আমি যখন থেকে অভিজিৎ রায়কে চিনি, তখন থেকে আসলে তাকে চিনতাম না !
২০০৬ সালের কথা। আমি তখন নিয়মিত “সায়েন্স ওয়ার্ল্ড” নামে একটি মাসিক বিজ্ঞান পত্রিকা পড়ি। এক সংখ্যা শেষ হতেই পরবর্তী সংখ্যার জন্য অপেক্ষা চলতে থাকে। মফঃস্বল শহরে থাকার কারণে পত্রিকা বের হবারও ৪-৫ দিন পরে এসে হাতে পৌঁছে। সেবারের ডিসেম্বর সংখ্যাটা একটু বেশি দেরী করে হাতে আসলো। তবে পত্রিকাটা হাতে পাবার পর- প্রচ্ছদ রচনা দেখেই মনটা ভরে গেল। সে সংখ্যায় “ইনফ্লেশন থিওরি” নিয়ে(প্রচ্ছদ রচনা) বেশ বড় একটা লেখা পেলাম। ঐ একটি লেখা পড়েই বিজ্ঞানের পরিধী ও প্রকৃতির সরূপ সম্পর্কে আমার ধারনা আগাগোড়া পাল্টে গেল। আমি তখন বিজ্ঞানের নতুন নতুন তত্ত্ব সম্পর্কে জানছিলাম, আর অবাক হচ্ছিলাম। ঠিক সেই সময়টাতে এমন একটি লেখা পেলাম যা সম্পূর্ণ নতুন এক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিল। লেখাটি পড়ে বুঝতে পারলাম- দৃশ্যমান বাস্তবতার একঘেয়ে পরিধি ছাড়িয়ে বিজ্ঞান যে একটা ভিন্নধর্মী ফ্যান্টাসির জগতে প্রবেশ করেছে, সেটা মারাত্মক আকর্ষণীয় । ঐ সময়টাতে আমি লেখাটির দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হলেও, লিখাটি কে লিখেছে সে বিষয়ে কোন কিছুই ভাবিনি। আসলে সে সময়ে সায়েন্স ওয়ার্ল্ড পত্রিকায় এতসব অদ্ভুত তত্ত্ব এবং বিজ্ঞানের খবর থাকত যে- তখন শুধু লেখাগুলো নিয়েই ভাবতাম; এই লিখাটি কে লিখেছে সে সম্পর্কে কিছুই ভাবতাম না ।
এরপর আরও দুই-তিন বছর চলে গেছে। একদিন হঠাৎ করেই একটি ব্যতিক্রমী শিরোনামের একটি বই হাতে পেয়ে যাই । বইটির নাম- “ মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোজে”। লেখক- অভিজিৎ রায় ও ফরিদ আহমেদ । শিরোনাম দেখেই মনে হলো, এখানে “বহির্বিশ্বের প্রাণ” ও “জীবনের উৎপত্তি” সম্পর্কে আলোচনা থাকবে। ঐসব বিষয়ে আগ্রহের কারণে বইটি পড়া শুরু করলাম। পড়া শুরু করতেই আমার অবাক হওয়া শুরু হল। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানের অনেক বই আগে পড়েছি; সেসব বইয়ের উপস্থাপনা ও লেখার দৃষ্টিভঙ্গি তো এমন না ! একদম মৌলিক ও ভেতরের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশের বিজ্ঞান লেখকরা কেন যেন লিখতে চান না । আর নির্মোহ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিষয় আছে। সেটাও তাদের লেখায় খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এই বইটি সম্পূর্ণ আলাদা। এই আলাদা বিষয়গুলো খুঁজে পাওয়া যায় একমাত্র কিছু বিদেশি লেখকদের মাঝে। যেমন- আমি এখানে মিচিও কাকুর কথা বলতে পারি। কাকুর লেখার মধ্যে একটি বৈজ্ঞানিক অন্তর্দৃষ্টি আছে; তা আপনাকে লেখার গভীরে নিয়ে যাবে। আপনি বুঝতে পারবেন- বিজ্ঞান আমাদের কি বলতে চায়, বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো ঠিক কিভাবে প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করে, এসব । ঠিক এই বিষয়গুলো যখন কোন বাংলা বইতে পাওয়া যায়, তখন আসলে অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। এই বিষয়গুলোর দেখা পেলাম সেই নতুন বইটিতে। তখন আর আমার আগের মত অবস্থা নেই; ভাল লেখা দেখলে লেখকের নাম মনে করে রাখি। পারলে লেখকের সম্পর্কে খোঁজ নেবার চেষ্টা করি। ঐ লেখকের অন্য কোন লেখা আছে কিনা সেটাও জানার চেষ্টা করি। বইটি শেষ করার পর অবাক হয়ে ভাবলাম –এরা এত ভাল লেখেন, তাহলে আমি এখনো এদের নাম শুনলাম না কেন ? বেশ অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে মাথায় সেট করে ফেলেছি যে- এই লেখকদের বই আমাকে খুঁজে বেড় করতে হবে।
