ঊনবিংশ থেকে বিংশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে মানুষের উদ্ভব ও বিবর্তন বিষয়ে পরীক্ষণযোগ্য কোনো অনুকল্প তৈরি করার মতো নৃবিজ্ঞানীদের কাছে হোমিনিড ফসিল রেকর্ড যথেষ্ট সংখ্যক ছিল না। তবু যে কয়টি হোমিনিড ফসিল সেসময় আবিষ্কৃত হয়েছিল তা থেকে বুঝা যাচ্ছিল পৃথিবীর আর সকল জীবের মতো আমরা মানব প্রজাতিও বিবর্তনের ফল। এ প্রজাতি কোনো ‘স্বতন্ত্র সৃষ্টি’ নয়। ফলে মানুষের বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে তেমন দ্বিমত ছিল না। ভিন্নমত ছিল, তবে সেটা বিবর্তনের প্রক্রিয়াসহ আরও কিছু বিষয় নিয়ে; যেমন মানুষের পূর্বপুরুষরা দেখতে কেমন ছিল? তাদের শারীরিক আকার কেমন ছিল? বিশ্বের কোন জায়গা আমাদের আদি পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি? এশিয়া না আফ্রিকা? ইত্যাদি।

বর্তমানকাল থেকে প্রায় সাত-আট মিলিয়ন আগে প্রাইমেট বর্গের অন্তর্ভুক্ত সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে মানুষের বংশানুক্রম (লিনিজ) এবং শিম্পাঞ্জির বংশানুক্রম পরস্পর আলাদা হয়ে গিয়েছিল। মানুষের বংশানুক্রমের সেইসব পূর্বপুরুষদের নৃবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘হোমিনিড’ বা ‘হোমিনিন’।

চার্লস ডারউইন তাঁর ডিসেন্ট অব ম্যান (১৮৭১) গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন :

It is… probable that Africa was formerly inhabitated by extinct apes closely allied to the gorilla and chimpanzee, and as these two species are now man’s nearest allies, it is somewhat more probable that our early progenitors lived on the African continent than elsewhere.

অর্থাৎ ডারউইনের মতে গরিলা ও শিম্পাঞ্জির সাথে মানুষের ঘণিষ্ঠ আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে এবং আফ্রিকা মহাদেশ মানুষের আদি পূর্বপুরুষের জন্মভূমি হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে (ডারউইনের ভাবশিষ্য) জার্মানির খ্যাতিমান শারীরবিজ্ঞানী আর্নেস্ট হেকেল (১৮৩৪-১৯১৯) বলেছেন, আফ্রিকা নয়, এশিয়া হবে হোমিনিডদের জন্মভূমি।১

জীবজগতে মানুষের (Homo sapiens) মতো এত ‘অনন্য সৃষ্টি’ জীবের পূর্বপুরুষদের জন্মস্থান আফ্রিকার মতো এক অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাদেশ–ডারউইনের এ বক্তব্য অবশ্য অনেক নৃবিজ্ঞানীই মেনে নিতে পারেন নি। পর্যাপ্ত প্রমাণ হাতে না থাকায় এ বিষয়ে জীববিজ্ঞানীরা ছিলেন দ্বিধাবিভক্ত। এছাড়া তাদের মধ্যে প্রশ্ন ছিল হোমিনিডদের মধ্যে কোন বৈশিষ্ট্য সবার আগে বিকাশ লাভ করেছে? যে সব হোমিনিডের খুলি ফসিল হিসেবে উদ্ধার হয়েছিল, তা থেকে দেখা যায় হোমিনিডদের করোটির আয়তন আধুনিক মানুষের তুলনায় অনেক কম। অর্থাৎ তুলনামূলকভাবে তাদের মস্তিষ্কের ধারণক্ষমতা কম। শুধু ফসিল নয় সে-সময় জীবিত এপদের খুলি পরীক্ষা করেও নিশ্চিত হয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা।

(জীববিজ্ঞানের শ্রেণীবিন্যাসবিদ্যায় ‘এপ’ বলতে সুপারফ্যামিলি Hominoidea-এর অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের বোঝায়। এরা হল গিবন, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, মানুষ ও ওরাংউটাং)। তাই প্রশ্ন দেখা দেয় হোমিনিডদের মধ্যে আগে কী মস্তিষ্কের আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং পরবর্তীতে এপদের মত ‘নাকলওয়াকিং’ থেকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই পায়ে হাঁটতে পারার মতা লাভ হয়েছিল? নাকি উল্টোটা? অথবা দুটি বৈশিষ্ট্যই কি হোমিনিডদের মধ্যে সমানতালে বিকশিত হয়েছিল? এরকম অসংখ্য অমীমাংসিত প্রশ্ন বা অনুকল্প নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমত ছিল।

তথাপি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে নৃবিজ্ঞানে সবচেয়ে কৌতূহলকর অনুকল্প ছিল ‘কোন বৈশিষ্ট্যটি আমাদের মানুষ বানিয়েছে?’ এপ-সদৃশ ও মানব-সদৃশ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যে-সব হোমিনিড ফসিল তখন আবিষ্কার হয়েছিল, তাতে প্রশ্ন দেখা দেয় হোমিনিড ফসিলগুলোর সাথে আধুনিক মানুষের কিছু সাদৃশ্যপূর্ণ অবস্থান থাকলেও প্রকৃতিতে মানুষের প্রজাতি হিসেবে স্বতন্ত্র অবস্থান কোথায়? এই প্রশ্নটি নিয়ে অনেকেই ভাবছিলেন তখন। নৃবিজ্ঞানীদের কাছেও এর সম্ভাব্য উত্তর ছিল ‘বড় মস্তিষ্ক’। বড় মস্তিষ্কই আমাদেরকে জীবজগতে শ্রেষ্ঠতর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। তাই বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল সবচেয়ে প্রাচীন হোমিনিড বা মানুষের পূর্বপুরুষ বা সবচেয়ে প্রথম মানবের মস্তিষ্ক অবশ্যই বড় হতে হবে। বড় মস্তিষ্ক ছাড়া জীবটি যতই আমাদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হোক না কেন, এটি এপ-ই হবে; মোটেও আমাদের মতো মানুষ নয়, কিংবা মানুষের পূর্বপুরুষ হতে পারে না।

