(এই লেখাটা পর্ব আকারে শুরু করেছিলাম মুক্তমনায়। আমার পর্ব আকারে লেখাগুলোর যে গতি হয়, সেটি হয়েছিল এর ক্ষেত্রে। দুই পর্বের পরেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল লেখাটা। পুরোনো সব অসমাপ্ত লেখাগুলো শেষ করবো এই মর্মে পণ করেছি আমি। সেই পণের ফলশ্রুতিতে এক এক করে সিকি আনা, আধা আনা, পৌণে এক আনা লেখাগুলোকে আস্ত আনায় পরিণত করা শুরু করেছি। এরই অংশ হিসাবে হুমায়ুননামার এই গ্রন্থ আলোচনাটি শেষ হয়েছে। তবে, এটাকে ঠিক কতটুকু গ্রন্থ আলোচনা বলবেন, সেটি আপনাদের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি। কিছুটা ভিন্ন আঙ্গিকে হুমায়ুননামা নিয়ে আলোচনা করেছি আমি। ভিন্ন যে সেটা অবশ্য এর আকার দেখলেই বুঝতে পারবেন। সাতষট্টি পৃষ্ঠার একটা ক্ষীণ কটি বইয়ের পর্যালোচনা গিয়ে দাঁড়িয়েছে সাতাশ পৃষ্ঠার একটা ঢাউশ সাইজে। তারপরেও যে শেষ করতে পেরেছি, এতেই তৃপ্ত আমি। লেখা বড় হয়ে যাবে দেখে এক অংশ পোস্ট করলাম। এটি প্রথম পাতা থেকে সরে গেলেই শেষ পর্ব পোস্ট করে দেবো। )
৬. পলাতক এক পাদশাহ
বাবরের মৃত্যুর পর হুমায়ুন সিংহাসনে বসেন। হুমায়ুন ছাড়াও বাবরের আরো তিনটি পুত্র সন্তান ছিল। এরা হচ্ছে কামরান, হিন্দোল ও মির্জা আস্করি। কিন্তু, বাবর মৃত্যুকালে একমাত্র হুমায়ুনকেই সাম্রাজ্য দিয়ে যান। হুমায়ুন পিতার মৃত্যুকালীন আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি কামরানকে কাবুল ও পাঞ্জাবের দায়িত্ব দেন। হিন্দোলকে সম্বলের এবং মির্জা আসকরিকে মেওয়াতের শাসন ক্ষমতা প্রদান করেন। কামরানকে কাবুল এবং পাঞ্জাবের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়াটা হুমায়ুনের জন্য বড় ধরনের একটা কৌশলগত ভুল ছিল। এর মাশুল তাকে দিতে হয়েছিল কড়ায় গণ্ডায়। মোগলরা সাধারণত এই অঞ্চল থেকে সৈন্য এবং যুদ্ধাপকরণ সংগ্রহ করতো। ভারতবর্ষে মোগল শাসনের প্রাথমিক পর্যায় সেটি। নানা ধরনের যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত হতে হয়েছে মোগলদের ক্ষমতাকে স্থায়ী এবং সুদৃঢ় করার জন্য। এই সময়ে সৈন্য সরবরাহের লাইনটা অবিচ্ছিন এবং সক্রিয় থাকা উচিত ছিল। হুমায়ুনের দূরদর্শীতার অভাবে সেটা থাকে নি।
সিংহাসনে বসার পর থেকেই একের পর এক বিপদে পড়া শুরু করেন হুমায়ুন। তাঁর একজন অন্তরঙ্গ বন্ধু তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করার পায়তারা করছিল। কিন্তু, ঘটনাটা আগেই ফাঁস হয়ে যাওয়ায় সেই লোক পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় গুজরাটের অধিপতি বাহাদুর শাহের কাছে। তাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য বার বার অনুরোধ করলেও কোনো কাজ হয় না। শুধু এই লোকুই নয়, ইব্রাহিম লোদির পিতৃব্য আলাউদ্দিন লোদিও বাহাদুর শাহের আশ্রয় গ্রহণ করেন। এঁর প্ররোচণায় বাহাদুর শাহ তাঁর পুত্র তাতার খার অধীনে বিশাল এক সেনাবাহিনী পাঠালেন হুমায়ুনের বিরুদ্ধে। হুমায়ুন খুব সহজেই এই বাহিনীকে পরাস্ত করলেন। তাতার খাঁ যুদ্ধে নিহত হলেন। হুমায়ুন অবশ্য এতে ক্ষান্ত হলেন না, মোগল বাহিনী নিয়ে বাহাদুর শাহকে শিক্ষা দিতে গুজরাটে গিয়ে হাজির হলেন। যুদ্ধে বাহাদুর শাহ হেরে গেলেন, গুজরাট জয় করে নিলেন হুমায়ুন।
