এক
কাল ঈদ। মনে খুশী নিয়ে ট্রাঙ্ক খুলে লম্বা ছুরিটা বের করি। দুদিকেই ধারালো। দুপুরে বাজারে ধার দিয়ে এসেছি। তারপরেও মন ভরে না। আঙ্গুল দিয়ে ধার পরখ করি। এই দিয়ে কাল কোরবানি দিতে হবে। গরু, মহিষ, ছাগল … ঘুম আসে না সহসা, ধার দেয়ার পাথরটা বের করে ছুরিতে শান দিতে থাকি …

দুই
গরু কোরবানিই বেশি হয়। সাথে ছাগলও। ছাগল কোরবানি কিছুটা সহজ, খুব তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। কিন্তু গরু কোরবানিই বেশি ভালো লাগে। সম্মানিও বেশি পাওয়া যায়। অত বড় একটা পশু মাটিতে ফেলে দিয়ে আল্লাহু আকবর বলে তার গলায় ছুরি বসিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করতে শরীরে-মনে অন্যরকম একটা ভাব হয়। জোস চলে আসে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়। ছাগলের তুলনায় কি তার বেগ, রক্তের ধারা যেন থামতেই চায় না। গরু ছাড়া কোরবানিকে কোরবানিই মনে হয় না আজকাল। তবে পরিশ্রম একটু বেশিই হয়। সময়ও লাগে বেশি। তবে সেটা ব্যাপার না, পুশিয়ে যায়। তাছাড়া গরুকে বা ছাগলকে ধরা, ধরে মাটিতে ফেলে দেয়া, শক্ত করে সামনের পেছনের পা ধরে রাখা- কোনটাই আমাকে করতে হয় না। আমার কাজ কেবল গলায় ছুরি চালানো। অন্য রকম একটা অনুভূতি হয়। অতগুলো লোক মিলে আস্ত গরুকে পা বেধে মাটিতে ফেলে সামনের পেছনের পায়ের উপরে উঠে, পেটে পিঠে চড়ে বসে শক্ত করে ধরে আমার জন্যে অপেক্ষা করে। আমি ছুরিটা হাতে নিয়ে গর্বিত পায়ে এগিয়ে যাই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সবমিলিয়ে অন্যরকম অনুভূতি …

তিন
ইব্রাহীম (আঃ) তার প্রিয় সন্তানকে কোরবানি দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহ পাক আসলে নবীর পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। আল্লাহর নামে প্রিয় কিছু কোরবানি দিতে হবে, আল্লাহ স্বপ্নে আদেশ দিয়েছেন। নবী দেখলেন- সন্তান ইসমাইল (আঃ) হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়। সন্তানকে আল্লাহর ইচ্ছার জানানোর সাথে সাথে সন্তানও রাজী। তিনিও যে নবী। নবী ইব্রাহীম (আঃ) সন্তান ইসমাইল (আঃ) কে নিয়ে গেলেন কোরবানি দিতে। তিনি আল্লাহর পরীক্ষায় পাশ করলেন, আল্লাহ খুশী হয়ে ইসমাইল (আঃ) এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি দেওয়ালেন। সেই থেকে পশু কোরবানি হয়। কতবার শুনেছি, কতবার পড়েছি, কতবার এই গল্প কতজনকে শুনিয়েছি। আমাদের মাদ্রাসার বড় হুজুর এই গল্প করে প্রশ্ন করেন- আমরা এমন পরীক্ষা কি দিতে পারবো? আমাদের প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবান করতে পারবো? সবাই মাথা দুলাই, বলি- পারবো। আমাদের প্রিয় বস্তু কি? আমাদের বেশিরভাগেরই এখনো বিয়ে শাদি হয়নি, বাচ্চা কাচ্চাও হয়নি। আমার ক্লাসের আব্দুর রহিম বলে- আমাদের জানই হচ্ছে সবচেয়ে প্রিয়। শুনে অন্যরা জোরে জোরে মাথা দুলায়। আমার অবশ্য এই গল্পটা শুনলে অন্য কথা মাথায় আসে। দুম্বা কোরবানির কথা মনে হয়। কোনদিন দুম্বা কোরবানি দেইনি। ঊটও না। খুব ইচ্ছে করে- দুম্বা, উট কোরবানি দিতে। আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই আমার ইচ্ছা একদিন পূরণ করবেন।

