২০০৯ সালের মার্চ মাস। সকালবেলা।

লাহোরের পার্ক কন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে রাখা টিম বাসে জড়ো হয়েছে শ্রীলংকান ক্রিকেটারটা। গন্তব্য গাদ্দাফি স্টেডিয়াম। দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনের খেলা হবে সেখানে। হোটেলের সামনে শুধু শ্রীলংকা দলের বাসই নয়, একটা মিনিভ্যানও রয়েছে। এতে উঠে বসেছেন খেলার সাথে সংশ্লিষ্ট আইসিসির কর্মকর্তাবৃন্দ। শ্রীলংকান ক্রিকেটার এবং আইসিসির কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর গাড়িবহর। মটরসাইকেলে সওয়ার হয়েছে পুলিশবাহিনীর সদস্যরা। এছাড়া জরুরী প্রয়োজনের জন্য রয়েছে দমকল বাহিনীর একটা গাড়ি এবং একটি এম্বুলেন্স।

বাসে জড়ো হওয়া সহখেলোয়াড়দের সাথে মিলিত হবার জন্য হোটেল থেকে বেরিয়ে আসছেন অধিনায়ক জয়বর্ধনে। কানের কাছে সেলফোন ধরা। চোখমুখ কুচকে আছে বিরক্তিতে। খেলার আগে স্ত্রী ক্রিস্টিনার সাথে কথা বলাটা তাঁর দীর্ঘদিনের রীতি। আজকে কিছুতেই ক্রিস্টিনাকে পাচ্ছেন না তিনি। বারবার ভয়েস মেইলে চলে যাচ্ছে। এমন কখনো হয় না। তাঁর অভ্যাসের কথা ক্রিস্টিনা জানে। স্বামীর ফোনের প্রতীক্ষাতেই থাকে সে। আজকে কী হয়েছে কে জানে। সকালে আরো দুবার ফোন করেছিলেন। প্রতিবারই দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষ পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে ভয়েস মেইলে। অস্বাভাবিক একটা ঘটনা।

বিরক্তি নিয়ে বাসে উঠে পড়েন তিনি। বাসের মধ্যে অবশ্য স্বাভাবিক পরিস্থিতিই রয়েছে। অন্য সব খেলার আগে যেরকম হয়, সেরকমই খেলোয়াড়দের কেউ কেউ জানার পর্দা টেনে দিয়েছে। কেউ আবার পর্দা সম্পূর্ণ সরিয়ে দিয়েছে বাইরের দৃশ্য দেখবে বলে। বিরক্তি কিছুটা কমে স্বাভাবিক হয়ে আসেন মাহেলা। সবাইকে সম্ভাষণ জানিয়ে বাসের পিছনের দিকে চলে যান তিনি। বা পাশের একটা সিট নিয়ে বসেন। বসেই আবারো সেলফোনে ক্রিস্টিনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন তিনি।

বাদিকে টার্ন নিয়ে হটেল থেকে বেরিয়ে আসে গাড়িবহর। একটা ইউ টার্ন নিয়ে আবাসিক এলাকা গুলবার্গের মধ্য দিয়ে ছুটে যেতে থাকে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের দিকে। নিরাপত্তার খাতিরে যদিও বিভিন্ন দিকের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, তারপরেও রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা নয়। ফাঁকফোকর দিয়ে কিছু মটরসাইকেল আরোহীরা ঠিকই ঢুকে পড়েছে রাস্তায়।

শ্রীলংকা দলের সহকারী কোচ ফারব্রেস বসে আছেন নতুন আবিষ্কার স্পিন বোলার অজন্তা মেন্ডিসের পাশে। মাথার মধ্যে খেলা করছে আগামি তিন দিনে পাকিস্তানকে কীভাবে দুইবার অল আউট করা যায়। আরেকটু পিছনেই বসে আছে কুমার সাঙ্গাকারা এবং থিলান সামারাভিরা। এই ম্যাচের ডাবল সেঞ্চুরিয়ান। দুজনেই খুচ খুচ করে আলাপ করছে ম্যাচটা কীভাবে জেতা যায় তাই নিয়ে। এই ম্যাচটাই মাহেলার টেস্ট ক্যাপ্টেন হিসাবে শেষ ম্যাচ। জয় দিয়ে তাঁকে অধিনায়কত্ব থেকে বিদায় দিতে বদ্ধ পরিকর দুজনে।

