যার যার ঈশ্বর দেখতে তার তার পূর্ব পুরুষদের মতন। ঈশ্বরের চেহারায় পূর্ব পুরুষদের ছাপ থাকে। গতরাতে আমার ঘুম আসছিলো না। এমনিতে ঘুম না এলে স্বপ্ন আসে। এদিন স্বপ্ন আসেনি, তাই তিনি এলেন। তিনি বললেন, দেখো, আমার চেহারায় তোমার বাবা ও দাদার ছাপ আছে। আমিই তোমার ঈশ্বর।
নিজেকে আধুনিক ঈশ্বর বলে দাবি করেন এবং বলেন, তিনি আসবেন তাই আমার ঘুম আসেনি। আমি নাকি তার জন্য অপেক্ষা করছি। এ কথা শুনে কিছুক্ষণ হাসলাম। তিনিও হাসলেন।
ঈশ্বর এলেন মৃত্যুর দাবি নিয়ে। তিনি চান আমি যেন স্ব-ইচ্ছায় মৃত্যুবরন করি। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, আমার বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ এনেছেন এবং বলেছেন এসব মেনে নিতে। ঈশ্বর যখন অভিযোগসমূহ বলছিলেন, তখন তাকে খুব রাগান্বিত দেখিয়েছে। বেশ ক্ষুব্ধতার সাথে তার অভিযোগ বললেন।
-গত বর্ষায় বৃষ্টির দিনে তোমার বাসার বাম পাশের গলির মুখে যমদূত পাঠিয়েছিলাম। কথা ছিলো তুমি খুন হবে এবং বৃষ্টির জলধারা রক্তে লাল হয়ে নেমে পড়বে ওয়াসার ড্রেনে। কিন্তু তুমি গেলে ডান পাশের গলি দিয়ে এক সুন্দরী নারীর ছাতা ভাগাভাগি করে।
-দুঃখিত। বিষয়টা আমি জানতাম না।
– তার কিছুদিন পর অফিসের পাশে আন্ডারপাসের সিঁড়িতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকার কথা ছিলো। যেখানে সিঁড়ি শেষ, সেখানে সামান্য জল জমে থাকবে আর তোমার রক্ত সিঁড়ি বেয়ে সেই জলে মিশে যাবে। অথচ তুমি সেদিন অফিসেই গেলে না। বাসায়ও ছিলে না।
– আপনার এই পরিকল্পনার কথাও আমার অজানা ছিলো।
– পরের সপ্তাহের একদিন রাত বারোটায় তোমার সিগারেট শেষ হয়ে গেলে সিগারেট কিনতে বের হবে। ওঁৎ পেতে থাকা যমদূত তোমার প্রাণ নিয়ে আমার কাছে ফিরে আসবে। এই দেখো, ঠিক এরকমই লেখা আছে তোমার প্ল্যান বুকে। সিগারেট ঠিকই শেষ হয়েছে। কিন্তু সিগারেট কিনতে বের হয়েছিলো তোমার বন্ধুর গাড়ির ড্রাইভার। এবং সেটা তোমার বন্ধুর বাসায়। মৃত্যু পরোয়ানা মাথায় নিয়ে বৌ বাচ্চাকে ঘরে একা রেখে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিলে মদ খেতে, আড্ডা দিতে। যমদূত দেখেছে তোমার স্ত্রী ভয়ে সারা রাত ঘরে আলো জ্বেলে রেখেছিলো। অথচ তোমার কোন লজ্জা হয়নি।
-বন্ধুর বাসায় গিয়ে মদ খাওয়া এবং আড্ডা দেয়ার বিষয়ে আমার স্ত্রীর কোন অভিযোগ ছিলো না। সে আলো ভালোবাসে, তাই আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলো। সত্যি কথা বলতে কী, আমাদের পরিবারের সবাই অন্ধকারে অনভ্যস্ত।
ঈশ্বর বললেন, আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তার কোন আগ্রহ নেই। কিন্তু আমি যা করেছি, কিছুই তার পরিকল্পনায় ছিলো না। আমি নিজ পরিকল্পনায় চলছি এবং আইন অনুযায়ী একজন বিদ্রোহী। কিন্তু যেহেতু নিজস্ব পরিকল্পনায় চলার যোগ্যতা অর্জন করেছি, সেহেতু যোগ্যতার মর্যাদাস্বরূপ কোন শাস্তি পেতে হবে না। শুধু তার পরিকল্পনা মতে মৃত্যুকে বরন করে নিলেই তিনি খুশি।
খুব জোরশব্দে হাসার চেষ্টা করলাম। পেরেছিও। এমন উচ্চস্বরে খুব টান টান দম নিয়ে এর আগে কখনো হাসিনি। আমি জানি কারো হাসির শব্দ দূর থেকে মনযোগ দিয়ে শুনলে খুব বিশ্রী লাগে। অস্বস্তিকর। হাসি থামিয়ে জানতে চাইলাম আমাকে কেন এভাবে পথে ঘাটে মরে থাকতে হবে এবং আমার রক্ত কেন উচ্ছিষ্ট জলে গিয়ে মিশবে? এমন অপ্রচলিত মৃত্যুর কারণ কী?
