সপ্তম শ্রেণীতে থাকার সময় জীবনে আমার প্রথম প্রেম-পত্র লেখা। সে প্রেম আবার ভেঙ্গে যেতেও বেশি দিন লাগেনি। তার জন্য অবশ্য আমি-ই দায়ী। অন্য আর আট-দশটা কিশোরের মত, প্রেমিকাকে কি বলা যাবে আর কি বলা যাবে না, সেটা বুঝার সামর্থ্য সে-বয়সে তখন আমারও ছিলো না। তবে, কৈশরের সেই প্রেমে প্রেম ছিলো, প্রেমিকা ছিলো, প্রেম-পত্র ছিলো; কিন্তু, দূর্ভাগ্যজনকভাবে অন্য একজন প্রেমিকও ছিলো। আমি ছিলাম নিতান্তই এক পত্র লেখক। প্রেম-পত্র ছাড়া বাকী সব্কিছুই অন্যদের। সেখানে শেষ হলেও কথা ছিলো; কালের পরিক্রমায় দেখা গেলো, তাদের উথাল-পাথাল দূর্লভ প্রেমের সমাপ্তি ঘটার পিছনের মানুষটাও আমি। যদিও, সে-দিনের সেই প্রেম-ভাঙ্গা নষ্ট সময়ে, কষ্ট করেও তার কারণ বুঝতে পারিনি।

আমাদের বাড়ীর আশপাশেই রমিজ ভাইদের বাড়ী। হঠাৎ একদিন তিনি অনুরোধ করলেন, উনাকে কিছু একটা লিখে দিতে হবে। উনি লিখতে-পড়তে পারেন না। অবশ্য, উনার ভাষ্যমতে, উনি সবই পারেন, শুধু অভ্যাসটা নেই। প্রতিবেশীদের চিঠিপত্র লিখে দেয়া বা পড়ে শোনানো আমার জন্য নতুন কিছু নয়। আমি সানন্দে রাজী হয়ে গেলাম। যথাবিহিত সন্মান প্রদর্শন পূর্বক কাগজ-কলম নিয়ে হাজির হবার পর দেখা গেলো, উনি যে জিনিস লিখতে বললেন সেটার নাম উনার ব্যবহার্য শব্দমালা অনুযায়ী লাব ল্যাটার

দিন যায়, সপ্তাহ যায়, আমি লিখে যাই; আর অন্যদিক থেকে যে চিঠি আসে, সেগুলো পড়ে যাই। এক লাইনের মানে বুঝি, তো পরের লাইন বুঝি না; বোঝার চেষ্টাও হয়তো করিনি। রমিজ ভাই কিন্তু ঠিকই বুঝতেন, আর মাঝে মাঝে হাসতে থাকতেন। তবে, দু’জনার চিঠিতেই বেদের মেয়ে জোছনা ছায়াছবি থেকে যে ডায়ালগগুলো থাকে, সেটুকু বুঝতে আমার কখনোই সমস্যা হয়নি। বস্তুত, আমাদের সন্মিলিত প্রেম-প্রক্রিয়ায় বাংলা ছায়াছবির অবদান অনস্বীকার্য।

রমিজ ভাইয়ের চিঠি লিখে আমি পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা শেষ করে ফেলি, তাতে আমার আপত্তিও ছিলো না; কিন্তু, আমি আপত্তি না করলেও, বিদ্ঘুটে বাংলায় লেখা উনার প্রেমিকার চিঠিগুলো ঠিকই বিপত্তি ঘটাতো। সেখান থেকে মোটামুটি যুদ্ধ করে প্রতিটা শব্দ উদ্ধার করতে হতো আমাকে। অমন দুষ্পাঠ্য হাতের লেখা সাত জনমেও দুষ্প্রাপ্য। ভাবলাম এর একটা সমাধানতো করতেই হয়। উচিত-অনুচিত বিচার করার মত সে-বয়স আমার ছিলো না। সে-দিন কি ভেবেছিলাম, সেটা ঠিক মনেও নেই। শুধু মনে আছে, প্রেমিকার কাছে পাঠানো রমিজ ভাইয়ের সর্বশেষ চিঠিতে, সরল মনে নিজ দায়িত্বে যোগ করে দেয়া আমার সর্বশেষ লাইনগুলো। চিঠির শেষে লিখেছিলাম – তুমি কি চিঠি লিখো, তোমার লেখা কিচ্ছু পড়া যায় না। আমার মত অন্য কাউকে দিয়ে চিঠিটা লেখাও, তারপর পাঠাও। এই মহান কর্মটির পর, আমি কিংবা রমিজ ভাই, কাউকেই আর বহু বছর ধরে কোনো প্রেম-পত্র লিখতে হয়নি।

