শ্রীচৈতন্য বর্তমান হিন্দু বিশেষ করে বৈষ্ণবদের কাছে একটি মহান নাম। অনেক তথাকথিত “মুক্তমনা” হিন্দুও তার নামে পাগল হয়ে যান এবং নানা মুখে তার গুণকীর্তন করতে থাকেন। তিনি নাকি বিশাল দয়ালু ছিলেন,প্রেমধর্মের প্রচারক ছিলেন,অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার ছিলেন, হিন্দু মুসলমানের মিলন ঘটানোর চেষ্টা করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। এর সবই যে পুরোপুরি মিথ্যে বা তিনি খুব খারাপ মানুষ ছিলেন তা নয়। তবে এখানে আমি কয়েকটা ঘটনা তুলে ধরে দেখানোর চেষ্টা করবো যে প্রচলিত শ্রীচৈতন্য ঐতিহাসিক শ্রীচৈতন্য থেকে অনেকটাই আলাদা এবং ভক্তিবাদী রূপের পাশাপাশি তার ছিল চরম সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক রূপও।
হরিদাসঃ
হরিদাস মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং শ্রীচৈতন্যের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করেন। শ্রীচৈতন্যের ভক্তদের মাঝে তিনি “যবন হরিদাস” নামেই পরিচিত ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্ম গ্রহণ করার অপরাধে “মুলুকের পতি” অর্থাৎ সুলতান বা রাজকর্মচারী তাকে বলেনঃ
“কত ভাগ্যে দেখ তুমি হয়াছ যবন।
তবে কেন হিন্দুর আচারে দেহ মন।।
আমরা হিন্দুরে দেখি নাহি খাই ভাত।
তাহা তুমি ছাড় হই মহাবংশ জাত।।”
-চৈতন্যভাগবত,আদিখণ্ড,১৪শ অধ্যায়।
তিনি হুকুম দেন হরিদাসকে বাইশ বাজারে নিয়ে গিয়ে বেত্রাঘাতে হত্যা করতে হবে। হরিদাসকে সকলের সামনে কঠোর বেত্রাঘাত করা হয় কিন্তু তাতেও তিনি তার সংকল্প থেকে টলেন না। পরে বিরক্ত হয়ে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ইনি চৈতন্যের একনিষ্ঠ ভক্ত হন ও আজীবন চৈতন্যের স্নেহধন্য ছিলেন। এ ছাড়া আরেকজন হরিদাসও চৈতন্যের ভক্ত ছিলেন। তাকে “ছোট হরিদাস” বলা হয়। তিনিও চৈতন্যের খুব বড় ভক্ত ছিলেন কিন্তু চৈতন্যই তার মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ান। কি জন্য শুনতে চান? শুনুন তবে। চৈতন্য নিয়ম করেছিলেন যে তার ভক্তরা কোন অবস্থাতেই নারীর সাথে কথা বলতে পারবে না। হরিদাস একবার চৈতন্যের জন্য এক বৃদ্ধা ভক্তিমতী মহিলার কাছ থেকে ভাল মানের চাল চেয়ে এনেছিলেন। এই নিয়মভঙ্গের অপরাধে হরিদাসকে তিনি ত্যাগ করেন। তিনি বলেনঃ
“হরিদাস কইল প্রকৃতি সম্ভাষণ।
হেরিতে না পারি মুই তাহার বদন।।”
অন্যান্য ভক্তগণের অনুরোধ উপরোধেও তিনি বিন্দুমাত্র টললেন না। বললেন”মানুষের ইন্দ্রিয় দুর্বার,কাষ্ঠের নারীমূর্তি দেখিলেও মুনির মন চঞ্চল হয়। অসংযত চিত্ত জীব মর্কট বৈরাগ্য করিয়া স্ত্রী সম্ভাষণের ফলে ইন্দ্রিয় চরিতার্থ করিয়া বেড়াইতেছে।” এ কথা শুনে মনের দুঃখে হরিদাস প্রয়াগে ত্রিবেণীতে ডুবে আত্মহত্যা করেন।
-বাংলা দেশের ইতিহাস(মধ্য যুগ),৫ম সংস্করণ,পৃষ্ঠা ২৬০।
