গোটা পৃথিবীব্যাপি আদি এ অধিবাসীদের নিজস্ব ভুমি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে এবং সে উচ্ছেদ অভিযান চলছে এখনো বিরামহীনভাবেই। এশিয়া থেকে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা সবখানেই এ আগ্রাসন। কোথাও সে দস্যুপনা চলছে প্রতিরোধহীনভাবে; কোথাও প্রতিরোধের মুখে পড়ে থেমে থেমে আইনী চতুরতার মাধ্যমে। কানাডার এ ইরাকুয়া অধ্যুষিত সিক্স নেসন্স পল্লীতেও ভূমির অধিকারের সংগ্রাম চলেছে অনেকদিন থেকেই।
ইরাকুয়া টোটেম পোল
ইরাকুয়াদের ভুমির অধিকার ও সংরক্ষণের সংগ্রাম অন্যদের চেয়ে একটু জটিল। ইরাকুয়াদের ভূমির অধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রামে প্রতিপক্ষ হলো কানাডার ত্রিস্তর বিশিষ্ট সরকার ব্যবস্থাপনার তিনটি শক্তিশালী অংশ যথা স্থানীয়, প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার। তাই বড় দুরূহ এ প্রতিপক্ষ।
একদিন স্থানীয় এক ইরাকুয়ার সাথে আলাপে সেটাই মনে হলো। কিন্তু হাল ছাড়তে নারাজ ভূমির এ আদিসন্তানেরা। তাই তো মাঝে মাঝেই প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পুলিশ প্রশাসনের সাথে ইরাকুয়াদের প্রতিবাদ, ব্যারিকেড ইত্যাদি প্রতিরোধ আন্দোলনের খবর প্রায়শঃই স্থানীয় ও প্রাদেশিক গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্রে ছাপা হয়। কিন্তু কোথায় তাঁদের এ প্রতিরোধ আন্দোলনের শেকড়? সেটার সন্ধানেই সিক্স নেসন্স ইরাকুয়া পল্লীর ভুমির অধিকার রক্ষার ইতিবৃত্ত খুঁজতে শুরু করলাম।
১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশ ও আমেরিকান কলোনিস্টদের যে যুদ্ধ হয়, ইরাকুয়ারা সেখানে ব্রিটিশ ও আমেরিকান কলোনিস্টদের পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে জিতিয়ে দেন। এরপর ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের সাথে যখন আমেরিকান কলোনিস্টদের যুদ্ধ বাধে সেখানে ইরাকুয়ারা ব্রিটিশদের পক্ষাবলম্বন করেন। এই পরের যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে নবগঠিত আমেরিকান কনফেডারেশন্স থেকে ইরাকুয়ারা ব্রিটিশদের অঞ্চল কানাডার এই অংশে সরে আসেন। ইরাকুয়াদের দুই যুদ্ধ অংশগ্রহন ও বীরত্বের জন্য ব্রিটিশদের সাথে ইরাকুয়ারা একটি ভূমিচুক্তি করেন ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে; যার নাম “হেল্ডিম্যান ভূমি চুক্তি”। এই ‘হেল্ডিম্যান ভুমি চুক্তি”-ই সিক্স নেশন্স ইরাকুয়াদের ভূমি অধিকার ও সংরক্ষণ আন্দোলনের মূল দলিল।
কানাডার ইরাকুয়া আদিবাসী
১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের এ চুক্তি অনুযায়ী ৯৫০,০০০ একর জমি ইরাকুয়াদের দেয়া হয় বসবাস, শিকার করে জীবিকা নির্বাহ এবং এই অঞ্চল দিয়ে প্রবাহমান “গ্রান্ড রিভার” নদীর জলাধারের উৎস হিসেবে। ইরাকুয়া পল্লীর ভিতর দিয়ে “গ্র্যাণ্ড রিভার” নদী বয়ে চলে গেছে কয়েক শ’ বছর। ইরাকুয়া সিক্স নেশন্সদের জনসংখ্যা বেড়ে গেছে কয়েকশ’ গুন। কিন্তু ভূমির পরিমান কমে গেছে তারচেয়েও বেশী।
পরিসংখ্যান মেলে ধরলেন এক “মোহাক” গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ইরাকুয়া আদিবাসী একদিন। সে পরিসংখ্যান মতে, ২০১২ খ্রিস্টাব্দে ইরাকুয়া জনসংখ্যা ২৪,০০০ এবং ভুমির পরিমান মাত্র ৪৬,০০০ একর। অর্থ্যাৎ ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দের চুক্তির ৯৫০,০০০ একর জমির মাত্র ৫ শতাংশ এখন আদিবাসী ইরাকুয়াদের অধীনে। বাকী ৯৫ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে উড়ে এসে জুড়ে বসা অভিবাসীরা। গড়ে উঠেছে প্রায় কয়েক ডজন ছোট বড় শহর-বন্দর। আদিবাসীদের নিজস্ব ভূমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় ৯ লক্ষ মানুষের আবাস। অথচ নিজ বাসভূমিতে পরবাসী হয়ে এই ৪৬,০০০ একর জমির অধিকার সংরক্ষণেও এখন গলদঘর্ম হ’তে হচ্ছে এই ভূমিপুত্র ইরাকুয়াদের।
