প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের সংক্ষিপ্তসার
১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ দার্শনিক ব্রায়ান ম্যাজি বিবিসি-তে দ্য গ্রেট ফিলোসফারস নামে একটি ১৫ পর্বের ধারাবাহিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছিলেন যাতে প্রাচীন গ্রিসের প্লেটো থেকে শুরু করে আধুনিক অস্ট্রিয়া-ইংল্যান্ডের লুডভিগ ভিটগেনস্টাইন পর্যন্ত ১৫ জন বিখ্যাত দার্শনিকের কাজ নিয়ে সেই কাজের কোনো বিশেষজ্ঞের সাথে আলাপ করতেন। ১২তম পর্বে আধুনিক অস্তিত্ববাদ নিয়ে কথা বলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলির হিউবার্ট ড্রাইফাসের সাথে। আলোচনার শুরুতে ম্যাজি একটি ভূমিকা দেন যাতে এডমুন্ড হুসার্লের রূপতত্ত্বকে ব্যবহার করে এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে হাইডেগারের অস্তিত্ববাদ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। এরপর ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার করার জন্য ড্রাইফাসকে প্রশ্ন করেন।
ড্রাইফাস শুরু করেন ফরাসি দার্শনিক রনে দেকার্ত থেকে। দেকার্ত সবকিছু ব্যক্তি ও বস্তু হিসেবে দেখতেন, অর্থাৎ আমরা মানুষেরা হচ্ছি বস্তুজগৎ থেকে আলাদা ব্যক্তি, বস্তু পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি। সকল বস্তু যেহেতু ব্যক্তির কল্পনা হতে পারে সেহেতু দেকার্ত সব বাদ দিয়ে আগে কেবল এই ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন। প্রমাণের জন্য তিনি বলেন “আমি চিন্তা করি, তাই আছি।” এরপর বস্তু বা আমি ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তির অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য তিনি “ঈশ্বর” কে নিয়ে এসেছিলেন। এডমুন্ড হুসার্ল এসে বলেন, কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে কি নেই সেটা নিয়ে কোনো কথা না বলে যদি কোনোকিছু আমার চেতনায় যে রূপে ধরা দেয় সেই রূপটা নিয়েই কথা বলি তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। যেমন, আমার সামনে ল্যাপটপটা আমার অস্তিত্ব-নিরপেক্ষভাবে আছে কি না সে নিয়ে কিচ্ছু না বলে আমি যদি কেবল আমার চেতনায় রূপায়িত ল্যাপটপ নিয়ে কথা বলি তাহলেই হলো। কারণ “ল্যাপটপ” না থাকলেও “আমার-চেতনায়-রূপায়িত-ল্যাপটপ” যে আছে তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই। হুসার্ল আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেন: বস্তুনিরপেক্ষ চৈতন্য বলতে কিছু নেই, চেতনা সবসময়ই কিছু একটার চেতনা। যেমন একটা বহু আলোকবর্ষ দূরের গ্যালাক্সি নিয়ে চিন্তা করাটা সেই গ্যালাক্সি-বিষয়ক-চেতনা, যৌনকাম নিয়ে চিন্তা করাটা যৌনকাম-বিষয়ক-চেতনা ইত্যাদি। চেতনার এরকম কোনো কিছুর দিকে সর্বদা নিবদ্ধ হয়ে থাকাকে হুসার্ল বলেছিলেন ইন্টেনশনালিটি বা “নির্দেশনতা”, আর মনে রূপায়িত একটা জিনিসকে বলেছিলেন “নির্দেশনী আধেয়”।
হাইডেগার হুসার্লের ছাত্র ছিলেন এবং হুসার্লের রূপতত্ত্ব দিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন, দেকার্ত থেকে শুরু করে অনেকেই কিসের অস্তিত্ব আছে, কিসের নেই এসব নিয়ে কথা বলেছে, কিন্তু “অস্তিত্ব” কাকে বলে সেটাই বলেনি। হুসার্লের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি অস্তিত্বের কোনো পরম ব্যাখ্যায় গেলেন না, বরং আমাদের, অর্থাৎ মানুষদের চেতনায় অস্তিত্বশীল থাকা বা বিরাজ করা যে রূপে ধরা দেয় সেটা নিয়েই কথা বললেন। তিনি চিন্তিত হয়েছিলেন বিরাজ করা অর্থাৎ ক্রিয়াটি নিয়ে। চিন্তা করে তিনি দেখলেন, দেকার্তের “আমি চিন্তা করি, তাই আছি” ত্রুটিপূর্ণ, কারণ চিন্তা করতে হলে আগে থাকতে হবে, আগে তো অস্তিত্ব বা বিরাজ করা, তারপরে না চিন্তাভাবনা বা অন্য সবকিছু। তিনি বললেন, মানুষ গোড়া থেকেই জগৎ-মধ্যে-বিরাজমান, এবং জগতের বিভিন্ন জিনিসের সাথে তার তিন রকমের মিথস্ক্রিয়া