একটি দীর্ণ সত্তার সাথে রঙিন প্রজাপতির মিহিন কথোপকথন- কখনো মৃদু, কখনো উচ্চস্বরে আবার কখনো বা কোনো এক প্রান্ত ছোঁয়া নদীর মতো একেবারে শান্ত কিন্তু চলিষ্ণু হয়ে চলছে সে। কিন্তু কোথায়? কোনখানে? প্রশ্নগুলো একবারের নয়, বহুবারের- বহুধারার। এই অনন্যবোধের বাতি জ্বালিয়েই জীবন পাড়ি দেয় অনন্তলোকে, কোনো ঠিকানার পানে নয়, নয় কোনো ঐশ্বরিক শক্তি বা অন্য কোনো অর্থহীনতার কাছে- জীবন পাড়ি দেয় শূন্যে, যেখানে জীবনের বোধে সামিয়ানা টানায় ধূসর ক্যানভাস।
তবে এ বোধ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছিলো না- সে কথা বেশ নির্মোহভাবেই বলা চলে। বাঙালির শাশ্বত এক চৈতন্যের নাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তিনি বোধ ও চিন্তার ঊর্ণাজালে বেঁধেছেন মানবাত্মার প্রতিটি দর্শনকে; নাহ- ভুল বললাম, বাঁধতে চেয়েছিলেন- কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেননি। তিনি স্বপ্নময়তার স্রোতে ভেসে জীবন সৌকর্যের গান গেয়েছেন। জীবনের বহুমাত্রিক ধারাকে কখনো প্রলয়মুখর কখনো শান্ত নদীর স্রোতের মতো তুলে ধরেছেন, কখনো অতলস্পর্শী হৃদয়মুখরতার গাম্ভীর্য থেকে তিনি খুঁজে এনেছেন মহিমান্বিত নান্দনিকতা এবঙ শেষ পর্যন্ত সেই নান্দনিকতার কোলেই রবীন্দ্রনাথ বস্তুত একা হয়েছেন, প্রাণময়ী উষ্ণতায় মেলে ধরেছেন জীবনের সাতরঙ। তাই রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-দর্শন’ এর মতো তাঁর ‘মৃত্যু-দর্শন’ও গুরুত্বপূর্ণ; কেননা তিনি মৃত্যুকে দেখেছেন জীবনের ওতোপ্রতো অঙশ হিশেবেই। বোধ করি, জীবনের প্রতিটি মাধুর্যমণ্ডিত মুহূর্তেই তিনি পরম মমতায় মৃত্যুর অনিবার্য শূন্যতাকে উপলব্ধি করেছিলেন; তাই ছিন্নপত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-
ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই।
তবে ‘মৃত্যু-দর্শন’ শব্দটি এ লেখায় ব্যবহৃত হলেও এর তাত্ত্বিক কাঠামোগত আলোচনা হয়তো পাওয়া যাবে না। হয়তো আরও প্রগাঢ়ভাবে রবীন্দ্রনাথ পাঠ করলে সে দিকটিও উন্মোচন করা সম্ভব, কিন্তু ‘ফিলোসফি’ যতোটুকু রঙিন হবার কথা ছিলো, আপাতত সে রকম হচ্ছে না- যদিও ‘দর্শন’ শব্দটিতে ‘দেখা’ অর্থের অর্থদ্যোতনায় ‘ফিলোসফি’ও আসবে- আসতে বাধ্য।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) মৃত্যু-দর্শন গড়ে ওঠে তাঁর প্রায়-তেইশ বছর বয়সে লোকান্তরিতা নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু (১৮৮৪) থেকে, কবির তেরো বছর দশমাস বয়সে প্রয়াতা মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু (১৮৭৫) থেকে নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতির ‘মৃত্যুশোক’ অধ্যায়ে লিখেছেন-
আমার চব্বিশ বছর (আসলে বাইশ বছর এগারো মাস তেরো দিন) বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়। তাহা তাহার পরবর্তী প্রত্যেক বিচ্ছেদশোকের সঙ্গে মিলিয়া অশ্রুর মালা দীর্ঘ করিয়া গাঁথিয়া চলিয়াছে। শিশু বয়সের লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। (১)
তাছাড়া তেতালায় মাতার মৃত্যুর সময় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নিচের তলায় নিদ্রিত, বড়ো বউঠাকুরাণী সর্বসুন্দরী দেবীর মৃত্যুর (১৮৭৮) সময় কবি আমেদাবাদে অবস্থান করছিলেন, শিলাইদহে জ্যেষ্ঠ ভগ্নীপতি সারদাপ্রসাদের মৃত্যুর (১৮৮৩) সময় রবীন্দ্রনাথ কোলকাতায় নিজের বিবাহবাসরে। কিন্তু বিয়ের মাত্র চার মাস দশ দিন পর প্রায় দুদিনের করুণ সঙগ্রামে পরাজিতা (কবি যাঁকে ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, সেই) নতুন বৌঠানের মৃত্যু ঘটলো, বলতে গেলে, তাঁর চোখের সামনে। রবিজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন,
কাদম্বরী দেবীর চিকিৎসা বিষয়ে যে ব্যাপক ও বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, সুনয়নী দেবীর বর্ণনা-মতো আফিম-সেবনের ফলে মৃত অবস্থায় তাঁর দেহ আবিস্কৃত হয়নি, তাঁর জীবনরক্ষার জন্য বহু ডাক্তার প্রাণপণ চেষ্টা করার সুযোগ পেয়েছেন.. ..৮ ও ৯ বৈশাখ (রবিবার ২০ এপ্রিল) রাত্রে বা ১০ বৈশাখ (সোমবার ২১ এপ্রিল) প্রভাতে তাঁর জীবনাবসান ঘটে। (২)
অর্থাৎ রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বর্ণিত ও বহুল প্রচলিত ৮ বৈশাখ, ১২৯১ বা ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ তারিখটি তথ্য সমর্থিত নয়। মৃত্যু তারিখটি নিয়ে বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ এই যে, আত্মহত্যাকারিণীর মৃত্যু-সঙবাদটি কোনো সঙবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। সেটা না হবার কারণ হয়তো-
নূতন বৌঠাকুরাণীর মৃত্যু হওয়ায় খবরের কাগজে উক্ত সম্বাদ নিবারণ করার জন্যে ব্যয় বিঃ ১ বৌচর.. ..৫২ (৩)
যাহোক, কাদম্বরী দেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ে সোমেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ এবঙ অরুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথও শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের সবিস্তারে প্রত্যক্ষ করা এবঙ তাঁর সর্বসত্তাকে নাড়া দেয়া এই মৃত্যুটি থেকে পাওয়া প্রথম শোক অপরিশ্রুত রূপ পরিগ্রহ করে ‘পুষ্পাঞ্জলি’ শীর্ষক সমসাময়িক রচনায়, যা রবীন্দ্র-রচনাবলীর সতেরো নম্বর খণ্ডের ৪৮৬-৯৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কাদম্বরী দেবীর স্মৃতি-সুরভিত এই সব অনুচ্ছেদ, কবিতা বা গান লেখা হয়েছিলো শোকের গমকে গমকে বিভিন্ন সময়ে, তাঁর মৃত্যুর তিনমাসের মধ্যে- যদিও ছাপা হয়েছিলো এক বছর পর ‘ভারতী’র বৈশাখ ১২৯২ সঙখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদর্শন বা তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধ হবার অবকাশ তখনও হয়নি বলে লেখাগুলোতে যথেষ্ঠ সাহিত্যগুণ বর্তায়নি। এ-কারণেই লেখক ‘পুষ্পাঞ্জলি’কে তাঁর কোনো গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
মৃত্যুশোকের এই ফুটন্ত ‘ইমোশন রেকালেক্টেড ইন ট্র্যাঙকুইলিটি’ হয়ে প্রশান্ত রূপ লাভ করার পরেই কেবল পরিণত রচনা উপহার দিতে পারে। যেমন, ‘পুষ্পাঞ্জলি’র কিছু রচনা পঁয়ত্রিশ বছর পর ‘লিপিকা’র ‘সন্ধ্যা ও প্রভাত’, ‘সতেরো বছর’, ‘প্রথম শোক’-এ পরিণতি লাভ করে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকবিতার পূর্বসূরি বলে উদযাপিত হয়েছে। শেষোক্ত গদ্যিকাটির শেষ সঙলাপটি ছিলো-
যা ছিল শোক, আজ তাই হয়েছে শান্তি (৪)
এখানেই কবির বিমূর্ত সেই প্রথম শোকের, যে-শোকটি এখানে মূর্তিমতী শান্তি। শোকের এমনি শান্তিতে রূপান্তরণ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের একটা অঙ্গ। শান্তিরূপিণী সেই প্রথম মৃত্যুশোক কবিকে দিয়ে কাব্য রচিয়ে গিয়েছে জীবনের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। উদাহরণ, ‘আকাশপ্রদীপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘শ্যামা’ (১৯৩৮), ‘বধূ’ (১৯৩৮) এবঙ ‘কাঁচা আম’ (১৯৩৯) প্রভৃতি কবিতা যা আজকের পাঠকের মনকেও স্পর্শ করে। প্রসঙ্গত, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে সম্বোধন করা এই কবিতার বইটির উৎসর্গপত্রের দুটি বাক্য স্মরণযোগ্য-
