুর অস্থিত্ব আবিষ্কার করে বসে।তাদের সন্দেহপ্রবন মনে এই বিশ্বাস জন্মে যে পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চ্চা একটি জাতীয়তাবাদী সংস্কৃত আন্দোলনের সূচনা করতে পারে যা পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠবে।রবীন্দ্রনাথকে তারা বড় এক প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলল।পূর্বপাকিস্তানের সেই বিখ্যাত কর্তাভজা গভর্নর মোনায়েম খাঁতো আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হুংকার ছেড়ে বলেই বসলেন ‘রবীন্দ্র সংগীত রবীন্দ্র সংগীত বলে চিল্লা চিল্লি করেন নিজেরা রবীন্দ্রসংগীত লিখতে পারেননা ? মোনায়েম খাঁর এই বিখ্যাত উক্তিকে সবাই ব্যঙ্গার্থে উল্লেখ করেন কিন্তু এর গভীরে যে একটি গভীর তাৎপর্য লোকিয়ে আছে সে ব্যাপারে কেউ আলোকপাত করেছেন বলে মনে হয়না।মোনায়েম খাঁ অশিক্ষিত মূর্খ ছিলেননা কিন্তু নিজের সংস্কৃতি সম্বন্ধে কতটুকু অবজ্ঞা আর অজ্ঞতা থাকলে পরে এরকম মন্তব্য করা যায় তা ভাবতেই বিষ্ময় লাগে।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বাঙ্গালীদের মাঝেও যে এমন একটি স্বসংস্কৃতিবিবর্জিত সমাজ গড়ে উঠেছিল মোনায়েম খাঁ তার জলজ্যান্ত উদাহরণ।
…. পরের মন্তব্য দ্রষ্টব্য
পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ পূর্ব পাকিস্তানকে এই আদলে গড়ে তুলে পাকিস্তানের অখন্ডতাকে চিরকালীন রুপ দিতে।তারা রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করে দিল।কিন্তু ভুলে গেল নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাঁধ দিয়ে আটকে রাখতে চাইলে সেই সঞ্চিত প্রবাহ বাঁধ ভাঙ্গার জন্য প্রমত্ত হয়ে ওঠে।বাস্তবেও হলো তাই সংস্কৃতি আন্দোলনের বাঁধভাঙ্গা প্রবাহটি স্বাধীনতা আন্দোলনের বৃহৎ ধারাটির সাথে একাকার হয়ে তাকে আরো প্রবল ও অপ্রতিরুদ্ধ করে তুলল।এদিকে নজরুলকে নিয়ে পাকিস্তানীরা তাদের এদেশীয় দোসরদের নিয়ে নতুন ষঢ়যন্ত্রে নামল।এক্ষেত্রে তারা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি অবলম্বন করল।তাদের কাছে রবীন্দ্র নজরুলে কোনো ব্যবধান ছিলনা বরং রবীন্দ্রনাথ থেকে নজরুলই তাদের আদর্শের পরিপন্থী লেখা বেশী লিখেছেন।কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে প্রতিরোধ করতে নজরুলকে সামন্তরাল শক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর বিকল্প ছিলনা।যদিও সেই সময় নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ ‘এই শিকল পরা ছল’ জাগো অনশন বন্দী উঠরে যত’এইসব কালজয়ী গণসংগীত তৎকালীণ বাম আন্দোলনকে ভীষনভাবে উজ্জিবিত করছিল কিন্তু পাকিস্তানপন্থীরা তার বিপরীতে নজরুলের ইসলামী গান ও গজল নিয়ে মাঠে নামে।এই দ্বৈরথে নজরুলের বহু মাত্রিক পরস্পর বিরুধী পরস্পর সাংঘর্ষিক বিচিত্র রচনা সম্ভার দুই যুদ্ধরত প্রতিপক্ষকেই উপযোগি অস্ত্র সরবরাহে অকৃপণ ছিল।এককালে তাঁকে যারা কাফের নাস্তিক বলে হেনস্থা করেছিল সেই ‘মৌ-লোভী যত মৌলভী তত মোল্লারা’ই তাকে ইসলামী কবি বানিয়ে রবীন্দ্রনাথের উপরে বসিয়ে দিতে সচেষ্ট হল।তারা কৌশলে সাধারণে এই ধারণাও ছড়িয়ে দিতে লাগল নজরুলেরই নোবেল পাওয়ার কথা ছিল কিন্তু রবীন্দ্রনাথ কৌশলে তা নিজেই বাগিয়ে নিয়েছেন।