(মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু একটি হিন্দু পরিবারের অবস্থা এবং অবস্থান নিয়ে ধারাবাহিক উপন্যাসটির চতুর্থ পর্ব “মুক্তমনা”-তেই পোস্ট করেছিলাম সেপ্টেম্বর,২০১৩ সালে। দীর্ঘদিন পরে পর্ব পাঁচ পোস্ট করলাম। এ দীর্ঘ সময় আরও দীর্ঘতর হয়েছে আমাদের ক’জন প্রিয়মুখকে হারানোর শোকে। “আমরা শোকাহত কিন্তু আমরা অপরাজিত” এবং সে অপরাজেয় চিত্তের শক্তিই আমাদের সামনে চলার প্রেরণা।)
(১০)
থানা সদর থেকে আসা দু’টি নৌকার একটি নিমাই বিল দিয়ে সোজা ভবানীপুরের দিকে চলে গেল| অন্য নৌকা হঠাৎ করে মোড় ঘুরে নিমাই বিল থেকে যে খালটি আমাদের গ্রামের এসে পড়েছে সেখানে ঢুকল| তারপর সোজা গিয়ে ভিড়লো বাড়ির ঘাটে| বাড়ির সামনের পুরানো কয়েকটি নারকেল গাছের পাশেই নৌকা ঘাট| বন্যা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এলাকার বাড়িগুলো বেশ উচুঁ| শুকনো মরশুমে তাই বাঁশ কিংবা কাঠ দিয়ে ধাপে ধাপে অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে বাড়িতে উঠতে হয়। বর্ষাকালেও তাই একেবারে বন্যা না হলে ঘাটে নৌকা ভিড়লেও পাঁচ ছ্য় ফুট ধাপ বেয়ে বেয়ে বাড়িতে উঠতে হয়|
বিল এলাকায় গ্রামের বাড়িগুলো বর্ষাকালে যেন এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ| এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির মাঝখানে ছোট নিচু খাঁড়ি| আঞ্চলিক ভাষায় এ খাঁড়িগুলোকে “জোলা” বলে| জোলা শব্দটি জল থেকে আসতে পারে|
গ্রামের পূর্বপাড়ার প্রায় ২০টির মত বাড়ির মাঝখানে কমবেশী প্রশস্তের জোলা| বর্ষাকালে বাঁশ আড়াআড়ি পেতে সাঁকো বানিয়ে এই ২০টি বাড়ির সংযোগ করা হয়| একেবারে পূর্বদিকের আমাদের বাড়ির জোলাটি অনেকটা প্রশস্থ| এই দীর্ঘ দূরত্বকে সাঁকো দিয়ে জুড়ে দিতে যে পরিশ্রম করা দরকার তার তাগিদ ও মানসিকতা কারো নেই| একে তো যুদ্ধ চলছে| তার উপর ছোট দাদুর মৃত্যু| তাই বাঁশের সাকোঁটি বানায়নি কেউ| আর সেটাই এদিন শাপেবর হয়ে দেখা দিল|
মিলিটারি বোঝাই নৌকা গ্রামের দিকে আসতে দেখেই সাত-আট মাসের অন্তঃসত্বা মাকে বড়মার সাথে নৌকায় তুলে দিয়ে বাবা বাড়ির অন্যান্যদের নিয়ে শলাপরামর্শ করতে লেগে গেলেন। কিভাবে বাড়ির বউ-ঝি ও অন্যান্যদের রক্ষা করবেন? সবমিলিয়ে তখন বাড়িতে ছয়-সাত জন যুবক আর পূর্ণবয়স্ক মানুষ। সবাই সোমত্ত। শক্তিশালী ও সাহসী। তাই একজেঠা বললেন, বউদের ছেলেমেয়েসহ ‘জোলা” পার করে পাশের পাড়াতে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা ছয় জন লাঠি-বল্লম নিয়ে দাঁড়াব। নৌকা থেকে নামার সাথে সাথে এক একজনকে গেঁথে ফেলব।
