সাধারণ পূর্বপুরুষদের বয়ান
প্রাইমেট এবং সেই সাথে মানব বিবর্তনের ইতিহাসে আনুমানিক ৬.৩ কোটি বছর পূর্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রাণবৃক্ষের প্রাইমেট শাখাটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। অবশ্যই এটি এমন তাৎক্ষণিক কোন ব্যাপার নয়, এবং বাস্তবিক অর্থে এমন কোন বিভাজন রেখা টানাটাও বৈজ্ঞানিক নয়। কিন্তু আমরা অন্তত এটুকু বলতে পারি যে, আগে সব প্রাইমেটই দেখতে মোটামোটি একরকম ছিল, ৬.৩ কোটি বছর পূর্বে ডাইনোসরবিহীন পৃথিবী পেয়ে তাদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং আমরা দুই ধরণের প্রাইমেটের সাক্ষাৎ পাই: স্ট্রেপসিরাইন ও হ্যাপ্লোরাইন। স্ট্রেপসিরাইনদের নাক অনেকটা বর্তমান কুকুরের মতো, সকল লেমুর, লোরিস ও বুশবেবি এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। আর আমরা সহ বাকি সব প্রাইমেট হ্যাপ্লোরাইন। পূর্বের অধ্যায়ে প্রাইমেটদের শ্রেণীবিন্যাস পড়তে গিয়ে আমরা এদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম। সেখানে আমরা কেবল শ্রেণীবিভাগ দেখেছিলাম। এবার দেখব ইতিহাসের ঠিক কোন যুগটাতে এই পরিবর্তনগুলো প্রকট হতে শুরু করেছিল। প্রাইমেটদের পুরো ইতিহাসই নিচের বংশবৃক্ষটির মাধ্যমে বোঝানো সম্ভব।
প্রাণবৃক্ষের কেবল প্রাইমেট শাখাটিকে সময়ের আবর্তে কিভাবে বিভাজিত হয়েছে তাই দেখা যাচ্ছে এখানে। ৬.৩ কোটি বছর আগে শুরু হয়ে এই বিভাজন শেষ হয়েছে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর পূর্বে।
বংশবৃক্ষের কয়েকটি ছেদবিন্দুতে কালো ডট ও সাথে একটি সংখ্যা দেখা যাচ্ছে। এই সংখ্যাগুলো দিয়েই আমরা মানব বিবর্তনের ইতিহাস রচনা করব। ছেদবিন্দু থেকে যে দুটি শাখা বেরিয়া যাচ্ছে তারা দুটি প্রজাতির প্রতিনিধিত্ব করে। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় গোঁড়ার বিন্দুতে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ ছিল যাদের থেকে এই দুটি প্রজাতির জন্ম হয়েছে। রিচার্ড ডকিন্স সাধারণ পূর্বপুরুষ শব্দটির একটি চতুর নাম দিয়েছেন- ইংরেজি common ও ancestor কে মিলিয়ে concestor. আমরাও এখন থেকে সেই সব সাধারণ পূর্বপুরুষদের কনসেস্টর ডাকবো। প্রাণবৃক্ষ বরাবর পেছাতে থাকলে আধুনিক মানুষের শাখাটি যখন অন্য কোন প্রাইমেট প্রজাতির শাখার সাথে মিলিত হয় তখনই একটি কনসেস্টর গণনা করা হবে। আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ হোমো ইরেক্টাস, কিন্তু তাদেরকে আমরা আপাতত গোণায় ধরব না, কারণ তারা বর্তমানে জীবিত অন্য কোন প্রাইমেট প্রজাতির পূর্বপুরুষ নয়, বরং কেবলই আমাদের শাখার সদস্য। এভাবে যেতে থাকলে সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা দেখা পাব মোট আটটি কনসেস্টরের যাদেরকে বংশবৃক্ষে ১ থেকে ৮ পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে দেখানো হয়েছে। প্রথম কনসেস্টর ৬০ লক্ষ বছরেরও আগে পৃথিবীতে বাস করতো, আর ৬০ লক্ষ বছর আগে তাদের থেকে জন্ম নিতে শুরু করেছে দুটি প্রজাতি- মানুষ আর শিম্পাঞ্জি। দ্বিতীয় কনসেস্টর আবার একইসাথে কনসেস্টর ১ এবং গরিলার পূর্বপুরুষ। একইভাবে তৃতীয়টি ২য় কনসেস্টর এবং ওরাংওটাং এর পূর্বপুরুষ। নিচের টেবিলে সবগুলো কনসেস্টরের পরিচয় তুলে ধরা হল:
আমরা যাত্রা শুরু করব যথারীতি সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ৮ নম্বর কনসেস্টর দিয়ে যারা ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে স্ট্রেপসিরাইন ও হ্যাপ্লোরাইন- এ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এর আগে আফ্রিকা এবং সম্ভবত এশিয়ারও বিভিন্ন বনাঞ্চলে বাস করতো তারা। এরা দেখতে কেমন ছিল তার কিছুই আমরা জানতে পারতাম না যদি না উল্লেখযোগ্য সংখ্যক স্ট্রেপসিরাইন আজও জীবিত থাকতো। এদের বাঁচিয়ে রাখার পেছনে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে বিস্ময়কর একটি দ্বীপ- নাম তার মাদাগাস্কার। এ দ্বীপে মানুষ ছাড়া সকল প্রাইমেটই স্ট্রেপসিরাইন।
কনসেস্টর ৮: প্রোসিমিয়ান বিপ্লবের হোতা
মাদাগাস্কারের গল্পটা শুরু করতে হবে আরও আগে থেকে। আজ থেকে ১১০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে একটিমাত্র মহাদেশ ছিল যার নাম রোডিনিয়া। ৭৫ কোটি বছর পূর্বে এটি ভেঙে যায় এবং কিছু অংশ দক্ষিণ গোলার্ধে চলে আসে। মহাদেশগুলো গতিশীল টেকটোনিক প্লেটের উপর অবস্থিত। এই গতিই রোডিনিয়ার ভগ্নাংশগুলোকে আবার একত্রিত করে প্রায় ৩০ কোটি বছর পূর্বে গঠন করেছিল প্যানজিয়া নামের বিখ্যাত মহাদেশটি। ২০ কোটি বছর আগে অবশ্য প্যানজিয়া ভেঙে উত্তরে লাউরেশিয়া ও দক্ষিণে গন্ডোয়ানা নামের দুটি মহাদেশ গঠিত হয়। মাদাগাস্কার তখনো গন্ডোয়ানার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮ কোটি বছর পূর্বে জুরাসিক যুগের শুরুর দিকে গন্ডোয়ানার পূর্বাংশ আলাদা হয়ে যায়, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমান মাদাগাস্কার, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও অ্যান্টার্কটিকা। ১৩ কোটি বছর আগে পশ্চিম গন্ডোয়ানাও আবার দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়- এবার পূর্বের অংশটি হয় আফ্রিকা আর পশ্চিমেরটি দক্ষিণ আমেরিকা। এরপর ৯ কোটি বছর পূর্বে মাদাগাস্কার পুরনো বন্ধু ভারতকেও ছেড়ে দেয়, হয়ে ওঠে একটি স্বাধীন দ্বীপ। মাদাগাস্কারের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে ভারত নির্বিঘ্নে এশিয়ার দিকে এগোতে শুরু করে যার পরিণতি আমরা একটু পরে জানব।
এই মাদাগাস্কারই এক সময় হয়ে ওঠে স্ট্রেপসিরাইনদের স্বর্গ। কিন্তু স্বর্গের উপাখ্যান শুরুর আগে একটা প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন- স্ট্রেপসিরাইনি উপবর্গের আদিম সদস্যরা কি মাদাগাস্কারে পৃথকভাবে বিবর্তিত হয়েছে, নাকি আফ্রিকা থেকে এসেছে? আফ্রিকা এবং এশিয়ার কিছু স্থানেও যেহেতু স্ট্রেপসিরাইন দেখা যায় সেহেতু তাদের এক জায়গায় উদ্ভূত হয়ে পরে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়াটাই বেশি যুক্তিযুক্ত মনে হয়। আফ্রিকা থেকে মাদাগাস্কারে পৌঁছানো একটা ঝামেলা হতে পারে। ১৮ কোটি বছর আগে মাদাগাস্কারের জমি আফ্রিকা থেকে আলাদা হয়েছে, আর আফ্রিকায় স্ট্রেপসিরাইনদের উদ্ভব ঘটেছে মাত্র ৬.৩ কোটি বছর পূর্বে, কে/টি বিলুপ্তির ২ কোটি বছর পর। তাই মাদাগাস্কার যেতে হলে তাদেরকে বর্তমান মোজাম্বিক চ্যানেল পাড়ি দিতেই হতো। দুর্ঘটনাবশতও যদি স্ট্রেপসিরাইনদের এক জোড়া প্রজননে সক্ষম সদস্য আফ্রিকা থেকে কোন গাছের গুড়িতে ভাসতে ভাসতে মাদাগাস্কার চলে যেতে পারে তাহলেই যথেষ্ট। এমনটি হওয়া যে খুবই সম্ভব তার প্রমাণ একটু পরে দিচ্ছি।
তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি কে/টি বিলুপ্তির ঠিক পরপর বা হয়তো তারও আগে আফ্রিকা এবং এশিয়ায় সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ বাস করতো। তাদের থেকে বিবর্তিত স্ট্রেপসিরাইনদের একটি গোষ্ঠী কোন না কোনভাবে মাদাগাস্কারে পাড়ি জমিয়ে প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় আজও টিকে আছে। মাদাগাস্কারের লেমুররা তাই ৮ম কনসেস্টর সম্পর্কে আমাদের অনেক কিছু জানাতে পারে। তবে একটি প্রাচীন ফসিলও পাওয়া গেছে যা ৮ম কনসেস্টর সম্পর্কে কিছু ধারণা দিতে পারে। ফসিলটিকে অবশ্য Plesiadapiformes নামক একটা আলাদা বর্গে স্থান দেয়া হয়েছে। কেউ বলে এরাই কনসেস্টর ৮, কেউ বলে এরা কনসেস্টর ৮ এর আপন ভাই। ফসিল থেকে দেখা গেছে এরাই প্রথম প্রাণী যাদের আঙুলে নখড়ের বদলে নখ ছিল।
প্যালিওসিন শেষ হয়ে ইয়োসিন ইপকের শুরুটা ৮ম কনসেস্টরদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ৫ কোটি বছর পূর্বেই তাদের থেকে বর্তমান প্রোসিমিয়ানদের জন্ম হয়। তারা এতো সাফল্য লাভ করেছিল যে, সে সময় প্রোসিমিয়ানদের অন্তত ৬০টি গণ ছিল; এতোগুলো গণ থাকলে প্রজাতির সংখ্যা কতো হতে পারে বোঝাই যাচ্ছে। বর্তমানেও প্রোসিমিয়ানদের এতো বৈচিত্র্য নেই। তখনকার প্রোসিমিয়ানরা মূলত দুটি পরিবারে বিভক্ত ছিল: Adapidae (আদিম স্ট্রেপসিরাইন) এবং Omomyidae (আদিম হ্যাপ্লোরাইন)। প্রথমে উত্তর আমেরিকা, ইউরেশিয়া ও আফ্রিকা ছিল তাদের বাসস্থান। ইয়োসিন যুগের শুরুতেই তাদের কেউ কেউ মাদাগাস্কারে প্রবেশ করে। পৃথিবীর অন্য অনেক স্থানে প্রোসিমিয়ানদের থেকে যখন অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান সিমিয়ানদের বিবর্তন ঘটে তখন প্রোসিমিয়ানরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু মাদাগাস্কারে কখনো সিমিয়ান তথা বানরের উদ্ভব ঘটেনি বলে সুপ্রাচীন প্রোসিমিয়ানরা এখনও টিকে আছে।
কনসেস্টর ৭: ভূতের বাপ
