শেষ মেস আমার আশঙ্কাটাকে সত্যি প্রমান করে হাজারো নুতন অভিজিৎ এর জন্ম দিয়ে এবং আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করে উনি না ফেরার দেশে চলে গেলেন অথবা অন্য কথাই জোর পূর্বক তাঁকে না ফেরার দেশে পাঠিয়ে দিলো বেজন্মার দলগুলো । আর হ্যাঁ প্রতারনা ছাড়া আর কি বলবো, নইলে সুপার নোভা পরবর্তী জন্ম নেওয়া যে তারাটা হটাত করে আলো ছড়ানো বন্ধ করে নিভে গেলো, তাকে তো প্রতারনা বলা ছাড়া আর কোন উপযুক্ত শব্দ মাথাই আসছে না । অবশ্য কিছু কিছু তারা আছে যে গুলো খুব কম সময়ের মদ্ধেই নিঃশেষ হয়ে যাই । কেমন সে তারা ? অল্প কথাই যে তারাগুলো অনেক বড় । মহাবিশ্ব সৃষ্টি তত্ত্ব (Cosmology) মতে যে তারা (Star) যত বড় সে তারা তত তাড়াতাড়ি নিভে যাই । অভিজিৎ রাই এর মৃত্যুর পরে ধকল টা সারিয়ে শেষ পর্যন্ত এই উপসংহারে এসেই মনটাকে শান্তনা দিতে পারছি । কারন প্রকৃত অর্থেই উনি ছিলেন একটা বিশাল আকারের তারা (Gigantic Star) তো এমন একটা তারা তার কাজ শেষে দ্রুতই নিভে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক ।

প্রাই বছর আস্টেক আগে মুক্ত মনার পাঠক হিসাবে অভিজিৎ রাইয়ের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে উঠে নেটের দৌলতে । প্রথম প্রথম মন্তব্য এবং প্রতি মন্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো সক্ষতা । পরবর্তীতে উনি নিজেই আমাকে মুক্ত মনার একজন Blogger হিসাবে নির্বাচিত করেন । যদিও পেশাগত দায়দায়িত্তের কারনে আজ পর্যন্ত একটা পুরনাঙ্গ প্রবন্ধ বা রচনা লেখা হয়ে উঠেনি । তবে মুক্ত মনাতে অথবা উনার ফেসবুক পেইজে সব সময়েই একজন মন্তব্য কারি হিসাবে সচল ছিলাম । বিগত বছর গুলতে উনার যত বই অথবা বিশেষ কোন লেখা প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রাই সবগুলই একাধিকবার পড়েছি ( যদিও বিদেশে অবস্থানের কারনে উনার লেখা বইগুলো সংগ্রহ করাটা সহজ ছিল না ) বিশেষভাবে উনার লেখা ” আলো হাতে চলিয়াছে আধারে যাত্রী ” বইটি পড়েছি অন্ততপক্ষে ১০০ বার । বইটি লেখার উনার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, ( আমার মতে ) বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন বিষই গুলি এমন সহজ ভাষাই এবং গল্পের ছলে উপস্থাপন করেছেন, তাতে অনেক জাদুকরও তার কাছে হার মানতে বাধ্য ।

Passion বলে ইংরেজিতে যে একটা শব্দ আছে, লেখালেখির সন্মন্ধে বললে তার প্রকৃষ্ট উদাহরন ছিলেন তিনি । তিনি শুধু লিখতেন তাই নই , তিনি লিখতেন সঠিক সময়ে এবং সঠিক বিষইটিকে ঘিরে এবং কোনরকমের বিলম্ব ছাড়াই । এই যেমন গতকাল নোবেল কমিটি পদার্থ বিজ্ঞানে পুরস্কার প্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করল , অমনি দিন না পেরুতেই উনার ফেসবুক পেইজে পোস্ট চলে আসলো এব্যাপারে আদ্যোপান্ত । অথবা হিগস বোসন নিয়ে CERN এর বৈজ্ঞানিকগণ নুতন কি তথ্য দিলেন সেটা পাঠকদেরকে দ্রুত জানান দিতে কখনই তিনি কার্পণ্য বোধ করেননি । এমন হাজারো ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাই ।

এমন একদিন ছিলো যখন আমরা সবাই বিশ্বাস করতাম যখনি একটা কিছু ছাপা হরপে লেখা হয়ে যাই, তা সঠিক । এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের রোষানলে পড়ার খেসারৎ উনি এখানেই দিয়ে গিয়েছেন।
উনি যে জিনিসটা মোটা দাগে আমাদেরকে শিখিয়ে গিয়েছেন সেটা হচ্ছে ছাপা হরপে যা লেখা হয়ে গিয়েছে তার সব কিছুই ঠিক নই । BIG MISTAKE . যে সমাজে উনি জন্মিয়েছিলেন এবং যে সমাজের উদ্দেশে তিনি ঘরের খেয়ে বনের মহিস তাড়ানোর মতন কাজকে একটা গুরু দায়িত্ব মনে করেছিলেন, সেটা অন্তত তাঁর সমাজে গ্রহণযোগ্য নই অথবা অন্য কথাই সেই সমাজ এটা Deserve করে না । সেই সমাজে কেউ খাবনামার উপর একটা বই লিখলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে অথচ স্টিফেন হকিং, এডুয়েন হাবল বা রিচারড ডকিন্স কে নিয়ে কেউ কিছু লিখলে প্রকাশকের পুঁজিটাও ফিরে আসে কিনা সন্দেহ । তাঁর মৃত্যু পরবর্তীতে পৃথিবী নামের এই গ্রহের বাঘা বাঘা সংবাদ মাধ্যমগুলো ঘটনাটিকে নিয়ে Highlight করেছে অথচ যে সমাজের মঙ্গল কামনা করে তিনি নিজেকে উৎসর্গ করে গেলেন, সেই সমাজ কিন্তু তাঁর জীবন রক্ষাই এগিয়ে আসেনি । আজকে তাঁর মৃত্যুর পরে পথে যারা আহাজারি করছে, একটা পাতি রাজনৈতিক নেতার ডাকেও এর থেকে অনেক বেশি লোক রাস্তাই নেমে আসে ।

