এই লেখাটার প্রথম পর্ব এখানে রয়েছে।ওখানে আমি কথা দিয়েছিলাম যে এক সপ্তাহের মধ্যে এর দ্বিতীয় পর্ব পোস্ট করবো। ভদ্রলোকের এক জবান, এক সপ্তাহের মধ্যেই দ্বিতীয় পর্ব নামিয়ে দিয়েছি। তবে কত দিনে বা কত মাসে আমার সপ্তাহ হয়, সেটা জানার চেষ্টা না করাটাই বাঞ্ছনীয়। শুধু এইটুকুই জানিয়ে দিচ্ছি যে, এবারও পরের পর্ব সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই এসে হাজির হবে। নতুন পাঠকেরা আগের পর্বটা আগে পড়ে নিলে পরের পর্ব  উপভোগ করতে পারবেন যুৎ করে। পুরোনো পাঠকেরাও একবার ঢু মেরে আসতে পারেন ওখান থেকে। স্মৃতিশক্তি একটু ঝালাই হয়ে যাবে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে নিশ্চয়ই অনেক কিছুই ভুলে গেছেন আপনারা। 🙂  


সিরিজ লেখার ব্যাপারে আমার মনে হয় কোনো কুফাটুফা আছে। আজ পর্যন্ত যতগুলো সিরিজ লেখা শুরু করেছি, তার কোনোটাই আমি শেষ করতে পারি নাই। এক দুই পর্বের পরেই সেগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এই সিরিজটার ভাগ্যও যে অন্যরকম কিছু হবে, সেরকম কোনো আভাষ পাচ্ছি না। রোজা রমজানের দিন, পাঠকেরাই বরং খাস দিলে আমার জন্য একটু দোয়া দরুদ পড়েন। মহান আল্লাহপাক যেন আমাকে এই সিরিজটা শেষ করার তৌফিক দান করেন। আমেন। 

 

. ইতিহাসের সরল পাঠ 

মোগল শাসকেরা শুধু রাজ্য শাসন করেই তৃপ্ত ছিলেন না, নিজেদের শৌর্য্যবীর্যগাথা নিয়ে প্রশংসাসূচক বাক্য শোনারও মনোবাঞ্ছা ছিল। বাসনা ছিল ইতিহাসের পাতায় অমর হবার। সে কারণেই তাঁরা বিখ্যাত সব ঐতিহাসিকদের ভাড়া খাটিয়েছেন তাঁদের মনোপুত ইতিহাস লেখার জন্য। বাবুরের ক্ষেত্রে এটা লাগে নি। কারণ তিনি নিজেই নিজের জার্নাল লিখে রেখে গেছেন। তাঁর ঝঞ্ঝাবহুল জীবনের অকপট বর্ণনা লিখে রেখেছেন তিনি তাঁর বাবুরনামায়। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরী আকবরের আকাঙ্ক্ষা ছিল আরো বেশি। আরো বেশি প্রশংসাসূচক, আরো বেশি ভালো ভালো কথা, আরো বেশি বীরত্বব্যাঞ্জক ইতিহাসের প্রতি লোভ ছিল তাঁর। 

গুলবদনের গল্প বলার দারুণ সুনাম ছিল। এই সুনামের কারণেই বাদশা আকবর তাঁকে হুমায়ুনের জীবনবৃত্তান্ত লেখার জন্য দায়িত্ব দেন। মুগলদের মোটামুটি এটা একটা রেওয়াজই ছিল বিভিন্ন নামী দামী পণ্ডিতদের দিয়ে নিজেদের সময়কালকে লিপিবদ্ধ করা। আকবরের নিজের জীবনী আকবরনামা লিখেছেন পারসি পণ্ডিত আবুল ফজল। আকবর তাঁর ফুফুকে হুমায়ুনের জীবনের বিজয়গাথার আনন্দ এবং পরাজয়ের বেদনাসমূহ লিখতে বলেন। গুলবদন আকবরের এই আহবানে সাড়া দেন এবং তার নিজের মত করে হুমায়ুনের জীবনের ঘটনাসমূহ বর্ণনা করেন। এই বর্ণনাই হুমায়ুননামা। মূল নামটা ছিল বিশাল। আহওয়াল হুমায়ুন পাদশাহ জামাহ কারডম গুলবদন বেগম বিন্তে বাবুর পাদশা আম্মা আকবর পাদশাহ। এটা পরে হুমায়ুননামা হিসাবে বহুল পরিচিত হয়। 