গত অধ্যায়ে ভুতুড়ে টারশিয়ারদের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম আমরা। প্রাচীন মানুষেরা টারশিয়ারদের মতো প্রাণী দেখেই ভূতের ধারণা পেয়েছিল কিনা কে বলতে পারে। এদের চোখটা বিশাল বড়, এজন্যই তারা চোখের পাতা ফেলতে পারে না। আর চোখের পাতা ফেলতে পারে না বলেই অন্যদিকে দেখতে হলে পুরো ঘাড় ঘুরাতে হয়। কোন কোন টারশিয়ার মাথা পুরো ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ফেলতে পারে, কি ভয়ংকর ব্যাপার! আমাদের সপ্তম কনসেস্টররা এই ভূতের বাপ এবং দেখতে তারা টারশিয়ারদের বেশ কাছাকাছি ছিল। বংশবৃক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে ৫ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে ভূতের বাপ দুটি নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে শুরু করে, যার একটি প্রজাতি মুহুর্মুহু বিবর্তনের মাধ্যমে হয়েছে মানুষ, আরেকটি সেই ভূতই থেকে গেছে।
টারশিয়ারদের দেখে ৭ম কনসেস্টর সম্পর্কে অনেক কিছু জানা সম্ভব। প্রথম প্রশ্ন হতে পারে, টারশিয়ারদের মতো তারাও কি নিশাচর ছিল। উত্তরের জন্য চোখের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন যা প্রাইমেট ছাড়া সকল নিশাচর স্তন্যপায়ীরই আছে। এর নাম ট্যাপেটাম লুসিডাম। এটি আসলে চোখের রেটিনার পেছনে অবস্থিত একটি প্রতিফলক স্তর যা আপতিত আলোকে প্রতিফলিত করে আবার ফেরত পাঠায় যাতে রেটিনা দ্বিতীয়বারের মত তা গ্রহণ করতে পারে। এ কারণে রাতের স্বল্প আলোতেও নিশাচররা অনেক কিছু দেখতে পায়। কিন্তু কোন প্রাইমেট এমনকি টারশিয়ারেরও এটা নেই। তাই ধারণা করা হয়, ৭ম বা ৮ম কনসেস্টর কোন এক পর্যায়ে একই সাথে নিশাচর ও দিবাচর ছিল। দিনের বেলা চলতে পারে বলে তাদের ট্যাপেটাম লুসিডামের দরকার ছিল না। হয়তো ডাইনোসরদের যুগে সবাই নিশাচর ছিল এবং সব স্তন্যপায়ীরই ট্যাপেটাম লুসিডাম ছিল। কিন্তু কে/টি বিলুপ্তির পর প্রতিযোগিতা না থাকায় অনেকে দিনের বেলায়ও খাদ্যের সন্ধানে বের হতে পারে এবং ট্যাপেটাম লুসিডাম হারায়। কোন এক কারণে টারশিয়াররা আবার রাতের জীবনে ফিরে গেছে কিন্তু ট্যাপেটাম লুসিডাম পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। এর বদলে তাদের চোখের আকারটা অনেক বেড়ে গেছে যাতে যত বেশি সম্ভব ফোটন সংগ্রহ করা যায়।
তাই অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় ৭ম কনসেস্টরও একইসাথে নিশাচর ও দিবাচর ছিল এবং তাদের ট্যাপেটাম লুসিডাম ছিল না। দিনরাত্রির জীবনে অভ্যস্ততা ছাড়া টারশিয়ারদের সাথে তাদের বোধহয় আর তেমন কোন পার্থক্য ছিল না। তারা হয়তো অনেকটা Omomyidae ফসিল পরিবারের প্রাণীদের মত ছিল। ওমোমাইডরা ৫.৫ থেকে ৩.৪ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত জীবিত ছিল, তাদের চোখ টারশিয়ারদের মতো বড় না হলেও নিশাচর হওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। ৭ম কনসেস্টরদেরকে বলা যায় নিশাচর ওমোমাইডদের নিশাচর-দিবাচর সংস্করণ। এই পূর্বপুরুষদেরই একটি গোষ্ঠী সূর্যের আলোকে ভালবেসেছে, সূর্যও তাদের দুহাত ভরে দিয়েছে, ফলশ্রুতিতে তাদের থেকে জন্ম হয়েছে মানুষসহ সকল অ্যানথ্রোপয়েড প্রজাতির; আর একটি গোষ্ঠী ফিরে গেছে রাতের অন্ধকারে আর পরিণত হয়েছে বর্তমান টারশিয়ারে।
কনসেস্টর ৬: বাঁদরামোর জনক
ইয়োসিন ইপকের প্রোসিমিয়ানদের মধ্যেই এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আসতে শুরু করেছিল যা পরবর্তী সিমিয়ান তথা বানরদের কাছাকাছি। তাদের মস্তিষ্ক ও চোখ বড় হচ্ছিল আর নাক দিনদিন ছোট হচ্ছিল। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি এসেছিল ফোরামেন ম্যাগনামে। প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের পেছনের অংশে তথা ভিত্তিভূমিতে একটি ছিদ্র থাকে যেখান দিয়ে সুষুম্না কাণ্ড (spinal cord) প্রবেশ করে। এরই নাম ফোরামেন ম্যাগনাম, লাতিন ভাষায় যার অর্থ বড় ছিদ্র। এই ছিদ্রের অবস্থান দেখে বলে দেয়া যায় প্রাণীটির দেহ অনুভূমিক (ঘোড়ার মত) বা উল্লম্ব (বানরের মত) কোন অবস্থানে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ইয়োসিন যুগের কিছু প্রোসিমিয়ানদের ফোরামেন ম্যাগনাম করোটিকার পেছন থেকে সরে কেন্দ্রের দিকে চলে আসছিল। এ থেকেই বোঝা যায় তখন তারা দুই পায়ের উপর ভর করে বসতে শুরু করেছিল। তবে ইয়োসিন ইপকের শেষদিকে অনেকগুলো প্রোসিমিয়ান প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়, সম্ভবত তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে।
অবশ্য বিলুপ্ত হওয়ার আগেই সিমিয়ানদের উদ্ভব ঘটে যায়। ইয়োসিন কেবল প্রোসিমিয়ান নয় সিমিয়ানদের জন্যও আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিয়েছিল। এর একটি বড় কারণ পরিবেশ। তখন পৃথিবীর যত্রতত্র গজিয়ে উঠেছিল অসংখ্য ক্রান্তীয় বনভূমি। আজকের বিরান অ্যান্টার্কটিকার কিছু অংশও তখন সবুজ ছিল। স্বর্গ বলে এখন কিছু না থাকলেও সে সময় গোটা পৃথিবীটাই ছিল স্বর্গ। সেই স্বর্গোদ্যানেই আনুমানিক ৪ কোটি বছর পূর্বে ৬ষ্ঠ কনসেস্টর প্রথম বানরদের জন্ম দেয়। কিন্তু সে সময় দুই ধরণের বানরের দেখা মেলে: নতুন দুনিয়ার প্ল্যাটিরাইন বানর ও পুরনো দুনিয়ার ক্যাটিরাইন বানর। নতুন দুনিয়া বলতে আমেরিকা ও পুরনো দুনিয়া বলতে যে আফ্রিকা ও ইউরেশিয়া বোঝানো হয় সেটা আমরা শ্রেণীবিন্যাস পর্বেই জেনেছি। পুরনো দুনিয়ায় বানরদের জন্ম আমরা পরের কনসেস্টরের কাছে শুনবো। এখানে নতুন দুনিয়ার বানরদের কথা বলা যাক। কারণ ৬ষ্ঠ কনসেস্টরদের উত্তরসূরীদের মধ্যে এরাই প্রথম আমাদের সাথে গভীর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করেছিল।
প্রশ্ন হচ্ছে নতুন দুনিয়ার বানররা কি দক্ষিণ আমেরিকাতে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়েছিল নাকি আফ্রিকায় জন্ম নিয়ে পরবর্তীতে আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছে। আজকের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নটিকেই উদ্ভট মনে হবে। কারণ আফ্রিকা থেকে আমেরিকা যাওয়া আর যাই হোক কোন বানরে পক্ষে যে সম্ভব না সেটা সবাই বোঝেন। কিন্তু ৪ কোটি বছর পূর্বে দক্ষিণ আমেরিকা আফ্রিকার বেশ কাছে ছিল এবং সমুদ্রে পানির উচ্চতাও ছিল কম। এর ফলে হয়ত আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে অনেকগুলো ছোট ছোট দ্বীপ জেগে উঠেছিল। এই পরিবেশে আফ্রিকা থেকে কিছু বানর ম্যানগ্রোভ জলাভূমিকে ভেলা হিসেবে ব্যবহার করে নিজের অজান্তেই এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ হয়ে এক সময় দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিল। ম্যানগ্রোভ জলাভূমিগুলো হয়ত জীবন-বান্ধব ছিল এবং পানির স্রোতও হয়ত তাদের অনুকূলে ছিল। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একই সময় রোডেন্টদের (কাঠবিড়ালির মত প্রাণী) একটি প্রজাতিও দক্ষিণ আমেরিকায় পৌঁছেছিল যাদের নাম হিস্ট্রিকগন্যাথ রোডেন্ট। আগে জেনেছি স্ট্রেপসিরাইনরাও অনেকটা এভাবে আফ্রিকা থেকে মাদাগাস্কার পৌঁছেছে।
এই অভিপ্রয়াণের ব্যাপারে অনেকে একমত হলেও প্রশ্ন হচ্ছে, এটি কি কেবল একবারই ঘটেছিল নাকি বানরদের অনেকগুলো গোষ্ঠী বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকা ত্যাগ করে নতুন দুনিয়ায় গেছে? সমাধানের উপায়ও আছে। নতুন দুনিয়ার প্রজাতিগুলো যদি আফ্রিকার কেবল একটি প্রজাতির সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত হয় তাহলে বলতে হবে অভিপ্রয়াণ একবার ঘটেছিল। আর যদি দেখা যায় নতুন দুনিয়ার কিছু প্রজাতি আফ্রিকার এক প্রজাতির সাথে সম্পর্কিত আবার অন্য কিছু প্রজাতি আফ্রিকার অন্য এক প্রজাতির সাথে সম্পর্কিত তাহলে বলতে হবে, অভিপ্রয়াণ বারবার ঘটেছে। ডিএনএ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত দেখা গেছে প্রথমটিই সত্যি, একবারের বেশি হয়ত ব্যাপারটা ঘটেনি।
আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটাকে খুবই অস্বাভাবিক মনে হয়। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা যতোই কাছে হোক আর মাঝখানে যতগুলো দ্বীপই থাকুক, সন্দেহ কাটে না। কিন্তু কথা হচ্ছে, অভিপ্রয়াণ যদি কেবল একবার ঘটে তাহলেই যথেষ্ট। হয়তো কেবল একটি গর্ভবতী পুরনো দুনিয়ার বানর ভাসমান ম্যানগ্রোভ জলাভূমিতে চেপে বসেছিল আর জীবন ধারণে সক্ষম ভেলাটি তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল নতুন দুনিয়ায়। এভাবে কোন পাসপোর্ট ছাড়াই সে হয়ে গিয়েছিল নতুন দুনিয়ার বাসিন্দা। একজন মানুষের জীবদ্দশায় এমনটি দেখার সম্ভাবনা খুব কম মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে আফ্রিকাতে পুরনো দুনিয়ার বানর কয়েক কোটি বছর ধরে রাজত্ব করছিল। এক কোটি বছরে অন্তত একবার কি এমন কিছু ঘটতে পারে না?
