বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটা বিপ্লবের জন্য কি কি প্রয়োজন?
১। জনসমর্থন
২।বিপ্লবী বাহিনী।
৩।সরকারের তার নিজের বাহিনীর উপর নিয়ন্ত্রণ না থাকা অথবা জনবিচ্ছিন্নতা।
৪।বর্হিবিশ্বের সমর্থন।

জনসমর্থনের দিক থেকে দেখতে গেলে হেফাজতে ইসলামের কোন জনসমর্থন ছিল না। আমাদের দেশের মানুষ ধার্মিক। তারা ধর্ম পালন করার চেয়ে বিশ্বাস ধার্মিক পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করে। প্রতিটা গ্রাম থেকে শহরে মসজিদের হুজুরকে দাওয়াত করে ভাল ভাল খাবার দেয় । ঈদে তাদের জামা কাপড় ও দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এই হুজুরদের পছন্দ করে না। সমাজে মসজিদ ভিত্তিক তাদের সম্মান করা হলেও কোন প্রভাব খাঁটানোর অবস্থা কোথাও নাই। বেশির ভাগ মসজিদের ইমামরাই বেত ভুক্ত কর্মচারী। এবং এই বেতন কাঠামো একজন শ্রমিকের চেয়ে খুব তফাৎ নাই। একজন আমলার মতো বাড়তি টাকা উপার্জনের জন্য তার অনেক খাত নাই। তাই সে হয়তো ওয়াজ মাহফিল করে নয়তো এলাকার ধনী কোন ব্যক্তির তাবেদারি করে। এই রকম একটা পরনির্ভরশীল মানুষের পক্ষে আন্দোলন চালিয়ে নেয়া কতটা বাস্তব সম্মত?

একটু যদি তাকাই দেখতে পাই,কোন শ্রেণির মানুষ তার সন্তানদের এই হেফাজতী মাদ্রাসায় পাঠায়? আমাদের দেশটা দরিদ্র হওয়ার কারনে, এবং সরকারের অবহেলার কারনে এই দেশে দরিদ্র মানুষ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।নিজের সন্তানকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য সব অভিভাবকই তো চায়। এই দেশে লেখা পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য খরচ কিভাবে যোগাড় করবে?

আর অন্যদিকে কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের জন্য সব কিছুই ফ্রি। থাকা খাওয়া এমন কি লেখা পড়ার সকল সরঞ্জাম সব কিছুই মাদ্রাসা বহন করে থাকে। কি ভাবে বহন করে সেটা অন্য প্রসঙ্গ। আর অশিক্ষিত বাবা তার সন্তানকে নিজের কাঁধ থেকে নামিয়ে হেফাজতী মাদ্রাসায় পাঠাতে পারছে। সাথে তার সন্তান যদি একটা মোল্লা হয়ে বের হয় তাহলে পরের বাড়ি খাওয়ার একটা উপায় তো হবে! এটাও কম কি?

তো সমাজে এই নিম্ন শ্রেণী থেকে গড়ে উঠা আলেমের দল সমাজের উন্নয়নে কোন প্রভাবই রাখতে পারেনা।তাই সমাজেও তার কোন প্রভাব থাকে না? এই দেশের একটা মসজিদের ইমামকে যদি ইউনিয়ন পরিষদের একটা মেম্বার দাঁড় করিয়ে দেয়া হয় সে পাস করতে পারবে না। কারন এই শ্রেনীর উপর মানুষের কোন আস্থা নেই।আর জনগনের ভিক্ষার টাকায় যে চলে সে জনসাধারনের শাসকই কি করে হবে? তার তো শাসক হওয়ার মেরুদণ্ডই নাই।

শিক্ষার বিষয়টা এখানে মুখ্য না কারন গ্রামের অনেক অশিক্ষিত ব্যক্তি দক্ষতার সাথে গ্রাম্য বিচার সালিশ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই হেফাজতী মোল্লারা যে অশিক্ষিত জাতি এটা আমার কাছে বড় কোন বাঁধা বলে মনে হয় না।