গুজরাটের যুদ্ধে লিপ্ত থাকার কারণে হুমায়ুন দীর্ঘ সময় রাজধানীর বাইরে ছিলেন। এই সুযোগে নানা বিশৃঙ্খলা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। এগুলো সামাল দেবার জন্য গুজরাটের ভার ভাই কামরান মির্জার হাতে তুলে দিয়ে হুমায়ুন ফিরে এলেন আগ্রাতে। হুমায়ুন ফিরে আসার পরেই গুজরাটে মোগলদের মধ্যে অন্তর্কলহ দানা বেঁধে উঠলো। আর এই সুযোগ নিয়ে বাহাদুর শাহ আবার গুজরাট দখল করে নিলেন। রাজধানীতে ফিরে এসেও খুব ভালো কিছু হুমায়ুন পেলেন না। দেখলেন যে, সাম্রাজ্যের একেবারে পূর্ব প্রান্তে দাঁড়িয়ে শের খাঁ নামের এক প্রবল প্রতাপশালী আফগান তাঁর সদ্য অভিষিক্ত রাজ্যকে দখল করে নেবার জন্য প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। শের খাঁকে শায়েস্তা করার জন্য হুমায়ুন বঙ্গদেশে যাত্রা করলেন। শের খাঁর আফগান বাহিনীর সাথে হুমায়ুনের মোগল বাহিনীর প্রথম মোলাকাত হয় চুনার দূর্গে। শের খাঁ নিজের শক্তিমত্তার দুর্বলতা অনুধাবন করতে পেরে হুমায়ুনের সাথে বশ্যতামূলক সন্ধিতে যান। হুমায়ুন চুনার পরিত্যাগ করেন। এই সুযোগে শের খাঁ সমস্ত আফগানদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাদের পিছনে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন। ১৫৩৭ সালে শের খাঁ আবার বাংলাদেশ আক্রমণ করেন এবং তা দখল করে নেন। হুমায়ুন বাংলাদেশ উদ্ধার করতে আবার এসে হাজির হন। প্রথমে চুনার দুর্গ দখল করে নেন তিনি, তারপর বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হতে থাকে তাঁর বাহিনী। ১৫৩৯ সালে হুমায়ুন বঙ্গদেশ আক্রমণ করলেন। এই আক্রমণের সামনে শের খাঁর বাহিনী টিকলো না। শের খাঁ বাংলাদেশে থেকে সরে শেসারামে চলে গেলেন।
বাংলাদেশ দখল করে হুমায়ুন আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হয়ে পড়লেন, আর অন্যদিকে শের খাঁ হুমায়ুনকে পরাস্ত করার জন্য আবারো শক্তি সঞ্চয় শুরু করলেন। এর মধ্যে গোঁদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো বঙ্গদেশে বর্ষা শুরু হলো। এই বৈরী আবহাওয়া মোগল সৈন্যরা সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ হওয়া শুরু করলো। ঠিক এরকম সময়েই খবর আসলো যে, শাহজাদা হিন্দাল বিদ্রহো হয়েছেন, কামরান মির্জা সৈন্য সামন্ত নিয়ে আগ্রার দিকে রওনা দিয়েছে। হুমায়ুন কুলি বেগের উপর বাংলার শাসনভার অর্পণ করে আগ্রার দিকে