বলতে দ্বিধা নেই কোনো, আমার দেখা সমসাময়িক অনেকের মাঝে প্রয়াত ডঃ অভিজিৎ রায় ছিলেন সব থেকে বেশী ধৈর্য্যশীল একজন মানুষ । আমি তাঁকে অভিজিৎ দা বলে ডাকতাম । প্রায় বছর চারেক আগের কথা, আমি যখন কানাডা পাড়ি জমাই, লেখক কাজী মাহবুব হাসান আমাকে মুক্তমনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন । আমি অভিজিৎ দাকে ছোট্টো একটা ইনবক্স করি, তাঁর উদ্যেগের প্রসংশা করে । আর শেষ বারের মতো গত ২৪ ফেব্রুয়ারী অভিজিৎ দা আমাকে ইনবক্স করেন । তিনি ঢাকাতে জানতে পেরে আমি কিছুটা উদ্বিগ্ন হই কিন্তু তাঁকে তেমন কিছু জানতে না দিয়ে শুধু সংক্ষেপে বলি ‘সাবধানে থাকবেন’ । সেই হবে শেষ কথা দু:স্বপ্নেও ভাবিনি ।

বলতে সংকোচ বোধ করছি, অভিজিৎ দা আমাকে বহুবার লেখার অনুরোধ জানিয়েছেন আমি সময়ের অভাবে পারিনি তাঁর অনুরোধ রাখতে । তবে হয়তো আমি একজন ভিজ্যুয়াল মানুষ হিসেবে খুব দ্রুত ইমেজ নিয়ে কাজ করতে পারি বিধায় দাদা যখনই পোস্টার করে দিতে বলেছেন আমি চেষ্টা করেছি , আর নিজের মধ্যকার অপরাধবোধকে কিছুটা হলেও সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করেছি । আজ আমার লেখা অভিজিৎ দা দেখতে পাবে না সে কষ্টের থেকে বড় কষ্ট হয়তো আর কিছু হবে না । তবে আমি এতটুকু সৎ ছিলাম যে আমার পুরাতন কোনো লেখা দিয়ে মুক্তমনাতে লেখা শুরু করতে চায়নি বলেই সময় নিচ্ছিলাম । মনে মনে এমন একটা বিষয় খুঁজছিলাম যা কিনা, শিল্পকলা ও মুক্তচিন্তা বা বিজ্ঞান মনস্কতা কে একই সরল রেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারবে । এমন একটা বিষয় বস্তুকে মাথায় রেখে আমি ধারাবাহিক ভাবে লিখে যাবো । আমাকে যারা অল্প বিস্তর জানেন, তারা জানবেন আমি হলাম হাজার আইডিয়ার মানুষ , যার বেশির ভাগই শেষ করতে পারি না সময়ের অভাবে । যদিও আমি আমার পুরাতন একটা লেখা দিয়ে শুরু করছি কারণ এটাকেই আমার সময় উপোযোগি মনে হয়েছে, তবে আমি অবশ্যই আমার পুরাতন পরিকল্পনা অনুযায়ি লিখবো মুক্তমানাতে ।