বাবা আগাগোড়াই খুব ধীরস্থির-ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। বাবা বললেন, শুধু রাজাকার এলে কোন অসুবিধে নেই। কিন্তু আমরা তো জানি না, সাথে মিলিটারি আছে কিনা। তাছাড়া বাড়িতে কোন বন্দুক-রাইফেলও নেই যে,অস্ত্রের সামনে লড়াই করা যাবে। বউ-ছেলেমেয়েদের পাশের পাড়ায় পাঠিয়ে দাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি একটু চিন্তা করে নেই। আর লক্ষ্য রেখ নিমাইবিলের ওপার থেকে কোন নৌকা এদিকে আসে কিনা। বহেরাতলিতে মুক্তিবাহিনীর একটি গ্রুপ আছে। বুদ্ধি করে যদি ওরা এদিকে আসে তবেই আমরা লড়াই শুরু করবো।
সে মতেই ডিংগি নৌকায় করে কয়েক জোলা পার করে বেশ দূরত্বে জেঠিমাদের সাথে ছোট ছেলেমেয়েদের নামিয়ে দেয়া হলো। ঠাকুমা কিছুতেই ছেলে আর নাতিদের রেখে বাড়ি ছেড়ে যাবেন না। বাবা শত বুঝিয়েও তাঁর মাকে পাঠাতে পারলেন না। মাত্র দিন দুই আগেই এক পিসিমার বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে রাজাকারেরা। পিসিমা তাঁর বিবাহযোগ্যা দুই মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে। মেয়েদের পাঠিয়ে পিসিমাও ঠাকুমার সাথে রয়ে গেলেন বাড়িতে। তিন জেঠাতো ভাই ও তিন জেঠা মাছ মারার জন্য প্রস্তুত করে রাখা টেটা আর কুছের মাথায় লোহার ধারালো আংটাগুলো প্রস্তুত করে বৈঠকখানার পাশে জমা করতে লাগলেন।
বাবা তাকিয়ে আছেন মিলিটারি নৌকার দিকে। বহেরাতলি থেকে মুক্তিবাহিনীর কোন গ্রুপ এদিকে আসে কিনা সেদিকেও খেয়াল। একটি নৌকা নিমাইবিল থেকে খালে ঢুকতেই এক অজানা আশঙ্কায় বাড়ির সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে গেলেন। ঠাকুমা আর পিসিমা অহেতুক চিৎকার করে বাড়িতে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করতে লাগলেন।
নিঃসন্তান সেজো জেঠামশাই বাবাকে নিজের ছেলের মতোই ভালবাসেন। বাবাও তাঁর এই ভাইয়ের কথাকে কখনোই অমান্য করেন না। সেজো জেঠামশাই বাবাকে বললেন, দেখ এ বাড়িতে মিলিটারি আসবে শুধু তোকে মারার জন্য। বাড়ির অন্য সবাই মরে গেলেও যদি তুই বেঁচে থাকিস তবে পরিবারটা ভবিষ্যতে হয়ত বেঁচে থাকবে। তাই তুই পালিয়ে যা। আমরা মরার আগে যতটুকু পারি লড়াই করতে পারবো। কিন্তু তুই থাকলে সবাই তোকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে তাই প্রতিরোধটা ঠিকমতো করা যাবে না।
বাবা বললেন, এটা কি বলো! আমি সবাইকে ছেড়ে স্বার্থপরের মতো পালিয়ে যাব। তাছাড়া এই বর্ষাকালে পালাবই বা কোথায়? তার চেয়ে চল সবাই মরলে এক সাথে মরি। আর যদি বাঁচি তবে সবাই একসাথে।
