অভিজিৎ রায়ের লেখা আমি প্রথম পড়ি সাপ্তাহিক যায় যায় দিনে। শফিক রেহমানের সাপ্তাহিক যায় যায় দিন বাংলাদেশে এক সময় বেশ জনপ্রিয় ছিল। অভিজিৎ রায়ের লেখাটির শিরোনাম মনে নেই, তবে বিষয়বস্তু মনে আছে। বাংলা সাহিত্যে যৌনতা প্রকাশের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা এরকম কিছু। লেখাটি এতটাই আধুনিক এবং অন্যরকম ছিল যে অভিজিৎ রায় নামক লেখকের অন্য লেখার খোঁজ করতে শুরু করি।

টেকনোলজিতে আমি খুঁড়িয়ে চলা মানুষ। ইন্টারনেটে যে তিনি বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু করে দিয়েছেন তা জানতেও পারিনি সেই সময়। ২০০৫ সালের শেষের দিকে আজিজ সুপার মার্কেটের বইয়ের দোকান থেকে পেয়ে গেলাম ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’। বইটা পড়ে মনে হলো অভিজিৎ রায় সত্যিই আলো হাতে বের হয়ে পড়েছেন আমরা যারা মনের কোণের অন্ধকারে ঈশ্বরের-ইচ্ছা-ছাড়া-গাছের-একটা-পাতাও-নড়ে-না জাতীয় অন্ধ-বিশ্বাসে ভর করে বেঁচে আছি তাদের চোখ খুলে দিতে। বইটি পড়তে পড়তে মুগ্ধ হয়ে ভাবতে বসলাম – এভাবেও বিজ্ঞান লেখা যায়? এত গভীর অথচ একটুও ভার লাগে না। এত জটিল বিষয় অথচ কত স্বচ্ছন্দ। বাংলায় বিজ্ঞান রচনায় একটা নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছেন অভিজিৎ রায় তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের মাধ্যমে।

‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’র মলাট-তথ্য থেকে জানতে পারি ‘মুক্তমনা’ ওয়েবসাইট সম্পর্কে। মুক্তমনা ততদিনে পাঁচ বছর পার করে ফেলেছে। মুক্তমনা শব্দটি এতটাই জুৎসই এবং জোরালো ছিল আমার কাছে যে মুক্তমনার নিয়মিত পাঠক হয়ে উঠতে আমার বেশিদিন সময় লাগেনি। মুক্তমনার যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করেছিল তা হলো সত্যিকারের মুক্তভাবে আলোচনার একটা প্লাটফর্ম। গভীর বিশ্লেষণ আর যুক্তির চর্চা চলছে সেখানে।

বাংলাদেশের গ্রামে প্রায় গর্তজীবী হয়ে বেড়ে উঠেছি আমি। সেখানে নিত্যদিন দেখেছি পেশির জোরের জয়। পেশির জোর বেশি না থাকলে নিদেন পক্ষে গলার জোর। বাংলাদেশে সবকিছুই বড় বেশি ব্যক্তিনির্ভর। বস্তুনিষ্ঠতার ঠাঁই সেখানে নেই বললেই চলে। এ ব্যাপারে অনেকের মতো আমারো অনেক ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে।

বাংলাদেশে আমার পুরো কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন কেটেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের শাসনে তলোয়ারের ভয়ে মুখে কুলুপ এঁটে। একটা ঘটনার কথা বলা যাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলামের সেমিনার ‘কোরান তেলাওয়াত’ ছাড়া শুরু হওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় ছাত্রশিবির। তাদের সাথে যোগ দেয় বিভাগের অনেক মৌলবাদী ইসলামী-পদার্থবিজ্ঞানী। কিন্তু বিভাগীয় সভাপতি বললেন, “বিজ্ঞানের সেমিনার কি কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান? আকিকা কিংবা জানাজা? জানাজায় গিয়ে আমি বিগ ব্যাং ও ব্ল্যাক হোলের তত্ত্ব আলোচনা করতে শুরু করলে ভালো লাগবে? বৈজ্ঞানিক সেমিনারে ধর্ম টেনে এনো না।” ছাত্র শিবির বললো, “তোমাকে টেনে ব্ল্যাক হোলে ঢুকিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করছি ব্যাটা নাস্তিক।” কার্যত তাই হলো। ছাত্রশিবির ওই প্রফেসরের দিনরাত্রি যন্ত্রণাময় করে তুললো। বাসায় তালা লাগিয়ে দিয়ে মাইক লাগিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছে দিনের পর দিন। তবুও সান্ত্বনা যে প্রাণে মেরে ফেলেনি স্যারকে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসন চুপচাপ মজা দেখেছে সেদিন। সেই প্রফেসরের তত্ত্বাবধানে স্নাতকোত্তর গবেষণা করার কারণে আমাকেও সইতে হয়েছে অনেক দুর্ভোগ। সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

প্রবীর ঘোষের ‘অলৌকিক নয় লৌকিক’ এবং অন্যান্য বই পড়ে খুব মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কাজকর্ম দেখে একটা প্রশ্ন প্রায়ই মনে হতো। তারা ভারতে বসে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার ও শোষণ এবং প্রতারণার বিরুদ্ধে যেরকম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পেরেছেন সাংগঠনিকভাবে। বাংলাদেশে তা কতটুকু সম্ভব? অসম্ভব বলেই মনে হতো আমার। বাংলাদেশে তখন কেউই যে যুক্তিবাদের পক্ষে লিখছেন না তা কিন্তু নয়। আহমদ শরীফ এবং হুমায়ূন আজাদের লেখাগুলো যথেষ্ট উদ্দীপনাময়। কিন্তু তাঁদের লেখায় আবেগ একটু বেশি বলে মনে হয়েছে আমার। একেবারে নিরাবেগ হয়ে যুক্তির কথা বলা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেটা পাবার জন্যই মনের মধ্যে প্রচন্ড একটা তৃষ্ণা কাজ করছিল সব সময়।

মুক্তমনার ফোরামে খোলামেলা আলোচনা চলতে দেখে এবং আলোচনার ধরন দেখে মনে হলো এটার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম এতদিন। মুক্তমনায় দেখলাম যুক্তির আলোয় মনের আঁধার কেটে যাচ্ছে। যে মানুষটি মুক্তমনা দাঁড় করিয়েছেন এবং বিশাল বিশাল প্রবন্ধ লিখে চলেছেন তিনি অভিজিৎ রায়। আমি অভিজিৎ রায়ের লেখা এবং কাজ ভালোবেসে ফেললাম। মুক্তমনার প্রতি নিজের ভালোলাগার কথা জানিয়ে দুই পৃষ্ঠা লিখেও ফেললাম। লিখে ই-মেইল করে দিলাম মুক্তমনার ঠিকানায়। এক দিনের মধ্যেই আমি একটা ই-মেইল পেলাম স্বয়ং অভিজিৎ রায়ের কাছ থেকে। মুক্তমনায় নিয়মিত লেখার ব্যাপারে উৎসাহ জাগানিয়া উদার ই-মেইল।

অভিজিৎ রায়ের মতো এত শক্তিশালী লেখক এবং প্রভাবশালী সম্পাদকের কাছ থেকে আমি এতটা উদারতা আশা করিনি। কারণ আমি মনে করতাম যিনি যত বেশি শক্তিশালী লেখক তিনি তত বেশি অহংকারী এবং তিনি তত বেশি ধরা-ছোঁয়ার-বাইরে। বাংলাদেশের লেখকদের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক আর হুমায়ূন আজাদকে দেখেছি তীক্ষ্ণ ভাষায় ব্যক্তিগত ঝগড়া করে জানান দিতে যে কে কত বড়। হুমায়ূন আজাদের লেখা এবং কথায় এত বেশি আমি-আমি-আমি-আমি থাকতো যে মাঝে মাঝে বেশ অস্বস্তিই লাগতো। আমি-কেন-ঈশ্বরে-বিশ্বাস-করি-না খ্যাত প্রবীর ঘোষেরও সব বইতে দেখেছি তাঁর নিজের প্রশংসা, নিজের কৃতিত্বের কথা। বড় বাঙালি লেখকরা অন্য বাঙালি লেখকের বেশি প্রশংসা কখনোই করবেন না এটাই নিয়ম বলে মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম দেখলাম অভিজিৎ রায়ের ক্ষেত্রে। এই মানুষটা যেন প্রশংসার সাগর। কারো লেখা একটু ভালো লাগলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। অথচ নিজের ব্যাপারে অসম্ভববিনয়ী।

২০০৫ সাল থেকে ২০১৫- এই দশ বছরে অভিজিৎ রায় আটটি বই লিখেছেন এবং দুটো বই সম্পাদনা করেছেন। এই বইগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা নতুন মাইলফলক। তাঁর সর্বশেষ বিজ্ঞান বই ‘শূন্য থেকে মহাবিশ্ব’ বাংলা ভাষায় আধুনিক বিজ্ঞানের বইয়ের জগতে অনন্য সংযোজন। এই বইটা তিনি লিখে শেষ করেন ২০১৩ সালে। প্রকাশককে পাঠানোর আগে বইটির পান্ডুলিপি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন। এটা ছিল আমার কাছে পরম সম্মানের বিষয়। শুদ্ধস্বর ২০১৩ সালে বইটির পান্ডুলিপি জমা নিয়েও ২০১৪ সালের বইমেলায় প্রকাশ করেনি। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বইমেলায় বইটি প্রকাশিত হয়। এই মেলাই ছিল অভিজিৎ রায়ের শেষ বইমেলা।