avijit_da_26
অভিজিৎ রায়

আবারো বলছি অত্যন্ত সংকোচিত মনে ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে যে, আমরা হয়তো কারো উপস্থিতি বা তার কর্মতৎপরতা ততটা বুঝে উঠতে পারি না যতক্ষন না তাকে আমরা হারায় আমাদের জীবন থেকে । অভিজিৎ দা কে এমন অকালে হারাবো আমি হলফ করে বলতে পারি মুক্তমনা পরিবারের কোনো সদস্যই ভাবতে পারেননি। আমিও না, মনে হতো বা জানতাম দাদা আছেন কাজ করছেন, যে কাজ কেউই করেনি বাংলাদেশে, যে কাজ দাদা ছাড়া কারো পক্ষেই করা সম্ভব নয় ; এমন সাংগঠনিক ক্ষমতা ও দক্ষতা খুব কম মানুষের মধ্যে মেলে, আমাদের সমসাময়িক বাংলাদেশীদের মধ্যে । জানতাম দাদা আছেন পাশে, প্রয়োজন হলে আমি কাজ করে দেই; অপ্রয়োজনেইও দাদা কে বিরক্ত করবো; দাদা তো পাশেই আছেন । যেদিন দাদাকে হারালাম মনে হলে চোখের মনি থেকে একটা আলো হারিয়ে গেলো । আরো মনে হলো মাথার উপরের ছায়াটা হারিয়ে গেলো । ভয় হতে লাগলো, আমাদের মুক্তচিন্তার ও যুক্তির কথা বলার আর কাজ করবার প্লাটফর্মটা হারিয়ে যাবে না তো ?

আমরা জানি অভিজিৎ দা এর শূন্যতা আমরা পূরণ করতে পারবো না তবে, আমরা আমাদের কাজের মাধ্যমে তার চিহ্নিত অন্ধকারকে কিছুটা হলেও দূর করতে পারবো । আমাদের যে যার অবস্থান থেকে সেই কাজ গুলো করে যেতে হবে । আমার মনে হয় ব্যক্তিগত ভাবে যে আমরা ইতিমধ্যেই অন্ধকার বা অন্ধারের কারণগুলো কে চিন্হিত করেত পেরেছি, আমাদের উচিৎ এখন আলোর সন্ধান দেয়া । সেটা আমরা যে যার কাজের মধ্যমে করতে পারবো । যিনি লেখক তিনি লিখবেন , যিনি ভাস্কর তিনি ভাস্কর্য গড়বেন, যিনি চিকিৎসক তিনি চিকিৎসা করবেন, যিনি প্রকৌশলী তিনি নির্মাণ করবেন, যিনি দাশর্নিক তিনি চিন্তা করবেন, যিনি শিল্পী তিনি সৃষ্টি করবেন, সবাই কে অন্ধকারের পিছে ছুটতে হবে এমন কেনো কথা নয় বা সবাইকেই যে লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করতে হবে সেটাও নয়, অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াসের মাধ্যমে প্রতিবাদ ও প্রতিকার করা সম্ভব । আমি আমার সৃষ্টির মাধ্যমে সেই অন্ধকার দূর করতে চেষ্টা করি, যার মাঝে আমি নিজেই একদিন শ্বাসবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিলাম ।

Print

অভিজিৎ দা এর এমন অকাল অপমৃত্যু প্রথম নয় এবং এটাই শেষ নয়। আমার অনেক দিন সময় লাগবে এই ঘটনাকে সত্য বলে মেনে নিতে বা আমি হয়তো কখনই পারবো না মেনে নিতে । আমি অত্যন্ত স্পর্শকাতর একজন মানুষ, যার কারণে হয়তো আমি শিল্পী । আমি যেমন মেনে নিতে পারিনি আমার সহপাঠি ও বন্ধু ইসমত মনির মৃত্যুকে, ১৯৯৮ সালে এক সড়ক দূর্ঘটনায় সে প্রাণ হারায় । আমার শিল্পী বন্ধুটি ছিলো আমার দেখা প্রথম মুক্তমনা একজন মানুষ । সে আসলে সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়নি, ভুল হবে সেটা বললে । সে মারা গিয়েছিলো রাষ্ট্রের ধারাবাহিক অবহেলার কারণে ঠিক যেমন দাদার ক্ষেত্রে হয়েছে । মনি দূর্ঘটনার পরে বেঁচে ছিলো, ফার্মগেটে ঘটে যাওয়া দূর্ঘটনার সময় পুলিশ উপস্থিত ছিলো কিন্তু কোনো দায়িত্ব পালন করেনি , দায়িত্ব পালন করেনি ঢাকা মেডিকেলের কোনো চিকিৎসকও, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মনির মৃত্যু হয় রাত ৯টার সময়, তার দূর্ঘটনা ঘটেছিলো দুপুর ২ টা সময় । সেই উনিশ বিশ বছর বয়সে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ,স্বরাষ্ট মন্ত্রির কাছে গিয়েও কোনো বিচার না পেয়ে আমি বুঝে গিয়েছিলাম এ সমাজে মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই ….