আরও বিশ্বাসযোগ্য করতে, এযুগের কিছু অসচেতন অভিপ্রয়াণের উদাহরণ দেয়া যাক। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানের সবুজ ইগুয়ানা এক বিশালাকৃতির টিকটিকি প্রজাতি। এদের দৈর্ঘ্য সাধারণত এক মিটার তবে সর্বোচ্চ দুই মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ১৯৯৫ সালের ৪ঠা অক্টোবর ১৫টি এমন ইগুয়ানা ক্যারিবিয়ানের আংগুইলা দ্বীপের পূর্ব উপকূলে হাজির হয়েছিল একেবারে ভেলায় ভেসে। ভেলাটি ছিল আসলে উপড়ে পড়া বেশ কিছু গাছের গুড়ি, যার কোন কোনটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০ ফুট। হয়তো অন্য কোন দ্বীপে গাছের গুড়িতে তারা বিশ্রাম নিচ্ছিল, এমন সময় হারিকেনের কারণে গাছগুলি উপড়ে পড়ে সমুদ্রে ভেসে যায়। উল্লেখ্য ক্যারিবিয়ানের পূর্ব উপকূলে এর মাত্র ১ মাস এবং ১৫ দিন আগে দুটি ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ১৯৯৮ সালেও আংগুইলাতে অন্তত একটি প্রজননে সক্ষম স্ত্রী ইগুয়ানা দেখা গেছে।
ব্যাপারটা আসলেই শ্বাসরুদ্ধকর, কোনভাবে কেবল একবার ভূমিতে পৌঁছুতে পারলেই জীবন তার নিজের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নেয়। বাকিটা শুধুই ইতিহাস। বাণের জলে ভেসে আসা কেবল একটি প্রাণীই পারে তার পুরো প্রজাতির ভাগ্য এবং কালের প্রবাহে পৃথিবীর একটি বিশাল অংশের চেহারা পাল্টে দিতে। ৪ কোটি থেকে আড়াই কোটি বছর পূর্বের মধ্যবর্তী কোন এক সময়ে পুরনো দুনিয়ার বানররা এই বৈপ্লবিক কাজটিই করেছিল। তবে তারা আফ্রিকা ছেড়ে গেছে বলেই যথারীতি আমাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুব কম। আরেকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন- আমি যে নতুন ও পুরনো দুনিয়ার বানরদের কথা এখানে বললাম তারা কিন্তু বর্তমান বানরদের মতো নয়, বরং বর্তমান বানরদের পূর্বপুরুষ। এই প্রাচীন সিমিয়ানদের বিবর্তনের ইতিহাসটি বেশ করুণ, কারণ যে প্রোসিমিয়ানদের থেকে তারা বিবর্তিত হয়েছে, তাদের কারণে সেই প্রোসিমিয়ানরাই বিলুপ্ত হতে বসেছিল। বিস্তারিত জানতে আমাদের প্রবেশ করতে অলিগোসিন যুগে।
কনসেস্টর ৫: অলিগোসিন যুগের প্রতাপশালী বানর
অলিগোসিন যুগ ৩.৪ কোটি বছর পূর্বে শুরু হয়ে ২.৩ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত ছিল। এ সময় ইয়োসিন যুগের স্বর্গীয় পরিবেশ নষ্ট হয়ে যায়। কেবল প্রোসিমিয়ান নয়, বিজ্ঞানীদের জন্যও এই যুগ বিশেষ অনুকূল নয়। কারণ এই যুগের খুব কম ফসিলই পাওয়া গেছে। বিশেষ করে অলিগোসিন প্রোসিমিয়ানদের ফসিল নেই বললেই চলে। তাদের সম্পর্কে জানার প্রধান উপায় পশ্চিম আফ্রিকার একটি ফসিল। বর্তমানে এই এলাকা মরুভূমি হলেও ৩.৬ কোটি বছর আগে এটি ছিল ক্রান্তীয় ঘনবর্ষণ বনভূমি। এই যুগেই প্রায় আড়াই কোটি বছর পূর্বে নরবানর ও পুরনো দুনিয়ার বানরদের কনসেস্টরদের সাথে দেখা হয় আমাদের।
প্রোসিমিয়ানদের থেকে ইয়োসিন যুগের শেষ ও অলিগোসিন যুগের শুরুতে বানর তথা সিমিয়ানদের উদ্ভব ঘটেছিল, যে বানরদের কেউ কেউ আফ্রিকা ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। বানররা অ্যানথ্রোপয়ডিয়া উপবর্গের প্রথম সদস্য, অর্থাৎ আমাদের বেশ নিকট আত্মীয়। এই উপবর্গের সব প্রাণীকে অ্যানথ্রোপয়েড নামেও ডাকা হয়। মানুষের কাছাকাছি বলেই নামের আগে anthro-শব্দটি রয়েছে। এসব আদিম বানরের বেশ কয়েকটি গণ সনাক্ত করা হয়েছে, Apidium ও Aegyptopithecus সর্বাধিক পরিচিত। অ্যাপিডিয়ামের আকার মোটা কাঠবিড়ালির সমান আর ইজিপ্টোপিথেকাসের আকার গৃহপালিত বিড়ালের সমান। দুই গণের সদস্যরাই সম্ভবত গাছে গাছে চড়ে বেড়াতো আর ফল ও বীজ খেয়ে বেঁচে থাকতো। আদিম প্রোসিমিয়ানদের থেকে যে বৈশিষ্ট্যগুলো তাদের আলাদা করেছে তা হল: অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক দাঁত, বড় মস্তিষ্ক, আরও সামনের দিকে তাক করা চোখ এবং শিয়ালের মত চোখা ও বড় নয় বরং সরল নাক।
ইয়োসিন ইপককে প্রোসিমিয়ান বিপ্লবের যুগ বললে অলিগোসিন ইপককে অবশ্যই সংজ্ঞায়িত করতে হবে বানর বিপ্লবের মাধ্যমে। খাদ্য সংগ্রহের দক্ষতায় সিমিয়ানরা প্রোসিমিয়ানদের হারিয়ে দিয়েছিল। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, নতুন নির্বাচনী চাপের সাথে অভিযোজন করতে গিয়ে অনেক প্রজাতিই তার পূর্বসূরীর তুলনায় আরও কার্যকরী বৈশিষ্ট্য অর্জন করে। অলিগোসিন যুগে প্রোসিমিয়ানদের সংখ্যা হ্রাসের কারণ যে সিমিয়ানদের আধিপত্য এতে সন্দেহের অবকাশ খুব কম। কারণ, কেবল সে অঞ্চলগুলোতেই অনেক প্রোসিমিয়ান দেখা যায় যেখানে বানর নেই। আর বানর ও প্রোসিমিয়ান উভয়েই যেখানে আছে সেখানকার প্রোসিমিয়ানরা সাধারণত নিশাচর হয়, যাতে রাতের বেলা যখন অপেক্ষাকৃত বুদ্ধিমান বানররা ঘুমিয়ে থাকে তখন তারা খাদ্য সংগ্রহের কাজটা সেরে নিতে পারে।
অলিগোসিন যুগে বিবর্তনের গতিপথ পরিবর্তিত হওয়া ও কম ফসিল পাওয়া দুটোর কারণই ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়। এই যুগের শুরুতে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ আলাদা হয়ে দুটো পৃথক মহাদেশের জন্ম দেয়। গঠিত হয় পূর্ব আফ্রিকার গ্রেট রিফ্ট ভ্যালি বা বৃহৎ ফাটল উপত্যকা। বিশাল কয়েকটি টেকটোনিক প্লেটের মাঝখানে অবস্থিত আগ্নেয়ভাবে সক্রিয়া ফল্ট জোন বরাবর প্রায় ১২০০ মাইল দীর্ঘ এই উপত্যকা গড়ে উঠেছিল। এর আগে ইয়োসিন যুগের শুরুর দিকে অর্থাৎ ৫.৫ কোটি বছর পূর্বে ভারত এশিয়ার সাথে ধাক্কা খায়, যার ফলে জন্ম হয় পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয় এবং এর অপর পার্শ্বে তিব্বতীয় সমভূমির। অলিগোসিন যুগে হিমালয় বায়ুপ্রবাহের জন্য একটি বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় যার ফলে পাল্টে যায় পুরো মহাদেশের জলবায়ু। এমন আরও কিছু কারণে পুরো পৃথিবীর জলবায়ুই অনেকটা বদলে গিয়েছিল সে যুগে। ইয়োসিন যুগের শেষে পৃথিবী শীতল ও শুষ্ক হতে শুরু করেছিল যা এ যুগে আরও প্রকট রূপ ধারণ করে, বিশেষ করে উত্তর গোলার্ধে। তারপরও অবশ্য ভৌগলিক তাপমাত্রা বর্তমানের চেয়ে বেশি ছিল।
এ যুগের শেষ দিকে আফ্রিকা বাকি পুরো বিশ্ব থেকে একেবারে আলাদা ছিল। সবচেয়ে নিকটবর্তী স্থলভূমি স্পেনও ছিল বিশাল সাগর দিয়ে পৃথক করা। এখানেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে গিয়ে পুরনো দুনিয়ার বানরদের অনেকগুলো প্রজাতির জন্ম হয়। বর্তমানের সকল পুরনো দুনিয়ার বানরদের কনসেস্টর সম্ভবত আজ থেকে ১.৪ কোটি বছর পূর্বে বাস করতো। এই কনসেস্টর সম্পর্কে জানার সবচেয়ে ভাল উপায় ভিক্টোরিয়াপিথেকাস নামক একটি ফসিল। ভিক্টোরিয়া হ্রদের মাকাবো দ্বীপ থেকে এই প্রজাতির একটি সম্পূর্ণ খুলি পাওয়া গেছে, এছাড়া বিভিন্ন স্থান থেকে মিলেছে কয়েক হাজার ফসিলের টুকরো। প্রায় ৩ কোটি বছর পূর্বে যদি পুরনো দুনিয়ার বানরদের জন্ম হয়েছে ধরে নেয়া হয় তাহলে বলতে হবে, অর্ধ কোটি বছরে খুব বেশি পরিবর্তিত হয়নি তারা। তারপর ২.৫ কোটি বছর পূর্বে আদিম পুরনো দুনিয়ার বানরদের কোন প্রজাতি থেকে বিবর্তিত হয়েছে প্রথম নরবানর, অর্থাৎ লেজবিহীন বানর। আমরা নিজেরাও নরবানর। ৫ম কনসেস্টর সম্ভবত পূর্বে উল্লেখিত ইজিপ্টোপিথেকাস নামক ফসিল প্রজাতিটির মতো ছিল, কিংবা হয়তোবা সে নিজেই আমাদের ৫ম কনসেস্টর।