এবার বহু বছর পরের কথায় আসি। বিল গেটস্ আর স্টিভ্ জবসদের কল্যাণে বহুবছর পরে দুনিয়াতে ইমেইল আসলো, এসএমএস আসলো; পত্রবাহক কবুতরদের হটিয়ে দিয়ে মঞ্চে আসলো জাকারবার্গ। নীল খামে পাঠানো ভালোবাসার রঙিন পত্র কিংবা রমিজ ভাইদের লাব-ল্যাটারওয়ালা প্রেম বিলীন হয়ে গিয়ে জগতে আসলো ই-প্রেম, ভার্চুয়াল ভালোবাসা। জিমেইল-ইয়াহু আর ইমেইল-ফেইসবুকে ভর করে জন্ম নেয়া সেই ই-প্রেমের গল্প না-হয় আরেকদিন করা যাবে; এখন বরং প্রেম পরিবর্তনকারী, পাইরেটস্ অভ দ্যা সিলিকন ভ্যালি নামে খ্যাত সেই গেটস-জবসদেরই একজন, বিল এর কোম্পানি মাইক্রোসফট্ নিয়ে কিছু গল্প করা যাক।

অন্যসব নামকরা কোম্পানির মত খুব স্বাভাবিকভাবেই মাইক্রোসফট এর নিয়োগ প্রক্রিয়াও বেশ কঠিন। প্রথমে ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে কিংবা টেলিফোনে তাদের ইন্টারভিউয়াররা আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টার প্রাথমিক একটা ইন্টারভিউ নিয়ে থাকেন। সেটাতে নির্বাচিত হলে সাধারণত মাইক্রোসফট এর প্রধান শাখা ওয়াশিংটন স্টেইটের রেইডমন্ডে দিনব্যাপী ইন্টারভিউ এর জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে আবার চার-পাঁচটা ইন্টারভিউ হয়ে থাকে। সে-রকমই এক প্রাথমিক বাছাইয়ের জন্য ইন্টারভিউ দেয়ার কিছুদিন পর মাইক্রোসফট থেকে আমাকে ই-মেইল করলো। জানতে চাইলো, হেড অফিসে ইন্টারভিউ দেবার জন্য আমি রাজী আছি কি-না, রাজী থাকলে সুবিধাজনক দিন-ক্ষণ জানিয়ে উত্তর দেবার জন্য অনুরোধ করলো।

উত্তর দেয়াতো দূরের কথা, ইমেইল বাদ দিয়ে সাথে সাথে আমি প্রিপারেশান নিতে বসে গেলাম। বই-পুস্তক নয়, বসে গেলাম গুগল ম্যাপ নিয়ে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াবো তার প্রিপারেশান। দেখে শুনে, ঠান্ডা মাথায় দর্শনীয় স্থানের একটা লিস্ট তৈরী করে, কোন কোন দিন ঘুরে বেড়ানোর জন্য ওয়েদার ভালো থাকবে, সে-সব জেনে নিয়ে তারপর ইমেলের উত্তর পাঠালাম। বস্তুত, মাইক্রোসফট এর ইন্টারভিউ মানে আমার জন্য প্রমোদ ভ্রমণ। আসা-যাওয়ার প্লেনের টিকিট আগেই করে দেয় তারা। তার উপর দুই রাত তিন দিন থাকার জন্য হোটেল ভাড়া, সমস্ত খাওয়া-দাওয়া, যাতায়াতের বাকী সব খরচ, সবই তারা বহন করে।

