আমার নাম মোঃ আশরাফুল আলম। Md. Ashraful Alam. বাংলায় বিসর্গ, আর ইংরেজীতে ডট। বাপের রাখা নাম। মোঃ এর পুর্ণ রুপ কেন দিল না, সেইটা কোন রহস্য না – আমার আমলে শতকরা ৫০ ভাগ বাঙালি মুসলমান ছেলের নামেই মোঃ থাকত। ইদানিং অবশ্য মোহাম্মদ, মুহাম্মদ, মুহাম্মাদ ও মুহম্মদ দেখি বেশি।

আমাদের আমলে একবার এই বিসর্গ আর ডট নিয়ে বিরাট এক সমস্যা দেখা দিল। বিসিএস এর প্রিলিমিনারী পরীক্ষা দিয়েছিলাম। পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় বৃত্ত ভরাট করতে গিয়ে এমডি এর পরে ডট পূরণ করব নাকি স্পেস দেব, সেই প্রশ্নের কোন সদুত্তর পাই নি কারো কাছে। সে বছরই এই সব কম্পিউটার প্রযুক্তি নতুন চালু হয়েছে পরীক্ষা পদ্ধতিতে। এমসিকিউ পরীক্ষার খাতাও নাকি দেখা হবে কম্পিউটারে। আমরা বেশ ভয়ে ভয়ে আছি। রেজাল্ট হওয়ার আগে গুজব শোনা গেল, যারা নামের এমডি’র পরে ডট পূরণ করেছে, তারা নাকি কম্পিউটারের ডাটাবেজ থেকে বাদ পড়ে যাবে, অর্থাৎ তাদের খাতা দেখাই হবে না। এই ডটের কারণে নাকি কম্পিউটারের লজিক উলটাপালটা হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি। রেজাল্ট হওয়ার পরে দেখা গেল, সে সব নিছক গুজব ছিল। তবে আমাদের নামের মধ্যে বিসর্গ বা ডটের উপদ্রব নিয়ে বেশ মানসিক অশান্তিতে ছিলাম কয়েক সপ্তাহ।

প্রবাসে এসে ইদানিং অশান্তি বেড়েছে। অনেকেই জিজ্ঞেস করে, এমডি মানে কি ডক্টর অফ মেডিসিন? না, আমার বাপের জন্মে কেউ মেডিসিন পড়ে নি, কিন্তু কে শোনে কার কথা? একবার ইন্টারপ্রেটিং করতে গেলাম। কর্তব্যরত অফিসার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন তার দুই মক্কেলের সাথে, দিস ইজ এমডি, এন্ড দিস ইজ এমএসটি। যারা ভুলে গেছেন, এমএসটি মানে মোসাম্মাত। অনেকের নামে এমএসটি আকারেই থাকত। এমএসটি এক্রোনিমের আসল অর্থ আমার আজো জানা হয় নি।

তুরুষ্কের বা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানেরা আমার নাম দেখেই সালাম দিয়ে বসে। ব্রাদার বলে কাছে ডাকে, নামাজে ডাকে। তাদেরকে আশাহত করতে হয়। তবে ওরা তার চেয়ে বেশী আশাহত হয় আমাদের ভারতীয়দের নামে মোহাম্মদের পূর্ণরুপ না দেখে। ওদের দেশে মোহাম্মদ শব্দটা নামের আগে বসানো কোন অলংকার নয়, মোহাম্মদ একটা প্রপার নাউন। মানুষের নাম। এমডি লেখা নাকি রাসুলের জন্য অসন্মানের ব্যাপার। হতেও পারে। আমার নাম রাখার সময় রাসুলের সন্মান বিবেচনা করা হয়েছিল কি না তা আজ আর জানার উপায় নেই।