লন্ডনের রয়েল কলেজের সার্জন এবং খ্যাতিমান নৃবিজ্ঞানী স্যার আর্থার কিথ (১৮৬৬-১৯৫৫) বলেছিলেন মানুষের ইতিহাস অনেক অনেক প্রাচীন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, ওই সময় নৃবিজ্ঞানের ফসিল রেকর্ডে তথ্য খুব বেশি ছিল না যার দ্বারা আর্থার কিথের বক্তব্য এবং মানুষের উদ্ভব সংক্রান্ত তাঁর অন্যান্য অনুকল্পগুলো খণ্ডন করা যায় কিংবা সমর্থনও করা যায়।

এরপর অনেকটা আকস্মিকভাবেই নৃবিজ্ঞান জগতে বিরাট আলোড়ন ওঠে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে ইংল্যান্ডের পূর্ব-সাসেক্সের পিল্টডাউন গ্রাম থেকে বেশ কিছু ফসিল আবিষ্কৃত হয়। ঐ আট বছরের ঘটনাবলীর সময়সূচি অনেকটা এরকম : ১৯০৮ সালের দিকে ব্রিটিশ আইনজীবী এবং অপেশাদার পুরাতাত্ত্বিক চার্লস ড্যাসন (১৮৬৪-১৯১৬) দাবি করেন, পিল্টডাউন এলাকা থেকে তিনি কিছু হাড়গোড়ের খণ্ডাংশ পেয়েছেন। পরের বছর ড্যাসনের সাথে ফরাসি প্রত্নজীববিজ্ঞানী এবং ধর্মপ্রচারক পিয়ের টেইলহার্ড দ্যা শার্ডিনের (১৮৮১-১৯৫৫) যোগাযোগ হয়। ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ড্যাসন যোগাযোগ করেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের কিউরেটর স্যার আর্থার স্মিথ উডওয়ার্ডের সাথে। পিল্টডাউন থেকে উদ্ধার হওয়া একটি করোটির ফসিল দেখানোর উদ্দেশ্যে। ঐ বছরের জুন মাসে আর্থার উডওয়ার্ডের সাথে ড্যাসন এবং টেইলহার্ড দ্যা শার্ডিন যৌথভাবে ফসিল সন্ধানে যান পিল্টডাউন গ্রামে। ওখান থেকে হাতির দাঁত, করোটির হাড়ের টুকরোসহ কিছু নমুনা উদ্ধার করেন তারা। এরপর আবার একটি করোটির ডানপার্শ্বের অংশ, চোয়ালের হাড় এবং সাথে কিছু পাথরের অস্ত্র পাওয়া গেছে বলে শোনা যায়। ১৯১২-এর নভেম্বর মাসে গার্ডিয়ান পত্রিকাসহ ইংল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পিল্টডাউন থেকে ফসিলের স্পেসিমেন উদ্ধার নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।২

একই বছর ডিসেম্বরের ৫ তারিখে সায়েন্স জার্নাল নেচার-এ ছোট করে খবরটি প্রকাশিত হয়। কিছুদিন পরে ডিসেম্বরের ১৮ তারিখে ইংল্যান্ডের ভূতাত্ত্বিক সমিতির সভায় চার্লস ড্যাসন এবং স্যার আর্থার স্মিথ উডওয়ার্ড ফসিলটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। ফসিলটির ডাক নাম হয়ে যায় ‘পিল্টডাউন ম্যান’। ফসিলটির নমুনা বলতে মূলত একটি খুলি, চোয়াল, দুটি পেষক দাঁত। পিল্ট ডাউনের এই বিখ্যাত (বলা যায় কুখ্যাত-ও) ফসিল উদ্ধারের সঠিক তারিখ সম্পর্কে আসলে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। বলা হয়ে থাকে ১৯১২ সালে পিল্টডাউন এলাকার এক নুড়ি পাথরের গর্ত থেকে এটি উদ্ধার হয়েছিল। আবার সন্দেহবাদীরা বলেন, এক বা দুই বছর পর কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেসিমেন (একাধিক হোমিনিডের খুলি, পূর্বের নমুনার মত দেখতে একাধিক দাঁত, যার নাম হয় পিল্টডাউন ম্যান-২) প্রকাশ করা হয়, যেগুলো চার্লস ড্যাসন ১৯১৫ সালের দিকে পিল্টডাউন এলাকার দুই মাইল দূর থেকে আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু কিউরেটর উডওয়ার্ড ১৯১৬ সালে চার্লস ড্যাসনের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এগুলোর আবিষ্কার সম্পর্কে পরিষ্কার কোন বর্ণনা দেন নি।৩

পিল্টডাউন ম্যান ফসিলের বিচ্ছিন্ন নমুনাগুলো উদ্ধারের পর অতি যত্নের সাথে পুনর্গঠন করেন ব্রিটিশ মিউজিয়ামের (বর্তমান নাম ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম) কিউরেটর স্যার আর্থার স্মিথ উডওয়ার্ড, সহকারী কিউরেটর মার্টিন এ. সি. হিন্টন (তিনি রাসায়নিক পরীক্ষা দ্বারা পিল্টডাউন ফসিলের বিভিন্ন নমুনার বয়স নির্ধারণ করেছিলেন), বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী ও অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ স্যার গ্র্যাফটন ইলিয়ট স্মিথ এবং স্যার আর্থার কিথসহ আরো কয়েকজন। পিল্টডাউনের খুলিটি দেখতে অনেকটা আধুনিক মানুষের মতো, এর করোটির আয়তন ১৪০০ সি. সি. (কিউবিক সেন্টিমিটার)। অর্থাৎ পুরোপুরি আধুনিক মানুষের (Homo sapiens) করোটির সমান। কিন্তু পিল্টডাউন থেকে উদ্ধার করা চোয়ালটি আধুনিক মানুষের মতো নয়। এমন কি যে দুইটা পেষক দাঁত পাওয়া গেছে, এগুলোও আধুনিক মানুষের দাঁতের মতো নয়। বরং এপদের দাঁতের সাথে মিল বেশি।