সেজো জেঠামশাই বাবার মাথায় হাত দিয়ে বলল, দেখ মিলিটারি এলে সবাইকে মেরে ফেলবে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই। আর যদি রাজাকার আসে তবে ওরা তোকে শুধু মারবে। তোকে না পেলে বাড়িতে লুট করবে এর বেশী কিছু না। রাজাকারেরা আমাদের মারবে না বোধহয়। তাই পাগলামি করিস না ভাই। তুই পেছনের বাঁশঝাড়ের মধ্যে দিয়ে পুকুরের ওপারে জলের মধ্যে কচুরিপানার ভিতর লুকিয়ে থাক মাথা জাগিয়ে। এখনই যা। যত তাড়াতাড়ি যাবি তত দূরে সাঁতরে যেতে পারবি। মিলিটারি এলে ফাঁকা গুলিও করতে পারে। তাই নিরাপদে একটি জায়গায় চুপ করে লুকিয়ে থাকা চাই তোর। যা আর তর্ক করিস না।
বাবার কোন প্রতিরোধই সেজো জেঠামশাইর কাছে ধোপে টিকলো না। বাবাকে প্রায় জোর করেই ঠাকুমা-পিসিমার অলক্ষ্যে রান্না ঘরের পেছন দিয়ে ঘন লম্বা কচুরিপানা মধ্যে ডোবার জলে নামিয়ে দিলেন। বর্ষাকালে চারদিকে বাঁশ দিয়ে বেড়ি দিয়ে কচুরিপানা চাষ করা হয় গরুর খাবারের জন্য। বাবা সে কচুরিপানার ভিতর ডুব দিয়ে দিয়ে চলে গেলেন অনেক ভিতরে। পেছনের ডোবার ওপাশে আমন ধানের খেত। বর্ষাকালে জল বাড়ার সাথে সাথে ধানও বেড়ে ওঠে। তাই কচুরিপানার ডোবার সাথে আমন ধান খেতের সংযোগে সহজেই অনেক দূরে চলে যাওয়া যায় সন্তর্পণে সাঁতার কেটে কেটে। এককালের দক্ষ সাতাঁরু বাবা তাই বাড়ির নাগাল থেকে অনেক দূর চলে গেলেন। সেজো জেঠামশাই বাঁশঝাড়ের ঝোঁপের আড়াল থেকে লক্ষ্য করলেন, বাবা অনেক দূরে চলে গিয়ে ডোবার একেবারে শেষমাথায় একটি বাঁশের বেড়া ধরে আমন ধান আর কচুরিপানার মধ্যে একটু মাথা বের করে আছেন।
ততক্ষণে মিলিটারির নৌকা বাড়ির ঘাটে ভিড়ে গেছে। বড় জেঠামশাই একা কলতলায় নারিকেল গাছের কাছে এগিয়ে গেলেন। দেখা গেল হাতে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাশের গ্রামের কালু রাজাকার নৌকার ছইয়ের ভিতর থেকে মাথা বের করে বাড়ির ঘাটের কাঠের পাটাতনের সিঁড়িতে নামলো। পেছনে আরও আট থেকে দশ জন অচেনা লোক। এদের কয়েক জনের হাতে দোনালা কাঠের বন্দুক। চেহারা দেখে এদের কাউকেই পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারি মনে হলো না।
(১১)
কালু রাজাকারের নেতৃত্বে দোনলা বন্দুক হাতে অচেনা চেহারার লোকগুলো বাড়িতে ঢুকেই বাবাকে খুঁজতে আরম্ভ করলো। বড় ও সেজো জেঠামশাই দু’জনে তখনো বাইরের বাড়িতে দাঁড়িয়ে। কালু রাজাকারের দিকে তাকিয়ে অচেনা লোকেরা বুঝল, এদের দু’জনের কেউ-ই মাষ্টার মশাই নন, যাকে ধরে নিতেই তারা এ বাড়িতে এসেছে।
একজন বলে উঠলো, শালা মালাউনের বাচ্চাটা কোথায়?
সেজো জেঠামশাই কালুর দিকে তাকিয়ে বললো, তোমরা কাকে খুঁজছো?
কালু রাজাকার আমতা আমতা করে উত্তর দিল, স্যার কোথায়?
সেজো জেঠামশাই বললো, তোমরা যে এ বাড়িতে এসেছ শওকত ভাই জানেন?