পশ্চিমা দুনিয়ায়, বিশেষ করে ইংরেজী-ভাষী দেশগুলিতে, মানুষের নামের প্রথম অংশ ও শেষ অংশ আলাদা আলাদা কাজে ব্যবহ্রত হয়। বাংলাদেশে কারো নাম মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম / রফিকুল ইসলাম হলে তাকে সবাই রফিকুল বলে ডাকবে, আবার কারো নাম মোহাম্মাদ রফিক হলে তাকে রফিক বলে ডাকবে। অর্থাৎ নামের প্রথম, মধ্য অথবা শেষ, যে কোন অংশ ধরেই ডাকা হতে পারে, তার নামের উপরে নির্ভর করে। পশ্চিমে মানুষ একে অপরকে নামের প্রথম অংশ ধরে ডাকে, মোটামুটি বড় রকমের ব্যতিক্রম ছাড়া। এই রকম একটি ব্যতিক্রম হল, খুব সন্মানিত কাউকে তার নামের শেষাংশ দিয়ে ডাকা যায়, তবে তার আগে সন্মানসুচক মিস্টার/মিসেস লাগাতে হয়। যেমন, বারাক হুসেইন ওবামাকে তার বন্ধুরা বারাক বলে ডাকবে, কিন্তু মিডিয়াতে অথবা হোয়াইট হাউসের কলীগেরা তাকে মিস্টার ওবামা বলে সম্বোধন করবে। এর ফলে আমাদের দেশের মানুষেরা দেশের বাইরে এলে অনেকেই নাম নিয়ে বিড়ম্বনাতে পড়েন। যার নাম কাজী মকবুল হোসেন, তাকে সবাই বলে কাজী; যার নাম মোহাম্মদ রকিবুল ইসলাম, তাকে সবাই বলে মোহাম্মদ। আসল নাম ঢাকা পড়ে যায় সম্বোধন ও নামকরনের এই নতুন তরিকার পাল্লায় পড়ে। খুশবন্ত সিং এই নিয়ে লিখেছিলেনঃ “লন্ডনে একবার এক ফিরিঙ্গী আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি বলেছিলাম, আমার নাম সিং। সেই ফিরিঙ্গী খুশী হয়ে বলল, নাইস টু মিট ইউ। আমি ভারতে গেলে আপনার সঙ্গে দেখা করব, মিস্টার সিং। ভালো কথা। তবে ওই বেটা ফিরিঙ্গী তো আর জানে না যে, ভারতে কমপক্ষে ৫০ মিলিয়ন মানুষের নাম সিং। কাজেই, আমাকে খুঁজে পাওয়া ওর পক্ষে দুস্কর”। এই প্রবাসে আসার পর আমার ক্ষেত্রেও ওই একই অবস্থা। আমার পিত্রদত্ত নাম হল মোঃ আশরাফুল আলম, কিন্তু সবাই আমাকে ডাকে এমডি বলে। আমি বলি, এই নাম তো আর আমার একার নয়, বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে ৮ কোটি হল পুরুষ, যার মধ্যে ৭ কোটিই হল মুসলমান, এবং তাদের কমপক্ষে ২-৩ কোটি মানুষের নামেই এমডি বা মোহাম্মদ শব্দটা আছে।

একবার আমি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে এক সরকারী অফিসে গেলাম একটা কাজের জন্য। আমরা দুইজনেই আমাদের কাগজপত্র জমা দিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। ঘটনাক্রমে, আমার ওই বন্ধুর নামও আমার নামের মতই, মোঃ রফিকুল আলম, অর্থাৎ একই ফার্স্ট নেম ও লাস্ট নেম। আমাদের দুজনেরই নাম মোঃ আলম, অফিসিয়াল সব কাগজ-পত্রে। যখন কাউন্টার থেকে ডাকা হল, এমডি আলম, আমরা দুইজনেই এগিয়ে গেলাম। পরে ওই কর্মকর্তাকে আমাদের দেশীয় নামকরনের উপরে একটা লেকচার দিতে হয়েছিল এই ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য। ভাবুন একবার, নামে কত কিছু আসে যায়!

আমার দুই ছেলের জন্ম বাংলাদেশে। এই প্রবাসে এসে আবার ওদের নাম নিয়ে ঝামেলায় পড়লাম। আমাদের দেশে অনেকের নাম শুরু হয় পদবী দিয়ে, যেমন সৈয়দ আলী আশরাফ, শেখ হাসিনা, খন্দকার হাসান মাহমুদ ইত্যাদি। হাসান মাহমুদ খন্দকারের চেয়ে খন্দকার হাসান মাহমুদ একটু বেশী ফ্যাশনেবল, অন্তত আজকালকার মানদন্ডে। সেই সুত্র ধরে আমার যমজ ছেলেদের নামেও খন্দকারটা রেখেছি প্রথমেই, খন্দকার ফাইয়াজ তানজীম ও খন্দকার সাদাত তানবীর। এই দেশে আসার পরে এক কলীগ আমাকে বলল, তোমার ছেলেদের গার্লফ্রেন্ডেরা খুব বিপদে পড়বে, কোন খন্দকারকে খুঁজতে গিয়ে কোন খন্দকারকে পাবে তা বুঝতে পারবে না। চেহারাও প্রায় একই রকমের। নামটাও যদি এক হয়, তাহলে তো মহা মুসিবত। ছেলেরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগেই ওদের নাম পাল্টাতে হবে। হাজার হোক, ছেলেদের গার্লফ্রেন্ডদেরকে তো আর বিপদে পড়তে দেওয়া যায় না!