গুলবদন হুমায়ুননামা লিখেছিলেন সরল ফার্সিতে। ভাষার অলংকরণে তিনি যান নি, যেটা তাঁর সময়ের লেখকেরা করতেন। তাঁর বাবা বাবুরও একই একই স্টাইলে বাবুরনামা লিখেছিলেন। তাঁর সময়ের অন্য লেখকেরা যেখানে ঘটনা বর্ণনায় আলংকরিক ভাষার আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে গুলবদন যা ঘটেছে তার উপরেই নির্ভর করেছেন। যার কারণে উঁচুমানের লেখকদের তুলনায় তাঁর লেখা অনেক বেশি সতেজ এবং উঠে এসেছে হৃদয় থেকে। তাঁর লেখা থেকে শুধু হুমায়ুনের শাসনামলের বিভিন্ন দিকই উঠে আসে নি, বরং মুগল হেরেমের অন্তরালের জীবনযাপনও উঠে এসেছে। ষোড়শ শতকে লেখা মুগল কোনো নারীর লেখা। 

এই স্মৃতিকথাটি হারিয়ে গিয়েছিল কয়েক শতাব্দী ধরে। পরে যখন পাওয়া গিয়েছে তখন এটির প্রায় জীর্ণ দশা। বাজেভাবে বাধাই করা। অনেকগুলো পৃষ্ঠাও খোয়া গিয়েছে। যা আর কোনো দিনই উদ্ধার করা যায় নি। অসম্পুর্ণ পাণ্ডুলিপি এটি। শেষ অধ্যায়ের অনেকখানি-ই নেই। তারপরেও যা আছে, সেটিই অবিশ্বাস্য। মুগল হেরেমে বসবাস করা উচ্চপর্যায়ের একজন নারীর চোখে আমরা সেই সময়কে দেখতে পাই। এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ছিল হাতে গোনা মাত্র কয়েকটা। সে কারণেই হয়তো এটি যে ধরণের গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল তা পায় নি সেই সময়ে। মুগল ইতিহাসের এই দলিল লোক চক্ষুর অন্তরালে থেকে গিয়েছিল। 

ছিন্নভিন্ন একটা কপি ছিল ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। এ্যানেট এস বেভারিজ গুলবদনের এই ফার্সিতে লেখা বইটা ইংরেজিতে অনুবাদ করেন ১৯০২ সালে। ভারতে এর পেপারব্যাক সংস্করণ বের হয় ২০০১ সালে। এই পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করেছিলেন কর্নেল জি ডাব্লিউ হ্যামিল্টন। তিনি শুধু এটি নয়, প্রায় হাজার খানেক পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করেছিলেন বিভিন্ন বিষয়ের উপর। তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর বিধবা স্ত্রী এটিকে ১৮৬৮ সালে বিক্রি করে দেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। কিন্তু ১৯০১ সালের আগ পর্যন্ত এর অস্তিত্ব তেমন কেউ জানতো না। এ্যানেট এস বেভারিজ এটাকে অনুবাদ শুরু করার পরেই এর দিকে মানুষের নজর পড়ে। 

আকবর তাঁর ফুফুকে খুব ভালো বাসতেন। গুলবদনের যখন ষাট বছর বয়েস, আকবর তাঁর গল্প বলার অতুলনীয় ক্ষমতার কারণে তাঁর এবং অন্যদের স্মৃতির উপর নির্ভর করে হুমায়ুন এবং বাবুরের ইতিহাস রচনা করার জন্য বলেন। গুলবদন আকবরের এই অনুরোধে সাড়া দিয়েছিলেন। আর ফলাফল হয়েছিল বিস্ময়কর। 

