এবারে চাপাতি নয়, শান্তির রামদা ও পিস্তল নিয়ে এসেছিলেন ধর্মের ধ্বজাধারীরা। রাস্তায় নয়, সরাসরি বাসায়। ‘আল্লাহু আকবার’ বলে ধর্ম রক্ষা করে চলেন গেলেন তারা। তাতে ঝরে গেলো আরো একটি প্রাণ, আরো একজন মুক্তচিন্তকের প্রাণ।

এদেশে মানুষের হাতে মানুষ মরে প্রতিদিনই। মানুষ মারা গেলে তাতে লোকের সহানুভূতি থাকে, নাস্তিক মারা গেলে থাকে না। নাস্তিকেরা এদেশে মানুষ নয়, ইতর শ্রেণীর জীববিশেষ। তাদের বাঁচা-মরায় কারও কিছু যায় আসে না। ভুল বললাম, মরে গেলেই বরং খুশি হয় সবাই। স্বয়ং ঈশ্বরের কাছে যারা ঘৃণ্য, বান্দাদের কাছেও যে তা-ই হবে, এমনটা সহজেই অনুমেয়। ঘৃণ্যরা মরে যাক, তবেই না শান্তি।

এখন সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। অভিদা’র মতো করে বললে, আততায়ীর কোপে মরে গিয়ে দ্বিতীয়বার মরতে হয় এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। প্রতিবারের মতো এবারও এর ব্যত্যয় ঘটে নি। নিলয় নীলের মৃত্যুতেও অনলাইন পাড়া সরব। অল্প কিছু মানুষ হতাশা ব্যক্ত করছেন ঠিকই, তবে বেশিরভাগই করছে উল্লাস। কেউ কেউ কয়েক কাঠি সরেস হয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করছে যেন এ নাস্তিকনিধন অব্যাহত থাকে। এর আগে একজনের কমেন্টে দেখেছিলাম হত্যাকারীদেরকে বাসায় দাওয়াত করে খাওয়াতে চান তিনি। এবারে এখনো অমন মন্তব্য চোখে পড়ে নি, তবে কেউ না কেউ যে অচিরেই সে কাজে এগিয়ে আসবেন আশা করাই যায়। মুমিন বলে কথা।

অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পর বিবিসি বাংলার পেইজে সংবাদের লিঙ্কে মুমিনদের মন্তব্যের নমুনা। সবাই কিন্তু মন্তব্য করে না, অনেকেই লাইক দিয়ে সহমত পোষণ করে। তাই মন্তব্যগুলোতে লাইকের সংখ্যাটাও বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তাছাড়া কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরও মন্তব্য আছে এতে, মুমিনদের বিপরীতে তাদের বক্তব্যটাও খেয়াল করুন। পুরোটা দেখতে এখানে ঢু মারুন।

অনন্ত বিজয় দাশ হত্যাকাণ্ডের পর বিবিসি বাংলার পেইজে সংবাদের লিঙ্কে মুমিনদের মন্তব্যের নমুনা। সবাই কিন্তু মন্তব্য করে না, অনেকেই লাইক দিয়ে সহমত পোষণ করে। তাই মন্তব্যগুলোতে লাইকের সংখ্যাটাও বিশেষভাবে লক্ষনীয়। তাছাড়া কয়েকজন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরও মন্তব্য আছে এতে, মুমিনদের বিপরীতে তাদের বক্তব্যটাও খেয়াল করুন। পুরোটা দেখতে এখানে ঢু মারুন।

এ মুমিনেরা কারা? অল্প কথায় বললে এরা বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান সমাজ। কেউ কেউ হয়ত বলবেন, ফেসবুকাররা সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে না। হ্যাঁ, তা করে না, তবে এদেশের সবচেয়ে প্রগতিশীল এগিয়ে থাকা অংশের আধুনিক লোকজনেরই একটা স্যাম্পল হচ্ছে ফেসবুক। দিনে পাঁচ ওয়াক্ত না হলেও অন্তত শুক্রবার তারা নামাজে যান এবং রাতে বসেন সানি লিওন দেখতে। নাস্তিকদের প্রতি এদের বেশিরভাগেরই দৃষ্টিভঙ্গি যদি হয় এমন, তাহলে অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ বাকি জনগোষ্ঠীর কী দশা একবার ভাবুন!