সোয়াবের লোভে হেফাজতীদের দান খয়রাত করলেও আমাদের দেশের মানুষ মোল্লাদের উপর বরাবরই নাখুশ। তারা থাকে তাদের নিজস্ব গণ্ডিতে। সমাজের মানুষের সাথে তাদের সম্পর্কও থাকে খুবই কম। সমাজে ভিক্ষুক থাকতেই পারে কিন্তু ভিক্ষুক তো সমাজের কোন অপরিহার্য এলিমেন্ট হতে পারে না। হেফাজতীদের অবস্থান সমাজের সাধারণ মানুষের চোখে এই রকমই। ভিক্ষুকেরা ও তো সমাজে খেয়ে পরেই বাঁচে। কিন্তু তারা সমাজের ভেতরে থেকেও যেমন সামাজিক না তেমনি হেফাজতীরা সমাজের ভেতর থেকে গড়ে উঠলেও তারা সামাজিক নয়।

চে গুয়েভারা শেষ জীবনের বিপ্লবকেও এখন সমালোচকেরা জনবিচ্ছিন্ন বিপ্লব বলে মনে করেন। ১৯৭৫ এর পরে এই দেশে যত অভ্যত্থান হয়েছে সবই ছিল জনবিচ্ছিন্ন। এমন কি জাসদের যে বিপ্লব হয়েছে তাও জনবিচ্ছিন্নতার ছিল।

এই পর্যন্ত হেফাজতের কোন আন্দোলনে আমি সাধারণ মানুষদের কোন সম্পৃক্ততা দেখতে পাই নি।সমাজের মানুষ তাদের আন্দোলন দেখে ,হাসে অথবা বিরক্ত হয় কিন্তু সম্পৃক্ত হয় না। আর জনবিচ্ছিন্ন একদল মানুষ যদি কোন ক্রমে এই দেশের ক্ষমতা দখল করতেও সমর্থ হতো কিন্তু কোন ভাবেই টিকে থাকতে পারত না।

বিপ্লবী বাহিনী।

একটা সরকার যেমনই হোক তার একটা সশস্ত্র বাহিনী অবশ্যই থাকবে। আর বিপ্লবীদের এই বাহিনির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হবে। কেউ যদি মনে করে সরকার তার বাহিনীকে ধর্মবাদী বলে তাদের উপর ব্যবহার করবে না এটা চরম ভুল। একটা সরকার যদি পতনের আন্দোলন সরকার অবশ্যই প্রতিহত করবে। যে কোন বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তারা সময় মতো মাঠে নামনে। লক্ষ মানুষ মারা গেলেও সরকার তার পতনকে সহজে মেনে নেবে না। আর অল্প সময়ের ব্যবধানে বিদ্রোহী দমনে এই অঞ্চলটা অনেক সাহসী হয়ে উঠেছে। শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহী, ভারতে লাল গড়ে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে ঐ দুই দেশের সরকার যে ভাবে দমন নীতি চালিয়েছে এটাও মাথায় রাখতে হবে। মাও বাদী,তামিল বাহিনির মতো সশস্ত্রবাহিনী টিকতে পারেনি। আর হেফাজত আসলে লাঠি বল্লাম দিয়ে একটা আধুনিক সেনাবাহিনী বিশাল বহর থাকা একটা সরকারকে পরাজিত করতে। এটা খুবই হাস্যকর। যে সরকার মাত্র ১৫ মিনিটে একটা আন্দোলনকে ধুলিসাৎ করে দিতে পারে তার বিরুদ্ধে হেফাজতী প্রস্তুতিটা কি রকম ছিল সহজেই বুঝা যায়।

যে কোন দেশে বিপ্লব করতে গেলে সেই দেশের সরকারের অবস্থানটাও খুব জরুরি। দেশের বেশির ভাগ জনগন যদি সরকারের বিরুদ্ধে থাকে তবেই তা সম্ভব হবে। কিন্তু এই দেশের সরকারের বিরুদ্ধে জনগনের এই অবস্থান ছিল? জনগনের কাছে কি সরকার পতন কোন গুরুত্ব পূর্ন ইস্যু হিসেবে কেউ নিতে পেরেছে? পারেনি। হেফাজতীরা যে সব দাবী নিয়ে আন্দোলন করেছে তার সাথে তো সরকার পতনের কোন সম্পর্ক আগে ছিলই না। হঠাৎ তাদের মাথায় কেন এই দুর্বুদ্ধি এল আমার মাথায় আসে না।