পূর্বে ১৮৯১ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে উদ্ধার করা ‘জাভা মানব’ (Homo erectus) বা বিশ্বের অন্যান্য স্থান থেকে পূর্বে যেসব হোমিনিডের জীবাশ্ম আবিষ্কার হয়েছে, তাদের মাথার চেয়ে চোয়াল ছিল অধিক বিকশিত, আর করোটির ধারণ ক্ষমতা ছিল কম বিকশিত। কিন্তু পিল্টডাউনের ফসিলটি ঠিক বিপরীত। করোটির ধারণক্ষমতা প্রায় আধুনিক মানুষের মত আর চোয়ালের বৈশিষ্ট্য অনেক অনুন্নত। দুইটি পেষক দাঁত শিম্পাঞ্জির দাঁতের মত এবং চোয়ালের দুই পাশ প্রায় সমান্তরাল। এসব বৈশিষ্ট্য অনেক আদিম। তাই এ ধরনের অদ্ভুত ফসিল আবিষ্কারে স্বাভাবিকভাবেই আবিষ্কারক দল খুবই উত্তেজনা বোধ করেন। তারা প্রচার করতে লাগলেন ‘এই প্রথম বড় মস্তিষ্কের এমন একটি মানুষের পূর্বপুরুষের (মিসিং লিংক) ফসিলের সন্ধান পাওয়া গেছে যা এতদিন ধরে নৃবিজ্ঞানীরা শুধু কল্পনাই করে আসছিলেন।’ বলা হতে লাগলো এটিই প্রথম ইংরেজ-মানব।

উডওয়ার্ড পিল্টডাউন ম্যানের বৈজ্ঞানিক নাম দিলেন Eoanthropus dawsoni। শেষের নামটি আবিষ্কারক চার্লস ড্যাসনের নামের সাথে মিলিয়ে রাখা। স্বাভাবিকভাবে খবরটি গোটা দুনিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, ‘বড় মস্তিষ্কের মানুষের পূর্বপুরুষের ফসিল পাওয়া গেছে, সম্ভাব্য প্লেইসটোসিন যুগের (Pleistocene epoch) এবং এরা ইংল্যান্ডেই বাস করতো।’ (ভূতাত্ত্বিক কালপঞ্জি অনুসারে প্লেইসটোসিন যুগের অবস্থান ২৫ লক্ষ থেকে ১২ হাজার বছর পূর্বে বর্তমান সময় হতে)।

চিত্র-১ : পিল্টডাউন ম্যান
চিত্র-১ : পিল্টডাউন ম্যান

এ ধরনের চটকদার খবরে সাধারণ মানুষসহ সেই সময়ের অনেক নৃবিজ্ঞানী কান দিলেও কেউ কেউ আবার এ ধরনের আবিষ্কারকে সন্দেহের চোখে দেখেন। ফসিলটির রহস্যময় বৈশিষ্ট্য নিয়ে তারা ভিন্নমত প্রকাশ করেন। ১৯২৩ সালের দিকে জার্মানির প্রখ্যাত অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ এবং নৃবিজ্ঞানী অধ্যাপক ফ্র্যান্জ উয়েইডেনরিখ (১৮৭৩-১৯৪৮) পিল্টডাউন ম্যান ফসিলের বর্ণনার সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন ফসিলটির মুখমণ্ডলের নিম্নাংশ বা চোয়াল (Jaw) খুব বেশি পরিমাণ এপসদৃশ, তাই এটি কোনো এপের চোয়াল হবে, মানুষের নয়। দুই বছর পর (১৯২৫) ব্রিটিশ ভূতাত্ত্বিক ফ্রেডরিক হ্যারিসন এডমান্ডস্ (১৮৯৮-১৯৬৫) একটি রিপোর্টে জানান, ‘যে নুড়িপাথরের গর্ত থেকে পিল্টডাউনের ফসিল উদ্ধার হয়েছে তার ভূস্তরের বয়স নির্ধারণের ডেটিং-এ ভুল আছে। ড্যাসন যেরকম দাবি করছেন এটি অনেক পুরাতন, মোটেই তা নয়। বরং এই ভূস্তর তুলনামূলক অনেক নবীন।’ সোয়ানকম্ব (Swancombe) জীবাশ্মের আবিষ্কারক এবং দন্তচিকিৎসাবিদ এলান টি. মারস্টন ফসিলটির দাঁতের গঠন দেখে বিশেষভাবে সন্দেহ প্রকাশ করেন।

কিন্তু এসব ভিন্নমত বা নেতিবাচক বক্তব্যকে সেই সময়কার ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীরা থোড়াই কেয়ার করলেন। ইংল্যান্ডের সাধারণ জনগণও এগুলোকে কানে তুলতে চাইলো না। তাদের দৃষ্টিতে ‘অচ্ছুৎ’ আফ্রিকা থেকে কত গুরুত্বপূর্ণ ফসিল উদ্ধার হচ্ছে একের পর এক; ইউরোপের ভিতরে জার্মানির ডুসেল নদীর পাশের নিয়েন্ডারথাল উপত্যকা থেকে ১৮৫৭ সালে Homo neanderthalensis ফসিল উদ্ধার হয়েছে এবং ১৯০৭ সালে হাইডেলবার্গ এলাকা থেকে উদ্ধার হয়েছে Homo heidelbergensis প্রজাতির ফসিল। দক্ষিণ ফ্রান্স থেকে ৩০ ত্রিশ হাজার বছরের পুরাতন ক্রো-ম্যাগননের (আধুনিক মানুষ) একাধিক ফসিল উদ্ধার হয়েছে ১৮৬৮ সালে। ক্রো-ম্যাগনন মানুষের গুহার দেয়ালে অঙ্কিত চিত্র, আদিম যুগের অস্ত্র, পোষাক, অলঙ্কার ইত্যাদি পাওয়া গেছে। ১৯০৮ সালে ফ্রান্সে পাওয়া গেছে নিয়েন্ডারথাল প্রজাতির ফসিল। ১৮৭৮ সালে স্পেনের অরিনাঁ গুহায় ক্রো-ম্যাগনন মানুষের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এশিয়া থেকে ১৮৯১ সালে উদ্ধার হয়েছে ‘জাভা মানব’ (Homo erectus)। ১৯২৩-২৭ এবং ১৯২৯-৩৭ সালের ভিতর চীন থেকে উদ্ধার হয়েছে হোমো ইরেক্টাস প্রজাতির (‘পিকিং মানব’ নামে পরিচিত) প্রচুর সংখ্যক ফসিল।

নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় অনেক এগিয়ে গেছে এসব দেশ, আর বিশ্বরাজনীতিতে নেতৃস্থানীয় রাষ্ট্র ইংল্যান্ড এতদিন ফসিল আবিষ্কার থেকে বঞ্চিত। এটা কি সম্ভব ইংল্যান্ডে মানুষের বিবর্তন হয় নি? ইংরেজরা কি তাহলে শুধুমাত্র সামান্য কিছু বছর আগে বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আসা অভিবাসী লোকদের কলোনি? এসব প্রশ্নও সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের মধ্যে ঘোরাঘুরি করতো। তাই এবারে মানুষের পূর্বপুরুষের কথিত এই গুরুত্বপূর্ণ ফসিল উদ্ধার ব্রিটিশদের মনে বিরাট গর্বের অনুভূতি সৃষ্টি করে। ব্রিটিশ মিডিয়ার বৃহৎ প্রচারণায় চারিদিকে জয়জয়কার। এভাবে নৃবিজ্ঞানের জগতে একসময় পিল্টডাউন ম্যান গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নেয় কয়েক দশকের জন্য হলেও।

১৯২৭ সালে নৃবিজ্ঞানী গ্র্যাফটন ইলিয়ট স্মিথ পিল্টডাউন ম্যান ফসিলের উপর ভিত্তি করে ‘The Evolution of Man’ গ্রন্থে মানব-বিবর্তনের ধারা তুলে ধরেন অনেকটা এভাবে : বড় মস্তিষ্কের বিকাশ–)সোজা হয়ে দুই পায়ে হাঁটতে পারা (দ্বিপদী) –)হাতিয়ার, অস্ত্র ইত্যাদির ব্যবহার।৪

(পরবর্তীতে অবশ্য অনেকগুলো হোমিনিড যেমন অস্ট্রেলোপিথেকাস গণ কিংবা আর্ডিপিথেকাস গণের একাধিক প্রজাতির ফসিল উদ্ধারের পর বেশিরভাগ নৃবিজ্ঞানী-প্রত্নজীববিজ্ঞানী এখন মনে করেন, ‘বড় মস্তিষ্ক’ নয়, বরং দুই পায়ের উপর খাঁড়া হয়ে হাঁটতে পারার মতা হোমিনিডদের মধ্যে আগে বিকশিত হয়েছিল।)

পিল্টডাউন ফসিল আবিষ্কারের এক দশক পর নতুন আরেকটি ফসিল আবিষ্কার ঘটে ১৯২৪ সালে, ইংল্যান্ড থেকে হাজার খানেক মাইল দূরে, দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানকার টাউং গ্রামের পাশের একটি চুনাপাথরের কুয়োরি থেকে। খনিতে কাজ করতে গিয়ে একজন কুয়োরি শ্রমিক হঠাৎ করেই একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ খুলি, একাধিক দাঁত এবং কিছু হাড়গোড় পায়। পরে এগুলোকে পরীক্ষার জন্য জোহানেসবার্গের উইটওয়াটারস্রেন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল স্কুলের তরুণ অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ এবং স্নায়ুবিজ্ঞানী রেমন্ড ডার্টের (১৮৯৩-১৯৮৮) কাছে পাঠানো হয়। রেমন্ড ডার্ট মানব-বিবর্তন নিয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী ব্যক্তি। তিনি জানতেন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বেশ কয়েক মিলিয়ন বছর আগে এপরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আফ্রিকার যে অঞ্চলে এখন এপ আছে তার দূরত্ব (ডার্টের অবস্থান থেকে) প্রায় দুই হাজার মাইল। তাই মানুষ বা হোমিনিডের কোনো জীবাশ্ম দক্ষিণ আফ্রিকাতে পাওয়া যাবে এমন আশা করেন নি কখনো। তবে আফ্রিকা মহাদেশে কখন, কেন এবং কিভাবে মানুষের বিবর্তন ঘটেছে সে সম্পর্কে জানতে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন।

রেমন্ড ডার্টের কাছে আসা ফসিলের নমুনা মানে করোটির ছাঁচ (জমাট চুনাপাথরের মধ্যে করোটির ছাপ পড়ে আছে) যার মধ্যে শিরা-উপশিরাসহ মগজের ভাঁজগুলো খুব স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। ডার্ট ভাবলেন এটা বোধহয় কোন বেবুনের ফসিল হবে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জীবাশ্মবিদ না হলেও এবং তার কাছে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না থাকলেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রায় ৭৩ দিন ধরে করোটির হাড়, চোয়াল এবং দাঁতে লেগে থাকা চুনাপাথরের টুকরো পরিষ্কার করে চললেন। পরিষ্কারের কাজ শেষে ডার্ট বুঝতে পারলেন এটি কোন বেবুনের ফসিল নয়। এটি একটি শিশুর মাথার খুলি। খুলিটিতে ছোট এবং চ্যাপ্টা ছেদক দন্ত রয়েছে। মানুষের মতই এই করোটির ফোরেমেন ম্যাগনামের অবস্থান খুলির নিচের দিকে, যা নির্দেশ করে এটি সোজা হয়ে দুই পায়ে হাঁটতে পারতো।

ডার্ট বুঝতে পারলেন, এটি অত্যন্ত গুরুত্ব ফসিল যা থেকে ডারউইনের বক্তব্যের সঠিকতা প্রমাণ করে–‘মানুষের আদি পূর্বপুরুষ আফ্রিকাতেই ছিল।’ ডার্ট ১৯২৫ সালে বিশ্বের প্রথম সারির বিজ্ঞান জার্নাল নেচার-এ টাউং শিশুর ফসিলের কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “এটি কোনো আধুনিক মানুষের ফসিল নয়। এবং পুরোপুরি আধুনিক যুগের এপ নয়। এটি বর্তমানে জীবিত এনথ্রোপয়েড এবং মানুষের মধ্যবর্তী বিলুপ্ত জাতের এপ হবে।” ডার্ট ফসিলটিকে আমাদের Homo জিনাসের (গণ) পূর্বের আরেকটি জিনাস Australopithecus-এর অন্তর্গত স্বতন্ত্র প্রজাতিরূপে শ্রেণীবিন্যাস করেন, ‘Australopithecus africanus’। বাংলায় যাকে বলে ‘আফ্রিকার দক্ষিণের এপ’। ফসিলটির ডাক নাম হয়ে গেলে টাউং শিশু।