রওনা দিলেন। ফেরার পথে চৌসা নামের এক জায়গায় শের খাঁ অতর্কিতে প্রবল আক্রমণ চালান মোগল বাহিনীর উপরে। বিশ হাজার মোগল সৈন্য প্রাণ হারায় নদীতে। হুমায়ুন নিজেও প্রাণ বাঁচাতে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এক ভিস্তিওয়ালা তাঁকে প্রাণে বাঁচান। বিহার এবং বঙ্গ শের খাঁর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। শের খাঁ শাহ উপাধী ধারণ করেন।
১৫৪০ সালে শের শাহ বিপুল পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আগ্রার দিকে যাত্রা শুরু করেন। হুমায়ুনও এক লাখ সৈন্য নিয়ে কনৌজের কাছে শের শাহের বাহিনীর মুখোমুখি হন। এবারও দুর্ভাগ্য হুমায়ুনের। বর্ষাকাল তখন। মোগল শিবির জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল। এই সুযোগে শের শাহ সাঁড়াশী আক্রমণ চালান। হুমায়ুন সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হলেন এবং পালিয়ে লাহোর চলে গেলেন। সেখানে তিনি তাঁর ভাই কামরানের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করলেন। এখানেও তিনি শান্তিতে থাকতে পারলেন না। শের শাহের বাহিনী পাঞ্জাবেও এসে হাজির হলো। যুদ্ধে কামরানের বাহিনী পরাজিত হলো। তিনি শের শাহের সাথে সন্ধি করে পাঞ্জাব ছেড়ে দিয়ে কাবুলে চলে গেলেন। হুমায়ুন আশ্রয়হারা হয়ে সিন্ধু ও মাড়োয়ারের রাজা মালদেবের সাহায্য প্রার্থনা করলেন। মালদেব সাহায্য করাতো দূরের কথা, বরং তাঁকে বন্দী করে শের শাহের হাতে তুলে দেবার ফন্দি করতে লাগলেন। এই দুভিসন্ধি হুমায়ুন জানতে পেরে গভীর রাতে পালিয়ে গেলেন সিন্ধু থেকে। মরুভূমি পাড়ি দিতে গিয়ে অসংখ্য অনুচর হারালেন তিনি। শেষে মাত্র সাতজন অনুচরসহ তাঁরা গিয়ে পৌঁছোলেন অমরকোটে। অমরকোটের বাদশাহ তাঁকে আশ্রয় দিলেন। সেই সাথে দুই হাজার সৈন্য দিয়েও সাহায্য করলেন। ছয় মাস এখানে বিশ্রামের পর হুমায়ুন এই সৈন্যদল নিয়ে সিন্ধু বিজয়ের জন্য রওনা দিলেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্য যে, তাঁর সৈন্যবাহিনীর মধ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলো। এই অবস্থা যুদ্ধ করলে যা হয়, তাই হলো। সিন্ধুর রাজার সাথে যুদ্ধে পরাজিত হলেন তিনি। পরাজিত হয়ে কান্দাহারের দিকে পলায়ন করলেন তিনি। কান্দাহারে তখন মির্জা আস্করি মির্জা কামরানের প্রতিনিধি হিসাবে শাসন করছিলেন। তিনি ভাইকে আশ্রয় দেবার পরিবর্তে তাঁকে নানাভাবে আক্রমণ করে পর্যুদস্ত করে তুললেন।
