লেখক: নিকসন কান্তি

খুব অনিচ্ছা নিয়ে লিখতে বসেছি। মিনিমাম কমনসেন্স দিয়ে যেটা বোঝা যায়, সেটা ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়ে লিখতে বড় বিরক্তি লাগে। তবু লেখা দরকার। বুঝতে না পারাদের চেয়ে বুঝতে না চাওয়াদের সংখ্যা বড্ড বেড়ে যাচ্ছে যে। কিছু জিনিস বুঝতে না পারা দলে আমিও আছি। তাই এই লেখা যতটা না লেখা, তার চেয়ে বেশি থিংকিং লাউডলী।

অনুভূতিতে আঘাত আসবেই
প্রতিনিয়তই আমাদের কোন না কোন অনুভূতি আহত হয়। সেই শিশুকাল থেকেই হয়ে আসছে। বাবা কেন ফাঁকি দিয়ে অফিসে চলে গেল, ছোট বোনটাকে কেন আমার থেকে বেশী আহ্লাদ করা হচ্ছে- এসব দিয়ে শুরু হয়। তারপর স্কুলে গিয়ে- অংক পরীক্ষার খাতা ক্লাসে নিয়ে এসে নম্বরগুলো সবাইকে শোনানোর কী দরকার, বন্ধুরা কেন আমাকেই এত ক্ষেপায়…। তারপর কলেজ ইউনিভার্সিটিতে গেলে আসে নতুন কিছু উপাদান। সেটা কাটলে আসে কর্মজীবন, তৈরী হয় নিজের সংসার, এবং সেই সাথে তৈরী হয় আহত হবার নিত্যনতুন কারন। এসব আঘাত সয়েই আমরা বড় হই। আরও স্পষ্ট করে বললে, সইতে পারি বলেই বড় হই। বান্ধবীর ঝাড়ি খেয়েই শিখি ওভাবে ভাবাটা আধুনিকতা নয়। বসের ধমক থেকেই বুঝি ক্লায়েন্টকে অন্যভাবেও হ্যান্ডেল করতে পারতাম। এমন ছোট ছোট ধাক্কা খেয়ে খেয়েই আমরা সামনে এগোই, বারবার নিজেকে শুধরে নিই, পরিনত হই।

আবার অন্য ঘটনাও ঘটে। পরিবারের কারো অথবা কোন বন্ধুর অন্যায্য উদ্ভট কথায় হতবাক হয়ে যাই। রেগেমেগে তর্ক শুরু করি। অকল্পনীয় কুযুক্তি শুনে হতাশায় ছুটে পালাতে ইচ্ছে করে। ক্ষতবিক্ষত হয়ে চুপচাপ সরে আসি। কিন্তু বদলাই না।

তো আঘাত-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক, অনুভূতি আহত হওয়া যাপিত জীবনের একটি স্বাভাবিক অনুসঙ্গ। আহত না হয়ে যেমন জীবন কাটানো সম্ভব না, তেমনি কারো কোন রকম অনুভূতিতে কখনো আঘাত না করে থাকাও সম্ভব না।

আঘাত-পরবর্তী প্রতিক্রিয়া
শারীরিক আঘাত পেলে আমাদের প্রতিক্রিয়া হয় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রিফ্লেক্সজনিত। এজন্যই আত্মরক্ষা করতে গিয়ে যদি কেউ খুন করে বসে তাহলে প্রায় কোন ক্ষেত্রেই তার Ôখুনের শাস্তি’ হয় না। (এই লাইনটা লিখেই একটা বিচিত্র কথা মনে হলো- পরবর্তী টার্গেটকে আক্রমন করতে গিয়ে আক্রান্তের হাতে যদি কোন চাপাতিওয়ালা খুন হয় তারপর সেই ‘খুনি ব্লগার’এর কি ফাঁসি হবে? হতেও পারে। বাংলাদেশ বলে কথা।) কিন্তু চেতনায় বা অনুভূতিতে আঘাত পেয়ে যদি কেউ খুন করে আঘাতকারীকে? ধর্মানুভূতি নয়, ধরা যাক, কেউ একজন আমাকে খোলা রাস্তার ওপর সোজাসুজি বলে বসলো, তর বাপে একটা…। আমিও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে খুন করে ফেললাম। এরপর কেসটা আদালতে উঠলে আমি কি অনুভূতিতে আঘাতের কারন দেখিয়ে পার পাবো? পাবো না। আদালত বলবেন, অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া পর্যন্ত ঠিক আছে কিন্তু তারপর তোমার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটাতো তোমারই চুজ করা। তুমি তো পাল্টা একটা খারাপ কথা বলে বা তার চেয়েও খারাপ কিছু বলে গটগট করে চলে যেতে পারতে। গেলে না কেন? বেশ করেছো, এখন ঝুলে যাও।
তারপরও ধর্মানুভূতিকে বেশীর ভাগ মানুষ ঐ হিসাবের বাইরে রাখতে চায়। কেন?

