শৈশব থেকেই দূষিত মতদীক্ষায় ( Childhood Indoctrination) গড়ে ওঠা শিশু, সে নারী হোক বা পুরুষ, যতক্ষণ বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে সচেতন চিন্তা করতে না শিখছে, ততোক্ষণ সে ভ্রান্ত ভাবে ধর্মমোহের শেকলেই আবদ্ধ। সদ্যজন্ম নেয়া নির্মল, নিষ্কলুষ, শুদ্ধ শিশুটিও ভবিষ্যতে হয়ে উঠতে পারে একজন ধর্মান্ধ খুনিতে, অথবা হতে পারে কল্যাণকামী একজন অসাধারণ মানুষে; পুরোটাই নির্ভর করছে সে বিজ্ঞানমনস্ক, কল্যাণকামী ও সচেতন চিন্তা করতে শিখছে কি না, সেই সুযোগের উপরে।
সম্ভাবনার বিচারে বাংলাদেশের মত একটি ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক সমাজে সে সুযোগ কি আমরা তাকে দেব, না কি নিজ মত চাপিয়ে দেব তার উপর? তাকে কলুষিত করে তুলব কল্পিত খেলাফতের অলীক স্বপ্নে, গড়ে তুলব দুষিত চিন্তা ও চেতনায়?
যদিও ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ পৃথিবীর অনেক দেশেই ইতিমধ্যে ব্যর্থ হয়েছে ও হচ্ছে এবং এর অনিবার্য পতন প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও একটি অতীতমুখী, সর্বাত্মকবাদী, ইসলামো-ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের ধারনাটিকে সমর্থন চিন্তাই যে প্রবল অন্যায় ও বমনোদ্রেককারী বিষয়, সেটি বুঝবার মত বুদ্ধি অধিকাংশ মডারেট মুসলমানের ঘটে নেই।
রাজনৈতিক ইসলাম কেন আজও বিলুপ্ত হচ্ছেনা, তার নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষিত আছে। সংক্ষিপ্ত আকারে বললে মুলত তিনটি কারনে,
১/ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট (geo political, geo strategy, perception management),
২/ অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ( globalization of capitalism, neo-colonialism, corporatism) এবং
৩/ সামাজিক প্রেক্ষাপট, যাতে প্রতিটি মুসলমান শিশু শৈশব থেকেই দূষিত মতদীক্ষায় (Childhood Indoctrination) গড়ে ওঠে।
রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের মোকাবেলা একটি চলমান প্রক্রিয়া কিন্তু সামাজিক প্রেক্ষাপটটি দ্রুত পরিবর্তন করা সম্ভব, বিজ্ঞানমনস্কতা দিয়েই।
“তোমরা তোমাদের সন্তানগণকে সাত বছর বয়স হলে নামাযের জন্যে আদেশ করো। নামায না পড়লে দশ বছর বয়সের সময় প্রহর করো। এ বয়সে পৌছলেই তাদের শয্যা পৃথক করে দাও।” এমন হাদিস বিদ্যমান ।
নবী এমনটাও বলেছেন, তোমাদের কেউ মু’মিন হতে পারবে না, যতক্ষন না আমি তার কাছে তার পিতা, সন্তান ও সব মানুষের চেয়ে বেশি প্রিয় হই।
এই ধর্মমোহের মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু, সে নারী হোক বা পুরুষ, যতক্ষণ বিজ্ঞানমনস্ক ভাবে সচেতন চিন্তা করতে না শিখছে, ততোক্ষণ সে ভ্রান্ত ভাবে ধর্মীয় অন্ধত্বের শেকলেই আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। পরিনত হয় ধর্মান্ধ খুনি মুসলমানে বা পরিনত হয় তথাকথিত মডারেট বা মধ্যপন্থী মুসলমানে, যারা ইনিয়ে বিনিয়ে নানা কুযুক্তিতে রাজনৈতিক ইসলামকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।
ইসলামের অতি প্রাচীন এবং বাতিল যোগ্য ভ্রান্ত ধারনাগুলোর সাথে আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মননের মিল নেই বলেই এই মডারেট মুসলিম পুরুষ ও মহিলারা ইসলামকে তাদের নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে চলে। মডারেট মুসলিম মহিলারা আবার এই দিক থেকে মডারেট মুসলিম পুরুষের তুলনায় আরও এককাঠি এগিয়ে, কারন তারা নিজেরা হিজাব নামের পোশাকটি পড়া ছাড়া ধর্মের আর কোন শিক্ষা না পেলেও সহি ইসলামের ব্যাখ্যা দিতে উচ্চকণ্ঠ ও সদা উদগ্রীব। এরা ভুলেই যায়, কথিত আল্লাহর বানী ইসলাম সংস্কার যোগ্য নয়।
জন্ম থেকে যে অন্ধ, সেও নৈতিক মনোবলে যুদ্ধ করে অন্ধত্বের অভিশাপ মুক্ত হতে পারে; কিন্তু হৃদয় ও মস্তিস্ক বন্ধক দিয়ে মডারেট মুসলিমরা সাগ্রহে যে অন্ধত্বকে বরন করে নিয়েছে, তা থেকে বেরুবে কোন পথে ?