ঘটে: সদাপ্রস্তুত, অপ্রস্তুত ও বিদ্যমান। এই ঘরে ঢুকার সময় আমাকে হাতল ঘুরিয়ে দরজাটি খুলতে হয়েছে, কিন্তু হাতল ঘুরানোর কোনো স্মৃতি আমার নেই, কারণ সেই কাজটা আমি অচেতনভাবে করেছিলাম। এটাই সদাপ্রস্তুত কর্ম, এবং মানুষের প্রাত্যহিক অধিকাংশ কাজই এমন, মানুষ চিন্তাভাবনা করে কি করবে সেটা বের করে না, বরং অচেতনভাবে পরিস্থিতির সাথে স্বচ্ছভাবে মানিয়ে চলে। একটা কাঁচ বেশি স্বচ্ছ হলে যেমন তার মধ্যে দিয়ে সব দেখা যায় এবং স্বয়ং কাঁচটার অস্তিত্বই যেন উধাও হয়ে যায়, তেমনি মানুষের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড বা বিরাজনে চৈতন্যটা কাঁচের মতো স্বচ্ছ। এখন হাতলটা যদি বেশি টাইট হতো তাহলে আমি হঠাৎ করে হাতলটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে যেতাম, এবং পরে হয়ত কাউকে বলতামও যে হাতলটাতে সমস্যা আছে ঠিক করানো দরকার। এটাই অপ্রস্তুত দশা। এই সময় আমরা কিছুটা সচেতন হই, কিন্তু বস্তুটা যেমন হাতলটা সম্পর্কে সচেতন হই না, বরং সমস্যাটা নিয়ে সচেতন হই ও তা সমাধানের পথ খুঁজি। এখন যদি কখনো এমন সময় আসে যে, আমার কোনো কাজে মন নেই এবং বসে ধীরে সুস্থে ভাবছি। যেমন, হয়ত আনমনা হয়ে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ দরজাটা চোখে পড়ল আর আমি দরজার হাতল কী দিয়ে তৈরি ও সেটা কিভাবে কাজ করে তা নিয়ে ভাবা শুরু করলাম। এই ক্ষেত্রে আমার দশাটা হবে বিদ্যমান দশা, অর্থাৎ যাহা বিদ্যমান তাহা নিয়ে ভাবছি, এসময় আমি পূর্ণ সচেতন, এবং এই সময় দেকার্তের ধারণার মতোই বস্তুজগৎ আমার চৈতন্য থেকে আলাদা। কিন্তু অধিকাংশ সময় আমরা সদাপ্রস্তুত দশায় থাকি, সেটাই আমাদের বিরাজনের প্রধান উপায়।
এরপর মানুষের বিরাজ করার ক্রিয়াকে হাইডেগার একটা নতুন নাম দেন “ডাজাইন” যার মোটামুটি বাংলা করা যায় “সেথা-বিরাজন”, এবং ডাজাইনের রূপ বা কাঠামো নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তিনি বলেন ডাজাইন সময়ের মধ্যে প্রোথিত, এবং সময়েরই মূর্তরূপ। ডাজাইনের কাঠামো তিন স্তরের এবং স্তর তিনটিকে যথাক্রমে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের উপর স্থাপন করা যায়। প্রথমত ডাজাইন সর্বদা নিজেকে কোনো না কোনো মেজাজের (বেজার, খুশি, ক্লান্ত) মধ্যে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করে, আগে থেকেই অর্থাৎ অতীত থেকেই সে মেজাজবিশিষ্ট, তার কোনো মেজাজহীন দশা নেই। এরপর ডাজাইন সর্বদা বিশ্বের সাথে মিথস্ক্রিয়ায় রত, বিশ্বটা যেন একভাবে সেজে আছে এবং ডাজাইন সর্বদা তার সাজ ভেঙে দিয়ে তাকে খানিকটা নতুন সাজ দিচ্ছে, এরই নাম বর্তমান। আর ডাজাইন সর্বদা অচেতনভাবে ভবিষ্যতের দিকে প্রক্ষিপ্ত। আমি এখন দ্রুত এই লেখাটা শেষ করার চেষ্টা করছি যাতে একটু পরে আমি ফ্রি হয়ে যায়, এবং আমার সত্তাটা বাইসাইকেলে করে আরেক জায়গায় যেতে পারে। হাইডেগার আরো বলেন, ডাজাইনের শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থ নেই, সে কেবলই সময়ের মূর্তরূপ, এবং সময়ের কোনো অর্থ নেই।
এই পর্যায়ে ম্যাজি বলেন, মানুষ যদি অধিকাংশ সময় অচেতন সদাপ্রস্তুত দশায় থাকে এবং তার তিন স্তরের কাঠামোটা যদি আগে থেকেই সুনির্ধারিত থাকে তাহলে মানুষ কি এক ধরণের জিন্দা লাশ হয়ে গেল না, যার নিজের করার কিছু নেই? এই প্রসঙ্গে ড্রাইফাস যথার্থতার ধারণা নিয়ে আসেন। অধিকাংশ মানুষ বিরাজনের অর্থহীনতা স্বীকার করে না। কিন্তু যারা অর্থহীনতা স্বীকার করে নেয় তাদেরকে তিনি বলেছেন অথেন্টিক বা যথার্থ বা খাঁটি। যথার্থ ডাজাইনের মধ্যে এই অর্থহীনতার বোধ উদ্বেগের সৃষ্টি করে। উদ্বেগের কারণটা বুঝে ফেলার মাধ্যমে ডাজাইন উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে পারে। তার মুক্তিটা এই চিন্তা থেকে আসে যে, মুক্ত করার মতো কোনো পরম অর্থই নেই।