কোম্পানিগুলো থেকে খরচ বহন করার সাধারণ নিয়ম হচ্ছে, আগে প্রার্থীকে নিজে পকেট থেকে খরচ করতে হয়, পরবর্তীতে বিল জমা দিলে কোম্পানি টাকাটা ফেরত দেয়। কিন্তু, মাইক্রোসফটের হেড অফিস রেডমন্ডের হোটেলে ঢুকে, রিসেপশানিস্টের কাছে ক্রেডিট কার্ড এগিয়ে দিতেই বলে, ওটার দরকার নেই স্যার, মাইক্রোসফট আপনার সব বিল পরিশোধ করে রেখেছে। তারপর, অনেক প্র্যাকটিসে নিখুঁত হয়ে যাওয়া হাসিটা হেসে, হোটেল রুমের এক্সেস কার্ড এগিয়ে দিতে দিতে বলে, গুড লাক উইথ ইওর ইন্টারভিউ স্যার। আমি থমকে গিয়ে বলি, আমার যে ইন্টারভিউ এটা কি রেডমন্ড এর সবাই জানে নাকি! রিসেপশানিস্ট হাসতে হাসতে বলে, মাইক্রোসফট্ এর সাথে আমাদের চুক্তি আছে। সারা বছর জুড়ে লোক্জন ইন্টারভিউ দিতে আসে। অতএব, আমরা আগে থেকেই জানি

রিসেপশানিস্টের কাছ থেকে রুম এক্সেস কার্ড নিয়ে রুমে চলে গেলাম। রাতটা ঘুমিয়ে সকাল বেলা হোটেল কাউন্টারে এসে জানালে, তারাই ফোন করে ট্যাক্সি ডেকে দিলো। হোটেল থেকে ট্যাক্সি করে পৌঁছালাম মাইক্রোসফট ক্যাম্পাসে। ক্রেডিট কার্ড বের করতেই ড্রাইভার বলে, দরকার নেই স্যার, মাইক্রোসফটের সাথে আমাদের চুক্তি আছে। আপনি শুধু সাইন করে দিলেই হবে। শুনে মনে হলো আমি বুঝি সিসিলিতে এসে পড়েছি, শহরের লোক্জন সব গড ফাদারদের এজেন্ট। ধন্যবাদ দিয়ে ক্যাব থেকে বের হচ্ছি, এমন সময় ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে সেও বলে উঠে, গুড লাক উইথ ইওর ইন্টারভিউ স্যার। এ-বার গুডলাক সামলাতে একটু সময় নিতে হলো আমাকে, কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে মনে বললাম, গুড লাকের খেতা পুড়ি, রেডমন্ডের কাক-পক্ষীও কেমনে জানে কারা কারা ইন্টারভিউ দিতে আসছে!

কি আর করা, ক্যাব ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিতে হলো। কিন্তু, আসল সমস্যাটার সমাধান যে কোনভাবেই হলো না। মাইক্রোসফট প্রতিদিন খাবারের জন্য পঁচাত্তর ড্লার বরাদ্দ করে। এ খরচের টাকাটা আগে নিজের পকেট থেকে দিতে হয়, পরে বিল জমা দিলে তারা টাকা দিয়ে দিবে। কিন্তু, কোনোভাবেই দিনে পঁচাত্তর ডলার খেয়ে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। তার উপর সকালের খাবার দেয়া হয় হোটেল থেকে। ইন্টারভিউ এর দিন আবার অফিসই দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে। একটা ইন্টারভিউয়ের নামই হচ্ছে লাঞ্চ ইন্টারভিউ। লাঞ্চ করতে করতে ইন্টারভিউ। সে এক বিরাট ইতিহাস। অন্য লেখায় বলবো। আগে আমার পঁচাত্তর ডলারের কাহিনীটা বলে নিই।