আমি সরকারের দুর্বলতা বলতে বুঝি, সরকারের বাহিনীর উপর তার নিয়ন্ত্রণ না থাকা। কিন্তু এই দেশে এই অবস্থা এখনো হয় নি। সরকারের কোন সশস্ত্রবাহিনী এখনো পর্যন্ত সরকারের কোন নির্দেশ অমান্য করেনি। অতএব খুব সহজেই বুঝা যায় সরকার টিকিয়ে রাখতে এই বাহিনী অবশ্যই কাজ করবে। আর কোন বিপ্লব করতে হলে এই বাহিনীকে পরাস্ত করেই আসতে হবে। এই ক্ষেত্রে হেফাজতীদের তুলনা করলে বড় জোর একটা পাগলামী হতে পারে অন্য কিছু নয়।

স্বাধীনতার পর থেকে এই ছোট দেশটা কখনোই খুব সুশৃঙ্খল ছিল এটা বলা যায় না। তাহলে এখন যদি বলি দেশে বিশৃঙ্খলা চলছে তার কোন অর্থ থাকে না। জমাতী ছাগুরা কয়েক দিন তান্ডব চালিয়েছে এবং সরকার তা শক্ত হাতে দমন করেছে। দমন না করতে পারলে সেই পরিবেশটা হয়তো যে কোন বিপ্লবের জন্য সহায়ক হতো। এখন এই পরিস্থিতিতে কোন ভাবেই জোর করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার চিন্তা একমাত্র হেফাজতীদের এবং পাগলের থাকতে পারে। বিএনপি আধা পাগলা বলে হয়তো তারা এটা বিশ্বাসও করেছে।

বাংলাদেশের মতো ছোট,দরিদ্র একটা দেশ কোন ভাবেই বিশ্বের বড় বড় দেশের থ্রেড মোকাবিলা করে গুয়ার্তুমি করে এগিয়ে যেতে পারবে না। এই দেশের সরকার গঠনে ভোটের প্রভাব এবং বিদেশী রাষ্ট্রদূতের প্রভাব প্রায় সমান। দেশের পরিস্থিতি নিয়ে হাসিনা খালেদা যতবার নিজেদের মধ্যে বৈঠক করেছে তার চেয়ে বেশি বৈঠক করেছে বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সাথে। অতএব সহজ কথায় প্রভাবশালী দেশ গুলোর সমর্থন না পেলে এই দেশে সরকার টিকে থাকতে পারবে না।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এমনিতেই জঙ্গিবাদ একটা ভয়ঙ্কর অবস্থা সৃষ্টি করেছে। ইসলামী জঙ্গি ব্যপারে সারা পৃথিবীতে মানুষের খারাপ ধারনা আছে। দেশকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য গোপনে কিছু সমর্থন দিলেও প্রকাশ্যে কোন রাষ্ট্র এখন এই ইসলামী জঙ্গিদের সমর্থন দিতে পারবে না। বিএনপি ,জাতীয় পার্টি প্রকাশ্যে সমর্থন দিতে দেখা গেলেও তারা এখন হেফাজতী কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে এই কথাটা স্বীকার করতে রাজি নয়। বিএনপি,জাতীয় পার্টি ভালই জানে এদের সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক ভাবে কোন সমর্থন আদায় করা যাবে না। তাই সময় মতো তারা পিছু হটে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সমর্থনের অভাবে এশিয়াতে অনেক সুশৃঙ্খল বিপ্লবী বাহিনী পরাস্ত হতে হয়েছে। অনেক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও মাওবাদী,তামিল টাইগার এমন কি নির্বাচন করে নেপালে ক্ষমতায় আসা বামপন্থীরাও টিকে থাকতে পারেনি। আর হেফাজত তো সেই তুলনায় তেলাপোকা।

কিছু কিছু অন্ধ রাজনীতিক কর্মীদের হেফাজতি আন্দোলনে সমর্থন দিতে দেখি। আমি যখন প্রশ্ন করি আপনার ছেলে বা মেয়েকে নিশ্চয় সামনের বছর হেফাজতী মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন। সে রাজী হয়না। হেফাজতী মাদ্রাসায় পরে যদি দেশের প্রখ্যাত আলেম হওয়া যায়, তাদের সমাজে যদি উঁচু অবস্থান থাকে তবে আপনার সন্তানকে কেন দিবে না?