ইশ্বর ভরাট গলায় বললেন, তোমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ এরকম মৃত্যু পছন্দ করে। তাছাড়া তোমার বন্ধুদের মধ্যে যারা এর আগে এভাবে মারা গেছে, তাদের মৃত্যু দেশের অধিকাংশ মানুষকে আহত করেনি। অর্থাৎ তোমাদের জন্য এটাই প্রচলিত মৃত্যু।
– কিন্তু বিষয়টাতো আমার উপর নির্ভর করছে। এভাবে মারা যাওয়া আমার পছন্দ নয়। আমি আরো সম্ভ্রান্ত মৃত্যু চাই।
– শোনো, তোমার দেশে এখন একপক্ষ মরছে, আরেকপক্ষ মারছে। এরা সংখ্যায় কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এসব মৃত্যুর জন্য যারা মরছে তাদেরকে দোষ দিচ্ছে। তোমার উচিত জনমতকে শ্রদ্ধা জানানো। আমি চাই তুমি আরো গণতান্ত্রিক হও।
– এসব কথা আপনার মত করে বলছেন। মানুষের মত পরিবর্তন হয়। এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আপনি এমন একজনকে মানুষের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মরে যেতে বলছেন, যে কিনা মানুষের মত পরিবর্তনের জন্য কাজ করে। আপনি যুক্তি ছাড়া কথা বলছেন। আপনি একজন অযৌক্তিক ঈশ্বর।
এরপর ঈশ্বর বললেন আমি যেন তাকে ‘তুমি’ সম্বোধন করি। তিনি আমার বয়সে ছোট। আমার আর আমার ঈশ্বরের জন্ম একই সময়ে হয়নি। আমার জন্মের অনেক পরে নাকি তাকে সৃষ্টি করেছি।
-মিথ্যা কথা। আমি তোমাকে সৃষ্টি করিনি।
– তোমার বাবা, দাদা, মক্তবের হুজুর, স্কুলের শিক্ষকরা মিলে আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করেছে। এরপর তুমি ধারণ করেছো।
– কিন্তু শেষে তোমাকে ঘৃনা করেছি। দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি।
-হ্যাঁ, ঘৃনার আড়ালে ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে। সেই ভালোবাসার টানে এসেছি। তুমি রাজি হও, খুন হয়ে যাও। প্লীজ!
– কী অদ্ভুত!
– আচ্ছা তোমরা ঈশ্বরকে সৃষ্টি করার পর যে পরিমান ক্ষমতা বা পাওয়ার দিয়ে থাকো, সত্যি সত্যি যদি কেউ সমপরিমান মহাপরাক্রমশালী হয়ে তোমার প্রাণ নিতে আসে, তুমি কি তাকে বাধা দিতে পারবে?