একেবারে শেষ দিন সকাল বেলা হোটেলে নাস্তা করে দুপুরের দিকে এয়ারপোর্ট চলে আসি। কিন্তু, সে-পর্যন্ত সে-দিনের জন্য বরাদ্দ পঁচাত্তর ডলারের এক কড়িও খরচ হয়নি। টাকা খরচ করতে না পারাটা বিরাট ব্যর্থতা। তবে আশার কথা হলো, এয়ারপোর্টের ভিতরে খাবারের দোকান গুলোতে দাম বেশি। সারাজীবন এয়ারপোর্টের কর্নারে চুপটি করে বসে থাকা সস্তার ম্যাগডোনাল্ড খুঁজে নিয়েছি, আর সেদিন সমস্ত এয়ারপোর্ট ঘুরে একেবারে সবচেয়ে আকষণীয় দামী দোকানটা বের করে নিই। নামটাও অভিজাত, আফ্রিকান লাউঞ্জ। আমেরিকায় বসে আফ্রিকান আমেজ। মহা সমারোহে ভিতরে প্রবেশ করতেই ওয়েটার মেনু নিয়ে হাজির। মেনু হাতে নিয়ে আমি ভাব দেখাই, একি! এ-কোন ফুট্পাতে আসলাম। দাম এত কম কেন! আমার মুখভঙ্গি দেখে ওয়েটার আমেরিকান মেয়েটা বলে, এনি প্রবলেম স্যার?। আমি নো প্রবলেম বলতেই সে মেনু রেখে চলে গেলো।

অনেক খুঁজে-টুজে দেখি মেনুতে রাখা ভক্ষণযোগ্য সবচেয়ে দামী আইটেমটার দামই মাত্র দশ ডলার। তবে নামটা দেখে পছন্দ হলো, কঙ্গো বার্গার। আফ্রিকান লাউঞ্জে বসে কঙ্গো বার্গার। মন্দ নয়। খুশীর ব্যাপার হচ্ছে একটা চিকেন অ্যাপেটাইজার আছে যেটার দামও প্রায় আট ডলার। অ্যাপেটাইজার, কঙ্গো বার্গার আর সফট্ ড্রিঙ্ক মিলে বিশ ডলারের কাছাকাছি বিল আসবে, এই ভেবে কিঞ্চিৎ শান্তি পাওয়া গেলো। ওয়েটারকে অর্ডার দিতেই সে বলে, এত কিছু খেতে পারবা না। খাবারের পরিমাণ অনেক। আমি বলি, এত কিছু কোথায়! অ্যাপেটাইজার, বার্গার আর সফট্ ড্রিংক। সে বলে, ওটা আমারা অ্যাপেটাইজারের লিস্টে রাখলেও পরিমাণে অনেক, তুমি যে-কোনো একটাই অর্ডার দাও। মনে মনে ভাবি, মাতব্বরি করার আর জায়গা পাও না। মিনমিন করে বলি, না, নিয়ে আসো। সে বলে, শোনো, তোমাকে একটা সাজেশান দিই। আমি কঙ্গো বার্গারটা নিয়ে আসি, তারপর তোমার যদি মনে হয় আরো খাবার লাগবে, তাহলে অর্ডার করো। আমি ভাবি, হায়রে আমার উপদেষ্টা! এতদিন কোথায় ছিলেন, মহান অসহ্য বনলতা সেন!

অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না। যথা সময়ে বনলতা সেন কঙ্গো বার্গার নিয়ে হাজিরে হলে বুঝতে পারলাম, এই বার্গার দিয়ে লাঞ্চ করলে ডিনার না করলেও চলবে। সাইজ দেখে মুখ শুকিয়ে গেলো আমার, আর তার মুখে বীরের হাসি। ওদিকে এক লাফে আমার লাঞ্চ বিল বিশ ডলার থেকে দশ ডলারের নেমে আসলো। কিন্তু, কি আর করা। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর জোয়ারে ভাসায়।