গাড়ি বহর এগিয়ে যায় লিবার্টি চত্বরের দিকে। ঠিক সেই সময়ই মাহেলার কান তালা লেগে যায় বুলেটের তীব্র শব্দে। ধাতম কিছুতে আঘাত করার ঝনঝনাৎ শব্দ শোনা যায়। তিলকরত্নে দিলশান চিৎকার করে উঠেন সিংহলী ভাষায়। সবাইকে সিটের নীচে ঢুকে পড়ার নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। কী ঘটছে শুরুতে ঠিক বুঝতে পারেন নি মাহেলা। তারপরই টের পেলেন যে, কেউ বা কারা তাঁদের দিকে গুলি ছুড়ছে। ভয়ে হিম হয়ে যান তিনি। হাত থেকে আপনা আপনি ফোন পড়ে যায় বাসের মেঝেতে। এই আক্রমণের সময়ের তিরিশ সেকেন্ডের ঝাঁঝালো শব্দসমূহ রেকর্ড হয়ে যায় ক্রিস্টিনার ভয়েস মেইলে।

শুরুতে ফারব্রেস কিছুই বুঝতে পারেন নি। ভেবেছেন রাস্তায় কিছু একটা ঘটছে। বাসের পিছন থকে জয়বর্ধনের আর্তনাদ শুনতে পান তিনি। বোমার স্পিলিন্টার এসে লেগেছে তাঁর গোড়ালিতে। একটা বুলেটও গা ছুঁয়ে গিয়েছে তাঁর। তখনও দিলশান চিৎকার করে চলেছে সবাই নীচু হও নীচু হও বলে। নিজেকে বাঁচানোর জন্য সামনের সিটকে সজোরে আঁকড়ে ধরেন তিনি। আর ঠিক তখনই মেন্ডিস তাঁর সামনে লুটিয়ে পড়ে বাসের মেঝেতে। মাথা এবং পিঠ ঝাঁঝড়া হয়ে গিয়েছে স্পিলিন্টারে। ফারব্রেস নিজেও ততক্ষণে আর অনাঘাত নন। এক টুকরো ধাতবখণ্ড কোথা থেকে এসে ঢুকে গিয়েছে তাঁর বাহুতে।

সাঙ্গাকারা ঘাড় ঘুরিয়ে বাইরে কী হচ্ছে সেটা দেখতে গিয়েছিলেন। একটা বুলেট তাঁর কানের পাশ দিয়ে তীব্র শীষ বাজিয়ে ঢুকে যায় সিটের মধ্যে। একটু আগেই সেখানে মাথা ছিল তাঁর। পারানাভিটানার বুকে এসে গুলি লাগে। দড়াম করে পড়ে যান তিনি। শরীরের শার্টে রক্ত মাখামাখি। সামারাভিরা ধরে নিয়েছিলেন যে, পারানাভিটানা আর বেঁচে নেই। তবে, খুব বেশিক্ষণ পারানাভিটানাকে ভাবার সময় তিনি পান না। নিজের বা পায়ে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন তিনি। একটা বুলেট ঢুকে গিয়েছে তাঁর বা উরুতে।

আক্রমণ শাণিয়েছিল বারো জনের একটা সন্ত্রাসী দল। একে ফর্টি সেভেন, গ্রেনেড আর রকেট লঞ্চারের মত অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে শ্রীলংকা দলের ক্রিকেটারদের জন্য লিবার্টি চত্ত্বরে ওত পেতেছিল তারা। ক্রিকেট দলের বাস চত্বরের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই বাস লক্ষ্য করে হামলা চালায় তারা। বাসকে এসকোর্ট করা পাকিস্তানি পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই ছয়জন পুলিশ এবং দুজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা প্রথমেই বাসে চাকা বরাবর গুলি চালায়। বাসের এক পাশের চাকা দেবে গিয়ে অচল হয়ে যায় বাস। সেই সময়ই বাস লক্ষ্য করে রকেট লঞ্চার দিয়ে রকেট ফায়ার করে তারা। ভাগ্যক্রমে বাসকে আঘাত না করে পাশের ইলেক্ট্রিক পোলে গিয়ে আঘাত হানে সেটি।