এরপর চলে আসে হাইডেগারের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের কথা। পরবর্তী জীবনে তিনি বিরাজনের এই সংজ্ঞা শুধরাতে চেয়েছিলেন। তিনি এতক্ষণ ডাজাইনের যে তিন স্তরের কাঠামোর কথা বলেছেন তা না কি কেবলই আধুনিক পাশ্চাত্য মানুষের বিরাজন, সর্বকালের সর্বস্থানের মানুষের নয়। তিনি ইউরোপে তিন যুগের অন্তত তিনটি বিরাজন ধরিয়ে দেন। প্রাচীন গ্রিসে উদ্বেগ ছিল না, তখন মানুষ প্রকৃতির কোলে একটা গাছের মতোই আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে প্রতিষ্ঠিত ছিল, যার ফলে তাদের সংস্কৃতিতে মহানায়ক সৃষ্টি হয়েছিল। ইউরোপে পরবর্তী বিরাজনবোধ আসে খ্রিস্টধর্মের মাধ্যমে। এ সময়ও উদ্বেগ ছিল না, কারণ মানুষ প্রকৃতির কোল ছাড়লেও আশ্রয় নিয়েছিল ঈশ্বরের কোলে। আর হাইডেগার যে উদ্বিগ্ন ডাজাইনের কথা বলেছেন তা হচ্ছে আধুনিক প্রাযুক্তিক যুগের বিরাজনবোধ, যখন বিরাজনের চূড়ান্ত নাস্তিত্ব প্রকাশিত হয়ে পড়ায় মানুষ উদ্বিগ্ন হচ্ছে। ইউরোপের এই প্রাযুক্তিক উদ্বিগ্নতা থেকে মুক্তির কোনো আশা তিনি ব্যক্ত করেননি। এরপর আলোচনা খানিকটা ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। ভাষা নিয়ে কথা বলা শুরু করেন দুজনে। শুরু হলো এবারের পর্ব:
ম্যাজি: হাইডেগারের দর্শনের একটা দিক আমরা এখনও আলোচনা করিনি, কিন্তু পরবর্তী অস্তিত্ববাদী চিন্তাবিদদের নিয়ে আলোচনার আগে সেটা করে নেয়া উচিত। সেই দিকটা হচ্ছে, হাইডেগার ভাষা নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। আসলে পরবর্তী হাইডেগারকে ভাষা নিয়ে কেবল চিন্তিত বলা যাবে না, তিনি যেন ভাষার চিন্তা দিয়ে পুরোপুরি আচ্ছন্ন ছিলেন। কেন?
ড্রাইফাস: একদিক দিয়ে এটা বোঝার পথ আমাদের আলোচনায় ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। যেহেতু কোনো অর্থেই মানব বিশ্ব কেবল নিজের মধ্যে অর্থাৎ সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে থাকতে পারে না, সেহেতু ভাষাও তেমন কোনো বিশ্বের বাস্তবতার প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। কিন্তু তাই বলে আমরা যাচ্ছেতাই শব্দ বানাতে থাকতেও পারি না। বরং ভাষার কাজ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট যুগে বর্তমান লোকাচারগুলোকে প্রতিফলিত করা এবং কেন্দ্রীভূত করা। সাংস্কৃতিক প্যারাডাইম যে কাজ করে সেও সেই কাজ করে। হাইডেগারের মতে শব্দ বা মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন রূপক নাম প্রদানের মাধ্যমে নতুন জিনিসকে অস্তিত্ব দিতে পারে, এবং গোটা একটি যুগের সংবেদনশীলতা পাল্টে দিতে পারে। ক্যালিফোর্নিয়ায় যখন কেউ বলেছিল যে সেখানে অনেক মানুষ ‘laid back’ অবস্থায় আছে তারও আগে থেকে সেখানকার অনেক মানুষ টাবভর্তি গরম পানিতে ডুবে থাকত, আয়েশে দিন কাটাত এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহার করত। এই নতুন শব্দটা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে সুবিধা যা হয়েছে তা হলো মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, এই কাজগুলো একে অপরের সাথে বেশ খাপ খায়। দিন দিন আরো বেশি মানুষ এতে যোগ দিতে থেকেছে এবং ফলশ্রুতিতে এমন আরো অনেক লোকাচারের জন্ম হয়েছে। এভাবেই ভাষা খুব চমৎকারভাবে বিভিন্ন লোকাচার একীভূত করার মাধ্যমে সেগুলো সংরক্ষণ ও বর্ধন করতে পারে। হাইডেগারের মতে, ধর্মযাজক বা বিজ্ঞানীরা নয়, বরং কবি ও চিন্তাবিদেরাই নতুন ভাষা গ্রহণোন্মুখ এবং সে কারণে তারাই বিরাজনের নতুন উপায়কে অগ্রসর করতে পারে ও স্থায়িত্ব দিতে পারে। সুতরাং ভবিষ্যতে কোনো অ-ব্যক্তিক, অ-স্বেচ্ছাচারী নতুন বিশ্ব পাবার ক্ষেত্রে তারাই আমাদের একমাত্র ভরসা।