আমার রচনা তোমাদের কালকে স্পর্শ করবে আশা করে এই বই তোমার হাতের কাছে এগিয়ে দিলুম। তুমি আধুনিক সাহিত্যের সাধনক্ষেত্র থেকে একে গ্রহণ করো। (৫)
এই পর্যায়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের গঠন প্রক্রিয়াটি অনুধাবন করার চেষ্টা করবো। ‘পুষ্পাঞ্জলি’তে মৃত্যুশোকের উচ্ছ্বাসটুকু বৈশাখ থেকে ভাদ্র মাসের মধ্যেই উপচে পড়ে-যাওয়ার পর, থেকে-যাওয়া অবশেষটুকু গাঢ়ীভূত হতে থাকে এবঙ মাস দুয়েক পরেই রবীন্দ্রনাথের জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত প্রাথমিক ভাবনা একটা অবধারণীয় রূপ পরিগ্রহ করে ‘ঘাটের কথা’ (‘ভারতী’, কার্তিক, ১২৯১) এবঙ ‘রাজপথের কথা’ (নবজীবন, অগ্রহায়ণ, ১২৯১) নামের দুটো গদ্য-কথিকায় (পরে ‘গল্পগুচ্ছ’ভুক্ত)। সুকুমার সেন লিখেছেন-
গল্প দুটিতেই বিরহিনী নারীর মৌন অন্তর্বেদনা মুখরিত। সদ্য-প্রিয়জন-বিরহী কবি এই দুই কাহিনীর মধ্যে নিজেরই অন্তর্গূঢ় বেদনার প্রতিধ্বনি তুলিয়াছেন। গল্প দুইটি রবীন্দ্রনাথের জীবনভাবনার দুই প্রধান সিম্বল বহন করিতেছে। ঘাট অচল, পথ সচল কিন্তু দুই-ই বহমান জীবনস্রোতের সাক্ষী। (৬)
এই ‘অচল ঘাট আর সচল পথ’- ভাববন্ধই পরবর্তী ভাববন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে মাস-দশেক পরে রচিত ‘রুদ্ধ গৃহ’ শীর্ষ ‘বিচিত্র প্রবন্ধ’টিতে (‘বালক’, আশ্বিন-কার্তিক, ১২৯২) (৭)। এই ভাববন্ধটি হলো- মরণ অচল আর জীবন সচল। তবে সিদ্ধান্তের অনুসিদ্ধান্তটিই আসল। সেটি ছিলো- মৃত্যু, গতিময় জীবনের যতি হলেও, বস্তুত জীবনকাব্যের অর্থবোধক দাঁড়ি। প্রবন্ধটির পটভূমি স্মর্তব্য। জাহাজি ব্যবসা শুরু করার পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বেশির ভাগ সময় কাটাতে হতো বরিশালে। কোলকাতায় অবস্থানকালেও তাঁর প্রধান আস্তানা ছিলো মেজ বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর লোয়ার সার্কুলার রোডের বাড়িটি। তাই মহর্ষিভবনের বাহির-তেতালায় তাঁর আবাসগৃহটি স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর দীর্ঘদিন অব্যবহারে পড়েছিলো রুদ্ধরূপে। এই স্মৃতি বিজড়িত রুদ্ধ কক্ষটিকে মনে রেখেই রবীন্দ্রনাথ ‘রুদ্ধ গৃহ’ প্রবন্ধটি লেখেন, যা তাঁর জীবনমরণভাবনার স্থায়ী দিক-নির্দেশক। এ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন-
এ জগতে অবিশ্রাম জীবনের প্রবাহ মৃত্যুকে হু হু করিয়া ভাসাইয়া লইয়া যায়, মৃত্যু কোথাও টিকিয়া থাকিতে পারে না.. ..পৃথিবী মৃত্যুকেও কোলে করিয়া লয়, জীবনকেও কোলে করিয়া রাখে, পৃথিবীর কোলে উভয়েই ভাইবোনের মতো খেলা করে।.. ..পৃথিবীতে যাহা আসে তাহাই যায়। এই প্রবাহেই জগতের স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। কণামাত্রের যাতায়াত বন্ধ হইলে জগতের সামঞ্জস্য ভঙ্গ হয়। জীবন যেমন আসে জীবন তেমনি যায়। মৃত্যুও যেমন আসে মৃত্যুও তেমনি যায়। তাহাকে ধরিয়া রাখিবার চেষ্টা কর কেন? হৃদয়টাকে পাষাণ করিয়া সেই পাষাণের মধ্যে তাহাকে সমাহিত করিয়া রাখ কেন? তাহা কেবল অস্বাস্থ্যের কারণ হইয়া উঠে। ছাড়িয়া দাও, তাহাকে যাইতে দাও- জীবনমৃত্যুর প্রবাহ রোধ করিয়ো না। (৮)
পত্রিকায় প্রবন্ধটি পড়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের (১৮৪৯-১৯২৫) বন্ধু এবঙ রবীন্দ্রনাথের গুণগ্রাহী অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী (১৮৫০-৯৮) লেখকের বক্তব্যের বিরুদ্ধ মতবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। সোলাপুর থেকে লিখিত দীর্ঘ প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রুদ্ধ গৃহ’ প্রবন্ধের মূল ভাবটি ব্যাখ্যা করেন। দুটি পত্রই ‘উত্তর প্রত্যুত্তর’ শিরোনামে পৌষ সঙখ্যা ‘বালক’-এ মুদ্রিত হয়। পত্র-দুটি থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি জরুরি। কারণ দুই অসমবয়সী বন্ধুর এই বাদানুবাদের সুবাদে জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের তত্ত্বজ্ঞানের মূল ভাবটি পূর্ণ সম্প্রসারিত হয়েছে।
অক্ষয়চন্দ্র লিখেছিলেন-
‘রুদ্ধ গৃহ’ এর ভাব ধরিতে পারিলাম না। একজনের মধ্যে রুদ্ধ হইয়া থাকা, একজনকে লইয়াই চিরদিন শোক করা আপনি গর্হিত বলিয়াছেন। কিন্তু কি করা যায় বলুন!.. ..একদিকে চাহিয়া থাকা, একের চারি দিকে ঘোরাই প্রকৃতির নিয়ম, তাহাই প্রকৃতির বন্ধনের কারণ। আজ যদি পৃথিবী বলিয়া বসে- আমি সূর্যের চারিদিকে ঘুরিব না, কেননা সূর্যকে মেঘে ঢাকিয়াছে, সূর্য আমাকে আর আলো দেয় না, আমি অন্য আলোকের চেষ্টা দেখি, তাহা হইলে প্রকৃতির বন্ধন ছিন্ন হয়, পৃথিবীর মৃত্যু হয়। (৯)
প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
জগতের মধ্যে আমাদের এমন ‘এক’ নাই যা আমাদের চিরদিনের অবলম্বনীয়। প্রকৃতি ক্রমাগতই আমাদিগকে ‘এক’ হইতে একান্তরে লইয়া যাইতেছে- এক কাড়িয়া আর এক- দিতেছে। আমাদের শৈশবের ‘এক’ যৌবনের ‘এক’ নহে। ইহজন্মের ‘এক’ পরজন্মের ‘এক’ নহে। এইরূপ শতসহস্র ‘এক’ এর মধ্য দিয়া সেই এক মহৎ ‘এক’ এর দিকে লইয়া যাইতেছে। সেই দিকেই আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হবে, পথের মধ্যে বদ্ধ হইয়া থাকিতে আসি নাই। .. ..কিছুই থাকিতে চায় না, অথচ আমরা রাখিতে চাই, ইহাই আমাদের যত শোক দুঃখের কারণ। সকলকে যাইতে দাও এবং তুমিও চলো- জগতের সহিত নিষ্ফল সংগ্রাম করিও না।.. ..যখন আমরা নিতান্ত একজনের মধ্যেই আচ্ছন্ন হইয়া থাকি তখন আমরা জানিতেই পারি না আমাদের কতখানি ভালবাসিবার ক্ষমতা। একটি ক্ষুদ্র বস্তুও যখন চোখের নিতান্ত কাছে ধরি তখন মনে হয় সেই ক্ষুদ্র বস্তুটি ছাড়া আমাদের আর কিছুই দেখিবার ক্ষমতা নাই। সেই ব্যবধান অপসারিত করিয়া দাও, বৃহৎ জগত তাহার সৌন্দর্যরাশি লইয়া তোমার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইবে।
এখানে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের একটি অনুষঙ্গ ধরা পড়ে, যার নাম- বিস্মৃতি। তাই ‘প্রত্যুত্তরে’ তিনি শোক দুঃখের অনুষঙ্গ থেকে চলে গেলেন বিস্মৃতির অনুষঙ্গে এবঙ লিখলেন-
মৃত্যুকে আমরা যেমন ভয় করি বিস্মৃতিকেও আমরা তেমনি ভয় করি। কিন্তু অনেক সময় সে ভয় অকারণ। বিস্মৃতি মাঝে মাঝে আসিয়া স্মৃতির শৃঙ্খলা কাটিয়া দিয়া যায়। আমাদিগকে কিছুক্ষণের মতো স্বাধীন করিয়া দেয়। যখন কোনো কার্য বা ঘটনা হইতে তাহার সমস্ত ফললাভ করিয়া চুকাইয়া দিয়াছি বা তাহারা নিষ্ফলভাবে আমাদের কাছে স্তূপ বাঁধিয়া আছে, তখন বিস্মৃতি আসিয়া সেই সমস্ত উচ্ছিষ্ট-অবশেষ ও আবর্জনা ঝাঁটাইয়া ফেলিয়া দেয়। (১০)
গভীর গহিন থেকে উঠে এসে নিমজ্জমান স্মৃতির ঘাই মারার স্বাক্ষর রবীন্দ্রনাথের নানা রচনায় বিধৃত হয়েছে। তিনি যেনো বারবার উপলব্ধি করেছিলেন- ‘স্মৃতি’ শোকের বিষন্নতাকে ধরে রাখতে চায়, অন্যদিকে ‘বিস্মৃতি’ যা তাকে ছেড়ে দিয়ে প্রসন্নতা আনতে চায়। অন্যদিকে রবীন্দ্র নাট্যসাহিত্যের দিকে তাকালে দেখা যাবে- মৃত্যু-দর্শন পাতন-প্রক্রিয়াধীন এবঙ ইতোমধ্যেই শান্তির তীর্থযাত্রী। এই উপলব্ধিটুকুই পুর্ণব্যক্ত হয়েছে শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তীর জ্যেষ্ঠভ্রাতার আত্মহত্যার পর তাঁকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরের সান্ত্বনাপত্রে। তিনি লিখেছেন-
