অনেক দুর্বিসহ পরিবেশে জন্মেছিলাম মেয়ে হয়ে। নিষ্ঠুরতার মহাসাগরে হাবুডুবু খেতে খেতে বেঁচে ছিলাম শৈশব কৈশোর আর যৌবনে পদার্পণের সময় পর্যন্ত। মেয়ে ব’লে বাইরে যাওয়া যাবে না, খেলাধুলা করা যাবে না। শব্দ ক’রে হাঁটা যাবে না, হাসা যাবে না। সমস্ত কাজ করে যেতে হবে নীরবে। উচ্ছিষ্ট খেতে হবে যদি থাকে। খাঁচায় বন্দি থাকতে হবে। এসবের সাথে সাথে ধর্ম পালনের জন্যও নিয়মিত মারধোর করা হতো ভাল ভাবে। নামাজ পড়া, উপোস থাকা, অবোধ্য ভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়া – এসবে আমার ছোটবেলা থেকেই অনীহা ছিল। অন্ধবিশ্বাস আমার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল পৈত্রিক পাওনা হিসেবে। তবুও ধর্ম পালনে আমার আপাদমস্তক অনিচ্ছা ছিল আশ্চর্যজনকভাবে। নিয়মিত পাশবিক মার খেয়েও ধর্ম পালনের প্রতি প্রবল অনিচ্ছা আমার অটুট ছিল। আমি মার খেয়ে নামাজ পড়তে গিয়ে নামাজ পড়ার ভান করতাম। মাথার চুলগুলি ঢেকে রাখতে বললে আমার মাথায় আগুন লেগে যেতো, আমার আত্মসম্মানে ঘা লাগতো। কোরান পড়তে বসিয়ে দিলে আমি রাগে অপমানে কাঁদতাম। এত মার খেয়েও জীবনে আমি আরবি পড়তে শিখিনি কিন্তু। আর আমার সহোদর ভাইদের জীবন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। কারণ এরকম নাকি ধর্মে আছে।

কালসাগরে ডুবতে ডুবতে আমি মুক্তির স্বপ্ন দেখতাম। সেই রকম পরিবেশ-পরিস্থিতিতে মুক্তির মাত্র একটা উপায় ছিল। সেটা হচ্ছে ওই পরিবেশের শোষকশ্রেণীর বিপরীত মানসিকতার কারুর সাথে বিয়ে। বহু কাঙ্ক্ষিত বিয়ে একদিন হয়েই গেল। দেখলাম, আমার স্থানান্তর হলো। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। এবার নিষ্ঠুরতম মহাকালসাগরের তলায় আমাকে পদদলিত করে রাখা হলো। এবারের খাঁচাটা আরো অনেক শক্ত।

এক কালসাগর থেকে বদলি হয়ে যে আরেক কালসাগরে গেলাম সেখানকার অবস্থা এবং আমার পরিণতি আরো কালময়। এখন আমাকে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় ছয়-সাত ওয়াক্ত নামাজের ভান করতে হয়, বছরে একমাস উপোস থাকার পরেও বছরব্যাপী নফল উপোসের ভান করতে হয়। এখন শুধু মাথার চুল ঢাকা নয়, নিজের আপাদমস্তক বস্তায় ভরে বস্তার মুখ শক্ত করে বেঁধে বস্তাবন্দী বস্তু হয়ে দিবানিশি রোবটের মত গৃহকর্ম করতে বাধ্য করা হয়। কাজ শেষ হয়ে গেলে ধান-চাল মিশিয়ে বাছতে লাগিয়ে দেয়। ধান-চাল বাছা শেষ হলে হলুদের গুঁড়া আর মরিচের গুঁড়া মিশিয়ে বাছতে লাগিয়ে দেয়। সেটা বাছা শেষ হলে জিরার গুঁড়া আর ধনিয়ার গুঁড়া মিশিয়ে দেয়। তারপর লবণ আর চিনি মিশিয়ে দেয়। আমার মুক্তজীবনের আশার গুড়ে বালি। সেই বালি বেছে ফেলে দেবার আমার আর কোনো সাধ্য রইলো না। এবার স্বপ্ন দেখতেও সাহসে কুলোয় না। জোর করে দেখতে গেলে চোখে বালি কচকচ করে ওঠে।

দিনের পর দিন উপোসের ভান ও নামাজের ভান করতে করতে দক্ষ হয়ে গেছি। সমস্যা হয়ে যায় কোরান তিলাওয়াতের ভান করতে গিয়ে। চেহারায় খুব গুরুগম্ভীর ভাব এনে, গলায় কাঁদো-কাঁদো নাকি সুর এনে অবোধ্য কিছু আওয়াজ সৃষ্টি করতাম কোরান সামনে নিয়ে। নিজের এই নিপুণ ভান-পটুতায় নিজেই নিজের মনে ফিক ফিক করে হেসে উঠতাম। আবার ভয়ে বুকও কাঁপতো ধুক ধুক। ধরা পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা। ধরা পড়লে দ্বীনী স্টাইলে খবর আছে। তাই বুদ্ধি করে বাংলা উচ্চারণসহ একটা কোরান শরীফ কিনে ফেললাম। শুরু করে দিলাম নির্ভীক উচ্চকণ্ঠে তিলাওয়াত। কাউকে পাশ দিয়ে যেতে দেখলে গলার ভলিউম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়ে তিলাওয়াত করতে থাকি – আল মুহছানা তু মিনান্নিছা য়ি ইল্লা মা মালাকাত আইমা নুকুম কিতা বাল্লা হি।

বাংলা উচ্চারণের নিচে বাংলা অনুবাদও আছে দেখতে পাই। অনুবাদ পড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। অবোধ্য ভাষায় কী লেখা আছে কোরানে তা কোনোদিন জানার ইচ্ছা জাগেনি। শুধু প্রাণ বাঁচানোর তাগিদেই পড়তাম। তবুও উচ্চারণ পড়ার সময় তার নিচের লাইনে চোখ চলে যেতো বারম্বার। দেখতাম, বাংলায় লেখা রয়েছে – বৌ পেটাও, চোরের হাতগুলি কেটে ফেলে দাও, মেয়েদেরকে ছেলেদের অর্ধেক সম্পদ দাও, দাসী সম্ভোগ করো, মানুষকে আগুনে পোড়ানো হবে, ফুটন্ত পানিতে সেদ্ধ করা হবে, লোহার মুগুর দিয়ে পেটানো হবে। এই রকম আরো কত কি! এসব পড়ে আমি ভয়ে শিউড়ে উঠতাম। আমার গা কাঁপতো, গায়ে কাঁটা দিতো। আমার মনে প্রশ্ন জাগতো – জন্মের পর থেকে ইসলাম শান্তির ধর্ম ব’লে জেনেছি, একমাত্র খাঁটি ধর্ম ব’লে জেনেছি। সেই ইসলামের মূল গ্রন্থে এত জঘন্য বর্বরতা কেন? একটা বই কীভাবে এত আজেবাজে কথায় ভরপুর হতে পারে? এসব প্রশ্ন মনে আসতো ব’লেও ভয়ে কাঁপতাম। মনে হতো, এরকম প্রশ্ন মনে আসলে কঠিন গুনাহ হবে। মনকে শাসাতাম প্রবলভাবে। বলতাম, প্রশ্ন করো না, মন। চোখকে শাসাতাম। বলতাম, অনুবাদের দিকে তাকিওনা, শুধু অবোধ্য উচ্চারণ পড়ে যাও, চোখ। মন, চোখ কেউই আমাকে পাত্তা দিত না। বেয়াড়া মন বেপরোয়াভাবে প্রশ্ন করতো – পৃথিবী সমতল নাকি? চাঁদের আলো আছে নাকি? সূর্য পঙ্কিল জলাশয়ে অস্ত যায় নাকি? নারীদের কেন এত অসম্মান এখানে? পুরুষদেরকে কেন বহুবিবাহ করতে উদবুদ্ধ করা হয়েছে? দাসীদের কেন সম্ভোক করতে বলা হয়েছে? অমুসলিমদের সাথে কেন বন্ধুত্ব করা যাবে না? চুরি করলে জেল জরিমানা হবে। হাত কেটে ফেলতে হবে কেন? চোখ আমার অবাধ্য হয়ে পড়েই যেতো, মানুষকে প্রেমের অপরাধে দোররা মারো, অমুসলিমদের হাত পা কেটে দাও, তাদের আঙুলের কড়ায় কড়ায় আঘাত করো, জোড়ায় জোড়ায় হত্যা করো ইত্যাদি।

আমি বুঝে গেলাম, এসব বানোয়াট, সব ভণ্ডামি। শুধু ইসলাম নয় পৃথিবীর সকল ধর্মই ভুয়া। মানুষকে বোকা বানিয়ে, ভয় দেখিয়ে সুবিধা ভোগ করার জন্য কপট চতুর লোকদের তৈরি এসকল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কোনো ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। বরং ঈশ্বরেরাই মানুষের সৃষ্ট। জগৎ সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে। কোরানের অনুবাদ খতম দিয়ে আমি পাগলের মত হয়ে গেলাম। আমি অনুধাবন করলাম, কোরান অধিকাংশ মানুষই নিজের ভাষায় পড়ে না। তাই জানে না এখানে কী লেখা আছে। আমি তীব্রভাবে কর্তব্য অনুভব করলাম, কোরানে কী লেখা আছে তা সকলকে জানিয়ে দেবার। আমি অন্ধবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে গেছি, অন্যরা সেখানে ডুবে মরবে কেন। শুধু নিজে মুক্ত হলে ত হবে না। সবাইকে মুক্ত করতে হবে। সত্য জানাতে হবে সবাইকে। তাই সবার কাছে কোরানের অনুবাদ তিলাওয়াত করতে শুরু করলাম। কারুর সাথে দেখা হলে তিলাওয়াত করতে শুরু করি। নতুন কারুর সাথে পরিচয় হলে তিলাওয়াত করে শোনাই। আমি কোরানের একটা বাংলা রেকর্ডারে পরিণত হই। কারুর সাথে কথা শুরু হলেই রেকর্ড চালু করে দিই। সবাই বিরক্ত হয় আমার কথায়। রেগে যায়। আমার কথা কেউ শোনে না, বিশ্বাস করে না। কেউ বইটির অনুবাদ পড়ে না দেখেই বলে, আমি মিথ্যা বলছি। ঘরে ও বাইরে সবাই একবাক্যে ব’লে দেয়, আমার সাথে সম্পর্ক রাখা হারাম। আমি খুব একা হয়ে যাই। হতাশ হই, নিরাশ হই। তবুও সবাইকে ভয়ানক নর্দমা থেকে মুক্ত করার বিবেকী তাড়না অনুভব করি। ছোটভাইকেও ফোন করে করে তিলাওয়াত শোনাতে থাকি।সেও বিরক্ত হয়। তবুও আমি কোরানে হাফিজের মতো তিলাওয়াত করে চলি। একদিন সে আমাকে বলে, মুক্তমনা নামে একটা সাইট আছে। তুমি মুক্তমনা পড়ো।

আমি মুক্তমনা পড়তে শুরু করলাম। আহা, এ আমি কীসের সন্ধান পেলাম! দিনরাত পড়ি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে পড়ি। ডুবে থাকি। আমি এক বিশাল লাইব্রেরির সন্ধান পেলাম। এখানে আছে বিজ্ঞানের প্রান্তিক সব খবর, আছে যুক্তি, আছে সকল মানুষের সমান অধিকারের কথা, আছে মানবতার কথা, আছে সাহিত্য, আছে ইতিহাস, আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, আছে কবিতা। আরো কত কি! আমি পড়ে পড়ে বিভোর হই, মুগ্ধ হই। নিজেকে আর একা লাগে না আমার। আমার মত অন্ধবিশ্বাসমুক্ত মানুষ অনেক আছে আরো। যারা সমাজ পরিবর্তন করতে চায়, মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, সকল মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদী করে তুলতে চায়, একটি মানবিক সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার জন্য যারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যায় নিঃস্বার্থে। আমি এদেরই একজন হয়ে গেলাম মনে মনে।

আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী নই। বিজ্ঞানের সাধারণ ব্যাপারগুলিও জানতাম না। মুক্তমনায় এসে আমি অভিজিৎ রায়ের লেখাগুলি মন্ত্রমুগ্ধের মত পড়তে থাকলাম। আহা, কী অপরূপ তাঁর লেখার ভাষা! কী আশ্চর্য সুন্দর তাঁর লেখনীর স্টাইল! তাঁর একেকটা লেখা তথ্যে উপাত্তে ভাষায় প্রকাশে সৌন্দর্যে এমন পরিপূর্ণ! এ যেন লেখা নয়, যেন অদ্ভুত সুন্দর কোনো শিল্প। অভিজিৎ রায় হয়ে উঠলেন আমার অভিদা, আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধার ব্যক্তি, আমার হিরো। তিনি এমন একটি জায়গা তৈরি করেছেন যেখানে মানুষ এসে বিজ্ঞান জানতে পারে, ধর্মগুলির ভণ্ডামি জানতে পারে, অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে। মানুষ এসে কথা বলতে পারে। বিজ্ঞানের কথা, মানবতার কথা, ধর্মনিরপেক্ষতার কথা, সাহিত্যের কথা, শিল্পের কথা।

আমি কোরান পড়ে অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হবার পরেও কাউকে সরাসরি বলতাম না, আমি নাস্তিক। কোরানের আয়াতগুলি বলে যেতাম। ওরা জিজ্ঞেস করতো, আপনি এভাবে ধর্মের সমালোচনা করেন! আপনি নামাজ পড়ে ন না? আমি কাঁচুমাচু করে বলতাম, মাঝে মাঝে পড়ি আরকি। সব সময় পড়ি না। তো আপনি রোজা রাখেন না? আমি বলতাম, রাখি, তবে সবগুলি রাখি না। মিথ্যা বলতাম মানুষকে। আমি যে পুরোপুরি অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছি তা বলতে সংকোচ বোধ করতাম, লজ্জা বোধ করতাম, সমাজ সংসারকে ভয় পেতাম। একসময় মানুষের লাথি খেয়ে জড় পদার্থের মতো পড়ে থাকতাম। টুঁ-শব্দও করতাম না। ততদিনে আমরা আলাদা বাসা নিয়েছিলাম। তাই নিজেকে আর হ্যালোইন কস্টিউম (বোরকা) বা বস্তায় পুরে রাখা থেকে একটু মুক্তি পেয়েছিলাম। তবুও মাথার চুল ঢেকে রাখার বাধ্য-বাধকতা ছিল। মুক্তমনা পড়ে পড়ে, এখানকার বিতর্কগুলি পড়ে পড়ে আমি কথা বলতে শিখি। আমার সাথে কেউ অন্যায় করলে জবাব দিই। প্রতিবাদ করি। আমার চুলগুলিকে আমি বন্দিত্ব থেকে মুক্ত করে দিই। আমি বস্তা থেকে বেরিয়ে আসি। এবার আমি নিজের থেকেই সবাইকে বলি, আমি নাস্তিক। আমি কোনো উপাসনা করি না কোনো বানোয়াট কিছুর কাছে। প্রার্থনা মানে সময় নষ্ট। আমি আর সংকোচ বোধ করি না, লজ্জা করি না, ভয় করি না নিজেকে অন্ধবিশ্বাসমুক্ত বলতে। আমি এখন বলতে পারি, নাস্তিকতা কোনো অপরাধ নয়, লজ্জা পাবার বিষয় নয়। ধর্মগুলিই বরং খারাপির বিশাল বিশাল গুদাম। আমি কোদালকে কোদাল বলতে আর দ্বিধা করি না। আমি নিজের অধিকার সচেতন হই। আমি বুঝতে শিখি, আমার স্বাধীনতা আমার নিজের কাছে। আমার পোষাকের স্বাধীনতা, আমার খাওয়ার স্বাধীনতা, আমার পড়ার স্বাধীনতা ইত্যাদি আর কারুর কাছে জিম্মি নয়। আমি আর নিজেকে বস্তাবন্দী বস্ত নয়, একজন মানুষ ভাবতে শিখি। এসবই মুক্তমনার অবদান।

এবার আমি শুধু নীরব-পাঠক হয়ে থাকতে চাইলাম না। মুক্তমনায় মন্তব্য করার, লিখার আমার প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগলো। আমি এই মানুষগুলির সাথে মত বিনিময় করতে চাই। নিজের কথা লিখতে চাই এখানে। কিন্তু কিভাবে তা জানি না। আমি বাংলা টাইপ করতে জানতাম না। কম্পিউটারের ব্যবহার কিছুই জানতাম না। ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কীভাবে বাংলা লিখতে হয়। সে বললো, অভ্র ডাউনলোড করো। তারপর টাইপিং শেখো। আমি মনপ্রাণ দিয়ে টাইপিং শিখে ফেললাম শুধুই মুক্তমনায় লেখার জন্য। আবার ভাবলাম, আমি তো লিখতেই জানি না। আমি কিছু মন্তব্য করলে, কিছু লিখে পাঠালে কি মুক্তমনায় তা ছাপানো হবে। একদিন সাহস করে একটা মন্তব্য করেই ফেললাম। কিছুক্ষণ পর পর মুক্তমনায় ঢুকে দেখছি মন্তব্যটি ছাপানো হয়েছে কিনা। না, দেখছি না। এক সময় দেখলাম, আমার মন্তব্যটি ছাপানো হয়েছে। আমার প্রিয় মুক্তমনায় আমার মত সামান্য একজন মানুষের সামান্য একটি মন্তব্য ছাপানো হয়েছে- এই আনন্দে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। এবার প্রায় সব লেখায় আমি আমার মতামত জানাতে লাগলাম। কয়েকদিন পরে মডারেশনের পক্ষ থেকে আমাকে ইমেইল চেক করতে বলা হলো। কারণ আমাকে সদস্যপদ দেওয়া হয়েছে। আমার আনন্দ আর ধরে না। দুরু দুরু বক্ষে একটা লেখা লিখে পাঠিয়ে দিলাম। লেখা ছাপা হয়ে গেল। সেই প্রথমদিন থেকে মুক্তমনা আমার কতটুকু আপন তা বলে বোঝাতে পারবো না। অভিদা ও তাঁর তৈরি মুক্তমনার কাছে আমার এক জীবনের চেয়ে বেশি ঋণ। কোরানের অনুবাদ পড়ে অন্ধবিশ্বাসমুক্ত নাস্তিক হওয়ার পরে মুক্তমনায় এসে আমি বদ্ধ উন্মাদ হওয়া থেকে বেঁচেছি। সমমনা অন্ধকারমুক্ত মানুষদের সাথে মত বিনিময় করার সুযোগ পেয়েছি। বিজ্ঞান দর্শন সাহিত্য ইতিহাস ইত্যাদি সম্পর্কে জেনেছি অনেক অনেক কিছু। সমকামিতা ও সমকামীদের প্রতি ছিল আমার ঘৃণা; যা আমার মধ্যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে সংক্রমিত হয়েছিল। অভিদার লেখা সমকামিতা বইটি পড়ে সেই ভ্রান্ত মনোভাব কেটে গেছে। বইটি পড়ে আমি জেনেছি, সমকামিতা কোনো অপরাধ নয়, যেমন কোনো অপরাধ নয় বিষমকামিতা। জেনেছি এর বৈজ্ঞানিক ব্যাপারগুলিও। জীবনে আমি কিছুই হতে পারিনি। আমি অন্ধবিশ্বাসমুক্ত হয়েছি এবং আমি মুক্তমনার একজন লেখক- এটা আমার জীবনের সকল ব্যর্থতাকে ভুলিয়ে দেয়।