ম্যাজি: হাইডেগারের দর্শন নিয়ে আপনার অনন্যসাধারণ ভূমিকাটার পর আমার আর কোনো সংশয় নেই যে, শুধু হাইডেগারকে নিয়ে আজকের আলোচনার প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করা ঠিকই ছিল। হাইডেগার যে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অস্তিত্ববাদী দার্শনিক সে নিয়ে আমার মনে হয় কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। কিন্তু আমি ভূমিকাতে অন্যদের সম্পর্কেও কথা বলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম এবং এখন মনে হয় সেটা পালন করা উচিত। আমি মূলত জঁ-পল সার্ত্র এবং মরিস মের্লো-পোঁতি এই দুজনের নাম বলেছিলাম। চলুন এই দুইজনকে নিয়ে এই ক্রম মেনেই আলোচনা করি, কারণ তাদের কাজও এই ক্রমানুসারেই প্রকাশিত হয়েছিল। সার্ত্র’র দার্শনিক ক্যারিয়ারকে আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন?
ড্রাইফাস: সার্ত্র হুসার্লবাদী হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং রূপতত্ত্ব (phenomenology) কাজে লাগিয়ে La Nausée নামে একটা চমৎকার উপন্যাস লিখেছিলেন। উপন্যাসটিতে এক জন ব্যক্তির গোটা বিশ্ব ভেঙে পড়া বর্ণনা করা হয় সেই ব্যক্তিরই দৃষ্টিকোণ থেকে। এরপর তিনি হাইডেগার পড়েন এবং হাইডেগারীয় অস্তিত্ববাদ বলতে যা বুঝেছিলেন সেটাতেই দীক্ষিত হন। কিন্তু হুসার্লবাদী হওয়ার কারণে, এবং আরো বেশি বোধহয় ফরাসি হওয়ার কারণে, তিনি হাইডেগারকে সংশোধন করে আরো কার্তেসীয় করে নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সুতরাং তিনি সেই সচেতন ব্যক্তি সত্তা থেকে শুরু করেন, এবং তারপর হাইডেগারের মতোই মৃত্যু, উদ্বেগ, অযথার্থতা, বিরাজ এবং নাস্তি ইত্যাদি সব নিয়ে কথা বলেন। এগুলো তিনি যে বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন সেই “বিরাজ ও শূন্যতা” আসলে হাইডেগারের “বিরাজ ও সময়” বইটিকে ভুল বুঝার একটা চমৎকার উদাহরণ। আমরা এতক্ষণ যা বলেছি তা যদি ঠিক হয় তাহলে বলতে হবে, হাইডেগার আমাদেরকে ঠিক এই কার্তেসীয় অনুমিতিগুলো থেকেই মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমি একবার হাইডেগারের সাথে দেখা করতে গিয়ে তার টেবিলের উপর জার্মান অনুবাদে সার্ত্র’র “বিরাজ ও শূন্যতা” বইটা দেখে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, “তো, আপনি সার্ত্র পড়ছেন?” উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “এই আবর্জনা তো পড়া শুরু করাই আমার পক্ষে সম্ভব না।” এটা ভয়ানক শক্ত কথা, কিন্তু একদিক দিয়ে তিনি ভুল বলেননি; হাইডেগার ব্যক্তি নিয়ে আলোচনা করছিলেন বলা মানে তাকে আবার হুসার্লে ফিরিয়ে নেয়া। সার্ত্র আসলে হুসার্লেরই একটা অস্তিত্ববাদী সংস্করণ রচনা করেছিলেন। সার্ত্র’র “নিজের-তরে” (for-itself) আসলে হুসার্লের তুরীয় ইগো—একটি ব্যক্তি সত্তা যে নির্দেশনতার (intentionality) মাধ্যমে সবকিছুকে অর্থ দান করে। চেতনাই যেহেতু সব অর্থ দেয়, সেহেতু ঐ চেতনা’র জন্য যেকোনো জিনিসের যেকোনো অর্থ থাকতে পারে। হাইডেগার যে নিক্ষিপ্ততা, অর্থাৎ কোনো মেজাজের মধ্যে নিজেদের হুট করে আবিষ্কার করার কথা বলছিলেন সেই facticity-র কোনো বালাই নেই এখানে। এর অর্থ দাঁড়ায় আমরা যেকোনো মূল্যবোধকে নিজেদের জন্য অর্থপূর্ণ করে নিতে পারি। সার্ত্র জুয়ারীর মাধ্যমে একটা উদাহরণ দিয়েছিলেন। এই মুহূর্তে যদি আমি আর কখনো জুয়া না খেলার সিদ্ধান্ত নেই, তারপরও ঠিক পরমুহূর্তেই আমি এই সিদ্ধান্তকে একটা নতুন অর্থ দিতে পারি, হয়ত বলতে পারি সিদ্ধান্তটা গাধামো ছিল, এবং আমার অতি অবশ্যই জুয়া খেলা উচিত। সার্ত্র’র ভাষায়, আমি বিশুদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততা, বিশুদ্ধ চপলতা, বিশুদ্ধ স্বাধীনতা, বিশুদ্ধ শূন্যতা — কিম্ভূতকিমাকার রকমের স্বাধীন। সার্ত্র’র মতে চৈতন্য ‘স্বাধীনতার অতীত’, এবং মানব সত্তা হচ্ছে জীবনের একটি স্থায়ী অর্থ খোঁজার একটি কিম্ভূতকিমাকার ও বিফল প্রচেষ্টা।
ম্যাজি: আমার ভাবতে খুবই কষ্ট হয়ে যে সার্ত্র দার্শনিক হিসেবে টিকে থাকবেন। তবে নাট্যকার ও ঔপন্যাসিক হিসেবে তার টিকে থাকার সম্ভাবনা অনেক বেশি… আচ্ছা, মের্লো-পোঁতি সম্পর্কে আপনার সাধারণ ধারণাটা কেমন?