এক সময় যখন আমার বয়স তোমারই মত ছিল তখন আমি যে নিদারুণ শোক পেয়েছিলাম, সে ঠিক তোমারই মত। আমার যে পরমাত্মীয় আত্মহত্যা করে মরেন.. ..তাঁর আকস্মিক মৃত্যুতে.. ..আমার জগৎ শূন্য হল.. ..সেই শূন্যতার কুহক কোনোদিন ঘুচবে না, এমন কথা আমি মনে করতে পারিনি। কিন্তু তারপর সে প্রচণ্ড বেদনা থেকেই আমার জীবন মুক্তির ক্ষেত্রে প্রথম প্রবেশ লাভ করলে। আমি ক্রমে বুঝতে পারলুম, জীবনকে মৃত্যুর জানালার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায় প্রথমে তা বড়ো দুঃসহ। কিন্তু তার পরে তার ঔদার্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হালকা হয়ে দেখা দেয়। (১১)
মৃত্যুর এই ঔদার্য রবীন্দ্রনাথের ‘মনকে আনন্দ দিতে’ শুরু করেছিলো বৌঠানের প্রয়াণের মাসখানেকের মধ্যেই, যে- আনন্দের দ্বিধাগ্রস্ত প্রথম প্রকাশ ‘সরোজিনী প্রয়াণ’- নামক ভ্রমণবৃত্তান্ত রচনায়। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন-
যে- ভাবাবেগ অশ্রান্ত ও অদম্য দীর্ঘশ্বাসরূপে আপনাকে অপচয় করিতেছিলো, তাহাই এক গভীর জীবনসত্যের আধারে বিধৃত হইয়া আর্টের অবিনশ্বরতা লাভ করিলো। মৃত্যুর প্রেতায়িত নিশ্চলতার সহিত জীবনের সবল আনন্দপ্রবাহের যোগ হইয়া জীবন ও মৃত্যু পরস্পরের স্বাভাবিক সুস্থ সম্পর্কে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হইল।.. .. মর্মান্তিক দুঃখের আঘাতে লেখকের দার্শনিক ও শিল্পিমনের অর্ধরুদ্ধ কপাট পূর্ণভাবে উন্মোচিত হইল। (১২) [আলোচ্য উদ্ধৃতিতে লেখক নিজেই ‘শিল্পীমন’কে ‘শিল্পিমন’ লিখেছেন]
মৃত্যুর অভিঘাত নির্ভর করে সম্পর্কের গুণগত ও মানগত ধরণের উপরে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছিলো। এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হাতের কাছেই। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর একমাস তেইশ দিন পরেই একই বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ (যিনি স্বকালের ইঙরেজী পড়ানোর তরঙ্গভঙ্গ করে ঠাকুরবাড়ির বালকদের বাঙলা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন) মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে। অথচ তাঁর এই অকালমৃত্যুটি সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি রবীন্দ্রনাথ। হতে পারে, মৃত্যু যে জীবনকে মুক্ত ও সত্যরূপে দেখার একটি জানালামাত্র, সেটি তিনি এরই মধ্যে উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। তাঁর সেই উপলব্ধিকে স্বচ্ছ থেকে স্বচ্ছতর করে তুলেছিলো মহর্ষি পরিবারের আরো তিনটি মৃত্যু- ভ্রাতুষ্পুত্রী (হেমেন্দ্রনাথের কন্যা) সুকণ্ঠী অভিজ্ঞা দেবীর মৃত্যু (১৮৯৬), ভ্রাতুষ্পুত্র (বীরেন্দ্রনাথের পুত্র) সুসাহিত্যিক বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু (১৮৯৯) এবঙ রবীন্দ্রনাথের ‘লালবাড়ি’র স্থপতি, ভ্রাতুষ্পুত্র (দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র) নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যু (১৯০১)। সম্ভবত এই জন্যই নতুন বৌঠানের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে-সাময়িক ‘একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ’ দেখা দিয়েছিলো, স্ত্রীর মৃত্যুতে (১৯০২) তাঁর মধ্যে সে-ধরনের কিছু দেখা যায়নি- এমনকি মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর মাত্র দশ মাস পর নববিবাহিতা দ্বিতীয়া কন্যা বারো বছরেরও কমবয়সী রেণুকার মৃত্যুতেও (১৯০৩) না।
বরঞ্চ স্ত্রীর মৃত্যুর একমাস পর রবীন্দ্রনাথ পুত্র-কন্যাদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে মহাসমারোহে ব্রাহ্মোৎসব পালন করেন ৭ পৌষ। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, শ্যামসুন্দর মিশ্র, অক্ষয়কুমার মজুমদার ও কাঙালীচরণ সেন প্রমুখ খ্যাতনামা বহিরাগত গায়কগণ উৎসবের শোভাবর্ধন করেন। (১৩)
তবে অন্তরে একেবারেই নির্বিকার ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ। বৌঠানের মৃত্যুর পর তাঁকে হারানোর বেদনার সঙ্গে যেমন ‘মুক্তির দিক দিয়া দেখিয়া একটা উদার শান্তি’ বোধ করেছিলেন, স্ত্রীর মৃত্যুর পরে কেবল সেই উপলব্ধিতেই সুস্থির থাকতে পারেননি তিনি। উপলব্ধিটি পরবর্তীস্তরে উন্নীত হয়েছিলো। এই উত্তরণের কথা রবীন্দ্রনাথ মৃণালিনীর মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরে শান্তিনিকেতন থেকে মোহিতচন্দ্র সেনকে লিখেছেন-
ঈশ্বর আমার শোককে নিষ্ফল করিবেন না। তিনি আমার পরম ক্ষতিকেও সার্থক করিবেন তাহা আমার হৃদয়ের মধ্যে অনুভব করিয়াছি। তিনি আমাকে আমার শিক্ষালয়ের এক শ্রেণী হইতে আর এক শ্রেণীতে উত্তীর্ণ করিলেন। (১৪)
সুতরাঙ এইটুকু পরিস্কার যে, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুপরবর্তী-স্তরের উপলব্ধিটি ছিলো এ রকম-
জগৎটা আমাদের জীবনের সঙ্গে ত্বকের মতো অবিচ্ছেদ্য নয়, মরণের মাধ্যমে জগৎ থেকে জীবনের বন্দীত্ব ঘুচে যায় এবং জীবন মুক্তি লাভ করে। (১৫)
অন্যদিকে মৃণালিনী দেবীর মৃত্যু-পরবর্তী-স্তরের উপলব্ধিটুকু ছিলো-
একবার সম্পূর্ণ মরতে হবে- তবেই নূতন করে ভগবানে জন্মানো যাবে.. ..পুনর্জন্মের পূর্বে এখন সেই মৃত্যুবেদনা.. ..এসো মৃত্যু এসো- এসো অমৃতের দূত এসো- (১৬)
অতএব, মুক্তিজনিত উল্লিখিত ‘উদার শান্তি’ লাভের জন্য কবি তাঁর দৈহিক মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারবেন না, জীবনের মধ্যেই তাঁকে ‘একবার সম্পূর্ণ মরতে হবে’। চেতনার এই স্তরে উন্নীত হতেই জাগতিক রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু হলো এবঙ ‘অন্য এক’ রবীন্দ্রনাথের জন্ম হলো- যাঁকে বলা চলে আধ্যাত্মিক রবীন্দ্রনাথ। (১৭)
‘উৎসর্গ’ কাব্যের নয় নম্বর কবিতাটির (কুঁড়ির ভিতরে কাঁদিছে গন্ধ) ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে লিখেছিলেন-
ওটা গন্ধের পুষ্পগর্ভ থেকে বেরিয়ে আসার বেদনাজনিত কান্না: ‘বাহিরে যাহার সার্থকতা, বাহিরে আসিবার পূর্বে সে তীব্র বেদনা অনুভব করে- বস্তুত এই বেদনাই জানায় যে তাহাকে বাহিরে আসিতে হইবে, ইহাই গর্ভবেদনা- এবং মৃত্যুবেদনারও নিঃসন্দেহে এই তাৎপর্য। (১৮)
কবির এই উপলব্ধিটি জেগেছে স্ত্রীর মৃত্যুর পরপরই, শান্তিনিকেতনে বাসকালে। তিনি নিজেই দেখতে পাচ্ছিলেন যেনো, তাঁর স্ত্রী মৃত্যুবরণ করে এই জগজ্জীবনেই একটি জগত-বহির্ভূত জন্ম লাভ করেছেন। সুতরাঙ একটি আধ্যাত্মিক মনেবৃত্তির স্ফূরণ ঘটে, যা তৎকালীন সময়ের বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থে প্রভাব বিস্তার করে। এই আকুতি প্রাধান্য বিস্তার করে ‘খেয়া’র যুগ থেকে, যে-কাব্যের ‘আগমন’ কবিতাটিতে কবি তাঁর শূন্য ঘরে ‘দুঃখরাতের রাজা’কে অভ্যর্থনা করেন (১৯)। অতঃপর এই হৃদয়াবেগ ‘গোরা’ উপন্যাসসহ গীতাঞ্জলি-গীতিমাল্য-গীতিকা প্রমুখ কাব্যত্রয়ীকে আধ্যাত্মিক আলোকে উদ্ভাসিত করে ‘পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়’।