ততদিনে ব্লগ পড়া শুরু করে দিয়েছি। প্রথম সন্ধান পাই “টেকটিউনস” এবং “বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি” ব্লগের। এই ব্লগ দুটিতে মূলত তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর লেখা থাকত, বিজ্ঞানের লেখা থাকত খুবই কম। কিন্তু সে সময়টায় সেটাই আমার কাছে দামি একটি মাধ্যম মনে হত। এর পর ধীরে ধীরে আরও অনেক ব্লগের সন্ধান পাই। আর এভাবেই একদিন উপস্থিত হই, “মুক্তমনা বাংলা ব্লগে” গিয়ে। কোন একটি বিজ্ঞানের লেখা পড়ার জন্য মুক্তমনায় ঢুকে দেখতে পাই- অসংখ্য বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ রয়েছে ব্লগটিতে। মনে মনে ঠিক এমন একটি ব্লগের সন্ধানই করছিলাম আমি। দেখা গেল আমি যা কল্পনা করেছি- তা ইতিমধ্যেই তৈরি করা হয়ে গেছে। আর এই ব্লগের লেখাগুলোও অনেক সমৃদ্ধ। “মুক্তমনা” থেকেই প্রথম অভিজিৎ রায় সম্পর্কে ভালমতো জানতে পারি। জানতে পারি এই ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা তিনি নিজেই। এই ব্লগ থেকেই তার অন্য বইগুলো সম্পর্কে জানতে পারি; একদিন কিনে আনি- “ আলো হাতে চলিয়াছে আধারের যাত্রী” । এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করে ফেলি। তারপর থেকে যতই তার লেখা পড়েছি, ততই মুগ্ধ হয়েছি। একটি মানুষ এত বিষয়ে জানে কিভাবে! অভিজিৎ রায়ের বই থেকে শুধু যে লেখা পড়েছি তা কিন্তু না, তার বইয়ের শেষে শখানেক বইয়ের ও “পেপারের” রেফারেন্স থাকত। সেই রেফারেন্সগুলো আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে।
একদিন ফেসবুকে তার আইডি পেয়ে একটি রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দেই। আমি ভেবেছিলাম একসেপ্ট করার সম্ভাবনা খুব কম, কেননা এমনিতেই অনেক আইডি পেন্ডিং পরে আছে। কিন্তু একদিন পরেই রিকোয়েস্ট একসেপ্ট হয়ে যায়। আমি তো মহাখুশি। স্বয়ং অভিজিৎ রায় আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে! তার সাথে যোগাযোগের একটা উপায় তৈরি হল। তবে তার সাথে আমার খুব বেশি কথা হয়নি। ভাবতাম উনি এত ব্যস্ত মানুষ শুধুশুধু বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না । কিন্তু পরে বিভিন্নভাবে জানতে পেরেছি তিনি আসলে তেমন মানুষ না যে বিরক্ত হবেন। তবে তারপরও কেন যেন আমি বেশি নক করার সাহস করতাম না । কিন্তু নতুন কোন লিখা লিখলে সেটা নিয়ে কোন কনফিউশন থাকলে সাহস করে সেটা সেন্ড করে দিতাম। আর সাথে একটা ম্যাসেজ পাঠাতাম । আর তিনিও লেখাটা শেষ করে তার সুচিন্তিত মতামত দিতেন। বিজ্ঞান নিয়ে লেখালেখির বিষয়ে যে সাহায্য আমি কারো কাছ থেকে পাইনি, সেটা আমি তার কাছে পেয়েছি। এ দিক থেকে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে করি। তিনি ছিলেন নতুন বিজ্ঞান লেখকদের অকথিত অভিভাবক।
অভিজিৎ রায়ের সাথে যে দেখা হয়ে যাবে, সেটা আমি কল্পনাও করিনি। কিন্তু গত বইমেলায় একদম অপ্রত্যাশিতভাবেই তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। ব্যক্তিগতভাবে স্মৃতিচারণ করার মত তেমন কোন কিছুই নেই। তবে তিনি যে কতটা অসাধারণ মানুষ তা সরাসরি না দেখলে- তার লেখা পড়েই সেটা বুঝতে পারা যাবে না । তার সাথেই দেখা হয়ে যায় আরেকজন অসাধারণ মানুষ বন্যা আহমেদের সাথে। এক কথায় বলতে গেলে- “ এমন দুজন মানুষের সাথে দেখা হয়ে যাওয়াটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়ার মধ্যে একটি”। তারা কত বড় মানুষ, তাদের কাছে নিজেকে কত ক্ষুদ্র মনে হয়, অথচ কত অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে আপন করে নিতে পারেন। তারপর আর কি বলব- বলার জন্য কোন শব্দই আমার কাছে নেই। বিদায়ের আগেই শেষ বিদায় নিয়ে চলে গেলেন, না ফেরার দেশে। খুব কষ্ট হয়েছিল । কিন্তু আমি জানি- আমরা তাকে ধরে রাখার মত কিছুই অর্জন করতে পারিনি; তাই ধরে রাখতে পারলাম না ।