ড্রাইফাস: মের্লো-পোঁতি আমার মনে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি ছাপ ফেলেছে। আমি মনে করি তিনি একজন চমৎকার দার্শনিক এবং টিকে থাকবেন। তার মূল অবদান হচ্ছে তিনি আমাদের জগৎ-মধ্যে-বিরাজনে দেহকে নিয়ে এসেছেন। আমাদের মন-বহির্ভূত নির্দেশনতা (কোনোকিছুর প্রতি নিবিষ্ট থাকা) বর্ণনার জন্য তিনি অনেক সময় দেহকে নির্দেশনী কোষ (টিস্যু) হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
“বিরাজ ও সময়” এ দুটি বড় ফাঁক আছে। প্রথমটা হচ্ছে হাইডেগার কখনো দেহ নিয়ে কথা বলেন না, বা এমনকি কোনো দক্ষতা বা লোকাচার নিয়েও কথা বলেন না। এই আলোচনায় এই বিষয়গুলো আমিই যোগ করেছি, যাতে তার সদাপ্রস্তুত, অপ্রস্তুত, বিরাজন-বোধ ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণাগুলো স্পষ্ট করা যায়। সুতরাং মের্লো-পোঁতি যেহেতু দেহ নিয়ে কথা বলেন এবং দেহ কিভাবে বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে তা বর্ণনা করেন সেহেতু তিনি আসলে হাইডেগারকে আমাদের জন্য আরো স্পষ্ট করেন। একইসাথে তিনি সার্ত্রকেও সমুচিত জবাব দেন। তিনি বলেন আমরা পুরোপুরি স্বাধীন নই। আমরা প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট দেহে বাঁধা, যে দেহের একটা নির্দিষ্ট আকার আছে, যে দেহ কেবল একটি নির্দিষ্টভাবেই চলাচল করতে পারে। আমরা ব্যক্তিগত এবং সমষ্টিগত সুস্থিত অর্থ তৈরি করতে পারি, কারণ আমরা যা করি সেগুলো আমাদের দেহে দক্ষতা ও অভ্যাস হিসেবে স্থাপিত হয়ে যায়, এবং এই দক্ষতা ও অভ্যাসগুলোকে আমরা চাইলেই যখন যেভাবে ইচ্ছা পাল্টাতে পারি না। একে ইতিহাসের আয়রনিই বলতে হবে যে, হুসার্লবাদী সার্ত্র’র জবাব দিতে গিয়ে মের্লো-পোঁতি হাইডেগারকে পুনরুদ্ভাবিত করেছেন এবং ফলশ্রুতিতে “বিরাজ ও সময়” কে আরেকটু পূর্ণতা দিয়েছেন।
“বিরাজ ও সময়” এর আরেকটি ফাঁক হচ্ছে প্রত্যক্ষণ (perception)। হাইডেগারের কথা শুনলে মনে হয় প্রত্যক্ষণ বুঝি কেবল কোনো জিনেসের দিকে চেয়ে থাকা, যা বেশ দুর্ভাগ্যজনক, কারণ আমাদের আসলেই মনে হয় যে আমরা বিভিন্ন জিনিস ব্যবহারের পিছনেই কেবল নয়, বরং দেখার পিছনেও অনেক সময় ব্যয় করি। মের্লো-পোঁতি প্রত্যক্ষণকে একটি মূর্তকর্ম হিসেবে দেখেন, যে মূর্তকর্মের মধ্যে আমরা চলাচল করি বিশ্বের বিভিন্ন জিনিস পুরোপুরি আয়ত্ত করতে। এবং এভাবেই আমরা অনেককিছুতে সদাপ্রস্তুত দশা অর্জন করতে পারি। এদিক থেকেই মের্লো-পোঁতি হাইডেগারের চিত্রটাকে আরো পূর্ণতা দিচ্ছেন।
ম্যাজি: একটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় লেগেছে। সার্ত্র যখন হাইডেগারের মতো কথা বলছেন বলে দাবী করছিলেন তখন আসলে তিনি কথা বলছিলেন হুসার্লের মতো, আর সার্ত্র’র প্রতি মের্লো-পোঁতির জবাবটা আসলে ঠিক হুসার্লের প্রতি হাইডেগারের জবাবকেই পুনর্নির্মিত করেছে।
আমরা এতক্ষণ যে চার জন দার্শনিককে নিয়ে কথা বললাম তারা সবাই এখন মৃত। বিংশ শতাব্দীর দর্শনে এই চার জন যে ধারাটির প্রতিনিধিত্ব করতেন সেই ধারার খেলা কি একেবারে ফুরিয়ে গেছে বলে মনে করেন, না কি ধারাটি এখনো চলমান ও সজীব?