কৌতুক রেখে কাজের কথায় আসি। আমাকে অনেকে বলেন, ধর্মকর্ম করেন না, কিন্তু নাম তো মুসলমানের বাচ্চার মত! আমি বলি, আমার বাপ তো ভবিষ্যত দেখতে পারতেন না। তাছাড়া, আপনাদের নবীর নাম যদি ইসলামের আগেই রাখা হয়ে থাকে, এমনকি বেশিরভাগ সাহাবীর আইয়ামে জাহেলিয়াতের নামই ইসলামের আমলেও বহাল থাকে, তাহলে আমি আর দোষটা করলাম কোথায়? আত্নপক্ষ সমর্থন করতে উদাহরণ দেই, সাদ্দামের আমলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারেক আজিজ ছিল ক্যাথলিক খ্রীস্টান। কিম্বা লেবানন-মিশরে আশরাফ নামের অনেক অমুসলিম আছে। তাতে আমার দূর্নাম আরো বাড়ে ধার্মিক বুজুর্গ মহলে।

নামে যে কিছু আসে যায় না, সে কথায় কারো দ্বিমত না থাকলেও একটা সুন্দর ও অর্থবোধক নাম সবাই পছন্দ করেন। গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক, তা আগের মতই সুরভী ছড়াবে, যদিও এই যুক্তি গোলাপের নামের সৌন্দর্য্যকে অস্বীকার করে না কিংবা সুন্দর নামকে অপ্রয়োজনীয়ও মনে করে না – সুন্দর সুরভীর পাশাপাশি সুন্দর একটা নাম থাকলে ক্ষতি কি? অনেকে অবশ্য মনে করেন যে ‘কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন’ রাখাটা একটা বাড়াবাড়ি, তবে তারা ভুলে যান যে কানা ছেলের নাম ‘কানাবাবু’ রাখাটা আরো বেশি রকমের বাড়াবাড়ি। চোখ না থাকুক, অন্ততঃ একটা সুন্দর নাম থাকতে তো বাধা নাই।

নামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট হল যে, এটা কোন বস্তুর নিজস্ব গুন নয়, এটা বাইরে থেকে আরোপিত। এ পৃথিবীতে অবস্থিত সকল প্রকার বস্তুর একটা নাম আছে। নামবিহীন কোন কিছু কল্পনা করা যায় না – কঠিন, তরল বা বায়বীয় যাই হোক না কেন। মানুষ যখন থেকে বুঝতে শিখেছে এবং ভাষার ব্যবহার আয়ত্ব করেছে, তখন থেকেই তারা আশেপাশের সবকিছুকে নাম দিয়েছে, কারন নাম ছাড়া কোন কিছুর অস্তিত্বকে বর্ননা করা যায় না। এই নামগুলো ভাষার কারসাজি – আর তাই একই জিনিসের নাম হাজার ভাষায় হাজারো রকমের। আমরা বলি ‘ভালোবাসা’, ভারতীয়রা/পাকিস্তানীরা বলে ইশক, ইংরেজরা বলে লাভ, ইতালিয়ানরা বলে ‘আমোর বা আমো’। আবার, আমাদের ভাষায় যাকে আমরা পাহাড় বলি, তাকে যদি নদী বলতাম, আর নদীকে পাহাড় বলতাম, তাতে এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। তখন হয়তো বলতে হত ‘পাহাড়ে বান ডেকেছে’ অথবা ‘গারো নদীতে বাস করে উপজাতীয়রা’ – পার্থক্য বলতে এইটুকুই। এখন বলি ‘পাহাড়সম বাধা’, তখন বলতাম ‘নদীসম বাধা’। তবে মজার ব্যাপার হল, নাম আদতে আলগা জিনিস হলেও সময়ের সাথে সাথে তা বস্তুর উপরে স্থায়িত্ব পেতে থাকে, ফলে তাকে সহজে বদলানো যায় না। সমাজে যে নাম প্রচলিত হয়ে যায়, তার একটা সহজাত অর্থ এবং ব্যঞ্জনা ভাষায় স্থান লাভ করে, ফলে তাকে বদলানো ভয়ানক কঠিন। পাহাড়কে নদী আর নদীকে পাহাড় বললে ক্ষতি নেই, তবে তা আজ প্রায় অসম্ভব। শুরুতে যা ছিল আরোপিত, আজ তা ঐ বস্তুগুলির সুনির্দিষ্ট পরিচয় বহন করে। হাজার বছর ধরে আমরা যা বলে আসছি, তাকে উপেক্ষা করে আমি যদি আজ লিখি ‘বর্ষার পানিতে পাহাড়ের দুকুল উপচে পরছে’ তাহলে সবাই ভাববে আমি হয়তো পাগল নয়তো ভাষায় নিতান্তই অপটু।