ক্যাটিরাইনি অণুবর্গের দুটি অধিপরিবারের কথা জেনেছি আমরা- হোমিনয়ডিয়ার অন্তর্ভুক্ত সকল নরবানর আর সার্কোপিথেকয়ডিয়া সকল পুরনো দুনিয়ার বানরদের জন্য বরাদ্দ। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরু ও নিম্নমুখী নাক। এর বিপরীতে প্ল্যাটিরাইনদের নাক ছিল প্রশস্ত ও বোঁচা। কে জানে হয়তো নিম্নমুখী হওয়ার কারণে আমাদের পূর্বপুরুষদের নাকে বৃষ্টির পানি ঢুকতে পারতো না। তারা প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছিল মায়োসিন যুগে।
৪র্থ কনসেস্টর: মায়োসিন যুগের নরবানর
অলিগোসিন ইপকে টেকটোনিক প্লেটগুলোর যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল তা চলতে থাকে মায়োসিন ইপকেও। জলবায়ু পাল্টে যেতে থাকে। দিনদিন পৃথিবী শীতল ও শুষ্ক হয়, মেরুদেশীয় বরফ বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রের স্তর নিচে নেমে যায়, এতে উপকূলীয় স্থলভাগ যায় বেড়ে। এভাবেই আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে একটি সংযোগ স্থাপিত হয়, এক মহাদেশের প্রাণী অন্যটিতে যাওয়া শুরু করে। পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ক্রান্তীয় বনভূমির স্থান দখল করে নিতে থাকে শুষ্ক তৃণভূমি। এই বিষয়গুলো প্রাইমেট বিবর্তনে একটি নতুন নির্বাচনীয় চাপ সরবরাহ করে।
অলিগোসিন ইপক শেষ ও মায়োসিন ইপক শুরুর এমন একটি সময়েই নরবানরদের উৎপত্তি ঘটে। বংশবৃক্ষে আমরা দেখেছি পুরনো দুনিয়ার বানরদের শাখাটি দুই ভাগ হয়ে গেছে আড়াই কোটি বছর আগে, একটির সদস্য আধুনিক পুরনো দুনিয়ার বানররা, আরেকটির সদস্য সকল নরবানর। তারপর ১.৪ কোটি বছর আগে পুরনো দুনিয়ার বানরদের শাখাটির আরও বিভাজন ছবিতে দেখানো হয়নি কারণ মানব বিবর্তনের জন্য সেটা খুব দরকারি নয়। আমাদের চোখ রাখতে হবে নরবানর শাখাটির দিকে যা ইনসেটে আরও বিস্তারিতভাবে দেখানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর পূর্বে নরবানর শাখা প্রথমবারের মত ভাগ হয়। একটি চলে যায় গিবনদের দিকে আরেকটি হোমিনিডাই পরিবারের দিকে যার সদস্য আমরা। এ সময় আফ্রিকা এবং এশিয়ার মধ্যে কোন বাঁধা ছিল না। তাই গিবন পাওয়া যায় কেবল পূর্ব এশিয়ায়। গিবনদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে এশিয়ায় এসেছেন সেটা একটু পরেই বলছি। আপাতত গিবন ও আমাদের সাধারণ পূর্বপুরুষ অর্থাৎ ৪র্থ কনসেস্টর কেমন ছিল তা বোঝার জন্য আধুনিক গিবনদের একটু ভালভাবে লক্ষ্য করা যাক।
প্রথমত, গিবনরা ব্র্যাকিয়েশনে কতোটা দক্ষ তা আমাদের যৌথ পরিবার পর্বেই জেনেছি। কিন্তু এটা বলা হয়নি যে তারা দুই পায়েও হাঁটতে পারে। সত্যি বলতে মানুষের পরই দুই পায়ে হাঁটতে সবচেয়ে দক্ষ প্রাইমেট হচ্ছে গিবন। তারা গাছের ডালে দুই পায়ে হেঁটে বেড়ায় আর এক ডাল থেকে আরেক ডালে যেতে ব্যবহার করে ব্র্যাকিয়েশন- দুই হাত দিয়ে পেন্ডুলামের মতো ঝুলে ঝুলে মহা আনন্দে এক ডাল থেকে আরেক ডালে ঘুরে বেড়ায় তারা। ৪র্থ কনসেস্টরদেরও কি দুই পায়ে সামান্য দূর পর্যন্ত হাঁটা ও ব্র্যাকিয়েশনের ক্ষমতা ছিল? থাকার সম্ভাবনাই বেশি। হয়তো সেই আদিম দ্বিপদিতাই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ৭০ লক্ষ বছর আগের আফ্রিকান সাভানাতে যখন সত্যিকারের দ্বিপদিতার চর্চা শুরু করে আমাদের পূর্বপুরুষরা। আর আমাদের পূর্বপুরুষরা কখনো ব্র্যাকিয়েশনের মতো মজার একটা কাজ করতে পারেনি তা ভাবতেই খারাপ লাগে। আসুন ধরে নেই, আমরা এক সময় লম্বা হাত দিয়ে এক গাছ থেকে লাফ দিয়ে চলে যেতাম আরেক গাছে, আমাদের জীবন চলতো গাছের ডগায় ডগায়, আমাদের চোখ কখনো মাটির দিকে নামতো না।
গিবনদের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা জেনেছি আমরা: সুরে সুরে যোগাযোগ করা। গিবনদের বাকযন্ত্র অন্যান্য প্রাইমেটদের তুলনায় বেশ উন্নত। হয়তোবা ৪র্থ কনসেস্টরেরও এটা ছিল, এ কারণেই কি আমরা কথা বলতে এতো ওস্তাদ? একটা বিষয়ে পৃথিবীর সকল জাতির মানুষ সমান পারদর্শী, তা হল সঙ্গীত। সেই সঙ্গীতের উত্তরাধিকার কি আমরা দুই কোটি বছর আগের গিবনরূপী পূর্বপুরুষদের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম? হয়তো তাই! তবে একটা বিষয়ে আবার গিবনরা বেশ আলাদা। ওরা একেবারে বিশ্বস্ত একগামী, অন্যদিকে মানুষ এবং অন্যান্য সকল বৃহৎ নরবানর বহুগামী, এক সঙ্গী-তে আমাদের মন ভরে না। আমরা তো আবার বহুগামিতাকে আস্কারা দেয়ার জন্য কিছু ধর্মই তৈরি করেছি।
৪র্থ কনসেস্টরদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা আকারে বেশ ছোট ছিল, বর্তমান গিবনদের মতোই। আকারে বাড়া বা কমা বিভিন্ন নির্বাচনী চাপের সাথে খাপ খাওয়ানোর খুব কার্যকরী উপায়। নরবানরদের এই স্বর্ণযুগে অনেকেই আকারে ছোট হয়ে গিয়েছিল। যেমন, প্লায়োপিথেকাস নামের একটি ছোট নরবানর মায়োসিন যুগেই ইউরোপে বাস করতো, গিবনদের মত ব্র্যাকিয়েট করতে পারলেও তারা গিবনদের পূর্বপুরুষ নয়। মনে রাখতে হবে গিবন ও আমাদের কনসেস্টরই কিন্তু সকল নরবানরের কনসেস্টর। মোটামোটি নিশ্চিত যে এদের লেজ ছিল না। আরও সঠিক করে বললে, তাদের লেজের হাড় দেহের ভেতর একটি খুবই ছোট অভ্যন্তরীন লেজ গঠন করেছিল যার নাম কক্সিক্স, আমাদের দেহেও এটি আছে। একে অনেক সময় টেইলবোন বা লেজুরাস্থিও বলা হয়। লেজ হারানো নিয়ে একটু কথা বলার সবচেয়ে ভাল সময় এটাই।
আসলে স্পষ্ট ভাষায় এর উত্তর দেয়া সম্ভব না। তবে একটা সুবিধা হচ্ছে শুধু নরবানর নয় আরও অনেক প্রাণীই লেজ হারিয়েছে। যদিও লেজবিহীন প্রাইমেটদের নরবানর বলার চল আছে, তথাপি কিছু বানর এবং মাদাগাস্কারের কিছু লেমুরেরও কিন্তু লেজ নেই। লেজ হারানোর সবচেয়ে সাধারণ ব্যাখ্যা হতে পারে অপ্রয়োজনীয়তা। কোন অঙ্গের প্রয়োজনীয়তা ফুরালে সর্বোচ্চ কর্মদক্ষতার খাতিরেই তার আকার প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছোট হতে থাকার কথা। স্তন্যপায়ীদের লেজের বহুবিধ ব্যবহার আছে। যেমন, কাঠবিড়ালির লেজ বাতাসে ভর করে অনেক দূর পর্যন্ত লাফ দিতে সাহায্য করে। গেছো প্রাণীদের লেজ সাহায্য করে ভারসাম্য রক্ষায়। যারা গাছে খুব বেশি লাফালাফি করে না তাদের লেজ ছোট, যেমন লোরিস। আবার বুশবেবি লোরিসের নিকটাত্মীয় হলেও আদর্শ গেছো জীবনের জন্য তার দীর্ঘ্য লেজ আছে। বোর্নিও ও সুমাত্রায় স্থলচর মাকাকদের লেজ ছোট কিন্তু গেছো মাকাকদের লেজ দীর্ঘ্য। বানরদের মধ্যে যারা গাছে খুব সক্রিয় তাদের লেজ অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ্য। তারা ডালের উপর দিয়ে অনুভূমিকভাবে হেঁটে যায়, আর পেছনের লেজটা ভারসাম্য রক্ষার লাঠি হিসেবে কাজ করে।
কিন্তু গেছো জীবনে লেজের এতো দরকার থাকলে সারাজীবন গাছে চরে বেড়ানো গিবনদের লেজ নেই কেন? উত্তর সম্ভবত নিহিত আছে গাছে চলাফেরার ভঙ্গিতে। অধিকাংশ নরবানরই একটু হলেও দুই পায়ে হাঁটতে পারে। গিবনরা ডালের উপর হাঁটাচলা করে দুই পায় এবং তখন দুই হাতকে ভারসাম্য রক্ষার কাজে ব্যবহার করতে পারে। আসলে যেকোন দ্বিপদীর জন্যই লেজ একটা অপ্রয়োজনীয় অঙ্গ এবং হয়তো বিরক্তিকরও। তাছাড়া গিবনরা এক ডাল থেকে আরেক ডালে লাফ দেয়ার সময় দেহটি উল্লম্ব অবস্থানে রাখে, অন্যদিকে বানররা রাখে অনুভূমিক অবস্থানে। তাই গিবনদের ক্ষেত্রে লেজ ভারসাম্য রক্ষার পরিবর্তে উল্টো তাকে নিচের দিকে নামিয়ে ফেলতে চাইবে। কারণ উল্লম্বভাবে লাফ দিলে লেজটা থাকবে নিচের দিকে। সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় লেজের ভাগ্যে তাই হয়তো বিলুপ্তি ভিন্ন অন্য কোন পথ খোলা ছিল না।
