লেখকঃ আহমেদ শাহাব

খুব চমৎকার এবং অতি প্রয়োজনীয় একটি বিতর্ক সম্প্রতি বেশ জমে উঠেছে। বিতর্কের জন্মদাতা বাংলাদেশের একজন ডাকসাইটে মন্ত্রী জনাব নাসিম সাহেব।নজরুল জয়ন্তীর এক আলোচনা সভায় স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম নজরুলের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে অনেকটা ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলেছেন। তিনি বলেছেন ‘জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনেক স্নেহ দিয়ে কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছিলেন। ভীনদেশে কবি নজরুলকে অনাদর করা হয়েছে” ফ্যাকড়া বেঁধেছে এইখানেই। নাসিম সাহেব ভীনদেশ বলতে কী বুঝাতে চেয়েছেন? নিজের জন্মভূমি নজরুলের কাছে ভীনদেশ হবে কেন? নজরুলকে নিয়ে একটি বিতর্ক অনেক আগেই ওঠা উচিৎ ছিল নাসিম সাহেব বাংলাদেশের একজন মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসুলভ কথা বলে সে বিতর্কের সুচনা করে ভালই করেছেন।

বাংলাদেশ এবং ভারত দুই দেশেই নজরুলকে নিয়ে বিতর্ক হওয়া উচিৎ। মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ঝড় বইছে।অনেক শক্ত শক্ত মন্তব্য পড়েছে। অনেকে মন্ত্রীকে কটাক্ষ করতে গিয়ে আমাদের জাতীয় সত্তাকেই কটাক্ষ করে বসেছেন। এ কটাক্ষও সম্ভবতঃ আমাদের প্রাপ্য। আমরা এমনই এক জাতি যাদের জাতীয় সংগীত জাতীয় কবি দুটোই বিদেশ থেকে ধার করে আনা সে হিসেবে ওপাড় বাংলা হলো আমাদের দাতা আর আমরা হলাম তার গ্রহীতা। দাতা গ্রহীতার সম্পর্ক চিরকালই অসাম্যময়। বিশেষ করে দাতার সাথে সৌজন্যতা কৃতজ্ঞতাবোধ ইত্যাদি ব্যাপারে গ্রহীতাকেই সব সময় সতর্ক থাকতে হয়।কিন্তু এই চিরন্তন ব্যাকরণ ভুলে গিয়ে যদি উল্টো গ্রহীতা দাতাকেই করুণা দেখাতে শুরু করে দান সামগ্রী অনাদর অবহেলায় ছিল বলে অভিযোগ তোলে তার প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়া স্বাভাবিক তেমনটিই হয়েছে। তবে ওপাড় বাংলার যারা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন তারা মন্ত্রী বা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখানোর সাথে সাথে তাদের নিজ দেশের সরকারের কাছেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রাখতে পারেন কোন কারণে কোন পরিপ্রেক্ষিতে একজন বাংলাভাষী ভারতীয় কবিকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। তাদের নিজ দেশের একজন প্রখ্যাত কবির জীবনবৃত্তান্ত হালচাল ইতিহাস জানার অধিকার এবং দায়িত্ব দুটোই তাদের রয়েছে। কবি যদি স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে বাংলাদেশে অভিবাসী হতেন তবে প্রশ্ন উঠতনা কিন্তু নজরুল যখন বাংলাদেশে আসেন তখন তিনি যেকোন ধরণের সিদ্ধান্ত গ্রহনের উর্ধে বিরল রোগে আক্রান্ত বাক এবং বোধশক্তি রহিত। এমন একজন অসুস্থ কবির সমুদয় দায় দায়িত্বতো রাষ্ট্রেরই নেয়ার কথা কিন্তু তা না করে কেন অন্য একটি দেশে তাকে হস্তান্তর করা হলো ? সেটা কি কবির ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে না কি দায় এড়ানোর মানসিকতা প্রসূত ? এ দুটির একটিওতো যুক্তির ধোপে টেকেনা।