আইসিসির কর্মকর্তাদের বহনকারী মিনিভ্যানও আক্রমণের হাত থেকে বাঁচে নি। এর ড্রাইভার আক্রমণের শুরুতে মারা যায়। চতুর্থ রেফারি আহসান রাজা বুকে গুলি খেয়ে আহত হন।  ম্যাচ রেফারি ক্রিস ব্রড আহত স্থানে শক্ত করে হাতচাপা দিয়ে রাখেন রক্তক্ষরণ বন্ধ রাখার জন্য। ব্রডের গালাগালি খেয়ে এক পুলিশ অফিসার, যিনি নিজে বাঁচার জন্য আশ্রয় নিয়েছিলেন ভ্যানের  মধ্যে, চালিয়ে নিয়ে সরে যান নিরাপদ দূরত্বে।

শ্রীলংকা দলের নিরাপত্তার দায়িত্ব ঘাড়ে পেতে নেন দিলশান। ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সিটেই বসে ছিলেন তিনি। ওখান থেকেই তিনি নির্দেশনা দিতে থাকেন ড্রাইভার মোহাম্মেদ খলিলকে। খলিল ড্যাশবোর্ডের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে ড্রাইভ করতে থাকেন দিলশানের নির্দেশ অনুযায়ী। বাসকে পালাতে দেখে সন্ত্রাসীরা বাসের নীচে গ্রেনেড ছুড়ে মারে। কিন্তু ভাগ্য ভালো ওটি বিস্ফোরিত হবার আগেই বাস সরে যায় নিরাপদ দূরত্বে। খলিল তীব্র গতিতে গাড়ি চালিয়ে আধা কিলোমিটার দূরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের লোহার দরজা ভেঙে ঢুকে পড়েন মাঠের ভিতরে।

অনেকের হয়তো কৌতুহল হচ্ছে যে, পাকিস্তানি টিম তখন কোথায় ছিল? পাকিস্তানি টিম শ্রীলংকান টিমের সাথে একই হোটেলে ছিল। কিন্তু শ্রীলংকান টিমের সাথে একই সাথে স্টেডিয়ামে যায় নি সেদিন। এর আগের দুদিনই পাকিস্তান টিম শ্রীলংকান টিমের সাথে একই সাথে মাঠে গিয়েছে। এটাই রীতি। ওইদিনই তাঁরা একসাথে না যাবার কাকতালীয় অজুহাত নিয়ে হাজির হয়েছিল। নাস্তার সময় পাকিস্তানের অধিনায়ক ইউনুস খান চতুর্থ রেফারি আহসান রাজাকে জানায় যে, করাচিতে টেস্ট খেলে এবং লাহোরের এই গরমে গত দুই দিন পুড়ে তার ছেলেরা ক্লান্ত। কাজেই, পনেরো মিনিট পরে তারা হোটেল ছেড়ে বের হবে। ইউনুস খান পরে এটাকে আল্লাহর রহমত হিসাবে বর্ণনা করে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই বলে যে, ভাগ্যিস আমরা একসাথে বের হই নি। হলে ভয়াবহ বিপর্যয়কর ঘটনা ঘটে যেতো।

লাহোর টেস্ট সাথে সাথেই বাতিল করা হয়। শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় পাশের একটা এয়ারবেইজে। চার্টার্ড প্লেনে করে আহত খেলোয়াড়দের নিয়ে যাওয়া হয় কলম্বোতে।

এই ভয়াবহ ঘটনার ট্রমা থেকে বাঁচার জন্য শ্রীলংকার খেলোয়াড় এবং কর্মকর্তাদের পোস্ট ট্রমাটিক কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। শুধু ক্রিকেটার এবং কর্মকর্তারাই নয়, এই কাউন্সিল থেকে বাদ পড়ে নি খেলোয়াড়দের পরিবারের অন্তরঙ্গ সদস্যরাও।

