ভেবে রেখেছিলাম মুক্তমনার রজত জয়ন্তী কিংবা হীরক জয়ন্তীর জন্যে যখন লেখা আহবান করা হবে তখন আমার লেখালেখির গল্পটা সেই উপলক্ষ্যে লিখবো। লেখালেখির গল্পটা যেখানে শুরু হবে, সেখানে মুক্তমনা তথা অভিজিৎ ভাইয়ের কথা আসবে না সেটা কী করে হতে পারে? হ্যাঁ, আজকাল আর মুক্তমনায় হয়তো নিয়মিত নই, নিয়মিত নই আসলে কোন ব্লগ বা ফেসবুক গ্রুপেই। তারপরও টুকটাক লেখালেখি হয়ে যায়, আর যেখানে আমার লেখার গল্প সেখানে মুক্তমনা তথা অভিজিৎ রায় আছেন বই কী!

আমার কাছে মুক্তমনা আর অভিজিৎ রায় সমার্থক নাম।

অভিজিৎ রায় ছাড়া মুক্তমনা ভাবি নি আর কোন স্বপ্নে বা দুঃস্বপ্নেও ভাবি নি এই দিনটা উপলক্ষ্য করে কিছু কখনো লিখবো।

বিয়ে করে প্রথমে দেশছাড়া, তার কিছুদিন পর থেকে, ধরতে গেলে দেশ থেকে আনা বই, পোস্টে আসা সাপ্তাহিক ২০০০, লন্ডন থেকে আসা জনমত বাদ দিলে বাংলাদেশের সমস্ত প্রায় খবরাখবর ছাড়া। বাংলাদেশে তখনও এতো ওয়েব পোর্টাল জন্মায় নি।

আমি তখন ওলন্দাজ ভাষার সাথে কুস্তি করে নাস্তানাবুদ হয়ে নিজের গ্র্যাজুয়েশান নিয়ে চরম ব্যস্ত। তারপর মা হয়ে সাংসারিক ফুরসতে অন্তর্জালে এদিক ওদিক ঢুঁ মারি। এক আত্মীয়ের সুবাদে ভিন্নমতে আসি। ভিন্নমতে তখন গুটিকয়েক মানুষ লেখালেখি করেন যাঁদের কাউকে কাউকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি আর অনেক অচেনা লেখকের মাঝে ক্ষুরধার যুক্তি নিয়ে লেখেন অভিজিৎ রায়। আস্তিকতা–নাস্তিকতা নিয়ে তুমুল বির্তক, যুক্তি, মাঝে মাঝে হাস্যরস কিংবা ব্যক্তিগত আক্রমণ সবই ছিল। এরপর-ভিন্নমত থেকে ‘মুক্তমনা’।

অনেক সময় একটি লেখার বিপরীতে অন্য একটি লেখা নিয়ে বেশ অনেকদিন ধরেই বির্তক চলতে থাকতো। লেখা পড়তে পড়তে এর যুক্তিতর্ক এমনকি লেখকের সাথেও মানসিকভাবে যুক্ত হয়ে যেতাম। সেধরনের কোন লেখায় প্রতিক্রিয়া জানানো থেকেই মুক্তমনায় যুক্ত হই। কিন্তু তখন বাংলা টাইপ করতে জানতাম না, বাংলিশ টাইপ করতাম কিংবা ইংরেজিতে লিখতাম। বাড়িতে বিজয় কিবোর্ড ছিল, কিন্তু সেটার লে আউট দেখে বাংলা টাইপ করা বিশাল ঝক্কির কাজ মনে হত আর তাই ইচ্ছে করলেই কিছু লেখাও হয়ে উঠতো না। যদিও ওয়ার্ডে কিছু লেখা হতো তারপর পিডিএফ আর করতে পারতাম না, ফ্রি পিডিএফ ফাইল করার অপশন বেশ অনেক পরে ইন্টারনেটে খুঁজে পেয়েছিলাম। সেসব কাটিয়ে উঠে যদি কোন কিছু কখনো লিখেছি, লেখাটা কোন রকমে লিখে শেষ করে অভিজিৎ ভাইকে মেইল করে দিয়ে ঝাড়া হাতপা। লেখা পিডিএফ করে কখনো কখনো লেখায় সুন্দর, সামঞ্জস্যপূর্ণ ছবি যোগ করে দিয়ে আপ্লোড করে দিতেন।

মেইলে তাগাদা দিলেন, তারপর লিঙ্ক পাঠালেন বর্ণসফট ডাউনলোড করার জন্যে। করছি করছি করেও অনেকদিন ফেলে রাখার পর যখন বর্ণসফট ডাউনলোড করলাম, বাংলায় লেখালেখির একটা বিরাট দরজা খুলে গেলো। কোন কিছু একবার হাতে ফিক্সড হয়ে গেলে আমি সহসা পরিবর্তন করতে চাই না, কিছুটা সনাতনিদের মত চরিত্র আমার। সবার কাছে ‘অভ্র, অভ্র’ শুনে গেলেও আমি বর্ণসফটই ব্যবহার করে যাচ্ছিলাম। বর্ণসফটের পর অভ্র, সেও অভিজিৎ ভাইয়ের বলাতেই ব্যবহার শুরু করলাম। জাহেদ, মেহুল, বিপ্লব, অর্ণব, নন্দিনী, নুরুজ্জামান, কণা, অজয় স্যার, জাফরুল্লাহ, ভজনদা, আকাশ মালিক সাহেব, লুনা শিরীন কত তর্ক বির্তক, কতো সুন্দর সময় কেটেছে এখানে। কতো কতো ঘন্টা কেটে গেছে।