এরকম পরিস্থিতিতে অন্য কোনো উপায় না দেখে হুমায়ুন পারস্যে গিয়ে হাজির হলেন। পারস্যের বাদশাহ তহমাস তাঁকে আশ্রয় দিলেন। এখানে তিনি কী অবস্থায় ছিলেন, সে বিষয়ে দুটি মত পাওয়া যায়। পারস্যের ইতিহাস লেখক স্যার জন ম্যালকম তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন যে, পারস্যের দরবারে অবস্থানকালে পারস্যের বাদশাহ তহমাস তাঁকে আদর ও সম্মান প্রদর্শন করেই রেখেছিলেন। অন্যদিকে হুমায়ুনের অনুচর জওহের এর লিখিত বৃত্তান্তে জানা যায় যে, তিনি পারস্য দরবারে নানারূপ লাঞ্ছনা সহ্য করেছিলেন। এলফিনস্টোন সাহেবও এই মতের পক্ষপাতী। তিনি বলেন যে, শাহ প্রথমত তাঁকে যথোচিত সম্মানের সাথে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে ধর্ম সম্বন্ধীয় মতানৈক্য ছিল। হুমায়ুন নিজস্ব ধর্ম ত্যাগ করতে রাজি না হলে তহমাস তাঁর সাথে খারাপ ব্যবহার করা শুরু করেন। এদের দুজনের সম্পর্কের মধ্যে যে টানাপোড়েন চলছিল তা গুলবদনের ভাষ্য থেকেও জানা যায়। তবে তিনি বলেছেন যে, হুমায়ুন নিজে উদ্যোগী হয়ে এই অবস্থার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কাছে থাকা মূল্যবান কিছু জহরত তিনি বাদশাহ তহমাসকে উপহার দেন। এই উপহার পেয়ে বাদশাহ তহমাসের হুমায়ুনের প্রতি যে বিরূপভাব ছিল তা কেটে যায়। দুজনের সম্পর্ক আবার উষ্ণ হয়ে ওঠে।
রামপ্রাণ গুপ্ত তাঁর মোগল বংশ বইতে হুমায়ুনের পলাতক জীবনের এই দুরাবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, “হুমায়ুন শের শাহের বিনাশসাধন করিবার উপযোগী বল সংগ্রহ করিতে না পারিয়া আগ্রা পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। তিনি আগ্রা পরিত্যাগ করিয়া ভারতবর্ষের নানা স্থানে বাত্যাতাড়িত বৃক্ষপত্রের ন্যায় ঘূর্ণিত হইতে লাগিলেন। এই সময়ে হুমায়ুনের দুর্দ্দশার একশেষ হইয়াছিল। সে করুণকাহিনী পাঠ করিতে করিতে চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া উঠে। ঘটনাচক্রে পতিত হইয়া পৃথিবীর অনেক নরপতিই পথের ভিখারী হইয়া অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করিয়াছেন; কিন্তু ঈদৃশ্য মর্ম্মান্তিক বৃত্তান্ত সমগ্র ইতিহাসেও দুর্ল্লভ। অন্তরঙ্গ আশ্রিত ব্যাক্তিগণ পূর্ব্ব-ঋণ বিস্মৃত হইয়া তাঁহাকে অনাদরে প্রত্যাখান করিয়াছিল। ভাগ্য-বিপর্য্যয়ে তিনি সে সকল ক্ষুদ্র রাজার শরণাপন্ন হন, তাঁহারা তাঁহাকে অপমানিত করিতেও কুণ্ঠিত হইয়াছিলেন না। কেবলমাত্র কতিপয় অনুরক্ত অনুচর ব্যতীত সকলেই তাঁহার সহিত দুর্ব্যবহার করিল।“
হুমায়ুনের কাছ থেকে রাজ্য দখল করে শের শাহ বঙ্গ, বিহার এবং উত্তর-পশ্চিম ভারতে আধিপত্য বিস্তার করেন। এরপর মাড়োয়ার, মালব এবং বুন্দেলখণ্ড দখলেরও চেষ্টা চালান। মাড়োয়ার দখল করতে বিস্তর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। ১৫৪৫ সালে শের শাহ বুন্দেলখণ্ডের কালিগঞ্জ দূর্গ অবরোধ করার সময় ভূ-গর্ভস্থ বারুদখানায় আগুন লেগে যায়। সেই আগুনে শের শাহের সারাদেহ পুড়ে গিয়েছিল। দূর্গ অধিকারের পরপরই তাঁর মৃত্যু হয়।
শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৫৫৩ সালে ইসলাম শাহও মারা যান। তিনি সাত বছর ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু শান্তিতে শাসন করতে পারেন নি। বিদ্রোহ দমন করতেই দিন গেছে তাঁর। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর তাঁর শিশু পুত্র সিংহাসনে বসে। এ সময়ে আদিল নামের এক লোক এই বাচ্চাকে হত্যা করে আদিল শাহ নাম নিয়ে সিংহাসন দখল করে নেয়। এর এক মন্ত্রী ছিল হিমু নামের এক লোক। এই লোক মহা কুটিল ধরনের মানুষ ছিল। এর মন্ত্রণাতে আদিল শাহ নানাদিকে অত্যাচার করে বেড়াতো। ফলে চারিদিকে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গ এবং মালব স্বাধীনতা ঘোষণা করে। শের শাহের এক ভ্রাতুষ্পুত্র পাঞ্জাবে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। আদিল এবং হিমু চুনারে বিদ্রোহ দমন করতে গেলে এব্রাহিম সুর নামে একজন দিল্লীর সিংহাসন দখল করে নিলেন। আদিলের হাতে থেকে যায় সাম্রাজের পূর্ব অংশ। কিন্তু, এই এব্রাহিম সুরও মসনদ ধরে রাখতে পারলেন না। পাঞ্জাব থেকে সেকেন্দর নামে আদিলের এক আত্মীয় এসে দখল করে নিলেন দিল্লীর মসনদ। এব্রাহিম সুর পালিয়ে গেলেও মসনদ দখলের আকাঙ্খা পরিত্যাগ করলেন না। তার বদলে শক্তি সঞ্চয় করা শুরু কর্লেন তিনি। এদিকে ঠিক এই সময়ে বঙ্গদেশের শাসঙ্কর্তা মোহাম্মদ সুর স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে দিল্লীর সাম্রাজ্য দখলের দিকে নজর দিলেন।
এই সব সংবাদই হুমায়ুনের কাছে এসে পৌঁছোলো। দিল্লীর মসনদ পুনর্দখল করার এর চেয়ে সুবর্ণ সময় আর হবে না। পারস্যের রাজা তমপেশ হুমায়ুনকে চৌদ্দ হাজার সৈন্য দিলে। হুমায়ুন এই সৈন্য নিয়ে প্রথমে কামরান মির্জাকে পরাজিত করে কাবুল এবং কান্দাহার দখল করে নিলেন। কামরান মির্জাকে শাস্তি হিসাবে তাঁর দুই চোখ সেলাই করে বন্ধ করে দেওয়া হলো। তারপর দিল্লীর দিকে রওনা দিলেন। দিল্লীর মসনদ দখল নিয়ে শুরু হলো আদিল, এব্রাহিম সুর, মোহাম্মদ সুর, সেকেন্দর এবং হুমায়ুনের পঞ্চমুখী লড়াই। এর মধ্যে এব্রাহিম সুরের শক্তি ছিল সবচেয়ে কম। পূর্ব অংশে আদিল আগে মোহাম্মদ সুরকে দমন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পশ্চিম অংশে হুমায়ুন আর সেকেন্দর মুখোমুখি হয়ে গেলেন। সেকেন্দরকে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসন পুনরুদ্ধার করলেন হুমায়ুন। পূর্ব অংশে আদিল এবং হিমু মোহাম্মদ সুরকে হত্যা করে হুমায়ুনের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েই গেলেন।
৭. পাগলা রাজা
হুমায়ুনের জীবনটা পাগলামি, আলস্য আর খামখেয়ালিতে পরিপূর্ণ। আফিমে বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি, করতেন উদ্ভট সব কাণ্ডকারখান, যা একজন বাদশাহের চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এ যেন এক পাগলা রাজা, সমস্ত নিয়মনীতিকে উলটে দিয়ে যিনি চলেন তাঁর একান্ত নিজস্ব নিয়ম এবং ইচ্ছা অনুসারে।
