কাল্পনিক ঈশ্বরকে সন্ত্তষ্ট করার জন্য আস্তিকদের কোরবানী প্রথার সমালোচনা করলেই শুনতে হয়,- কোরবানী পছন্দ নয়, কিন্তু মাংস তো ঠিকই খান। জ্বি নাস্তিকরাও মাংস খায়। খেতেই হয়। বেঁচে থাকার জন্য এটা খাদ্যচক্র।

কথা হচ্ছে- মাংস কে কিভাবে খায়। এই পৃথিবীতে অনেক জাতিগোষ্ঠী আছে যারা মানুষের মাংস ভক্ষণ করে। একে বলে ক্যানিবালিজম, অর্থ্যাৎ যারা মানুষ হয়েও অন্য মানুষের মাংস খায়। লিবিয়া ও কঙ্গোর বেশ কিছু যুদ্ধে এই ক্যানিবালিজমের চর্চ্চা হয়েছিল। কঙ্গোর লেন্দু উপজাতি মানুষের মাংস খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে পরিচিত। আফ্রিকা মহাদেশের কঙ্গোর বিভিন্ন প্রদেশের গহীন জঙ্গলে বাস করে তারা। লেন্দুরা যখন তখন পিগমি উপজাতিদের হত্যা করে তাদের কাঁচা মাংস খেয়ে ফেলে। উল্লাস করে মানুষের মাথা নিয়ে। লেন্দুরা মূলত জীব-জন্তুর মাংস খেয়ে থাকে। পিগমিরা জঙ্গলে বাস করে বলে লেন্দুরা তাদের জীব-জন্তুর ন্যায় মনে করে এবং হত্যা করে। এছাড়া করোওয়াই নামে একটি উপজাতি আছে যারা এখনো বিশ্বাস করে যে নরমাংস ভক্ষণ তাদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। এখনও মিলেনেশিয়ান উপজাতিরা তাদের ধর্ম চর্চ্চায় ও যুদ্ধে ক্যানিবালিজমের চর্চ্চা করে। ক্যানিবালিজম এমন একটি প্রথা যা নৃতত্ত্ববিদদের সমস্যায় ফেলে দেয় মানুষের আচরণের গ্রহণযোগ্যতার সীমানা নির্ধারণে।

আফ্রিকার মাসাই আদিবাসী আর উত্তর মেরু বা সুমেরুতে বসবাসকারী এস্কিমোদের পশুর রক্ত পান বা কাঁচা মাংস খাওয়ার সংস্কৃতি আমরা সবাই জানি। আফ্রিকার মাসাইরা পশু জবাই করেই তার রক্ত মাটিতে পড়তে দেয়না। তারা পাত্রে সংগ্রহ করে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করা পশুর তাজা রক্ত পান করতে শুরু করে। এস্কিমো জনগোষ্ঠীর মানুষেরা শুধুমাত্র কাঁচা মাংস খেয়েই জীবন ধারণ করে। সিদ্ধ মাংস খায় সভ্য সমাজে এমন মানুষ যেমন কম নয়, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য- পশু জবাই করে সঙ্গে সঙ্গেই কাঁচা মাংস খেতে শুরু করে এমন মানুষের সংখ্যাও পৃথিবীতে কম নয়। আবার অনেক জনগোষ্ঠী কাঁচা মাংস খায় রক্তসহ। মাংস ধোয়ারও প্রয়োজন মনে করে না এরা। আফ্রিকা আর ব্রাজিলে এমন অনেক জনগোষ্ঠী আছে- যারা পশু জবাই করেই প্রথমে পশুটির হৃদপিন্ড, ফুসফুস আর কলিজার মতো নরম অংশগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে। হাতে পাওয়া মাত্রই তা কাঁচা খেতে শুরু করে। এরা সভ্য বিশ্ব থেকে এখনো অনেক দূরে।

