দিবালোকের মতো প্রতিষ্ঠিত হলো এক সত্যদর্শীর অনুভব, চিন্তা, চেতনার মাঝে অবয়ব পাওয়া এক উপমা! বিশ্বাসের ভাইরাস!মুক্ত-মনা এবং এর বাইরের ব্লগ গুলোতে এ নিয়ে কতো যে বিতর্ক! আমার মনে হতো বিশ্বের তাবৎ বিতার্কিকরা তীরন্দাজ! লক্ষ্য ডঃ অভিজিৎ রায়! এক পর্যায়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি যেতো হাড়িয়ে, তার বদলে উগড়ে দিতো অশ্রাব্য ভাষা। অথচ তারও জবাব দিতেন ডঃ অভিজিৎ এতো সুনিপূন ভাবে যে আমি সত্যিই আশ্চর্য হয়ে ভাবতাম, যুক্তির এ কঠিন দেয়াল তিনি এতো সহজে গড়তেন কিকরে! অসম্ভব মেধাবী আর তীক্ষ্ম স্মরণ শক্তি না হলে এ কোনভাবেই বিনির্মান সম্ভব নয়। যুক্তির দেয়ালে ধাক্কা ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে বের করে আনতে হয় পথ এবং পথের দিশা! এর জন্যে যেমন দরকার অধ্যাবসায় তেমনি ধৈর্য্য। একজন মানুষের সৃষ্টিশীলতার মধ্যেই তার মেধার মাধুর্য্য ফুটে উঠে। যেটা ছিলো পূর্ণভাবে তাঁর মাঝে। এই যে এতো বড় এক পরিবার মুক্তমনা, কি যত্নে তিনি তা গড়েছেন সেই প্রথমদিন থেকে, আমি দেখেছি এর কিছুটা। এক সময় বাংলায় লিখতে পারতামনা, ডঃ অভিজিৎ আমাকে পথ দেখিয়েছিলেন, বানানের হযবরল অবস্থা পরম মমতায় শুধরে দিতেন ফরিদ ভাই! শুধু তাই নয় এখানে যারা যখনই এসেছেন পরম আদরে টেনে নিয়েছেন ভেতরে সবার মাঝে। আর এই পরিবার নিয়ন্ত্রনের কাজটুকু উদার ভাবে করতেন অভিজিৎ দা। আমি নিজেও খানিকটা বই এর পোকা। আমি উপলব্ধী করতাম ডঃ অভিজিৎ কতো সময় দিতেন পড়াশুনায়। ব্যক্তিগত মেইলে যা আবদার করতাম বিশেষ করে তথ্যের, আমি নিশ্চিত থাকতাম এক ঘন্টার মধ্যে সে তথ্য আমার মেইল বক্সে আসবেই! এমন এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া তিনি আমার কাছে ছিলেন! যেদিন তাঁর স্ত্রী বন্যাদির ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বইটি হাতে নিলাম, মলাটের প্রচ্ছদের দিকে তাকিয়েই মনে হয়েছিলো যা খুঁজছি তা পেয়েছি! মাত্র দেড় দিনে শেষ করা বইটির পরে বিবর্তন নিয়ে যেকোন আলোচনায় আমার এক ধরনের স্বচ্ছ স্বাচ্ছন্দ্য ছিলো, এখনো আছে। বিবর্তন তো আগেও পড়েছি, কিন্তু এ বইটি পড়ার পরে যে বিশ্লেষনী দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পেয়েছি তা অনন্য! বিজ্ঞান মনস্কতার বিস্তারে, কূপমন্ডুকতার দেয়াল ডিঙ্গিয়ে এক অপার খোলা আকাশের নীচে আমাদের অবস্থান হোক এইই ছিলো ডঃ অভিজিৎ রায়ের ধ্যান ও জ্ঞান। মুক্তমনায় লিখতে গিয়ে যে কতো নির্বোধের মতো ভুল করতাম, নিজেই নিজের উপড়ে বিরক্ত হতাম; কিন্তু তিনি সাহস দিয়ে যত্ন নিয়ে বলতেন কোন যায়গাটায় খেয়াল রাখলে এমনটি হবেনা! বলুন এমন মানুষকে কি ভাই বন্ধু বলবো না শিক্ষকের মতো কেউ, এমন বলবো?