নামের মাহাত্ন্য এখানেই। নাম আরোপিত, তবে তা একবার আরোপ করা হয়ে গেলে হয়ে যায় স্থায়ী, আর সেই নামেই সবাই তাকে চেনে। মানুষের নামের বেলায়ও এটা শতভাগ প্রযোজ্য। কাজেই, নামকরন ব্যাপারটা বেশ গুরুত্ব বহন করে, বলা বাহুল্য।

যুগে যুগে মানুষ তাদের নবজাতকের নাম রেখেছে কিছু সাধারন নিয়ম অনুসরন করে, যেমন তাদের প্রিয় মানুষের নামে, অথবা সেই যুগের বা আগের যুগের কোন মহান ব্যক্তিত্বের নামে, অথবা ধর্মীয় সাধুপুরুষদের নামে, অথবা তাদের নিজেদের ভাষার কোন অর্থপুর্ন শব্দ থেকে। এর ব্যতিক্রমও প্রচুর। তবে এই সাধারন নিয়মের প্রতিফলন আমরা দেখি আজকের দুনিয়ায় – নাম শুনেই আমরা বলতে পারি কে জাপানিজ, কে ভারতীয়, কে জার্মান আর কে আফ্রিকান। তবে ধর্মের সঙ্গে নামকরনের একটা সম্পর্ক থাকায়, একই নাম সুদানের মুসলমান অথবা বাংলাদেশের মুসলমান উভয়েই গ্রহন করতে পারেন। একইভাবে, সংস্কৃত নাম যেমন ভারতীয় হিন্দু বুঝাতে পারে, তেমনি বাংলাদেশি বা পাকিস্তানী মুসলমানও বুঝাতে পারে, কারন এই তিনটি দেশের ধর্ম আলাদা হলেও এদের ভাষা (হিন্দি, উর্দু ও বাংলা) সংস্কৃত থেকে উদ্ভুত। আবার, ফিলিপাইন দীর্ঘদিন স্পেনের উপনিবেশ ছিল বলে সেখানে অনেকে তাদের ছেলেমেয়েদের স্প্যানিশ নাম রাখতো। দক্ষিন ভারতে ব্রিটিশ শাসনামলে খ্রীস্টান মিশনারীদের অনেক ততপরতা থাকায় ওখানে অনেক মানুষ খ্রীস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়, এবং তাদের মত করে সন্তানদের নামকরন করতে থাকে। আজকে সেখানে রাহুল রোজারিও, বেলা জর্জ, অরবিন্দ ডি সিলভা কিংবা প্রবীন ফার্নান্ডেজ ধরনের নাম বহুল প্রচলিত।

খ্রীস্ট ধর্মে নামকরনের সময় প্রাচীন সাধুপুরুষদের নাম বহুল ব্যবহ্রত, যেমন মাইকেল, ডেভিড, আব্রাহাম, জোসুয়া ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে ব্যবহার হয় আল্লাহ ও নবী-রাসুলদের গুনবাচক নাম – যেমন আহম্মেদ, মোহাম্মদ, আব্দুল মালেক, আব্দুল খালেক, ইত্যাদি। আবার, প্রাচীন আরবে সমাজ ছিল পিত্রতান্ত্রিক, যেখানে সন্তানের মাতার পরিচয় ছিল গৌন। পিতার পরিচয়েই সন্তানেরা সমাজে পরিচিত হত, আর তাই সন্তানের নামের সঙ্গে পিতার নাম জুড়ে দিয়ে নামকরনের প্রথা ছিল সেখানে। উদাহরনঃ উমর ইবনে আব্দুল খাত্তাব, অর্থাৎ আব্দুল খাত্তাবের পুত্র উমর। হিন্দু ধর্মে নামকরন হত দেব-দেবীর নামে অথবা অর্থপূর্ণ শব্দ দিয়ে, তবে তা ছিল সমাজের বর্নভেদ প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে সেগুলো মানতে বাধ্য করা হত সবাইকে। এই ব্যাপারে সাম্প্রতিক বাংলা কথাসাহিত্যের শক্তিমান পুরুষ, নিম্ন-বর্গীয় হিন্দু বংশোদ্ভুত, জনাব হরিশংকর জলদাসের আত্নকথা ‘কৈবর্তকথা’ থেকে তার নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরা যায়ঃ