বর্তমান সময়ের প্রত্নস্নায়ুবিজ্ঞানী ডিন ফক টাউং শিশু গবেষণা করে জানিয়েছেন টাউং শিশুর মস্তিষ্ক যতটুকু না মানব-সদৃশ তার থেকে বেশি এপ-সদৃশ। বয়স ডেটিং করে জানা গেছে এটি আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগের (ঊর্ধ্বস্থ প্লিওসিন যুগের) এবং করোটির ধারণ ক্ষমতা (৩৪০ সি. সি.) দেখে বোঝা যায় এপের মত এর ছোট মস্তিষ্ক, যা পিল্টডাউন ফসিলের মস্তিষ্কের তিন ভাগের একভাগ হবে। (১৯২৪ সালের টাউং শিশুর খুলিটি বিশ্বের প্রথম উদ্ধার করা অস্ট্রেলোপিথেসাইনদের মাথার খুলি।)


চিত্র-২ : রেমন্ড ডার্ট এবং তাঁর টাউং শিশু

আধুনিক মানুষের জনগোষ্ঠীর সাথে টাউং শিশুর দাঁতের গঠন ও বৃদ্ধির তুলনা থেকে বুঝা গেল মৃত্যুকালে এর বয়স ছিল প্রায় ছয় বছর। পরবর্তীতে একাধিক উন্নত বৈজ্ঞানিক গবেষণা, যেমন ত্রিমাত্রিক কম্পিউটার ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে টাউং শিশুর মাড়িতে দাঁতের অবস্থান এবং কিছু অপ্রকাশিত শারীরিক বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে টাউং শিশুর দাঁতের বৃদ্ধি পূর্বের থেকে সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ফসিলটির দাঁতের অবস্থান এবং বৃদ্ধি মানুষের চেয়ে এপের সাথে সাদৃশ্য বেশি; এবং পূর্বে যা জানা গিয়েছিল, মৃত্যুকালে টাউং শিশুর বয়স ছিল তার থেকে আরো কম। মাত্র তিন থেকে চার বছর হবে।৫

উল্লেখ্য, ২০০৬ সালের প্রথম দিকে সংবাদসংস্থা বিবিসি জানায়, টাউং শিশুর খুলি এবং চুগহ্বরে আঘাতের চিহ্ন দেখে ফসিলবিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন এ শিশুটি ঈগল কিংবা এই ধরনের বড় কোনো শিকারী পাখির আক্রমণে মারা গেছে।

যাহোক, রেমন্ড ডার্টের এ অভূতপূর্ব আবিষ্কার সময় মত আসে নি। ডার্টের টাউং শিশু বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলে গৃহীত হয়েছিল আদি মানুষের বিবর্তনের ‘জটিল নমুনা’ হিসেবে। মানুষের পূর্বপুরুষ হিসেবে এটি স্বীকৃতি পায়নি তখন। দীর্ঘ ৩০টি বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল রেমন্ড ডার্টকে স্বীকৃতি পাবার জন্য। ‘নিছক’ আরেকটি এপের ফসিল হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন তৎকালীন বিজ্ঞানীরা। রেমন্ড ডার্টের প্রতি এই বঞ্চনার কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে : ডার্টের কাছে তখন আবিষ্কৃত জীবাশ্মের নমুনা ছিল মাত্র একটি। জীবাশ্মটির ঊরুর হাড় (ফিমার) বা শ্রোণীচক্র পাওয়া যায় নি, তাই (সমালোচকদের মত ছিল) শুধুমাত্র করোটির ফোরেমেন ম্যাগনামের অবস্থান থেকে নির্ভরযোগ্যতার সাথে বলা যাবে না, প্রাণীটি সোজা হয়ে হাঁটতে পারতো কিনা? রেমন্ড ডার্টের কাছে ঐ সময় এগুলোর কোনো জবাব ছিল না।

তাছাড়া বিজ্ঞানী গোষ্ঠীর এক বড় অংশের দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ ছিল ‘পিল্টডাউন’ নামক তথাকথিত মানুষের পূর্বপুরুষের ফসিলের ওপর। আরেক অংশের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এশিয়ার ওপর। আর্নেস্ট হেকেল যেমনটা মনে করেছিলেন ‘এশিয়ার গ্রেট এপের (বিশেষ করে ওরাংউটাং) সাথে মানুষের দৈহিক গঠনের অভূতপূর্ব মিল রয়েছে, আফ্রিকার গ্রেট এপদের চেয়ে। সুতরাং আফ্রিকা নয়, বরং এশিয়াই হবে হোমিনিডদের পূর্বপুরুষের জন্মভূমি।’ (উল্লেখ্য গ্রেট এপের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা, ওরাংউটাং। গিবন এপের অন্তর্ভুক্ত হলেও গ্রেট এপের সদস্য না।)

হেকেল ছাড়াও এশিয়াতেই মানুষের উদ্ভব ঘটেছে, এখানেই মানুষের পূর্বপুরুষের ফসিল পাওয়া যেতে পারে–এমন ভাবনায় তখন অনেকেই আচ্ছন্ন ছিলেন। তাই সেসময় রেমন্ড ডার্ট যতই তার এই আবিষ্কার নিয়ে বিজ্ঞানীদের নজর কাড়ার চেষ্টা করেন, ততই টাউং শিশুর ‘ছোট এই করোটিখানি এপদের করোটির সাথে খুবই সাদৃশ্যপূর্ণ, তাই এটি এপই হবে’–সমালোচকরা সহজেই এই ধরনের দাবি তুলে ডার্টের উৎসাহে পানি ঢেলে দেন। আসলে মানুষের বিবর্তন সম্পর্কে যে ধরনের ভাবনা তখন নৃবিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত ছিল তার সাথে পিল্টডাউন ফসিল যথেষ্ট খাপ খেয়ে গিয়েছিল।