আমাদের সমাজে কিছু কিছু কাজ করাটা হারাম । অভিজিৎ রায় ছিলেন একজন বিজ্ঞান ভিত্তিক লেখক। এবং বিজ্ঞানের খাতিরেই তাঁর লেখাই কিছু কিছু বিষই প্রাসঙ্গিকভাবেই চলে এসেছে যেটাকে চাইলেও তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি নিতান্তই যুক্তির খাতিরেই । এবং ভুলটা ঠিক এখানেই করে গিয়েছেন এবং জীবন দিয়ে তার মাসুল দিয়ে গিয়েছেন । আমাদের সমাজের মূলমন্ত্রটাই হচ্ছে বিচার, সালি্‌স, বিজ্ঞান, গনিত, ইতিহাস ভূগোল সব কিছুই মানি কিন্তু তাল গাছটা আমার । আর এই মূলমন্ত্রের পিছনে ছুটতে ছুটতে এক সময়ের ভালো মানুষ থেকে আমরা মানুষ এবং তারপরে অমানুষ হয়ে গিয়েছি । আজকের এই দিনে বাংলাদেশে ভালো মানুষ আছে কিনা জানিনা তবে কয়েকজন মানুষ (?) খুঁজে পাউয়া আর খড়ের গাদাই সুঁই খোঁজা সমার্থক । আমি নিজেও জন্মসুত্রে একজন বাংলাদেশি এবং নিজেকে একজন বাংলাদেশি ভেবে এক সমই গর্ব বোধ করতাম কিন্তু আজ সততার সঙ্গে বলছি আমার দেশের মাটিতে আজ যত অপকর্ম হচ্ছে তাতে মনে হই নিজেকে বাংলাদেশি বংসদ্বশোদ্ভূত ভাবতে খুব শীঘ্রই হইত গর্বের পরিবর্তে লজ্জ্যা বোধ করা শুরু হয়ে যাবে ।

আমি সবচেয়ে বিস্মিত হয়েছি উনার বাংলাদেশে যাবার ব্যাপারে । উনার লেখার ভিতরে ভুলের কাছে আপোষ না করার যে প্রবণতাটাকে আমি লক্ষ্য করেছি সেই কারনে আমার মতন ছলিমুদ্দি, কলিমুদ্দির মতন বান্দাও বুঝে ফেলেছিলো যে বাংলাদেশের মতন একটি দেশের মাটিতে পা রাখাটা তাঁর জন্য কতটা বিপজ্জনক । পরিতাপের বিষই যিনি আমাদেরকে বিগ ব্যাঙ থেকে ব্ল্যাক হোল বা কুয়ান্টাম মেকানিক্সের বিষয়ে জ্ঞান দান করে গিয়েছেন তাঁর মাথাতেও এই সহজ জিনিষটি ঢুকেনি ।

বছর দুয়েক আগে অভিজিৎ রায় এসেছিলেন Switzerland এ এবং সেইসুবাদে সপরিবারে গিয়েছিলেন জগত কাঁপানো Experiment, LHC র কেন্দ্রস্থল জেনেভার অদুরে CERN পরিদর্শন করতে । তখন আমার বাস ছিলো জেনেভা শহরের অদুরে । আমি এতো কাছে থাকার পরেও যে উনার দর্শন লাভ করতে পারিনি , সে ব্যাপারে Chat এর মাদ্ধমে উনার কাছে আক্ষেপ করার সঙ্গে উনাকে জানিয়েছিলাম যে, আমি হিগস বোসন এবং LHC/CERN এর উপর একটা প্রবন্ধ অর্ধেক লিখে ফেলে রেখেছি । উনি আক্ষেপ করেছিলেন এবং আমাকে অনুরোধ করেছিলেন আমি যেন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি প্রবন্ধটা লিখে মুক্ত মনাই পোস্ট করি । আমি উনাকে আমন্ত্রন জানিয়েছিলাম আমার সঙ্গে নিশিত সূর্যের দেশ Nordkapp এ ( North cape, Norway) মধ্যরাতে সূর্য দেখার অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য আমার সঙ্গি হবার জন্য । এর আগে আমার একবার সেখানে ভ্রমন করার অভিজ্ঞতা হয়েছিলো এবং তার উপর ভিত্তি করেই উনাকে প্রস্তাব দিয়ে ছিলাম সমই মতন আমার সফর সঙ্গি হবার জন্য । আমার কাছে উনার মতন একজন বেক্তির সঙ্গে প্রকৃতির এমন দৃশ্য উপভোগ করাটা আমার জন্য অবশ্যই একটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। উনি কথা দিয়েছিলেন পরবর্তীতে উনি যখন ইউরোপে আসবেন তখন সর্বাত্মক চেস্টা করবেন আমার কথা রাখার। পেশাগত এবং নিত্যদিনের বেস্ততার কারনে আমার আর ওই LHC/ CERN তথা হিগস বোসনের উপর লেখাটা শেষ করা হয়ে ওঠেনি আর সেই জন্যই মনে হই প্রতিশোধ নিতে দাদা আমাকে ফাঁকি দিয়ে আলো হাতে অন্ধকারের যাত্রী হয়ে আমাদের এই পৃথিবী তথা Milky way Galaxy র মায়া ছাড়িয়ে Andromeda Galaxy র উদ্দেশে পাড়ি জমিয়েছেন ।