চার
আমার রুমের মোঃ নুর ইসলাম ভাই ফিরলেন। জামা কাপড় পাল্টে মেশওয়াক নিয়ে বাথরুম ঘুরে এসে গামছা দিয়ে গা হাতপা মুছতে মুছতে আমার দিকে হেসে প্রশ্ন করলেন- সারারাতই ছুরিতে শান দিব নাকি! বেশিরাত জেগে না কাল আবার ঈদের প্রথম জামাত মিস করি। আমি লাজুক হেসে বললাম- এইতো কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বো। আমাকে এমন বললেন বটে, কিন্তু তিনি নিজেও তার ছুরি বের করে শান দিতে বসে গেলেন। জানি, আমাদের মাদ্রাসার এই হোস্টেলের বেশিরভাগ রুমে এখনো বাতি নিভেনি- ছুরিতে শান দেয়া চলছে। ফজরের ওয়াকতে ওঠা আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছে। দেরিতে ঘুমালেও ঠিক ঘুম ভেঙ্গে যায়। সবাই জানে, ঈদের প্রথম জামাত কারো বাদ দেয়া যাবে না। কেননা যত আগে নামাজ শেষ হবে, তত আগে কাজে নেমে পড়া যাবে …

পাঁচ
গত ঈদে গরু কোরবানি দিয়েছিলাম ৭ টি, ছাগল ৩ টি। এবার আরো বেশি দিতে পারবো ইনশাল্লাহ। একটা ফ্লাটে কথা হয়েছে- সেখানে গরুই আছে ১০ টা, ছাগল ৫/৬ টা। আরেকজনকে না বলে থাকলে একহাতে সব কোরবানি আমিই দিতে পারবো … এখন আমি অনেক ভালো কোরবানি দিতে পারি, খুব দ্রুত পারি। ছুরিটা আমার বেশ ভালো। মজবুত, লম্বা- কাটেও ভালো। ধার যত বেশি, তত দ্রুত কোরবানি হবে। গত চার/ পাঁচ বছর থেকেই কোরবানি দিচ্ছি। প্রথমবার যখন দেই- বয়স ছিল ১১ কি ১২ বছর। মাদ্রাসারই কুদ্দুস হুজুরের সাথে গিয়েছিলাম। একটা ছাগল কোরবানি দিয়েছিলাম। এতটুকু ভয় লাগেনি, এতটুকু হাত কাপেনি। তারপর থেকে প্রতিবছরই নিজ হাতে কোরবানি দিয়ে যাচ্ছি … গরু- ছাগলের রক্তের ধারা দেখলে তেজ আসে। পাশাপাশি গরু ছাগলগুলো যখন কোরবানি দেই- পুরো রাস্তা বা উঠোন রক্তে ভেসে যায়। রক্তে মাখামাখি অবস্থা হয়। আমার সাদা পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামায় ছোপ ছোপ রক্ত লাগে। গায়ে জামায় রক্ত যাতে না লাগে তার কোন চেষ্টাই করিনা। বরং গায়ে জামায় রক্ত যত লাগে- তত গর্ব বোধ করি। এ যেন আমার অধিক গরু- ছাগল কোরবানি দেয়ার পরিচয় বহনকারি। পাঞ্জাবি- পাজামায় ছোপ ছোপ রক্ত, হাতে রক্ত- পায়ে রক্ত, খোলা লম্বা ছুরিটাও রক্তমাখা- এ ভঙ্গীতে যখন হাটি, তখন অন্যরকম লাগে। আমাকে দেখে অনেকে ডাকে, আরো কোরবানি দিতে পারি।

ছয়
চারপেয়ে পশুকে কোরবানি দেয়ার চাইতে মনের পশুকে কোরবানি দেয়া খুব দরকার। আমাদের বড় হুজুর মাঝে মধ্যেই এটা বলেন। আমাদের মনের মধ্যে যে কত পাপ বাসা বেঁধেছে তার ইয়ত্ত্বা নেই। অন্তর থেকে আল্লাহর ভয়ডর সব উবে যাচ্ছে। দুনিয়াটা ধীরে ধীরে পাপে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আল্লাহতে বিশ্বাস নাই হয়ে যাচ্ছে। চারদিকে নাস্তিক- নাসারা তাদের বিষাক্ত ফনা বিস্তার করছে … যত দেখি, যত শুনি, যত ভাবি- মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়, খুব ছটফট লাগে। হে আল্লাহ তুমি রহম করো …

সাত
রাতে স্বপ্ন দেখি। আমার উপরে আদেশ নাজিল হয়।

আট
ঈদের প্রথম জামাতে নামাজ শেষ করে। উন্মুক্ত ছুরি হাতে নিয়ে ছুটতে থাকি।
নির্ধারিত ফ্লাটবাড়িতে পৌছে যাই। আমাকে দেখে বিল্ডিং এর দারোয়ানরা অপেক্ষা করতে বলে। তারা বিভিন্ন ফ্লাটের ইন্টারকমে কল দিয়ে আমার আসার কথা বলতে থাকে। কসাইরাও উপস্থিত। আমি চারদিকে দাঁড়িয়ে- বসে থাকা গরু ছাগলের দিকে তাকাই। কাগজের ফুলের মালা, রাংতা কাগজের মালা, রঙ্গিন কাপড়ের মালা গলায়- শিং এ পরা। করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে তারা। আমার ছুরির দিকেও।