গল্পটি বোধহয় এখানেই শেষ হয়ে যেত, যদি না এটি বিজ্ঞান হত। বিজ্ঞান নিজে স্বতঃসংশোধনশীল প্রক্রিয়া। সংশয়, সন্দেহ, যুক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ, গবেষণা বিজ্ঞানের প্রাণশক্তি। এরপরও বলতে হয় এক বা একাধিক বিজ্ঞানীর ভুল হতে পারে, ভুল করতে পারেন। ধর্মচেতনা, বর্ণবাদ, জাত্যাভিমানসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা প্রভাবিত হতে পারেন। বিজ্ঞানীরা তো সমাজবিচ্ছিন্ন কেউ নন। তবু এক বা একাধিক বিজ্ঞানী ভুল করলেও সারা বিশ্বে হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ যুক্তিমনস্ক বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা সংশয়বাদিতার আলো জ্বেলে রেখে বিজ্ঞান গবেষণাকে এগিয়ে নিয়ে যান। বিজ্ঞান যতই দেরি হোক, যতই প্রতিষ্ঠিত মতামত বা তত্ত্ব হোক না কেন, ভুল ধরা পড়লে স্বীকার করে নিয়ে নিজেকে শুধরে ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করে না। পিল্টডাউনের ঘটনাবলী বিজ্ঞানের এই স্বতঃসংশোধনশীল প্রক্রিয়াকে আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় রেমন্ড ডার্ট এবং তার সহযোগীরা দক্ষিণ আফ্রিকার আলাদা আলাদা স্থান থেকে অস্ট্রেলোপিথেসাইনের বেশ কিছু ফসিল উদ্ধার করেন : প্রথমে স্টার্কফন্টেইন থেকে, কিছুকাল পরে ক্রোমডুরাই, সোয়ার্টক্রান্স এবং মাকাপংসাট এলাকা থেকে। ফসিল আবিষ্কারের জন্য সবচেয়ে প্রখ্যাত অঞ্চল হচ্ছে জোহানেসবার্গের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত স্টার্কফন্টেইন অঞ্চল। এখানে অসংখ্য চুনাপাথরের গুহা আছে। গত কয়েক দশক ধরে এসব গুহা থেকে হোমিনিডের প্রচুর সংখ্যক ফসিল উদ্ধার হয়েছে, যেমন অস্ট্রেলোপিথেকাস, হোমো, প্যারানথ্রোপাস গণের ফসিল। তাই এই জায়গাকে নৃবিজ্ঞানীরা ‘মানব জাতির দোলনা’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০০০ সালে ইউনেস্কো এ অঞ্চলকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবেও ঘোষণা করেছে।

১৯৪৭ সালে উইটওয়াটারস্রেন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রবার্ট ব্রুম এবং জন টি. রবিনসন স্টার্কফন্টেইন থেকে পূর্ণবয়স্ক একজন নারীর করোটি উদ্ধার করেন। এর মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা ৪৫০ সি. সি.। সাথে পাওয়া যায় প্রায় সম্পূর্ণ মেরুদণ্ড, ঊরুর হাড়, পাজরের হাড়, শ্রোণী। এমনিতে আমরা জানি ভূস্তরে জীবাশ্মায়নের ঘটনা অনেক দুর্লভ। তবু বিভিন্ন সময় হোমিনিডসহ বিভিন্ন প্রজাতির বেশ কিছু পূর্ণাঙ্গ ফসিল উদ্ধার হয়েছে যা খুব ভালোভাবেই সংরক্ষিত ছিল। যেমন ব্রুম এবং রবিনসনের উদ্ধার করা ফসিলটি। উদ্ধারকারীরা প্রাথমিকভাবে ফসিলটির নাম দেন ‘Plesianthropus transvaalensis’ এবং ডাক নাম দেয়া হয় ‘মিসেস প্লেস’। ডাক নামেই এখন সে বিখ্যাত।

পরবর্তীতে অবশ্য ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখা গেছে মিসেস প্লেস আলাদা কোনো জিনাস বা গণের স্বতন্ত্র প্রজাতি নয়, এটি Australopithecus africanus প্রজাতির সদস্য। বয়স ডেটিং করে দেখা গেল এটি প্রায় ২.৩ থেকে ২.৮ মিলিয়ন বছরের পুরাতন। অর্থাৎ এটিও ঊর্ধ্বস্থ প্লিওসিন যুগের। উদ্ধার হওয়া প্লেসের প্রায় সম্পূর্ণ কঙ্কাল থেকে খুব পরিষ্কার এবং অবিতর্কিতভাবে প্রমাণ করে এটি ছিল দ্বিপদী। প্লেসের ঊরুর হাড় আধুনিক মানুষের মত অনেকাংশেই, মানুষের মত এর ফোরেমেন ম্যাগনামের অবস্থান ছিল খুলির নিচের দিকে (অর্থাৎ এটি ছিল দ্বিপদী)। ফসিলের নমুনায় দেহের বিভিন্ন অংশ এত পূর্ণাঙ্গভাবে রক্ষিত ছিল যা পুনর্গঠিত ‘Eoanthropus dawsoni’ পিল্টডাউন ফসিলেও পাওয়া যায়নি।

১৯৫০-এর শুরুর দিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এত বেশি হোমিনিড ফসিল উদ্ধার পেতে লাগলো, অবশেষে প্রখ্যাত ব্রিটিশ অ্যানাটমি (অঙ্গব্যবচ্ছেদ) বিশেষজ্ঞ স্যার উইলফ্রেড ল্যা গ্রোস ক্লার্ক (১৮৯৫-১৯৭১) জোরালো কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন রেমন্ড ডার্টই সঠিক–পিল্টডাউন নয়, Australopithecus africanus মানুষের আদি পূর্বপুরুষ।

ক্লার্কের এ বক্তব্যে সবাই যেন চমকে উঠলো। প্রশ্ন দেখা দিল Australopithecus africanus-ই যদি মানুষের আদি পূর্বপুরুষ হয়, পিল্টডাউন ফসিলটা তাহলে কিসের বা কাদের? সারা বিশ্বের নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হল। পিল্টডাউন ফসিলের সঠিকতা নিয়ে বিভিন্ন নৃবিজ্ঞান সংগঠন ও কর্তৃপ প্রশ্ন তুলতে লাগলেন, যা গত ত্রিশ বছর আগে ভিন্নমতের নৃবিজ্ঞানীরা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। ইতোমধ্যে (চল্লিশের দশকের শুরুর দিকে) রসায়নবিদ কেন্থ ওকলি ফোরিনের পরিমাণ মেপে জীবাশ্মের বয়স নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম পিল্টডাউন ফসিলের সঠিকতা নিয়ে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার আয়োজন করে ১৯৪৯ সালের দিকে।


