পাহাড়ের কান্না
আকাশ মালিক
ছোটবেলা খেলার মাঠে, নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একা একা সপ্ন দেখতাম, একদিন উত্তরের খাসিয়া পাহাড়ের উঁচু চুড়ায় উঠে সারা বাংলাদেশ দেখবো। প্রভাতের কুয়াশার চাদরে ঢাকা সবুজ পাহাড় দেখে কতোকিছু কল্পনা করতাম। পাহাড়ের পেছনে বুঝি আর কিছু আছে, নাকি সেখানেই দুনিয়ার শেষ সীমানা? গাছগুলো ছোট ছোট না বিরাট আকারের দৈত্য-দানবের বাসা? সাদা সাদা দাগগুলো ছোট ছোট নদী না খাল, না ঝর্ণা? মানুষ তো দূরের কথা অন্য কোন জীবও যে সেখানে থাকতে পারে সেটা কোনদিন কল্পনাই করি নাই। পাহাড় কোনদিন দেখা আমার হয়নি তবে দুই বার দুটো টিলা দেখেছি। একবার মামার সাথে প্রায় ৪৫ বছর আগে ছাতক থানার পশ্চিমে একটি টিলায় গিয়েছিলাম। এই মাটি, মাটির রঙ, গাছ-বিছালি, এই ফল-ফুল, উঁচু-নিচু সরু আঁকাবাঁকা পথ, পথের ধারে ছড়ানো লজ্জাবতি, ছোট ছোট কুয়ো আর ঝর্ণা, এর আগে আমি কোনদিন দেখিনি। টিলার সব কিছু দেখে সেই বয়সে আমার কেন জানি মনে হতো, এই পাহাড় এই টিলা থেকেই বুঝি জগতের সৃষ্টির শুরু, এখানেই হবে শেষ। দ্বিতীয়বার গিয়েছিলাম ৮০ সালে সিলেট শহরে আমার এক আত্মীয়ের খরিদ করা তার বাসার পার্শবর্তি একটি টিলায়। টিলার বেশ কিছু জায়গা জুড়ে কলোনি গড়ে তোলা হয়েছে। নিচ থেকে অনুমানই করা যায়না টিলার উপরে কোন ঘর বসতি আছে। সারি বাঁধা বিশটি টিনের ঘর, সবগুলোই ভাড়া দেয়ার জন্যে। প্রায় সকল ভাড়াটিয়া রিকশাওয়ালা, দিন মজুর। ঘরগুলো দেখে নিচে নেমে আসার পথে ভয়ে ভয়ে বারবার পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখছিলাম, এই ঘরগুলো কি আদৌ নিরাপদ? কোনদিন ঘরের নিচ থেকে মাটি সরে যাবেনা তো? পাশের উঁচু মাটি ধ্বসে ঘরের উপর পড়বেনা তো? মৃত্যুর ঝুকি নিয়ে গরিব মানুষগুলো টিলার উপর পাহাড়ের চুড়ায় বসত করে। আর ধনী লোভীরা তাদের জীবন নিয়ে ব্যবসা করে। এ সপ্তাহের পত্রিকার খবর পড়ে পুরনো দিনের সেই কথা গুলো মনে পড়ে গেল।
সিলেটের দক্ষিণ ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও এলাকার টিলার চূড়ায় গর্ত করে নির্মাণ করা হয়েছে একটি ঘর।
(ছবি) পাঠানটিলা সিলেট
বছরের জুন-জুলাই মাস যেন পাহাড়িদের সর্বনাশের মাস। বাড়ি ঘর মাটিতে মিশে যাবে, মানুষ মারা যাবে, মাতা পিতা সন্তান হারা হবে, সন্তান এতিম হবে, বিবাহিত নারী বিধবা হবে, স্বজন হারাদের চিৎকার হাহাকার ক্রন্দন ধ্বনিতে পাহাড়ের বাতাস ভারী হবে। এ যেন পাহাড়িদের নিয়তির লিখন হয়ে গেছে। পত্রিকার পাতায় টেলিভিশনের পর্দায় খবর যারা দেখেছেন, পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই চট্টগ্রামের পাহাড়িদের কান্না শুনতে পেয়েছেন। গত দশ বৎসরের হিসেব নিলে দেখা যাবে এমন কোন বছর নেই যে চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেনি, পাহাড় ধ্বসে, মাটি চাপা পড়ে মানুষ মারা যায়নি। পাহাড় ধ্বসে মানুষের মৃত্যু কেন হয়, কী তার কারণ, কে দোষী, কে দায়ী, কী করা উচিৎ ছিল, কী করা হয় নি, এ সব আলোচনা বা তর্ক করা এই লেখার উদ্দ্যেশ্য নয়। আমরা জানি পাহাড়ের বা টিলার উপরে মানুষের বাসা রেখে নিচে মাটি কেটে ফুটবল মাঠের দর্শক-গ্যালারী তৈ্রী করার পাশবিক বুদ্ধির মানুষের অভাব এই দেশে নেই। এখানে আমরা দেখবো ঘর হারা, প্রিয়জন হারা দুর্দশাগ্রস্থ এই অসহায় মানুষগুলোর জন্যে আমরা কি কিছু করতে পারি। তার আগে একটা ঘটনা আপনাদের স্ম্বরণ করিয়ে দেই।
উপরের ছবিটি অনেকেই হয়তো দেখেছেন, মনেও রেখেছেন । ওরা টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের পশ্চিম সিকদার পাড়া এলাকার বাবা নুর মুহাম্মদ ও মা লায়লা বেগমের সন্তান নুরুল আমিন , নুর হাদীস ও শাহেনা আক্তার রুবি। তাদের আরো একটি ভাই ও একটি বোন ছিল। ২০১০ সালের জুন মাসে পাহাড় ধ্বসে একই রাতে তাদের মা, বাবা মারা যান, সাথে ভাই নুরুল আবছার ও বোন নাছিমা আক্তারও মারা যায়। চরম অসহায় এই তিন এতিম শিশু আরেক ট্রাজেডির শিকারে বেঁচে যাওয়া চাচা নুরুল কবির এর কাছে আশ্রয় নেয়। বিষয়টি সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচারের পর উখিয়া-টেকনাফের সাংসদ আবদুর রহমান বদির নজরে পড়ে। সাংসদ বদি এই তিন এতীমের , টাকা পয়সা, খাবার দাবার লেখা পড়ার দায়িত্ব নেন। আশা করি সাংসদ আবদুর রহমানের তত্ত্বাবধানে তারা ভাল আছে, আমরা তাদের সুখী সুন্দর ভবিষ্যত কামনা করি । দেশে যারা আছেন, যাদের সামর্থ্য আছে তারা হয়তো সাংসদ আবদুর রহমান এর মতো কোন অসহায়কে সাহায্য করতে অবদান রাখতে পারবেন বা পেরেছেন, কিন্তু আমরা যারা বিদেশে আছি আমাদের ইচ্ছে থাকা সত্বেও ততটুকু হয়তো করতে পারবোনা।
(ছবি) লামা বান্দরবান
বছর ঘুরে জুন আসবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে, শুধু মাটি ধ্বস নয়, ঝড়-বৃষ্টি, খরা-বন্যা হবে। কেবল পাহাড়ী এলাকায় নয়, বিপর্যয় ঘটবে, দেশের অন্যত্রও। মানুষের দুঃখে আমরা দুঃখবোধ করি, মানুষের ব্যাথায় ব্যতিত হই, সমবেদনা প্রকাশ করি। অনেক সময় সাহয্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চাই কিন্তু সুযোগ সুবিধার অভাবে তা করতে পারিনা। মুক্তমনা অতীতে বেশ কয়েকবার সেই সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিল, সুহৃদয় সদস্যবৃন্দ নিজ নিজ সামর্থানুযায়ী