নয়
একফাকে লিফটের সামনে গিয়ে হাজির হই। লিফটে ঢুকে ৭ -এ টিপ দেই। সেভেন এর এ। কলিং বেল বেজে ওঠে, ভিতর থেকে ‘কে কে’ বলতে বলতে খুলে দেয়। কাজের মেয়েটা বলে, খালু তো এখনো নামাজ থেকে ফেরেন নি। আমাদের কোরবানি নিচেই হবে। বাড়ির কর্ত্রী ডেকে নিয়ে বলেন একটু সেমাই খেতে। আমি সোজা একটা ঘরে ঢুকে যাই- যেখানে বাড়ির বড় ছেলে রাত জেগে বেঘোরে ঘুমাচ্ছিল। দেয়ালে দেয়ালে বেদায়েতি- বেশরম ছবি টাঙ্গানো। ঈদের নামাজ পড়তে যায় না, কিন্তু কোরবানির মাংস ঠিকই হালুম হালুম করে খেয়ে ফেলবে। সব নাস্তিক- নাসারাদের দল কোথাকার! বিসমিল্লাহ- আল্লাহু আকবর – লা ইলাহা ইল্লাহু বলে ছুরি চালিয়ে দেই। এতটুকু হাত কাপেনা। রক্তের ধারা বিছানা বেয়ে মেঝেতে পড়তে থাকে, রক্তে মাখামাখি হতে ভালো লাগে … পবিত্র পবিত্র এক অনুভূতি …

দশ
জানি, আমার মত আরো অনেকেই আজ ব্যস্ত। আজ শহর জুড়ে আসল কোরবানি। মনের পশু মানে তো মানুষের মনের পশুই … গরু ছাগলের তো মন বলে কিছু নেই- তাদের মধ্যে পাপ পূন্য বলেও কিছু নেই। মানুষের মনের পশুকে কোরবানির উপায় তো তাকেই কোরবানি দেয়া … আল্লাহ তুমি রহম করো …

ভূমিকাঃ
বেশ কয়েকবছর আগে বাবামা’র দেয়া ছাগল কোরবানিতে এসেছিল পাশের মাদ্রাসা থেকে বাচ্চা একটা ছেলে। বিল্ডিং এর ছাদে তিনটা ছাগল এক হাতে কোরবানি দিয়ে চলে গেল। ফাকে ফাকে অনেক কথা হলো। কোরবানি দিতে কেমন লাগে, কবে থেকে দেয়, কতদিন এই মাদ্রাসায়, বয়স কত, বাড়ি কোথা, কে কে থাকে … ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করি। কোরবানিগুলো দেয়ার পরে তাকে দেখে আমি খুব খুব বিচলিত হয়েছিলাম- বাচ্চা একটা ছেলে, পাঞ্জাবি পায়জামাতে রক্ত দিয়ে একেবারে মাখামাখি, হাতে লম্বা খোলা ছুরি … প্রতিবার কোরবানি এলে কোরবানি বা পশু জবাই দিতে আসা হুজুরদের দেখলেই আমার ঐ বাচ্চা ছেলেটার কথা মনে পড়ে যায় … এরপরেও অনেক হুজুরের সাথে কথা বলেছি … মোটামুটি সবার অভিজ্ঞতা একই রকমের। এবং সবার কাছেই এই একের পর এক জবাই করার কাজটি প্রায় ডাল ভাতের মত … রক্ত, টক্ত দেখে কারোরই কোন ভাবান্তর হয় না …

পরিচিত অনেককেই এ অভিজ্ঞতার কথা বলেছি, কেউ কেউ যুক্তি করেছে- এমনটাই তো স্বাভাবিক, কসাইদের সাথে তুলনা করে বলেছে, যারা কসাই- তাদের ডেইলি মাংস কাটতে হয়- তাদের মাংস কাটায়, বা রক্ত দেখে কোন ভাবান্তর হয়? আমি ভাবি, মাদ্রাসার বাচ্চারা তো কসাই হতে আসেনি … কেমন যেন লাগে … এই পোস্টটি সেই অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা … ১ থেকে ৬, বাস্তব অভিজ্ঞতা- ৭ থেকে ১০ আমার কল্পনা, কিংবা দুঃস্বপ্ন … কোরবানির দিনে জামায় রক্ত মাখা উন্মুক্ত ছুরি হাতে হুজুররা যখন হেঁটে যায়- আমি একরকম আতঙ্ক বোধ করি … রক্তের প্রতি এই প্রেম কবে যে মানুষের রক্ত পিপাসায় পরিণত হয় …