– আমরা কি কোন ব্যাটারিচালিত ঈশ্বর নিয়ে আলোচনা করছি? এ বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই।
এবার তিনি খুব হতাশ হলেন। আমার কাছে এরকম আচরণ আশা করেননি। কথাটিকে গালি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তার মতে ঈশ্বররা অদৃশ্য ক্ষমতায় চলেন, তাদের কোন ব্যাটারির প্রয়োজন হয় না। অথচ তার মতামতকে আমি এতটুকু মূল্য দিইনি। এমন কথার জবাবে তাচ্ছিল্যে হাসি হাসলাম।
তার সাথে আলোচনায় আগ্রহ হারাচ্ছি দেখে তিনি আমার সাথে মৃত্যুর উপায় নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মৃত্যুর কথা বললেন। ঈশ্বরের মতে এটা একটা সুযোগ। তিনি আমাকে মৃত্যুর অপশন দিবেন। সেখান থেকে পছন্দসই উপায়ে মারা যেতে পারবো। এই বিশেষ সুযোগটি কেবল আমার জন্য। এরকম বললেন।
– মনে করো তারা তোমাকে নিয়ে একটি ৩০ তলা দালানের উপর উঠলো। তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। দালানের যে পাশে ধাক্কা মারবে, সে পাশে থাকবে একটি সুন্দর ফুলবাগান। সেক্ষেত্রে তোমার রক্ত ফুল বাগানের মাটিতে মিশে যাবে। সার হবে এবং সেই সারের পুষ্টিতে বাগানে আরো বেশি বেশি ফুল ফুটবে। রক্ত ড্রেনের জলে মিশে যাওয়ার সুযোগ থাকবে না।
রক্তের শক্তিতে হৃষ্টপুষ্ট ফুলের জবাবে আমি কিছু বলিনি।
– অথবা ধরো তারা তোমাকে একটি বড় মাঠে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করলো। তারপর ঠিক সেখানেই মাটিতে পুঁতে ফেললো।
– জ্যন্ত পুঁতে ফেললে কী হয়?
– যাদের জন্য তুমি মারা যাবে, তাদের আত্মতৃপ্তির একটা ব্যাপার থাকে না! চাপাতি দিয়ে কোপানোর বিষয়টা এখন কালচার। এভাবেই হচ্ছে।
– বাদ দাও এসব।
– আচ্ছা, আরো একটা উপায় বলি। প্রথমে তারা একটি গর্ত খুঁড়লো। এরপর তোমাকে সেখানে শুইয়ে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মাটিচাপা দিয়ে দিলো। এতে আপত্তি আছে?
– তুমি কি ঈশ্বর? নাকি ডেথ প্ল্যানার? এত নৃশংস মৃত্যু পরিকল্পনা নিয়ে বেঁচে আছো। তোমার লজ্জা করে না?
– দেখো, ঈশ্বর কখনো কাউকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে না। তিনি যে কাজে দক্ষ, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। আজ পর্যন্ত দেখেছো ঈশ্বর কাউকে বাঁচিয়ে রেখেছে? সবাই মরে যায়। মরতে হয়।
উনার কথা শুনে আমার গা গুলিয়ে বমি আসতে চাইলো। তখনো ভোর হতে ঘন্টাখানেক বাকি ছিলো। বমি করার জন্য যথেষ্ট সময় ছিলো। চেষ্টাও করেছি, কিন্তু হয়নি। ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছি, যেহেতু আমি তাকে বিশ্বাস করি না, সেহেতু তিনি যেন আমার কাছে না আসেন। আমার এসব ভালো লাগে না।
আরেকটি কথা তাকে স্পষ্টভাবে বলেছি। তার ইচ্ছা অনুযায়ী মারা যাওয়ার কোন আগ্রহ আমার নেই। তিনি বললেন আগ্রহ যে নেই, এটা পুরোপুরি ঠিক না। তার দেয়া মৃত্যুর অপশন বিষয়ক আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছি এবং জ্যন্ত পুঁতে ফেলার মত একটি অপশন প্রস্তাব করেছি। পরোক্ষভাবে এটা নাকি আমার সম্মতি। আমি বলেছি, এটা আমার সম্মতি নয়। বরং এটা হচ্ছে ভয়। কখনো যদি খুনীর মুখোমুখি হই, তখন হয়তো তাদের কাছে রক্তপাতহীন মৃত্যু দাবি করবো। আমি লাল গোলাপ, লাল শিমুল, লাল ফিতা, লাল চুড়ি, লাল জুতো, লাল সূর্য, লাল ওয়াইন পছন্দ করি। কিন্তু রক্ত নয়। এতকিছু বলার পরও তিনি আমার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেলেন। খুব অসহায়বোধ করলাম।
-কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শোনো। এই দেশে তুমি যখন তখন মরে যেতে পারো। মনে করো তুমি অটোরিক্সা করে কাওরান বাজার থেকে মতিঝিল যাচ্ছ। একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তোমাকে বহন করা অটোরিক্সাটি চাপা দিলো। তুমি গেলে। অথবা মনে করো শশুর বাড়ি যাওয়ার সময় লঞ্চে করে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছো। একটি ডুবো চরে ধাক্কা খেয়ে লঞ্চের তলায় ফাটল ধরে পানি ঢুকে ডুবে যেতে লাগলো। ক্লান্ত শরীরে তুমি তখন ঘুমিয়ে আছো। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে লঞ্চের সবগুলো লাইফবয় অন্য যাত্রীরা দখল করে নিলো। অনেক কিছু আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাইলে, কিন্তু পারলে না। ডুবে মরলে।
– প্লীজ, এসব বন্ধ করো। তুমি এত বর্বর কেন? একটি মৃত্যু নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন? এটা খুব বোরিং।
– এমনওতো হতে পারে তোমার বাসায় আগুন লাগলো। বৌ বাচ্চাদের বাসা থেকে বের করতে গিয়ে শেষে নিজেই আটকা পড়লে। আচ্ছা মানলাম তুমি আগুনে পুড়ে মরলে না। কিন্তু ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মরে গেলে। আসলে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যে, জঙ্গীদের হাতে চাপাতির কোপ খেয়ে না মরলেও অন্য অনেক কারণে মরে যেতে পারো। এখানে মরার জন্য হাজারটা সহজলভ্য উপায় আছে। মরেই যখন যাবে, তখন আগামীকালই মরবে না কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। পরশু মরো। অথবা তার পরদিন। তুমি একটা ডেট দাও। সেদিন যমদূত পাঠাবো। কোন ঝামেলা না করে মরে যাও।
– প্রয়োজনে আমি দেশ ছাড়বো। এমন দেশে যাবো, যেখানে মৃত্যুর হাজারটা সহজলভ্য উপায় নেই।
– কোথায় যাবে? জামার্নী, সুইডেন, নরওয়ে, কানাডা, নেদারল্যান্ডস অথবা মনে করো সুইজারল্যান্ডই গেলে। সবগুলো শীতের দেশ। মনে করো এমন শীত পড়লো যে, তুমি বরফে জমে গেলে। মৃত্যু কিন্তু তোমার পিছু ছাড়বে না। আচ্ছা বাদ দাও। শোনো, তোমার সাথে কথা বলাটা এখন আর এনজয় করছি না। খুব বোরড ফীল করছি। এটা দ্রুত শেষ করো।
আসলে ততক্ষণে আমিও খুব বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করছিলাম। কখনো ভাবিনি ঈশ্বরের সাথে শুধু মৃত্যু নিয়ে কথা বলবো। কিছুদিন ধরে প্রচুর মুভি দেখছি। কয়েকটা মুভিতে ভয়াবহ প্লটহোল খুঁজে পেয়েছি। খুব ভালো হতো যদি উনার সাথে মুভি নিয়ে কথা বলতে পারতাম। অথবা আমার ছোট ছেলের মাথার চুল নিয়ে। তার চুলগুলো খুব দ্রুত বাড়ছে এবং বাদামী হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আমরা পারিবারিকভাবে অত্যন্ত ব্যস্ত। তার চুলের বেড়ে উঠা এবং রং পরিবর্তন নিয়ে বেশিরভাগ সময় আলোচনা করি। কিন্তু ঈশ্বর এলেন শুধুই মৃত্যু নিয়ে কথা বলতে। অসহ্য। এমনকি আমার সাথে তার কোন ভালো সম্পর্কও নেই। আমার কাছে তিনি মঞ্চের ভাঁড়ের চাইতে হাস্যকর, এবং ভাঙা মদের গ্লাসের চাইতে বিরক্তিকর। কখনোই আমি তাকে আশা করিনি।
