মুক্তমনার অন্যতম সুহৃৎ ড.এ এইচ জাফর উল্লাহ  আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। গতকাল (অগাস্ট ২১, ২০১৩) পরিবার পরিজন পরিবেষ্টিত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার এ চলে যাওয়া হঠাৎই, একেবারেই অকল্পনীয়। বিশেষ করে মুক্তমনা পরিবারের জন্য এ এক বিরাট ক্ষতি। মুক্তমনার উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি।

 

ড. জাফর উল্লাহর পরিচয় বিবিধ। বর্ণাঢ্য মানুষ ছিলেন তিনি।  জেনেটিক্সের উপর পিএইচডি করেছিলেন ১৯৭৫ সালে ওহাইয়োর সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।  পোস্ট ডক করেছিলেন নিউইয়র্কের স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তারপর ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত আরবানা শ্যাম্পেইনের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৮৫ সালের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিউ অর্লিন্সের  USDA’এর সাদার্ন রিজনাল রিসার্চ সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। এনজাইম নিয়ে তার বেশ কিছু কাজ বায়োকেমিস্ট্রি এবং কৃষিতে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে আমাদের কাছে জাফর উল্লাহর পরিচয় সেগুলো ছিল না।  তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এবং মুক্তবুদ্ধির জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক সৈনিক।

আমি উনাকে ‘জাফর ভাই’ বলে ডাকতাম। আমার সাথে মাঝে সাঝেই ফোনে কথা হত। তার ছোট ছেলেকে জর্জিয়াটেকে ভর্তির সময় আটলান্টা এসেছিলেন, আমার সাথে সেই একবারই দেখা। আজ ঘুরে ফিরে কেবলই সেই স্বল্পকালীন আড্ডার কথা মনের আঙ্গিনায় ভেসে উঠছে।

আজকের তরুণ প্রজন্ম জাফর উল্লাহর লেখালিখির সাথে কতটুকু পরিচিত জানি না, একসময় ইন্টারনেটের সেক্যুলার লড়াকু লেখক বুঝতে আমরা জাফর উল্লাহকেই বুঝতাম।  তখনো মুক্তমনার জন্ম হয়নি।  জন্ম হয়নি বাংলা ব্লগগুলোর। এনএফবি (নিউজ ফ্রম বাংলাদেশ) নামের একটা অনলাইন পত্রিকা ছিল, তার সম্পাদক ছিলেন তানভীর চৌধুরী। তিনি তার পত্রিকায় একটা প্ল্যাটফর্ম করে দিয়েছিলেন , ‘রিডার্স ওপিনিয়ন’ বিভাগে লেখালিখি করার।  জামাল ভাইয়ের (জামাল হাসান)  কল্যাণে কি করে যেন এই সাইটের ঠিকানা পেয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম এলাহি কাণ্ডকারখানা।   লেখালিখিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে একগুচ্ছ মুক্তমনা লেখক। তাদের ক্ষুরধার লেখনীর কাছে পর্যুদস্ত হতেন সেই সব মন মানসিকতার লোকেরা যাদেরকে আমরা বাংলা ব্লগগুলোতে ‘ছাগু’ নামে চিনি। সাহসী লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল, আপন বৈচিত্র্যে ভাস্বর ছিলেন জাফর ভাই।   নিজে তো লিখতেনই, কেউ চাইলে তাদের লেখাও সংশোধন করে দিতেন।  আমিও এনএফবিতে কিছু পাঠানোর আগে অনেক সময় জাফর ভাইকে দিয়ে ভাষা এবং ব্যাকরণগুলো ঠিক ঠাক করিয়ে নিতাম প্রথম দিকে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম বাংলাভাষাভাষী লেখকদের মধ্যে ইংরেজিতে এত দক্ষ খুব কম লেখকই অনলাইনে পাওয়া যায়। পরে বুঝেছিলাম আমি ভুল ছিলাম। সঠিক বাক্যটি হবে, শুধু বাঙালি নয়, ইংরেজি ভাষাভাষীদের গোনায় ধরলেও খুব কমই পাওয়া যাবে যিনি জাফর উল্লাহর মতো চমৎকার ইংরেজি লিখতে পারতেন।