সেই সময়ে বা পরবর্তী সময়েও ইতিহাস লিখতো বাদশাহদের ভাড়া করা লোকেরা। এই সব ভাড়াটে লোকদের ইতিহাস হতো বাহুল্যময় এবং বিরক্তিকর। যার ইতিহাস লেখা হতো তাকে বিশাল পুজোনীয় কেউ বানিয়ে দেওয়া হতো কাল্পনিক সব গুণাগুণ আরোপ করে। আসলে কী ঘটেছিল সেগুলো প্রায়শই চেপে যেতো তাঁরা। গুলবদনের বই এই সব বৈশিষ্ট্য বর্জিত ছিল। তাঁর বর্ণনা ছিল অলংকারবর্জিত সাদামাঠা, একেবারে সত্যিটাকে তিনি তুলে এনেছিলেন অনাড়ম্বরভাবে। অনাড়ম্বর কিন্তু আন্তরিকতার কোনো খাদ ছিল না সেখানে। 

তাঁর পাণ্ডুলিপি লেখা হয়েছিল অনেকটা ডায়েরির মত করে। তিনি যাঁদের নিয়ে লিখেছেন তাঁদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি এক্ষেত্রে নিজেকেও বাদ দেন নি। আর এ কারণেই পাঠকের কাছে এটি হয়ে উঠেছে আকর্ষণীয়। হুমায়ুননামা পড়লে কে গুলবদনের প্রিয় ছিল আর কে অপ্রিয় ছিল, এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র বেগ পেতে হয় না। এমনই অকপট সারল্য ছিল তাঁর বর্ণনায়। হেরেমবাসিনী হবার ফলে অসাধারণ এক সম্পদের অধিকারী ছিলেন তিনি। এই সম্পদের কোনো নাগাল পুরুষ ঐতিহাসিকেরা কখনোই পান নি। হেরেমের অভ্যন্তরের মহিলাদের অভিমত, চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতিকে যেভাবে তিনি কাজে লাগানোর সুযোগ পেয়েছেন, পুরুষ ইতিহাসবেত্তাদের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। বাবুরের বিষয়ে তাঁর খুব একটা স্মৃতি ছিল না, যেহেতু তিনি তখন অনেক ছোট ছিলেন। কিন্তু হেরেমের অন্যান্য নারী, যাঁদের বাবুরের সাথে স্মৃতি রয়েছে, তাঁদের কাছ থেকে তিনি সেগুলো সংগ্রহ করেছেন। গুলবদন সেই সময়কার সংস্কৃতি, প্রথা নিয়েও আলোচনা করেছেন। তিনি এগুলো নিয়ে আলাপ না করলে আমাদের হয়তো সেগুলো জানাই হতো না। হারিয়ে যেতো চিরদিনের জন্য। 

হুমায়ুননামা অসম্পূর্ণ রচনা। হুমায়ুনকে নিয়ে লেখা কিন্তু হুমায়ুনের মৃত্যুর ঘটনা এতে নেই। হুমায়ুন মারা গেছেন ১৫৫৬ সালে। আর এই পাণ্ডুলিপি শেষ হয়েছে ১৫৫২ সালে। শেষটা হারিয়ে গেছে নাকি আদৌ লেখা হয় নি, তার কিছুই জানি না আমরা। তবে, যে অবস্থায় হঠাৎ করে অসম্পূর্ণ বাক্য দিয়ে এটি শেষ হয়েছে তাতে অনুমান করা যায় যে শেষ অংশটা হারিয়েই গেছে চিরতরে। 

গুলবদন তাঁর পাণ্ডুলিপিতে প্রচুর তুর্কি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কোনোটা এসেছে সাবলীলভাবে, কোনোটাকে বা জোর করে গুঁজে দেওয়া হয়েছে। গুলবদনের মাতৃভাষা ছিল তুর্কি। এমন কী তাঁর স্বামীর ভাষাও ছিল তুর্কি। ফার্সি তিনি শিখেছিলেন। ফলে, এই সন্দেহও জেগেছে যে, তিনি কি এটা ফার্সিতে রচনা করেছেন? নাকি, তুর্কিতে? তুর্কিতে যে তাঁর অসাধারণ দখল ছিল, এটা জানা যায় তাঁর বেড়ে উঠার পরিবেশ এবং বাবুরের বইয়ের রেফারেন্স দেওয়া থেকে। 