আমি আজো মানতে পারিনি সেই অকাল মৃত্যুকে । মনির অর্পূণ রয়ে যাওয়া স্বপ্নকে আমি সফল করার চেষ্টাকরি আমার সৃষ্টির মাধ্যমে , আমি চেষ্টা করি যে অদ্ভুত আধাঁর দেশটাকে ঘিরে ধরেছে সেটার চাদরটাকে ছিড়ে ফেলতে । আমি চেষ্টা করে যাবো অভিজিৎ দা এর যে স্বপ্ন ছিলো মুক্তমনের সমাজ গড়ে তোলা, সেই স্বপ্নের কিছুটা দায়ভার নিতে । অভিজিৎ দাকে হারিয়ে আমারা যেনো হরালাম আমাদের এক সক্রেটিসকে এবং বড্ড অসময়ে ! আমার আজ শিল্পী জাক-লুই ডাভিড এর আঁকা ‘দ্যা ডেথ অব সক্রেটিস’ চিত্রকর্মটির কথাই মনে পড়ছে বার বার ।

The_Death_of_Socrates

নিওক্লাসিসিজমের ফরাসী শিল্পী জাক – লুই ডাভিড (১৭৪৮-১৮২৫) এর আঁকা
দি ডেথ অব সক্রেটিস, ১৭৮৭, ৫১ বাই ৭৭ ১/৪ ইঞ্চি, ক্যানভাসে তৈলচিত্র

ফরাসী বিপ্লবের অনুসারী শিল্পীদের অনেকেরই গ্রীক ও রোমান থীমের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিলো। শিল্পী জাক-লুই ডাভিডও প্রাচীন সেই ক্লাসিকাল পিরিয়ডের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী ছিলেন । তিনি প্লেটোর রচনা ‘ফিডো ’ এবং সমসাময়িক বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে জ্ঞান লাভ করে তবে ‘দি ডেথ অব সক্রেটস’ চিত্রটি নির্মাণ করেন।

সেই ক্লাসিকাল সময়ের অনেক ব্যক্তিত্ব ও মহাপুরুষদের মধ্যে তারা তাদের আদর্শের প্রতিবিম্ব খুঁজতেন । বিপ্লবী দার্শনিক সক্রেটিস ( খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৪৬৯-৩৯৯ ) তাদের মধ্যে অন্যতম যিনি তাঁর আর্দশকে টিকিয়ে রাখতে আপোষ করেননি এবং অন্যায় ও অবিচারের শিকার হয়ে বিষপানে আত্মহত্যা করার দন্ডে দন্ডিত হয়েছিলেন।

এই চুড়ান্ত দন্ড তিনি মেনে নিয়েছিলেন ঠিকই, তাঁর নিজস্ব দর্শনকে পরিত্যাগ করার কোন চেষ্টা করেননি। অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসী বিপ্লবের অনুসারী এই শিল্পী নিজেকে খুঁজেছেন সেই ঐতিহাসিক ঘটনার মাঝে, নিজেকে অভিব্যক্ত করেছেন সমাজের প্রতিষ্ঠিত সব অন্যায়ের কেন্দ্র আদর্শে অনঢ় বীররুপে ।