মুক্তমনায় যেদিন যোগ দিই, অভিজিৎ রায়কে সেদিন আমার উপলব্ধী বলেছিলাম। হবহু তো মনে নেই তবে এমনটি বলেছিলাম যে এ যেনো নিজের বাড়ির ড্রিইংরুম! বিস্তর আড্ডা, বিষয়ের শেষ নেই! আদিগন্ত জ্ঞান সমুদ্রে ভাসছি অথচ ডুবে মরার কোন সম্ভাবনা নেই! সবার হাতে তথ্যের লাইফ জ্যকেট নিদেন পক্ষে তো বয়া আছেই! প্রত্যেক সদস্য বই, পত্র-পত্রিকা, অন্তর্জালের তথ্য, পাবলিক লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগাঢ়, আর ন্যাচার, সাইন্স সহ হাজারো জর্নারের রেফারেন্স সহ উপস্থাপিত এক একটি প্রবন্ধ কিংবা আলোচ্য বিষয় কিংবা সংবাদপত্রের কোন সংবাদের যে চুলচেরা বিশ্লেষন নিয়ে হাজির হন এখানে তা বিষ্ময়করই বটে। এমন একটি ফোরামের জন্ম দিয়েছিলেন ডঃ অভিজিৎ রায়। পরিচালনা করতেন। এখানে কথা বলার উপড়ে নেই কোন বাধা যদি তা যুক্তি, তথ্য-উপাত্য ও তথ্য বিবরণীর মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় অথচ ভব্যতা-বোধের সীমাকে অতিক্রম না করে। বিদ্বান-সজ্জন আর উজ্জ্বল মানুষের ভীড়ে আজও মুক্তমনা আলোকিত! শুধু এ আসরের মধ্যমণিদের একজনকে আমরা অকালে হারিয়েছি এক শ্বাপদের বিষাক্ত আচমকা জান্তব আক্রমনে। মুক্তমনার মৃত্যু নেই, ডঃ অভিজিৎ রায় বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে যে কলম হাতে তুলে দিয়ে গেলেন সে কলমের শিখা অনির্বাণ!

যে মৌলবাদী শ্বপদেরা এই কাপুরুষোচিত আক্রমন করে আমাদের অভিজিৎ রায়কে হত্যা করেছে, একবারো কি তারা ভেবেছে যে তাদের সৃষ্টিকর্তা কতোটা কাপুরুষ! একজন নিরস্ত্র কলমধারীকে স্তব্ধ করতে তাদের সৃষ্টিকর্তাকে আশ্রয নিতে হয়েছে জনাকতক জন্তুকে! তাও আবার চোরের মতো লুকিয়ে পেছন থেকে আক্রমন! ছিঃ। সেই তাকে তোমরা ঈশ্বর বলো, আল্লাহ-রসুল বলো, ভগবান-কৃষ্ণ বলো, বলো যেহবা-যীশু! ধিক, ধিক তোমাদের সৃষ্টিকর্তাকে! তোমরা বলেছিলে পৃথিবী স্থির, সূর্য সহ অপরাপর চন্দ্র-তারা, গ্রহ-কেতুরা পৃথিবীকে কেন্দ্রকরে ঘোড়ে। তোমাদের ঈশ্বরের বাণীবুকে তা লিপিবদ্ধ ছিলো! সেটি যে সত্য নয় তা প্রকাশের দায়ে তোমরা ব্রুনোকে হত্যা করেছিলে! গ্যলিলিওকে করোছিলে আমৃত্যু নির্যাতন। তাতে কি তোমাদের বাণীবুকের সিদ্ধান্ত অটল ছিলো? তোমাদের তথাকথিত বাণীবুকে সমতল ধরাধামের কথা উল্লেখিত আছে! তোমাদের সৃষ্টিকর্তার লিখিত বাণীবুক এমন এমন ভুলে ভরা হলো কি করে? ভেবেছো একবারো? এমন ছন্নছাড়া স্বল্প মেধার সৃষ্টিকর্তা তোমাদের যে তিনি নিজেই সৃষ্টিকরে ভুলে গেলেন কি আর কিভাবে সৃষ্টি করেছিলেন! তাই আবার তোমরা মানো! গর্বও করো! যারা স্ববিবেচনায় সংশয়ী হয় তাকে হত্যাও করো পেছন থেকে পশুর মতো আচমকা আক্রমনে? এই তোমাদের তথাকথিত সৃষ্টিকর্তার শক্তির মদমত্ততা! অপার দয়া আর সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের অধিকর্তা!

