পহেলা বৈশাখে সমকামীদেরপ্রথম প্রকাশ্য র‍্যালি” – শিরোনামে একটি লেখা প্রকাশ করেছে প্রিয় ডট কম। এ খবর নিয়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনার ঝড় উঠেছে। প্রিয় ডট কমের এই নিউজটি আবার শেয়ার করেছে “বিডি ন্যাশনালিস্ট” নামের বিএনপিপন্থী একটি ফেসবুক পেজ। যেমনটা ধারণা করা যায়, তারা ইস্যুটিকে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে।

সমকামীদের অধিকারের বিষয় নিয়ে এখন আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। একদিকে কাঠমোল্লারা ছি ছি করে চলেছে, সমাজের “অবক্ষয়”কে দায়ী করছে সমকামীদের এই উত্থানের পেছনে। তাদের সাথে তাল দিচ্ছে সরকারের বিরোধীপক্ষ, কারণ তাদের এখন আন্দোলনের নতুন ইস্যু দরকার। অন্যদিকে প্রগতিশীলেরা, যারা এখনো বাংলাদেশের সমাজের খুব ক্ষুদ্র একটা অংশ, সমকামীদের অধিকারের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। এটি খুবই আশার কথা যে আমাদের নতুন প্রজন্ম থেকে বুদ্ধিজীবী একটি অংশের সৃষ্টি হয়েছে, যারা এখন কুসংস্কারের ঊর্ধ্বে উঠে নিজের মতকে স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারছেন।

আমার এই লেখা সেইসব পাঠকের উদ্দেশ্যে যারা সমকামিতাকে প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক অংশ বলে মনে করেন। সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ কিংবা ধর্মীয়/ সামাজিক দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয় এমন ধ্যান ধারণা নিয়ে যারা বসে আছেন তাদের এই পোস্ট না পড়াই মঙ্গল। সব কিছু ইহুদী/ নাসারা/ ইন্ডিয়া/ আওয়ামী সরকারের ষড়যন্ত্র নয়, এর বাইরেও আরো অনেক কিছুই আছে।

“গে প্রাইড প্যারেড” সম্পর্কে অনেকেই হয়তো জানেন। পশ্চিমা দেশগুলোর বিভিন্ন এলাকায় (বিশেষত যেসব দেশে সমকামিতা আইনের দৃষ্টিতে বৈধ) LGBT (Lesbian, Gay, Bisexual & Transgender) গ্রুপগুলো এই প্যারেডের আয়োজন করে। এই প্রাইড প্যারেডগুলোর মূল লক্ষ্য সমাজকে জানানো যে সমকামীরা যে ভিনগ্রহ থেকে উড়ে আসা কোন গোষ্ঠী নয়, বরং সমাজেরই একটি অংশ। এই বৈচিত্র্য লুকিয়ে রাখার কোন বিষয় নয়, বরং এটি প্রকাশ্যেই উদযাপন করা উচিত। এই “Pride” এর প্রতীকস্বরূপ ব্যবহার করা হয় রংধনু রঙের পতাকা।

পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশীদের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক উৎসব। নতুন বছরের আগমন উপলক্ষে সারা দেশে নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সবচেয়ে বড় আয়োজন থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলা এবং রমনা এলাকায়। এবারের পহেলা বৈশাখে চারুকলা থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রার পরপরই আরেকটি র্যা লি বের হয়। সেই র্যাুলিতে অংশ নিয়েছিলেন সমকামীরা এবং সমকামীদের সমানাধিকার সমর্থন করেন এমন অনেকে। রংধনুর সাত রঙে মেলানো সেই র্যাালি অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। প্রাইড প্যারেড সম্পর্কে সিংহভাগ মানুষের ধারণা না থাকায় তারা বুঝতে পারেন নি আসলে কি হচ্ছে।

পহেলা বৈশাখে এ ধরনের আয়োজন নিয়ে নানাজনের নানামত থাকতে পারে। আমার মতে এ ধরনের আয়োজনের ধনাত্বক ঋণাত্বক দুটি দিকই আছে। ভালো দিকটি হল, এ ধরনের আয়োজনের মাধ্যমে সমাজকে সমকামীদের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানান দেয়া হল। সমাজ এখন আর আগের মত এই গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করতে পারবে না। সেই সাথে বাংলাদেশের নানা প্রান্তে সমাজের ভয়ে লুকিয়ে থাকা সমকামীদের জানানো হল – তুমি একা নও। আর এ বিষয়টি আলোচনায় আসাতে অনেকে হয়তো বিষয়টি নিয়ে একটু পড়াশোনা করবে। “ছিছি” রব তোলা অনেকেরই হয়তো দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাবে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঋণাত্বক প্রভাবের সংখ্যা একটু বেশি। আমাদের সমাজ এখনো সমকামীদের প্রকাশ্যে দেখতে প্রস্তুত নয়। যখনই সমকামীরা প্রকাশ্য হতে শুরু করবে, আমাদের সমাজ তার ভঙ্গুর ইমেজ (যে ইমেজ দাবী করে এই দেশে কোন সমকামী নেই) রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাবে। সে যাকেই হাতের কাছে পাবে তাকেই আহত করতে চাইবে। সরকারবিরোধী পক্ষ বিষয়টিকে সরকারের বিরুদ্ধে ডাইভার্ট করতে চাইবে আর সরকার ইস্যুটিকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কিছু পদক্ষেপ হয়তো নেবে। সমকামীদের মত সমাজের অত্যন্ত ভালনারেবল একটি অংশ যদি মহাশক্তিধর সরকারের আক্রোশের শিকার হয় তাহলে তার ফলাফল কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। এ প্রসঙ্গে হেফাজত বনাম নাস্তিক ব্লগারদের ইস্যুটির কথা মনে করা যেতে পারে। সরকার হেফাজতকে ছেড়ে দেয় নি একথা যেমন সত্য, তারা তিনজন নাস্তিক ব্লগারকে জেলে ভরেছিল একথাও তেমন সত্য।

“সমকামিতা পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসন” – পহেলা বৈশাখে প্রাইড প্যারেড/ রংধনু র্যাতলির আয়োজন করার আগে আয়োজকেরা এ বিষয় কি ভেবেছিলেন কে জানে। আমার মনে হচ্ছে এ ধরনের অযৌক্তিক দাবিকে আরেকটু উস্কেই দিলো এই র্যােলিটি। সমকামীদের প্রতি সহানুভূতিশীল/ পর্যবেক্ষক একটি গোষ্ঠীও কিন্তু আছে আমাদের সমাজে। সমকামীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তাদের সম্পৃক্ততা চাইলে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরেকটু গভীরভাবে চিন্তার প্রয়োজন আছে।

আমি নিজে সমকামী এবং আমারও স্বপ্ন আছে একদিন এই মিছিলে যোগ দেবার। কিন্তু আমার এই উৎকীর্ণ অভিলাষকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে আমি কাউকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে চাই না। রূপবানের দ্বিতীয় সংখ্যা আসছে। সুতরাং এই বিষয়গুলো নিয়ে তর্ক বিতর্ক চলতেই থাকবে। এবং আমি বিশ্বাস করি শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবেই; সমস্ত অজ্ঞানতার অন্ধকার দূর করে আমাদের এই দেশ একদিন আলোর সমুদ্রে ভাসবে। কিন্তু সেই কন্টকাকীর্ণ যাত্রায় রক্ত যত কম ঝরে ততই মঙ্গল।

লেখকঃ তন্ময়