এক এক সময় এক এক বিপদে কাটাতে হয় প্রায়শঃ। এইবার হচ্ছে মেয়ে সংক্রান্ত। আমাদের ব্যবসার জায়গা রক্ষনাবেক্ষনের কাজে এক বয়ষ্ক মানুষ আছে। আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে। মাঝে সাঝে সেখানে যাই।
স্বামীর কাজের কিছু তদারকি করি। সেই সাথে কর্মচারিদের ভালোমন্দ, কেমন আছে, কোনো অভিযোগ আছে কীনা এইসব খবর নেই। ওদের সমস্যার যথাসাধ্য সমাধান করতে চেষ্টা করি।
তারাও আমার পরিবারের মঙ্গল কামনা করে( আমার ধারনা ভুলও হতে পারে)। এক এক জন প্রকাশ্যেই দোয়া করে, আর বলে-
-এতো বিষয় সম্পত্তি খাইব কে? মাইয়া হইসে সব পোলা নাই একটাও। হায় –সবই আল্লার লীলা।
আমার আড়ালে বলছে তথাপি আমার কানে আসে ঠিকই। যদিও মেয়ে হওয়া নিয়ে কোনোদিন কোন সময় এমন অদ্ভূত চিন্তার উদয় হয়নি। এমন কি আমার বাবার পরিবারেও হয়নি।
কিন্তু স্বামীর কিঞ্চিত পরিমানে হয়েছিল।তাঁর আশা ছিল (হয়তো) ছেলে হলে বাবার হাতের লাঠি হবে। এখন মেয়ে যে ছেলের চাইতে কম নয় তা অবশ্য স্বীকার করেন তিনি নিজেই। লাঠি না হোক, কঞ্চি তো হয়েছে। আর শ্বশুর বাড়ি তো কথাই নেই।
দ্বিতীয় সন্তান জন্মের পরে আমার মরহুম শ্বশুর মশায় একদিনের জন্যে দেখতে আসেননি। তা না আসুন।
এমন ভাবে বেড়ে ওঠে আমাদের দেশের কন্যা সন্তানেরা।
অবহেলা এক সময় ওরা প্রছন্ন ভাবে বুঝতে শেখে।
কন্যা বলে লেখাপড়া বা অন্য কোনো কিছুতে তাদের বুঝতে দেইনি তারা আর ছেলে আলাদা। তথাপি বালির বাঁধ ঠেকায় কী দিয়ে? কন্যাদ্বয় ঠিক বুঝতে পারে তাদের আলাদা চোখে দেখে আত্মীয় স্বজনেরা, আর তার ভাই(চাচাত,ফুফাত ইত্যাদি) অন্য চোখে দেখা হয়।
চাকরি ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হবে বুঝে উঠতে সময় লাগল। মেয়ে চাকরি পেয়েছে একটা মাল্টিন্যাশন্যাল কোম্পানিতে। ইন্টারভিউ দিয়ে অনেকের মাঝে মেয়েও একাই টিকল। এই চাকরিতে মেয়েই হোক ছেলেই হোক, প্রথমে ঢাকার বাইরে পোষ্টিং হয়। এইটাই শর্ত। মেয়ে গেল কর্মক্ষেত্রে।
কোম্পানি থেকেই থাকার প্রাথমিক ব্যবস্থা সাথে সম্পূর্ণ নিরাপত্তার ব্যবস্থা, গাড়ি ইত্যাদি দেয়া হল। ছেলে হলে ইর্ষনীয় চাকরি বটে।
কিন্তু, এ ক্ষেত্রে বাদ সাধছে ঐ একই সমস্যা।
-আপনার মেয়ে একা থাকবে? দু’চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি।
-হাঁ, চাকরি যখন নিয়েছে তখন একা থাকায় সমস্যা কী?
-না মানে মেয়ে মানুষ কিনা-
অর্থাৎ মেয়েটা মেয়ে মানুষ। সম্পূর্ণ রুপে মানুষ হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্ধিহান। আশ্চর্য! আমাদের বাবা, মায়ের সমস্যা নেই। অথচ পাড়ার মানুষের ঘুম নেই।
আরো কথা আছে। তা হচ্ছে মেয়ে যেহেতু অবিবাহিত। মেয়ে মানেই আর একজনের কাঁধে ভর দিয়ে তাকে হাটতে হবে।
-আপনার মেয়ে কি সম্পূর্ন একা থাকে?
-হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমি যাই, ওর বাবা যাই। কেনো?