শওকত ভাই মানে ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান শওকত আলীর কথা বোঝালেন সেজো জেঠামশাই।
কালুর পাশ থেকে একজন হঠাৎ বলে উঠলো, শালা মালাউনের বাচ্চার বেজায় সাহস হয়েছে বোঝা যাচ্ছে। হিন্দু বাড়িতে আসতে শওকত চেয়ারম্যানের কাছ থেকে পারমিশন নিতে হবে? তোদের চোদ্দগোষ্ঠীর ভাগ্য যে পাকিস্তানি মিলিটারি সাথে আনি নাই ।
বলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সেজো জেঠামশাইকে কাঠের বন্দুক দিয়ে আঘাত করতে উদ্যত হলো। প্রায় ছয় ফুটের বিশাল দেহের সেজো জেঠামশাই হাত দিয়ে বন্ধুকের সামনের অংশ ধরে আবার ছেড়ে দিলেন।
বড় জেঠামশাই পরিস্থিতি হালকা করতে কালু রাজাকারকে বললেন, কালু তুমি আমাদের পরিচিত। কতদিন আমাদের বাড়িতে এসেছো। তোমার স্যারকে দরকার, তুমি কিংবা শওকত খবর পাঠালেই তো হতো। রাজাকার নিয়ে বাড়িতে আসার প্রয়োজন ছিল কি?
কালু রাজাকার কোন উত্তর না দিয়ে বাড়ির ভিতরের দিকে চলে যেতে সবাইকে নির্দেশ দিল। অচেনা রাজাকারগুলোও কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে সবগুলো ঘরে খোঁজাখুজি আরম্ভ করে দিল।
ইতিমধ্যে বাড়িতে থাকা আরেক জেঠামশাই আর তিন জেঠাতো ভাই ঘরের ভিতর থেকে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বড় জেঠামশাইর দিকে চোখাচোখা করছেন, তিনি কোন নির্দেশ দেন কিনা জানার জন্য। বড় জেঠামশাই প্রতিরোধের কোন ইংগিতই দিলেন না।
সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও বাবাকে না পেয়ে সবাই আবার বাইরের উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন বললো, শালা ভেগে গেছে।
আরেকজন কালু রাজাকারের সাথে দূরে গিয়ে একটু শলাপরামর্শ করে সবচেয়ে ছোট জেঠাতো ভাই ফনিন্দ্রকে করে জাপটে ধরে বেঁধে ফেললো। ক্লাশ টেনের ছাত্র ফনিন্দ্র একটু বাধা দিতেই কাঠের বন্দুক দিয়ে মুখে এমন জোরে মারলো যে ফনিন্দ্রের নাক ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে আরম্ভ করল।
সেজোজেঠা মশাই ধুতির আঁচল দিয়ে ফনিন্দ্রর মুখের রক্ত মুছিয়ে দিতেই আরেকজন সেজো জেঠামশাইকেও মাথায় মারলো। দাঁড়িয়ে থাকা অন্য রাজাকারেরা মুহুর্তেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট জেঠামশাই ও অন্য দুই জেঠাতো ভাইকে পিঠমোড়া করে বেঁধে ফেলল কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। সবাই বড় জেঠামশাইর দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে অথচ নির্বিকার বড় জেঠামশাই রাজাকারদেরকে প্রতিরোধ করার কোন নির্দেশই দিলেন না।
প্রায় বিনা প্রতিরোধেই সবল সক্ষম পাঁচজন মানুষকে ওরা বন্দুকের বাট আর লাথি মেরে মেরে হাত পা বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দিল। বাড়িতে থাকা ঠাকুরমা ও পিসিমা সবার চিৎকারে আর ঘরে লুকিয়ে থাকতে না পেরে বাড়ির উঠোনে চলে এলেন। আহত পাঁচজনের গোংরানির সাথে ঠাকুরমা ও পিসিমার চিৎকার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করলো।