জাতি ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে পৃথিবীর যেকোথাও যেকোনো মানুষের উপর কোনো অন্যায় হলে অভিদা সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লেখেন, অত্যাচারিতের পাশে দাঁড়ান তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁর লেখাগুলি পড়ে বরাবরই মনে হয়, একজন মানুষ এত পড়াশোনা করে কীভাবে। অনেক পড়াশোনা অনেকেই করে। কিন্তু জ্ঞান আহরণ করে তা সন্নিবেশিত করে এমন শিল্পের মত করে লিখতে পারে ক’জন? জ্ঞান আহরণে এমন সুতীব্র পিপাসা এবং তা মানুষকে জানানোর এমন অসম্ভব ক্ষ্যাপামি আর কারো মধ্যে আছে কিনা জানি না।

অভিদাকে মেসেজ দিয়ে দিয়ে বলতাম, দাদা, এই বিষয়ে একটু লিখুন, ওই বিষয়ে একটু লিখুন। আমার অনুরোধে লিখেছিলেনও। সে লেখা দেখে আমার সেকি আনন্দ! আমার অনুরোধে অভিদা লিখেছেন। কতজনকে যে আমি সেই লেখা পড়িয়েছি। আনন্দে ফেটে পড়ে গর্ব করে বলেছি, দ্যাখো, আমার কথাতে দাদা এই লেখাটা লিখেছেন। লিখেছিলেনও ফাটাফাটি যথারীতি।

আজ বাংলা ভাষায় অনলাইলে অনেকেই লিখছেন ধর্মের বিরুদ্ধে। এর শুরুটা করেছেন অভিদা। অনলাইনে বাংলায় নাস্তিক্যবাদের পথিকৃৎ হচ্ছেন অভিদা। আলো হাতে তিনিই প্রথম নেমেছিলেন বিষম আঁধারের পথে মানুষকে আলো দেখাতে, অন্ধকার হতে উদ্ধার করতে। যেন-তেন আলো তো নয়, নেমেছিলেন তিনি নক্ষত্র হাতে নিয়ে। তিনি জানতেন, এই পথ মসৃণ নয়, স্বাপদসংকুল। তিনি জানতেন, এ পথে হায়েনারা ওঁৎ পেতে থাকে নররক্তের লোভে। তিনি লিখেছিলেন, বিনা রক্তে বিজয় অর্জিত হয় না। নিজের রক্ত দিয়ে, এই ক্ষণজন্মা জীবন ইসলামিস্টদের হাতে বলি হতে দিয়ে কি নিজের কথার প্রমাণ দিয়ে গেলেন, অভিদা?