হতাশ গলায় বুঝাতে অক্ষম আমরা তো চিন্তা করিনা। উনারা কেন এমন ব্যতিব্যস্ত করেন।
-তবু, মেয়ে মানুষ বলে কথা, আপনারা মেয়ের শীঘ্র বিয়ে দিয়ে দেন। শত হলেও মেয়ে মানুষ-
আর এক যন্ত্রণার প্রসঙ্গ। আমরা বাঙ্গালিরা এটা কাজ বেশ পারি তা হচ্ছে বিনা টাকার উপদেশ খয়রাত করতে। এই বিষয়ে বাঙ্গালিদের জুড়ি মেলা দায়।
-মেয়ে এখন বিয়ে করবে না বলেছে।ওর ইচ্ছে বিরুদ্ধে আমরা কিছু জোর করে চাপিয়ে দিতে চাইনা। আর বিয়ে তো পালিয়ে যাচ্ছে না। কিছুদিন সময় নিচ্ছে সমস্যা কী?
– বুঝবেন না। পরে বুঝবেন। মেয়েদের বেশি চোখ, কান ফোটাতে হয়না।
চোখ ফূটা-ফুটির কি আছে বুঝলাম না। আমি এমনেই একটু গাধা টাইপের। স্বামী বলেন টিউব লাইট। এতো বুঝে কাজ কী? কম বুঝা বরং ভালো। এই ভেবেচুপ করে থাকি।
আগে কথা শুনতে হত বাচ্চাদের রেজাল্ট নিয়ে, অমুকের মেয়ে ক্লাস এ প্রথম হয় আমারগুলো হয়না কেনো? স্বামীর অভিযোগ, আত্মীয়দের অনূযোগ। এখন শুনছি চাকরি, বিবাহ ইত্যাদি নিয়ে।
আর কথা বাড়ানর ইচ্ছে ছিলনা। আমার নির্লিপ্ত মুখ দেখে ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন।
কী বিড়ম্বনা! আমাদের সমস্যা নাই। অথচ-
বিদেশে মেয়েকে একা পড়তে পাঠালে সমস্যা নাই। দেশেই সমস্যা। কেনো? কী কারনে এই মানসিকতা লোকজনের বুঝতে অনেক বেগ পেতে হয়। আমাদের নিজেদের জীবন যেমন ভালো বুঝি তেমন চালাব। অথচ তার উপাই নেই।
কন্যার কাছে প্রায় গল্প শুনি বিভিন্ন অভিজ্ঞতার। একা ফ্লাটে থাকে তাই নিয়ে কতজনের কৌতুহল।
কতো ছল করে বাড়িতে এসে পরিচয় করতে চায়। সে ক্ষেত্রে মহিলাদের চাইতে পুরুষের অগ্রনী ভূমিকা বেশি। অর্থাৎ তারা ছলে বলে মেয়ের সাথে আলাপ করতে চান। মহিলারা দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি-ঝুঁকি মারেন বেশি।
সপ্তাহ খানেক বেড়িয়ে এলাম। অফিস দেখলাম, যে যে সাইটে ও যায় সেখানেও নিয়ে গেল। কন্যার সাফল্যে অজান্তে চোখে জল এলো।
সেই সময় দেখেছি- কত ছল করে আসে নানান জন। কত আপত্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। কেবল একটাই কারন কন্যা অবিবাহিত তাই। আশ্চর্য!
আমি গৃহবধু। যেন অচ্ছুত শ্রেনীভুক্ত মানুষ (?)। বিনাবেতনের থাঙ্কলেস চাকরি করি। সে আবার লিখে
কী আশ্চর্য! বিবিধ প্রশ্ন স্বামীর অনুমতি আছে কীনা ইত্যাদি। মাঝে মাঝে মধ্যরাতে লিখি। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলে আমাকে দেখে কেউ কেউ পাগল ঠাউরাবে। এমনিতেই আধা পাগল ভাবে।
লেখা-লেখির ক্ষেত্রে আমার কিছু কথা অনেক আগে একজায়গায় লিখেছিলাম। । কেমন করে লিখতে হয় তেমন কিছুতেই আমি প্রশিক্ষণ নেইনি। সেই লেখাকেই কীনা বেছে নিলাম। নানা জনের নানান কটুক্তি। যারা লেখে তারা হয় অধ্যাপক হয়, নিদেন পক্ষে স্কুলের টিচার তো হয়ই এতে কোনো ভুল নেই।
হায়! হায়! আমি তো এর কোনোটাতেই পড়িনা। সাহিত্য হচ্ছে একটা কঠিন বিষয়। তবে উপায়? আমাদের বাংলা স্যর’কে দেখেছিলাম পাঞ্জাবি পরে আসতেন। মুখ গম্ভীর হয়ে ক্লাস নিতেন, কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথ, শরৎ চন্দ্রের উদাহরন দিতেন। বাংলা স্যর এর উপস্থিতি মাঝে মাঝেই বিভীষিকার মত লাগত।
ওহে আমি পুরুষ .. আমি কিছুদিন চাকরি নিয়ে একা একা ছিলাম .. আমার বাড়ির মালিক আমাকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পরেছিল .. আমি কেন একা একা থাকি .. আমার বিয়ে করা দরকার .. পরে মনে হলো মনের মত বন্ধু পেলে অন্যকে সঙ্গে নিয়ে থাকাটাই শ্রেয় .. মনের শান্তি .. জানিনা অন্যরা কিরকম ভাবে .. তবে আমার মা আমাকে নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল ..