ভারততো তখনো ঐতিহ্যবাহী ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আর নবীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র আরো এক ধাপ এগিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সুতরাং ধর্মপরিচয়ের নিরিখে একজন কবির নাগরিকত্ব নিরুপনতো সেখানে অবাস্তব। এমনকি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারত যেখানে একটি ধীর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আদর্শ হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছে এ সময়েওতো এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবেনা।তবে কি মৈত্রী আর বন্ধুত্বের নিদর্শন স্বরুপ নজরুলকে বাংলাদেশের কাছে সমর্পন করা হয়েছিল ?তাহলেওতো প্রশ্ন উঠবে কবি কি বস্তুবাচক কোনো উপহার সামগ্রী অথবা বিতর্কিত ছিটমহল যে ইচ্ছে হলেই তাকে বন্ধু রাষ্ট্রের হাতে তোলে দেয়া যায়? সব শেষে আসে দায় এড়ানোর প্রশ্নটি।ভারতের মতো একটি দেশ তার দেশের একজন অসুস্থ কবির দায় নিতে অপারগ বা অনিচ্ছুক এ যুক্তিতো আরো বেশী হাস্যকর। তাহলে সঠিক ব্যাখ্যা কোনটি? সেই সঠিক উত্তর দেয়ার দায়িত্ব ভারতীয় উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আর তা জানার দায়িত্বও ভারতীয়দের।

ভারতীয়দের সাথে সাথে বাংলাদেশীদেরও দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাছে জানতে চাওয়া নজরুল কেন এবং কীকরে আমাদের জাতীয় কবি? কোন অধিকার বলে একজন বাক ও বোধশক্তিরহিত কবিকে তাঁর প্রিয় জন্মভূমি থেকে শিকড় উপড়ে এদেশে নিয়ে আসা হলো? ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা শিশুর মতো অসহায় মানুষটি কি এই অনিচ্ছুক অভিবাসনকে অন্তর দিয়ে গ্রহণ করেছিলেন? এর উত্তর আমরা কোনদিনও জানতে পারবনা। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়ার সঠিক ব্যাখ্যা কি তা জনগণকে অবহিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।আমরা আম জনতা অনুমানে বিভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি। তুলে আনতে পারি এর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দিক। ধর্মীয় দিকটি হয়তো এরকম নজরুলের পূর্বাপর সময়ে রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও আরো পাঁচ ছয়জন প্রবল শক্তিধর কবি বাংলা সাহিত্যে নক্ষত্রের মতো জ্বলছিলেন যাদের কাব্যকৃতি যথা সময়ে আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হলে আরো একাধিক বাঙ্গালী কবি নোবেল প্রাইজে সম্মানিত হতে পারতেন। ঘটনাক্রমে নজরুল ব্যতিত এদের সকলেই ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। নজরুল মুসলমান সমাজের একক প্রতিনিধি হলেও তাঁর ব্যতিক্রমী আবির্ভাবকে সমালোচকরা বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল ধূমকেতুর সাথেই তূলনা করেন। নজরুলের কল্যাণেই অসংখ্য মুসলমানী শব্দ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও মিথ বাংলা সাহিত্যে পংক্তিভুক্ত হয়। তাঁর অনেক কবিতা ও গান আমাদের মুক্তি সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূকিকা রাখে। এ দর্শন বাদ দিলেতো আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদা পাওয়ার দাবীদার বরিশালে জন্ম নেয়া রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বা যশোরের মধু কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কিন্তু তা করতে পারলেতো আমরা সত্যিকার অর্থেই একটি আদর্শ সেক্যুলার জাতি হয়ে যেতাম।বাস্তবেতো আমরা তা নই। এই ধর্মীয় পরিচয়কে মাথায় নিয়েই যদি নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয় তবে বলতে হয় সেটাই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেক্যুলার চেতনার বিপরীতে প্রথম সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত।