মুমিনদের মন্তব্যগুলো পড়লে দেখা যায় এদের বক্তব্য ঘুরেফিরে একই – নাস্তিকেরা গালাগালি করে, তাদের ধর্মের অবমাননা করে। ধর্ম-অবমাননা বলে কথা, এর শাস্তি হওয়া চাই। মৃত্যুদণ্ডই হচ্ছে এর সবচেয়ে যুৎসই শাস্তি।

বুদ্ধিজীবী সুশীলেরা বলেন, মুসলমানদের সবাই জঙ্গি নয়। তারা নামাজ পড়েন, ঘর-সংসার সামলান, সন্তানদের স্কুলে পাঠান, দিনে কাজ করেন আর রাতে পরিবারের সবাই মিলে স্টার জলসা দেখেন। আহা! কত সুন্দর! কিন্তু গোল বাধে কোন নাস্তিক খুন হলে। সেসময় উগ্র জঙ্গি আর সুশীল শান্তিকামী মুমিন যেন সোনায় সোহাগা, এককাট্টা জিগরি দোস্ত। জিমি কিমেলের অনুষ্ঠানে গিয়ে বিল মারের বলা এ কথাগুলোই তখন সত্য হয়ে ওঠে –

“I know most Muslim people would not have carried out an attack like this. But here’s the important point: Hundreds of millions of them support an attack like this. They applaud an attack like this. What they say is, ‘We don’t approve of violence, but you know what? When you make fun of the Prophet, all bets are off.”

ধর্ম-অবমাননা কাকে বলে, কত প্রকার, কী কী – সে বিষয়ে মুমিনেরা এখনো একমত হতে পেরেছে বলে আমার জানা নেই। বেশ কিছুদিন আগে ফেসবুকেই কিছু ভদ্রগোছের মুমিনের সঙ্গে এ বিষয়ে কিঞ্চিত বাৎচিত হয়েছিল। ধর্ম-অবমাননাকে তারা সংজ্ঞায়িত করতে না পারলেও নবী মুহাম্মাদকে নিয়ে নাস্তিকদের ‘গালাগালি’র কিছু নমুনা সেবার হাজির করেছিল। বোঝাই যায়, নাস্তিকদের লেখালেখি সম্বন্ধে তাদের জানাশোনা ঐ থাবা বাবা পর্যন্তই, বছর দুয়েক আগে ফেসবুক শেয়ারের কল্যাণে যেটা ছড়িয়ে পড়েছলো সর্বত্র। নাস্তিক কাকে বলে সে বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলেও লোকে অন্তত এটুকু জানে যে তার নবীকে নিয়ে ইন্টারনেটে আজেবাজে কথা বলে বেড়ায় এরা। অনেকসময় হয়ত জেনেশুনেই গালাগালির অভিযোগ এনে থাকে অনেকে; ‘সমালোচনা’র অভিযোগ অতটা জোরালো শোনায় না, এর চাইতে ‘গালাগালি’র অভিযোগে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা অনেক সহজ। সেই সুপ্রাচীন স্ট্রম্যান ফ্যালাসিরই আশ্রয় নেয়া আরকি। যাহোক, একসময় এ অভিযোগ পুরো ব্লগার কমিউনিটির বিরুদ্ধে করলেও আস্তে আস্তে এরা বুঝতে শেখে ব্লগ কী, ব্লগার কারা। তবে এখনো সম্ভবত তাদের বদ্ধমূল ধারণা নাস্তিকদের একমাত্র কাজ হলো তাদের নবীকে গালাগাল ও ব্যাঙ্গবিদ্রূপ করা। কেউ কেউ গালাগালি আর সমালোচনার মধ্যে পার্থক্যটুকু বুঝতে পারে ঠিকই, তবু তাদের আপত্তি এই সমালোচনাকে ঘিরেই। সত্যি বলতে এই সমালোচনারই সার্বজনীন মুমিনীয় প্রতিশব্দ হচ্ছে অবমাননা। সেটা অশিষ্ট শব্দচয়নপূর্বক গালাগালিই হোক কিংবা যথার্থ তথ্য ও সাক্ষ্যপ্রমাণের আলোকে যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনাই হোক (যেমনটা কিছুদিন আগে করে জনগণের রোষানলে পড়েছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী), সোজা কথা ধর্ম বা নবীকে অবমাননা করা যাবে না, ইহা খ্রাপ।