“আচারনির্ভর হিন্দু সমাজের সংবিধান হল মনুসংহিতা, যে গ্রন্থে ঋষি মনু শিশুদের নামকরণের ক্ষেত্রে কড়া নির্দেশ জারি করেছেনঃ ব্রাহ্মণসন্তানের নাম হবে মঙ্গলবাচক, বৈশ্যের ধনজ্ঞাপক, ক্ষত্রিয়ের বলসূচক এবং শুদ্রসন্তানের নাম হবে ঘৃণাজনক। এই নির্দেশানুসারে আমার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘কফ জলদাস’ অথবা ‘বিষ্ঠা কৈবর্ত্য’। কিন্তু আমার বাবা সন্তানের নাম রাখতে গিয়ে বিদ্রোহী হলেন। তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রাখলেন হরিশংকর অর্থাৎ ব্রাহ্মণ সন্তানের নামের সমতুল্য নাম রাখলেন তিনি। তাঁর বাবা চন্দ্রমণিও মহাভারতের বিশিষ্ট ক্ষত্রিয় চরিত্রের নাম অনুসারে তাঁর একমাত্র সন্তানের নাম রেখেছিলেন যুধিষ্ঠির। এটা হিন্দু সংবিধানবহির্ভূত সিদ্ধান্ত। এইভাবেই এই জেলে পরিবারটি ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের কথা জানিয়ে দিয়েছিল প্রায় এক শতাব্দী আগে।“

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নাটক-উপন্যাস-ছোটগল্পে চরিত্রদের নামকরন করতেন রুচিপূর্ণ ও সুন্দরভাবে, যেকারনে এই নামগুলো বাঙ্গালীসমাজে প্রচন্ড রকমের জনপ্রিয়। ধর্ম নির্বিশেষে আজকে আপনি লাবন্য, প্রভা, সুনয়না, বৈশাখী, সৌরভ, সুরভী, কৃষ্ণকলি, সবিতা, শুভ্রা, সেঁজুতি, সুজাতা এই নামগুলি বাংলাদেশে ও পশ্চিম বাংলায় খুঁজে পাবেন। কলকাতায় অনেক মানুষ তাদের সন্তানের জন্মের পরে কবিগুরুর দ্বারস্থ হতেন শিশুর নামকরনের জন্য। সাধারন মানুষতো বটেই, এমনকি ততকালীন সরকারও তার দ্বারস্থ হয়েছিলেন কলকাতা বেতার ও টেলিভিশনের আনুষ্ঠানিক নামকরনের জন্য। কবিগুরু কলকাতা বেতারের নাম দিলেন আকাশবানী, আর টেলিভিশনের নাম দিলেন দূরদর্শন। পরবর্তীতে দূরদর্শন শব্দটি অল-ইন্ডিয়া টেলিভিশনের নাম হিশেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

শেষের কবিতা উপন্যাসে নাম নিয়ে একটা মজার ধারনা এসেছে। নায়ক ‘অমিত রায়’ সমকালীন ফ্যাশনে নামটাকে একটু পালটিয়ে ‘অমিত রে’ করেছিল, এবং এর ব্যাখ্যা হিশেবে বলেছিল যে, নাম যত ছোট হবে, অন্যদের মনের গভীরে সেটা ততই ত্বরিত গতিতে প্রবেশ করবে। বস্তুর ভর কম হলে, যদি ভরবেগ একই থাকে, বেগ বেশী হওয়াটাই স্বাভাবিক। আকাট্য যুক্তি। আজকে আমরা যে আদর করে হুমায়রাকে বলি হুমা, ক্রিস্টোফারকে বলি ক্রিস, জোহরাকে বলি জোহু,মাশরাফীকে বলি ম্যাশ, আর শাবনাজকে বলি শাবা বা শাবু, সেটা এই নামের আপেক্ষিকতারই প্রতিফলন।