ড্রাইফাস: আমি মনে করি এটা পুরোমাত্রায় জীবন্ত। এমনকি হুসার্লের যে রূপতত্ত্ব হাইডেগার ধ্বংস করতে চাচ্ছিলেন সেটিও পুরোমাত্রায় জীবিত। হুসার্ল সজীব দুইভাবে: প্রথমত, হুসার্ল আমাদেরকে একইসাথে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার লাইসেন্স এবং একটা উপায় বাতলে দেয়। গান শুনতে কেমন লাগে, যৌনাকাঙ্ক্ষা পোষণ কেমন জিনিস এগুলো আমরা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করতে পারি তারই কারণে।
ম্যাজি: আমি একটু যোগ করতে চাই যে, বর্তমানে ব্রিটেনে অনেক মেধাবী তরুণ দার্শনিক ঠিক এই বিষয়গুলো নিয়ে ঠিক এই পদ্ধতিতেই লেখালেখি করছে।
ড্রাইফাস: এবং যুক্তরাষ্ট্রেও। হুসার্লের অন্য দিকটা এমনকি আরো প্রভাবশালী। তিনি আমাদের নির্দেশনী আধেয়’র — যা আমাদেরকে বিভিন্ন জিনিসের দিকে নিবদ্ধ হতে সাহায্য করে — কাঠামো নিয়ে অনেক চিন্তিত ছিলেন। বর্তমানে চৈতন্যবিজ্ঞান নামে বিজ্ঞানের একটা শাখাই তৈরি হয়েছে যারা ঠিক এই কাজটা করার দাবী করে, অর্থাৎ বিভিন্ন জিনিসের মানসিক প্রতিনিধিত্বের কাঠামো নিয়ে কথা বলে। এই ধরণের গবেষণা যে-ই করতে চাইবে তাকেই হুসার্লের দেখিয়ে যাওয়া মৌলিক দিকনির্দেশনাটি অনুসরণ করতে হবে। এছাড়া কেউ যদি একটা কৃত্রিম মন তৈরি করতে চায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করা কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা যা করার চেষ্টা করছেন, তাহলেও তার হুসার্লের কাছে ঋণ থাকবে। হুসার্ল যে বলেছিলেন মানুষের মন কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়মের প্রাধান্যপরম্পরা অনুসরণ করে সেটা বর্তমানে অনেক কম্পিউটার প্রোগ্রামে প্রয়োগ করে দেখা হচ্ছে। সুতরাং হুসার্লের অবস্থা এখনও বেশ ভালো।
এবং হাইডেগারের অবস্থাও ভালো। যদিও হয়ত “বিরাজ ও সময়” যতটা আলোচিত হওয়া উচিত ততটা হয় না। ভাষা, সত্য, প্রসঙ্গকাঠামো, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে বইটির অনেক কিছু বলার আছে যা সমকালীন দার্শনিকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে সেই প্রাত্যহিক স্বচ্ছ মানানো’র কথাই নিয়ে আসা যাক। আমাদের অধিকাংশ কর্মকাণ্ডই যদি এমন নিবিষ্টমনে বা অচৈতন্যে ঘটে থাকে তাহলে ভাষাগত বিশ্লেষকদের — যারা হয় মানুষের স্বজ্ঞা নয় তাদের ভাষাগত শ্রেণিবিভাগগুলোর উপর আস্থা রাখেন — সমালোচনা করতে পারি। হাইডেগার হলে বলতেন, স্বজ্ঞার উপর আস্থা স্থাপনের অর্থ হচ্ছে, মানুষের বিশ্বাস বা আকাঙ্ক্ষা দিয়ে তার আচরণ পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যায় এটা মেনে নেয়া, যা ঠিক নয়, এবং মানুষের কর্মকাণ্ডের রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তা দেখানো সম্ভব। একইভাবে ভাষা আমাদের কাজকর্মের পিছনের পটভূমিটা ফুটিয়ে তুলতে পারে না বলে পুরোপুরি আস্থাযোগ্য নয়। আমাদের নিত্য দিনের স্বচ্ছ মানানো প্রকাশ করার মতো কোনো শব্দ ভাষাতে নেই। সুতরাং ইঙ্গো-মার্কিন দর্শনের কিছু একেবারে মৌলিক অনুমিতিকে হাইডেগারের রূপতত্ত্ব দিয়ে কঠোরভাবে সমালোচনা করা যায়। এবং পরিশেষে এটাও বলতে হয় যে, ইউরোপে, বিশেষ করে ফ্রান্সে যারা এই দার্শনিক ধারাকে বিনির্মাণ (deconstruction) করতে চান তাদের জন্যও হাইডেগার প্রথম পথপ্রদর্শক। যেমন মিশেল ফুকো এবং জাক দেরিদা এই যুগের পাশ্চাত্য মানুষের বিরাজনের বা বাঁচার সংজ্ঞা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন হাইডেগারের মতো করেই, যাতে এই বিরাজন থেকে বেরিয়ে আসা যায়।
