বিবর্তনকে উদ্দেশ্য করে সৃষ্টিবাদীদের করা সবচেয়ে প্রচারিত সন্দেহ, বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব, এর কোনো বাস্তবতা নেই [১]। প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে জেনে নেই তত্ত্বের সংজ্ঞা কী।
প্রচলিত অর্থে তত্ত্ব (Theory) বলতে আমরা যা বুঝি তা থেকে তত্ত্বের বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা সম্পূর্ণ আলাদা। তত্ত্বের ইংরেজি শব্দ থিওরির দুইটি অর্থ। প্রচলিত অর্থে, থিওরি বলতে অবাস্তব অনুমান বোঝানো হয়। যেমনঃ ঠিক কোন কাজটা করলে আমাদের বাংলাদেশ সোনার বাংলাদেশ হয়ে উঠবে সে ব্যাপারে আমাদের অনেকেরেই কোনো না কোনো থিওরি আছে। অপরদিকে বিজ্ঞানে থিওরি বা তত্ত্ব শব্দটি একেবারে ভিন্ন অর্থ বহন করে। আমেরিকার জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদের মতে, ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হল প্রাকৃতিক কোনো ঘটনা বা বাস্তবতার (phenomenon) প্রতিপাদিত ব্যাখ্যা। তত্ত্ব, প্রাকৃতিক বাস্তবতাকে যৌক্তিকভাবে বর্ণনা করার সমীকরণ [২] ।’ দেখা যাচ্ছে, বিবর্তন শুধুই একটি তত্ত্ব প্রশ্নটিতে- খুব সুচারূভাবে বিজ্ঞানের তত্ত্ব শব্দটির অর্থকে বদলে ফেলা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবর্তন একটি তত্ত্ব হতে পারে, কিন্তু কখনই ‘শুধুই একটি তত্ত্ব’ এ অর্থে না।
বিজ্ঞানীরা মূলতঃ বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্যই তত্ত্ব দাঁড় করান। কোনো পর্যবেক্ষণ যখন বারংবার বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় তখন তাকে আমরা বাস্তবতা বা সত্য (fact) বলে ধরে নেই। আর তত্ত্ব হচ্ছে সেই বাস্তবতাটি কিভাবে ঘটছে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা। গাছ থেকে আপেল পড়ার ব্যাপারটাই ধরি। গাছ থেকে যে আপেল মাটিতে পড়ছে তা বাস্তবতা। আর যে তত্ত্বের সাহায্যে এই বাস্তবতার ব্যাখ্যা দেয়া হয় তাকে আমরা বলি মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব। বিবর্তনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। জীবজগৎ স্থির নয়, তাদের বিবর্তন ঘটছে, এই বাস্তবতাটি বিগত দেড়শ বছর ধরে হাজারো পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বহু রকমভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আর যে তত্ত্বের মাধ্যমে এই বাস্তবতাটি ব্যাখ্যা করা হয় তার নামকরণ করা হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব [৩],[৪],[৫]।
বিবর্তন যে বাস্তব সেটা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। প্রাণের বিবর্তন ঘটছে। কোন প্রজাতি স্বতন্ত্রভাবে ‘সৃষ্টি’ করা হয়নি, বরঞ্চ প্রাণের উদ্ভবের পর থেকে প্রতিনিয়ত পরিবেশের বিভিন্ন প্রভাবের কারণে এক প্রজাতি বিবর্তিত হয়ে অন্য প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। নর বানরেরা রাতে ঘুমালো, সকালে উঠে দেখলো তারা সবাই আধুনিক মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গেছে- এমন নয়, বরং এটি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের ফসল। প্রজাতি এক রূপ থেকে আরেক রূপে বিবর্তিত হতে পারে না, এটা এই যুগে এসে মনে করাটা বোকামি, যখন দেখা