– এতো বেশি ঘৃনা করা ঠিক না। তোমার চারপাশে অনেক উদাহরণ আছে। যারা একসময় আমাকে খুব ঘৃনা করতো, এখন তারচে বেশি ভালোবাসে। যখনই তুমি আমাকে ঘৃনা করতে থাকবে, তখনই আমি আশাবাদী হতে থাকবো। কারণ আমি জানি একসময় তুমি আমাকে অনেক বেশি ভালোবাসবে। তাছাড়া তুমি যদি আমাকে আশা না করতে, আমি এখানে আসতে পারতাম না। যেভাবেই হোক, তুমি আমাকে আশা করেছ। তাই এসেছি।
– না, আমি তোমাকে আশা করিনি। একটুও না।
– তাহলে তোমার স্বপ্ন আসেনি কেন? তুমি কী অস্বীকার করতে পারবে যে দিন দিন কেমন স্বপ্নহীন হয়ে যাচ্ছো। ঈশ্বরের কোন ক্ষমতা নেই আত্মবিশ্বাসী কোন স্বপ্নবান মানুষের কাছে ঘেঁষার। আজ তুমি সম্পূর্ণরূপে স্বপ্নহীন ছিলে বলেই আমি এসেছি। অথচ কেমন বাজে ব্যবহারটাই না করলে। যদিও তাতে বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। কারণ মানুষের প্রতি এখন আর আমার কোন বিশ্বাস নেই। মানুষ নিজে যাকে সৃষ্টি করে, আবার তাকেই ধ্বংস করে।
– এতক্ষণে একজন অভিমানী ঈশ্বরের দেখা পেলাম। হা হা হা।
– দেখো, আমি আমাকে সৃষ্টি করিনি। এটা সম্ভব না। তোমরা ঈশ্বর বানাও, ধর্মগ্রন্থ বানাও। আবার ঈশ্বরকে ধ্বংস করো, ধর্মগ্রন্থ নিয়ে হাসাহাসি করো। এসব গ্রন্থ কি আমি লিখেছি? তোমরা এখন এসব গ্রন্থকে হাস্যকর বলো, উদ্ভট বলো। অথচ এগুলো তোমাদের পূর্ব পুরুষরাই লিখে গেছে। তোমরা নিজেরা যা জানো না, যা বুঝো না, যা আবিষ্কার করতে পারোনি, তার সবকিছু ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার জন্য ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছো। তোমাদের সকল ব্যর্থতার ভার আমাদেরকে বহন করতে হয়। অনেক সময় কৃতিত্বের ভাগও দাও। কিন্তু সেটা সবসময় না। তোমরা নিজেদের মত করে আমাদেরকে মহিমান্বিত করেছো। তারপর আবার তুচ্ছতাচ্ছিল্যও করছো। তোমরা আমাকে নিয়ে খেলছো। এটা খুবই ফালতু একটা গেইম, যা তোমরাই সৃষ্টি করেছো।
– বলে যাও। খারাপ লাগছে না।
– আমাকে তোমার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। অথচ আজ তুমি আমাকে স্বীকার করো না। আমি তোমার কাছে আসার জন্য, পাশে বসার জন্য শকুনের মতো তাকিয়ে থাকি। কখন একটু সুযোগ পাবো, এই আশায়। বহুদিন পর আজ সুযোগ পেয়েছি। যতই অবহেলা, অপমান করো না কেন, আমার ভালো লেগেছে। তুমি হয়তো জানো না, একা থাকার কী কষ্ট।
– তোমার কথায় যুক্তি আছে। এতক্ষণে মনে হচ্ছে তোমার সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।
– কিন্তু আমাকে বলো কেন তুমি মরতে চাও না?
– আসলে এটা মৃত্যুর জন্য সঠিক বয়স নয়। তুমি জানো আমি এখন কী পরিমান ব্যস্ত। হাতে অনেক কাজ। তাছাড়া আমার দু’টো ছেলে এখনো অনেক ছোট। আমি তাদের যুবক বয়সটা দেখে যেতে চাই। তারা কিভাবে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলে, কিভাবে অন্যের কাছে আকর্ষনীয়ভাবে উপস্থান করে, তাদের প্রতি আমার কতটুকু প্রভাব নিয়ে বেড়ে উঠে, কেমন মেয়ের সাথে প্রেম করবে, এসব। তাছাড়া তাদেরকে সাথে নিয়ে আমি পাহাড় বাইতে যাবো। তারা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। বলবে, কিভাবে পাহাড় বাইতে হয়।
– তুমি কি এটাকে তোমার স্বপ্ন হিসেবে নির্মাণ করেছো?