সুতরাং বলতেই হচ্ছে, বর্তমানে এমন বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্র খুব কমই আছে যাতে এই দার্শনিকদের চিন্তাধারা কোনো না কোনো মাত্রায় প্রাসঙ্গিক নয়।
[আলোচনা সমাপ্ত। কষ্ট করে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। উপহার হিসেবে নিন একগুচ্ছ উদ্বিগ্নতা]
এই পর্বের শুরুতে আগের দু পর্বের রিভিউটা বেশ চমৎকার হয়েছে…. আগের দু পর্বের কঠিন আলোচনাকে অনেক সহজ ভাবে উপস্থাপন করায় লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ…..
দেকার্তের এই উক্তিটি যেমন অস্তিত্ববাদের মূল কথা,ঠিক তেমনি বস্তুবাদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে,পরের পর্বগুলোও পড়লাম একসাথে।ভালো লাগলো।পরের পর্বে নীটশে,ক্যামু,সার্ত্র এদের নিয়েও লেখা চাই।।
এককালে মানুষকে শেখানো হয়েছিল যে পৃথিবীটা মানুষের ভোগের জন্যে।সুতরাং এ পৃথিবীতে উদ্ভিদ্, পশুপক্ষী যারাই আছে,তাদের অস্তিত্ত্ব কেবল মানুষের ভোগোপকরণ যুগিয়ে যাওয়াতে।তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা,তাদের বাঁচবার এষণা,তাদের সুখ-দুঃখ-ভালবাসা, তাদের মায়া-মমতায় ভরা পারিবারিক বা গোষ্ঠীজীবনের কোন দাম নেই।ছাগলছানার বাঁচবার ইচ্ছে যতই থাকুক না কেন, ছাগলছানার শরীরে কত ওজনের মাংস রয়েছে সেটাই বিবেচ্য।এই ভুল দর্শন মানুষকে হিংস্র করে তুলে ছিল।মানুষকে রক্তলোলুপ শার্দুলের চেয়েও ভয়ংকর করে তুলেছিল।কারণ,শার্দুল জীবহত্যা করে বাঁচবার দায়ে,পেটের দায়ে।আর মানুষ অধিকাংশ সময়ে জীবহত্যা করে লালসার প্রেষণায়।অনেক সময় মানুষ নিজের লালসা বৃত্তিকে ঢাকা দিতে গিয়ে কপটাচরণের(hypocricy) আশ্রয় নিয়েছে।দেবতাকে তুষ্ট করার অজুহাত দেখিয়ে জীবহত্যা করেছে আসলে নিজের রসনাকে তৃপ্ত করার জন্যে। এ সবই ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের ফলশ্রুতি।
কোন দর্শন বিশেষ কোন মানবগোষ্ঠীকে শিখিয়েছে – “এই মানবগোষ্ঠী পরমপুরুষের আশির্বাদধন্য প্রিয় সন্তান – বাকীরা ঈশ্বরের অভিশাপদগ্ধ অবাঞ্ছিত ব্যষ্টি।” এই দার্শনিক ত্রুটিতে এক গোষ্ঠীর মানুষ অন্য গোষ্ঠীকে ধ্বংস করাও পুণ্য কাজ বলে মনে করেছে।সমাজের পাষাণকঠোর বেদী নিরীহ মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে।ভুল দর্শনের স্তাবকেরা নিরীহ মানুষের রক্তে মুক্তিস্নান করেছে।ওঃ কী বিভীষিকা! ভুল দর্শন মানুষকে শিখিয়েছে -বুদ্ধির বলে যদি অন্যকে শোষণ করি তাতে দোষ কিসের ! বুদ্ধি প্রয়োগ করাও তো একটা পরিশ্রম।বুদ্ধি প্রয়োগ করারও তো একটা অধিকার আছে – এই যুক্তিতেই লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত মোক্ষণ করে কিছু সংখ্যক পরভোজী জীব স্ফীতোদর হয়েছে।আর অগুণতি মানুষ অস্থিচর্মসার জীবিত কঙ্কালে পরিণত হয়েছে।