মুসলিম সমাজে জন্মানো প্রত্যেক শিশুর নামকরনের বেলায় অর্থপূর্ণ এবং শ্রুতিমধুর নাম রাখা প্রতিটি অভিভাবকের ধর্মীয় কর্তব্য। সুন্দর নাম রাখা মা-বাবার নিকট শিশুর প্রাপ্য অধিকার। হযরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাঃ)বলেছেন, “পিতার উপর নবজাতকের হক হলো তার জন্য সুন্দর নাম রাখা” (মুসলিম শরীফ)। আবু হুরাইরা নামের অর্থ অবশ্য বিড়ালের পিতা। প্লিজ হাসবেন না।

কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে গিয়ে মুসলমানরা কিছু ভুল করে ফেলছেন। লক্ষ্য করা গেছে যে অনেকেই সন্তানের নাম রাখার সময় আল্লাহতায়ালার পবিত্র নাম সমূহের সাথে মিলিয়ে রাখেন। যেমন-আব্দুল খালেক, রিয়াজ বিন খালেক ইত্যাদি। এখানে ‘খালেক’ নামটি আল্লাহতায়ালার পবিত্র নামসমূহের একটি।‘খালেক’ নামের অর্থ হচ্ছে ‘স্রষ্টা’ এবং আল্লাহতায়ালাই এই নামের অধি্কারী হতে পারেন, অন্য কেউ হতে পারে না। সেক্ষেত্রে একজন মুসলমানের নাম আব্দুল খালেক অর্থাৎ ‘স্রষ্টা বা সৃষ্টিকর্তার চাকর বা বান্দা’ হওয়াটাই শ্রেয়। রিয়াজ বিন খালেক অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার পুত্র রিয়াজ হতে পারে না। আবার আমরা নাম রাখলাম ঠিকই আব্দুল খালেক, অথচ ডাকার সময় ডাকলাম ‘খালেক সাহেব’ বা ‘খালেক ভাই’। প্রতি উত্তরে যিনি আব্দুল খালেক তিনিও খালেক সাহেব বা ভাই বলে তাকে ডাক দেওয়ায় কথপোকথন চালিয়ে যান। কিন্তু কোনো ব্যক্তি কি ‘খালেক’ হওয়ার উপযোগী? ইসলামের দৃষ্টিতে তো কখনোই নয়।

আরবী নামের ক্ষেত্রে আবার গ্রামারের গ্যাঁড়াকলে পড়ে নাম বা নামের অর্থ বিকৃত হতে পারে। আশরাফুল আলম এর অর্থ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ, কিন্তু এই নামের আসল রুপ হল আশরাফ-উল-আলম। ‘উল’ হল কঞ্জাংশান। কাজেই, শুধু ‘আশরাফুল’ শব্দটা পূর্নাঙ্গ নয় (আশরাফুল মানে best of … …, যেখানে প্রশ্ন জাগে, best of / best amongst what?), আশরাফ বা আশরাফুল-আলম বললেই কেবল সেটা অর্থবোধক হতে পারে। রফিকুল ইসলাম / হামিদুল ইসলাম জাতীয় সকল নামের ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য। হয় রফিক, নয় রফিকুল ইসলাম, কিন্তু রফিকুল অর্থহীন।