যায়, জাপানি কৃষকেরা গোল তরমুজকে চারকোণা করে ফেলেছে। কবুতর, কুকুরের ব্রিডিং সম্পর্কেও আমরা সবাই অবগত। মাত্র কয়েক প্রজন্মেই এক প্রজাতির কুকুর থেকে যেখানে আরেক প্রজাতির উদ্ভব হয়, সেখানে পরিবেশ পেয়েছে লক্ষ- কোটি বছর। বিবর্তন যে বাস্তব এই প্রমাণ দেখতে আগ্রহীদের জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফি চ্যানেলের নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র ‘ওয়াজ ডারউইন রং [৬] , চ্যানেল ফোরের ‘জিনিয়াস অফ চার্লস ডারউইন [৭]’ , অথবা রিচার্ড ডকিন্সের লেখা ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’, জেরি কোয়েন এর “হোয়াই ইভোলিউশন ইজ ট্রু” -এর মতো বইগুলো সহায়ক হতে পারে। সংক্ষিপ্ত ধারণার জন্য দেখুন মুক্তমনা বিবর্তন আর্কাইভের “বিবর্তনের পক্ষে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি”– ভুক্তিটি দেখা যেতে পারে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বিবর্তন ঘটে। পাহাড় সমান সাক্ষ্য প্রমাণ [৮] , ফসিল কিংবা ডিএনএ -র আবিষ্কার প্রমাণ করে,এটা বাস্তব [৯]। আমরা জানি, পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান ব্যাখ্যা করার জন্যই প্রয়োজন হয় বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের। যেমনঃ আমরা উপরে দেখেছি গাছ থেকে আপেল পড়ে, এটি একটি বাস্তবতা, একে ব্যাখ্যা করা হয় নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্ব দ্বারা। তত্ত্ব কোনও সাধারণ বাক্য নয়, বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্য বিজ্ঞানীরা প্রথমে একটি হাইপোথিসিস বা অনুকল্প দাঁড় করান। পরবর্তীকালে এই অনুমিত তত্ত্বটি পর্যবেক্ষণলব্ধ জ্ঞান ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক সূত্রের মাধ্যমে বার বার যাচাই করা হয়। যদি সব আঘাত থেকে যুক্তিযুক্তভাবে একটি অনুকল্প বেঁচে ফিরতে পারে এবং যখন প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সকল প্রমাণ একে সমর্থন করে তখন একে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব উপাধি দেওয়া হয়। বিবর্তন যে তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়, তার নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটা বিবর্তন তত্ত্ব’[১০]।
প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব নিয়ে ডারউইন একদিকে যেমন নিঃসংশয় ছিলেন অপরদিকে ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ লক্ষ- কোটি প্রজাতির মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট একটি প্রজাতির এই তত্ত্বের বাইরে উদ্ভব হওয়া এই তত্ত্বটি বাতিল করে দিতে যথেষ্ট। দীর্ঘ বিশ বছর বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহের পর ডারউইন ১৮৫৯ সালে তত্ত্বটি প্রকাশ করেন [১১]। তারপর গত দেড়শ বছর ধরে বিভিন্নভাবে বিবর্তন তত্ত্বকে নানাভাবে পরীক্ষা করা হয়েছে,এটি কখনোই ভুল প্রমাণিত হয়নি।