. সাঁতার  না জানা এক শাহজাদা 

জনপ্রিয় সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ বাদশাহ হুমায়ুনকে নিয়ে একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন।  নাম বাদশাহ নামদার। এই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, 

সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। এই অর্থে হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাঁতারই জানেন না সেখানে সারাজীবন তাঁকে সাঁতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। 

সম্রাট হুমায়ুন বহু বর্ণের মানুষ। তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রঙ ব্যবহার করতে হয় নি। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয় নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয় নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পুর্ণ। 

আসলেই তাই। হুমায়ূনের জীবন ছিল বর্ণিল,  চড়াই-উৎড়াইয়ে ভরপুর শোভাময়। নানা রঙে সিক্ত রংধনুসম এক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। 

বাদশাহ বাবুবের প্রথম স্ত্রী মহমের গর্ভে হুমায়ুনের জন্ম। হুমায়ুন ছিলেন পিতার অসম্ভব আদরের সন্তান। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বাবুরের নিজের লেখা আত্মজীবনীতেই। সমরখন্দ থেকে ব্যর্থ মনোরথে হুমায়ুন হঠাৎ করে ফিরে আসার পরে পুত্রের দর্শনে পিতা কীভাবে আনন্দিত হয়েছিলেন তা লিখে গেছেন বাবুর এভাবেঃ 

আমি  হুমায়ুনের মাতার সহিত হুমায়ুনের  বিষয় আলাপ করিতেছিলাম। এরূপ সময় হুমায়ুন আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহার এইরূপ সপম্পূর্ণ আকস্মিকভাবে আগমন করায় আমার হৃদয় গোলাপ-মুকুলের ন্যায় প্রস্ফুটিত ও আমাদের নয়ন প্রদীপের ন্যায় উজ্জ্বল দীপ্তিলাভ করিল। ভোজনের সময় আত্মীয়স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা আমরণ নিয়ম, কিন্তু এই উপলক্ষে তাহার সম্মানার্থে ভোজের আয়োজন করিয়া তাঁহাকে বিবিধ প্রকারে মর্য্যাদা প্রদর্শন করিয়াছিলাম। আমরা কিয়দ্দিন এক সঙ্গে বাস করিয়াছিলাম। 

হুমায়ুনের প্রতি বাবুরের এই স্নেহ ভালবাসার বিবরণ শুধু বাবুরের আত্মজীবনীতেই নেই, এস, এম এডওয়ার্ড তাঁর “বাবর” বইতেও বাবুর সম্পর্কে প্রচলিত  একটা গল্পের বর্ণনা দিয়েছেন। এই গল্প থেকে বোঝা যায় যে, হুমায়ুন বাবুরের কতখানি প্রিয় সন্তান ছিল। 

১৫৩০ খ্রীষ্টাব্দের শেষ ভাগে হুমায়ুন প্রবল জ্বর রোগে আক্রান্ত হন। আগ্রার সুনিপুণ এবং সুবিখ্যাত চিকিৎসকেরা প্রাণপণ যত্ন দ্বারা  কিছুই  করিতে পারিলেন না। বাবর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী প্রিয়তম পুত্রের জীবন-রক্ষার জন্য বিবিধ ধর্ম্মকার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন। এই সময়ে বাবরকে একজন দরবেশ বলিলেন –যদি কেহ যুবরাজের জন্য প্রাণ দেন তাহা হইলে তাঁহার জীবন রক্ষা হইতে পারে। বাবর বলিলেন – “আমার প্রিয় পুত্রের জীবন রক্ষার জন্য আমিই প্রাণ দিব।“ এইরূপ বলিয়া বাবর পুত্রের শয্যার পার্শ্বে বসিয়া ভগবানের নিকট পুত্রের আরোগ্য প্রার্থনা করিতে লাগিলেন এবং অবশেষে হুমায়ুনের শয্যার চারিদিক তিনবার প্রদক্ষিণ  করিয়ায় কহিলেন, “আমি ব্যাধি গ্রহণ করিলাম, আমি  ব্যাধি গ্রহণ করিলাম।“ ফলে তাহাই হইল। সেদিন হইতে হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করিতে লাগিলেন আর বাবর অত্যন্ত অসুস্থ  হইয়া পড়িলেন। সত্য সত্যি হুমায়ুন আরোগ্য লাভ করিলেন এবং  সেই রোগে বাবর প্রাণত্যাগ করিলেন। 

বাবুর এবং হুমায়ুনকে নিয়ে এই অলৌকিক গল্পটি বহুল প্রচলিত। এর উৎসভুমি খুব সম্ভবত গুলবদনের হুমায়ুননামা। তিনি হুমায়ুননামাতে হুমায়ুনের প্রতি বাবুবের অত্যাধিক স্নেহ ভালবাসা প্রমাণ করার জন্য এই গল্পটি ফেঁদেছিলেন। হুমায়ুনের রোগাক্রান্ত হওয়া, বাবুরের প্রার্থনা, হুমায়ুনের আরোগ্যলাভ, এবং পরবর্তীতে বাবুরের অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করা, এর কোনোটিই অসত্য নয়,  তবে অসত্য অংশ হচ্ছে এর সঙ্গে আরোপিত অলৌকিক অংশটি।  যাই হোক হুমায়ুননামা থেকে দেখি গুলবদন এ বিষয়ে কী বলেছেনঃ 

হঠাৎই দিল্লি  থেকে মওলানা মুহাম্মদ ফরগলির একখানা পত্র এল যাতে লেখা হয়েছে যে মির্জা হুমায়ুন গুরুতর অসুস্থ। একে তো অল্প কদিন আগে আমাদের কনিষ্ঠ ভ্রাতা মির্জা আলয়ারের দেহান্ত হয়েছে। এখন মির্জা হুমায়ুনের অসুস্থতার সংবাদে আমার মাতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কোনোমতে তাঁর জ্ঞান ফেরানো হলে প্রচন্ড মানসিক উদ্বেগ ও যন্ত্রণা নিয়েই তিনি দিল্লি যাত্রা  করেন। পথে মথুরাতে মাতাপুত্রের সাক্ষাৎ হল। তিনি তখন অত্যন্ত দুর্বল এবং শীর্ণ। মথুরা থেকেই মির্জা হুমায়ুন সহ তাঁরা আগ্রাতে ফেরেন। আগ্রাতে আসার পর আমি এবং আমার ভগিনীরা আমাদের ফেরেস্তার মতো ভাইটিকে দেখতে তাঁর কষে গেলাম এবং  সকলে মিলে তাঁর রোগশয্যা ঘিরে দাঁড়ালাম। ভ্রাতা হুমায়ুন এতটাই দুর্বল ছিলেন যে ক্ষণে  ক্ষণে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। জ্ঞান ফিরে আসতেই আর্ধনিমিলিত চোখে আমাদের উদ্দেশ্য করে স্নেহপুর্ণ কণ্ঠে বললেন, ভগিনীরা তোমরা আমার শুভেচ্ছা নাও। তোমরা দূরে দাঁড়িয়ে না থেকে আমার আরও কাছে এসো। আমার বুকে এসে আমাকে ভালবাসা জানাও, ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নানা কারণে আমি কোনোদিন তোমাদের আলিঙ্গন করে স্নেহাশিষ দিইনি। এইভাবে তিনি তিনবার আমাদের উদ্দেশ্যে এই ধরণের কথা বললেন। ইতিমধ্যে আলা হজরত বাদশাহ বাবুর ওখানে এলেন এবং রোগীর বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ  করলেন। তিনি হুমায়ুন মির্জার রক্তশূন্য মুখমন্ডল দেখে অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। অন্যদিকে শ্রদ্ধেয় পিতাকে দেখেও শাহজাদা হুমায়ুন আবেগ বিহবল হয়ে পড়েন। আমার মাতা যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বাদশাহ হুজুরকে বললেন, আমার পুত্রের জন্য তোমার এত ভাবনা  কীসের?  তুমি বাদশাহ, তোমার আরও অনেক পুত্রকন্যা  আছে, কিন্তু আমি হতভাগিনী মাতা, আমার ওই একটিমাত্র পুত্র। উত্তরে বাদশাহ বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ বেগম, আমার আরও পুত্রকন্যা আছে। কিন্তু শাহজাদা হুমায়ুনই আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমি প্রার্থনা  করি তোমার এই পুত্র একদিন যশস্বী হবে এবং চিরকাল সুখে সম্পদে থাকবে। তাছাড়া সে আমার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। আমার অন্য পুত্রেরা কেউই মির্জা হুমায়ুনের মতো যোগ্য নয়। 

মির্জা হুমায়ুনের রোগ যখন  দিন দিন বেড়ে চলেছে, চিকিৎসকদের  সমস্ত চেষ্টাই প্রায় ব্যর্থ হতে চলেছে তখন  পিতা  হুজুর  হজরত আলি মুর্তজাকে স্মরণ করে মির্জা হুমায়ুনের শয্যার চারপাশ প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন। শেষ পর্যন্ত পুত্রের জীবন রক্ষার আর কোনো উপায় না দেখে আল্লাহর কাছে করুণ আর্জি পেশ করলেনঃ 

‘হে মহান খোদাতালা, যদি একজনের প্রাণ দিয়ে আরেকজনের প্রাণরক্ষা আপনার মর্জি হয় তাহলে আমি  আমার প্রিয়তম পুত্র মির্জা হুমায়ুনের প্রাণের পরিবর্তে নিজের প্রাণ দিতে প্রস্তুত। নিজের প্রাণের বিনিময়ে আমি আমার পুত্রকে ফিরে পেতে চাই, খোদা।‘ হজরতে আলা বাদশাহ বাবুর যেদিন থেকে খোদার দরবারে এই আর্জি পেশ করা আরম্ভ করেছিলেন সেই দিনটি ছিল জুম্মাবারের আগের আগের দিন। আশ্চর্য! এই প্রার্থনার পরই বাদশাহ বাবুর ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং শাহজাদা হুমায়ুন ধীরে ধীরে সুস্থ হতে লাগলেন। 

বাবুরের অসুস্থ হয়ে পড়াটাকে গুলবদন অলৌকিক হিসাবে প্রচার করেছেন। কিন্তু এতে অলৌকিকতার কিছুই  ছিল না। তিনি নিজেও তা জানতেন। বাবুর আসলে বিষে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গুলবদনের তা অজানা ছিল  না। তা সত্ত্বেও এটাকে তিনি অলৌকিকতার মোড়ক দিতে চেয়েছিলেন। বাবু্রের খাবারের সাথে যে বিষ মেশানো হয়েছিল এবং এর প্রতিক্রিয়াতেই যে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, প্রার্থনার কারণে সন্তানের রোগ তার দেহ থেকে সরে এসে পিতার দেহে বাসা বাধেনি, তা গুলবদনের লেখনি থেকেই জানা যায়। তিনি লিখেছেনঃ 

এসময় বাদশাহের পেটের যন্ত্রণা ভীষণভাবে  বেড়ে উঠল। মির্জা হুমায়ুন তো পিতার  এরকম অবস্থা দেখে ভাবনায় আকুল। তিনি ভেবেই পাচ্ছেন  না কী করলে পিতা হজুরের কষ্ট লাঘব হবে।  হাকিম ও অন্যান্য  চিকিৎসকদের সকলকেই তলব করা হল। তাদের বলা হল, স্বয়ং বাদশাহ রোগাক্রান্ত তারা যেন তাদের সমস্ত বিদ্যা ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার উজার করে বাদশাহের চিকিৎসা  করে। যে করেই হোক তাঁকে যেন সুস্থ করে তোলা হয়। হাকিম বৈদ্যরা পুনরায় বাদশাহের স্বাস্থ্য  পরীক্ষা  করে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা  করলেন। তারপর ব্যর্থ হয়ে শাহজাদা হুমায়ুনের কাছে একরকম আত্মসমর্পণ  করে বললেন, আমরা অত্যন্ত দুঃখিত এবং লজ্জিত যে আমাদের কোনো ওষুধই আলা হজরতের রোগ  নিরাময় করতে পারছে না। এখন একটাই উপায়, খোদার কাছে প্রার্থনা করা। তিনিই পারেন কোনো অদৃশ্য চমৎকারি ওষুধের মাধ্যমে বাদশাহ হুজুরের রোগ দূর করতে। এই সমস্ত আলাপ আলোচনার পর তাঁরা আবার বাদশাহের ধমনির স্পন্দন মাপলেন এবং বললেন, এই স্পন্দন দেখে মনে হচ্ছে  বাদশাহ হুজুরকে বিষ দেওয়া হয়েছে। হাকিমদের অনুমান সত্য ছিল। পরাজিত সুলতান ইব্রাহিমের মাতা পুত্র হত্যার প্রতিশোধের মানসে পিতা হুজুরের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে ছিল। আশ্চর্যের কথা এই, শয়তান বৃদ্ধাকে পিতা হুজুর মাতা সম্বোধন করতেন। তাকে বাস করার জন্য উপযুক্ত বাড়ি পর্যাপ্ত জায়গির ও অন্যান অনেক সুবিধাদি দিয়েছিলেন। কিন্তু এরা ছিল নিম্ন জাতির  এবং নিম্ন রুচির। পিতার মহত্ত্ব এদের কুটিল মনে কোনো রেখাপাতই করেনি। পিতা এদের জন্য যত বেশি করেছেন এদের মনের মধ্যে হিংস্রতার বীজ তত তীব্র হয়ে উঠেছিল। কারণ তারা ভাবত এসব অনুগ্রহ তাদের প্রাপ্য। প্রকৃতপক্ষে তারা মানুষ হিসাবেই ছিল  অত্যন্ত ক্রুর, হিংস্র এবং নিমকহারাম।  কথায় বলে, প্রত্যেক বস্তু নিজের প্রকৃত সত্তার দিকেই কোনো না কোনোদিন ফিরে যায়। মোটকথা, ইব্রাহিম লোদির মা যখন তার কোনো বিশ্বস্ত লোক মারফত বাদশাহের রসুইখানার বাবুর্চির হাতে এই বিষ পৌঁছে দেয়, তখন সেই বাবুর্চি  তার মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেলেছিল।  সে বিষের পুরিয়া  নিয়ে এত ভয় পেয়েছিল যে তাকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা সে কার্যকরী  করতে পারেনি। কোনো মতে নানরুটির উপরে কিছু বিষের গুঁড়ো সে ছড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিন আহারে বাদশাহ সামান্য পরিমাণেই নানরুটি খেয়েছিলেন। কিন্তু বিষ এত তীব্র ছিল যে ওই সামান্য পরিমাণেই বাদশাহের বিষক্রিয়া আরম্ভ হয়ে যায়। এই বিষক্রিয়াতেই তাঁর শরীর অসুস্থ হতে থাকে এবং দিন দিন তিনি দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়েন।  

তাঁর মৃত্যুর পরে কিংবা অবসরের যাবার পরে হুমায়ুন বাদশাহ হিসাবে অভিষিক্ত হবেন,  এটাই ছিল বাবুবের ইচ্ছা।  হুমায়ুন শুধু  তাঁর  বড় সন্তান বলেই নয়, অন্য যে কোনো সন্তানের চেয়ে তিনি হুমায়ুনকে যোগ্য বলে মনে করতেন এবং হুমায়ুনের প্রতি তাঁর বিশেষ অপত্য স্নেহই এর মূল কারণ। বিষের ক্রিয়ায়  জর্জরিত মৃত্যু পথযাত্রী বাবুর এটাকেই আদর্শ  সময় হিসাবে বেছে নিলেন তাঁর বাদশাহীর উত্তরাধিকার হুমায়ুনের হাতে তুলে  দেবার। রোগ শয্যাতেই ডাকিয়ে আনলেন আমির, ওমরাহ, উজিরসহ সাম্রাজ্যের প্রধান ব্যক্তিদের। তাঁদের বললেনঃ 