পাকিস্তান একটা বিশৃঙ্খল, জঙ্গী এবং ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে অনেকদিন ধরেই।  অনেকদিন ধরেই প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট দলগুলো সেখানে খেলতে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। সেপ্টেম্বর ইলেভেনের পরে নিউজিল্যান্ড পাকিস্তান সফর না করার সিদ্ধান্ত নেয়। অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজও তাদের খেলাগুলোকে নিরপেক্ষে ভেন্যু কলম্বো এবং সারজাহতে সরিয়ে নেয়। দুই হাজার দুই সালে নিউজিল্যান্ড যায় পাকিস্তানে। কিন্তু তাঁরা যেখানে ছিল সেই হোটেল শেরাটনের সামনেই বোমার বিস্ফোরণ ঘটে।

দুই হাজার সাত সালে বেনজীর ভুট্টোর হত্যাকাণ্ডের পরে ২০০৮ সালে অস্ট্রেলিয়া তার পাকিস্তান সফর বাতিল করে দেয় নিরাপত্তার অজুহাতে। একই বছরে নিরাপত্তাকে ইস্যু করে আটটার মধ্যে পাঁচটা আইসিসি সদস্যি চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে দল পাঠাতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে, পরের বছর অক্টোবর পর্যন্ত এই টুর্নামেন্ট স্থগিত হয়ে যায়। ওয়েস্ট ইন্ডিজও তাদের প্রস্তাবিত ভ্রমণসূচী বাতিল করে দেয় একই কারণ দেখিয়ে।

এই বছরের ডিসেম্বর মাসে মুম্বাই সন্ত্রাসী আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী নির্দেশনায় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড পাকিস্তান সফর স্থগিত করে।

দুই হাজার নয় সালে আইসিসি পাকিস্তানে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি না করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সংগঠনের অনেক সদস্যেরই পাকিস্তান যাবার বিষয়ে উদ্বেগ ছিল।

দুই হাজার আট সালে ভারত তার পাকিস্তান সফর স্থগিত করলে পাকিস্তান বাইরের কোনো একটা দেশকে নিয়ে এসে খেলানোর ব্যাপারে মরিয়া হয়ে উঠে। তারা হাত বাড়ায় শ্রীলংকার দিকে। জয়বর্ধনে ভাষ্য অনুযায়ী ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার পাকিস্তান না যাবার কারণে তাঁরা দুশ্চিন্ত অবস্থায় ছিল। ফলে, নিরাপত্তার বিষয়ে তাঁরা প্রশ্ন তোলে ক্রিকেট বোর্ডকে। শ্রীলংকান ক্রিকেট বোর্ড জানায় যে, শ্রীলংকান ক্রিকেটারদের প্রেসিডেন্সিয়াল নিরাপত্তা দেওয়া হবে। এই আশ্বাস পেয়েই শ্রীলংকান খেলোয়াড়েরা অনীচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিল এই ভ্রমণে।

শ্রীলংকান খেলোয়াড়দের উপর হামলার দায় দায়িত্ব সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর এ তাইবার ঘাড়ে চাপিয়ে ছিল পাকিস্তান সরকার। মুম্বাইয়ে আক্রমণ এরাই করেছিল। সেই আক্রমণের সাথে এই আক্রমণের মিল থাকাটাই এদের ঘাড়ে দোষ চাপানোর পিছনে অন্যতম দায়ী। এই সংগঠন ভারত পাকিস্তান দুই দেশেই নিষিদ্ধ।  মজার একটা তথ্য হচ্ছে যে, এরা ক্রিকেট খেলাকে অনৈসলামিক মনে করে। দুই হাজার চার সালে এ বিষয়ে একটা ফতোয়াও জারি করেছিল তারা।

তবে কথা হচ্ছে যে, এই জাতটার নাম পাকিস্তান। যে কোনো বিষয়ে দোষ এড়ানোতে এদের জুড়ি মেলা ভার। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইউসুফ রাজা জিলানি এই আক্রমণের দায়দায়িত্ব শ্রীলংকান সন্ত্রাসীদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন যে, শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট তাঁকে জানিয়েছে যে, আমাদের কাছে তথ্য প্রমাণ আছে যে, শ্রীলংকার সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে পাকিস্তানে টাকা গিয়েছে আক্রমণ পরিচালনার জন্য।