– অনেকটা তাই।
– তুমি আমাকে এভাবে দুর্বল করতে পারো না। আমিও কিছু স্বপ্ন নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু তোমার স্বপ্ন যেভাবে নির্মিত হয়, আমার স্বপ্ন একই সাথে একইভাবে ধ্বংস হয়। খুব মন খারাপ হলো। কিছুটা সময় একা থাকতে পারলে ভালো লাগতো। আশপাশে কেউ থাকলে মন খারাপ শেষ করা যায় না। বড়জোর এড়িয়ে যাওয়া যায়।
– তার আগে একেবারে সত্যি করে বলো, তুমি কেন আমাকে মারতে এত আগ্রহী।
– কারণ আমি মুক্তি চাই। তোমার আমার জন্ম একইসাথে না হলেও আমাদের মৃত্যু একইসাথে হবে। মানুষের মৃত্যুর পর আর তার ঈশ্বর বেঁচে থাকে না। ইশ্বর তার মালিক ছাড়া একা বাঁচতে পারে না। হয় আমাকে ভালোবাসো, নয় মুক্তি দাও।
আলোচনা এমন মানবিক রূপ ধারন করবে বুঝিনি। ঈশ্বরকে একটু একা থাকতে দিয়ে জলপান করতে রান্না ঘরে যাই। জগে জল ছিলো না। জার থেকে জল ঢেলে খুব প্রশান্তি নিয়ে পেটভরে জল নিলাম। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি বাইরে ভোরের আলো ছড়িয়েছে। গতকালের ভোরের সাথে আজকের ভোরের বিশেষ পার্থক্য নেই। একইরকম আলো, একইরকম কুয়াশা। হঠাৎ খুব শীত শীত লাগছে। খেয়াল করে দেখি, আমার গায়ে একটি হালকা ফুলহাতা টীশার্ট। অথচ এতক্ষণ শীত গরম কিছুই অনুভব করিনি। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে রীতিমত কাঁপছি। দ্রুত শোবার ঘরে গেলাম সোয়েটার পরতে। গিয়ে দেখি আমি আমার বিছানার উপর বসে আছি। সোয়েটার পরে। শোবার ঘরে এখন দু’টো আমি। একটি সোয়েটার পরা, আরেকটি সোয়েটার ছাড়া। ঈশ্বর চেহারা পাল্টে হুবহু আমার রূপ ধরে বসে আছেন। বললেন, খুব শীত পড়ছে, এসো ঘুমিয়ে পড়ি।
তার কথা এড়িয়ে যেতে পারিনি। হঠাৎ চোখের পাতায় প্রচুর ঘুম নেমে আসে। বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। প্রতিদিন আমি দু’টো বালিশ মাথায় দিয়ে খাটের মাঝখানে ঘুমাই। ঈশ্বর বালিশ দু’টো পাশাপাশি রাখলেন। তিনি ডানের বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লেন। শীত থেকে বাঁচার জন্য আমিও দ্রুত বাম পাশের বালিশে শুয়ে পড়ি। ঠিক তখন কানের কাছে মুখ এনে ঈশ্বর ফিসফিস করে বললেন, “মারা যাওয়ার কথাটা মাথায় রেখো। চাইলে আত্মহত্যাও করতে পারো।“
তারপর আর কিছু মনে নেই। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ দুপুরে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ঈশ্বরের বালিশে শুয়ে আছি। বাম পাশের বালিশটি খালি। শোবার ঘরে আমি ছাড়া কেউ নেই।
আমারও একটা ঈশ্বরের বালিশ দরকার।
ঈশ্বরের বালিশে ঘুমাতে আরাম আছে তো?
অসাধারন। “ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি
ঈশ্বরের বালিশে শুয়ে আছি।
বাম পাশের বালিশটি খালি।”
ধন্যবাদ
Well written. You got my true attention. Hope will get more. :good:
:rose: