আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বরে- সেই ঈশ্বর যে আমাকে বানায়নি, বরং আমি বানিয়েছি যাকে। নিজের মনের মাধুরী মিশায়ে, কাব্য আর গীতের ললিত শব্দ চয়নে রচনা করেছি আমি তারে। নিজের সব ভাল ভাল উপাদান, কি দেইনি আমি তারে! আপন হৃদয়ের রক্ত নিংড়ায়ে তার পদপদ্ম রাঙিয়ে দিয়েছি। এখন সে আমার, শুধুই আমার। মনের গহনে মন্দির মসজিদ বানিয়ে সেখানে বসিয়েছি তারে। স্বতস্ফুর্ত সঙ্গীত রাগিনী বেরিয়ে পড়ে সে ভজনালয় থেকে লোক-চরাচরে। সে গীতবানী মুগ্ধ করে আমাকে- সবার শ্রবনে ঢালে সুধা।
তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা
তুমি আমার সাধের সাধনা।
মম শূন্য গগন বিহারী
আমি আপন মনের মাধুরী মিশায়ে
তোমারে করেছি রচনা।
তুমি আমারই, তুমি আমারই।
মম হৃদয় রক্ত রাগে
তব চরন দিয়েছি রাঙিয়া।
ঐ সন্ধ্যা স্বপন বিহারী
তব অধর একেছি সুধা বিষে মিশে,
মম সুখ দুঃখ ভাঙিয়া।
তুমি আমারই, তুমি আমারই-
মম বিজন জীবন বিহারী।
আমার সেই ঈশ্বরকেই ভজি আমি। আমার ভেতরেই তার আসন। তাই নিজেকে সিজদা করি আমি আর জপি বারংবার- ‘ওম নমশ্বিবায়ো’। আমারি আকারে স্বভাবে উপকরনে গড়া শত সহস্র মানুষ পৃথিবীর উপর দিয়ে চরে বেড়ায়- তার কর্কশ পৃষ্ঠকে আলোকিত করে, করে মসৃন। তাদেরও সবার মনের মসজিদে আমারই ঈশ্বর, আমারই প্রেমাস্পদ। তাই আমি ওদের চরন ভজি। ওদেরো করি সিজদা। সেই ভজন-সুখের উল্লাশ শব্দ হয়ে বেরিয়ে আসে আমার মন-মন্দির থেকে।
মানুষ ধরো, মানুষ ভজো
শোন বলি এই পাগল মন।
মানুষের ভেতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন।
সারা বিশ্ব ঘুরে এসে দেখলাম এই ব্যক্তি আমি কখনও অমর নই- ছিলামও না কখনো। মরনশীল এই জীবন। হাজারটা ধ্রুব সত্যের ভেতরে এটাও একটা সত্য। তাই জীবনই আমার কাছে সবচেয়ে মূল্যবান। ঠিক সেই কারনে মৃত্যুই জীবনের ছেদ- এটা মনে করতেও আমার কোন দ্বিধা নেই। মৃত্যর পরের জীবন আসলেই মৃত। এটাই আমার সহজ পথ। এভাবেই আমি আমার জীবন কে সহজ করে নিয়েছি। আমার তৈরী ঈশ্বরও তাই আতি সরল।
শুনি ম’লে পাবে বেহেশতখানা
আসলেতো মন মানে না।
নগদ ছেড়ে বাকীর আশা
কে করে এই ভুবনে।
সহজ মানুষ
ভজে দেখনা রে মন দিব্য জ্ঞানে।
মানুষই সত্য। মানুষই হক। সব কিছুই মানুষের জন্য- কোন বস্তুর জন্যে মানুষ নয়। ঠিক যেমন, পথ পথিকের জন্য, পথিক পথের জন্য নয়। তাই আমি সত্য। তাই আমি নিজের অজান্তে উচ্চারন করি- ‘আনাল হক’। সব কিছু মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে এই মানুষে।
আমি চির বিদ্রহী বীর,
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা
চির উন্নত মম শির।
