চার

বলা হচ্ছে সামরিক অভ্যূত্থান, অথচ এর নায়ক হিসাবে উর্ধ্বতন কোন সামরিক কর্মকর্তার নাম শোণা যাচ্ছে না-আলমের বোধগম্য হচ্ছে না কিছুই । তিন বাহিনী প্রধান একে একে মোশতাক সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন । অভ্যূত্থানকারী কতিপয় জুনিয়র সামরিক কর্মকর্তার সমর্থনে নিয়ে দেশ চালাচ্ছে খন্দকার মোশতাক। দেশে চলছে সামরিক শাসন।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে রাষ্ট্র সরে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। মুক্তিযুদ্ধর বীরোচিত শ্লোগান-জয় বাংলার পরিবর্তে পাকিস্তানী কায়দায় আবার বাংলাদেশ জিন্দাবাদ উচ্চারিত হচ্ছে সরকারী প্রচার মাধ্যম সহ সকল সরকারী অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ বেতার আবার হয়ে গেল রেডিও বাংলাদেশ। খন্দকার মোশতাক মন্ত্রীসভা গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক ঘনিষ্ঠ সহকর্মী মন্ত্রী হিসাব একে একে শপথ নিলেন।

সহসা সবকিছুই যেন স্বাভাবিক হয়ে গেল। বাঙ্গালীর হাজার বছরের সেরা অর্জন-একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধ-যেন এক আঘাতেই কূপোকাত । সফল হয়ে গেল প্রতিবিপ্লব-কোন প্রতিরোধ-প্রতিবাদ ছাড়াই । চরম বিষন্নতায় আক্রান্ত হল আলম । নিজকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে পরিচয় দিতে এখন বিব্রত বোধ করে সে । কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারে না আলম। এত বিশাল মুক্তিযুদ্ধ, এত বীর মুক্তিযোদ্ধারা-সবই হারিয়ে যাবে । না-এটা মানা যায় না। প্রতিরোধ করতেই হবে-ভিতরে ভিতরে সঙ্কল্প করে আলম।

এদিকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফরম পূরণের শেষ তারিখ সমাগত। কিন্তু প্রয়োজনীয় টাকা জোগাড় করতে পারে নি আলমের বাবা। অবস্থাপন্ন অনেকে আত্মীয়ের কাছে ধর্ণা দিয়েছে তার বাবা। কিন্তু হা হতোস্মি । একে একে সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে । অথচ এসব আত্মীয় স্বজন অনেকের পরিবারের ভরণপোষণ করেছে আলমের বাবা, মাসের পর মাস । আলম ভাবে-তার পরীক্ষা দেওয়া হবে না মাত্র কয়েক শ’ টাকার অভাবে। অনেক চেষ্টা তদবির করে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দেয় তার বাবা। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী নন আলমের মা। শেষ চেষ্টা করে সে টাকা জোগাড় করে আনল । আলম পরীক্ষার ফরম পূরণ করল শেষ পর্যন্ত । পরীক্ষায় অবতীর্ণ হল আলম। কাঙ্ক্ষিত প্রথম বিভাগের পরিবর্তে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হল সে । কিন্তু এর পর কী করবে সে ? কিছুই যেন ভেবে পাচ্ছে না।

জীবন সংগ্রামের নতুন অধ্যায়
এ ভাবে টানাপোড়নের মধ্য দিয়ে লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে বলে আলম মনে করে না। পরিবারের জন্য কিছু একটা করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে আলম। বিভিন্ন বাসায় ছাত্র-ছাত্রী পড়ানোর পাশাপাশি হন্যে হয়ে চাকুরীর সন্ধান করছে আলম । এক সময় তার এক ফুফা আব্দুল মোনাফের সহায়তায় টি,এস,পি,কমপ্লেক্স নামক স্থানীয় একটি সার কারখানায় দৈনিক-ভিত্তিক শ্রমিকের খাতায় নাম লেখায় আলম । দৈনিক মজুরী সাত টাকা-যেদিন কাজ সেদিন মজুরী । টি,এস,পি,কারখানার ব্যাগিং-ড্রাইং শাখায়-যেখানে উৎপাদিত সার শুকানোর পর বস্তা ভর্তি করে স্টক করা হয় ।