বড় জেঠামশাই তখনো কালুর সাথে দেনদরবার করছেন যাতে ওরা আর কিছু না করে এখান থেকে চলে যায়। কালু কিছুতেই বাবাকে ছাড়া যাবে না। কালু বললো, স্যার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে। আপনি মিথ্যে কথা বলছেন।
বড় জেঠামশাই বললেন, বাড়িতে থাকলে কি এতোগুলো মানুষের আর্তচিৎকারের পরেও ও সামনে না এসে পারে? তুমি তোমার স্যারকে তো চেন।
কালু রাজাকার কিছুতেই বাবাকে না ধরে এমনি এমনি চলে যেতে রাজি না। অবশেষে বললো, আপনাকে ও এদের পাঁচজনকে ইউনিয়ন বোর্ডে নিয়ে যাব। মিলিটারি ভবানিপুর গেছে, আসতে সন্ধ্যা হবে। এর মধ্যে স্যার যদি ইউনিয়ন বোর্ড অফিসে না যায়, তবে আপনাদের সবাইকে মিলিটারির হাতে তুলে দেব।
বলেই কালু রাজাকার চোখ ইশারায় সবাইকে নৌকায় ওঠাতে নির্দেশ দিল। কালুর কথার সাথে সাথে অন্যান্য রাজাকারেরা টেনে হিচড়ে সবাইকে নৌকায় তুলতে লাগল। ঠাকুরমা-পিসিমা কালুর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা ভিক্ষা করছে। কিন্তু কালু রাজাকারের মন কিছুতেই নরম হলো না। ঠাকুরমা তার তিন ছেলে ও তিন নাতিকে বাঁচাতে ঘরের যা কিছু আছে সব কালুকে দিতে চাইলেও সেদিকে ওদের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এদিকে একে একে আহত সবাইকে টেনে হিঁচড়ে নৌকায় তোলা হলো। সবার শেষে বড় জেঠামশাই নিজে হেঁটে হেঁটেই নৌকার দিকে এগিয়ে গেল।
সবচেয়ে আহত ফনিন্দ্র ‘জল খাব” বলে কার্তস্বরে গোংড়াচ্ছে। একজন রাজাকারের দয়া হলো। কাছেই টিউবওয়েল থেকে নৌকায় থাকা মাটির পাত্র ভরে জল নিয়ে মুখে ঢেলে দিল।
ষাটোর্ধ বয়সের ঠাকুরমা ছেলে ও নাতিদেরকে রক্ষা করতে শেষ চেষ্টায় নিজেও নৌকায় উঠে বসলো। এক রাজাকার জোর করে ঠেলে-ধাক্কে বুড়িকে নৌকা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল কাদাজলের ভিতর। নৌকাটি সবাইকে নিয়ে বাড়ির ঘাট থেকে দূরে চলে যেতে লাগলো।
এদিকে আহত পাঁচজনের মধ্যে ফনিন্দ্রের অবস্থা খুবই খারাপ। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ে নৌকার পাটাতন ভেসে যাচ্ছে। অন্য চার জনের অবস্থাও ভাল মনে হলো না। নৌকার ভিতর এক নারকীয় অবস্থা। কালু রাজাকারের সংগে আসা অচেনা লোকগুলো নৌকার ছইয়ের উপরে পজিশন নিয়ে আছে যদি বাবার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী আক্রমন ক’রে বসে এ আশঙ্কায়। অথচ কোথাও কাউকে দেখা গেল না। ভরা বর্ষাকালের দুপুরের নিস্তব্ধতা বাড়ি থেকে ভেসে আসা ঠাকুরমা-পিসিমার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো।
নৌকা আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে। একটি পরিবারের এতগুলো মানুষের সমূহ মৃত্যু চিন্তায় বড় জেঠামশাই আতঙ্কগ্রস্থ হয়েও শেষ চেষ্টা করতে লাগলেন।
বড় জেঠামশাই কালুকে বললো, আর একটু পরেই হয়ত আমার ভাই-ভাতিজাদের অনেকেই মরে যাবে। কালু তুমি তো আমাকে জানো, শওকত চেয়ারম্যান আর আমি খুব ছোটবেলার বন্ধু। এক সাথে ইস্কুলে পড়েছি। শওকত আমার সাথে অন্তত এতখানি বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার বিশ্বাস হয় না। জানি না শওকত তোমাদের এ অপারেশনের কথা জানে কিনা? জানলে আমাদের বাড়ির পাঁচজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য তোমাদের পাঠাতো বলে আমার মনে হয় না।