ভারতেও এমন অনেক ধর্মীয় জনগোষ্ঠী আছে- যারা পশুর তাজা রক্ত পান করে। তুলনামূলক ভাবে এরা অনেকটা সভ্য হলেও এ রক্ত এরা পান করে ধর্ম বিশ্বাস থেকে। হিন্দুরা এখনো পশুবলি দেয় প্রকাশ্যে, তবে মাংস এরা রান্না করে খায়।

মুসলমানরাও বেশ সভ্য। এরা রক্ত বা কাঁচা মাংস না খেলেও পশু কোরবানী দেয় প্রকাশ্যে এবং উৎসব করে। উৎসবের দিন তাদের লক্ষ লক্ষ পশু কোরবানী দেবার দৃশ্য শিশু থেকে শুরু করে দূর্বলচিত্তের বা অসুস্থ মানুষেরাও উপভোগ করে। তারা প্রকাশ্যে পশু কোরবানীর এ উৎসবকে মোটেও বিভৎস বা বর্বর মনে করে না। বরং এটাকে খুবই সভ্য এবং স্বভাবিক ধর্মীয় আচরণ বলে মনে করে।

ইউরোপিয়ানরাও মাংস খায়। তবে উত্তর ও মধ্য ইউরোপের উন্নত ও শিক্ষিত দেশগুলোতে প্রকাশ্যে পশু এমনকি পাখি জবাই করাও অনেক আগে থেকেই নিষিদ্ধ। কাল্পনিক ঈশ্বরের সন্ত্তষ্টিতে পশু বলি- এ অঞ্চলের মানুষ বিশ্বাস করেনা। এরা পশু বা পাখির মাংস বাজার থেকে কিনে খায়। পশু বা পাখি কোথায় বা কিভাবে জবাই হয়- এ অঞ্চলের মানুষদের তা দেখতে হয় না। ইউরোপের শিশুরা মুরগী বা পশু জবাইয়ের দৃশ্য কখনো দেখেনি। কসাইখানায় পশুর মাংস প্রক্রিয়াজাত করার জন্য সুনির্দিষ্ট পেশাগত শিক্ষা এবং দক্ষতা অর্জন করার পরই একজন কসাই মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কসাইয়ের কাজ করার সুযোগ পায়। আর প্রতিটি প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় থাকে মাংসের গুনগত মান আর রোগ-জীবানু পরীক্ষা করার জন্য নিজস্ব ল্যাবরেটরী। আমেরিকা, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া সহ আরো অনেক উন্নত দেশে এরকম ব্যাবস্থা আছে।

মাংস খাওয়ার এত রকম উদাহরণ এজন্য দিলাম যে, আপনাকে আমি এখন প্রশ্ন করতেই পারি,- কোন্ জনগোষ্ঠীর মাংস খাওয়ার সংস্কৃতি বা ধরণ আপনার কাছে সবচেয়ে সভ্য বলে মনে হয়? কোরবানীর প্রশ্নে নাস্তিকরা মুসলমানদের আরেকটু সভ্য হতে পরামর্শ দেয়। অন্য সব ধর্মের ধার্মিকদের পশু বলির বেলায়ও তাই। মাংস খাবার জন্য বা কাল্পনিক ঈশ্বরকে সন্ত্তষ্ট করার জন্য প্রকাশ্যে পশুহত্যা বা রক্তের উৎসব আর যাই হোক, সভ্য মানুষের সুস্থ আচরণ হতে পারে না। আপনারা খেয়াল করলেই দেখবেন, বিশ্বের যে অঞ্চলগুলোতে প্রকাশ্যে পশু জবাইয়ের সংস্কৃতি প্রচলিত আছে, সেসব অঞ্চলে মানুষ জবাইয়ের মত অপরাধও সংঘঠিত হয় বেশি। রক্তারক্তির খেলা শুরু হয় পশু থেকেই, আর তা শেষ হয় মানুষে।