এই ‘পূর্ণতা প্রাপ্তি’র প্রসঙ্গটি এনেছেন আবদুশ শাকুর, রবীন্দ্রনাথের মরণদর্শন নিয়ে আলোচনার সময়ে। এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়- আধ্যাত্মিকতাবাদ কী সত্যিই রবীন্দ্র-সাহিত্যে পূর্ণতার আলো জ্বেলেছিলো? রবীন্দ্রনাথের ধর্মবিশ্বাস বেশ আনন্দদায়ক- কাব্যজীবনের প্রাথমিক স্তরে তিনি স্রষ্টাকে ‘নাথ’ বলে সম্বোধন করেছেন, মধ্যজীবনে তিনি স্রষ্টাকে করে নিয়েছেন ‘জীবন-দেবতা’ কিন্তু শেষ পর্যায়ে এসে তিনি স্রষ্টাকে ‘সখা’ নামে ডেকেছেন। এবঙ সন্দেহ নেই তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন, সঙশয়বাদীতা আচ্ছন্ন করেছিলো তাঁকে। অপ্রযোজনীয় ‘ঈশ্বর ধারণা’কে তিনি লালন করেছিলেন- যে যুক্তিতেই হোক, তিনি শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পেরেছিলেন বলে আমার মনে হয় না। কেননা, মৃত্যুর কিছু আগে- ১৯৪১ সালের জুলাই মাসের ৩০ তারিখে সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি তাঁর শেষ কবিতাটি লেখেন। কবিতার অঙশ-
তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী।
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে সরল জীবনে।
এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছো চিহ্নিত,
তার তরে রাখ নি গোপন রাত্রি।
মৃত্যুর আগে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস টলে গিয়েছিলো, তিনি সঙশয়বাদী হয়ে উঠেছিলেন, যা আরও বহু আগেই তাঁর হওয়া উচিত ছিলো।
জায়া-কন্যার মৃত্যুর তুলনায়, ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুতে অন্তরেও শান্ত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তবে সেটি এজন্য নয় যে- মহর্ষি মৃত্যুবরণ করেছিলেন আটাশি বছরের পরিপক্ক বয়সে। কারণ কিছুটা অনুমিত হয় কবির নিজের ভাষায়-
পরিপক্ক ফল যেমন বৃন্তচ্যুত হয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ দান করে- তেমনি মৃত্যুর দ্বারাই তিনি তাঁর জীবনকে আমাদের দান করে গেছেন। মৃত্যুর ভিতর দিয়া না পেলে এমন সম্পূর্ণ করে পাওয়া যায় না। জীবন নানা সীমার দ্বারা আপনাকে বেষ্টিত করে রক্ষা করে.. ..(২০)
১৯০৭ সালে বালকপুত্র শমীন্দ্রনাথের আকস্মিক মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ যেনো সমাধি লাভ করেন। তাঁর সেই সমাধির অভ্যন্তরে প্রচুর ভাঙচুর চলে এবঙ এর ফলে কবির মৃত্যু-দর্শনের সমস্ত অঙ্গ বিকশিত ও সমন্বিত হয়। এই মৃত্যুটির আঘাত এতো প্রচণ্ড কেনো সেটি বোঝার জন্য পিতার হৃদয়ে কনিষ্ঠ পুত্রের জায়গাটা একটু জরিপ করা প্রয়োজন। ইন্দিরা দেবী লিখেছেন-
লোকে বলে যে রবিকাকার ছোটো ছেলে শমীন্দ্রই বেশি তাঁর মতো দেখতে ছিলো। শমী অল্প বয়সেই বিসর্জনের মতো শক্ত নাটকের কবিতাও অনর্গল মুখস্থ বলতে পারতো। দুলে দুলে রবিকাকার উপাসনা করাও নকল করতো। হেমলতা বৌঠানের কাছে শুনেছি, বাপের টেবিলে বসে নাকি তাঁর মতো লেখক হবার অভিনয় করতো। (২১)
অনুমিত হয় যে- ‘ডাকঘর’ (১৯১১) নাটকের অমল শমীন্দ্রনাথেরই আদলে গড়া। ছয় বছর বয়সে মাতৃহারা এই শিশুটিকে মনে রেখেই কবি ‘শিশু’ (১৯০৩) গ্রন্থের কবিতাগুলো লেখেন।
মৃত্যু-দর্শনের প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্ধ রবীন্দ্রনাথের নিজের মনেও অবশিষ্ট ছিলো, যা তাঁর বিদ্যালয়টির কল্যাণরূপিণী পত্নীকে অসময়ে হারিয়ে বেড়ে উঠেছিলো সঙগত কারণেই। প্রিয়জনদের নানারকম দুঃখ-সওয়া এবঙ দুঃখ-দেওয়া অকালমৃত্যুগুলি প্রত্যেকটিই একটিমাত্র প্রশ্ন করে বসে আছে রবীন্দ্রনাথের মনে- মানুষের জীবনে দুঃখের ভূমিকা কী? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক ভাবনাই ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু গুছিয়ে নিতে পারছিলেন না যেনো। অবশেষে তাঁর ‘শমী ঠাকুর’ এর মৃত্যু এতো দুঃখ নিয়ে এলো যে, কবি বুঝি বলে উঠলেন- আরো দুঃখ! রাখবো কোথায়? আবার দুঃখও বুঝি রবীন্দ্রনাথকে বলে উঠলো- আমাকে আবার রাখবে কি? আমি যে তোমার প্রাপ্য রাখার আধার। এরপর দুঃখকে পুরোপুরি বুঝলেন কবি, তাঁর মৃত্যু-দর্শনের স্নিগ্ধতা কোজাগরী পূর্ণিমার মতোই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখলো।
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শনের প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি বোধ, তা হলো- মৃত্যু তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের- সত্যের, মুক্তির ও শক্তির- ত্রয়ীরূপকেই ফুটিয়ে তোলে। সুতরাঙ সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাও জীবনের মতো মৃত্যুকেও।
এবঙ একটি সময় এলো- রবীন্দ্রনাথও সেই দর্শনের নিশ্চিদ্র নিরালায় হারিয়ে গেলেন। বাইশে শ্রাবণের অনন্ত রোদন তাই কখনো সঙ্গীত, কখনো প্রেম, কখনো বৃষ্টির এক টানা সাহানা সুর- আবার কখনো সব কিছু মিলিয়ে গেলে- একজন রবীন্দ্রনাথ; প্রেরণা-সুখে-দুঃখে-প্রাণময় অভিমানে-সীমানা পেরোনো ভালোবাসায় যিনি এক পশলা বৃষ্টির মতোন ছুঁয়ে যান, ছুঁয়ে যান, ছুঁয়ে যান.. ..
রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে গেলেও, তাঁকে নিয়েই একলা হতে হয় আমাদের- তিনি-ই আমাদের দৃষ্টি জোড়া বিষন্নতা, সৃষ্টিছাড়া সুখ।
তথ্যসূত্র
১। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা: ৪২৩
২। রবিজীবনী, খণ্ড দুই, পৃষ্ঠা: ২০৬
৩। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা: ২০৭
৪। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ২৬, পৃষ্ঠা: ১০৭
৫। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ২৩, পৃষ্ঠা: ৭৩
৬। বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা: ৩০৭
৭। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা: ৪৭৭-৭৮
৮। প্রাগুক্ত
৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা: ৫৬০-৬৪
১০। প্রাগুক্ত
১১। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা: ৪৮৫-৮৬, চিঠিপত্র ১১, পৃষ্ঠা ৮
১২। রবীন্দ্র-সৃষ্টি-সমীক্ষা, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ২৩৬, সুবর্ণজয়ন্তী সঙস্করণ
১৩। রবিজীবনী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১০১
১৪। রবিজীবনী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৯৬-৯৭
১৫। মরণ, রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৩৬৭
১৬। প্রাগুক্ত
১৭। রবীন্দ্রনাথের মরণদর্শন, আবদুশ শাকুর
১৮। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ৬৪৬
১৯। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ১০৩-০৫
২০। রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ১৪, পৃষ্ঠা ৩১১-১২
২১। স্মৃতিকথা, মীরা দেবী, পৃষ্ঠা ১৮
২১ শ্রাবণ, ১৪১৯
লেখাটি পড়লাম।
শনিবারের চিঠির আণুবীক্ষণিক নয়ন। এতো সুক্ষভাবে রবির মৃত্যুভাবনার বিশ্লেষণ এই লেখাটাকেও সার্থক করে তুলেছে। সাধারণ পাঠকের সাথে তার যে বিশাল পার্থক্য তা তার লেখনীতে ফুটে উঠেছে। তার মতো চিন্তাশীল পাঠক হতে পারাও এক বিশাল অর্জন। অনেক ভালো লাগলো।
@জটিল বাক্য, অনেক কৃতজ্ঞতা। জটিল বাক্যের মন্তব্য দেখে ভালো লাগছে।
@শনিবারের চিঠি,
মুক্তমনায় স্বাগতম। চমৎকার একটি বিষয় নিয়ে খুব ভালো একটি লেখা লিখেছেন। এই লেখাটি পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেল কবির আত্না-ভাবনা, তথা প্ল্যানচেটে অগাধ বিশ্বাসের কথা। লেখার এর ওপর খানিকটা আলোকপাত করতে পারতেন।
___
মুক্তমনায় মুক্তিযুদ্ধের ওপর আপনার গবেষণাধর্মী লেখা পড়তে চাই। চলুক। (Y)
@বিপ্লব রহমান, আমি অবশ্যই লিখবো বিপ্লব দা…আপনি ভালো থাকবেন, শুভ কামনা
@শনিবারের চিঠি
.