বৈচিত্রের ভেতরে সৃষ্টির এক অনন্য সত্য লুকিয়ে আছে। বৈপরিত্যে আছে জীবনের স্পন্দন। সে স্পন্দনে ভালবাসা, প্রেম আর ভক্তি যেমন থাকে তেমনি থাকতে পারে ঘৃনা আর নিন্দা। আমার ঈশ্বর আমার প্রান। সে প্রানে কেউ কাটার আঘাত করলে আমার ভক্তির সাগরে ঢেউ উঠে, প্রেমে আসে জোয়ার। সে জোয়ার ভাসিয়ে নিয়ে যায় নিন্দাকারীর উপরে সব রাগ অভিমান আর হিংসা কাতরতা- মত আর পথের বৈচিত্রের মুগ্ধতায়। ক্রুদ্ধ না হয়ে নিন্দাকারীকে তখন আরও বেশী কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করে সখ্যতার বাঁধনে।
যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বানী
আমি লয়ে সখী সেই মুখখানি,
কতো ঠাই হতে কতো কী যে আনি
সাজাই বারংবার।
আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা
আমি বাধি তারি ঘর।
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই
যে মোরে করেছে পর।
বিগলিত হৃদয়ের সে কান্না মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছে হয়ে জমা হয়ে যায় মনের গহনে সেই মন-মন্দিরে। সময় আর সুযোগে লোক-চরাচরে সে সব ইচ্ছে বেরিয়ে আসে আশিষ হয়ে। তাই আমি গোপন, নেপথ্যচারী। আমার ঈশ্বরেরও নেই কোন তকমা- নেই কোন উজ্জল নাম। আমি ওসব চাইও না কখনও। অনেকের মতো আমারো ধর্মানুভুতি প্রবল। যখন তখন সেখনে আঘাত পাই- তাও সেই মানুষেরই কাছ থেকে। এ আঘাত তখনই পাই, যখন কেউ যুক্তিহীন কথা বলে, যুক্তিহীন কাজ ও চিন্তা করে- মানুষ হয়ে মানুষের বৈধ জাগতিক স্বার্থগুলো পায়ে দলে। কারন আমার ঈশ্বর যুক্তি ছাড়া এক পাও নড়েন না। সেদিক দিয়ে আমাকে কেউ ধার্মিক বললেও বলতে পারে। তার পরেও আমি ভাবের সাগরে ভাসি- আমার সাধ্যমত বা যতটুকু আমার প্রয়োজন ততটুকু। সৌন্দর্য্যের নির্জাসটুকু ছুয়ে দেখার জন্য, মর্মে ধারন করবার জন্যে হৃদয় আমার ভেসে যায় সেই পরম সৌন্দর্য্যেরই উদ্দেশ্যে।
আজ হৃদয় আমার
যায়, যায় যে ভেসে।
যার পাইনি দেখা, তার উদ্দেশে
ভেসে ভেসে, আজ হৃদয় আমার।
প্রেমে যেমন আমার অপার মুগ্ধতা তেমনি জ্ঞানেও। ভাব আর জ্ঞানের ভারসাম্য আমার মন-মন্দিরে। তারা একে অপরকে পূর্নতা দেয় পরম যত্নে আদরে। আমার জ্ঞান বাড়ে যুক্তিতে, সন্দেহে, সংশয়ে। আমার ভাব-লোকের ভাবও বাড়ে সাথে সাথে। দ্বি-ধার খঞ্জরের তীক্ষ্ণতায় আমি আমার মন-মন্দিরের ঈশ্বরের দেহকে কাটা ছেড়া করি- নতুন করে বানাই নিত্য। দুটোকেই আমার নতুন চাই, আনকোরা। তবেই আমি সবাইকে নিয়ে সামনে চলতে পারি। এক হাতে ভাবের পুতুল আর অন্য হাতে জ্ঞানের তরঙ্গ নিয়েই আমি স্বাভাবিক, সচল। আমি সচল থাকতে চাই। কারন গতিই সত্য, গতিই স্বাভাবিকতা।
এক হাতে মোর ভাবের পুতুল
যুক্তি-মশাল অন্য হাতে
ভাব-জগত আর জ্ঞান-জগতের
দোস্তী সমান আমার সাথে।
আকাশের ঐ নীল তারকা
আমায় দেখে মুচকি হাসে-
আমি কি সই ভাবের পাগল?