খাবার দাবার শেষে বিল নিয়ে উপস্থিত হলো ওয়েটার। মাত্র দশটা ডলার বিল দিতে যাবো, এমন সময় দেখি আবার তার আকর্ণবিস্তৃত হাসি। তার হাসি দেখলেই আমি বুঝতে পারি, বিপদ আসন্ন। হাসতে হাসতে বলে, স্যার আজকে আমাদের রেস্টুরেন্টের অ্যানিভার্সারি, সব খাবারে দাম ৫০ পার্সেন্ট কম রাখা হচ্ছে। এবার আমার ভিতর মাতম শুরু হয়ে গেলো। পঁচাত্তর ডলার বাজেটের মাত্র পাঁচ ডলার বিল। উপায় না পেয়ে স্থির করালাম, এবার কিছুটা পুরোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করা যাক। আমেরিকার রেস্টুরেন্টগুলোতে সাধারণত ১৫ পার্সেন্ট টিপস্ দেবার নিয়ম। কিন্তু, স্টুডেন্ট হবার অজুহাতে চেতন-অবচেতনে বেশ কয়েক বার সেটা ফাঁকি দিয়েছিলাম। ঠিক করলাম আজকে টিপস্ দেব, মূল বিলের কয়েকগুণ বেশি। যেই চিন্তা সেই কাজ। কিছুক্ষণ পর ওয়েটার এসে ক্রেডিট কার্ড আর বিল নিয়ে চলে গেলো।

মনে মনে ভাবলাম আজ যদি বাংলাদেশী কোনো ওয়েটার হতো, তাহলে এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে যেত, শ্যাম বাজারে আমার মাছের আড়ৎ আছে। সেটা যদি নাও থাকে, নিদেনপক্ষে হাজারীবাগে ট্যানারি ব্যবসায় শেয়ার আছে। টাকা রাখার জায়গা পাচ্ছি না। কিন্তু, এই বজ্জাত দেশে না আছে শ্যামবাজার, না আছে হাজারীবাগ। কিন্তু, তাতে কি, কিছু না কিছু তো আছে ! আমি সাগ্রহে অপেক্ষা করছি, বনলতা সেন কখন রিসিট নিয়ে ফিরে আসবে; কখন সে এত এত বখশিস দেখে কৃতজ্ঞতার ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়বে। আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে বলবে, ওহ্, থ্যাঙ্ক ইয়ু স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ। অবশেষে আমার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটিয়ে ওয়েটার ফিরে আসে। এসেই বলে, এক্সকিউজ মি স্যার, ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড। নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহর দৌহিত্র জ্ঞান করে রাশভারী কণ্ঠে আমি বললাম, হোয়াট। তারপর চরম বিব্রত ভঙ্গিতে, বোধ করি সেই প্রথম থেকেই আমার সন্দেহজনক আচরণ দেখে, ধন্যবাদের আশপাশ দিয়েও না গিয়ে, আমাকে সে বলেই ফেললো- আর ইউ ড্রাঙ্ক?

লাভ-লেটার আর ইমেইলের কথা হলো, বিল গেটসদের কথা হলো, মাইক্রোসফট্ এর কথা হলো, সেখানকার ইন্টারভিউ এর কথাও হলো। কিন্তু, যে সাবজেক্ট এর কল্যাণে এত্ত সব আয়োজন, সেটার কথা কিছু বলা হলো না। অতএব, এবার কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে একটা কাহিনী বলা যাক। একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে আমার সাথে পরিচয় হয় নিউ জার্সির নামকরা এক ইউনিভার্সিটির চাইনিজ স্টুডেন্ট হু ফু (Hu Fu) এর সাথে। ফু-দের বিশ্ববিদ্যালয়ে আইটি সাপোর্ট দিয়ে থাকতেন মিস এরিকা। নতুন স্টুডেন্ট আসলে সবার ইমেল অ্যাড্রেস এর ব্যবস্থা করা, ল্যাবগুলোর ইন্টারনেট দেখাশোনা করা, ডিপার্টমেন্টাল ওয়েবসাইট মেইনটেইন করা, এর সব্কিছুই এরিকা এবং তার সহকারীদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমস্যা হচ্ছে এরিকার ভাব খানিকটা বেশি। সেটার জন্য অবশ্য কখনোই তাকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। নিন্দুকেরা বলেন, এরিকা হচ্ছে আমেরিকান বিউটি, বিউটিদের কখনো সমস্যা থাকতে নেই।