১৮৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাঁর ঘোড়ার চড়ার খবর সোত্সাহে ছেপেছিল যে -পত্রিকাগুলো, সেই পত্রিকাগুলোতে তাঁর অত্মহত্যার খবর ছাপা হলো না।
ব্যাপারটা নিয়ে বেশি না ভাবলেও এমনিতে প্রশ্ন আসাটাও অস্বাভাবিক নয়?
দেবেন্দ্রনাথ ঘুস দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করালেন। এমনকি , তাঁর মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্যে মর্গে পাঠানো হলো না। করোনার্স কোর্টে মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করার যে নিয়ম ছিল, ঘুস দিয়ে সেই কোর্ট বাসানো হয় ঠাকুরবাড়িতে।
.
করোনার কী রিপোর্ট দিয়েছিলেন,তাও জানা গেল না। রিপোর্টটি উধাও হলো। আজ্ও পাওয়া যায়নি সে রিপোর্ট। গুম করা লাশের মতো কাদম্বরী দেবী একেবারে হারিয়ে গেলেন। ঠাকুর বাড়ির এধরনের ঘটনাও দেখছি প্রচুর আছে।
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় রবীন্দ্রনাথ গেলেন কিন্ত্ত জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নয়।
কেন?
@আহমেদ সায়েম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আসলে বড়ো হয়েছিলেন ভিক্টোরিয়ান রুচির মধ্যে, তার সঙ্গে আবার মিশেছিলো ব্রাহ্মরুচি, বিশেষ করে দেবেন্দ্রনাথের রুচি। যে দেবেন্দ্রনাথ নিজের পিতাকে নির্বাসন দিয়েছিলেন উদারপন্থি বলে। ঠাকুরবাড়ির অনেক ইতিহাসই চাপা পড়ে গেছে, বা ইচ্ছে করে সেসব ইতিহাস এখন বন্দী করে রাখা হচ্ছে।
কাদম্বরীর ঘোড়ায় চড়ার খবর, না কি জ্ঞানদানন্দিনীর?
কাদম্বরীর বাবা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির দূরসম্পর্কের আত্মীয় এবঙ কম বেতনের বাজার-সরকার। বেতন মাত্র কুড়ি টাকা। আগে থেকে তার সঙ্গে আত্মীয়তাও ছিলো। তার মা ছিলেন স্বয়ঙ দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামাতো বোন। কিন্তু তাই বলে না আত্মীয়তার কারণে, না বৈবাহিক কারণে তিনি কোনো বিশেষ সম্মান পাননি ঠাকুর পরিবারের কাছ থেকে। কাদম্বরীর নিজের গায়ের রঙও ছিল শ্যামলা। সে তুলনায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ছিলেন রাজপুত্রের মতো।
পিতা বাজার-সরকার সেই সূত্রে কাদম্বরী বড়ো হয়েছিলেন ঠাকুরবাড়ির নিচের তলার সাধারণ চাকরবাকরদের সঙ্গে, অযত্নে লালিত। ওপরতলার মূল পরিবারের সদস্যরা এদের দেখতেন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের চোখে, কৃপার দৃষ্টিতে। এহেন নয় বছর বয়সী কালো মেয়েকেই বিয়ে করতে বাধ্য হলেন উনিশ বছর বয়সী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বধূ হিসেবে মেনে নিলেন অন্য বউয়েরাও। কারণ, দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ অথবা আদেশ সে বাড়িতে ছিলো বেদবাক্যের মতো। অলঙ্ঘনীয়। কিন্তু অন্য বউয়েরা তাকে কখনও নিজেদের জা হিসেবে মন থেকে গ্রহণ করেননি। সবচেয়ে বিরোধিতা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী যিনি ছিলেন বিলেতফেরত এবং ভারতীয়দের মধ্যে প্রথম সিভিলিয়ানের স্ত্রী। অতি আধুনিক। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ওদিকে ভক্ত ছিলেন এই আধুনিকার। ভক্ত না বলে মোহগ্রস্ত বলাই ভালো। নিজের বউয়ের দিকে খানিকটা মনোযোগ দিয়েছিলেন কাদম্বরী যখন উদ্ভিন্নযৌবন। স্বল্প সময়ের জন্য। নয়তো বাড়িতে ফিরতেন না। কাদম্বরীর সঙ্গে দৈহিক মিলনও হতো না। অথবা হলে হতো ব্যতিক্রম হিশেবে। তাকে বন্ধ্যা বলে আখ্যায়িত করা হতো কোনো ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে তিনি যে গৃহের দিকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না এ জন্য সবাই বউয়েরই দোষ দিতেন, বিশেষ করে মহিলারা কারণ পুরুষের সাত খুন মাফ। কাদম্বরীর নিঃসঙ্গতা, হতাশা, রবীন্দ্রনির্ভরতা সবকিছুর কারণই এসব। তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স মাত্র সাত, কাদম্বরীর থেকে এক বছর নয় মাসের ছোটো। রবীন্দ্রনাথের লেখা যখন অপরিণত ছিলো, তখন কাদম্বরীই ছিলো তার সব লেখার পাঠক- কিন্তু ক্রমে পরিণত হতে থাকা রবীন্দ্রনাথের লেখাগুলো যখন প্রকাশিত হতে থাকলো- কাদম্বরী হয়ে উঠলেন একা। তদুপরি, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এমনিতে পছন্দ করতেন সেকালের আধুনিকতার পথিকৃৎ বউদি জ্ঞানদানন্দিনীকে। সেখানেই সময় কাটাতেন। তার ওপর জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দুটি নাটকের অভিনয় করতে এসে সেকালের সবচেয়ে নামকরা অভিনেত্রী বিনোদিনীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সেই পরিচয় ক্রমশ পরিণতি লাভ করে প্রণয়ে।
রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরে এলেন। সবাই তাকে উষ্ণতার সঙ্গে বরণ করে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে, দীর্ঘ বিরহের পর কাদম্বরী দেবী তাকে পেয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়াই স্বাভাবিক। বিলেত থেকে ফিরে জ্যোতিদাদা আর বউদির সঙ্গে গেলেন বোলপুরে। কিন্তু ততোদিনে তার দিগন্তটা একটু প্রসারিত হয়েছিলো, তিনি আর একা কাদম্বরীর আদরের দেবর ছিলেন না। সে পরিবর্তন কাদম্বরী দেবী সম্ভবত অনুভব করতে পারলেন। করতে পেরে থাকলে তার আরও হতাশ এবঙ আরও নিঃসঙ্গ বোধ করার কথা। কিন্তু তাদের এ সময়ে ঘনিষ্ঠতা হওয়ার তথ্যও জানা যায়। দুজনে মিলে ছাদের ওপরে তৈরি করলেন একটি বাগান ‘নন্দনকানন’। সেখানেই সময় কাটতো দুজনার। দুজন পরস্পরের বন্ধু, পরস্পরের ভালোবাসা এবং সান্তনা। ‘দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী’।
পরের বছর পুজোর সময় দুজন মিলে দার্জিলিঙ বেড়াতে যান। শুধু দুজন, নাকি জ্যোতিরিন্দ্রনাথও ছিলেন, তা জানা যায় না। কয়েক মাস পরে ১৮৮৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা ‘ভারতী’তে প্রেমের উচ্ছ্বাসপূর্ণ একটি লেখা প্রকাশিত হয়। তাতে লেখেন-
এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর দেবেন্দ্রনাথসহ গোটা ঠাকুরপরিবার সচকিত হয়ে উঠল। এর মাস ছয়েকের মধ্যে ১৮৮৩ সালের ৯ ডিসেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিয়ে করলেন একটি নিরক্ষর গ্রাম্য মেয়েকে দক্ষিণডিহি থেকে [এখনকার খুলনার কাছে]। যাকে বিয়ে করলেন তার নাম ভবতারিণী। কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, তিনি নিরক্ষর ছিলেন না। কিন্তু হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বরাত দিয়ে প্রশান্ত পালের তথ্য থেকে জানা যায়, দক্ষিণডিহির ধারেকাছে কোনো প্রাইমারি স্কুল ছিল না। সুতরাঙ তিনি স্কুলে যাননি অথবা কোনো পরীক্ষায় অঙশ নেননি।
নিরক্ষর ছিলেন কি-না, সেটা নিয়ে বিতর্ক করলে করা সম্ভব। কিন্তু তিনি যে রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী হওয়ার যোগ্য ছিলেন না, এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ ছিল না। তা সত্ত্বেও, ‘আধুনিকা’ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী নেতৃত্ব দিয়ে এই কন্যাকেই পছন্দ করে আনেন। কাদম্বরীকে তিনি হাড়ে হাড়ে অপছন্দ করতেন, সেই কাদম্বরী-ভক্ত রবীন্দ্রনাথের ওপর শোধ নেওয়ার জন্যই হয়তো ভবতারিণীকে বেছে নিয়ে এসেছিলেন। আর, কাদম্বরীর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিতে মেয়ে পছন্দ করার কাজে তাকেও সঙ্গে নিয়ে যান।
কাদম্বরী দেবী আরও একবার নিজেকে একেবারে নিঃসঙ্গ এবঙ অসহায় মনে করলেন। বিষন্ন হলেন, যাকে এখন বলা হয় ডিপ্রেস্ড। তা সত্ত্বেও নিজেকে জীবন্মৃত অবস্থায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন পরের সাড়ে চার মাস। এরপর আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু মারা যান পরের দিন রাতে অথবা তার পরের দিন সকালে। চিকিৎসাও করা হয়। আমার ধারণা, কেলেঙ্কারি এড়ানোর জন্য। আর রবীন্দ্রনাথের বিয়ে করার সঙ্গে এর কোনো যোগাযোগ নেই, এটা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ এমন কথাও বলেছেন যে, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জোব্বার পকেট থেকে উদ্ধার করা কয়েকটি চিঠি থেকে কাদম্বরী এটা জানতে পারলেন যে, নটী বিনোদিনীর সঙ্গে তার স্বামীর প্রণয় সম্পর্ক রয়েছে। এ কথা আগে থেকেই জানা ছিল, সুতরাঙ একে ঠুনকো অজুহাত ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। অতএব এটা স্পষ্টত যে- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কেনো শবযাত্রায় শামিল হয়নি।
@শনিবারের চিঠি,
রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যখনই কথা উঠে, জানিনা কেন তাতক্ষণিকভাবেই দুটো নারী চিত্র ভেসে উঠে আমার মানসপটে। বিমলা আর চারুলতা। নষ্ট নীড় আর ঘরে বাইরে যেন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা চেতনা, মন-মানস, সপ্ন-দর্শন ও ঠাকুর পরিবারেরই এক ছায়াচিত্র। উপরে আহমেদ সায়েমকে দেয়া আপনার এই দীর্ঘ মন্তব্যটা পড়ে এর সাথে কিছুটা যোগ করার লোভে কিছু তথ্য, আনন্দবাজার ব্লগের তন্ময় দত্তগুপ্তের লেখা থেকে কিছুটা অংশ চুরি করে নিয়ে এলাম-
এবার সাগর সেনের কণ্ঠে “আমার প্রাণের পরে চলে গেলো কে, বসন্তের বাতাসটুকুর মতো” গানটা হয়ে যাক কেমন?