সাহায্য করেছিলেন। স্ম্বরণ করিয়ে দিতে চাই, মুক্তমনা কুড়িগ্রাম স্কুলের জন্য দুই লক্ষ চৌত্রিশ হাজার দুই শত পাঁচ টাকা, শাহরিয়ার কবির এন্ড সেকুলার এক্টিভিষ্টস খাতে পয়ত্রিশ হাজার টাকা, আযাদ মেমোরিয়েল ফান্ড এর জন্যে ষাট হাজার বত্রিশ টাকা, ও নির্মল সেনের সাহায্যার্থে এক হাজার পনেরো আমেরিকান ডলার সংগ্রহ করতে সামর্থ হয়েছিল। যতোই ক্ষুদ্র হউক, আমাদের সম্মিলিত সাহায্য একটি অসহায় শিশুর মুখে হাসি ফুটাতে পারে, হতাশাগ্রস্থ একজন মানুষের মনে বেঁচে থাকার সাধ ফিরিয়ে দিতে পারে। মুক্তমনা ট্রাস্ট বা ফান্ড নামে স্থায়ী একটা একাউন্ট খুলতে পারলে সময়ে সময়ে প্রবাসী সদস্যবৃন্দ ক্ষুদ্রাকারে হলেও টাকা জমা রাখতে পারতেন। আর প্রয়োজনানুসারে মুক্তমনার এই ফান্ড থেকে অভাবগ্রস্থ, দূর্দশাগ্রস্থ মানুষদেরকে সাহায্য করা যেতো। কর্তৃপক্ষ সেই দিকটা কি বিবেচনা করে দেখবেন?
httpv://www.youtube.com/watch?v=ICZJ7JTdj_k
প্রতিবছর এমন দুর্ঘটনা বন্ধ করার পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সব শেষে ত্রান দিয়ে দায় সারার পক্ষে আমি নই। এমন মৃত্যু কাম্য নয়, চাই স্বাভাবিক মৃত্যু
@শান্ত কৈরী,
১০০% একমত।
কিন্তু যাদের মাথার উপরে আজ ছাদ নেই, দাঁড়াবার এক টুকরো জায়গা নেই, মাথা গোঁজার ঠাই নেই, ভাতের হাড়ি-বাসন বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাদের কী হবে? কবি যে বললেন-
আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে’
সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
[img]http://i1088.photobucket.com/albums/i332/malik1956/chittagong20120627132051.jpg[/img]
বছর দুয়েক আগে কক্সবাজারে পাহাড় ধ্বসের সময় সরেজমিন প্রতিবেদন করতে সেখানে গিয়েছিলাম; খুব কাছ থেকে দেখেছি প্রকৃতির কি নির্মম প্রতিশোধ!
আসলে এইসব অসহায় মানুষ কিছু লোভি মানুষের পাহাড়-প্রকৃতি নাশের মূল্য পরিশোধ করছেন মৃত্যু দিয়ে। পাহাড় থেকে এইসব হত-দরিদ্র, প্রায় ছিন্নমূল মানুষজনদের নিরাপদ অঞ্চলে পুনর্বাসন করা না গেলে প্রায়ই এমন দুর্ঘটনা ঘটতেই থাকবে; এটি প্রায় অনিবার্য। কারণ, এই সব দরিদ্র-পীড়িত মানুষের সামর্থ নেই হাজার+ টাকা দিয়ে নিরাপদ অঞ্চলে বসবাস করার। তাই তারা পাহাড়েই ঘর তুলে কোনো রকমে দিন-যাপনে অনেকটাই বাধ্য।
ফেবু’তে একজন পাহাড়ি বন্ধু বলছিলেন, প্রতিবার দূর্ঘটনায় একজন পাহাড়ি মানুষও মারা যায় না কেনো? কারণ, আদিবাসী পাহাড়িরা পাহাড়-বন-প্রকৃতিকে বোঝেন। তারা মনে করেন, এসবই তাদের জীবনের অংশ। তাই পাহাড় বা বন বা প্রকৃতি নাশ করার অর্থ হচ্ছে, নিজের জীবন নাশ!