ছোট বেলায় ছোটবোনের পুতুল খেলা দেখতাম! মাঝে মাঝে তার সাথে খেলতামও পিঠাপিঠি ছিলাম বলে! আমি হাট-বাজার করতাম, সে পুতুলের সংসার সামলাতো! পুতুলেরা দুষ্টুমী করতো! কথা শুনতো না! বেয়াদপী করতো! শাস্তিও দিতাম! কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকো, নয়তো নিলডাউন হয়ে থাকো এরকম আর কি….! কিন্তু তাই বলে মেরে কেটে ফেলতাম না! হাজার হলেও নিজ হাতে গড়া কাপড়ের পুতুলতো! পরমযত্নে শ্রমে, ঘামে, মেধায় ওরা আমাদের হাতেই সৃষ্ট! সেই শিশু মনে যে দরদ, সে দরদ কি তোমাদের সৃষ্টি কর্তার আছে? নাই, থাকলে তিনি সৃষ্টিকে খুন করতে এসব শ্বাপদ-দের পাঠাতেন না। থাকবেইবা কি করে, তিনি কি সৃষ্টি করেছেন? প্রকৃতির নিযমেই যেমন মানুষের আবির্ভাব তেমনি প্রকৃতির নিয়মেই কিছু মানুষের মাঝে পশু সত্ত্বার জিন ভেতরে ভেতরে ক্রিয়াশীল! বিশ্বাসের ভাইরাস এদের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে অনেক বেশী। তাই মানুষের মাঝে মিশে থেকেও এরা পশুর মতো হিংস্রতা নিয়ে আবির্ভূত হয়।

যুগে যুগে ধর্মের জন্যে যে রক্তক্ষয় হয়েছে এ বিশ্বে, আর কিছুতেই তা হয়নি! তাই মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ম কি মানুষের জন্যে নাকি মানুষ ধর্মের জন্যে? ডঃ অভিজিৎ জিঘাংসার শিকার হয়ে আত্ম বলিদানে প্রমান করলেন বিশ্বাসের ভাইরাসের ভয়ঙ্কর তর্জন-গর্জন ও উপস্থিতি! সেই তর্জন-গর্জনই সার হবে অন্যান্য বালাইয়ের মতো যুগের ক্রান্তিকালে। সভ্যতা এগিয়েই চলে। সাধ্যকার সে চাকার গতি উল্টোমুখ করে? যে হাতে নাঙ্গা চাপাতি মানুষ খুনে আজ উদ্যত স্বাধীন মতপ্রকাশের বিরুদ্ধে সেই হাতে গড়া কচি মুখটাই হয়তো একদিন চোখতুলে এই অপার বিশ্বকে দেখবে বিমুগ্ধ চিত্তে আর ভাবে তার উত্তর সূরীর অর্বচীনতার কথা! সেইটেই হবে এই ক্ষনজন্মা মানুষটির গ্রন্থিত জীবনের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে থাকা লিপির স্বার্থকতা।

আমরাই অভিজিৎ…! অভিজিতের মৃত্যু নেই, নেই পরাজয়! আছে শুধু জ্ঞানে, মননে, মানবিকতায় উজ্জ্বল সীমাহীন এগিযে চলা এক বিজ্ঞানমনস্ক আধুনিক সংস্কৃতি!