httpv://www.youtube.com/watch?v=NkkwHfRHIpA
@আকাশ মালিক, গানের জন্যে একেবারে বুক ভাসানো ভালোবাসা। রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেক নারী এসেছে- এ কথাটি ধ্রুব সত্য, তবে এটাও ঠিক- তিনি বৌঠানকে কখনোই ভুলতে পারেননি, এমনকি বৌঠানের জন্যে তাঁর যে স্থান- সেটাও তিনি কাউকে দেননি। রবীন্দ্রনাথের এই প্রেক্ষাপটটা চিন্তা করলে আমার শুধুই মনে হয়- কেনো বৌঠানকে কাছে পাইলাম না (দুষ্টুমি সমেত 😉 )
গুরুর ভাবনা; চ্যালার বিশ্লেষণ ……… অসাধারণ ।
@বিভা, ধন্যবাদ। 🙂
আপনার লেখা পড়ে ভাল লাগল। আগেও পড়তাম, বিশেষত কবিতা। এই লেখাটি নিয়েও কিছুই বলার নেই। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু দর্শন নিয়ে লেখাটা বাইশে শ্রাবণের আগে সত্যিই খুব বড় একটি পাওয়া। অনেক অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্যে।
@অজন্তা, কৃতজ্ঞতা জানবেন।
শনি, আপনার লেখা বরাবরের মতই, সেটা নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। তবে আমার মনে হয়েছে যে ‘উদাত্ত শান্তি’র কথা আপনি উল্লেখ করেছেন, মৃত্যুকে তার সমার্থক ভাবার জন্যে অনেক বড় একটি মানসিক স্থিরতার প্রয়োজন। সেই স্থিরতা অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের ছিল, কিন্তু সেটা কি শেষ পর্যন্ত ছিল? মনে হয় না, তাই বোধ করি শেষে এসে কিছুটা সংশয়বাদী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এই বিষয়টা কি লেখার মাঝে একটি সূক্ষ্ম মত-পার্থক্য তৈরি করছে না?
@মাটির মানুষ, স্থিরতার লেখচিত্র ধরে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে গিয়েছিলেন বটে- তবে তার বাঁক এসেছে, বাঁকের স্রোতে জল হয়তো ঘোলাও হয়েছে। আমি মূল লেখাটি তৈরি করেছি মূলত রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-দর্শন, যা তাঁর কাব্যের আয়নায় প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিনিয়ত। আপনি দেখবেন- স্রষ্টার দর্শন ব্যাখ্যা করতে যাবার জন্যে তাঁর সৃষ্টির অন্ত্যজ রসায়ন ব্যাখ্যার প্রয়োজন। অপ্রাসঙ্গিকভাবে এসে পড়ে সেই কথাটা যে- মানুষের জন্ম-বেড়ে ওঠা এবঙ তার মৃত্যু- সব কিছুর ভেতরেই একটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি সুদৃঢ়, অতএব কোনো স্রষ্টার আবেদন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তো আর সে হিশেবে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই বলছি- রবীন্দ্রনাথের দর্শন বুঝতে হলে, তাঁর সৃষ্টির মধ্যেই বুঝতে হবে; মানছি- তার জীবনাচরণ গুরুত্বপূর্ণ, তবে সেখানে দর্শনের চেয়ে বেশি প্রথাই গুরুত্ব পেয়েছে।
আপনি লেখার মাঝে সূক্ষ্ম মত-পার্থক্যের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি আগেও বলেছি, লেখাটি রবীন্দ্রনাথের দর্শন অনুসৃত, অতএব তাঁর সৃষ্টি ধারায় যদি কনট্রাডিকশন থাকে, লেখাতেও থাকতে বাধ্য। আমি কোথাও দাবি করিনি- এটি তাঁর সৃষ্টিসত্তা সম্বন্ধে আমার নিজস্ব ধারণাপ্রসূত লেখা।
কষ্ট করে লেখাটি পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ।
@শনিবারের চিঠি,
কিছু মনে করবেন না শনি, আমি এই জায়গাটার একটা ব্যাখ্যা চাই।
@মাটির মানুষ, আমার ব্যাখ্যা আপনার মনের মতো হবে কি না জানি না, তবে চেষ্টা করবো। দেখেন- রবীন্দ্রনাথের উপনিষদ দর্শনকেন্দ্রীক চিন্তাধারা প্রকাশ কিন্তু বাস্তব জীবনে, অর্থাৎ ব্যবহারিক জীবনে কম উপস্থিত। আপনি প্রথমে দেয়া অভিজিৎ দা’র মন্তব্যটা পড়েন, দেখবেন- চিকিৎসা নিয়েও তাঁর একটা বাতিক ছিলো। সেটা কিন্তু প্রগাঢ় দর্শনকেন্দ্রীক নয়, আবার তিনি বিজ্ঞানের বিষয়ে বেশ আগ্রহী ছিলেন, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন বসুকে চিঠিও লিখেছেন- তবে তা কতোটা গ্রহণ করেছেন, সেটা ভাববার বিষয়।
১৩৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ শ্রী নিকেতনের বাৎসরিক উৎসবে গ্রামবাসীদের প্রতি কথিত এক ভাষণে বলেন-
লক্ষ্য করেন- এ বোধ কিন্তু স্থায়ী হয়নি; তিনি পরবর্তী সময়ে এসে কথা পাল্টেছেন- ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরাকে দিয়ে অনেক কিছুই বলিয়ে নিয়েছেন। এটা হলো সময়ের সাথে, প্রথার সাথে তার পরিবর্তনীয় মানসিকতার উদাহরণ। দর্শনকে তিনি কাব্যে ধরেছেন, তবে তা দিয়ে যে জীবন চলবে না- সেটাও তিনি বুঝেছিলেন।
ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে সজ্ঞানভারে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই- আসাধারণ লাগলো রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তোমার আর অভিজিৎ এর লেখা । অনেক বিষয়ই জানতে পারলাম সেই সময়কার ঠাকুর পরিবারের কথা আর রবীন্দ্র নাথের মৃত্যু বিষয়ক ভাবনা আর ঈশ্বর বিশ্বাস।
@বেণুবর্না, অনেক অনেক ধন্যবাদ প্রিয় বেণুবর্না। 🙂
অসাধারণ লিখা, শনিবারের চিঠি (Y)
রবীন্দ্রনাথকে কে নিয়ে আলোচনার ধৃষ্টতা আমার নেই। তার আবেশটুকুই নিজের সৃষ্টিতে দেখতে পাই। আবারও কৃতজ্ঞতা রইল 🙂
ভাল থাকুন সতত 🙂
@কবি নীরব, অনেক ভালো লাগছে, যে আপনি লেখাটি পড়েছেন। আপনার সৃষ্টিসত্তা উজ্জ্বল হোক, প্রগাঢ় হোক। কৃতজ্ঞতা জানবেন।
শচি বরাবরের মত অসাধারণ। (F) (F) (F)
@আলিয়া, অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আপু, কষ্ট করে পড়ার জন্যে।
🙂 🙂 রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, লিখছেনও কিন্তু এই সময়কার মধ্যে এমন সুন্দর বিশ্লেষণ খুব কম চোখে পড়েছে । অসাধারণ লাগলো । আপনার পরিশ্রম কে সাধুবাদ জানাই ।
@সাকিয়া রিপা, অনেক ধন্যবাদ আপু। কষ্ট করে পড়ার জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ। দারুণ লেখা।
একটা বইতে (নাম সঠিক মনে নেই- সম্ভবতঃ সুনীলের প্রথম আলো)পড়েছিলাম।কিভাবে রবীন্দ্রনাথ এত শোকের মধ্যে লিখে গেছেন-বিস্ময়ে ভাবি! মৃত্য শোক, মেয়ের অসুস্হতা,সে সাথে এক মেয়ের বিয়ের সময় এক ঘটনায় নিদারুণ কষ্ট পেয়েছিলেন। মনের মধ্যে কষ্টের ঝড় বয়ে যাচ্ছে অথচ প্রকাশকের তাগাদা,বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগদান,চিঠির উত্তর দেয়া,বিদেশে আমন্ত্রণ- কোনটা থেকে নিস্তার নেই।
সমালোচনা সাহিত্য আমার বরাবরই প্রিয়। ভালো থাকবেন।
@অসীম, আমার ভালো লাগলো আপনার মন্তব্যে। অনেক কৃতজ্ঞতা লেখাটি পড়ার জন্যে। এটা ঠিক তীব্র কষ্ট- আর দহন যন্ত্রণা রবীন্দ্রনাথকে লেখনীর দরিয়ায় ভাসিয়েছে। দেখা গেছে- মৃত্যুসঙবাদ শোনার তীব্র যন্ত্রণাতেও তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার অমোঘ নিদর্শনগুলো তৈরি করেছেন।
দারুণ লাগল। অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য (F) (F)
@তামান্না ঝুমু, অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা পড়ার জন্যে। শুভ কামনা জানবেন। (F)
আপনাকে এখানে দেখে খুব ভাল লাগছে। এবার ব্লগে সাহিত্য আলোচনা জমে উঠবে। প্রথম লেখার জন্যে
(F) (F) (F) (F) (F) (F) (F)
নিচের ঘটনাটা বোধ হয় একই সময়ের-
httpv://www.youtube.com/watch?v=Q1XcZopxmmI
@আকাশ মালিক, একেবারে দুর্দান্ত সঙযোজন। ঠিক এই বিষয়টাই। আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ জানাবো। অনেক কৃতজ্ঞতা। (C) (C) (C)
শনিবারের চিঠি, আপনার লেখা আমি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। এটাও পড়লাম। আমার একটি বিষয় মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু-দর্শন কি কেবল তার কাব্য চেতনায় সীমাবদ্ধ ছিলো? বা কেবল কাব্যধারার স্রোতে কি দর্শনের বোধগম্যতা সম্ভব?