লেখালেখি নিয়ে তর্কে জড়িয়ে গেলে অনেক সময় অভিজিৎ ভাই বিরক্ত হতেন। মেইল করতেন, কী দরকার ছিলো! ভাল লেখা অনুবাদ কর, আর্টিকেল পড়। লেখার লিঙ্ক দিতেন, বইয়ের নাম দিতেন। একজন আলোকিত মানুষের চেষ্টা থাকে তার চারপাশ আলোয় ভরিয়ে দিতে, সেদিক থেকে অভিজিৎ রায়ের চেষ্টার কোন কমতি ছিলো না। আমার মত কতজনকেই হাত ধরে লেখার হাতেখড়ি দিয়েছেন, বাংলা টাইপ করা শিখিয়েছেন। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ছোটবেলার লেখালেখা খেলা বহু আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল, অভিজিৎ ভাইয়ের মত তুখোড় একজন মানুষের উৎসাহ, উদ্দীপনা না পেলে লেখার অভ্যেসটা আর কখনোই সামনে আসতো না। আজ লেখার জন্যে যতোটুকু পরিচিতি আছে তার অবদান এই মানুষটিরই।

এই মানুষটি কি শুধু লিখতেন আর পড়তেন? না, এর বাইরেও মানুষের জন্যে তাঁর আরো অনেক দায়িত্ব ছিল, বন্যাদুর্গতদের সাহায্যের জন্যে ২০০৪ সালে প্রজেক্ট করেছিলেন, রৌমারিতে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের পড়াশোনার জন্যে স্কুল খুলেছিলেন, ২০০১-এ নির্যাতিত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্যে প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছিলেন, বন্দী ব্লগারদের জন্যে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন দেশেবিদেশে জনমত গড়ে তুলে। সমাজের কোন সমস্যাই ছিলো না যেটাতে তিনি সচেতন ছিলেন না কিংবা সুবিধাবাধীদের মুখ লুকিয়ে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতেন।

তিনি তাঁর বক্তব্য নির্ভীক ভাবে লিখতেন। এসব দিকে অজয় স্যার আর অভিজিৎ ভাই, পুত্র আর পিতা একে অন্যের পরিপূরক ছিলেন। দুজনেই দুজনের কাজের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন রাখতেন। প্রায় সব সমসাময়িক ব্যাপারেই অভিজিৎ ভাইয়ের লেখা পড়ার সময় আমরা প্রায় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করতাম, অভিজিৎ ভাই যে-বিষয় নিয়ে লিখেছেন, সেই বিষয়ে তাঁর লেখাটি পড়লেই চলবে; আর কারো লেখা পড়তে হবে না। এতো খেটে, এতো পড়াশোনা করে, আদ্যোপান্ত খুঁটিনাটি ধরে খুব কম লেখকই কিছু লেখেন। সমস্ত তথ্য, তত্ত্ব জড়ো করে এক জায়গায় পরিবেশন করতেন তিনি। প্রচণ্ডরকমের সংগীতপিপাসু ছিলেন এই তরুণ বিজ্ঞানমনস্ক বিজ্ঞানলেখক। নিভৃতচারী এই ভদ্রলোক নিজের সম্পর্কে একটি কথাও বলতে চাইতেন না, নিজের কিছু নিয়ে গর্ব করা তো দূরে থাক। তবে নিজের লেখার স্বীকৃতি পেলে বড্ড আনন্দিত হতেন তিনি।

প্রকৃতির অবাধ্য নিয়মে যেমন গোত্র গড়ে, তেমনি আবার জীবনের টানে প্রকৃতির নিয়ম মেনেই রাস্তা আলাদা হয়ে যায়। মুক্তমনার অনেকেই আমরা সবাই যার যার মত আবার জীবনের অন্য পর্বে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। কদাচিৎ মেইল কিংবা ফেসবুকে কারো কারো সাথে যোগাযোগ, কারো কারো সাথে ফোন বা কোথাও সামনাসামনি দেখা। রঙিন সেই দিনের স্মৃতিচারণ। আর ফেসবুকের কল্যাণে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না-থাকলেও পরোক্ষ যোগাযোগ থেকেই যায় বেশিরভাগ সময়।

তারপর এলো ভয়াবহ সেই রাত…যদিও অনেকদিন হয়তো এর মাঝে কেটে গেছে কিন্তু মনে হয়…এইতো সেদিন…

ভুল সময়ে ভুল দেশে জন্মেছিলেন আপনি অভিজিৎ রায়। প্রাণের দামে সেই ভুলের মাশুল আপনি শোধ করলেন ভাই। এ মৃত্যু পুরো জাতির জন্যে লজ্জার আর কলঙ্কের।

হ্যাপি বার্থডে অভিজিৎ ভাই, হ্যাঁ আপনাকেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, কারণ সত্যের মৃত্যু নেই। অভিজিৎ রায়েরা কখনো হারে না, তারা হারিয়ে যেতে পারে না। অভিজিৎ রায় বেঁচে থাকেন তাঁর শত শত বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের কাছে, যারা কখনো কোন কারণে তার কাছাকাছি এসেছিলো তাদের হৃদয়ের মাঝে।

জানি আমি আপনি ভাল আছেন, ভাল থাকবেন।

ক’দিনের অপেক্ষামাত্র যোগাযোগ হয়ে যাবে হয়তো এই মহাবিশ্বের কোথাও আবার। কোন গ্রহে, কিংবা ইথারে তরঙ্গে, কে জানে…টু মেনি থিঙ্গজ…ইয়েট টু ডিসকোভার…

তানবীরা
০৮/০৯/২০১৫