জ্যোতিষশাস্ত্রে হুমায়ুনের গভীর পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ফলিত জ্যোতিষের আলোচনায় অপরিসীম আনন্দ অনুভব করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের অভ্যর্থনার জন্য সাতটি সুসজ্জিত কক্ষ করেছিলেন হুমায়ুন। সাতটা গ্রহের নামে এদের নামকরণ করেছিলেন তিনি। এই সকল কক্ষের গৃহসজ্জা, চিত্রাবলী এবং ভৃত্যদের পোশাকে সেই গ্রহের চিহ্ন আঁকা থাকতো। যে দিন যে গ্রহের প্রভাব বিদ্যমান থাকতো, সেদিন সেই গ্রহের নামানুসারে করা কক্ষে হুমায়ুন দরবার করতেন। রাজদর্শনাভিলাষী ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁর যে গুণের প্রাধান্য থাকতো, তাঁকে সেই গুণবিশিষ্ট গ্রহের নামে ডাকা কক্ষে উপস্থিত হতে হতো। কবি, পরিব্রাজক ও বিদেশী রাজদূত সোম কক্ষে, বিচারক, শাস্ত্রবেত্তা ও কার্য্যাধ্যক্ষরা বুধ কক্ষে এবং সৈনিক পুরুষেরা বৃহস্পতিকক্ষে রাজদর্শন করতেন।
হুমায়ুন রাজকার্য নির্বাহের জন্য চতুর্ভুতের নামানুসারে চারটি বিভাগ সৃষ্টি করেছিলেন। এগুলো হচ্ছে আতসী, হাওয়াই, আবি ও খাকি। এই চার বিভাগের কাজ সম্পাদন করার জন্য চারজন মন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। যে সব দ্রব্য প্রস্তুত করার জন্য অগ্নির আবশ্যক হতো, যেমন নানাবিধ যুদ্ধাস্ত্র এবং যন ত্র, সেগুলোর নির্মানকাজ আতসী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরিচ্ছদগৃহ, পাকশালা ও আস্তাবল, এগুলো হাওয়াই বিভাগের অধীন ছিল। সরবতখানা, সুজিখানা ও খাল, এগুলোর কাজ আবি বিভাগের তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত হতো। কৃষি, পূর্ত, খালসা ভূমি ও কোনো কোনো গৃহকাজের জন্য খাকি বিভাগের সৃষ্টি হয়েছিল।
এগুলোকে খামখেয়ালি বলে চালানো যেতে পারে। কিন্তু, এক ভিস্তিওলাকে নিয়ে হুমায়ুন যা করেছিলেন, সেই রকম পাগলামি ইতিহাসে বিরল। চৌসার যুদ্ধের সময় বিশ হাজার মোগল সৈন্য নদীতে ডুবে যায়, হুমায়ুনের ঘোড়া নিহত হয় এবং তিনি নিজে জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সাঁতার না জানা এই বাদশাহকে এক ভিস্তিওলা তার মশকের সাহায্যে নদীর জলে ডুবে মরা থেকে বাঁচান। কৃতজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ হিসাবে এই ভিস্তিওলাকে তিনি দুই দিনের জন্য সত্যিকারভাবে সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। গুলবদন এ বিষয়ে এভাবে বর্ণনা করেছেন।