আপনার পরিশ্রমকে অনেক শ্রদ্ধা জানাই।
@মোমতাজ, প্রথমেই ধন্যবাদ, কষ্ট করে লেখাটি পড়বার জন্যে- এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গে আসছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি- দর্শনের যে আভিধানিক সঙজ্ঞা, তার আওতায় রবীন্দ্র-সাহিত্য উঠে এসেছে অনেক পড়ে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম বিশাল ও ব্যাপক, একেবারে ধারণাতীত না হলেও ধারণা করা মোটামুটি দুস্কর। তো একজন কবি হিশেবে কেবল নন- তিনি সাহিত্যের নানা শাখাতেই বিচরণ করেছেন, এবঙ তাঁর ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সেটা তাঁর নিজস্ব দর্শন থেকে খুব বেশি বিচ্যুত হয়নি বলেই আমার মনে হয়েছে। আপনি লক্ষ্য করবেন- আমি বলেছি-
বস্তুত ঘটনাও তাই- আমার ব্যক্তিগত চিন্তার ফ্রেম থেকে রবীন্দ্রনাথের ‘মৃত্যু-দর্শন’এর ল্যাণ্ডস্কেপ দেখতে গেলে যে পরিমাণ পড়াশুনা ও ভাবনার গভীরতা প্রয়োজন, আমি তা এখনও অর্জন করিনি। তবে স্বীকার করতেই হয়- আপনি আমার সীমাবদ্ধতাটাই খুঁজে বের করেছেন। 🙂
আপনার কাছে অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা।
@শনিবারের চিঠি, তাহলে কি রবীন্দ্রসাহিত্যের বাইরে রবীন্দ্রদর্শন অনুপস্থিত? আমি বলতে চাইছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও আচরণে কি তাঁর দর্শনকে উপস্থিত করতে পেরেছিলেন?
@মোমতাজ, একজন সাহিত্যিক কখনোই ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে এসে তাঁর সৃষ্টিধারার অমোঘ স্রোত তৈরি করতে পারেন না; রবীন্দ্রনাথেরও পারবার কথা না। এখন দর্শন- যেটুকু তাঁর চিন্তায় ছিলো- সেটুকু তিনি প্রকাশ করেছেন কাব্যে-সৃজনে; কিন্তু তাঁর সামগ্রিক জীবনাচরণে পেরেছেন কি না- সেটা ভাববার বিষয়। লক্ষ্য করবেন- রবীন্দ্রনাথ এক সময় উপনিষদ দর্শনের অনুস্রোতায়নে কাব্য রচনা করেছেন, পরে তিনি যখন ভারতবর্ষের বাইরে গেলেন, জগতের নানা বিশালতা সম্বন্ধে দেখলেন-বুঝলেন-জানলেন- তখন তিনি তাঁর কাব্যের রঙ বদলাতে থাকলেন। এক্ষেত্রে অমিয় চক্রবর্তীর একটি কথা উল্লেখ প্রয়োজন। কথাগুলো তিনি যখন লিখেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তখন মিউনিখে। চুয়াল্লিশ মাইল দূরে মের্গাউ নদীর তীরে একটি গ্রাম ওবের আমের্গাউ। প্রতি দশ বছর অন্তর ‘প্যাশন প্লে’ নামে যিশু খ্রিস্টের জীবনলীলা অভিনীত হয়ে থাকে এখানে। তখন ঐ নাট্যাভিনয় চলছিলো। রবীন্দ্রনাথকে দেখাবার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো। অমিয় চক্রবর্তী লিখেছেন-
পরে সুবোধকুমার সরকারের লেখা ‘বরীন্দ্র-কাব্য পঞ্জিকা’ থেকে জানতে পারি- সেদিনই রাত্রে লেখা হলো একটি ইংরেজি কবিতা, কবির লেখা প্রথম ইংরেজি কবিতা, The Child; বিষয়বস্তু শিশু নয়, যেমন ‘শিশু’ কিংবা ‘শিশু ভোলানাথে’র কবিতা।
এখন কিন্তু একটা প্রশ্ন আসতে পারে; ‘কড়ি ও কোমল’, ‘প্রভাতসঙ্গীত’ এর কবিকে কেনো লিখতে হলো ইংরেজিতে? তাঁর সূচনালগ্নের দর্শনতো তা অনুমোদন করে না। সন্দেহ নেই অগ্নিগর্ভ আবেগের অগ্ন্যুৎপাত, বৈদেশী সংস্কৃতি-আবহাওয়ায় প্রাসঙ্গিক অনুভবের উৎসারণ। The Child হয়ে দাঁড়ালো সভ্যতা বিকাশের গতিধারায় মনুষ্যত্বের অবস্থান সম্পর্কিত কাব্যোপলব্ধি। পরের বৎসরই কবিতাটি ছেপে বের করেছিলেন লন্ডনের অ্যালেন এ্যান্ড আনউইন। অমাযামিনীতে শুরু কবিতার : What of the night?’ they ask/No answer comes..’ এই বছরেই, অর্থাৎ মূল রচনার এক বছর পরে ১৩৩৮-এর শ্রাবণে The Child থেকে গেঁথে তুললেন ‘শিশুতীর্থ’ (প্রসঙ্গত ‘পুনশ্চ’ কাব্যের এই কবিতা দিয়েই তিনি নান্দীপাঠ করলেন গদ্যকবিতা রচনার)। ‘শিশুতীর্থের’ সঙ্গে ‘মানবপুত্র’ ‘চিররূপের বাণী’ এবং ‘তীর্থযাত্রী’ মিলিয়ে পড়লে ধরা পড়বে মনুষ্যত্ব সাধনার কোন স্তরকে ছুঁতে চাইছেন কবি। কিন্তু সেখানে শিশুর জায়গা কোথায়? এলিয়টের ‘দ্য জার্নি অব দ্য মেজাই’ কবিতার ভাষান্তর, কোন সন্দেহ নেই, অনুবাদশৈলীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে হাত মকশো করা নয়, অন্তর্গত চাপসঞ্জাত প্রণোদনা। পুনরায় প্রশ্ন ওঠে কিন্তু শিশু কেন? অক্ষম ও অসহায় শিশু আসে কোথা থেকে? আসে এ জন্য যে শিশুই হল মানব-অস্তিত্বের শাশ্বত সত্য, যার ক্ষয় বা বিলুপ্তি নেই, কারণ মানবপ্রাণের ধারাবাহিকতা তার ভেতর দিয়ে বহমান। এই শিশু জেসাস ক্রাইস্ট। রবীন্দ্রনাথ যিশু খ্রিস্টকে ধূলিমলিন মর্ত্যভূমিতে চিরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবাত্মা হিসেবে সর্বদা বিবেচনা করেছেন। ‘জয় হোক মানুষের’ কথার মধ্যে জটিল, নিষ্ঠুর, হন্তারক পাপী মানুষ লুকিয়ে নেই; এই মানুষ সর্বদাই শিশু মূর্তি, সেই শিশু যার দৈবী বিভান্বিত রূপমাধুরী ‘শিশু’ কাব্যের শিশুমূর্তিতে তিনি তৈরি করেছিলেন।
এখন আপনি প্রশ্ন করতে পারেন- এ নির্মোহ দর্শনকে কি রবীন্দ্রনাথ তাঁর সন্তানদের মাঝে প্রয়োগোৎসাহী ছিলেন? বা তাঁর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে কি এ দর্শনের ছাপ ছিলো? থাকতেও পারে- তবে তার নিরেট উপস্থাপনা মৈত্রীয় দেবী পারলেও. আমি পারবো না।
@শনিবারের চিঠি, মন্তব্যের জন্যে অনেক ধন্যবাদ, এবার পরিস্কার হলো বিষয়টা। তবে এর মধ্যে কোথায় যেনো একটা সীমাবদ্ধতা টের পাচ্ছি, এটা আমার বোঝার সীমাবদ্ধতাও হতে পারে।
@মোমতাজ, সীমাবদ্ধতা যেটুকু সেটুকু এই যে, আমি কেবল কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ থেকে আলোচনা করলাম, ছোটোগল্পের ধার সামান্য ঘেঁষে গেলেও উপন্যাসের চৌকাঠ তো ছুঁই-ই নি। এখানে আপনার মনের খামতিটা থাকতেই পারে।
@শনিবারের চিঠি, তাহলে তাঁর উপন্যাসগুলো নিয়ে আলোচনা আসুক। সেটা অবশ্যই অনেক প্রাণবন্ত হবে বলে আশা করি। আপনার বুক রিভিউগুলো পড়া আছে- আপনার কাছে আশা করা চলে। 🙂
চমৎকার লেখা। এমন একটি লেখা দিয়ে মুক্তমনায় বউনি করার জন্য অভিনন্দন। রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে অনেকগুলো কাছের মানুষের মৃত্যুই দেখেছিলেন। তার মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যু, বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু, এমনকি নিজের পুত্র শমী এবং কন্যা মাধুরীলতার মৃত্যুও। তবে বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু তার জীবনের প্রথমেই যেভাবে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল, সেটা সত্যই অন্যরকম। তিনি ঠিকই বলেছিলেন – “আমার চব্বিশ বছর বয়সের সময় মৃত্যুর সঙ্গে যে-পরিচয় হইল তাহা স্থায়ী পরিচয়…”।