অনেক নাটকের পরে এই ব্যর্থ রাষ্ট্রের মৃত্যুপুরীতেই ক্রিকেট খেলতে যাচ্ছে বঙ্গশার্দুলেরা। না, তাঁরা নিজের ইচ্ছায় যাচ্ছে না। তাঁদেরকে বাধ্য করছে লোটাস কামাল নামের এক লোভী ব্যবসায়ী। টাকার জোরে বিসিবির প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছে এই লোক। শুধু বিসিবির প্রেসিডেন্ট হয়েই তার সাধ মেটেনি। আইসিসির ভাইস প্রেসিডেন্ট হবারও শখ চাগিয়েছে তার। আর এর জন্য তার দরকার পাকিস্তানের সাহায্য। অন্যদিকে পাকিস্তানেরও প্রয়োজন কোনো একটা ক্রিকেট দলকে পাকিস্তানে নিয়ে খেলিয়ে প্রমাণ করা যে, তাদের সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় আছে। পাকিস্তানের আমন্ত্রণে সেখানে গিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে এসেছে লোটাস কামাল। সেই নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট সে। কাজেই দল পাঠানোতে তার কোনো আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে। কিন্তু আইসিসি আবার পাকিস্তানের এই নিরাপত্তায় সন্তুষ্ট নয়। সেখানে তার কর্মকর্তাদের পাঠাতে প্রবলভাবে অনিচ্ছুক আইসিসি। কিন্তু বিসিবির লোটাস কামাল এবং পিসিবির জাকা আশরাফের গভীর প্রেম দেখে তারা বলে দিয়েছিল যে, খেলতে চাইলে অনিরপেক্ষ কর্মকর্তা দিয়েই খেলাতে হবে। আইসিসির পক্ষ থেকে কাউকে পাঠানো হবে না ।

আইসিসি জড়িত না হলে, এটা ক্রিকেট না হয়ে যে পিকনিক হবে, সেটা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় নি লোটাস কামালের। এ ছাড়া ঘরের মধ্যেও প্রবল বিরোধিতায় রয়েছে পাকিস্তানে টিম পাঠানোর বিষয়ে। সে কারণেই লোটাসের সুর ভিন্নতর হয়েছিল। জিগরি দোস্তের সুরের এই ভিন্নতা দেখে ক্ষোভে দুঃখে জাকা আশরাফ হুমকি পর্যন্ত দিয়ে ছেড়েছিল এই বলে যে, বাংলাদেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদের থেকে সমর্থন প্রত্যহার করে নিতে পারে পাকিস্তান। এই ধমকের কারণেই কি না, কে জানে হঠাৎ করে পাকিস্তান যাবার চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ফেলেছে লোটাস কামাল। ২৯ শে এপ্রিল গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে একটা একদিনের ম্যাচ এবং পরের দিন একটা বিশ ওভারের ম্যাচ খেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

এই সফর থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেট কী উপকৃত হবে কেউ জানে না। রকিবুল হাসান এত সংক্ষিপ্ত ট্যুরের কোনো মূল্যমান খুঁজে পান নি। একটা মাত্র ওয়ান ডে এবং টি টোয়েন্টি বাংলাদেশের ক্রিকেটকে কীভাবে সাহায্য করবে আমি জানি না। তাঁর মতে, আমাদের ক্রিকেটাররা এখন সবাই ছুটিতে। সবচেয়ে বড় দুজন তারকা আইপিএল এ ব্যস্ত। এ অবস্থায় পাকিস্তানে দল পাঠালে সেটি হবে খর্ব ব্যাটিং শক্তির দল।

ক্রিকেটার্স ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত পালও বিসিবি-র এই সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ক্রিকেটার এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এই ভ্রমণের বিষয়ে উদবিগ্ন। ওই দেশে যেখানে কেউ-ই যেতে চায় না, সেখানে আমরা কেন যাচ্ছি। এর পিছনের ব্যক্তিগত স্বার্থটা আমরা জানতে চাই।

রকিবুল হাসান বা দেবব্রত পাল তাঁদের অবস্থানগত কারণে কূটনৈতিকভাবে এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। আমাদের সেই দায়বদ্ধতা নেই। আমরা জানি একজন লোভী মানুষের লোভের শিকার হচ্ছে আমাদের ক্রিকেটাররা। পাকিস্তানের জনগণ ক্রিকেট থেকে বঞ্চিত না অবঞ্চিত সেটা দেখার আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই। আমরা শুধু আমাদের ছেলেদের নিরাপত্তাটুকু দেখতে চাই। যে দেশে আইসিসি-র একটা দেশও যায় না, সেখানে আমাদের যেতে হবে কোন দুঃখে? কিসের ঠেকা পড়েছে আমাদের? আজকে যদি ওখানে কোনো অঘটন ঘটে তাঁর দায়দায়িত্ব কে নেবে? যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেটের তা কি পূরণ করা সম্ভব হবে?