প্রায়শই যেমন যাই, একদিন বিকেলে তেমনি করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম ইরাকুয়া সিক্স নেশন্সস পল্লীতে। শহরের চাকচিক্য কোথাও নেই। নেই স্বচ্ছলতার ছিঁটেফোটা চিহ্নও। ট্যাক্সমুক্ত গ্যাস ও তামাকজাত পন্যের মূল্য এখানে অনেক কম। ফলে আশপাশের শহর থেকে অনেকেই এখানে আসে সাশ্রয়ের লোভে। সে রকম কিছু গাড়ী। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কয়েকটা দোকান। ভিতরে ঢুকলে দেখা যাবে প্রায় অধিকাংশ সামগ্রীই নেশা ও ক্ষতিকর তামাক ও এলকোহল জাতীয়। যেখানে কানাডার প্রায় অধিকাংশ স্থানেই প্রকাশ্যে তামাক জাতীয় সামগ্রী ও এলকোহল বিক্রি নিষিদ্ধ, সেখানে আদিবাসী পল্লীগুলোতে এসকল সামগ্রীর সহজলভ্যতা দেখে বিস্মিত হতেই হয়।
ইরাকুয়া পল্লীর এক বিকেল
প্রধান সড়ক থেকে একটু ভিতরে গেলেই থোক থোক জীর্ণ-শীর্ণ ঘর। কোনটা কোনমতে টিকে আছে। কোথাও ঘরের চারদিক মোটা পলিথিন কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। গরমের দিনে এ রকম রেখেঢেকে চলে। কিন্তু তাপমাত্রার পারদ যখন শূন্য থেকেও আরো ৪০ ডিগ্রী সেলসিয়াস নিচে নামবে তখন?
ভাবনার বিন্দু কল্পনার বৃত্ত ছাড়িয়ে দুঃশ্চিন্তার দিগন্তে উড়ে যেতে না যেতেই মনে হলো,তবুও তো আছে মাথাগোঁজার এতটুকু ঠাঁই ইরাকুয়াদের। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জায়গা থেকেই তো উচ্ছেদ শুধু নয়, নির্মূল-নিঃচিহ্ন করে দেয়া হচ্ছে ভুমির এ আদিম সন্তানদের। একদিন এ সকল বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিল এক ইরাকুয়া “মোহাক” গোত্রের আদিবাসীর সাথে কোন এক পউওউ উৎসব মেলায়।
তার কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ সরকারের এক প্রতিনিধি দল জাতিসংঘে গিয়ে বলে এসেছেন যে, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই। পার্বত্য চট্রগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যাঁরা বসবাস করেন, তাঁরা হলো নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। অথচ যাঁরা হাজার হাজার বছর যাবৎ বসবাস করে এসেছেন নিজেদের সংস্কৃতি-কৃষ্টি-জীবনযাপন প্রনালী নিয়ে,যা দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র, তাঁরাই তো হলেন আদিবাসী। আদিবাসীদের এ সংজ্ঞা ইন্টারনেশনাল লেবার অর্গানাইজেশন বা আইএলও কনভেনশন-১৬৯ দ্বারা স্বীকৃত। শুধু আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতই শুধু নয়, বাংলাদেশের নৃতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতেও বাংলাদেশের ভূমির এ আদি সন্তানেরা পার্বত্য চট্রগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন এবং দেশের সংখ্যাগুরু মানুষের কাছেও তারা আদিবাসী হিসেবেই পরিচিত। অথচ ২০১১ সালে এসে ঘোষনা করা হলো এরা আদিবাসী নয়, নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী।
আমার কাছ থেকে বিশদ শুনে খুব আগ্রহ ভরেই তাকিয়ে রইলেন বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ কানাডার প্রাচীনতম এক আদিবাসী জনগোষ্ঠীভুক্ত এ সহজ সরল মানুষটি। তাঁর চোখে মুখে নিদারুণ ঔৎসুক্য। জানতে চাইলেন প্রবল আগ্রহ ভরে, আদিবাসীদের প্রতি এ অবিচারের কারণ কি ভূমি দখল? আধিপত্য বিস্তার? আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে ন্যায্য অধিকার দিতে হবে রাষ্ট্রীয়ভাবে, সে আশঙ্কা?