সেই বিখ্যাত গানটি আবারো শুনা যাক –
httpv://www.youtube.com/watch?v=G71Mg_BdySc
আমার অবশ্য রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিণী দেবীর মৃত্যু নিয়ে কিছু কৌতুহল হয়েছিল। কিছু অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছিলাম। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বেশ কিছু বইয়ের পাশাপাশি ডা. শ্যামল চক্রবর্তীর ‘রবি ঠাকুরের ডাক্তারি’ (সাহিত্য সংসদ, ২০১১) নামের বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। লেখক দাবী করেছেন যে, রবিঠাকুরের বাতিকগ্রস্থতা (লেখকের মতে ‘চিকিৎসাবায়ুগ্রস্ততা) এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলো যে তিনি মৃণালিনী দেবীর অসুস্থতার সময় কোন এলোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেননি, নিজের হোমিও-জ্ঞান (রবীন্দ্রনাথ শুধু হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসই করতেন না, নিজেও হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে মানুষ জনের চিকিৎসা করতেন) প্রয়োগ করে গেছেন দিনের পর দিন তার স্ত্রীর উপর। লেখকের দাবী অনুযায়ী ‘চিকিৎসক’ রবিঠাকুরের এই ভুল চিকিৎসায় মৃণালিনী দেবী জোড়াসাঁকোর একটি আলো-বাতাস-হীন ঘরে প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে মারা যান। এ সময় কোন আধুনিক চিকিৎসাই মৃণালিনীকে দেয়া হয়নি। কেবল অসুস্থ স্ত্রীকে পাখার বাতাস করে গেছেন, আর নিজের হোমিওপ্যাথির উদ্ভট ঔষধ খাইয়ে গেছেন। ডাক্তার শ্যামল চক্রবর্তীর মতে মৃণালিনী দেবীর রোগটি ছিলো গর্ভপাত-পরবর্তী জরায়ু ও সন্নিহিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংক্রমণ যা চিকিৎসা শাস্ত্রে ‘পোস্টঅ্যাররটাল সেপসিস’ নামে চিহ্নিত। অথচ এই রোগের ভাল চিকিৎসা তখন এলোপ্যাথিতে ছিলোই। তিনি তা নেননি, বরং ডঃ শ্যামল চক্রবর্তী লিখেছেন –
এই বইটি প্রসঙ্গে আনন্দ বাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে (নির্মোহ, বিরল রবীন্দ্রচর্চা, বইপোকা, ৪ কার্তিক ১৪১৮ শনিবার ২২ অক্টোবর ২০১১) – “…বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ‘মৃণালিনীর মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ’ অধ্যায়টি। সেখানে ঠিক কোন অসুখে মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল সে সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ অনুমান আছে, আছে এই তথ্যভিত্তিক ইঙ্গিতও যে মৃণালিনীর মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী রবীন্দ্রনাথই… রবীন্দ্রচর্চায় এমন নির্মোহ গবেষকের দৃষ্টি বিরল”।
এ নিয়ে আমার ভবিষ্যতে কিছু লেখার ইচ্ছে আছে।
লেখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি লেখককে।
@অভিজিৎ দা, বইটি আমি পড়িনি, তবে অবশ্যই পড়ার আগ্রহ রইলো। আপনার উল্লিখিত এই বিষয়টি আসলেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অ্যালোপ্যাথিতে বেশ পিছপা ছিলেন, এটা সম্ভবত তাঁর সঙস্কার। কারণ মৈত্রেয়ী দেবীর (১৯১৪-১৯৯০) ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ [মুক্তধারা প্রকাশনী, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১০] পড়েও আমার তাই মনে হয়েছে। সেখানের এক স্থানে আছে রবীন্দ্রনাথ মৈত্রীয় দেবীকে বলছেন-
বোঝা যায়- উনি আসলে কবিতার পাশাপাশি ডাক্তারিটাকেও আয়ত্বে আনতে চেয়েছিলেন এবঙ সেটি তিনি করতে চেয়েছিলেন অত্যন্ত ভুল একটি উপায়ে। মৃণালিনীর প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা নিয়েও গবেষক গোলাম মুরশিদ সন্দেহ পোষণ করেছিলেন। তবে সে জায়গাটা অবশ্য আমার ভালো লাগেনি, আমার মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ ভালোবাসতে গিয়ে কোনো কার্পণ্য করতে পারেন। তাছাড়া আপনার লেখাতেও এসেছে-
কোলের সন্তানকে বোলপুর পাঠিয়ে দেবার কারণ বোধ হয় এই যে- ওই সময় সন্তান যেনো মায়ের কষ্ট না দেখতে পারে। জানি না, এইটা নিয়ে আরও গভীরভাবে পড়াশুনা করলে একটা সুরাহা পাওয়া যাবে।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ দাদা; অনুপ্রেরণার দীপাবলীটা জ্বেলে দেবার জন্যে।
@শনিবারের চিঠি,
আমার কাছে কি মনে হয় জানেন, মেজো বৌঠান জ্ঞানদানন্দিনী প্রতি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিংবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর প্রতি কবিগুরুর আকর্ষণ – এটা ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহলের সংস্কৃতি। দেওরের বয়সের সাথে বৌঠানদের সখ্যতার কারণ – নিছক বয়েস। প্রায় সমবয়সী বলে এ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল।
অপ্রাসংগিক হলে লোভ সামলাতে পারছি না, প্রতিভা বসুর “জীবনের জলছবি”-তে পড়েছিলাম। তাঁর মতে, সরলা দেবীর সাথে উনি ফাংশন সেরে কোলকাতায় ফিরলেন। সরলা দেবীর মা জ্ঞানদানন্দিনী রেল স্টেশনে মেয়ের প্রতীক্ষায়। অসম্ভব রকমের সুন্দরী,গায়ের রঙ আর দারুণ স্মার্ট -সব মিলিয়ে জ্ঞানদানন্দিনীর মতো কোন মহিলা নাকি আর দেখেননি পরবর্তীতে বহুদেশ ঘুরে – বুদ্ধদেব বসুর সাথে।
বলে রাখি, ”ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল“ নামে একটা বই আছে। পড়ে দেখতে পারেন। ঠাকুর বাড়ির মেয়েদের পোষাক আশাকের ব্যবহার আর সৌন্দর্য সংস্কৃতি নিয়ে একটা লেখার ইচ্ছে আছে মুক্তমনায়।
ভালো থাকবেন।
@অসীম,
মানে চিত্রা দেবী’র বইটা? আহা- কী দারুণ! বইটার একটা জায়গায় যেনো ছিলো শর্মিলা ঠাকুর ঠাকুরবাড়ির মেয়ে, পরে তাঁর এক সাক্ষাৎকারের বরাত দিয়ে আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু (F) 😉 বলেছিলেন- তিনি ঠাকুরবাড়ির মেয়ে নন। বিষয়টা নিয়ে জানার আগ্রহ আছে।
আমি আপনার লেখার প্রতীক্ষায় (অপেক্ষায় না কিন্তু) রইলাম।