সিমেস্টার শুরু হলে, ডিপার্টমেন্টে নতুন ভর্তি হওয়া সব পিএইচডি স্টুডেন্টরা একদিন এসে জড়ো হয় এরিকার অফিসে। কারণটা গুরুত্ব্পূর্ণ, সবার জন্য ইউনিভার্সিটির ডোমেইনে (.edu) ইমেইল একাউন্ট তৈরি করা হবে। সাধারণত ফার্স্ট নেইম আর লাস্ট নেইম এক করে ইমেইল একাউন্ট তৈরি করা হয়ে থাকে। একাধিক স্টুডেন্ট এর ইমেইল এক হয়ে গেলে, সেক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়ে থাকে। এরিকা সবার ফার্স্ট নেইম আর লাস্ট নেইম জোড়া লাগিয়ে শেষে CS-ও জুড়ে দিচ্ছে। যাতে করে ইমেইল অ্যাড্রেস দেখে সহজেই বুঝা যায় তারা CS অর্থাৎ Computer Science এর স্টুডেন্ট।

সামনে থাকা কম্পিউটারে লিস্ট খুলে, একটা একটা করে নাম নিয়ে, একে একে সব স্টুডেন্ট এর জন্য ইমেইল আইডি তৈরি করছে এরিকা। আর সাথে সাথে বলছে- পারফেক্ট। প্রথম জনের নাম Martin Ray, তার ইমেইল আইডি হবে [email protected]। এরিকা শেষের অংশটুকু বাদ দিয়ে, শুধু সামনের অংশটুকু একসাথে নিয়ে বলে যাচ্ছে। তার আমেরিকান ঢং-এ বলা ইংরেজী উচ্চারণ দিয়ে martinraycs কে সে পড়ছে মার্টিন রেইক্স, তার ঠিক পরপরই বলছে, পারফেক্ট; সব মিলিয়ে মার্টিন রেইক্স, পারফেক্ট। নাম বলা শেষ হলে মনিটর থেকে চোখ তুলে, ভীড় করে দাঁড়িয়ে থাকা পিএইচডি স্টুডেন্টদের দিকে তাকায় এরিকা। ভীড়ের মাঝ খান থেকে হাত তুলে মার্টিন। হাত তুলে জানান দেয় সে উপস্থিত আছে এবং নিজের ইমেইল আইডিটা বুঝে পেয়েছে।

Martin Ray এর পর আসে Zak Rubi, হয়ে যায় জ্যাক রুবিক্স, পারফেক্ট; অর্জুন রাও হয়ে যায় অর্জুন রাওক্স, পারফেক্ট। ভীড়ের মাঝ থেকে একে একে হাত তুলে জ্যাক, অর্জুনরা জানিয়ে দেয়, তাদের উপস্থিতির কথা। কিন্তু, সেই কুক্ষণে, এরিকার কম্পিউটারের স্টুডেন্ট লিস্ট-এ উঠে আসে Hu Fu এর নাম। করিৎকর্মা এরিকা ফার্স্ট নেইমের সাথে লাস্ট নেইম লাগিয়ে, তাতে CS যোগ করে, তৎক্ষণাত বলে উঠলো হু ফাক্স, পারফেক্ট। বলার সাথে সাথে সে আওয়াজ পৌঁছে গেলো এরিকার নিজের কানেও; কিন্তু, ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। তবে, বিব্রত হবার বিন্দুমাত্র চিহ্নটুকুও দক্ষতার সাথে নিজের চেহারা থেকে লুকিয়ে ফেলে এরিকা। কিন্তু, মনিটর থেকে মুখ তুলে তাকাতেই দেখতে পায়- রুমভর্তি পিএইচডি স্টুডেন্টদের সবাই হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে।

এই সিরিজের বাকী পর্বগুলো এবং অন্যান্য সব লেখার লিঙ্ক একসাথে পাবেন এখানে।

মইনুল রাজু
[email protected]