২০০১ সালে মুক্তমনা তৈরির পর উনাকে এখানে লিখতে অনুরোধ করি। জাফর ভাই খুব আগ্রহ নিয়েই আসলেন। লেখালিখি করতে করতেই মুক্তমনার জড়িয়ে গেলেন তিনি।  ডারউইন দিবস, যুক্তিবাদী দিবস, নারী দিবস পালন করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন। বিবর্তন নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন জাফর ভাই (এখানে)।  মানববিবর্তন নিয়ে অনেক লেখা লিখেছেন তিনি (এখানে), লিখেছেন ইনটেলিজেন্ট ডিজাইন বনাম বিবর্তন বিতর্ক নিয়েও (এখানে, এখানে)।  যখন বরেণ্য লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ঘাতকাহত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন কলম তুলে নিয়েছিলেন জাফর ভাই।  সিরিজ আকারে প্রবন্ধ লিখেছিলেন ইসলামিস্টদের নষ্টামি নিয়ে (এখানে, এখানে, এখানে, এখানে)।  জার্মানিতে যাওয়ার প্রাক্কালে দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি মর্মস্পর্শী ‘খোলা চিঠি’ লিখেছিলেন হুমায়ুন আজাদ।  অবধারিতভাবে সেই চিঠিটি অনুবাদের যোগ্য লোক হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলেন জাফর উল্লাহ। তাঁর অনুদিত চিঠিটি মুক্তমনায় তো বটেই, দেশের এবং বিদেশের বহু খ্যাতনামা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল সেসময়।

জাফর ভাই ছিলেন মননশীল একজন সাংস্কৃতিক মানুষ। তার নমুনা পাওয়া যায় তার বহু কাজ কর্মে।  জোয়ানা কার্কপ্যাট্রিক নামের এক ব্রিটিশ লেখিকার সাথে মিলে কালিদাসের মেঘদূত পুরোটা ইংরেজিতে অনুবাদ করে ফেলেছিলেন তিনি (এখানে, এখানে)।  তিনি সুযোগ পেলেই অনুবাদ করতেন জীবনানন্দ দাসের কবিতা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা।   লেখালিখির পাশাপাশি গান বাজনাতেও অফুরন্ত উৎসাহ ছিল তাঁর। বড় কোন কনসার্টে গেলে আমাকে জানাতেন তিনি, মাঝে মধ্যে এমপিথ্রি ফরম্যাটে ফাইল পাঠাতেন আমাকে শোনানোর জন্য।  সঙ্গীত নিয়ে তাঁর অনুরাগের চিহ্ন আমাদের মুক্তমনা সাইটেও রয়ে গেছে বিভিন্ন জায়গায় (এখানে, এখানে)।  পরে জেনেছিলাম দেশে ‘ঝঙ্কার’ নামে মিউজিকাল স্টুডিওর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি।

জাফর ভাই ছিলেন আগাগোড়া স্পষ্টভাষী।  নিজের আদর্শের ব্যাপারে আপোষ করেননি তিনি। একটা ঘটনা উল্লেখ করি। যারা মুক্তমনার পুরনো সদস্য তারা অনেকেই মনে করতে পারবেন। মুক্তমনার পাশাপাশি ভিন্নমত নামেও একটা সাইট ছিল এক সময়। সত্যিকার মুক্তমনা লেখকদের পাশাপাশি চরমপন্থি কিছু লেখক খুঁটি গেড়েছিল সেখানে। যুক্তিবাদ মানবতাবাদ নয়, তাদের  একমাত্র মিশন ছিল কেবল ‘ইসলাম তাড়ানো’। তারা ইসলাম তাড়ানোর জন্য বুশের মত উগ্রপন্থী প্রেসিডেন্টের যাবতীয় কাজকর্ম সমর্থন করতেন। আফগানিস্তানের বোমা মারা, ইরাক আক্রমণ থেকে শুরু করে নির্বাচনে জন কেরির বদলে বুশকে সমর্থন করে ভোট চাওয়া, প্যালেস্টাইনে ইসরাইলী আগ্রাসন  সহ সবকিছুই তারা  সমর্থন করতেন। এহেন চরমপন্থা জাফর ভাইয়ের পছন্দ হয়নি। একসময় এই ভিন্নমতীদের থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিলেন তিনি।  আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে গঠন করলেন মুক্তমনাদের সত্যিকারের মিশন, যারা কেবল ইসলাম বা মুসলিমদের বিরুদ্ধেই কথা বলবে না, যে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদী থাকবে। কেবল ধর্ম নয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং  সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটা মননশীল সাইট হবে মুক্তমনা। আমরা তাঁর নেতৃত্বে ইরাক যুদ্ধের বিরোধিতা করছিলাম, আমেরিকার নির্বাচনে যুদ্ধংদেহী ম্যাকেইন  কিংবা মিট রমনীর বদলে ওবামাকেই বেছে নিয়েছিলাম (এখানে, এখানে, এখানে)।  ইসলামের কঠোর সমালোচক হবার পরেও প্যালেস্টাইনের উপর যখন গণহত্যা হতো, ইরাকে নির্বিচারে বোমা মারা হত, কিংবা হত কাশ্মীরী মুসলিমদের উপর অত্যাচার,  জাত ধর্ম ভুলে জাফর উল্লাহ কলম তুলে নিতেন তাদের পক্ষে দাঁড়াতে, কখনো পিটিশন লেখায় সহায়তা করতেন, গণহত্যা বন্ধের দাবীতে।  সত্যিকারের মুক্তমনা তো এরকমই হয়।

