[জগদীশচন্দ্র বসুকে নিয়ে এর আগে দুটো প্রবন্ধ আমি লিখেছি। মুক্তমনায় তা প্রকাশিত হয়েছে। একটা প্রবন্ধ আমার “উপমহাদেশের ১১ জন পদার্থবিজ্ঞানী” বইতে প্রকাশিত হয়েছে। এবার জগদীশচন্দ্রকে নিয়ে একটা পুরো বই লিখে ফেলেছি। ২০১৬ সালের বইমেলায় তা প্রকাশিত হচ্ছে। মুক্তমনার পাঠকদের জন্য বইটির কিছু অংশ।]
“অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান
প্রাণের প্রথম জাগরণে, তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ-
ঊর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা
ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-‘পরে; আনিলে বেদনা
নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।।”
বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুর প্রভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘বৃক্ষবন্দনা’। কবিতার শুরুতে বৃক্ষ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন তার অনেকখানি প্রযোজ্য বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসুর ক্ষেত্রেও। ইওরোপে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হবার কয়েক শতাব্দী পরেও আমাদের এই উপমহাদেশের বিজ্ঞান-ভূমি ছিল অন্ধকারে। জগদীশচন্দ্র বসুই ছিলেন প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই উপমহাদেশে আধুনিক বিজ্ঞান-গবেষণার জাগরণ ঘটিয়েছিলেন। তিনিই বিশ্ববিজ্ঞানের আসরে প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে সুবিধাবঞ্চিত তৎকালীন পরাধীন ভারতের বাঙালিও নিজের অধ্যবসায় ও মেধার জোরে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
জগদীশচন্দ্র বসু ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম পদার্থবিজ্ঞানী। শুধু তাই নয়- বিশ্বের বিজ্ঞানজগতে তাঁর যে অবদান তার সবটুকু আমরা সেই সময়ে বুঝতেও পারিনি। সেমিকন্ডাক্টর পদার্থবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র যাত্রা শুরু হবার অনেক আগেই – তিনি সেমিকন্ডাক্টর দিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে যন্ত্রপাতি তৈরি করে গবেষণা করেছেন। সলিড স্টেট ফিজিক্সের জন্মের অনেক বছর আগেই জগদীশচন্দ্র সলিড স্টেট ফিজিক্সের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
মাইক্রোওয়েভ গবেষণার একজন পথিকৃৎ জগদীশচন্দ্র। তাঁর তৈরি যন্ত্র ব্যবহার করে বেতার যোগাযোগে সাফল্য দেখিয়েছেন ইতালির গুল্গিয়েল্মো মার্কনি এবং সেজন্য তিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। আমরা এখন হা-হুতাশ এবং ক্ষোভ দেখাই যে জগদীশচন্দ্র বসুকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু নিজে কোনদিন এই ব্যাপারে একটা শব্দও উচ্চারণ করেননি। কারণ পুরষ্কারের দিকে তাঁর কোন নজরই ছিল না কখনো। তাছাড়া সেই সময়ে (আজ থেকে শতাধিক বছর আগে) নোবেল পুরষ্কার নিয়ে এত বেশি বাড়াবাড়ি রকমের হৈ চৈ করা হতো না। নোবেল পুরষ্কার তখন ছিল যে কোন পুরষ্কারের মতই একটা ইওরোপীয় পুরষ্কার মাত্র। বৈজ্ঞানিক ইতিহাসের সাম্প্রতিক গবেষণায় বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে যে প্রথম দিকের বেতার যোগাযোগব্যবস্থায় জগদীশচন্দ্র বসুর অবদান অনস্বীকার্য। মার্কনির নাতি ড. ফ্রান্সেস্কো মার্কনি – যিনি নিজেও একজন বেতার-জ্যোতির্বিজ্ঞানী – কলকাতায় বসু বিজ্ঞান মন্দিরে এসে বলেছেন যে নোবেল পুরষ্কার জগদীশচন্দ্র বসুরই প্রাপ্য ছিল।