৩য় কনসেস্টর: এশিয়া জয়ের নায়ক
১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর পূর্বে মায়োসিন যুগের একেবারে মাঝামাঝি সময়ে মানুষ, শিম্পাঞ্জি, গরিলা এবং ওরাংওটাং এর সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ৩য় কনসেস্টর পৃথিবীতে বিচরণ করছিল। আণবিক জীববিদ্যা থেকে এর বেশ শক্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু এই পূর্বপুরুষ ঠিক কোথায় বাস করতো তা এক কথায় বলে দেয়া সম্ভব না।
তখন বর্তমান তুষার যুগ কেবল শুরু হচ্ছিল, তারপরও জলবায়ু বেশ উষ্ণ ছিল এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বর্তমানের চেয়ে একটু বেশিই ছিল। এ কারণে আফ্রিকা ও এশিয়া সংযোগভূমি এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের কিছু অংশ মাঝেমাঝে পানিতে ডুবে যাচ্ছিল আবার ভেসে উঠছিল। গিবন ও আমাদের কনসেস্টরের জন্য যেমন আফ্রিকা ও এশিয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না এবার আর নিরবচ্ছিন্নভাবে তেমনটি সম্ভব না। শিম্পাঞ্জি ও গরিলাদের সাথে আমাদের গভীর সম্পর্ক মাত্র কয়েক দশক আগে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর আগে বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা এশীয় ও আফ্রিকান নরবানরদের সাথে একই পরিমাণ সম্পর্কিত। এশিয়ার পক্ষে যুক্তি ছিল, মায়োসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত সেখানে প্রচুর নরবানরের ফসিল পাওয়া গেছে। তাই মায়োসিনের শেষ দিকে আমাদের পূর্বপুরুষরা এশিয়াতেই বাস করতো বলে মনে করতেন অধিকাংশ বিজ্ঞানী। কেউ কেউ আবার রামাপিথেকাস নামক একটি এশীয় ফসিল গণকে আমাদের পূর্বপুরুষ হিসেবে আখ্যাই দিয়ে দিয়েছিলেন। পরে জানা গেছে আরও আগে সিভাপিথেকাস নামের যে ফসিল পাওয়া গিয়েছিল তার সাথে রামাপিথেকাসের কোন পার্থক্য নেই। বর্তমানে দুটিকে বোঝাতে কেবল সিভাপিথেকাস নামটিই ব্যবহৃত হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন পরে বোঝা গেছে সিভাপিথেকাস আমাদের তুলনায় ওরাংওটাংদের পূর্বপুরুষের সাথে বেশি সম্পর্কিত, এমনকি সে তাদের সরাসরি পূর্বপুরুষও হতে পারে।
এছাড়া আরও কিছু এশীয় ফসিল ছিল। যেমন, জাইগান্টোপিথেকাস ছিল সিভাপিথেকাসের একটি স্থলচর ও বড় সংস্করণ। এক সময় Ouranopithecus এবং Dryopithecus মানুষের পূর্বপুরুষ হতে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। কিন্তু জিনতত্ত্ব এসে তাদেরকে হারিয়ে দিল। আণবিক পরীক্ষা নীরিক্ষা শেষে বিজ্ঞানীরা বললেন গরিলা ও শিম্পাঞ্জিরাই আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয়। আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও এদের দেখা যায় না। তাই আফ্রিকার পক্ষেই রায় দিলেন বিজ্ঞানী সমাজ। এশিয়াকে সবাই ভুলেই গেলেন বলা যায়। কিন্তু সমস্যা হল মায়োসিন যুগের মাঝামাঝি থেকে শেষ পর্যন্ত আফ্রিকায় প্রাইমেট ফসিলের অভাব। সেখানে মায়োসিন যুগের শুরুতে নরবানরের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। আফ্রিকায় সে সময়কার প্রোকনসাল গণের অনেকগুলো প্রজাতির ফসিল পাওয়া গেছে। এছাড়া আছে আফ্রোপিথেকাস ও কেনিয়াপিথেকাসের ফসিল। কিন্তু তার পর গঠাৎ কেন হারিয়ে গেল সব ফসিল? তাও বিজ্ঞানীরা হাল ছাড়লেন না; বললেন, আমাদের বিবর্তনের পুরো ইতিহাসটাই আফ্রিকাতে, মাঝখানের এই সময়টার ফসিল কোন কারণে সংরক্ষিত হয়নি।
১৯৯৮ সাল পর্যন্ত অবস্থা এমনই ছিল। কিন্তু সে বছর মার্কিন জীববিজ্ঞানী সি বি স্টুয়ার্ট ও টড ডিসোটেল “Primate evolution- in and out of Africa” নামে একটি সাড়া জাগানিয়া গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। এতে দাবী করা হয় চিরকাল আফ্রিকাই আমাদের সূতিকাগার ছিল এটা ঠিক নয়। এর বদলে ২ কোটি বছর আগে নরবানরদের একটি দল আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল যারা বর্তমানে জীবিত ওরাংওটাং ও গিবন সহ সকল এশীয় নরবানরের জন্ম দিয়েছে। ওরাংওটাং ও গিবনরা এশিয়ায় থেকে গেলেও ১ কোটি বছর পূর্বে সেখান থেকে নরবানরদের আরেকটি দল পুনরায় আফ্রিকাতে ফিরে এসেছে। সেই অনুকল্পই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য যেটি সবচেয়ে কম স্বতঃসিদ্ধের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি ব্যাখ্যা দিতে পারে। (ডকিন্সের মতে এই বিচারে চার্লস ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব পৃথিবীর সেরা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব।)
আপাতদৃষ্টিতে ‘চিরকাল আফ্রিকায় ছিল’ অনুকল্পটি কম স্বতঃসিদ্ধ গ্রহণ করেছে বলে মনে হয়। কিন্তু এমন মনে হওয়ার কারণ শুধু আমাদের পূর্বপুরুষদের কথা বিবেচনা করা। এর বদলে ফসিল প্রজাতিসহ সকল নরবানরের পূর্বপুরুষ বিবেচনায় নিলে দেখা যায় পরিস্থিতি ভিন্ন। এই উদ্দেশ্যে স্টুয়ার্ট ও ডিসোটেল প্রথমেই ফসিল প্রজাতিসহ এখন পর্যন্ত জানা সকল নরবানরের একটি বংশবৃক্ষ তৈরি করেন। তারপর কোন নরবানরটি কোন মহাদেশের বাসিন্দা তা সনাক্ত করেন। নিচে তাদের ছবিটি দেখানো হয়েছে: লাল দ্বারা আফ্রিকান প্রজাতি ও কালো দ্বারা এশীয় প্রজাতি বোঝানো হয়েছে। পাশাপাশি তারা পুরনো দুনিয়ার বানরদেরও এই ছবিতে যোগ করেন যারা আড়াই কোটি বছর আগেই নরবানরদের থেকে পৃথক হয়ে গিয়েছিল। অভিপ্রয়াণের ঘটনাগুলো তীর চিহ্ন দ্বারা দেখানো হয়েছে। বৃত্তের ভেতরও আলাদাভাবে সময়সীমা উল্লেখ করা হয়েছে।
ছবি থেকে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে এই অনুকল্প সত্য হতে হলে মাত্র দুটি স্বতঃসিদ্ধ অর্থাৎ দুটি অভিপ্রয়াণ ধরে নিতে হয়:
১। ২ কোটি বছর আগে আফ্রিকান নরবানরদের একটি গোষ্ঠী এশিয়া গিয়ে বর্তমানের সকল এশীয় নরবানরের জন্ম দিয়েছে।
২। ১ কোটি বছর পূর্বে আবার এশিয়া থেকে কিছু নরবানর আফ্রিকায় ফিরে এসে বর্তমান আফ্রিকান নরবানরদের জন্ম দিয়েছে। ২ কোটি বছর আগে যেসব নরবানর আফ্রিকায় থেকে গিয়েছিল তারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অন্যদিকে ‘চিরকাল আফ্রিকায় ছিল’ অনুকল্প সত্য হতে হল ছয়টি অভিপ্রয়াণ ঘটনা ধরে নিতে হয় যার সবগুলোই আফ্রিকা থেকে এশিয়ার দিকে, ছবি থেকেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। যেকোন দিকে যদি যাওয়া যায় তাহলে নরবানররা কেন শুধু একদিকে যাবে সেটাও এক প্রশ্ন। যাহোক অভিপ্রয়াণগুলো হচ্ছে:
১। ১ কোটি ৮০ লক্ষ বছর আগে গিবন
২। ১ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে অরিওপিথেকাস
৩। দেড় কোটি বছর আগে লুফেংপিথেকাস
৪। ১ কোটি ৪০ লক্ষ বছর আগে সিভাপিথেকাস এবং ওরাংওটাং
৫। ১ কোটি ৩০ লক্ষ বছর আগে ড্রায়োপিথেকাস
৬। ১ কোটি ২০ লক্ষ বছর আগে আউরানোপিথেকাস