মাঝে বহুদিন ব্লগে অনুপস্থিত ছিলেন জাফর ভাই। শুনেছিলাম শরীর খারাপ। চোখে সমস্যা। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলেই লেখায় ফিরে আসতেন তিনি।  শাহবাগ আন্দোলন শুরু হবার পরে বাংলায় এবং ইংরেজিতে লেখা লিখলেন। আসিফ মহিউদ্দীন, রাসেল, শুভ আর বিপ্লব – চারজন ব্লগারদের যখন অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হল, বিক্ষুব্ধ হলেন জাফর ভাই। মুক্তমনায় লিখলেন, ‘Muzzling the voice of freethinking bloggers: An alarming development in Bangladesh!’।  অগ্নিঝড়া কলম থেকে যেন বারুদের গন্ধ –

…The Mullahs in Bangladesh do not want the impressionable children to hear the above mentioned scientific truth. They think ignorance is bliss. It is a whole lot better that way.

Most folks in this modern world have trust in the freedom of speech and expression. This should be the way in Bangladesh. The government of Bangladesh is trying to curtail or ration our freedom of speech. This is an alarming development. We all should protest against this misadventure of the government. Sheikh Hasina’s government thinks that it is politically expedient now to go after the atheist bloggers because this will give them a boost in electoral counts in the upcoming parliamentary election.

Let us not delude ourselves that this is the cumulative work of all the deshi bloggers who made it possible to have the Shahbag Movement. What Awami Leaguers could not achieve in the last dozen years was only possible by college kids who vilified the politicians belonging to Jamaat that took part in crime against humanity.

In this day of the Internet, it will be an exercise in futility on the part of government to muzzle the voice of the bloggers. There are several ways that a blogger could post his or her commentary in the Net. Barely a decade ago, it was not possible to post any articles for wider dissemination in the cyberspace, but now it is just a mouse-click away.

The government’s ill-conceived plan to bar bloggers from posting and to incarcerate them on trumped-up charges of maligning Islam will give them a black eye. Bangladesh will become a laughingstock to the rest of the world barring Taliban and Saudi Kingdom.

The government should think twice before undertaking this misadventure to harass the free-spirited bloggers. They have achieved something in one-month time, which no political party in Bangladesh had achieved in their lifetime.’

আজ লেখাটিতে গিয়ে দেখলাম – তার এই লেখাটি দেড় হাজারের বেশি পঠিত হয়েছে, ফেসবুকে শেয়ার হয়েছে পাঁচশর বেশি, টুইট করা হয়েছে প্রায় আড়াইশ।  বিদেশী মিডিয়াতেও লেখাটা রেফার করা হয়েছে একাধিকবার, হাফিংটন পোস্টে উদ্ধৃত হয়েছে। মূলতঃ এ লেখা থেকেই বাইরের পৃথিবী জানতে পেরেছিল বাংলাদশের ব্লগারদের উপর চলছে সরকারী নিপীড়নের স্টিমরোলার। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল,  সিএফআই, আইএইচইইউ সহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার এবং মুক্তমনা সংস্থাগুলো সচেতন হতে পেরেছিল। মুক্তমনায় জাফর ভাইয়ের শেষ লেখা ছিল হেফাজতে ইসলামীদের লং মার্চ নিয়ে –‘ Secularists are at loggerheads with Islamists in Bangladesh’ ।  প্রকাশিত হয়েছিল এপ্রিল মাসের ৫ তারিখে।

আমি জানতাম না, যে মুহূর্তে আমরা লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, আসিফের মুক্তি এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করছিলাম, জুন মাসের শেষ দিকে বড় সড় কার্ডিয়াক এরেস্টে জাফর ভাই হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর থেকেই প্রায় অচেতন অবস্থাতেই ছিলেন। শেষ দিকে একেবারেই সংজ্ঞাহীন কোমায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। সে অবস্থা থেকে আর ফিরে আসেননি তিনি। গতকাল পরিবার পরিজনের সম্মতিতে লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়া হয় তার।  মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার বড় ছেলে রাশাদ উল্লাহ বাবার পাশে থেকে প্রিয় সঙ্গীতগুলো শুনিয়ে গিয়েছেন।  সুরের মূর্ছনাতেই ধীরে ধীরে হারিয়ে গেলেন আমাদের সঙ্গীতপ্রিয় জাফর ভাই।

বিদায় জাফর ভাই, বিদায় লড়াকু সেক্যুলারিস্ট সৈনিক।  বিদায়।