পদার্থবিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞানের সমন্বয়ে বায়োফিজিক্স বা জীবপদার্থবিজ্ঞান এখন একটি দ্রুত সম্প্রসারণশীল গবেষণাক্ষেত্র। কিন্তু একশ’ বছর আগে যখন জগদীশচন্দ্র বসু এই সম্মিলিত ক্ষেত্রে গবেষণা করেছেন তখন এই বিষয়ের আলাদা কোন অস্তিত্বই ছিল না। তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী।
১৮৯৫ সালে জার্মানির উইলহেল্ম রন্টগেন যখন এক্স-রে আবিষ্কার করেন – জগদীশচন্দ্র বসু তখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ – মাইক্রোওয়েভ নিয়ে গবেষণা করছেন। এক্স-রেও উচ্চ-কম্পাঙ্কের ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ। কলকাতায় নিজের গবেষণাগারে সেই সময় তিনি এক্স-রে উৎপাদন করেছিলেন। এই উপমহাদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক্স-রে’র প্রথম প্রয়োগ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু।
পদার্থবিজ্ঞানে অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের পাশাপাশি উদ্ভিদের সংবেদনশীলতা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত করেন জগদীশচন্দ্র। উদ্ভিদও যে উদ্দীপনায় সাড়া দেয় – এ তথ্য জগদীশচন্দ্র বসুর আগে কেউ উপলব্ধি করেননি, প্রমাণ করতে পারেননি। জীব ও জড়ের মধ্যে সাড়ার যে ঐক্য অর্থাৎ বাইরের উত্তেজনায় জীব ও জড় যে প্রায় একই রকমের সাড়া দেয় জগদীশচন্দ্রের আগে তা কেউ চিন্তাও করেননি। এখন আমরা যে রোবটিক সায়েন্স নিয়ে এত মাতামাতি করি – তার শুরু কিন্তু হয়েছিল জগদীশচন্দ্রের হাতে।
শুধু বিজ্ঞান নয়, বাংলা ভাষায় প্রথম কল্পকাহিনির লেখকও ছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু। তাঁর লেখা সায়েন্স ফিকশান ‘নিরুদ্দেশের কাহিনি’ প্রথম ‘কুন্তলীন পুরষ্কার’ লাভ করেছিল। শিশুকিশোরদের জন্য বেশ কিছু বিজ্ঞান-প্রবন্ধ লিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র যার সাহিত্য-মূল্যও অনেক। জগদীশচন্দ্র বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতিও ছিলেন কয়েক বছর। বাংলায় বিজ্ঞান-সাহিত্যে জগদীশচন্দ্রের অবদান ঐতিহাসিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন জগদীশচন্দ্রের খুবই কাছের বন্ধু। জগদীশচন্দ্র বসুকে দেশের মানুষের কাছে সম্মানের আসনে তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে বেশি চেষ্টা যিনি করেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথ। বিদেশে জগদীশচন্দ্রের বৈজ্ঞানিক সম্মানকে রবীন্দ্রনাথ দেখেছেন বিদেশীদের বিরুদ্ধে পরাধীন ভারতবর্ষের জয় হিসেবে।
ভারতীয় বিজ্ঞানের জয়গাথা বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর সারাজীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। এই বিজ্ঞান মন্দির এখন ‘বোস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ নামে একটি প্রথম সারির গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