তত্ত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থাকে, এর মাধ্যমে আমরা সঠিকভাবে বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। বিবর্তন তত্ত্ব সুচারুভাবে এই দায়িত্ব পালন করে। যেমন,আধুনিক পিঁপড়াদের পূর্বপুরুষের ফসিল কোথা থেকে পাওয়া যাবে, কিংবা মাছ এবং চতুষ্পদী উভচর প্রাণীর মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীর ফসিল কোথায় পাওয়া যাবে, -এ ধরণের অনুমানগুলো বিবর্তন তত্ত্ব দিয়ে বের করে সত্যতা যাচাই করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে পড়ুন – বিবর্তন কখনো বৈজ্ঞানিক ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে না এই দাবির উত্তর।
আবার আসা যাক নিউটনের মহাকর্ষ তত্ত্বে। একটি অনুকল্প যখন গ্রহণ করা হয় তখন এর সত্যতা পরীক্ষার জন্য একে বর্তমান পর্যন্ত সকল আহরিত জ্ঞানের চোখ দিয়ে যাচাই করা হয়। যদি এই অনুকল্পটি বিভিন্ন পরীক্ষায় সঠিক ফলাফল দেয়, এবং সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়, তাহলেই একে তত্ত্বের মর্যাদা প্রদান করা হয়। আমরা জানি, দীর্ঘ সময় পর্যন্ত গাছ থেকে আপেল পড়া বাস্তবতাটির ব্যাখ্যায় নিউটনের তত্ত্বই সঠিক ফলাফল দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র খুব ভালই ফলাফল দেয়। কিন্তু দেখা গেল বিশেষ কিছু পরিস্থিতি, যেমন- অত্যন্ত দ্রুত বেগে (আলোর বেগের কাছাকাছি) চলমান বস্তুর ক্ষেত্রে কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের মতো বিশাল ভর গণনায় নিউটনের তত্ত্ব সঠিক ফলাফল দিতে পারছে না। যা পারছে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। সুতরাং এখন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বই সার্বিকভাবে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব থেকে গ্রহণযোগ্য। এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা বিশেষ প্রয়োজন, গাছ থেকে আপেল পড়ার ব্যাখ্যা যা দিয়েই দেওয়া হোকনা কেন, আপেল পড়া কিন্তু থেমে যায়নি। বিবর্তনও তাই। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে গত দেড়শ বছর ধরে পাওয়া হাজারো প্রমাণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা শতভাগ নিশ্চিত যে, পৃথিবীর সকল প্রজাতির উদ্ভব বিবর্তনের মাধ্যমেই হয়েছে। এটি সূর্য পৃথিবী চারদিকে ঘোরার বা গাছ থেকে আপেল পড়ার মতোই বাস্তবতা। এই বাস্তবতাটি ডারউইনের প্রস্তাবিত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব দিয়ে এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, ভবিষ্যতের কোনও পরিস্থিতিতে ডারউইনের তত্ত্ব যদি সঠিক ফলাফল দিতে অপারগ হয় তাহলে আমরা আরও সঠিক কোনো ব্যাখ্যার সন্ধান পাবো। কিন্তু গাছ থেকে আপেল পড়ছিল, পড়ছে এবং পড়তে থাকবে, বিবর্তনও হয়েছিল, হচ্ছে, হতেই থাকবে।
তথ্যসূত্রঃ
১. বিবর্তন নিয়ে ইসলামী পন্ডিত জাকির নায়েকের লেকচার http://tiny.cc/xkexk
২.সায়েন্টিফিক আমেরিকান ম্যাগাজিনের জুলাই ২০০২ এর ইস্যুতে সম্পাদক জন রেনি’র “15 Answers to Creationist Nonsense” প্রবন্ধ। মুক্তমনার লেখক পৃথিবীর করা অনুবাদের অনলাইন লিংক http://tiny.cc/a0sbr
৩. মোরান, লরেন্স “Evolution is a Fact and a Theory”, টক অরিজিন। অনলাইন লিংক http://tiny.cc/xctrm
৪. গুল্ড, স্টিফেন জে “Evolution as Fact and Theory”. Discover 2 (5): 34–37. অনলাইন লিংক http://tiny.cc/0cvsk
৫.লেনস্কি, রিচার্ড ই “Evolution: Fact and Theory”. American Institute of Biological Sciences. অনলাইন লিংক http://tiny.cc/p253u
৬. http://tiny.cc/b8n7k
৭. http://tiny.cc/p487c
৮. মুক্তমনা বিবর্তন আর্কাইভ ‘বিবর্তনের পক্ষে কোনো সাক্ষ্যপ্রমান পাওয়া যায়নি’।
৯. অভিজিৎ রায়,এক বিবর্তন বিরোধীর প্রত্যুত্তরে, অনলাইন লিংক http://tiny.cc/qph0b
১০. বন্যা আহমেদ,বিবর্তনের পথ ধরে,অবসর প্রকাশনী। অনলাইন লিংক http://tiny.cc/ocp2d
১১. চার্লস ডারউইন, The Origin of Species by Means of Natural Selection (London: John Murray, 1859)
(Y)
ভালো লাগলো। ঠিকঠাক উত্তর।
বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্রে পাঠচক্রে আমাদেরকে দেবোপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বায়াসড বাই “যে গল্পের শেষ নেই” বইটি পড়ানোর পর অমল দাশগুপ্তের “মানুষের ঠিকানা” নামক চমৎকার একটা বই পড়য়েছিল যাতে বিবর্তন এবং সভ্যতার ক্রমবিকাশ খুবই সহজ এবং চমৎকারভাবে লেখা ছিল। কিন্তু বইটা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এত হতাশ হয়েছিলাম! আমি যখন বইটা নিয়ে কথা বলছিলাম তখন এক ভাই করেছিল সেই পুরনো প্রশ্ন “লেজটা গেল কই?” আর আরেক ভাই চিৎকার করেছিল এই বলে “বিবর্তন একটা থিওরি মাত্র”। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি, সেটা হয়ত আমারই কম জানার কারণে। তার ওয়ালে লিঙ্কটা পোস্ট করছি। দেখি সে যতটা খোলা মনে আর সবকিছু নিতে পারে ততটা ভালভাবে এটা বোঝার চেষ্টা করে কিনা। মজার ব্যাপার হল ঐ ভাই ইসলামের ভাষায় যা কিছু বেশরিয়তি সবই করে অথচ ইসলাম বা বিবর্তন নিয়ে কথা উঠলে আমাকে এড়িয়ে যায় এবং অনুরোধ করে তাকে তার মত থাকতে দিতে! একই কাজ করে আমার বন্ধুরাও! হতাশ লাগে যখন আমি কিছু বললেই সবাই এক্সট্রিমিস্ট ভাবে :-Y
@লীনা রহমান,
আমাকে আমার মতো থাকতে দাও- খুবই কমন স্ট্যান্ড 🙂
@লীনা রহমান, নিজে তো গোল্লায় গেছেই, ছানা-পোনাদেরকে কার মতো থাকতে দেবে এখন সেটাই দেখার।
@লীনা রহমান,
অমল দাশগুপ্তের “মানুষের ঠিকানা” বইটির কোন পিডিএফ ভার্সন আছে কি বা দেবোপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বইটির ? অথবা কি করে সংগ্রহ করতে পারি?
বিবর্তনের প্রশ্নমালাটি কি এখানে দেয়া যাবে ? প্রশ্নমালাটি দেখলে বোঝা যেত সাধারণত কি ধরণের প্রশ্ন বিবর্তনবাদ নিয়ে করা হয়ে থাকে ।
@সংশপ্তক,
কি কি প্রশ্ন থাকবে তার পূর্ণাঙ্গ লিস্ট প্রস্তুত করিনি। এখন করছি। করে আপনাকে পাঠাবো। কিন্তু কি ধরণের প্রশ্ন সাধারণ করা হয় সেটা দেখার জন্য বিবর্তন আর্কাইভের প্রশ্নগুলো দেখা যেতে পারে। লিংক দিতে গিয়েও দিলাম না, ডর লাগে 😛
একটা বিষয় অনেকদিন ধরে চোখে পড়তেছে। আমরা শুরুতে বিবর্তনকে একটি বিস্তবতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেও এক সময় সেটাকে বিবর্তন তত্ত্বই ডাকা শুরু করি। তোর লেখাতেও কিন্তু শুরুতে বিবর্তন একটি বাস্তবতা- এই বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করার পর বিবর্তনকে তত্ত্ব হিসেবেই বলা ডেকেছিস। প্রায় সব লেখাতেই এমনটা দেখেছি। কিন্তু ব্যাপারটা আরেকটু ডিটেল করা যেতে পারে মনে হয়।
এই লাইনটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যার দাবী রাখে।
বিবর্তন বাস্তবতা, অনুকল্প নাকি তত্ত্ব?