ছয়টি একমুখী অভিপ্রয়াণের তুলনায় দুইটি দ্বিমুখী অভিপ্রয়াণ ডকিন্সের মত আমাদের কাছেও বেশি গ্রহণযোগ্য ঠেকছে। তবে এই অনুকল্প সত্যি হতে হলে প্রথমে বংশবৃক্ষটিকে পুরোপুরি ঠিক হতে হবে এবং সেটা আসলেই করা সম্ভব কিনা তা প্রশ্নের অপেক্ষা রাখে। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির রিচার্ড ক্লাইন তো একটি পাঠ্যবইয়ে দাবী করে বসেছেন যে, আমাদের পূর্বপুরুষ অস্ট্রালোপিথেকাস প্রজাতিটি আফ্রিকান কেনিয়াপিকাসের তুলনায় এশীয় আউরানোপিথেকাসের বেশি কাছাকাছি। এটা সত্যি হলে বংশবৃক্ষ গোলমেলে হয়ে যাবে। অ্যানাটমি অনুসারে ক্লাইনের কথায় কিছুটা সত্যতা থাকলেও ভাগ্য ভাল যে অন্তত ভূগোল ও মরফোলজি অনুসারে তার সত্যতা পাওয়া যায় না। তাই এখনও স্টুয়ার্ট-ডেসোটেলের আসা-যাওয়া তত্ত্বকে বেশি গ্রহণযোগ্য ধরে নেয়া যায়। ভবিষ্যতে কোনটা সত্য হয় সে নাহয় ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাকলো। তবে ভবিষ্যতের পাঠকদেরকে অনুরোধ করব আমাদের বইয়ের এই অংশটা একটু সতর্কতার সাথে পড়তে। আপাতত আমরা ঘোষণা দিয়ে দিচ্ছি, সকল বৃহৎ নরবানরের (গিবন, গরিলা, ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি, মানুষ) কনসেস্টর তথা সাধারণ পূর্বপুরুষ এশিয়াতেই বাস করতো।
২য় কনসেস্টর: জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনকারী
স্টুয়ার্ট-ডিসোটেলের তত্ত্ব অনুসারে ১ কোটি বছর আগে এশিয়া থেকে নরবানররা আফ্রিকায় ফিরে আসে এবং আফ্রিকার নতুন পরিবেশে তাদের থেকে নতুন সব প্রজাতির উদ্ভব ঘটে। এরপর ৭০ লক্ষ বছর আগে প্রাণবৃক্ষে আমাদের শাখা থেকে গরিলাদের শাখাটি আলাদা হয়ে যায়। তখনো উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মিলেনি, আন্দিজ পর্বতমালা তখনো এতোটা উঁচু হয়নি। তারপরও মহাদেশগুলোকে দেখতে অনেকটা আজকের মতোই লাগতো, আফ্রিকার জলবায়ু আরেকটু সিক্ত হলেও আগের চেয়ে খুব বেশি আলাদা ছিল না। আফ্রিকাতে তখন বনভূমির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল, এমনকি বর্তমান সাহারা মরুভূমিতেও তখন কিছুটা সবুজের ছোঁয়া মিলতো।
প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ, গরিলা ও শিম্পাঞ্জির সাধারণ পূর্বপুরুষ তথা ২য় কনসেস্টরের সাথে এই তিনটি প্রজাতির মধ্যে কোনটির মিল সবচেয়ে বেশি? মানুষের মত হওয়াটা বেশ অস্বাভাবিক হবে কারণ তখনো মানবীয় বৈশিষ্ট্য দেখা দিতে শুরু করেনি। আর গরিলা সাধারণ নরবানরদের তুলনায় একটু বেশিই দানবীয়। কনসেস্টরের এতোটা ব্যতিক্রমী হওয়ার কথা না। সে হিসেবে তার শিম্পাঞ্জির মত হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি। তবে গরিলার অতিকায় দেহই শেষকথা নয়, এর চেয়ে বড় প্রাইমেটও এক সময় পৃথিবীতে বাস করেছে। চীনের জাইগান্টোপিথেকাস গণের সদস্যরা গরিলার পাশে দাঁড়ালে তাদের কাঁধ ও মাথা গরিলার মাথার উপরে থাকতো। মাত্র ৫ লক্ষ বছর পূর্বে এরা বিলুপ্ত হয়েছে। এত সাম্প্রতিক দেখে অনেকে এমনকি দাবী করে বসেছিলেন ইয়েতি নামক হিমালয়ের তুষারমানবদের যে পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে তা জাইগান্টোপিথেকাসকেই নির্দেশ করে। কিন্তু সেটা খুবই অসম্ভব, কারণ ৫ লক্ষ বছর আগে তিব্বত বা নেপালে মানুষের সমগোত্রীয় কোন প্রজাতি ছিলই না।
সূর্যের আলোর প্রভাবে কিভাবে গায়ের রং পরিবর্তিত হয় তা আমরা আরেক অধ্যায়ে দেখব। এখানে এটুকু বলে রাখছি যে, সূর্যের আলো বেশি পড়লে অতিবেগুনি রশ্মি থেকে বাঁচতে গায়ের রং কালো হয়ে যায়। সুতরাং আফ্রিকার এই ২য় কনসেস্টরদের গায়ের রং যে গরিলা, শিম্পাঞ্জি ও আফ্রিকান মানুষদের মতোই কালো ছিল তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। শিম্পাঞ্জি ও গরিলার মতোই সম্ভবত তারা হাতের আঙুলের গাঁটে ভর করে হাঁটতো। শিম্পাঞ্জিদের মতো রাতের কিছুটা সময় তারা গাছেও কাটাতো, বিশেষ করে রাতের বেলায়। বনভূমির অভাব ছিল না বলেই হয়ত ৭০ লক্ষ বছর আগে গরিলারা নিজেদের দেহের আকার বাড়াতে কোন কার্পণ্য করেনি।
১ম কনসেস্টর: জেইন গুডলের হোমিনিন
আমরা প্রাণবৃক্ষে মানুষের নিজস্ব শাখাটির খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। বাকি আছে কেবল আমাদের নিটকতম আত্মীয়দের কথা। জিনতত্ত্ব অনুসারে শিম্পাঞ্জিরাই আমাদের সবচেয়ে নিকটাত্মীয়। মানুষের গণ হোমো এবং শিম্পাঞ্জির গণ প্যান এর সকল সদস্যদেরকে হোমিনিন বলা হয়। আনুমানিক ৬০ লক্ষ বছর আগে ১ম কনসেস্টরের শাখা থেকে দুটো প্রশাখায় বের হয় যার একটিতে আছে সাধারণ শিম্পাঞ্জি ও বনবো শিম্পাঞ্জি, আর অন্যটিতে আধুনিক মানুষ। তবে এই তারিখ নিয়ে বিতর্ক আছে। ৫০ থেকে ৭০ লক্ষ বছর আগের যে কোন সময় এটা হতে পারে। ৩০ লক্ষ বছর আগে শিম্পাঞ্জির শাখাটি দুই ভাগে ভাগ হয়েছিল যা থেকে জন্ম হয়েছে বর্তমান দুটি শিম্পাঞ্জি প্রজাতির। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে ফসিলের মাধ্যমে আমাদের কনসেস্টর থেকে শিম্পাঞ্জির বিবর্তন ইতিহাস একেবারেই জানা যায়নি। মানুষের পূর্বপুরুষদের অনেক ফসিল মিললেও তাদের সমসাময়িক শিম্পাঞ্জির একটি ফসিলও পাওয়া যায়নি। এর কারণ হতে পারে, শিম্পাঞ্জিরা বনের প্রাণী, এবং বনের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা গাছের পাতা ফসিল সংরক্ষিত হতে দেয় না।
তবে শিম্পাঞ্জিদের দুই প্রজাতিতে ভাগ হয়ে যাওয়ার একটি কারণ আমরা দাঁড় করাতে পারি। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের প্রতি বেশি সৎ থাকলে বলতে হয়, কোন সাধারষ পূর্বপুরুষ থেকে দুটি ভিন্ন প্রজাতি উদ্ভবের একটি অন্যতম শর্ত হচ্ছে পূর্বপুরুষদের দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে ভৌগলিক ব্যবধান সৃষ্টি যাতে এক অংশের সদস্যরা অনেক সময় ধরে অন্য অংশের সাথে মিশতে না পারে। অন্যথায় দুয়ের মধ্যে যৌন প্রজননের মাধ্যমে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে। ২০-৩০ লক্ষ বছর আগে এমনই একটি ভৌগলিক বাঁধ শিম্পাঞ্জির দুটি গোষ্ঠীকে আলাদা করে দিয়েছিল। বাঁধটি ছিল প্লাইস্টোসিন যুগে অর্থাৎ আনুমানিক ২০ লক্ষ বছর আগে সৃষ্টি হওয়া কঙ্গো নদী। বর্তমানে সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের কেবল কঙ্গো নদীর উত্তরে এবং বনবোদেরকে কেবল নদীটির দক্ষিণে পাওয়া যায়।
এমনই আরেকটি বাঁধ মানুষ ও শিম্পাঞ্জির কনসেস্টরদের দুটি গোষ্ঠীকে প্রায় ৬০ লক্ষ বছর আগে আলাদা করে দিয়েছিল বলে দাবী করেছিলেন অনেকে। এবার বাঁধ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল পূর্ব আফ্রিকার সেই গ্রেট রিফ্ট ভ্যালিকে। শিম্পাঞ্জিদেরকে এই উপত্যকার কেবল পশ্চিমে পাওয়া যায় এটা ঠিক। ফরাসি জীবাশ্মবিদ Yves Coppens এভাবে দুটি প্রজাতি সৃষ্টির ঘটনার একটা আকর্ষণীয় নামও দিয়েছিলেন- ইস্ট সাইড স্টোরি, অবশ্যই হলিউডের বিখ্যাত মিউজিক্যাল কমেডি সিনেমা ওয়েস্ট সাইড স্টোরির নামানুসারে। কিন্তু ইভেসের এই গল্প বোধহয় গল্পই থেকে গেছে, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের মর্যাদা পেতে পারেনি। কারণ, রিফ্ট ভ্যালির অনেক পশ্চিমে সেই চাঁদে সাহেলানথ্রোপাস নামে একটি হোমিনিড ফসিল পাওয়া গেছে। এর পরে চাঁদে অস্ট্রালোপিথেকাস গণের একটি প্রজাতিও আবিষ্কৃত হয়েছিল। তাই মানুষ ও শিম্পাঞ্জির শাখা আলাদা হয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ইস্ট সাইড স্টোরির চেয়ে ভাল ব্যাখ্যা লাগবে। সেই ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত গতি নেই।