বাঙালি স্বভাবতই আবেগপ্রবণ। তাই আমরা যাদের সম্মানের আসনে বসাই – অনেকটা অন্ধভাবেই তা করি। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের থাকে না। তাই গত এক শতাব্দী ধরে জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে যত লেখা প্রকাশিত হয়েছে সেখানে শুধু জগদীশচন্দ্র বসুর গুণগানই করা হয়েছে। ‘বিজ্ঞানী’ জগদীশ বসুর চেয়েও প্রধান হয়ে উঠেছেন ‘আচার্য’ জগদীশ বসু। ভালোবাসার আবেগে দেবতা বানাতে গিয়ে আমরা খেয়াল করি না যে জগদীশবসু তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধগুলোর কোনটাতেই তাঁর সহকর্মীদের কারো নাম প্রকাশ করেননি বা সামান্যতম কৃতজ্ঞতাস্বীকারও করেননি। তাঁর জীবদ্দশায় সি ভি রামন কলকাতায় বসেই গবেষণা করে ‘রামন ইফেক্ট’ আবিষ্কার করেছেন এবং সেজন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। অথচ জগদীশচন্দ্র ভারতীয় বিজ্ঞানের প্রসারে তাঁর নিজের চেষ্টা ও আগ্রহের ব্যাপারে সোচ্চার হলেও কখনো সি ভি রামন সম্পর্কে প্রশংসা তো দূরের কথা, সামান্য উল্লেখ পর্যন্ত করেননি কোথাও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও জগদীশচন্দ্রের ব্যাপারে এতটা উচ্ছ্বসিত, কিন্তু রামনের ব্যাপারে একেবারেই নিরব। সিস্টার নিবেদিতার সাথে খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর। নিবেদিতা জগদীশচন্দ্র বসুর অনেক গবেষণাপত্র লিখে দিয়েছেন, কয়েকটা বইও সম্পাদনা করেছেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র সেটাও কখনো সরাসরি প্রকাশ্যে স্বীকার করেননি।
জগদীশচন্দ্র বসুর জীবন ও তাঁর বিজ্ঞান-গবেষণা সম্পর্কে একটা সামগ্রিক ধারণা দেয়ার লক্ষ্যেই এই বইটা লিখেছি। মীরা প্রকাশন ‘বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী’ সিরিজ বের করছে বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা বেগবান করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
আমাদের জগদীশ
উনিশ শতক পর্যন্ত ভারতীয় ইতিহাসে রাজনৈতিক উত্থান পতন ঘটেছে অনেক। এই সময়ে মুষ্টিমেয় কয়েকজন রাজা বাদশার পৃষ্ঠপোষকতায় সঙ্গীত ও শিল্প-সাহিত্যের কিছু উন্নতি হলেও পুরো দুই শ’ বছরের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশে বিজ্ঞান সাধনার কোন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। জগদীশ বসুই প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী যিনি ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের গবেষণায় ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। জগদীশ বসুর হাত দিয়েই ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা শুরু হয়েছিল।
উনিশ শতকের শেষের কয়েক বছরে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অনেকগুলো যুগান্তকারী আবিষ্কারের ঘটনা ঘটে যেগুলোর ভিত্তিতে বিংশ শতাব্দী হয়ে ওঠে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রযুক্তির স্বর্ণযুগ। ১৮৮৮ সালে হেনরিখ হার্টজ সর্বপ্রথম বেতার তরঙ্গ তৈরি করেন এবং তা সনাক্ত করার পদ্ধতি (ডিটেক্টর) আবিষ্কার করেন। ১৮৯৫ সালে উইলহেল্ম রন্টগেন এক্স-রে আবিষ্কার করেন। ১৮৯৬ সালে হেন্রি বেকোয়ারেল আবিষ্কার করেন রেডিও-অ্যাক্টিভিটি বা তেজষ্ক্রিয়তা। ১৮৯৭ সালে জেমস থমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করেন। সূত্রপাত হয় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের এক নতুন যুগের। ইওরোপ আমেরিকার উন্নত গবেষণাগারে যখন ব্যাপক গবেষণা-যজ্ঞ চলছে সেই সময় ভারতের বিজ্ঞান-মরুতে গবেষণার ফল ফলানোর জন্য একাই লড়ে চলেছেন জগদীশচন্দ্র।