যে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ও চেতনার বিরুদ্ধে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিধ্বস্থ বাংলাদেশের দগদগে ক্ষতের উপর দাঁড়িয়ে সেই সাম্প্রদায়িক চেতনার কাছেই প্রথম আত্নসমর্পনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হলো। সেক্যুলার চেতনার সদ্য ভাঁজ খোলা চাদরে প্রথম ছিদ্রটিরও উদ্বোধন করা হলো এর মাধ্যমে।বর্তমানে আওয়ামীলীগের ছিদ্রাকীর্ণ সেক্যুলার গিলাপের ফাঁকফোঁকড় দিয়ে তাদের সাম্প্রদায়িক চরিত্রের যে স্বরুপ প্রায়শই বেরিয়ে আসে তার শুরু তাহলে সেই বিছমিল্লাহ থেকেই। অথবা বলা যায় এর পেছনে কোনো যুক্তিই কাজ করেনি এ ছিল নিছক মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মুসলমানের একটি যুক্তিহীন আবেগের প্রকাশ। জাতীয় সংগীতের মতো জাতীয় কবির কোনো তাৎক্ষণিক প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও হুট করে ভিন দেশী একজন কবিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি ঘোষণা এবং তড়িঘড়ি করে তাঁকে তাঁর জন্মভূমি থেকে ছিনিয়ে আনার মাঝে এক অদমিত আবেগও কাজ করে থাকতে পারে। সে আবেগ এতই দুর্নিবার ছিল যে একজন বাক-বোধ শক্তি রহিত কবিকে গ্রহণে হস্তান্তরে বাংলাদেশ ভারত দুই দেশই এক অভূতপূর্ব ও অযৌক্তিক ঘটনার জন্ম দিয়ে ফেলল।নজরুলকে জাতীয় কবি ঘোষনার আরেকটি রাজনৈতিক দর্শণও এখানে অনুমান করা যায়। বঙ্গবন্ধু হয়তো তাঁর সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দীর্ঘ সময়ের অভিজ্ঞতায় অনুমান করতে পেরেছিলেন সময়ের সাথে সাথে আবেগপ্রবন বাঙ্গালীর সেক্যুলার চেতনায় একদিন ভাটা পড়বে আর তার স্থান নেবে উগ্র সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি তখন রবীন্দ্রনাথ আর বাঙ্গালী রবীন্দ্রনাথ থাকবেননা হয়ে যাবেন ভারতীয় এবং হিন্দু রবীন্দ্রনাথ সে সাথে জাতীয় সংগীতটিও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। হিন্দু মুসলমানের ব্যালেন্স রক্ষার জন্যেই কি তাহলে নজরুলকে এক ধরনের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে? এ যুক্তি সত্য হলে একে রাজনৈতিক প্রজ্ঞাপূর্ণ দূরদর্শী মনে হওয়া স্বাভাবিক কিন্তু তাতে যে আমাদের মুখটি খুব উজ্জ্বল হয়নি তাও দিবালোকের মতো ধরা পড়ে। এতে করে ওপাড়ের কাছে আমাদের ঋণ ভারটা আরেকটু বেড়ে গেল। আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতটার দীনতাটুকু আরো বেশী উন্মোচিত হলো। জাতীয় কবির অপশনটাকে ওপেন রেখে দিলে কী এমন ক্ষতি হতো? অতীতের কাউকেই এ আসনে বসাতে হবে এবং নবুয়তির মতো এ চাপ্টারেও সীলগালা লাগিয়ে দিতে হবে এমন বাঁধাধরা নিয়মতো সেখানে ছিলনা। ওপেন রাখলেই বরং আমাদের প্রতিভাবান কবিরা তাদের প্রতিভাকে আরেকটু ঝালাই ফালাই করার অনুপ্রেরণা পেতেন নতুন নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেন একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন হতো। জাতি হিসেবে তাতে আমরা উপকৃতই হতাম। জাতীয় কবির স্থানটি পূর্ণ হয়ে গেছে বলেই কি না কে জানে এখন দলীয় কবি হওয়ার প্রবনতা হুহু করে বেড়ে যাচ্ছে।