এই ধরণের ভুল দর্শন আবার অনেক মানুষকে নৈতিকতার পথ থেকে বিচ্যুত করে উদর-উপস্থজীবী ধর্মবিহীন নরকের কীটে পরিণত করেছে।মানুষকে ধর্ম সম্বন্ধীয় ঠিক জ্ঞান থেকে দূরে রেখে ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যা করে মানষ জাতির চরম শত্রুতা করেছে। সকল মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখতে শিখিয়েছে।মানুষের কল্যাণের কাজগুলো গোষ্ঠীবিশেষের হাতে সীমিত রেখে বাকী মানুষকে সত্যি কথাটা জানতে দেয়নি।জানতে দেয়নি তারা মানুষের সত্যিকারের কল্যাণকৃত্, না অকল্যাণকৃত্।মানুষের সামনে এক লৌহ-যবনিকা, মসীকৃষ্ণ অজ্ঞতার পর্দা টাঙ্গিয়ে রেখে মানুষকে ছককাটা কতকগুলো বাঁধা কথা বলতে শিখিয়েছে।জীবনধারাকে ক্ষুদ্রপ্রকোষ্ঠের মধ্যে রেখে তার দ্বার আর বাতায়নগুলোকে রুদ্ধ করে মানুষকে অন্ধকারের পেচকে পরিণত করেছে।এ সবই ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের ফলশ্রুতি।
তাই একটু আগেই বললুম,আবারও বলছি, মানুষের মনের সংরচনাকে গড়ে দেয় সর্বস্পর্শী দর্শন যাতে রয়েছে আকাশের উদারতা আর ঊর্মিচঞ্চল সমুদ্রের স্পান্দনিক বিশালতা। যে দর্শন তা করতে পারে না সে দর্শন মানুষকে ডগমার অন্ধকূপে নিমজ্জিত করে তার ঐহিক,পারত্রিক তথা সর্বলৌকিক বিকাশকে কষ্টিপাথরের কঠোরতায় অবরুদ্ধ করে দেয়।মানুষ ভুলে যায় প্রজ্ঞার অবাধপ্রসারী মানবাস্তিত্বের প্রধান বৈশিষ্ট্য।সেই বৈশিষ্ট্য টুকু খুইয়ে ফেলে কেবল উদর-উপস্থ জীবে পরিণত হলে মানুষের যা কিছই থাকুক না কেন,মানুষ আর যা কিছুই পা’ক না কেন,মানুষের পরিচিতি বহনের যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে।তাই মানুষের কর্তব্য এমন একটা সর্বস্পর্শী দর্শনকে অন্তর দিয়ে দু’ বাহু প্রসারিত করে গ্রহণ করা যা কোন অবস্থাতেই তাকে মানবতার বিরুদ্ধে যেতে বলবে না বা যেতে প্রত্যক্ষ তথা পরোক্ষ প্রোত্সাহন দেবে না।
—-শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তি
ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বলে যে ব্যপারটা আছে সেটা জেগে ওঠে এমন সব কঠিন অথচ চমৎকার লেখা দেখলে। আগের দুটো পর্ব বুঝতে চেষ্টা করছি, এটাও। এপর্যন্ত এটুকুই বলতে পারি যে জীবনকে, মহাবিশ্বকে কত ভাবেই না দেখা যায়।
//ক্যালিফোর্নিয়ায় যখন কেউ বলেছিল যে সেখানে অনেক মানুষ ‘laid back’ অবস্থায় আছে তারও আগে থেকে সেখানকার অনেক মানুষ টাবভর্তি গরম পানিতে ডুবে থাকত, আয়েশে দিন কাটাত এবং মাদকদ্রব্য ব্যবহার করত। এই নতুন শব্দটা আবিষ্কৃত হওয়ার ফলে সুবিধা যা হয়েছে তা হলো মানুষ বুঝতে পেরেছে যে, এই কাজগুলো একে অপরের সাথে বেশ খাপ খায়। দিন দিন আরো বেশি মানুষ এতে যোগ দিতে থেকেছে এবং ফলশ্রুতিতে এমন আরো অনেক লোকাচারের জন্ম হয়েছে। এভাবেই ভাষা খুব চমৎকারভাবে বিভিন্ন লোকাচার একীভূত করার মাধ্যমে সেগুলো সংরক্ষণ ও বর্ধন করতে পারে। হাইডেগারের মতে, ধর্মযাজক বা বিজ্ঞানীরা নয়, বরং কবি ও চিন্তাবিদেরাই নতুন ভাষা গ্রহণোন্মুখ এবং সে কারণে তারাই বিরাজনের নতুন উপায়কে অগ্রসর করতে পারে ও স্থায়িত্ব দিতে পারে। সুতরাং ভবিষ্যতে কোনো অ-ব্যক্তিক, অ-স্বেচ্ছাচারী নতুন বিশ্ব পাবার ক্ষেত্রে তারাই আমাদের একমাত্র ভরসা।
লেখাটা পড়ে নতুন কিছু উপলব্ধি করলাম । চমৎকার লেখা।