এক্স-রে আবিষ্কারের পরপরই জগদীশচন্দ্র তাঁর নিজের পরীক্ষাগারে এক্স-রে উৎপাদন করেন। শুধু তাই নয়, এক্স-রে’র সাহায্যে যে শরীরের রোগ নির্ণয় করা যায় তার সফল প্রয়োগ উপমহাদেশে সর্বপ্রথম শুরু করেন জগদীশচন্দ্র। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত সৈনিকদের শরীরে এক্স-রে প্রয়োগ করে বিশ্বের প্রথম চিকিৎসা-পদার্থবিজ্ঞানী (Medical Physicist) হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন মেরি কুরি। মেরি কুরির জন্মদিন ৭ই নভেম্বরকে ‘ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল ফিজিক্স ডে’ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু মেরি কুরিরও অনেক আগে জগদীশচন্দ্র কলকাতায় এক্স-রে দিয়ে রোগীর শরীরের ছবি তুলতে শুরু করেছিলেন। ডাক্তার নীলরতন সরকার তাঁর রোগীদের জগদীশচন্দ্রের কাছে পাঠাতেন এক্স-রে করার জন্য। ১৮৯৯ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা জগদীশচন্দ্রের এক চিঠিতে তার প্রমাণ মেলে:
“যদি পারেন তাহা হইলে সকালে ৮টার সময় প্রেসিডেন্সি কলেজ হইয়া আসিবেন। রঞ্জেন কলে একজন রোগী দেখিতে হইবে। তাহার পৃষ্ঠভঙ্গ হইয়াছে। ডাক্তার নীলরতন সরকারের কথা এড়াইতে পারিলাম না।”
নতুন যন্ত্র প্রস্তুত করার ব্যাপারে আশ্চর্য দক্ষতা ছিল জগদীশচন্দ্রের। বিজ্ঞানের সঠিক ব্যবহার তিনি যে কোন ব্যাপারেই করতে পারতেন। ১৯০৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেজ মেয়ে রেণুকা খুব অসুস্থ। অক্সিজেন দেয়া দরকার। তখন অক্সিজেন সহজলভ্য ছিল না। জগদীশচন্দ্র ভাবলেন আবেশ-কুন্ডলির (induction coil) সাহায্যে অক্সিজেনের মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ-চালনা করলে অক্সিজেন আংশিকভাবে ওজোনে (O3) পরিণত হয়। ওজোন মিশ্রিত অক্সিজেন থেকে আয়নিত অবস্থায় যে অক্সিজেন পাওয়া যায় তা শ্বাসকষ্ট দূর করার পক্ষে সহায়ক। জগদীশচন্দ্র এই কাজের জন্য একটা যন্ত্র বানিয়ে রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন।
ধরতে গেলে তাঁর হাতেই সলিড স্টেট ফিজিক্সের সূত্রপাত হয়েছে সময়ের অনেক আগেই। সলিড স্টেট ফিজিক্সের প্রথম পেপার লিখেছিলেন তিনি। যদিও পরবর্তীতে যখন সেমিকন্ডাক্টর ফিজিক্সের দ্রুত উন্নয়ন ঘটেছে জগদীশচন্দ্র আর সেদিকে যাননি। তবুও আমরা গর্ব করি এটুকু জেনে যে একশ’ বছর আগেই সলিড স্টেটের প্রথম গবেষণাপত্রটি রচিত হয়েছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র বসুর হাতে।
আধুনিক ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ‘ওয়েভ-গাইড’ একটি অতিপরিচিত শব্দ। কিন্তু এক শ’ বছর আগে এই ওয়েভ-গাইড বলে কিছু ছিল না। ১৮৯৭ সালে জগদীশচন্দ্র রয়্যাল ইন্সটিটিউশানে পোলারাইজেশান অব ইলেকট্রিক রে বিষয়ক যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেখানে যে যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন সেই যন্ত্র ছিল সময়ের তুলনায় খুবই আধুনিক। সেখানে তিনি একটি শক্তি বিকিরণকারী নলের ব্যবহার করেছিলেন। সেই নলটিই আজ মাইক্রোওয়েভ বিজ্ঞানীদের কাছে পৃথিবীর প্রথম “ওভারমোডেড ওয়েভগাইড” হিসেবে স্বীকৃত।
জগদীশচন্দ্র বসু তাঁর গবেষণায় যে ফলাফল পেয়েছিলেন এবং যেসব যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলেন আজ তার শতাধিক বছর পর আমরা সেখান থেকে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্র আবিষ্কার করতে পেরেছি। প্ল্যান্ট নিউরোবায়োলজি, ক্রোনোবায়োলজি, ভেজিটেবল ইলেকট্রিসিটি ইত্যাদি সবকিছুরই পথিকৃৎ ছিলেন জগদীশচন্দ্র। ‘Integrative Biophysics Biophotonics’ -এ বায়োফিজিক্সের অগ্রদূতদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে জগদীশচন্দ্র বসুকে।