ধর্মানুভূতি কি আলাদা কিছু?
ধর্মানুভূতি কি সবচেয়ে বেশী স্পর্শকাতর? তাই নাকি! কে করলো এই র‌্যাঙ্কিং? কিভাবে করলো? এক ঘর মানুষের সামনে আমার বোনটাকে যখন শুনতে হয়, Ôএখনো বাচ্চাকাচ্চা হয়নি!Õ – তখন আমারইতো হাত নিশপিশ করতে থাকে। কিংবা বিদেশ বিভূঁইয়ে যখন কেউ বলে, Ôবাংলাদেশ! উফ বাব্বা! কি করে যে ছিলাম এতদিন!Õ -তখন… আচ্ছা থাক। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ধর্মানুভূতির চেয়ে প্রবল অনুভূতি অনেক আছে। এবং সেগুলো প্রায়শঃ আহতও হয়। এবং আমরা ভায়োলেন্ট কোন প্রতিক্রিয়া দেখাবো না বলে চুজ করি। তবু ধর্মানুভূতি একটা দিক থেকে আলাদা হয়ে গেছে। এখানে আঘাত করলে খুন হতে হয়। এবং সে খুন বিপুল সংখ্যক মানুষ দ্বারা সমর্থিত হয়। অন্য যে কোন অনুভূতিতে আঘাত লাগলে আমি যদি খুনখারাবি করি তবে সেটা আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু ধর্মানুভূতির ক্ষেত্রে ব্যাপার আলাদা। এখানে আঘাত করাই অপরাধ। তাই তো বানী এসেছে, লেখকরা সীমা লঙ্ঘন করতে পারবেন না।
অনেকেই আইজিপি সাহেবের ওপর নাখোশ। নারে ভাই, ওনার কোন দোষ নেই। পবিত্র কোরানেই আছে- [জাস্টিস মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান অনুদিত] (সুরা বাকারা, আয়াত ১৯০) Òআর যারা তোমাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করো; তবে সীমা লঙ্ঘন করো না।” আবার ঠিক তার পরের আয়াতেই আছে, Ò…যদি তারা তোমাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে তবে তোমরা তাদেরকে হত্যা করবে, এই তো অবিশ্বাসীদের পরিনাম”। অর্থাৎ অবিশ্বাসীরা লেখার মাধ্যমে মুমিনদের বিরূদ্ধে Ôযুদ্ধ’করছে এবং এই যুদ্ধে মুমিনদের জন্য অলঙ্ঘনীয় সীমাটা Ôহত্যা’ পর্যন্ত বর্ধিত করা আছে। আবার, সুরা আল ইমরান আয়াত ১২৮ এ বলা হচ্ছে, Òতিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন, না শাস্তি দেবেন, সে ব্যাপারে তোমার কিছু করার নেই; কারন তারা তো সীমা লঙ্ঘনকারী।” কিন্তু সুরা বাকারা আয়াত ১৯১ তে বলা আছে, Òআর যেখানে তাদেরকে তোমরা পাবে তাদেরকে তোমরা হত্যা করবে…Ó। সেকথাই তো বলছি, তোমাদের Ôকিছু করার নেই’, তোমরা কেবল Ôহত্যা করবে’। এবার বলেন, আইজিপি সাহেবের কোন দোষ আছে? কোন দোষ নাই। ধর্মানুভূতি সত্যিই আলাদা কিছু। এ এমন এক অনুভূতি যেটা থাকলে অন্য অনেককিছুই মাথা থেকে বেরিয়ে যাবে বা অন্ততঃ কোনঠাসা হয়ে থাকবে; যেমন, কমনসেন্স, যুক্তিবোধ, মানবিকতা, কৌতুহল ইত্যাদি।