—
মুক্তমনা ট্রাস্ট/ ফাণ্ডের পক্ষে ভোট দিলাম। (Y)
@বিপ্লব রহমান,
বিভিন্ন ব্লগ, ফেইসবুক গ্রুপ যারা দেশে আছে ইতোমধ্যে টাকা পয়সা, ত্রান-সামগী নিয়ে দূর্গত এলাকায় পৌছে গেছেন, যারা বিদেশে আছেন পে-প্যাল একাউন্ট বা অন্যান্য পথে নিজ গ্রুপের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন।
গত সপ্তাহের খবরে পত্রিকা বলছে- Those killed were drowned in flash floods, hit by landslides, struck by lightning or buried by wall collapses. Many homeless people live at the foot of the hills or close to them despite warnings from the authorities about the danger of landslides. সূত্রঃ বিবিসি
সন্তানকে বাঁচাতে গিয়ে মা আর ফিরে আসেনি।
কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগর-এর মিলন স্থল, পাহাড়, নদী আর সাগরের দেশ চট্টগ্রাম শুনেছি খুব সুন্দর জায়গা। খুলশী, হারবাং , বান্দরবন, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা শুধু নাম শুনেছি, কোনদিন দেখিনি। যদি কোনদিন দেশে আসি, আপনি আমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাবেন তো দাদা? আমি পাহাড়িদের সাথে কিছুদিন থাকতে চাই, কেমন?
@আকাশ মালিক,
ভ্রাতা, আপনার আগ্রহকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এই অধম নিজেই পাহাড়ের একজন বহিরাগত পর্যবেক্ষকমাত্র। তবে আদিবাসী পাহাড়িদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বিনিময়ে হয়তো আপনার যোগসূত্র হতে পারি। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িদের আপনারদের মতো মুক্তমনা বন্ধুর প্রয়োজন আছে বৈকি!
অনেক শুভেচ্ছা। (Y)
@আকাশ মালিক,
মুক্তমনা ট্রাস্ট বা ফান্ড নামে স্থায়ী একটা একাউন্ট খুলতে পারলে সময়ে সময়ে প্রবাসী সদস্যবৃন্দ ক্ষুদ্রাকারে হলেও টাকা জমা রাখতে পারতেন। আর প্রয়োজনানুসারে মুক্তমনার এই ফান্ড থেকে অভাবগ্রস্থ, দূর্দশাগ্রস্থ মানুষদেরকে সাহায্য করা যেতো। কর্তৃপক্ষ সেই দিকটা কি বিবেচনা করে দেখবেন?
(Y)
ধন্যবাদ অতি প্রয়োজনীয় একটি বিষয় নিয়ে লেখার জন্য। (F)
@হেলাল,
এক সময় মুক্তমনা থেকে বেশ বড় কয়েকটা প্রজেক্ট এর কাজ করা হয়েছিল। এখন ফান্ড কালেকশনের জন্যে একটা স্থায়ী একাউন্ট দরকার। প্রচুর সদস্য প্রবাসে বাস করেন, যতই ক্ষুদ্র হউক নিয়মিতভাবে ফান্ড কালেকশন হলে, বৎসরে বড় অংকের ফান্ড একাউন্টে জমা হতে পারে। রমজান আসছে দেখবেন কতো মিলিয়ন টাকা বিদেশ থেকে কালেকশন হয় মসজিদ মাদ্রাসার জন্যে। ওদিকে মানুষ অনাহারে প্রাণ হারায়। আজিব এই দুনিয়ার মানুষ।
খুবই দুঃখজনক! প্রতি বছরে এমন ঘটনা ঘটে চলেছে। সরকার কেমন পদক্ষেপ নিবেন তা জানিনা। কেননা
কথার সাথে কাজের মিল কম দেখা যায়।
আশা করি মুক্তমনা কর্তৃপক্ষ আপনার এই লেখার মূল বক্তব্য বিশেষ বিবেচনায় নেবেন। তাহলে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়াতে সক্ষম হবে।
সময়োপযোগী লেখাটার জন্য ধন্যবাদ (Y)
@আফরোজা আলম,
জানিনা চ্যারিটি ফান্ড বা একটা স্থায়ী একাউন্ট চালানোর ব্যাপারটা কতোটুকু সময় ও কষ্টসাধ্য। তবে করতে পারলে একটা মহৎ কাজ যে হতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। লেখাটি পড়া ও মতামতের জন্যে ধন্যবাদ।