অভিদা বিজ্ঞানের কথা লিখেছেন, যুক্তির কথা লিখেছেন, লিখেছেন মানবতার কথা, মানবাধিকারের কথা, লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের কথা, লিখেছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা, লিখেছেন যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে। মুক্তমনা নামের একটা অসাধারণ সাইট তৈরি করেছেন যেখানে এসে মানুষ এসব বিষয়ে কথা বলতে পারে, আলোচনা করতে পারে, বিতর্ক করতে পারে। অনেক অপরাধ করেছিলেন অভিদা। আর এই অপরাধেই তাঁকে খুন হতে হয়েছে তাঁর প্রিয় জন্মভূমির মাটিতে, তাঁর প্রিয় বইমেলার ফুটপাতে। যে জায়গায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন, তাঁর সে অত্যন্ত আপন, চিরচেনা জায়গায় হাজার লোকের ভীড়ে, অনেকগুলি সিসিটিভির সামনে, পুলিশের উপস্থিতির অদূরে ইসলামিস্টরা তাঁকে নির্বিঘ্নে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করে চলে গেছে। একবার ভাবুন, বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামিস্ট খুনিরা কতটুকু স্বাধীন, কতটুকু নির্ভীক। নীলকে খুন করেছে ওরা তার বাসায় গিয়ে দিনে দুপুরে। পাঁচতলা বিল্ডিঙের একটি ফ্ল্যাটে থাকতো নীল। সেখানে গিয়ে দিনে দুপুরে দাপটের সাথে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে ওকে। বাস্তায় দাঁড়িয়ে একটা চকোলেট খাওয়া যেমন কোনো ব্যাপার না, কোনো অপরাধ না, বাংলাদেশে লেখক খুনও তেমনি কোনো ব্যাপারই না। পাকিস্তানি হায়েনারা যেমন তালিকা করে বাংলার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল এখনকার ইসলামিস্টরাও তাই করছে। জাতির আলোকিত শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করেছে ওরা। সরকার কেন এসব হত্যাকাণ্ডের বিচার করছে না? এটা কি কোনো দেশ, নাকি কশাইখানা? এটা কি কোনো দেশ নাকি মানবতার বধ্যভূমি?

অভিদার রক্তমাখা মগজ পড়ে আছে ফুটপাতে অর্থহীন ভাবে, তাঁর কোপানো নিথর দেহ অসহায়ভাবে উপুড় হয়ে পড়ে আছে ফুটপাতে তাঁরই তাজারক্তের স্রোতের উপর। বন্যাদির মাথায়ও লেগাছে কয়েকটি কোপ। একটা আঙ্গুল হারিয়েছেন তিনি। কোপ খাওয়া শরীরে, একটা আঙ্গুল হারিয়ে, নিজের এবং তাঁর প্রেমিক, জীবনসঙ্গী ও শ্রেষ্ঠবন্ধুর রক্তের স্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে সবার কাছে সাহায্য চেয়ে যাচ্ছেন, কেউ এগিয়ে আসুন, অভিকে বাঁচান।
চারিদিকে এতগুলি সিসিটিভির একটিতেও অভিদাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করার দৃশ্য ভিডিও হয়নি – এই অবান্তর কথা কি আমরা বিশ্বাস করি? ভিডিও থাকলেই বা কি? খুনিদের সবাই খুন করতে দেখলেই বা কি হতো? এই সকল খুনিদের বিচার করবে কে? যে সরকার বিজ্ঞানমনস্ক মানবতাবাদী নাস্তিক লেখকদের হত্যার জন্য প্রকাশ্যে খুনিদের প্রত্যক্ষ উৎসাহ উদ্দীপনা দিয়ে যাচ্ছে, ইসলামিস্টদের বানানো লিস্ট অনুযায়ী নাস্তিক লেখক ধরে ধরে জেলে পুরছে, ব্লাসফেমী আইন পাস করছে, মদিনা সনদ মোতাবেক দেশ চালাচ্ছে সেই সরকার কি করবে হুমায়ূন আজাদ, থাবা বাবা, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় ও নিলয় নীলের খুনিদের বিচার?

তবুও আমরা বিচার চেয়ে যাবো। আমরা আমাদের কলমের লড়াই চালিয়ে যাবো। আমরা কলম ছাড়ব না, কীবোর্ড ছাড়ব না। সরকারকে বাধ্য করে ছাড়বো এই সকল নিরপরাধ মানুষের হত্যার বিচার করতে।
অভিজিৎ-চেতনার মৃত্যু নেই। অভিজিৎ-দার লেখাগুলির মৃত্যু নেই। নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলবে তাঁর লেখাগুলি অনন্তকাল। এক অভিজিৎ থেকে অগণিত অভিজিৎ সৃষ্ট হয়েছে, হচ্ছে, হতে থাকবে।