বহুকাল ধরেই আমার মনের মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা  রয়েছে যে আমি শাহজাদা মির্জা হুমায়ুনকে আমার সিংহাসন, বাদশাহি, সবকিছু সোপর্দ করে চলে যাব বাগ-এ-জর আফসাতে। সেখানেই আমি আমার অবসর দিনগুলি কাটাতে চাই। খোদার দয়ায় ও অনুগ্রহে এবং আপনাদের সহযোগিতায় আমি অগাধ ঐশ্বর্য লাভ করতে পেরেছি, বিশাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছাও পুরণ হয়েছে। কিন্তু রোগ ব্যাধি আমাকে দুর্বল করে দিয়েছে, এটাকেও খোদার ইচ্ছা মনে করে আমি  আমার ওসিয়াত (উইল) ঘোষণা করছি যে, আমার সমস্ত কিছুই (সিংহাসন, মুকুট ইত্যাদি) আমি হুমায়ুনকে দিয়ে যাচ্ছি। আপনারা সকলে যেমন আমার অনুগত ছিলেন ঠিক সেইভাবে মির্জা হুমায়ুনেরও অনুগত থাকবেন এবং তার সমস্ত কাজকর্মে আপনারা সহমত হবেন। খোদার কাছে প্রার্থনা করি এবং আশা করি যে আমার পুত্র মির্জা হুমায়ুন দরবারের সকলের সঙ্গে সদ্ব্যাবহার করবে এবং সে প্রত্যেকের প্রিয় হবে। 

অভিষিক্ত শাহজাদাকে মৃত্যুপথযাত্রী বাবুর বলে গেলেন এই  শেষ কথাগুলোঃ 

আমি তোমাকে ও আমার সমুদয় আত্মীয়বন্ধুবান্ধবগণকে ঈশ্বরের হস্তে ন্যস্ত  করিয়া চলিলাম।  তুমি তোমার ভ্রাতাদের প্রতি দুর্ব্যবহার করিবে না। 

শাহজাদা হুমায়ুন কতখানি  সকলের প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন, সেটা নিশ্চিত  করে বলাটা একটু কষ্টকরই।  কিন্তু ভাইদের প্রতি দুর্ব্যবহার না করার পিতার নির্দেশকে তিনি যে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন, সে  বিষয়ে ইতিহাসের স্বাক্ষ্য মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। 

হুমায়ুন মৃদুস্বভাপন্ন ব্যক্তি ছিলেন।সুশিক্ষিত ও সুপণ্ডিত ছিলেন তিনি। সাহিত্য এবং জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশেষ অনুরাগ ছিল তাঁর।  মোগলদের প্রকৃতিগত নিষ্ঠুরতা তাঁর চরিত্রে ছিল না। বাবুরের মত ব্যাঘ্রতেজ, শারীরিক শক্তিমত্তা, চাতুর্য, ক্রূরতা এবং কূটবুদ্ধি তাঁর মধ্যে অনুপস্থিত ছিল। ইচ্ছা থাকলে বাবুরের গুণাবলী হয়তো তাঁর মধ্যেও থাকতো, বাবুরের মত ভয়ংকর যোদ্ধাও হতে পারতেন, কিন্তু এই ইচ্ছাটারই অভাব ছিল তাঁর।   প্রচন্ড আলসে, খামখেয়ালীময় এবং জীবন সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন তিনি। আফিমে বুঁদ  হয়েই কাটিয়ে দিতেন তাঁর সময়গুলো। 

মৃত্যু শয্যায় শায়িত বাবুর এর কোনো কিছুই অনুধাবন করতে পারেন নি। তরুণ শাহজাদাকে দক্ষ সাঁতারু ভেবে রাজনীতির ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ মাতাল সাগরে ঢেউয়ের বিপরীতে সাঁতার কাটার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন তাঁর সুদক্ষ সাঁতারু সন্তান উত্তাল উর্মিমালাকে পরাস্ত করে পৌঁছে যাবে তীরে। ঘুণাক্ষরেও বাবুর টের পান নি যে, দক্ষ সাঁতারু হওয়াতো দূরের কথা, তাঁর এই প্রাণপ্রিয় সন্তান সাঁতারই জানে  না। সেই সাঁতার না জানার মাশুল কড়ায় গণ্ডায় দিতে হয়েছে হুমায়ুনকে। সিংহাসন ছেড়ে বনে-বাদাড়ে পালিয়ে পালিয়ে কেটেছে বাদশাহ নামদারের  সারাজীবন প্রায়। 

(চলতেও পারে  কিংবা মুখ থুবড়ে পড়তেও পারে)