তারা নজরুলকে ইসলামী কবি বানাতে গিয়ে একটি জঘন্য কাজ করে বসল।সেসময় পাঠ্য বইয়ে নজরুলের তরুণের অভিযান’ শীর্ষক বিখ্যাত রণ সঙ্গীতটির ‘নব নবীনের গাহিয়া গান সজীব করিব মহা শ্মশান’এর মহাশ্মশান শব্দটিকে বদলিয়ে গোরস্থান করে দিল।মহাশ্মশানকে সজীব করলেতো সেখান থেকে হিন্দু বেরিয়ে আসবে তাতে মুসলমানের কি?অতএব মুসলমানকে জাগাতে হলেতো গোরস্থানকে সজীব করতে হয়।কিন্তু এই মুসলমান সঞ্জীবন প্রকল্প সম্পাদন করতে গিয়ে যে কবিকেই হত্যা করা হল এ বোধ কি তাদের ছিল ?একজন জীবমৃত কবির অমতে তার লেখায় এরকম জঘন্য কাঁচি চালানো সত্যিই নজীরবিহীন।কিন্তু এই ধান্ধাবাজ আহম্মকেরা কি জানতোনা নজরুলের কবিতা থেকে এক দুইটি শব্দকে ধর্মান্তর করালেই তাঁকে খাঁটি মোমিন মুসলমান বানানো যাবেনা।তাঁর সাহিত্য থেকে হিন্দুয়ানী অনুসঙ্গ ছেটে ফেললে যে নজরুল লোম বাছতে কম্বল উজাড় অবস্থায় উপনীত হবেন। পাকিস্তানীদের কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার কৌশল সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলেও বাঙ্গালী মুসলমানের মাথায় নজরুল বিষয়ক যে ধারণা তারা ঢুকিয়ে দিয়েছিল তা আজও সক্রীয় আছে বলেই মনে হয়।গোগলে সার্চ করলেই নজরুলকে রবীন্দ্রনাথের উপরে স্থান দেয়া অনেক ব্লগের সন্ধান পাওয়া যায়।কে জানে নজরুলকে যখন জাতীয় কবি ঘোষণা করা হয় তখনও এই মানসিক সংকটই অবচতনে কাজ করেছিল কি না।
দারুন লিখেছেন। এই প্রসংগটি আরো আগেই একটি বিতর্কিত বিষয় হিসেবে আলোচিত হওয়া উচিৎ ছিল। বাংলাদেশের চিন্তাশীল জগতে তা সে মুক্তমনা বামপন্থী দলীয় বা দলনিরপেক্ষ যাই হোক না কেন কখনোই কাউকে এ বিষয়ে কিছু বলতে শুনিনি। বোধহয় সেই চিরাচরিত ধর্মীয় বা জাতীয়তাবাদী সংকীর্ণ মানসিকতাইই এর কারণ। যা থেকে অনেক মুক্তমনা পরিচয়ধারীরাও মুক্ত নন।
নজরুল ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী কবি হওয়া সত্ত্বেও তাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি করার পেছনে ধর্মীয় কারণই দায়ী। আমার ধারনা কবি যদি সজ্ঞান থাকতেন তাহলে উনি কখনোই এতে রাজী হতেন না। প্রসংগত যতদূর জানি তার এক ছেলের অমতেই কাজটি সংঘটিত হয়েছিল।
নজরুল শুরু থেকেই ধর্মভিত্তিক ভারতভাগের তীব্র বিরোধী ছিলেন। তদুপরি বাংলাদেশের সাথে তার শৈশবের এক বছর ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোন মানসিক বা আত্নিক সম্পর্ক ছিল না। তাই পাকিস্তান থেকে থেকে স্বাধীন হয়ে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলেও নজরুল সেখানে স্বেচ্ছায় জাতীয় কবির পদ নিয়ে চলে আসতেন তা নজরুলের আজন্ম বিদ্রোহী সত্ত্বার সাথে কোনোভাবেই মানানসই নয়। তাই নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া বঙ্গবন্ধুর একটা পলিটিকাল ও ধর্মীয় স্টান্টবাজী বলেই মনে হয়। যা বাক বোধশক্তিহীন কবির সাথে একধরনের ছেলেখেলারই নামান্তর। তাছাড়া উনি ত কখনো স্বাধীন বাংলার স্বপ্নও দেখেননি। উনার আজন্ম কাংখিত স্বপ্ন ছিল ভারতের স্বাধীনতা। সেখানে উনাকে বাংলাদেশের জাতীয় কবি করা কি তাকে খন্ডিত করে ফেলা নয়?