ক্রোনোবায়োলজি হলো জীববিজ্ঞানের সেই শাখা যেখানে জীবনের পর্যায়ক্রমিক ছন্দকে পর্যবেক্ষণ করে। যেমন সূর্য ও পৃথিবীর মধ্যে পর্যায়ক্রমিক ছন্দে দিন-রাত মাস বৎসর হয়। এটা তুলনামূলকভাবে খুবই নতুন বিষয়। ১৯৬০ সালের আগে এই বিষয়ের আলাদা কোন অস্তিত্বই ছিলো না। কিন্তু জগদীশচন্দ্র বসু উদ্ভিদের পর্যায়ক্রমিক ছন্দ পর্যবেক্ষণ করে অনেক তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন তারও পঞ্চাশ বছর আগে। আলো এবং অন্ধকারে উদ্ভিদের দৈনিক পরিবর্তন, তাপমাত্রার পরিবর্তনের সাথে উদ্ভিদের বৃদ্ধির পরিবর্তন ইত্যাদিতে একটি চমৎকার জীবন-ছন্দ আছে। জগদীশচন্দ্র সেই ছন্দ আবিষ্কার করেছিলেন।
Dictionary of Scientific Biography-তে Charles Susskind বিজ্ঞান-ইতিহাসের তথ্য-প্রমাণ সহ দেখিয়েছেন যে জগদীশচন্দ্র বসুই ছিলেন পৃথিবীর প্রথম জীবপদার্থবিজ্ঞানী বা বায়োফিজিসিস্ট।
ভারতে প্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ রিসার্চ-ইনস্টিটিউট ‘বসু-বিজ্ঞান-মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেছেন জগদীশচন্দ্র বসু। ভারতবর্ষ থেকে প্রথম সায়েন্টিফিক জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে তাঁর উদ্যোগে, তার সম্পাদনায়।
আমরা আজ যে বিজ্ঞান-গবেষণার পথে খুব আস্তে আস্তে হলেও হাঁটতে শুরু করেছি, সেই পথ অর্ধ-শত বছরের কঠিন পরিশ্রমে তৈরি করেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু – আমাদের জগদীশ।
_____________________
১। রবীন্দ্রনাথকে লেখা চিঠি। ১৮৯৯ ফেব্রুয়ারি।
২। দিবাকর সেন, দেশ, ডিসেম্বর ১৩, ১৯৯৭।
৩। Arunima Chaudhuri and Amitabha Chattopadhyay, Aian Agri-History, Vol. 13, No. 4, 2009, pp 315-319.
৪। Marco Bischof, Introduction to Integrative Biophysics, F. A. Popp and L. Beloussov (eds.), Kluwer Academic Publishers, 2003, pp 1-115.
৫। M. K. Chandrashekaran, J C Bose’s Contributions to Chronobiology, Resonance, February 1998.
সাধারনের জন্য বাংলায় বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার জন্য ধন্যবাদ।
আমরা এমনই হতভাগ্য জাতি যে স্যার জগদীশ চন্দ্র বোসের পৈত্রিক বাড়ীটিও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে পারি নি। দেশে আজ উন্নয়নের জোয়ার বয়ে চলেছে, নিজের টাকায় আমরা পদ্মা সেতু করছি, সময়ে- অসময়ে কোটি টাকা খরচ করে বিদেশী কলাকার এনে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করা আমাদের কাছে কোন ব্যাপার না, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও অতীতের যেকোনো রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়েছে— সম্পদশালী হয়ে ওঠার এতোসব খবরেও দেশের ইতিহাস আর ঐতিহ্য ধরে রাখার মত জরুরী কাজগুলো করা হয়ে উঠছে না। বাড়ীটির বেহাল দশা দূর করে, এই মহান বিজ্ঞানীর কিছু ছবি, আবিষ্কারের নমুনা দিয়ে সাজিয়ে রাখা কি এতোই কঠিন কাজ? শুনেছি একসময় নাকি বাড়ীটিতে ওনার কিছু চিঠিপত্র আর ব্যক্তিগত জিনিসও ছিল, সময়ের পরিক্রমায় এখন যা হাতছাড়া! এই মহান বিজ্ঞানীর বাড়ীটিকে কেন্দ্র করে একটি বিজ্ঞান যাদুঘর গড়ে তোলা হলে তা দেশের অনেক তরুণ, কিশোরকেই বিজ্ঞানে উৎসাহী করে তুলত। হয়তো তা এলাকার অল্পবয়স্কদের মধ্যে মাদকের নেশা, অপরাধ বা উগ্রপন্থা অনুসরণের ক্ষেত্রেও প্রতিষেধক হিসাবে কাজ করতো, আর আমরাও আন্তর্জাতিকভাবে বিশাল খ্যাতির অধিকারী দেশের এই অনন্য প্রতিভার বিভিন্ন আবিষ্কার সম্পর্কে জেনে বা জানিয়ে গর্ববোধ করতে পারতাম!