আমার মনে হয় উত্তর হবে বিবর্তন একই সাথে একটি বাস্তবতা এবং তত্ত্ব, এখানে বাস্তবতা আর তত্ত্বের সীমানা খুব সরু। বিবর্তন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু নয় মনে হয়- কারণ মহাকর্ষও একইসাথে একটি বাস্তবতা ও তত্ত্ব। গাছ থেকে আপেল পড়াটা বাস্তবতা, আবার ভরওয়ালা বস্তু একে অপরকে আকর্ষণ করে (অর্থাৎ মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ) সেটাকেও বাস্তবতা বলা যায়। তাহলে আপেল পড়াটা কোন মৌলিক বাস্তবতা নয় বরং আরেকটি বাস্তবতা তথা মহাকর্ষের ফলাফল। আবার আইনস্টাইনীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে চিন্তা করলে, মহাকর্ষ নিজেও মৌলিক বাস্তবতা নয় বরং আরেকটি বাস্তবতার ফলাফল। সেই মৌলিক বাস্তবতা হচ্ছে- সকল ভরওয়ালা বস্তুই তার আশপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়। সেই বক্রতাই চূড়ান্ত বাস্তবতা, মহাকর্ষ হচ্ছে সেই বাস্তবতার ফলাফল।
ব্যাপারটা মনে হয় দার্শনিক দিকে মোড় নিচ্ছে। যেমন আমি স্ট্যানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোসফি তে বিবর্তন বিষয়ক লেখাটাতে এমন পেলাম:
আমি কোন উপসংহার টানতেছি না, আরও আলোচনা করতে হবে এ প্রসঙ্গে।
আমি একটা সম্ভাব্যতা দেখতে পাচ্ছি:
– সকল জীবের অবিরাম পরিবর্তন একটি বাস্তবতা, ফ্যাক্ট বা সত্য।
– এক প্রজাতি থেকে অন্য এক বা একাধিক প্রজাতিতে রূপান্তর (বিবর্তন) সেই পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবী ফলাফল
– প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই পরিবর্তনের অন্যতম একটি কারণ
এখন কোনটাকে ঘটনা, ঘটনার কারণ, ঘটনার ফলাফল এই তিনটি বিষয় নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা উচিত। স্ট্যানফোর্ড থেকে আরও শিক্ষা নেয়া যায়। সবার আলোচনার জন্যই ব্যাপারটা উত্থাপন করলাম।
দ্রষ্টব্য: এখানে বিবর্তনকে একটি বাস্তব ঘটনার ফলাফল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, কিন্তু ফলাফলটি কিভাবে রূপ লাভ করে সেটা নিয়ে একের অধিক ব্যাখ্যা আছে। যেমন লামার্ক বিবর্তন কে দেখেছেন লিনিয়ার হিসেবে, অর্থাৎ প্রতিটি প্রজাতি লিনিয়ার বিবর্তনের মাধ্যমে সরল থেকে জটিল হয়। আর ডারউইন উপস্থাপন করেছেন শাখাময় বিবর্তন। অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অনেকগুলো প্রজাতির শাখা-প্রশাখা সৃষ্টি হতে পারে যার কিছু জীবিত থাকে আর কিছু বিলুপ্ত হয়ে যায়। তবে সর্বসাকুল্যে প্রজাতির সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলে। এসব বিবেচনা করলে আবার বিবর্তনকে তত্ত্বই বলতে হয়।
হয়তো
– বিবর্তন বাস্তবতার ফলাফল ব্যাখ্যা করার তত্ত্ব
– আর প্রাকৃতিক নির্বাচন সেই বাস্তবতার কারণ ব্যাখ্যা করার তত্ত্ব
জানি না… 😀
একটা বই পেলাম: Theory and Reality by Peter Godfrey-Smith
@শিক্ষানবিস,
বিশ্বাস করবিনা, এই বিষয়টা নিয়া আমিও বেশ ভাবছি। সমস্যা হৈলো বিবর্তনকে বাস্তবতা বলে আবার বিবর্তন তত্ত্ব ডাকার কারণটা হলো যে অন্য কোনো নাম না পাওয়া। ইংরেজিতে খুব সুন্দর Theory of Evolution বলা যায়- শুনলেই পরিষ্কার বোঝা যায়, বিবর্তনের তত্ত্ব। অর্থাৎ বিবর্তন বাস্তবতা, সেটা ব্যাখ্যা করার তত্ত্ব। বাংলায় তো এভাবে বলার উপায় নেই।
বিবর্তনের ক্ষেত্রে আসলেই তত্ত্ব নাকি বাস্তবতা সেই সীমারেখাটা খুব সরু। তারপরও যদি সীমারেখা টানতে চাই, পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনের জন্য, তাহলে- প্রাণের বিবর্তনকে বাস্তবতা এবং বিবর্তন হওয়ার কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক নির্বাচনকে তত্ত্ব ডাকতে পারি।
ডারউইনের ক্ষেত্রে সমস্যা যেটা হয়েছিলো- যে তাকে বিবর্তন হয় এবং এর পেছনে কারণ দুইটাই আলাদা করে প্রস্তাব করতে হয়েছিলো। যেটা করতে হয়নি নিউটনকে। নিউটনকে আপেল পড়ে এই জিনিস প্রমান করতে হয়নি। ডারউইন তো বিবর্তন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন দুইটাকেই হাইপোথিসিস হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন, কালের বিবর্তনে একটি হাইপোথিসিস এখন বাস্তবতা আরেকটি তত্ত্ব।
অভিদা ঠিক করে দিচ্ছি। লিংকগুলো আসলে ছোট করার জন্য কোনো এক কালে এমন করেছিলাম। এখন কাজ করছেনা দেখি। লিংকগুলো রাতে ঠিক করছি।
লেখাটা বেশ ভাল হয়েছে, যদিও ব্যাপারগুলো আমদের অনেকদিন ধরেই জানা। কিন্তু জানা থাকলেও অনেকেই ব্যাপারটা মাথার মধ্যে ধারণ করতে পারেন না, কেউ বা আবার চান না।
মাধ্যাকর্ষণের সাথে বিবর্তনের তুলনাটা খুব ভাল হয়েছে। আপেল পড়া যেমন বাস্তবতা, ঠিক তেমনি বাস্তবতা হল জীবজগতের ক্রমান্বয়িক পরিবর্তন। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের মাধ্যমেই ব্যাপারটিকে সবচেয়ে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বলেই সেটি বিজ্ঞানের জগতে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব।
তানভীরুল খুব ভাল কিছু কথা বলেছে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব নিয়ে। সেখান থেকে সারমর্ম নিয়ে কিছু ফুটনোট হিসেবে রাখতে পার। ব্যাপারটা আকর্ষণীয় হবে।