এথেন্সের রাষ্ট্রপরিচালনাকারীরা সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে যে, সক্রেটিস কোনো ঈশ্বরের অস্তিত্ত্বে বিশ্বাস করে না এবং তাদের পুর্বপুরুষের ধর্মেও বিশ্বাসী নয়, এবং তিনি তার জ্ঞানের মাধ্যমে তরুণদের বিভ্রান্ত করছে সুতরাং তারা দাবি করেছিলো যে হয় সক্রেটিস তার ধর্ম বিশ্বাসের কথা সবাইকে ব্যক্ত করবে অথবা হেমলক বিষপানে আত্মহত্যা করবে । শিল্পী ডাভিড ১৭৮৭ সালে চিত্রটি নির্মাণ করেন এবং এটা সম্ভবত শিল্পী ডাভিডের আঁকা দার্শনিক ধ্যানধারণা নিয়ে সব থেকে সুনিপূন নিউক্লাসিসিজমের উদাহরণ ।

hb_31.45_av1

‘দি ডেথ অব সক্রেটিস’ তৈলচিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই, নির্ভিক দার্শনিক সক্রেটিস এক হাতে বিষের পেয়ালা তুলে নিচ্ছেন। অন্যহাতে তুলে প্রকাশ করছেন নিজের দৃঢ়তাকে । তাঁর হাতে বিষ তুলে দিচ্ছে একজন কারারক্ষী। টকটকে লাল টিউনিক পরিহিত রক্ষী লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে রয়েছে, হাতে চোখ ঢাকা তার, যেনো অত্যন্ত অনিচ্ছা ভরে সে এই অসীম জ্ঞানী আর সৎ মানুষটি হাতে হেমলকের বিষ মেশানো শেষ পান-পাত্র তুলে দিচ্ছে । তার গায়ের লাল যেনো মৃত্যুর কথাই ঘোষনা করছে ।

বিছানার প্রান্তে বসা ছাই রঙা চাদরে মোড়া ফিগারটিকে প্লেটো বলে ধরে নেয়া হয় কারণ, তাঁর পায়ের কাছে লেখার কাগজ , কালির দোয়াত ও কলম পড়ে আছে । যদিও প্লেটোর মতে, সেদিন তিনি সেখানে উপস্হিত ছিলেন না ; তবুও শিল্পী শোকে মুহ্যমান সক্রেটিস এর ছাত্র প্লেটোকে দিখিয়েছেন কাতর ও অবশ হয়ে বসে থাকতে । যেনো বোঝার উপায় নেই তিনি জীবিত, নাকি জীবিত অবস্থায় মৃতের মত অসাড় হয়ে আছেন ।
বাদামী-লাল চাদরে মোড়া ফিগারটি সক্রেটিস ছাত্র ক্রিটো । যে সক্রেটিসের হাটুতে হাত রেখে আছে যেনো, শেষবারের মতো চেষ্টা করছে, তার গুরুকে বিষ পান থেকে বিরত করতে ।

hb_31.45_av3

আর্চের মধ্য থেকে দুরে অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে সক্রেটিসের পরিবার –পরিজনেরা ফিরে যাচ্ছে ঘরে। প্লেটোর ভাষায়, সক্রেটিস চাননি আপনজনদেরকে নিজের মৃত্যুর সাক্ষী রাখতে !

The_Death_of_Socrates
যদিও চিত্রটিতে বেশ নাটকীয়তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন শিল্পী জাক-লুই ডাভিড । প্রধান চরিত্র ও ব্যাকগ্রাউন্ডের ফিগারগুলোর সাথে সম্পর্ক বেশ কনট্রাস্ট বা বিভেদ সৃষ্টিকারী ও আবেগঘন । আর আবেগকে সক্রেটিস কখনই প্রশ্রয় দিতে পচ্ছন্দ করতেন না ।
hb_31.45_av2

তাঁর মতো আদর্শবান যুক্তিবাদী দার্শনিকের পক্ষে সেটাই স্বাভাবিক ছিলো । এই অসাধারণ চিত্রটিতে সক্রেটিস এর সেই চারিত্রিক বলিষ্ঠতা ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন শিল্পী ।