ধর্মকে অবমাননা (পড়ুন ‘সমালোচনা’) করা যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা সম্ভব। ব্লগস্ফিয়ারেই এ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কম হয় নি। তবু ভাঙা রেকর্ডের মতোই লোকে এখনো বলে চলেছে ধর্মের সমালোচনা করা যাবে না, কেননা সমালোচনা মানেই অবমাননা। আর কোনকিছুর অবমাননা করা হচ্ছে বর্বর কাজ। বর্বর কাজ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তা-ই যদি হয়, তাহলে ধর্ম ছাড়াও আর কী কী বিষয়ের আপমান-অবমাননা করে থাকি আমরা এই একবিংশ শতাব্দীর সুশীল সভ্য বাংলাদেশে বসে, চলুন একটু খুঁজে দেখি।

প্রতিদিন পত্রিকা খুললেই প্রথমে যেটা চোখে পড়ে সেটা হলো কোন না কোন রাজনৈতিক দল ও তার নেতানেত্রী, চোর, ডাকাত, খুনি, ধর্ষক, দুর্নীতিবাজদের নিয়ে নানান কেচ্ছাকাহিনী। এটাকে অবশ্য খবরের চেয়ে বেশি কিছু বলা যাবে না, হতে পারে যাদেরকে নিয়ে রটেছে, তাদের দাবিমতে এসব মিথ্যা সংবাদ। মূল সমালোচনাটা থাকে প্রধানত সম্পাদকীয় পাতাতেই। মুমিনদের যুক্তি মানতে গেলে বলতে হয়, কলামিস্টরা সেখানে যাচ্ছেতাইভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে প্রতিদিন অপমান-অবমাননা করে যাচ্ছেন।

ব্যঙ্গ-বিদ্রুপেও মুমিনদের প্রবল আপত্তি। অথচ প্রায় প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় নানা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের কার্টুন প্রকাশিত হচ্ছে, সপ্তাহান্তে ম্যাগাজিনে লেখা হচ্ছে রম্যরচনা। মুমিনদের যুক্তিতে এসব অবমাননা নয় কি? মনে আছে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের একটা কার্টুন ছেপেছিল প্রথম আলো, তা দেখে ভদ্রলোকের অনুভূতি আহত হয়েছিল খুব। এটা নিয়ে তিনি বিবৃতিও দিয়েছিলেন। তার এ আহত অনুভূতি নিয়ে সেবার আমাদের সুশীল শান্তিকামী মুমিনদের কিছু যায়-আসে নি।

তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সেই কার্টুন।

তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সেই কার্টুন।

পত্রপত্রিকায় সাংবাদিক, কলামিস্টদের এহেন ন্যক্কারজনক নোংরামি, অসভ্যতা দেখে অতিষ্ঠ হয়ে যে ফেসবুকে বসবো দুদণ্ড শান্তি পেতে তার-ও উপায় নেই। ট্রোল ফুটবল, ট্রোল ক্রিকেট, ট্রোল অমুক, ট্রোল তমুক ইত্যাদি নানা পেজে সয়লাব হয়ে আছে সেখানে। এই দল তো ঐ খেলোয়াড়, এই রাজনীতিক তো ঐ চলচ্চিত্র অভিনেতা – কী নেই যা নিয়ে রঙ্গরসিকতা হচ্ছে না? ব্যাপারখানা এমন যেন ঐ খেলোয়াড়, দল বা অভিনেতার কিংবা তাদের ফ্যান-সমর্থকদের কোন অনুভূতি নেই।