কী উত্তর দেবো ভেবে না পেয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম ফ্যাল ফ্যাল করে তাঁর মুখের দিকে। আদিবাসীদের প্রতি অত্যাচার, অবিচার ও ভূমি থেকে উচ্ছেদের চিত্রটি বুঝি পৃথিবীব্যাপি এক ও অভিন্নই।
তামাক, মাদক, নেশা আদিবাসীদের সংগ্রাম ও প্রতিবাদী চেতনা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এক কার্য্যকরী এবং বিশ্বব্যাপী অতিপরিচিত কৌশল। দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ও লক্ষ্যের প্রতি অবিচল সংগ্রাম ছাড়া মুক্তির আর কোনো উপায় নেই।
বিশ্বের সর্বত্র আদিবাসীরা বঞ্চনার শিকার হ্যেছে,হচ্ছে। তারা তাদের মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে ও উচ্ছেদ হওয়ার পর্যায় এসেছে। এর জন্য কোন স্রকাররেরই মাথা ব্যাথা নেই। আদিবাসীদের স্রলতার সুযোগ নিয়ে আমাদের মত শিস্কিত ভদ্র মানুষেরা ওদের মাটি থেকে বঞ্চিত করছে। এদের বিভিন্ন ধরনের নেশা করার স্মগ্রী দেওয়াতে, এরাআ নেশা করে নিজেদের হারিয়ে ফ্লে। ের সুযুগে শিস্কিত লোকেরা কম আর্থে ওদের মাটি নিয়ে নেয়। প্রত্যেক দেশের সরকারকে আদিবাসীদের উপর লস্ক্য রাখতে হবে, যেন ওদের কেউ মাটি থেকে বঞ্চিত করতে না পারে।
আদিবাসীদের নেশা করার বিষয়টিও আদি। বাংলাদেশেও এর খুব বেশি ব্যতিক্রম নয় । ভূমিপুত্র ইরাকুয়াদের তবুও রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি আছে আমাদের দেশের আদিবাসীদের তাও নেই।
মাদক ও নেশা জাতীয় দ্রব্যের সহজলভ্যতার জন্য মাদকাসক্তির হার জাতীয় হারের প্রায় দ্বিগুন। আবার ইনুইটস ও মেটিস ( উত্তর মেরুর কাছাকাছি টেরিটরিগুলোতে যাদের বাস) আদিবাসীদের মধ্যে এ হার আবার ফার্স্ট নেশন্সদের প্রায় দ্বিগুন। আদিবাসীদের মধ্যে এ মাদকাসক্তির মারাত্মক প্রভাব দেখা যায় পরিবারগুলোতে। তাই প্রায় অর্ধেক আদিবাসী শিশু দারিদ্রের মধ্যে বাস করে। এ হার আবার দুই-তৃতীয়াংশ কোন কোন প্রদেশ ও টেরিটরিতে। পরিসংখ্যানের অন্যান্য সূচকের দিকে তাকালে ভাবতেই কষ্ট হয় যে, এ আদিবাসী জনগোষ্ঠী কানাডার মতো এক উন্নত দেশে বাস করে।
এটা কী জীবন ধারনের জন্যে? ব্যবসা?
চারধারে লোভই কী মানবতা খেয়ে নিলো? কানাডাকেও?
আমাদের দেশের পাহাড়েও মাদকের ছড়াছড়ি। মদ ছাড়াও আছে গাজা, হেরোইন, ইয়াবার বিস্তর বিস্তার। আর তমাকের চাষ ত্তো অবাধ। এটি হচ্ছে বিদ্রোহ ভুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর কৌশল।
এসবের বিরুদ্ধে চাই “আফিম বিপ্লব”, প্রচণ্ড প্রতিবাদ।
নোটটি চিন্তাশীল, ব্যতিক্রমী। শেয়ার দিলাম।
আমিও সেরকম কিছুই অনুমান করেছিলাম
কানাডাতেও এই অবস্থা? অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও এরকম দেখা যায়।
কি হুবহু মিল ইরাকুয়া আদিবাসীদের সাথে বাংলাদেশের আদিবাসীদের……একটি উন্নত বিশ্বের চিত্র আর আরেকটি অ-উন্নত বিশ্বের।
সংগ্রাম এবং প্রতিবাদ চলুক এবং জীবনের মানেই যে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা সেটা ব্যক্তি থেকে পরিবারে,সমাজে,রাষ্ট্রে এবং সর্বোপরি সর্বত্র এবং বিশ্বের আনাচে কানাচে।