মানব বিবর্তন শুরুর একেবারে দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছি আমরা। এই মুহূর্তে শিম্পাঞ্জি ও মানুষের কনসেস্টর সম্পর্কে আরেকটু জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। সেই একই প্রশ্ন আবার করতে পারি- সে দেখতে কার মত বেশি ছিল। আমাদের ধারণা শিম্পাঞ্জির মতোই বেশি ছিল, কারণ প্রাইমেট জগতে গরিলার মত মানুষও ব্যতিক্রম, মানুষ বোধহয় একটু বেশিই ব্যতিক্রম। তাই কোন কনসেস্টরের অপেক্ষাকৃত টিপিক্যাল প্রজাতিটিরই বেশি কাছাকাছি হওয়ার কথা। মানবীয় অধিকাংশ বৈশিষ্ট্যই এসেছে মানুষের শাখাটি আলাদা হয়ে যাওয়ার পর। তাই বলা যায়, আমাদের প্রথম কনসেস্টরটির গায়ে শিম্পাঞ্জির মত লোম ছিল, সে আঙুলের গাঁটে ভর করে হাঁটতো, কিছুটা সময় গাছে কাটালেও তার অধিকাংশ সময় কাটতো মাটিতে। তার মস্তিষ্ক ছিল শিম্পাঞ্জির সমান এবং আফ্রিকা ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও তার অস্তিত্ব ছিল না। সে সর্বভুক হলেও ফলের প্রতি একটু বেশি আসক্ত ছিল।
কনসেস্টরদের কিছুটা পরিচয় ধরে রাখার কৃতিত্ব যেমন শিম্পাঞ্জিদের তেমনি সেই পরিচয়টুকু আরেক উত্তরসূরী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কৃতিত্ব জেইন গুডলের, যিনি মানুষ হয়েও শিম্পাঞ্জিদের পরমাত্মীয়। এ প্রসঙ্গে ব্লগার তারেক অণুর একটি কথা যেন আমাদের সবার অনুভূতি প্রকাশ করে, “জেইন গুডল নামটি কানে প্রবেশ করলেই যে ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা একজন স্বর্ণকেশী তরুণীর, আলগোছে বসে সামনের দিকে একটি হাত আলতো বাড়িয়ে দিয়েছেন, তার মুখমণ্ডল খুব একটা দৃশ্যমান নয়, তার বাড়িয়ে দেয়া হাত ছোঁয়ার জন্য একটি আবেগি হাত ইতস্তত বাড়িয়ে দিয়েছে অপরপ্রান্ত থেকে এক শিশু শিম্পাঞ্জী, তার মুখে যাবতীয় অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ। বিশেষ করে সব কিছু ছাপিয়ে কৌতূহল আর সেই তরুণীর প্রতি তার বিশ্বাস ফুটে ওঠে চোখের তারা দুটোয়। এটিই সম্ভবত মানুষ এবং বুনো প্রাণীর সহাবস্থানের সবচেয়ে বিখ্যাত আলোকচিত্র।”
শিম্পাঞ্জিদের সাথে পরিচিত হওয়ার সময় আমরা তাদের যেসব কর্মকাণ্ড দেখেছি তার সবই প্রথম আবিষ্কার করেছেন জেইন গুডল। তিনি মানুষকে প্রথম জানিয়েছিলেন, শিম্পাঞ্জিরা শিকার করে, এক দল আরেক দলের সাথে যুদ্ধ করে, কাঠি দিয়ে ফাঁদ পেতে পোকা ধরে। বনের একেক অংশের শিম্পাঞ্জিদের একেক ধরণের কৌশল দেখেছিলেন তিনি, কোন গোষ্ঠীর শিম্পাঞ্জিরা কাঠি দিয়ে পোকা ধরে, কোন গোষ্ঠীর সদস্যরা আবার পাথরের টুকরো দিয়ে বাদামের খোসা ছাড়ায় যার বর্ণনা আমরা আগেই পেয়েছি। দেখা যাচ্ছে তাদের কৌশলগুলো পুরোই সাংস্কৃতিক। বিভিন্ন অঞ্চলের চাহিদা ও সেখানতার শিম্পাঞ্জিদের ক্ষমতা অনুসারে হাতিয়ারের ব্যবহার বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। মানুষের হাতে বন্দি বনবোদেরকেও হাতিয়ার ব্যবহার করতে দেখা যায়। বনের বনবোরা এমনটি করে কিনা তা জানা যায়নি কারণ তাদেরকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য কোন জেইন গুডল ছিলেন না। তবে বন্দিদশায় করলে বনভূমিতে না করার কোন কারণ নেই। শিম্পাঞ্জির দুটি প্রজাতিই যদি সক্রিয়ভাবে হাতিয়ার ব্যবহার করে তাহলে বলা যায় আমাদের ১ম কনসেস্টরও তা করতো।
এক সময় শিম্পাঞ্জির কোন প্রজাতির সাথে আমাদের মিল বেশি এ নিয়ে কানকথা ছড়িয়েছিল। বনবোদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যৌনতার ব্যবহার। ডাচ প্রাইমেটবিদ ফ্রান্স ডে ভাল সুন্দরভাবে বলেছিলেন, “শিম্পাঞ্জিরা যৌনজীবনের সমস্যা নিরসন করে ক্ষমতা দেখিয়ে আর বনবোরা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিরসন করে যৌনতা দিয়ে”। আমরা যেমন সামাজিক লেনদেনের কাজে মুদ্রা ব্যবহার করি বনবোরা তেমন লেনদেনের জন্য ব্যবহার করে সেক্স। এবং সেক্সে তাদের কোন বাছবিচার নেই। সমকাম, উভকাম, শিশুকাম সবকিছুই তাদের সমাজে অবশ্য করণীয়। বন্দি স্ত্রী বনবোদের মাঝে সমকামের বর্ণনা দিয়েছিলেন ডে ভাল। উপরের স্ত্রী বনবো দুই হাত ও দুই পায়ে ভর করে দাঁড়ায়, নিচ থেকে আরেকটি স্ত্রী বনবো দুই হাত ও পা দিয়ে উপরের জনকে জড়িয়ে ধরে। এরপর দুজনে দুজনের যৌনাঙ্গ ঘষে। সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের সমাজ কঠোর পিতৃতান্ত্রিক এবং সেখানে যৌনতা বেশ নিয়ন্ত্রিত। এর বদলে বনবোদের মুক্ত যৌনতা দেখে অনেকে দাবী করে বসেছিলেন মানুষের সাথে সাধারণ শিম্পাঞ্জির তুলনায় বনবোদের মিল বেশি। যারা দাবী করেছিলেন তারা কতোটা মুক্ত সমাজে বাস করেন তা আমাদের জানা নেই, কিন্তু আশপাশ দেখে মনে হয় মানব সমাজ সাধারণ শিম্পাঞ্জিদের চেয়েও বদ্ধ। আর সত্যি বলতে দুটি প্রজাতির সাথে আমাদের সম্পর্ক সমান সমান।
বনবোদের উদার প্রেম, শিম্পাঞ্জিদের চতুর সংস্কৃতি, বেবুনদের হারেম, গিবনদের সঙ্গীত, মাকাকদের বর্ণবিদ্বেষ ইত্যাদি দেখে আমরা সকল প্রাইমেট প্রজাতির সাথে এক ধরণের একাত্মতা অনুভব করেছিলাম। এবার প্রাইমেটদের বিবর্তনের ইতিহাসটা জানার পর সেই একাত্মতার কারণটাও বোঝা গেল। আমরা এসেছি বিবর্তনের পথ ধরে, আমরা হলাম গিয়ে খাঁটি প্রাইমেট, আর আমরা কোথায় চলেছি সেটা বোধহয় আর প্রকৃতির হাতে নেই। কোথায় যাব সেটা নির্ধারণের ক্ষমতা এখন আমাদেরই আছে। এতোটা ক্ষমতাবান হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই আমরা প্রকৃতিরই সৃষ্টি এবং প্রকৃতির কাছে অনেক দিক দিয়েই অসহায়, আমরা চাইলেই সমুদ্রের নিচে বা মহাশূন্যে শ্বাস নিতে পারি না, আমরা চাইলেই এক তারা থেকে লাফ দিয়ে আরেক তারার দেশে চলে যেতে পারি না। তাই কোথায় যাব সেই সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে নিজেদের ইতিহাস জানা প্রয়োজন, সেই সাথে প্রয়োজন প্রকৃতিকে বোঝা এবং প্রকৃতিতে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে সতর্ক থাকা। নইলে অন্ধকারে হাঁটতে গিয়ে ফাঁদে পড়বো না তার নিশ্চয়তা কী? সেই সতর্কতা, সচেতনতা আর প্রজ্ঞা সৃষ্টিই হোক আমাদের এই বিবর্তন পাঠের উদ্দেশ্য।
তথ্যসূত্র
১। Richard Dawkins, “The Ancestor’s Tale”, Widenfeld & Nicolson
২। Connie Barlow, “Greet the Concestors: A Pilgrimage to Celebrate the Bonds of Kinship with All Life“, 2005
৩। Jan Klein, Naoyuki Takahata, “Where Do We Come From: The Molecular Evidence for Human Descent”, Springer 2002
৪। Peter Ward, “Impact From the Deep“, Scientific American, October 2006
৫। The First Primates, ANTHROPOLOGY TUTORIALS, Palomar College
৬। Roger Lewin, “Human Evolution: An Illustrated Introduction”, ৫ম সংস্করণ। অধ্যায় ১০: Primate Heritage
৭। Caro-Beth Stewart, Todd R. Disotell, “Primate evolution — in and out of Africa“, Current Biology, 1998
৮। তারেক অণু, “প্রিয় মুখ-১ : জেন গুডাল“, সচলায়তন, এপ্রিল ২৫, ২০১২
@শিক্ষানবিশ
কি যেন খুঁজতে জ্ঞানঘরে ঠুকেছিলাম, পড়ল এটা সামনে ,পড়তে শুরু করে শেষে এসে আর মনেই পড়ছে না আমি কী যেন খুঁজতে এসেছিলাম। অসাধারণ! অসাধারণ!