এ পর্যায়ে এসে মুমিনরা হয়ত বলবেন, “সবই বুঝলাম বাপু, কিন্তু আমার নবীকে নিয়ে কোন চুদুরবুদুর চইলত ন।” এখানেই বাধে বিপত্তি। এতে সন্দেহ নেই যে নিজ ধর্ম ও নবী-রাসুলদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা অপরিসীম। আল্লাহ-রাসুলকে খুশি করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করতে লোকে রাজি, তবু ধর্ম ও তার প্রবর্তকদের ব্যাপারে কোন কটুকথা সওয়া চলবে না। কথা হচ্ছে, আপনি আপনার ধর্মকে যতই সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবেন, আপনার নবীকে যতই মহামানব বলে বিশ্বাস করেন, অন্য ধর্মাবলম্বী বা অবিশ্বাসীদেরকেও সেটা মানতে হবে কেন? আপনি যেটা সম্মান করেন, সম্মান পাবার বিন্দুমাত্র যোগ্যতা নেই জানা সত্ত্বেও তাকে সম্মান করতে ধর্মহীনদের কী ঠ্যাকা পড়েছে? আপনার ধর্মকে, ধর্মের প্রবর্তককে শ্রদ্ধা করতে হবে – মামাবাড়ির আবদার নাকি দাদা? আপনার ধর্মে যাদের বিশ্বাস নেই, কোন যুক্তিতে আপনার রাসুলকে তাদের সম্মান করতে বলেন? ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পর দেখেছিলাম, কিছু তথাকথিত বড়ভাই তাদের ‘সম্মান’ নিয়ে খুবই চিন্তিত। ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্রটি তাকে সম্মান করছে কিনা তা নিয়ে তাদের চিন্তার অন্ত নেই। সম্মান আদায় করার প্রথম পদক্ষেপটা নেয় তারা ‘র‍্যাগিং’ নামের একটা রিচুয়ালের মধ্য দিয়ে। নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রটিকে সেখানে কী কী ভাবে অপদস্থ করা হয় সে ব্যাপারে আর না-ই বলি। এরপর থেকে ছেলেটি উঠতে-বসতে বা দেখা হলে বড় ভাইদেরকে সালাম-নমস্কার থেকে শুরু করে যতভাবে সম্ভব একজনকে সম্মান দেয়া যায়, তা দিতে এতটুকু বাদ রাখবে না, এমন একটা নিশ্চয়তা নিয়েই যেন ছেলেটিকে সেখান থেকে ছাড়া হয়। ওদের সম্ভবত ধারণা নেই যে শ্রদ্ধা এমনি এমনি অর্জন করা যায় না, কারো শ্রদ্ধা পেতে গেলে আগে নিজেকে তা পাবার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। এদেশের অধিকাংশ ধর্মানুরাগীর মানসিকতাও তথৈবচ। তাদের জানা নেই যে একজন অবিশ্বাসীর কাছ থেকে যথার্থ সম্মান পেতে হলে তার ধর্মটিরও সেরূপ যোগ্যতা থাকা চাই। কেবল গলাবাজি ও চাপাতির জোরেই শর্টকাটে সম্মান আদায় করতে চায় এরা।

এবারে হয়ত তারা বলবেন, “সম্মান না করুক, অন্তত তাকে নিয়ে বাজে কিছু বলা চলবে না।” তাদের কাছে আমার প্রশ্ন – বিনা কারণে আপনি কাউকে অসম্মান করেন? যদি কোন কারণ থেকে থাকে, আপনি কি সেটা না বলে মুখ বুজে থাকেন? থাকেন না? তাহলে নাস্তিক বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের সেটা বলতে বাধা কোথায়? হ্যাঁ, এতে আপনার অনুভূতি আহত হয় সেটা জানি, আপনি যখন কারো নিন্দা করেন, তখন তারও হয়, তার আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষী নিকটজনদেরও হয়। তাই বলে সত্য বলা থেকে বিরত থাকতে হবে?

ধর্মের নাম নিয়ে ইসলামের সৈনিকেরা কোন কুকীর্তি সম্পাদন করে বসলে পরক্ষণেই দেখা যায় সারা দুনিয়ার মডারেট মুমিন সমাজ একযোগে শীৎকার শুরু করে, “ইহা সহি ইসলাম নয়।” ইদানীং দেখা যাচ্ছে, কোন মুক্তচিন্তক লেখকের মৃত্যুর পর তার পক্ষের শুভানুধ্যায়ী লোকজনও একইভাবে বলা আরম্ভ করে, “ইনি তো ধর্মকে গালি দেন নি”, “বাজে কিছু লেখেন নি” ইত্যাদি ইত্যাদি। নাস্তিক পরিচয়কে সযত্নে পাশ কাটিয়ে নানা রকম শুগারকোটিং-এর মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় ইনি লিখতেন কেবল ‘ধর্মীয় কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার’ বিরুদ্ধে, কিংবা তিনি ছিলেন যুদ্ধাপরাধী বিচারের আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ইত্যাদি। অধিকাংশ সাধারণ মুসলমান মৌলবাদকে বর্জন করে চলে। অনেকক্ষেত্রে তাদের কুসংস্কার ও সাম্প্রদায়িকতার মাত্রাকেও চরম পর্যায়ের বলা চলে না। তাদের অনেকের দৃষ্টিতেই এগুলো ধর্ম থেকে আলাদা। তাই নিহতের ‘নাস্তিক’ পরিচয়কে গোপন রেখে কেবল মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে সহানুভূতি পাওয়ার একটা সস্তা প্রচেষ্টা বলে মনে হয় এটা আমার কাছে।