নারী ও যৌনতা সম্পর্কে প্রায় প্রত্যেক ধর্মগুরুর মধ্যেই এক ধরণের অতি বাড়াবাড়ি ও পাগলামি লক্ষ্য করা যায়। শ্রীচৈতন্যও এর ব্যাতিক্রম নন, চৈতন্যের জীবনীগ্রন্থগুলি থেকে নারী সম্পর্কে এমন আরও বহু অপমানকর ও বৈষম্যবাদী উক্তি তুলে ধরা সম্ভব।আর এই পাগলামির শিকার হতে হয় হরিদাসকে। দয়ালু ও ভক্তের প্রতি সহানুভূতিশীল চৈতন্যের পরিবর্তে এখানে আমরা পাই কঠোর,আত্মম্ভরি ও বদমেজাজি চৈতন্যকে।
সাম্প্রদায়িক শ্রীচৈতন্যঃ
বলা হয়ে থাকে শ্রীচৈতন্য নাকি অসাম্প্রদায়িক ও উদার চেতনার অধিকারী ছিলেন। এ কথা মোটেও সত্য নয়। তিনি হিন্দুদের জাতপ্রথার বিরুদ্ধে ছিলেন কারণ জাতপ্রথার কড়াকড়ির কারণে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করছিল। তিনি চেয়েছিলেন বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ ঘটিয়ে এই ধর্মান্তরণ প্রক্রিয়া রোধ করতে এবং মুসলিমরাও যেন বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করে হিন্দু সমাজে প্রবেশ করতে পারে সেই ব্যাবস্থা করতে। তাই দেখতে পাই নিচুবর্ণের হিন্দুদের প্রতি তিনি সহানুভূতিশীল হলেও মুসলিমদের তিনি যবন, ম্লেচ্ছ ও অস্পৃশ্য বলেই ঘৃণা করতেন। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে।
তখনকার দিনে মুসলমানের স্পর্শ করা খাবার বা পানীয় গ্রহণ করলে হিন্দুরা জাতিচ্যুত হত। চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায় যে সুলতান হোসেন শাহ বাল্যকালে সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে চাকরি করতেন এবং কর্তব্য কাজে অবহেলার জন্য সুবুদ্ধি তাকে চাবুক মেরেছিলেন। সুলতান হবার পরে হোসেন শাহের স্ত্রী এই ঘটনা শুনে সুবুদ্ধিকে হত্যা করার পরামর্শ দেন। সুলতান এতে অসম্মত হলে তার স্ত্রী তাকে সুবুদ্ধির জাতি নষ্ট করতে বলেন। এরপর সুলতান মুসলমানের পাত্র থেকে পানি খাইয়ে তার জাতি নষ্ট করেন। সুবুদ্ধি কাশীতে গিয়ে পণ্ডিতদের কাছে প্রায়শ্চিত্তের বিধান চান। একদল বলেন গরম ঘি খেয়ে প্রানত্যাগ করতে আর আরেকদল বলেন যে অল্পদোষে এরকম কঠোর শাস্তির দরকার নেই। এ ঘটনা চৈতন্য শুনতে পান ও সুবুদ্ধিকে বলেন তুমি বৃন্দাবনে গিয়ে “নিরন্তর কর কৃষ্ণনাম সংকীর্তন।” তিনি বলেন যে এতে সুবুদ্ধির পাপক্ষয় হবে ও তিনি কৃষ্ণের চরণ পাবেন। চৈতন্য যদি সত্যিই অসাম্প্রদায়িক হতেন তাহলে তিনি মুসলমানের পাত্রের পানি খাওয়াকে পাপ ভাবতেন না ও পাপ লাঘবের উপায়ও বাতলাতেন না।
এছাড়া দেখি চৈতন্য নিজের জীবনেও মুসলমানের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতেন। নবদ্বীপের মুসলিম কাজী চৈতন্যের গ্রাম সম্পর্কের মামা হতেন এবং মাঝে মাঝে তাদের বাড়িতে আসতেন। তবে এই “কাজী মামা” চৈতন্যের বাড়িতে আসলে যে আসনে বসতেন তা গঙ্গাজল দিয়ে ধুয়ে শোধন করতে হতো,পানি চাইলে যে পাত্রে পানি দেয়া হতো তা ভেঙে ফেলা বা শোধন করা হতো। আর খাবারের তো প্রশ্নই ওঠে না। নিমাই পণ্ডিত(চৈতন্যের বাল্য নাম) “কাজী মামার” বাড়ি গিয়ে কিছু খেলে বা পান করলে জাতিচ্যুত হতেন।