কালু রাজাকার বড় জেঠামশাইয়ের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। বড় জেঠামশাই আবার বলতে শুরু করলেন, তার চেয়ে তুমি আমাদের ছেড়ে দাও।আমি কথা দিচ্ছি তুমি টাকা-পয়সা যা চাও, আমি একা একা তোমাকে দিয়ে আসবো। “তোমার স্যার” জানবে না। আর ও যাতে থানায় গিয়ে দেখা করে সে ব্যবস্থা আমি করবো।
কালু অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলো। ততক্ষণে নৌকা গ্রামের পুবদিকের খালের প্রায় মাঝামাঝি চলে এসেছে। আর একটু পরেই নিমাইবিলে পড়বে। কালু নৌকার পেছনের মাঝিকে ইশারা করলো। নৌকাটি আবার আমাদের বাড়ির ঘাটের দিকে রওনা হলো।
নৌকা ঘাটে ভিড়তেই আহত পাঁচজনকে চ্যাংদোলা করে নৌকা থেকে নামিয়ে দিয়ে নৌকাটি আবার খাল পেরিয়ে নিমাইবিলের দিকে চলে গেল।
বাড়িতে তখন আহত সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। বাবাও কচুরিপানার জংগল থেকে ভেজা শরীরে বাড়িতে উঠে এসেছে। ঠাকুরমা-পিসিমা ঘরে শুকিয়ে রাখা সাদা ধূতি ছিঁড়ে সবার ক্ষতস্থান জড়িয়ে দিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বাবা ও বড় জেঠামশাই সবাইকে বাঁচিয়ে রাখতে আপ্রান চেষ্টা করতে লাগলেন।
পাঁচজন আহত মানুষের আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়ে এলো। ভরা বর্ষার থই থই জলে কান্নার প্রতিধ্বনি যেন ভাদ্রমাসের গুমোট গরমকে আরও অসহ্য করে তুললো। রাজাকারের নৌকা চলে যেতে দেখে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে এলো। বহেরাতলি থেকে যে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের হাত বাড়াতে এগিয়ে আসার কথা ছিল বাবা ওদের না দেখে বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। জেঠামশাইয়ের বোকামির জন্যই যে প্রতিরোধ করা গেল না, সে কথাই আহত সবাই কান্নার সাথে সাথে বলতে লাগলেন। বাবাও নিজের পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তকে কিছুতেই মানতে পারছেন না।
এভাবেই দুপুর গড়িয়ে বিকেল। সন্ধ্যের দিকে বহেরাতলির মুসলমান পাড়া থেকে বড়মা সহ আমরা সবাই চলে এলাম। থানা সদরে আহতদের নেয়ার সাহসও কারো নেই। গ্রামের হোমিওপাথি ডাক্তার জিতেন বাবুর চিকিৎসার উপর নির্ভর করেই সেদিন রাত্রি কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
অনেকদিন পর পর্বটি পড়লাম
ভালো লাগলো ৷
‘চন্দ্রমুখী জানালা’পর্ব -পাঁচ পড়লাম ৷এই ঘটনা, এই ছবি অামার অনেক চেনা ৷অাচ্ছা,শওকত চেয়ারম্যানের ভূমিকা অাসলে কেমন ছিলো একাত্তরে ?বাইরে থেকেতো তাকে বেশ ভদ্র মনে হত ৷
‘চন্দ্রমুখী জানালা’ মুদ্রিত কপি হাতে পাবার অপেক্ষায় থাকলাম ৷
নিরন্তর শুভ কামনায়-
অাব্দুস সাত্তার
কবিতা নিলয়
পয়লা,তেরশ্রী
ঘিওর,মানিকগঞ্জ-১৮৪০
মোবা:০১৭২৬৩৬০৩০৩ ৷