বাক-স্বাধীনতার সীমা
মানুষ কথা বলে (বা লেখে) অন্যের সাথে যোগাযোগ করতে বা নিজের মত প্রকাশ করতে (সেটাও যোগাযোগই)। আর এই যোগাযোগ তথা সমাজবদ্ধতা হলো মানুষের শ্রেষ্ঠতম হয়ে ওঠার অন্যতম উপকরণ। তাই বাক-স্বাধীনতার যদি সীমা টেনে দেয়া হয় তবে সীমাটা আসলে টানা হয় মানুষের উন্নতির সম্ভাবনায়। আরেক দিক থেকে দেখলে, মানুষ কথা বলে কেন- ভাবে বলেই তো? তাই কথা বলতে নিষেধ করা মানে তো প্রকারান্তরে ভাবতে নিষেধ করা। যারা বাক-স্বাধীনতার সীমা নিয়ে Ôবলছেন’তারা কি আদৌ বিষয়টা তলিয়ে ÔভাবছেনÕ? কে জানে, হয়তো ভাবছেন না বলেই বলতে পারছেন।

ভাববার দায়
নাহ। ভাববার দায় যেন এখন কারোরই নেই। সময়ই নেই। এখন সময় মেনে নেবার। সেজন্য ঠিকই সময় আছে। মেনে নিয়ে বসে থাকবে। নতুন করে ভাববে না। সুখে থাকবে।

‘সুখে আছো যারা সুখে থাকো; এ সুখ সইবে নাÕ (-কবীর সুমন)। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেখা গেছে এরই মধ্যে- মাওলানা ফারুকীর খুন। এরপর শুধু মাজারপ্রীতির জন্য না, ক্রিকেট-প্রীতির জন্যও খুন হতে পারেন একদিন। তারপর শাড়ী পরার জন্যও খুন হবেন- কী অশ্লীল পোশাক! অতএব Ôইসলাম খাতরে মে হ্যায়’। তারপর একদিন স্কুলে যাবার জন্যও…। এখনো সময় আছে- তাকান সামনে। ইতিমধ্যে ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করেছেন।

নতুন ভাবনা এসেছে- ধর্মহীনরা সংখ্যায় সিগনিফিকেন্ট হয়ে উঠলে, ভোটে প্রভাব ফেলার মতো বেড়ে উঠলে হয়তো অবস্থা পাল্টাবে। হতে পারে- অন্য কোন দেশে; যেখানে নির্বাচন ব্যবস্থা ঠিকঠাক আছে। বাংলাদেশ নিয়ে আমি আশাবাদী নই। সরকারী চাকরির সুবাদে গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনে (স্থানীয় এবং জাতীয়) বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে আমাকে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন ব্যবস্থাটাকে কী করে ছেড়েছে তার প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন আমি। আমি পরিস্কার জানি, খুব সহসা এদেশে আর নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের অভিনয় হবে মাঝে মাঝে। বন্ধুবান্ধবদের বলেছি, আওয়ামীলীগ এই মুহূর্তে অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী জনপ্রিয়। কেন? আগে যারা তাদের সাপোর্ট করতো তারা তো আছেই। এখন চাপাতিওয়ালারাও চায় আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকুক। বিচারহীনতার সংস্কৃতিটা তাদের খুব কাজে লাগছে যে। এবং তাদের গদিতে টিকে থাকার নৈতিক ভিত্তি যেহেতু নেই তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা চাইবে বড়রকম কোন বিদ্রোহ যেন না হয়। সবাইকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে সন্তুষ্ট রাখবে। ওয়েল, সবাইকে না, সংখ্যায় অতি লঘু ধর্মহীন গ্রুপটাকে অত তোয়াজ করার কোন কারন নেই। কারন এরা কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে না। স্রেফ লেখালিখি করে কুম্ভকর্নের ঘুম এরা ভাঙাতে পারবে না। এটা বাংলাদেশ।

তবু ভাবতে থাকবো। পড়বো। শিখবো। লিখবো হঠাৎ হঠাৎ। বেঁচে থাকাটা তো অর্থহীন হয়ে গেছে; মৃত্যুটার যেন একটা অর্থ থাকে। বুড়ো থুত্থুরে হয়ে বিছানায় নিজের মলমুত্রের মাঝে ডুবে মরার চেয়ে রক্তগঙ্গাতেই নাহয় ডুবে যাবো। তবুও যদি খুব কাছের মানুষগুলোকে অন্ততঃ একটু ভাবতে বাধ্য করা যায়।