-বাংলা দেশের ইতিহাস(মধ্য যুগ),পঞ্চম সংস্করণ,পৃষ্ঠা ৩২৫-৩২৬।
এতে আর যাই হোক,মামা ভাগনের মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হয় না। এসব কথা বেশ খোলাখুলিভাবেই চৈতন্যের জীবনীকারেরা উল্লেখ করেছেন। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের সাথে উদারভাবে মিশলেও মুসলমানদের থেকে তিনি দূরেই থাকতেন। আসলে চৈতন্য যা করেছেন তা মূলত সমাজসংস্কার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। জাতিভেদের কড়াকড়ি ও জাতি নষ্টের কারণে বহু হিন্দু ধর্মান্তরিত হচ্ছিল। এতে হিন্দু সমাজ আস্তে আস্তে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছিল। এটা ঠেকানোর জন্যই চৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলন হাজির হয়েছিলো। এর মধ্যে কোন উদার, বৈশ্বিক মানবতাবাদ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

নির্যবন করো আজি সকল ভুবনঃ
চৈতন্যকে তার ভক্তরা প্রেম ও ক্ষমার অবতার হিসেবে দেখেন। কিন্তু ইতিহাস বলে অন্য কথা। নবদ্বীপের মুসলিম কাজীর হুকুমে যখন কীর্তন গান নিষিদ্ধ হল ও বৈষ্ণবদের ওপর বিষম অত্যাচার আরম্ভ হল তখন অনেক বৈষ্ণব ভয় পেয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তাব করলেন। কিন্তু চৈতন্য বললেনঃ
“ভাঙ্গিব কাজীর ঘর কাজীর দুয়ারে।
কীর্তন করিব দেখি কোন কর্ম করে।।
তিলার্ধেকও ভয় কেহ না করিও মনে।”
চৈতন্যের আদেশে তার অনুচরেরা যে কাজীর ঘর ও ফুলের বাগান ধ্বংস করেছিল বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত গ্রন্থে তার বিস্তৃত বিবরণ আছে। কিন্তু বৈষ্ণবদের প্রেমসুলভ মনোভাবের সাথে চৈতন্যের এই উদ্ধত ও হিংসাত্মক আচরণ সুসঙ্গত হয় না সম্ভবত এই কারণে এবং কিছুটা মুসলিম রাজা ও রাজকর্মচারীর ভয়ে তারা এই ঐতিহাসিক ঘটনাটিকে স্বীকৃতি দেন নি এবং বিকৃত করেছেন। বৃন্দাবন দাস ছিলেন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী-কাউকে ভয় পেতেন না। কিন্তু আরেক চৈতন্য চরিতকার মুরারি গুপ্ত ছিলেন গৃহী। তিনি সুলতান হোসেন শাহের ছেলে নসরত শাহের আমলে চৈতন্যের জীবনী লেখেন। কাজীর ব্যাপার ঘটেছিল তার বাবার আমলে। সুতরাং যদিও বৃন্দাবন দাস লিখেছেন যে কাজীর ঘর ভাঙ্গার ব্যাপারে মুরারি গুপ্ত সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন কিন্তু মুরারি গুপ্ত এই ঘটনার বিন্দুমাত্র উল্লেখ করেননি। সমসাময়িক অন্যান্য চৈতন্য জীবনিকারেরাও এই ঘটনা হয় এড়িয়ে গেছেন নয়ত কোনমতে দায়সারাভাবে উল্লেখ করেছেন। ঘটনার প্রায় একশ বছর পরে বৃদ্ধ কৃষ্ণদাস কবিরাজ তার বিখ্যাত গ্রন্থ “চৈতন্যচরিতামৃত” রচনা করেন। তখন আকবরের রাজ্য কেবল শেষ হয়েছে। সুতরাং মুসলিম সরকারের ভয় কম। এই কারণে তিনি কাজীর ঘটনা,তার ঘর, বাগান ধ্বংসের ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন কিন্তু তিনি লিখেছেন এই হিংসাত্মক ব্যাপারে চৈতন্যের কোন হাত ছিল না বরং এটা কয়েকজন উদ্ধতপ্রকৃতি লোকের কাজ। তার মতে চৈতন্য নাকি খুব ভদ্রভাবে কাজীকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে কীর্তন বন্ধ না করা হয়। কিন্তু বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবতে স্পষ্ট আছেঃ