“এই সময় একজন ভিস্তিকে (জলবাহক) সর্বদা বাদশাহের সঙ্গে দেখা যেত। এই ভিস্তি এক নিদারুণ বিপদের মুহুর্তে বাদশাহের প্রাণরক্ষা করেছিল। চুসা অঞ্চলের যুদ্ধে বাদশাহের ঘোড়া নিহত হয়, প্রাণ বাঁচাতে বাদশাহ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তখন এই ভিস্তি তার মশক দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করেছিল। চুসা অঞ্চলের যুদ্ধে বাদশাহের ঘোড়া নিহত হয়, প্রাণ বাঁচাতে বাদশাহ গঙ্গায় ঝাঁপ দেন। তখন এই ভিস্তি তার মশক দিয়ে বাদশাহকে রক্ষা করেছিল। তার মশকের সাহায্য না পেলে বাদশাহ নদীতে হয়তো ডুবেই যেতেন। এই কাজের জন্য সন্তুষ্ট হয়ে বাদশাহ তাকে পুরস্কার স্বরূপ আগ্রার সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। এই ভিস্তিটির সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই আমি জানতাম না। কেউ কেউ তার নাম বলত নিজামাবার কেউ বলত সম্বল। হজরত বাদশাহের অমূল্যজীবন রক্ষার পুরস্কার হিসাবে সে সিংহাসনে বসার দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছিল।“
এই সিংহাসনে বসানো যে শুধুমাত্র লোক দেখানো ছিল তা নয়, কিংবা তামাশাও নয়। ভিস্তিওয়ালা নিজামকে সত্যি সত্যি বাদশাহের সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে গুলবদন বলেছেন,
“বাদশাহ দরবারের সমস্ত আমির ওমরাহদের বলে দিয়েছিলেন যে তাঁরা বাদশাহকে যেমন মর্যাদা দিয়ে সালাম জানান, কুর্নিশ করেন, ভিস্তি নিজাম যখন সিংহাসনে আসীন হবেন তখন তাকেও যেন অনুরূপভাবেই সম্মান দেখান। গোলাম নিজাম সিংহাসনে বসে খুব দান খয়রাত ও পদ প্রদান করে।“
স্ক্রাইন অবশ্য ভিস্তি নিজাম যে দুই দিন সিংহাসনে আসীন ছিলেন, এটা মানেন নি। তার মতে মাত্র কয়েক ঘণ্টা স্থায়ীত্ব হয়েছিল এই ক্ষণিকের তরের বাদশাহি। তাঁর ভাষ্যে,
“এই ভিস্তিওয়ালা পুরস্কারপ্রার্থী হইয়া দিল্লীতে উপনীত হইলে হুমায়ুন তাহাকে বারো ঘণ্টার (কারো কারো মতে দুই ঘণ্টা) জন্য সিংহাসনে উপবিষ্ট করিয়ে পুরস্কৃত করেন। ভিস্তিওয়ালা এই অল্প সময়ের জন্য সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করে নিজের ও নিজের আত্মীয়স্বজনের ভরণপোষণের সুবন্দোবস্ত করে নিয়েছিল।“
হুমায়ুনের এই ছেলেমানুষি আচরণ পছন্দ করে নি তাঁর ভাইদের কেউই। যে দুইদিন ভিস্তিওলা নিজাম সিংহাসনে বসে ছিলেন, সেই দুই দিন মির্জা হিন্দোল দরবারে আসেন নি। সৈন্য সংগ্রহের কথা বলে আলোর চলে যান তিনি। মির্জা কামরানও দরবারে আসেন নি। তিনি অবশ্য অসুস্থ ছিলেন এমনিতেই। তবে, তার মনোভাবও মির্জা হিন্দোলের মতোই ছিল। ভিস্তিওলাকে সিংহাসনে বসানোটাকে একদমই মেনে নিতে পারেন নি তিনি। তিনি বাদশাহকে বলেছিলেন যে, লোকটি যত উপকারই করে থাকুক না কেন, তার জন্য তাকে সিংহাসনে বসানো উচিত হয় নি। তাকে অন্য কোনো পুরস্কার কিংবা জায়গির দেওয়া যেতো। বিশেষত, শের খান যখন ক্রমশই আগ্রার দিকে এগিয়ে আসছে তখন হুমায়ুনের এই সব বালসুলভ কাজকর্মের কোনো অর্থ হয় না বলে বিষয়টাকে সমালোচনা করেছিলেন তিনি।
খুব ভালো লেখা। এই হিমু কি হেমচন্দ্র বিক্রমাদিত্য? যার সাথে আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধ লড়েছিলেন?
হ্যাঁ, একই হিমু।