আজকের দুনিয়ায় নাম মানুষের পরিচয় বহন করে। নাম দিয়ে অনেক সময় মানুষের ভাষিক পরিচয়, ধর্ম, এমনকি জাতীয়তাও জানা যেতে পারে। এই নামগুল একটু পরখ করে দেখুনঃ তাকাশিগো মুরাকাশি, চ্যাং জুন লাই, আলবার্তো রোমারিও, মোহাম্মাদ মুবাশশের আহমেদ, ইন্দ্রমোহন কৃষ্ণমুর্তি, মাইকেল জ্যাকসন, গ্রায়েম স্মিথ, আবু সুফিয়ান ইবনে কুরাইশ, পিটার ভন ডি বোরেন, এনকালা মুগাবে, শেখ জাওয়াহিরি আল মাহমুদ ইবনে আব্দুল আজিজ মাশায়েখ, সের্গেই নোব্রাভস্কি। আশা করি বিষয়টা ধরতে পেরেছেন। তবে নিয়ম যেখানে আছে, ব্যতিক্রমও সেখানে আছে। একসময় পিত্রতান্ত্রিক সমাজে সন্তানকে পিতার পরিচয়ে পরিচিত করার জন্য সন্তানের নামের শেষে পিতার নামের একটা অংশ জুড়ে দেওয়া হত, এবং বংশ-পরস্পরায় তা চলতে থাকতো। এভাবে ফ্যামিলী নামের প্রথা চালু হয়। আবার অনেক পরিবার রাজ-রাজড়াদের আনুকুল্যে কোন সন্মানসুচক পদবী পেলে তা বংশ-পরস্পরায় ব্যাবহার করা হত। অনেক সময় জন্মস্থানকেও পরিচয়সুচক পদবী হিসেবে ব্যবহার করা হত, ফলে পরে তা ফ্যামিলী নেম-এ রুপান্তরিত হত, যেমন রাবেয়া বাসরী – ইরাকের বসরার অধিবাসী, আব্দুল কাদির জীলানি – পারস্যের জীলানের অধিবাসী, জওহরলাল নেহরু (নেহরু অর্থ নদীপাড়ের বাসিন্দা। নেহেরুর দাদা কাশ্মীর থেকে দিল্লীতে মাইগ্রেশন করে এলে তাদেরকে বলা হত ‘কাশ্মীরের নদীর পাড় থেকে আসা’ তথা নেহেরী, এবং কালক্রমে নেহেরু, সবশেষে নেহরু)। আজকাল আর এই ব্যাপারটা ততটা মানা হয় না, তবে অনেকেই এখনও অনেকটা গর্বের সঙ্গে তাদের বংশ-পদবী ব্যবহার করে থাকেন। বাংলাদেশ/ভারতে এই পদবী অনেক সময় সামাজিক অবস্থানের পরিচয়জ্ঞাপক। তালুকদার মানে ছোট জমিদার, সৈয়দ মানে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা খানদানী মুসলিম বংশের লোক (অনেকে বলেন, সৈয়দরা কুরাইশদের বংশধর), মন্ডল মানে মাতব্বর বা গ্রামের অভভাবক-স্থানীয়, ভট্টাচার্য্য বা চৌধুরীরা অভিজাত, জলদাস/ফকিররা নিচুজাত। পেশা থেকেও পদবী হতে পারে, যেমন দুকানওয়ালা, লোখন্ডওয়ালা (লৌহ খন্ড ওয়ালা অর্থাৎ লোহার কারবারি), ঝুনঝুনিওয়ালা, পাতর (জেলে বা জলদাস) ইত্যাদি। প্রায় দুহাজার বছর আগে যীশুখ্রিস্ট যাকে সর্বপ্রথম খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তাঁর নাম ছিল পিটার। পিটার ছিলেন মৎসজীবী। পরবর্তীকালে সেই খিস্ট্রধর্মালম্বী ব্রিটিশরা এদেশে পেশাভিত্তিক আদমশুমারি করার সময় বাউরি, চর্মকার, জেলে, মেথর প্রভৃতিকে তফসিলি জাতির অন্তর্ভুক্ত করেছিল। এই সময় ব্রিটিশরা জেলেদের পদবি লিখল-পিটার। ‘পিটার’ শব্দটি পরে অপভ্রংশ হয়ে ‘পাতর’ এ রূপান্তরিত হলো। ব্রিটিশ আমলের জেলেদের জায়গা-জমির দলিলে ‘পাতর’ পদবির সন্ধান মেলে। যেমন : চন্দ্রমনি পাতর, যুধিষ্টির পাতর।

আল্লাহর ৯৯ নাম গুনবাচক নাম। এই সবগুলো নাম ইসলামপূর্ব যুগে পৌত্তলিক দেবতাদের গুনবাচক নাম হিসাবে এই নামগুলোর ব্যবহার হয়ে থাকত। কেউ কেউ ১০১ নামের কথাও বলেন। প্রাচীন কালে একটা বিশ্বাস ছিল যে আল্লাহ বেজোড় সংখ্যা পছন্দ করেন। এই বিশ্বাসটি খুব সম্ভবত প্রাচীন পারস্য থেকে পাওয়া। পারস্যের জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মাবলম্বিরা তাদের খোদা আহুরা মাজদা’র ১০১টি গুনবাচক নামের লিস্ট বানিয়েছিল। খুব সম্ভবত প্রি ইসলামিক আরব নয়, বরং প্রি ইসলামিক পারস্যের ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবেই ইসলামে আল্লাহর ৯৯টি নামের লিস্ট প্রচলিত হয়েছিল। আব্দুল গাফফার চৌধুরী নিউ ইয়র্কে যা বলেছেন সেটা কোন বক্তৃতাবাজী না, একটা একাডেমিক তথ্য। বাঙালির জাতীয়তা, পরিচয়ের সংকট, ভাষার ব্যবহার, ইত্যাদির অতীত বর্তমান ও বিকাশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তাকে এগুলো বলতেই হত।