এক কথায় অসাধারণ। (Y)
ওয়াও! হ্যাট্স অফ শিক্ষানবিস – আই মিন শিক্ষাগুরু।
অসাধারণ লিখেছেন। আপনার লিখার মান অনেক ভালো। চালিয়ে যান। শুভকামনা রইলো।
ডকিন্সের দি অ্যানসেস্টরস টেইল বই অনুসরণ করে লেখার কারণে এই অংশটা একটু ব্যাক ডেটেড হয়ে গেছে। ৮ম কনসেস্টর এর একটা চমৎকার ফসিল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে ২০০৭ সালে, দ্বিপদী নাম Darwinius masillae আর ডাকনাম Ida. জার্মানির Messel Pit এ পাওয়া ৪.৭ কোটি বছর আগের এই ফসিল নিয়ে প্রাইমেট বিষয়ক একটা আলাদা পর্ব আসছে শীঘ্রই। কারণ:
– এর আবিষ্কারের কাহিনী খুব মজার
– ফসিলটা হতে পারে সকল প্রাইমেটের সাধারণ পূর্বপুরুষ বা ৮ নং কনসেস্টর
– সবচেয়ে বড় কথা এ নিয়ে অ্যাটেনবুড়োর প্রামাণ্য চিত্র আছে:
সরি। এটা ৮ম নয়, ৬ষ্ঠ কনসেস্টর। অর্থাৎ সকল নরবানর ও বানরদের সাধারণ পূর্বপুরুষ এই ইডা।
চমৎকার! বাংলায় বিবর্তনের ওপরে এই ধরনের প্রাথমিক বিষয় নিয়ে হৃদয়গ্রাহী লেখার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। বন্যা আহমেদের ক্লাসিক বইটার (বিবর্তনের পথ ধরে) জনপ্রিয়তা তাই প্রমাণ করে। শিক্ষানবিসের লেখাও প্রাঞ্জল। বিবর্তনের দূরূহ বিষয় নিয়ে এমন সহজপাঠ্য লেখা খুব একটা দেখা যায় না। জ্ঞানপিপাসু বাঙালি পাঠকদের জন্য দারুন উপহার শিক্ষানবিসের এই সিরিজটা। আমি একটা বই-এর সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছি এর মাঝে। শুভকামনা রইলো।
মন্তব্যর জবাব দেব না আমি নিজে জবাব দেবঃ- তোদের যুক্তি গুলো তার ছেরা যুক্তি তা না এ ধরনের লেখা লিখতে পারতি না। পৃথিবীতে এত সামন্জস্য দেখে মনে হয় না সব কিছুর পিছনে একজন স্রষ্টার হাত আছে
@sumon,
আর এতো অসামঞ্জস্য দেখে আপনার কেন মনে হয় না কোনো স্রষ্টা নেই? কেন এত বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়, কেন সদ্যজাত শিশুর মা শিশুকে অসহায় অবস্থায় রেখে মারা যায়, কেন দালান ধ্বসে হাজারো নিরপরাধ মানুষ মারা যায়, ভূমিকম্পে-ঘূর্ণিঝড়ে লাখো মানুষ মারা যায়?
মহাবিশ্ব একটা বিশৃঙ্খলাপূর্ণ জায়গা, এখানে এমনকি গ্যালাক্সির সাথে গ্যালাক্সিরও সংঘর্ষ হয়।
একদম চমৎকার লেখা যাকে বলে। (Y)
চালিয়ে যাও।
মুক্তমনায় কখনই মন্তব্য করার সাহস হয়ে ওঠেনি। আজও নেই। শুধু লেখকের কাছে একটা প্রশ্ন নিয়ে এসেছি। এত গুছিয়ে লেখার রহস্যটা কি? দয়া করে জানালে কৃতজ্ঞ থাকব। কেন জানতে চাচ্ছি জিজ্ঞেস করলে এটুকুই বলব, আপনার এই লেখা দুটো আমি পড়িনি; দেখেছি।
এই মাত্র পড়ে শেষ করলাম। চমৎকার।
পরবর্তী পর্বে অপেক্ষায়।
অসাধারন লেখা …… পাগলের মতো পড়লাম….।
ফাটাফাটি লেখা। কয়েকবার পড়তে হবে। পড়তে পড়তে ঘোরের মধ্যে চলে গেছিলাম।
অনেক দিন ধরে এরকম একটা সিরিজের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। সত্যি বলতে গেলে ভাবছিলাম কেউ কি এভাবে ধারাবাহিক ভাবে গুছিয়ে এনে বিষয় টাকে নিয়ে লিখবে না? … শেষতক আজকে দেখে খুব ভাল লাগলো। সত্যিই অসাধারণ। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুক্তমনার আরও একটি ‘মুক্তা-মানিক্য’ লেখা। কেউ যদি বিজ্ঞানের সর্বশেষতম ধ্যান-ধারনার সাথে পরিচিত হতে চায়, নিতে চায় সহজ পাঠ, তাহলে মুক্তমনার কোন বিকল্প আছে বলে মনে হয় না!
পরিশ্রম করে এমন একটি অসাধারণ লেখা উপহার দেয়ার জন্য লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ! (F)
ভাই একসাথে বেশী খাওয়াইলে পরে বদ হজম হয়ে যাবে
সত্যিতো এভাবেতো কখনও ভেবে দেখেনি! আমরা (মানুষ) কিভাবে টিকে থাকবো? কিভাবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করবো? সেটা এখন অনেকটাই মানুষ নামের প্রাণীটার উপর নির্ভর করছে। যেটা ইতিপূর্বে অন্য কোন প্রজাতির পক্ষে সম্ভব ছিলনা। ইতিপূর্বে সব প্রাণীই ছিল প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল যার ফলে প্রকৃতির খেয়ালে সৃষ্টি হয়েছিল আবার প্রকৃতির খেয়ালে হারিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যে প্রকৃতিকেও ক্ষেত্র বিশেষ বশেঃ আনতে পারে। বন্যা আহমেদের “বিবর্তনের পথ ধরে” পড়ে যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম তেমন আপনার লেখা পড়ছি আর মুগ্ধ হচ্ছি। সব সময়ই আপনার লেখার অপেক্ষায় থাকবো আর বন্যা আপার লেখার প্রতিক্ষায়….
Onek Sundor Hoise
শিক্ষানবিস, ঘটনা কী তোমার? সকাল থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে তোমার প্রথম পর্বটা পড়ার চেষ্টা করতেসি, অপূর্ব একটা লেখার স্টাইল হইসে এইটা, শেষ করার আগেই আরেক পর্ব!!!! তোমার লেখার মান দেখে এখন ভয় লাগতেসে, তোমার সাথে বইটা লেখা ঠিক হবে কিনা বুঝতেসি না ঃ)। তবে, যারা তোমাকে দুইটা লেখা পরপর দিতে নিষেধ করে তাদের কথা শুইনোনা, তুমি এই গতিতে লিখলেই জাতি আগাবে, বই হবে… :lotpot: ।
আমি নিশ্চিত এতো ভাল হয় নাই, উৎসাহ দেয়ার জন্য বলতেছেন।
এরপরে আপনার লেখা না পেলে আমি কিন্তু পরেরটা আর পোস্ট করতেছি না। অবশ্য পরেরটা লিখতে কতোদিন লাগে কে জানে।
অই মিয়া, আস্তে আস্তে খাওয়াও। তোমার প্রথমটাই এখনো হজম করতে পারি নাই, এর মধ্যেই আবার ২য় পার্ট চলে আসছে। তুমি কি চাইর হাতে লিখ নাকি?
@অভিজিৎ, কাহিনী হইছে আমি পুরোটা একসাথে লিখছিলাম, কিন্তু বেশি বড় হয়ে গেছে দেখে দুই ভাগ করে দিলাম। আর করমু না এমন…………… এই শেষ।
দুইটা লেখা একটা আরেকটার সাথে খুব সম্পর্কিত তাই একসাথে থাকলে মনে হয় খারাপ হয় না। 😀