সাথেই আছি। অব্যাহত থাকুক লেখা।
@গীতা দাস,
আপনি পড়েছেন, আমি অনেক আনন্দ পেলাম। চালিয়ে যাবার ইচ্ছে আছে বাদ বাকি- 🙁
নানান সমস্যা যদি না আসে, বা মুড আসে।
নারীদের বিদ্রোহ করা শিখতে হবে। অন্তত সম্পত্তিতে সম-অধিকার তারা আজো প্রতিষ্টা করতে পারে নি। তারা দেখাতে পারে নি যে তারা মৌলবাদিদের চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
@সৈকত চৌধুরী,
এই স্বনির্ভর হওয়াটাই বিদ্রোহ। আলাদা করে যুদ্ধে যাবার দরকার নেই, আমার মতে। এইভাবেই আসবে পরিবর্তন। যে ভুল আমরা করেছি, সে ভুল ওরা করবে না,বলেই বিশ্বাস।
অনেক ধন্যবাদ।
মন ভেজানো লেখা।সুন্দর। (Y)
@সপ্তক,
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আফরোজার কন্যা যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, নিজেই নিজের ভাগ্য নির্দ্ধারণ করছে–এইটাই মনে হয় ঈর্ষার কারণ।
আফরোজার কন্যারাই আমাদের দেশে নারী জগরণের পথিকৃত–খালেদা কিংবা হাসিনা নয়–নয় এমনকি তসলিমা নাসরিনও
তাই আফরোজার কন্যার প্রতি রইল অকুণ্ঠ সমর্থন–এগিয়ে যাও, আমরা আছি তোমাদের সাথে।
@আবুল কাশেম,
অনেক ক্ষেত্রে তাই। ছেলে হলে মাথায় করে রাখা হয় । আর মেয়ে হয়ে যেনো অন্যায় হয়ে গেছে এমন চাকরি নিয়ে। খুব অবাক লাগে এই সব দেখলে। মেয়ে মানেই যেনো স্কুল টিচার, বা নিদেন পক্ষে ব্যাংক এ চাকরি করবে। সেখানে কীনা তামাক কোম্পানীতে চাকরি?
তাই রাজেশ কে যা বলেছি একই কথার পুনুরুক্তি করছি,
এখন পর্যন্ত মায়েদের কথাই বলব, তারা মনে করেন মেয়েদের লেখাপড়া করান অনেকটা ভালো পাত্র যোগাড় করার জন্য। (ভুল বললে মাফ চেয়ে নিচ্ছি)। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্ব-নির্ভর হবার
জন্য নয়।
ধন্যবাদ।
বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে মেয়েদের সামাজিক সমস্যাগুলো চমৎকারভাবে লেখনিতে তুলে ধরেছেন। (F)
মেয়েদের একা থাকা, একা একা চলাফেরা করা, মেয়েদের সাইকেল চালানো, গাড়ী চালানো, মেয়েদের ফুটবল ক্রিকেট খেলা ইত্যাদি বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বাস করা লোকেরা এখনো দেখে ঠিক অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। সামাজিক পরিবর্তন বা সংষ্কারের প্রাথমিক ধাপগুলোতে পরিবর্তিত হওয়া যেকোন বিষয় প্রথম অবস্থায় সমাজের অনেকের অনভ্যস্ত চোখে দৃষ্টিকটু মনে হতে পারে। তবে আশার কথা আপনাদের মত মায়েরা এভাবে এগিয়ে এলে সমাজ তাকে গ্রহণ করে নিতে বেশিদিন সময় লাগবেনা। আর বড়জোর ১০/১৫ বছর। সব কিছুতেই মেয়েরা ভোগ করতে শিখবে তাদের স্বাধীনতা।
@রাজেশ তালুকদার,
আপনি ঠিক বলেছেন, ১০ বছরেও হবে কিনা সন্দেহ। কেননা এর মূল কারণ আমরা নিজেরাই। নিজেদের মন মানসিকতা যদি একটু হলেও বদলাতে চেষ্টা করি তাহলে খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে।
এখন পর্যন্ত মায়েদের কথাই বলব, তারা মনে করেন মেয়েদের লেখাপড়া করান অনেকটা ভালো পাত্র যোগাড় করার জন্য। (ভুল বললে মাফ চেয়ে নিচ্ছি)। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্ব-নির্ভর হবার জন্য নয়।
এই কথা আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি। নাও হতে পারে। আপনি পড়েছেন তাই অনেক ধন্যবাদ।