২০০৬ সাল থেকে অভিজিৎ রায়ের লেখার নিয়মিত পাঠক আমি। লেখক অভিজিৎ রায় বাংলাদেশের মুক্তমনা আন্দোলনের পথিকৃৎ। বাংলার তরুণ সমাজে অভিজিৎ রায়ের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী। মুক্তমনা ব্লগের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অভিজিৎ রায় ছিলেন মুখর। যে কোন সামাজিক রাজনৈতিক আন্তর্জাতিক মানবিক সমস্যায় সোচ্চার একটি নাম অভিজিৎ রায়। ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই অভিজিৎ রায়ের সাথে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু ব্যক্তি অভিজিতের সাথে আমার পরিচয় তেমন ছিল না। দেখা হয়নি কোনদিন। টেলিফোনেও কথা হয়নি। কিন্তু আমার লেখার ব্যাপারে সবসময়েই উৎসাহ দিয়েছেন তিনি। উপমহাদেশের ১১জন পদার্থবিজ্ঞানী বইয়ের একটা ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করেছিলাম। বলেছিলাম, সময় করে আমার বইয়ের একটা ভূমিকা লিখে দেবেন? তিনি বলেছিলেন, লিখে দেবো না মানে? আমার বাবা লিখে দেবে। তিনি সত্যিই তাঁর বাবা অজয় রায়কে দিয়ে আমার বইয়ের ভূমিকা লিখিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। শুদ্ধস্বর আমার পান্ডুলিপি জমা নিয়েও যখন বছর দেড়েক প্রকাশের ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিচ্ছিলেন না তখন অভিজিৎ টুটুল ভাইকে বলেছিলেন, দরকার হলে আমার বইয়ের কাজ বন্ধ রেখে হলেও প্রদীপের বইটা ধরেন। এতটা উদারতা অভিজিৎ রায়ের পক্ষেই সম্ভব। ২০০৬ সাল থেকে আমি যা কিছু লিখেছি সব মুক্তমনার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে সবার আগে।

২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির পর মুক্তমনার পৃথিবী বদলে যায়। আমূল বদলে যায়। যে বইয়ের মাধ্যমে লেখার মাধ্যমে লেখক অভিজিৎ রায় সমাজ পরিবর্তনের কাজ শুরু করেছিলেন, সেই বইমেলাতেই অভিজিৎ রায়কে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে খুন করে চুপচাপ ভীড়ের মধ্যে মিশে যায় খুনিরা। বইমেলায় আলো ছিল। বইমেলায় ভীড় ছিল। বইমেলায় সহস্র মানুষ ছিল। সেই মানুষের হাতে মোবাইল ছিল। মোবাইল বের করে ছবি তোলার ইচ্ছে ছিল, সময় ছিল। কিন্তু খুনিকে ধরার সাহস ছিল না কারো। রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদকে সাহায্য করার জন্য হাত ছিল না কারো। তারপরের কাহিনি সবার জানা। কত রকমের আস্ফালন। কত রকমের চরিত্র-হনন। মাস পেরোতেই খুন হয়ে যান ওয়াশিকুর রহমান। তারপর অনন্ত বিজয়। তারপর নিলয় নীল। তারপর। রাষ্ট্র চুপ করে আছে। না, ঠিক চুপ করে নেই; বলছে নাস্তিকরা শাস্তি পাবে। কত রকমের রাষ্ট্রীয় ধারা আছে এখন নাস্তিকদের ধরার জন্য। ধরার পরে ধারায় ফেলে দিলেই হলো। এভাবে কতদিন চলবে জানি না। আশা করি না, তবুও একদিন হয়তো বিচার হবে। পৃথিবী বদলাবে একদিন। অভিজিৎ রায় স্টারডাস্ট হয়ে গেছেন। আগে পরে আমরা সবাই তাই হবো। সেটাই তো মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অভিজিৎ রায় আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন। তাঁর হাতের আলো থেকে জ্বলে উঠছে আরো অজস্র আলো। এই আলো কাটবে কোন্ চাপাতিতে? বাঁধবে কোন্ ধারায়?