মৌলবাদ, কুসংস্কার বা সাম্প্রদায়িকতাই হোক, বা এসবের জননী খোদ ধর্মই হোক, কে কীসের বিরুদ্ধে কীভাবে লিখলো সেটা বড় কথা নয়, যতক্ষণ না তা সত্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। ধর্ম বা নবীর সমালোচনায় বা স্যাটায়ারে অনেকেই খুব রূঢ় শব্দ ব্যবহার করেন, যেমন লুইচ্চা, মহাম্মক, মহাউন্মাদ ইত্যাদি। সাধারণ পাঠকের কাছে এগুলোকে আপাত দৃষ্টিতে স্রেফ গালাগালি বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও এসব শব্দচয়ন না করার পক্ষে। এগুলো ছাড়াও ধর্মের কঠোর সমালোচনা করা সম্ভব। এভাবে অভিজিৎ রায় লিখে গেছেন, আবুল কাসেম বা আকাশ মালিকের মতো অনেকেই লিখে চলেছেন এখনো, তাদেরকে কখনো এমন দুঃশীল ধাঁচে লিখতে দেখি নি। ইসলামের সমালোচনায় গত এক দশক ধরে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ব্লগার নাস্তিকের ধর্মকথার কথাই ধরা যাক, তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও দেখা যায় মুহাম্মাদের নামের পরে ঠিকই (সঃ) ব্যবহার করেছেন তিনি। এর মানে কিন্তু এই নয় যে তিনি আসলেই আত্মায় বিশ্বাসী বা সত্যিই মুহাম্মাদের আত্মার শান্তি কামনা করছেন। আলোচনাকে সুস্থ রাখতে প্রতিপক্ষকে এতটুকু সম্মান দিলে আমি তাতে কোন ক্ষতি দেখি না, দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে এতটুকু ছাড় তো দেয়াই যায়।

গালাগালির সংজ্ঞায়ও বোধহয় আমরা এখনো উপসংহারে পৌঁছতে পারিনি। তবে অনেকক্ষেত্রে কেবল কমন সেন্স দিয়েই বোঝা সম্ভব যেটাকে গালাগালি বলে দাবি করা হচ্ছে, আসলে তা নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করতে না চাইলে এক্ষেত্রে লেখককে বাধা দেয়াও যুক্তিসঙ্গত নয়। একটু ব্যাখ্যা করি।

স্পেডকে স্পেড বলার স্বাধীনতাই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। আপনি বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী হয়ে থাকলে বলুন তো, ছয়বছরের বাচ্চার প্রতি যে লুলায়িত হয় সে কি শিশুকামী নয়? (দেখুন সহিহ বুখারি, খণ্ড ৫, বই ৫৪, হাদিস নং ২৩৪ এবং ২৩৬) দাসীর সঙ্গে সেক্স কিংবা একের পর এক বিয়ে করা কি বেহায়া সেক্স ম্যানিয়াক যৌনাচারীর কর্ম নয়? (দেখুন, কোরআন, ৪:২৪, ৮:৬৯, ২৩:৫-৬ ইত্যাদি) নিজের পালিত পুত্রের স্ত্রীর দিকে যে লোলুপ দৃষ্টি দেয়, বিয়ে করে, সোজা ভাষায় সে পার্ভার্ট বৈ আর কী? (কোরআন ৩৩:৪, ৩৩:৩৭, ৩৩:৪০) একের পর এক আক্রমণাত্মক যুদ্ধ, লুটপাট, যুদ্ধবন্দী নারী ও শিশুদেরকে দাস-দাসী বানানো, যৌননির্যাতন – এসবের নির্দেশদাতাকে, ক্ষমতা পেয়ে উন্মাদ, উন্মত্ত হয়ে যাওয়া লোকটিকে কী বলে? (কোরআন ৯:১-৬,১১,১২,১৪,১৫, ৩৩:৫০ ইত্যাদি) বউ পেটানো জায়েজ করে যে বাণী আউড়াতে পারে, তাকে নারীনির্যাতনকারী বলা কি দোষের কিছু? (কোরআন ৪:৩৪) যাদুটোনায় বিশ্বাসী বিজ্ঞানবিমুখ প্রাগৈতিহাসিক গণ্ডমূর্খ আহাম্মককে সম্মানজনক কী বিশেষনে বিশেষিত করা যেতে পারে বলবেন কি? (কোরান ২:১০২, ৭:১১৬ কিংবা ১১৩:৪) কথায় কথায় যে নিজের বক্তব্য সৃষ্টিকর্তার নামে চালিয়ে দেয়, একজন ডাহা মিথ্যাবাদীর চাইতে সে কোন অংশে কম নির্দোষ? স্পষ্ট করে বললে, নিন্দার্থক এ বিশেষণগুলোকেই আসলে গালাগালি বলে ভ্রম হয়। ধর্মাবতারের চরিত্র-সমালোচনা করতে হলে তাঁকে কোলে তুলে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে শ্রুতিমধুর নমনীয় বিশেষণযোগে মৃদু বকতে হবে, এমন তো কোন কথা নেই, আছে কি?

পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে এখনো যারা বিশ্বাস করে পৃথিবী সমতল, চাঁদ হচ্ছে পনিরের তৈরি, ভূত, ভ্যাম্পায়ার, ওয়ারউলফ ইত্যাদি বাস্তবেই আছে। আছে টেলিপ্যাথি, জ্যোতিষশাস্ত্র, ডাইনিবিদ্যা, প্ল্যানচেট, পুনর্জন্মের মতো বিশ্বাস। এযুগের নতুন গজানো বিশ্বাসগুলোর মধ্যে আছে এলিয়েন অ্যাবডাকশন, ভ্যাক্সিন নিলে শিশুর প্রতিবন্ধী হয়ে যাওয়া কিংবা হাল আমলের জিএমও কন্সপিরেসি ইত্যাদি। এরকম আরও অসংখ্য বিশ্বাস-কুসংষ্কার আছে পৃথিবীতে যার সবকয়টা লিখে শেষ করা যাবে না। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার নিরিখে দেখলে এ বিশ্বাসগুলো হাস্যকর। হাসির উদ্রেক করে এমন কিছু নিয়ে হাসিঠাট্টা, ব্যাঙ্গবিদ্রূপের সুযোগ লোকে হেলায় হারাতে চায় না। এজন্যই এগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত কার্টুন আঁকা হয়, কৌতুক ও রম্য রচনা লেখা হয়। ঠিক একই কারণে ছয় দিনে পৃথিবী তৈরি ও এর বয়স ছয় হাজার বছর, নূহের প্লাবন, আদম-হাওয়ার কিচ্ছা, ভার্জিন বার্থ, মৃতকে জীবিত করা, পানির উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া, আত্মা, জিন, শয়তান, যাদুটোনা, তুকতাক, মিরাকল, অলৌকিকতার জগাখিচুরিসহ অসংখ্য মিথ্যার উপরে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম এবং সর্বোপরি সৃষ্টিকর্তার মতো কাল্পনিক চরিত্রে আপনার যে বিশ্বাস, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে সেটাও অবিশ্বাসীদের কাছে হাস্যকর। সুতরাং, এটা নিয়ে একটু মকিং তো তারা করতেই পারে, কী বলেন? তাই বলি, বিশ্বাস নিয়ে হাসাহাসি অপছন্দ হয়ে থাকলে হাস্যকর কিছুতে বিশ্বাস না করাই শ্রেয়।

একজন অবিশ্বাসীর কাছে মুহাম্মাদ (সাঃ) একজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি কিছু নন। একজন অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে একাধারে তিনি একজন স্নেহময়ী পিতা, প্রেমিক, স্বামী, ক্ষেত্রবিশেষে দয়ালু, অন্যদিকে ক্ষমতার লোভে মত্ত, হিংস্র, শেষ বয়সে গিয়ে চারিত্রিক স্খলন ঘটা একজন ভণ্ড। আপনি পারেন না তার প্রতি আপনার অন্ধ ভক্তিকে অবিশ্বাসীদের উপর চাপিয়ে দিতে। একইভাবে আপনি পারেন না আপনার মহানবীর হাস্যকর কার্যকলাপ নিয়ে অবিশ্বাসীদের ব্যাঙ্গবিদ্রূপকে জোর খাটিয়ে বন্ধ করতে। সারাদিন ট্রোল পোস্টে লাইক দিবেন, শেয়ার করবেন, আর দিনশেষে একজন নাস্তিকের মৃত্যুসংবাদ শুনে বলবেন, “খুনখারাবি আমার পছন্দ না, তবে আমার প্রফেটকে ইনছাল্ট করাও ঠিক না”, তখন আপনার এ চরিত্রকে বিশেষিত করবার জন্য খাঁটি বাংলায় একটা চমৎকার শব্দ বরাদ্দ আছে – দ্বিচারিতা, ইংরেজিতে যাকে বলে Double Standard নীতি। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এটাই এদেশের তথাকথিত মডারেট মুমিনদের জাতীয় চরিত্র।