দিনমজুরদের সাথে পালাক্রমে-প্রতি পালায় আট ঘন্টা-কাজ করে আলম। ব্যাগিং-মেশিনের সাহায্যে সার বস্তা ভরে, সিউইং মেশিনে সেলাই করে স্টক করে দিন মজুরেরা । কঠোর শারিরীক পরিশ্রমের কাজ-যাতে মোটেও অভ্যস্ত নয় আলম । শাখা প্রধান তাকে দিনমজুরদের তালিকা করা ও কাজ দেখাশুণার দায়িত্ব প্রদান করেন । সকাল-দুপুর-রাত-তিন পালায় কাজে যায় আলম। কাজ যখন চলে, তখন সারের ধূসর গুড়ায় ঘন কূয়াসার মত ছেয়ে যায় পুরা শপ বিল্ডিং। পাতলা কাপড়ের নোজ-মাক্স নাকে বাঁধতে হয় । আট ঘন্টার পালা শেষে যখন কারখানা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়, সর্বাঙ্গে ধূলিধুসর আলমকে তখন এক জীবন্ত মূর্তি বলে মনে হয় । সকাল ০৬ টা থেকে দুপুর ২-০টা, দুপুর ২-০টা থেকে রাত ১০-০০ টা এবং রাত ১০-০০টা হতে সকাল ৬-০০টা, এভাবে তিন পালায় কাজ করতে হয়। সব চেয়ে বেশি কষ্টকর রাতের পালা। রাত্রে ঘুমানোর কোন সুযোগ নেই। প্রতি পাঁচ দিন অন্তর পালার পরিবর্তন হয়। অতঃপর দু’দিনের বিশ্রাম। বিশ্রাম দিনের মজুরী দৈনিক-ভিত্তিক শ্রমিকদের প্রদান করা হয় না। অথচ প্রতি পালায় শাখা প্রধানেরা দিন মজুরের প্রকৃত সংখ্যার চেয়ে ৪/৫ জন বেশী নাম লিখে । মাসের শেষে ঠিকাদারের সাথে বাড়তি শ্রমিকের মজুরী ভাগাভাগি করে নেয়। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সাথে আলমের প্রথম পরিচয়। ভীষণ খারাপ লাগলেও তার কিছুই করার নেই। কাগজে কলমে সে ৭ টাকা মাইনের দিনমজুর। এভাবে সারা মাস শেষে বিশ/বাইশ দিনের হাজিরার মজুরী হিসাবে ১৪০/১৪৪ টাকা পায় আলম। এ টাকাগুলোও সে তার মায়ের হাতে তুলে দেয়।

দেশে তখনও চলছে সামরিক শাসন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিয়ে সেনা কর্মকর্তাদের নির্লজ্জ কামড়া-কামড়ির নানা গুজবের ছড়াছড়ি । প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে রেডিওর নব ঘুরায় আলম-সরকারে কোন পরিবর্তন হল কিনা তা জানার জন্য। মনে মনে সে কামনা করে-এত মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা-বীর উত্তম, বীরবিক্রম, বীর প্রতীক- তারা কি একটি পাল্টা ক্যূ করতে পারে না-মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে । কোন কারণে রেডিও অন হতে দেরী হলে উৎকর্ণ হয় আলম-কারা আবার ক্ষমতা দখল করল?
৩ নভেম্বর, ১৯৭৫, সকাল থেকে রেডিও মুখ খুলছে না। কি হল, কি হল-সব দিকেই জনমনে এ প্রশ্ন। আবারো সামরিক অভ্যূত্থানের গুজব। কিন্তু রেডিওতে কোন ঘোষণা নেই। কারা অভ্যূত্থান করল, কে ক্ষমতা দখল করল-কিছুই জানা যাচ্ছে না। পরম শঙ্কা-সংশয়েও আলমের মনে ক্ষীণ আশা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোন শক্তি এ অভ্যূত্থান ঘটাল নাতো। তাহলেত ভালই হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসবে-বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে ।
পরদিন জাতীয় পত্রিকায় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবী করে মিছিলের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হল। বাহাত্তর ঘন্টা পর ঢাকা বেতার মুখ খুলল। জানা গেল ৩ নভেম্বর রাতে জেলের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান মন্ত্রী তাজুদ্দিন আহমদ, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়েছে।

৬ নভেম্বর সকাল ৯-০০ ঘটিকায় বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম নতুন রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রথমবারের মত সরকারীভাবে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও জেল হত্যাকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করা হল। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনীর বিপদগামী কিছু সদস্যদের দায়ী করে ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্তের ঘোষণা দেওয়া হল। জিয়াউর রহমানের স্থলে জেনারেল খালেদ মোশারফ সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হলেন। প্রচণ্ড দুঃখ-বেদনার মধ্যেও আলম কিছুটা আশান্বিত হয়-রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির হাতে এসেছে মনে করে।

কিন্তু পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টায় আলমের সে আশা ভেঙ্গে যায় । আবার পাল্টা ক্যূ। এবার বিদ্রোহ করেছে সাধারণ সিপাহীরা তাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে । এ বিদ্রোহে অনেক সেনা কর্মকর্তা সিপাহীদের হাতে নিহত হয় । বিদ্রোহী সিপাহীরা ৩ নভেম্বরের অভ্যূত্থানের নায়ক নব নিয়োগপ্রাপ্ত সেনা প্রধান জেনারেল খালেদ মোশারফকে হত্যা করে। মেজর জিয়া আবারো সেনা প্রধান নিযুক্ত হন।

একটি সদ্য স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর কতিপয় কর্মকর্তারা, নিজেদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ লড়াইয়ে দেশের কি অপরিমেয় ক্ষতি যে করে গেল-তা ইতিহাস একদিন নির্ধারণ করবে।