বিজ্ঞানীরা বাস্তবে ঘটে না,এমন কোনো কিছু নিয়ে কখনও তত্ত্ব প্রদান করেন না। এটার বদলে এভাবে লিখতে পার – বিজ্ঞানীরা মূলতঃ বাস্তবতা ব্যাখ্যা করার জন্যই তত্ত্ব দাঁড় করান। Theory explains fact. বিজ্ঞানীরা বাস্তবে ঘটে না,এমন কোনো কিছু নিয়ে কখনও তত্ত্ব প্রদান করেন না, এভাবে বলে দিলে হয়ত স্ট্রিং থিওরি, মাল্টিভার্স থিওরি অনেক কিছু নিয়েই প্রশ্ন করা হবে। তবে আমি বুঝতে পেরেছি তুমি কি বলতে চেয়েছ। ভুত পেত্নীর নাচ নিয়ে বিজ্ঞানের কোন তত্ত্ব নেই, কারণ এ জিনিস বাস্তবে পাওয়া যায় না।
এই লাইনটাকে এভাবে লিখতে পার –
দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে নিউটনের সূত্র খুব ভালই ফলাফল দেয়। কিন্তু দেখা গেল, বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে, নিউটনের তত্ত্ব সঠিক ফলাফল দিতে পারছে না, বিশেষতঃ বস্তু যদি ছুটতে থাকে খুব বিশাল কোন বেগে, অনেকটা আলোর বেগের কাছাকাছি, কিংবা কৃষ্ণগহ্বরের মত বিশাল ভরের কোন গণনায়।
এভাবে বললে বোঝা যায়, কোন বিশেষ পরিস্থিতিগুলোতে নিউটনের সূত্র সংশোধনের প্রয়োজন পড়েছিলো।
আরেকটা ব্যাপার – http://tiny.cc এর লিঙ্কগুলো কাজ করছে না। সেগুলো বদলে সঠিক লিঙ্ক দেওয়া যায়? ওই লিঙ্কগুলোর শানে নজুল কি?
@অভিজিৎ দা,
এভাবে দিলাম।
রায়হান,
আমি বুঝতে পারছি তুমি কী বলতে চাইছো, কিন্তু কথাটা কী এভাবে বলা ১০০% সঠিক? ‘বাস্তবে ঘটা’ কথাটার টেকনিক্যালিটি নিয়ে কী এখানে প্রশ্ন তোলা যায়? মাল্টিভার্স, কিংবা স্ট্রিং থিওরীর মত তত্ত্বগুলো (এমনকি বিগ ব্যং থিওরি যখন প্রথম দেওয়া হয়েছিল) কিন্তু দেওয়া হয়েছে বা হয়েছিল ‘আদৌ বাস্তবে ঘটে কী’না তার প্রমাণ পাওয়ার অনেক আগেই। আমি আসলে এখানে জানার জন্যই প্রশ্ন করছি, ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য না 🙁 । কেউ উত্তর দিলে খুশী হব।
@বন্যা আহমেদ,
হ্যাঁ! এই জায়গাটা ঠিক করা দরকার। অভিদার সাজেশন মোতাবেক ঠিক করে দিচ্ছি।
আইসাক আসিমভের ‘ভুলের আপেক্ষিকতা’ নামক একটা লেখা পড়েছিলাম। একটা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে অন্য কোনো তত্ত্ব প্রণীত হয় যেখানে সেখানে এই ‘ভুল’ প্রমাণ করাটা কীভাবে কাজ করে সেই নিয়ে লেখা।