“ক্রোধে বলে প্রভু আরে কাজী বেটা কোথা।
ঝাঁট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলো মাথা।।
প্রাণ লয়া কোথা কাজী গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ প্রভু বলে বার বার।।”
ভাঙ্গিলেক যত সব বাহিরের ঘর।
প্রভু বলে অগ্নি দেহ বাড়ির ভিতর।
পুড়িয়া মরুক সব গণের সহিতে।
সর্ব বাড়ি বেড়ি অগ্নি দেহ চারি ভিতে।।”

শ্রীচৈতন্য আরও বলেছিলেন”নির্যবন করো আজি সকল ভুবন।”
-বাংলা দেশের ইতিহাস(মধ্য যুগ),পঞ্চম সংস্করণ, পৃষ্ঠা ২৬২।
প্রেমধর্মের প্রচারক শ্রীচৈতন্য চেয়েছিলেন পৃথিবীকে মুসলমানশূন্য করতে! কৃষ্ণদাসের চৈতন্যচরিতামৃতে কাজীর সম্পর্কে নানা অলৌকিক ও আজগুবি কাহিনী আছে যেমন চৈতন্যের কাজীর সাথে দেখা করা,তার কাছে কীর্তন করার অনুমতি চাওয়া,কাজীর অদ্ভুত স্বপ্ন দেখা ও সে কারণে কীর্তনের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা,কাজীর বৈষ্ণবধর্মে ভক্তি ইত্যাদি। কিন্তু সমসাময়িক বৃন্দাবনদাসের গ্রন্থে এসব অস্বাভাবিক ও অসঙ্গতিপূর্ণ কাহিনীর কিছুই নেই। একটু যুক্তি খাটালেই বোঝা যায় আসল ঘটনা কি ও পরে তা কি হয়েছে। এখানে কয়েকটি ব্যাপার পরিষ্কার করা দরকার যে চৈতন্য যে কাজীর বৈষম্যমুলক নিয়মের প্রতিবাদ করেছিলেন বা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলেন তার সমালোচনা আমি করছি না। আমি দেখাতে চেয়েছি যে সময়ে সময়ে চৈতন্য খুবই নিষ্ঠুর হতে পারতেন এমনকি তিনি কাজীকে সপরিবারে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। কাজীর ঘর ও বাগান ধ্বংসও তার সরাসরি নির্দেশেই হয়েছিলো। কাজী কোনমতে পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান বলে প্রাণে বেঁচেছিলেন নইলে চৈতন্য যে রুদ্ররূপ সেদিন ধারণ করেছিলেন তাতে কি হত বলা মুশকিল। পৃথিবীকে নির্যবন করার সেই অভিযান হয়ত কাজীকে হত্যার মধ্য দিয়েই শুরু হত।

ভক্তরা তাদের গুরুকে দেখতে চান শুধুই ভাল গুণের সমাহার হিসেবে। তাই তাদের প্রচারণায় ধর্মগুরুদের অন্ধকার দিকগুলি প্রায়ই ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু প্রগতির অন্যতম শর্ত হল সবকিছুর নির্মোহ বিশ্লেষণ ও সত্যানুসন্ধান। ভাল মন্দকে পাশাপাশি দেখলেই তো বোঝা যাবে কোনটা কতটুকু গ্রহণযোগ্য আর কোনটা বর্জনযোগ্য। ভাল দিকগুলি দেখে আমরা শিখবো ও উৎসাহ পাবো আর খারাপ দিকগুলিকে এড়িয়ে চলবো। এটাই সভ্যতার বিকাশের পথ। শেষ করছি হুমায়ুন আজাদের আমার একটি প্রিয় উক্তি দিয়ে-
“অনুরাগী আমি অনেকেরই তবে ভক্ত কারো হতে পারিনি।”