কিম্বা নিরেট জ্ঞানোচ্ছ্বাসে?
অনেক জেনেছি, বুঝেছি, দেখেছি তারপরেও মনে হয়েছে এখনও কিছুই জানা বুঝা হয়নি। তবে একটা জিনিস বোধে এসেছে, তা হলো- ভাবের চোখ হচ্ছে জ্ঞান বা যুক্তি এবং জ্ঞানের অনুপ্রেনা হলো ভাব। তাই বিশ্বাস আর যুক্তি এক দেহে লীন হয়ে গেছে, তাদের কোনভাবে আর আলাদা করা যায় না। তাই যুক্তিহীন বা জ্ঞানহীন বিশ্বাস অন্ধ মহিষের মতো। এই অন্ধ মহিষের হাত থেকে বাচার বিকল্প সন্ধান করতে হবে সকলকে এবং তা এখনি।
তথ্য সুত্রঃ
(গান ও কবিতা)
রবিঠাকুর, লালন, মনসুর হাল্লাজ, নজরুল এবং জসিম উদ্দীন থেকে।
ভাব আর ভাববাদ যে এক নয়; খুব চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আমাদের দেশে একসময় ভাবুকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। এখন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ভাববাদীদের।
@স্বপন মাঝি,
অন্ধ ভাববাদকে দৃষ্টি শক্তি দিতে পারলে তার থেকে ভাল ফল পাওয়া যাবে। এটা থেকে অনেক সময় ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স বা আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা পাওয়া যায়- যেম ন শিল্প, সাহিত্য, উন্নত সমাজ। কিন্ত অন্ধ ভাববাদ মানুষকে গুতিয়ে মারবে। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
সময় করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
পুরা লেখাটা এক নিশ্বাসে পড়েছি। খুবি ভাল লেগেছে। রবিন্দ্রনাথের গান যে এতটা বিশ্বজনিন তা আগে সেভাবে বুঝিনি। আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা। (F) (F)
লেখাটা ভীষন ট্রান্সফরমেটিভ। বিশেষ করে বিখ্যাত মানুষদের কোটেশন ব্যবহার করায় বক্তব্য আরো জোরাল এবং স্পষ্ট হয়েছে। সত্যিকারের ধার্মিকের স্বভাব কেমন হওয়া উচিত তা বুঝা যায় লেখাটা পড়লে। একটা ব্যতিক্রমী লেখা সন্দেহ নেই। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
@শেখ খলিল,
হতে পারে। তবে আমার মনে হয় এই ধরনের বিশ্বাসী মানুষ আমাদের দেশ আগে অনেক ছিল। তাই সমাজটা অন্য রকম ছিল। আজকের ধার্মিকেরা একেবারে অন্যরকম। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লেখাটি খুবই ব্যতিক্রমী, এবং চমৎকার। গান এবং কবিতাগুলোও খুব যথার্থ হয়েছে।
@অভিজিৎ,
ধন্যবাদ দাদা সময় নিয়ে পড়ার জন্যে। আমাদের আইকনদের লেখা পড়ে মনের ভেতরে যা আসে তাইই শব্দ আকারে চলে এসেছে মূক্তমনায়। লেখায় অনেক ভুল থাকতে পারে, বিশেষ করে বানান ভুল তো আছেই।
(F) (F) (F)
মানুষ ধরো, মানুষ ভজো
শোন বলি এই পাগল মন।
মানুষের ভেতরে মানুষ
করিতেছে বিরাজন। (Y)
@ঢাকা ঢাকা,
সত্যিকারের একজন আদর্শ বিশ্বাসী বা ধার্মিকের সরূপ এমন হওয়া উচিত। এতটা না হোক এর সিকি পরিমান ও পাওয়া যায় না আজকাল। অথচ এরকম মানুষ আগে আমাদের সমাজে ছিল। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।