আমাদের দেশটা একটা দ্বিধা কিংবা ত্রিধা বিভক্ত একটা দেশ। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের আত্মসম্মানের প্রবল ঘাটতি রয়েছে। আমি বাংলাদেশ ছাড়া আর কোনো দেশের মানুষকে অন্য দেশের জাতীয় দল নিয়ে মাতামাতি করতে দেখি নি, দেখি নি অন্য দেশের জাতীয় পতাকা কপালে, কপোলে মাখতে। এই দেশে একসময় কেউ ভারতীয় ক্রিকেট দলের সমর্থক ছিল, কেউ বা পাকিস্তানের। এখনো প্রচুর আছে। বাংলাদেশেই বাংলাদেশের সমর্থক ছিল না। ছিল না বললে ভুল হবে। ক্ষুদ্র একটা অংশ ছিল যারা মাটি কামড়ে ছিল। বুকের মধ্যে গভীর আশা পুষে রাখতো এই ভেবে যে, একদিন ঠিকই নিজেদের একটা শক্তিশালী দল হবে, সেই দলের সমর্থনে আমরাও পাকিস্তানি আর ভারতীয় সমর্থকদের চেয়ে আরো বেশি জোরে চিৎকার করবো, চেচামেচি করবো, ওদের চেয়েও বড় বড় পতাকা নিয়ে সবুজের প্রান্তর বানিয়ে দেবো স্টেডিয়ামকে,  দল জিতলে প্রবল উল্লাসে ফেটে পড়বো, সেই উল্লাসধ্বণি হবে সমুদ্র গর্জনের মত, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে দল হারলে গলা জড়িজড়ি করে আকুল হয়ে কাঁদবো। সেই কান্নাও হবে সুখের কান্না।

আজকে যখন একদল ছিপছিপে ক্ষিপ্র তরুণকে দেখি লাল-সবুজের রঙ গায়ে মেখে কাউকে তোয়াক্কা না করে বাঘের বাচ্চার মত জয়ের জন্য মাঠে তীব্র লড়াই করে, তখন বুকের ভিতরটা কেমন যেন আনচান করে উঠে। সদ্য কৈশোর পেরোনো কোনো তরুণ যখন দেশের জন্য, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নের পাহাড়সম ওজন নিয়ে, শেষ ওভারের শেষ বলে চার মারার জন্য চোখে গভীর আত্মপ্রত্যয় নিয়ে চোয়াল শক্ত করে ব্যাট উচিয়ে ধরে, তখন সেই তরুণ আর একা থাকে না, কোটি কোটি অদৃশ্য ভালবাসার হাত নিমেষেই ঘিরে ধরে তাকে। তার পিছনে শক্ত পাথরের দেয়ালের মত সারি বেধে দাঁড়িয়ে যায় অগণন মানুষ। আমরা যারা একদা একা ছিলাম, তারাও টের পাই, শুধুমাত্র এই ছেলেগুলোর জন্যই আমাদের কাঁধের পাশে এসে ঠেকছে অচেনা কাঁধ, হাতের সাথে মিলিত হচ্ছে অন্য কারো হাত। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছি আমরা।

আমাদেরকে যারা একতাবদ্ধ করছে, দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করছে, ভুলে যাওয়া পরিচয়ের গর্ব এনে দিচ্ছে, সেই সব সোনার ছেলেদের পচে গলে যাওয়া পাকিস্তান নামের এক মৃত্যুপুরীতে যেতে দিতে পারি না আমরা। কিছুতেই নয়।

সবটুকু শক্তি দিয়ে এটাকে প্রতিহত করতে হবে আমাদের।