চিত্র-৩: জোড়াতালি দিয়ে বানানো পিল্টডাউনের ফসিল।

পরীক্ষার আয়োজন যতটা চমকপ্রদ ছিল তার থেকে ঢের বেশি চমকপ্রদ ছিল পরীক্ষার ফলাফল : পেষক দাঁত এবং চোয়ালের হাড় পিল্টডাউনের খুলিতে কৃত্রিমভাবে সংযোজিত করা হয়েছে। ফোরিন টেস্টে ধরা পড়ল করোটি এবং মুখমণ্ডলের নিচের চোয়ালটি সম্পূর্ণ আলাদা, দুইটি অংশের মধ্যে বয়সের পার্থক্যও আছে; এবং ছেদক দাঁতগুলিও ভিন্ন ধরনের। পিল্টডাউন ফসিলটি পৃথক তিনটি প্রজাতির হাড়ের মিশ্রণে বানানো হয়েছে, করোটি ছিল মধ্যযুগের এক ৪০ বছর বয়সী মানুষের, চোয়াল ছিল প্রায় পাঁচশত বছরের পুরাতন এক ওরাংউটাঙের (সংগ্রহ করা হয়েছিল তিউনিসিয়া থেকে) আর দাঁতগুলো ছিল শিম্পাঞ্জির। রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে খুলি, চোয়াল এবং দাঁত ঘষে, রঙ করে পুরানো চেহারা দেয়া হয়েছে।৬ ১৯৫৩ সালের ৩০ নভেম্বর টাইম ম্যাগাজিনে স্যার উইলফ্রেড ল্যা গ্রোস ক্লার্ক, জোসেফ উইনার এবং রসায়নবিদ কেন্থ ওকলি যৌথভাবে লিখিত প্রবন্ধে পিল্টডাউন ম্যানের সব ভাঁওতাবাজি ফাঁস করেন এবং এর মাধ্যমে প্রায় চল্লিশ বছরের সকল নাটকের যবনিকাপাত ঘটে।

এক বা একাধিক ব্যক্তি বিভিন্ন হাড় ইচ্ছেকৃতভাবে সংযোজন করে পিল্টডাউন ফসিল বানিয়েছিলেন। কারা এই জোচ্চুরির সঙ্গে জড়িত তা পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া না গেলেও সন্দেহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন চার্লস ড্যাসন, ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রাণীবিজ্ঞানের কিউরেটর মার্টিন এ. সি. হিন্টন (তিনি স্যার আর্থার উডওয়ার্ডের অধীনে কাজ করতেন), ফরাসি প্রত্নজীববিজ্ঞানী পিয়ের টেউলহার্ড দ্যা শার্ডিনসহ আরো কয়েকজন। বলা হয়ে থাকে, স্যার আর্থার উডওয়ার্ডকে বোকা বানানো হয়েছিল কোনো না কোনোভাবে। এমন কি বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের স্রষ্টা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের নামও শোনা যায় জড়িতদের সাথে।

পিল্টডাউন রহস্য ফাঁস হওয়ার অনেক বছর পর জানা যায় নতুন কিছু তথ্য। ১৯৯৬ সালের ২৩ মে প্রকাশিত ব্রিটিশ সায়েন্স জার্নাল নেচার-এর এক প্রতিবেদনে ইংল্যান্ডের কিংস কলেজের প্রত্নজীববিজ্ঞানী ব্রায়ান গার্ডিনার বলেন পিল্টডাউন ঘটনার মূল নায়ক হিসেবে তিনি সন্দেহ করেন মার্টিন হিন্টনকে। মার্টিন হিন্টন তার বেতন-ভাতার দাবি নিয়ে তার বস আর্থার উডওয়ার্ডের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তাই লোকসম্মুখে লজ্জা দিয়ে বা বোকা বানিয়ে তিনি প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। (হয়তো এত দীর্ঘসময় ধরে পিল্টডাউনের জোচ্চুরি টিকে থাকবে সেটাও মনে হয় হিন্টন বুঝতে পারেন নি)। আর এ ব্যাপারে জেনে-ই হোক বা না জেনে হোক ফসিল আবিষ্কারের তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে চার্লস ড্যাসন বোকার মত হিন্টনকে সহায়তা করে গেছেন।

গার্ডিনার আরো বলেন ১৯৭০-এর মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের চিলেকোটা পরিষ্কার করতে গিয়ে একটি ট্রাঙ্ক উদ্ধার হয়। ধারণা করা হয় ট্রাঙ্কটি মার্টিন হিন্টনের ছিল। তিনি মারা যান ১৯৬১ সালে। ট্রাঙ্কের মধ্যে রাখা শতাধিক শিশিতে ইঁদুরের মত দেখতে তীক্ষ্ণদন্তের প্রাণী রৌড্ন্টের (rodent) ব্যবচ্ছেদ করা টুকরো পাওয়া যায়। মার্টিন হিন্টন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রৌড্ন্ট-বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ট্রাঙ্কটিতে আরো পাওয়া যায় হাতির দাঁত, জলহস্তীর ফসিল এবং বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর হাড়গোড় যেগুলো আয়রন, ম্যাংগানিজ এবং ক্রোমিয়ামের মিশ্রণ দিয়ে ঘষে মেজে রঙ পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে; পুরানো চেহারা দেয়া হয়েছে যেমনটা করা হয়েছিল পিল্টডাউন ফসিলের বেলায়।