এখানে আমার একটা কথা মনে পরে । আমাদের পাড়ায় একটা বট গাছ ছিল , যেটিকে লোহার জালের বেড়া দেওয়া হয়েছিলো যাতে ছাগল গরুতে না খাঁয় । ফলে নিরাপদে গাছটি বেশ বড়সড় হয়ে গেল । ছায়া , শীতল বাতাস দিতে লাগলো , নিচে বিশ্রামের ব্যাবস্তা হল , আমরা তাঁর নিচে সুখ অনুভব করতাম । কিন্তু একদিনের এক বিশাল ঝড়ে তা ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে গেল , ভেঙ্গে পরার আগে পাড়ার বড়রা বাঁশ – খুঁটি দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ঠেকিয়ে রাখতে পারেন নাই । আসলে যে লোহার বেড়টি দেওয়া হয়েছিলো , তা সময় মত খুলে বাড়ানো হয় নাই , ফলে যা হওয়ার তাই হল । শক্ত বেড় হওয়ায়, গাছটি কাণ্ডটির মাঝ খানে বেড়ের চাপে বারতে পারেনি ফলে কাণ্ডটি সরু হয়ে দুর্বল হয়ে গেছিলো । যে বেড় তাকে বাঁচিয়ে ছিল , এক সময় সেই-ই মৃত্যুর কারন হল। মক্কায় আল্লার নামে, মূর্তি পুজার নামে,দাস প্রথা নামে, সুধ ব্যাবসার নামে, ছোট ছোট গোষ্ঠীর মধ্যে ভয়ঙ্কর লড়াই চলতো । অস্ত্রের দ্বারা যা থামিয়ে এক শান্তিময় মক্কা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । মানুষ পেয়েছিল অধিকার , শান্তি ও সুস্তিথি , অনাথ পেয়েছিল আস্থানা । কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সংস্কার না হওয়ার ফলে তাই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে বিভিশিখা , মানব জাতির অগ্রগতির বাঁধা ।
মডারেটদের মগজে ঢুকে গিয়েছে “কুরান বিজ্ঞানময়।” এখন এরা যেখানেই বিজ্ঞান দেখে সেখানেই কুরানের বানীর সাথে মিল খোজে, নয়তো যেখানেই হাদীস বা কুরানের বানী দেখে সেখানে খোজে বিজ্ঞান। একেবারেই অশিক্ষিত কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা মানুষদের মধ্যে থেকেও আমরা আরজ আলী মাতুব্বর, লালনের মত চিন্তাশীল মানুষ পেয়েছি। কিন্তু এই মগজ ধোলাই করা শিক্ষিতদের মধ্যে থেকে সেসব পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। যে বিজ্ঞানী কি জিনিস তা জানেনা তাকে বোঝাতে পারেন আইনস্টাইন, নিউটন এদেরকে বিজ্ঞানী বলা হয়। কিন্তু যে বিজ্ঞানী কি তা জানে এবং জাকির নায়েককেও একজন বিজ্ঞানী মনে করে তার কাছে আইনস্টাইন, নিউটন, ডারউইন এরা খ্রীস্টান, ইহুদী কিংবা নাস্তিক ছাড়া কিছু না।
এটাই একটা বড় সমস্যা এসব হাঁসজারু বকধার্মিকদের বেলায়। এরা ঊর্দ্ধমুখী উট-হিজাব করবে, আবার প্রসাধনে মুখ পুরো প্রলেপে ঢাকবে। বিয়ের আগে মেকাউট করবে, এদিকে ফেসবুকে নারীদের শালীনতা নিয়ে পোস্ট দেবে। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষায় থাকবে, আবার হেফাজতের তের দফা মানবে। মানুষ ধর্মের নামে খুন হলে নির্বিকার থাকবে, ধর্মের ভাইদের গায়ে আঁচড়টি পড়লে বুক আছড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কান্না করতে থাকবে।
সত্যিই, কী বিচিত্র এই মডারেটমানস!
ধার্মিক হয়ে বা ধর্মের প্রতি ন্যুনতম বিশ্বাস রেখেও কি আসলেই বা সত্যিকারঅর্থেই অসাম্প্রদায়িক বা বিজ্ঞানমনস্ক হওয়া সম্ভব? আমার কাছে মনে হয় সম্ভব নয়। তাই ধর্মকে টিকিয়ে রেখে যুক্তিবাদী, প্রগতিশীল সমাজের আশা করা অনেকটা আকাশকুসুম কল্পনা করবার মতই হয়ে দাঁড়ায়।