তিনি না বললেও অবশ্য আবু হুরায়রা মানে বিড়ালের পিতাই হবে, আর আবু বকর মানে গাভীর পিতা কিম্বা ছাগলের পিতাই থেকে যাবে। আবদুল গাফফার চৌধুরী ভুল কিছু বলেননি বা নতুন কিছুও বলেননি। এর কিছুই ইসলামের ইতিহাসের পাঠকদের অজানা নয়। আরবিতে ইসলামপূর্ব নাম বা অন্যান্য শব্দই ইসলামি টেক্সটগুলিতে ব্যাবহার হয়েছে। শব্দের কোন ধর্ম নাই এবং শব্দের ধর্মান্তরও হয়না। জল আর পানি নিয়ে যে রাজনীতি, তা কেবল একটা অতিমূর্খ ধর্মান্ধ জনগোষ্ঠীকেই মানায়।

নামের কারনে মানুষ সমাজে নন্দিত বা নিন্দিত হতে পারে, আর সেই কারনে নাম পরিবর্তন করে সমাজের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার অথবা এ থেকে সুবিধা আদায়ের প্রবনতা চালু আছে ইতিহাসের আদিকাল থেকেই। আমেরিকায় যাওয়া অভিবাসীদের দ্বিতীয় বা তত-পরবর্তী প্রজন্মের উপরে চালিত এক গবেষনায় এই ধারার ইম্পিরিক্যাল তথা তথ্য-ভিত্তিক প্রমান মিলেছে। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাস্থ অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক প্রফেসর গবেষনা করেছেন সেদেশের কাজের ক্ষেত্রে্ অর্থাৎ কিনা জব-মার্কেটে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের নামের কোন প্রভাব আছে কি না তা নিয়ে। চমকপ্রদ ফলাফল পেয়েছেন তিনি। তিনি একই দরখাস্ত অনেক কপি করেছিলেন বিভিন্ন রকমের নাম দিয়ে, আর তারপরে সেই দরখাস্তগুলো দিয়ে একই চাকুরীর জন্য আবেদন করেছিলেন। দেখা গেল, ইঙ্গ-মার্কিন নামধারী চাকুরীপ্রার্থীরা অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছেন, অথচ ইতালীয়ান/গ্রীক/চীনা/ভারতীয়/আফ্রিকানরা সাড়া পাচ্ছেন অনেক কম। এই পরবর্তী দলের মধ্যে আবার ইতালিয়ানরা ও গ্রীকরা সাড়া পাচ্ছেন তুলনামুলকভাবে বেশি, চীনারা আর একটু কম, আর ভারতীয়/আফ্রিকানরা সবচেয়ে কম। উক্ত গবেষনায় আবার অস্ট্রেলিয়ায় এই বিভিন্ন দেশের মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে এই চাকুরীর আবেদনের সাড়া পাওয়া-না পাওয়ার ধনাত্নক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। সেটা স্বাভাবিক, বলাই বাহুল্য।

অতি সম্প্রতি, বিন-লাদেন ইফেক্টের কারনে, পশ্চিমা দুনিয়ায় খাঁটি আরবী নাম আবার এক ধরনের বিড়ম্বনার সুত্রপাত ঘটাচ্ছে। শুধু নাম নয়, এর সঙ্গে বেশভুষা এবং শারীরিক কিছু বৈশিষ্ট (যেমন লম্বা দাড়ি রাখা) এক ধরনের সন্দেহবাদীদের কাছে সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা দুঃখজনক। এর চেয়ে বড় কথা হল, আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডা-ব্রিটেনের মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের পরবর্তী প্রজন্মের নামকরনের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা যে মাথায় রাখবে, সেটা নিশ্চিত। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে বলে কথা! অনেক বাংলাদেশী প্রবাসীরা ছেলেমেয়ের নাম রাখছেন এইসব বাস্তবতা মাথায় রেখে – সেখানে আবু/ইবনে কিম্বা এমডি/মোহাম্মদ অনুপস্থিত। কাজেই, নামে হয়তোবা কিছুটা হলেও এসে যায়!