পিল্টডাউন ম্যান ফসিল আজ ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে পতিত। বিজ্ঞানের খাতা থেকেও এর নাম বাতিল। মানব-বিবর্তনের ফসিল রেকর্ডে তার কোনো অবস্থান নেই। বিজ্ঞান জগতের জালিয়াতি, ভাঁওতাবাজি বা জোচ্চুরি ছাড়া, বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো একাডেমিক আলোচনাতে বা পাঠ্যচর্চায় পিল্টডাউন ম্যানের নাম তেমন একটা উচ্চারিত হয় না। উল্লেখ্য, পিল্টডাউনের দীর্ঘদিনের জালিয়াতি উন্মোচন করেন বিজ্ঞানীরাই, কোনো ক্রিয়েশনিস্ট বা অন্য কেউ নন। এমন কি পিল্টডাউন ফসিল উদ্ধারের প্রথম দিক থেকে যারা সন্দেহ পোষণ করছিলেন, সমালোচনা করেছিলেন, ভুল ধরিয়ে দিয়েছিলেন তারাও ছিলেন বিজ্ঞানী। নেতৃস্থানীয় অনেক বিজ্ঞানীরা পিল্টডাউনের জালিয়াতি ধরতে না পারলেও সন্দেহ পোষণকারী বিজ্ঞানীরা সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত দেখে বিনা প্রশ্নে বিশ্বাস করে নেন নি; বা চুপ থাকেন নি। তাদের সন্দেহের কথা প্রকাশ করেছিলেন স্বাভাবিকভাবেই। এখানেই বিজ্ঞানের স্বাতন্ত্র্য। এমন কি, সবশেষে যে বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে পিল্টডাউনের রহস্য উদ্ঘাটিত হয় তা পরিকল্পনা-পরিচালনা করেন বিজ্ঞানীরাই।

অতঃপর ঘটে রেমন্ড ডার্ট এবং তার টাউং শিশুর নৃবিজ্ঞানের জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ। পিল্টডাউন ম্যানকে হটিয়ে দিয়ে মানব বিবর্তনের ফসিল রেকর্ডে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নেয় টাউং শিশু। গত ২০০০ সালে বিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা Science ঘোষণা করে ‘বিংশ শতাব্দীতে শ্বাসরুদ্ধকর ২০টি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে রেমন্ড ডার্টের টাউং শিশু আবিষ্কারও একটি; যা গোটা মানবজাতির জীবনে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।’

পিল্টডাউন নিয়ে অনেক বিভ্রান্তকর ভুল তথ্য বিভিন্ন সময় ছড়িয়েছে। এরকম একটি হচ্ছে : “এটি এত বড় মাপের একটি আবিষ্কার ছিল যে পরবর্তী ৪০ বছর পর্যন্ত ৫০০ টিরও বেশি ডক্টরেট থিসিস পেপার লেখা হয়েছে এর উপরে।” পিল্টডাউন মানব ফসিলের উপর সম্ভবত একটিও ডক্টরেট বা পিএইচ.ডি থিসিস পেপার লেখা হয় নি। যতদূর জানা যায় ১৯৫৪ সালে ব্রিটিশ জার্নাল নেচার-এর সম্পাদকীয়ের একটি ভুল ব্যাখ্যা থেকে এই ভুল প্রচারণার সূত্রপাত। পিল্টডাউন ফসিলের জোচ্চুরি ধরা পড়ার পর নেচার “The Piltdown bones and ‘implements’” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে এরকম একটা মন্তব্য ছিল : ‘ইতোমধ্যে এই ফসিল আবিষ্কারের কাহিনী আর বর্ণনা নিয়ে প্রায় পাঁচশতটির মতো প্রবন্ধ ও স্মৃতিকথা লেখা হয়েছে।” (দ্রষ্টব্য : Nature 274 (4419): 61-62)।

পিল্টডাউন ভাঁওতাবাজি উন্মোচনের পর গত অর্ধশতাব্দীকালেরও বেশি সময় হতে অসংখ্য হোমিনিড ফসিল উদ্ধার হয়েছে। এ-সময়কালের মধ্যে জিনেটিক্স-জিনোমিক্সের অভূতপূর্ব অগ্রগতিতে বিভিন্ন জীবের জিনোম সিকুয়েন্সের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে। জীবিত প্রাইমেটদের অ্যানাটমির সাথে মানুষের অ্যানাটমির তুলনামূলক পরীণের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভব এবং বিবর্তন ধারা বিষয়ে জীববিজ্ঞানীরা প্রচুর তথ্য-উপাত্ত জানতে পেরেছেন। পূর্বের সংগৃহীত তথ্যগুলোকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাচ্ছেন। ডারউইন বা তার পরবর্তী বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মত মানব-বিবর্তন ধারা এখন আর এতটা ‘ঝাপসা’ নয়, বরং অনেকখানি স্পষ্ট। তবে এটাও সত্য জীবজগতের জটিল এই বিবর্তন ধারা সম্পর্কে অনেক কিছুই জানার বাকি আছে এখনও। যাহোক, সত্য কেবল জানা যেতে পারে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান, গবেষণা, বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে। বিজ্ঞানে রয়েছে স্বতঃসংশোধনশীল প্রক্রিয়া। আর পিল্টডাউন ঘটনাবলী থেকে এ বিষয়টিই আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।৭

তথ্যনির্দেশিকা
1. Barbach, J. and Byron, C. Cultural Biases Reflected in the Hominid Fossil Record, ArchaeologyInfo.com webpage, http://archaeologyinfo.com/perspectives-2
2. Russell, M. Piltdown Man: Case Closed, Bournemouth University webpage, http://www.bournemouth.ac.uk/caah/landscapeandtownscapearchaeology/piltdown_man_a.html
3. Ruse, M. 2002. The Evolution Wars: A Guide to the Debates. New Jersey: Rutgers University Press. p 179
4. Shermer, M. 2002. The Borderlands of Science: Where Sense Meets Nonsense. USA: Oxford University Press. pp 307-19
5. Larsen, C. S., R. M. Matter and D. L. Gebo. 1998. Human Origin: The Fossil Record. USA: Waveland Press, Inc. p 59
6. Pallen, M. 2009. The Rough Guide to Evolution. London: Rough Guides Ltd. p 189
7. Larsen, C. S. 2008. Our Origin: Discovering Physical Anthropology. New York: W. W. Norton & Company. pp 274-75

[বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকার : পিল্টডাউন ম্যান সম্পর্কিত এ রচনায় উল্লেখযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ক্লার্ক স্পেনসার লারসেনের লেখা Our Origin: Discovering Physical Anthropology গ্রন্থ থেকে। অধ্যাপক লারসেন এ বিষয়ে সবিশেষ অনুমতি প্রদান করায় তাঁর প্রতি জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।]