যেমন পৃথিবী আগে সবাই সমতল ভাবতো। পরে দেখা গেল সেটা গোলোকাকার। সমতল আর গোলকে এমন আকাশপাতাল তফাত থাকলেও, এই যে আগের সমতল তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করে গোলাকার তত্ত্ব হলো এখানে পার্থক্যটা এক হিসাবে সুক্ষ্ম। কারণ সমতল তত্ত্বদানকারীরা, সারফেসে দাড়িয়েই এই তত্ত্ব দিয়েহে। এবং কেউ যদি কয়েক মাইল ও হাটে, তারপরেও সে যে একটা গোলাকার তলে হেটেছে সেটা তার পক্ষে অনুমান করা সম্ভব হয় না। কারণ অইদূরত্বে তার উচ্চতার বিচ্যুতি খুবই কম। এই যে ‘কম বিচ্যুতি’ এটাই আমাদেরকে শুরুত ঐ সমতল পৃথিবীতত্ত্বে উপনিত করেছিলো।
নিউটনের মধ্যাকর্ষণ তত্ত্বেও তাই। এটা থেকে আইনস্টাইনিয় তত্ত্বে যেতে যে সুক্ষবিচ্যুতিটা পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছে, সেটা এতটাই সুক্ষ্ম, যে বিজ্ঞানের পরীক্ষণপদ্ধতির অনেকটা অগ্রগতি হওয়া লেগেছে তার জন্য। কিন্তু এর মানে যে নিউটনের তত্ত্ব আমূল ভুল ছিলো তা নয়। আইনস্টাইনীয় তত্ত্ব এটার প্রিসিশনের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, নিউটনের তত্ত্ব দিয়ে গ্রহ নক্ষত্রের গতিপথ হিসাব করলে হয়তো দশমিকের পরে, চার ঘর সূক্ষ্ম হিসাব হতো। এখন হচ্ছে বারো ঘর। আর অবশ্যই মৌলিক গাঠনিক পার্থক্য আছে দুই তত্ত্বে। কিন্তু অবজার্ভ করছি তো আমরা সেই আপেল, সেই গ্রহনক্ষত্রই।
বিবর্তনতত্ত্ব ডারউইন যেভাবে দিয়েছেন, সেটাও কিন্তু টুকটাক বেশকিছু সংশোধনীর মধ্যে দিয়ে গেছে। ডারউইন এর ক্রেডিট হচ্ছে, তিনি একটা ভাবনার ব্যারিয়ার ক্রস করতে পেরেছেন। আর তার উন্মুক্ত করা দরজা দিয়ে অনেক খানি এগিয়ে গেছে বিজ্ঞান। মূল কথা হলো, প্রকৃতিতে আমরা বৈচিত্রময় একটা জীবজগত দেখি। এই বৈচিত্রের মধ্যে একটা ছন্দ, একটা ইন্টারপ্লেও দেখি। যে বৈজ্ঞানিক তত্ত্বটি এসবকে একসূত্রে গেথে একটা সার্বিক ব্যাখ্যা দেয়, সেটা হচ্ছে বিবর্তন তত্ত্ব। এই তত্ত্বের চেয়ে সঠিকতর কোনো তত্ত্ব যদি ভবিষ্যতে আসে (বিজ্ঞানে এ সম্ভাবনা সবসময়ই থাকে) তাহলে সেটা বিবর্তনের ধারণাকে স্রেফ আপডেটই করবে। এবং পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করবে আরও সূক্ষ্ম ভাবে।
বিজ্ঞান তার সবচেয়ে প্রতিষ্টিতত্ত্বকেও ক্রমাগত প্রশ্নের সম্মূখীন করতে থাকে। এই চলমানতাই বিজ্ঞান। তবে এ নিয়ে, সৃষ্টিতত্ত্ববাদীদের আশার গুড়ে বালি, কারণ (আর যেকোণো তত্ত্বের মতই) বিবর্তন তত্ত্ব যত আপডেট হবে, ততই শক্তিশালী হবে। ভুল প্রমাণিত হয়ে সব জলে মিশে যাবে না।
@তানভীরুল ইসলাম,
বিবর্তন সংক্রান্ত ধোঁয়াটে প্রশ্ন করে ভুল প্রমানের টেন্ডেসি যাদের মধ্যে লক্ষ্যনীয় তারা মূলত এই কাজটা করে ভাবেন, বিবর্তনের ভুল প্রমান হলে সৃষ্টিবাদ সঠিক হয়ে গেলো। হাস্যকর চিন্তাভাবনা।