বাঙালী বিজ্ঞানীদের নিয়ে আপনার আরও লেখা আগে মুক্তমনায় পড়েছি ( মেঘনাদ সাহাসহ) এবং আরও লেখা পড়তে চাচ্ছি।লেখা অব্যহত থাকুক।
দারুন তথ্যবহুল লেখা .. বইটার জন্যে অপেক্ষায় রইলাম
লেখককে ধন্যবাদ,
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
বইটার জন্যে অধীর আগ্রহে আছি….
বইটা মীরা প্রকাশনের স্টলে পাওয়া যাবে। স্টল নম্বর ৪৪৩-৪৪৪। ধন্যবাদ।
দারুন।
এভাবেই ছড়িয়ে পড়ুক বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাজ বাংলার বন্ধার্থ মনোজগতে।
ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন।
অনেক ধন্যবাদ। আপনিও সুস্থ থাকুন।
প্রদীববাবু
লেখাটি আরেকটু সমৃদ্ধ এবং সুসংগঠিত হলে ভাল হত।
(১) জগদীশ বোসের কাজ শুরু মাইক্রোয়েভ নিয়ে- ১৫০ স্কোয়ার ফিটের একটা ল্যাবেরেটরীতে যেখানে সরকার থেকে তিনি বঞ্চনার প্রতিবাদে টাকা নিচ্ছেন না-নিজের পকেটের টাকা খরচ করে গবেষনা করছেন রাতে-কারন দিনের বেলায় তাকে দেওয়া হয়েছে অসংখ্য ক্লাস। তিনি অম্লান বদনে তাই পড়াচ্ছেন-এতসব তুচ্ছ করেও তিনিই প্রথম ওয়ারলেস কমিউনিকেশনের জনক
এই অসম লড়াই এর কথাটা আরো বিশদে আসলে ভাল হয়
(২) ইউরোপের অনেক কোম্পানী উনাকে ফান্ড করতে চেয়েছে-ইউরোপে থেকে যেতে বলেছে-উনি যান নি।
পেটেন্টের প্রতি ছিল উনার অনীহা। কোন কাজই কমার্শিয়ালাইজ করতে চান নি। এগুলোর বিশ্লেষন দরকার। উনি এগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত করেছিলেন মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্ত পেটেন্ট রাইট না থাকলে ত কোন কোম্পানী প্রোডাক্টাইজেশনে রাজী হবে না-সিকিউরিটির অভাবে। এটা উনি বোঝেন নি। এটার জন্যই উনি সেমিকন্ডার নিয়ে তার কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি।
উনার দীর্ঘ জীবন এবং প্রতিভা নিয়ে বিশ্লেষন দরকার। উনি শুধু পথের দিশারীই নন- বিজ্ঞানীর ও বিজ্ঞানী।
ধন্যবাদ। জগদীশচন্দ্রের কাজ ও জীবন নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছি। এই অংশটা সেই বইয়ের ভূমিকা ও প্রথম অধ্যায়। বইটিতে আরো চব্বিশটি অধ্যায় আছে। মুক্তমনায় ক্রমশ প্রকাশের ইচ্ছে আছে। আর বইটি এবারের বইমেলাতেও পাওয়া যাচ্ছে।
অনেক অজানা তথ্য জানলাম জগদীশচন্দ্র বসু সম্পর্কে। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
সিরিজ আকারে কি এখানে পুরো বইটি প্রকাশ করা যায়?
ধন্যবাদ নীলাঞ্জনা। হ্যাঁ – বইটি মুক্তমনায় প্রকাশিত হবে।