অপরাধের প্যাথলজি?
সামাজিক অপরাধকে প্যাথলজিকাল দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার বিপদ হোলো এটার মাধ্যমে অপরাধকে প্রশ্রয় দেবার মত পরিস্থিতির তৈরি হয়। ফলে পপুলিস্ট প্রতিরোধের মূখে রাজনৈতিক শুদ্ধতার চর্চার প্রয়োজন এবং প্রবণতা দেখা দেয়। এতসব পর্দা পেরিয়ে দরকারি কথাটুকু অনেক সময় বলা হয়ে ওঠে না– আবার বলা হলেও বার্তাটা ঢাকা পরে যায় পর্দার আড়ালে। কিন্তু জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে আচরনবাদি দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা বেড়ে গেছে মানুষের। এই আচরনবাদি দৃষ্টিভঙ্গীগুলোকে কি প্রক্রিয়ায় সামাজিক রীতিনীতির অংশে পরিণত করা যাবে বা করা উচিৎ সেটা একটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু জ্ঞান–বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে সমাজজীবনের ঘটনা প্রবাহকে মূল্যায়নের চর্চা না থাকলে একই সমস্যাগুলোকে যুগের পর যুগ টিকিয়ে রাখাই হবে মাত্র, সামাজিক অপরাধগুলির ক্রমাগত পুরনরুৎপাদন হতে থাকবে ক্রমবর্ধমান হারে। তাই বিবর্তনের দৃষ্টিতে পারিবারিক নির্যাতনের মূল্যায়ন বিষয়ক পুরোনো এই লেখাটাকে আবার সামনে এনে ফেললাম। বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার জন্য আগাম ক্ষমা চেয়ে রাখছি।
লেখাটার ব্যকগ্রাউন্ড
লেখাটি যখন লিখেছিলাম রুমানা-সাইদের ঘটনাটি তখন ভিন্ন এক প্রেক্ষিতে চলছিল। সত্যাসত্য না জেনে কোনো পক্ষ নেয়াটা কঠিন ছিল — আজকেও সেটা খুব সহজ হয়ে যায়নি। তবু সাইদের মৃত্যুর ঘটনায় কিছুটা হলেও ঘটনার আঙ্গিক পাল্টেছে — হয়ত নির্মোহ ভঙ্গীতে যেকোন পরিস্থিতিকে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন আরেকটু বেশি করে আমাদের মনে আসতে পারে এই পরিস্থিতিতে। তাই লেখাটির পূর্ববর্তি সংস্করনে কিছুটা পরিমার্জন করে মুক্তমনায় দিচ্ছি। যখন লেখাটি লিখি সেদিন মুক্তমনায় দেইনি অভিজিৎ দা’র এই বিষয়ে অনেক বেশি সুলিখিত লেখা চলে আসে। অবশ্য সেই লেখাটি আগে চোখে পড়লে এই লেখাটা লেখাই হোতো না, অথবা যেটুকু পড়াশোনা করেছিলাম সেটাও করা হোতো না।
এইবারে মূল লেখাটাঃ
“সুরঞ্জনা, অইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনা :
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর। ”
(জীবনান্দ দাসের কবিতা আকাশলীনার অংশ)
সুরঞ্জনাকে “ঐ যুবকের” সাথে কথা বলতে বারন করেছিলেন জীবনানন্দ দাস — পুরুষ মনের চিরন্তন আকুতি এটা। মানব পুরুষের কাছে তার এই আকুতির আবেদনের অর্থ অগম্য নয় বোধগম্য কারনে, সঙ্গিবিহীন পুরুষও বোঝে “ঐ যুবকের” সাথে কথা বললে মনে কতটা চোট লাগে– নারীর কাছেও পরুষের এই আকুতি অপরিচিত নয়। পুরুষসঙ্গির প্রতি নারীরও কাছাকাছি অনুভূতি থাকার কথা। নারি-পুরুষের আদিরূপের ধারাবাহিকতায় এইধরনের হিংসার অনুভুতি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যেকোন মানুষকে হিংস্রও করে তুলতে পারে। যদি এমনটা ঘটে সেখানে কাব্যময় ব্যপারটা আর কাব্যময় থাকেনা। যেই অনুভূতিটা একটা পর্যায় পর্যন্ত “রোমান্টিক”, সেটা একটা সীমানা ছাড়িয়ে গেলে রীতিমত সমাজসুদ্ধ মানুষকে ভাবিয়ে তোলে, মারমুখী করে তোলে। মনোবিজ্ঞানীরা এরকম সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। আর অধুনা এই চেষ্টার পালে লেগেছে বিবর্তনবাদি হাওয়া। মানবজাতির জ্ঞানের ভান্ডার এতে আরো সমৃদ্ধ হয়েছে বলতে বাঁধা নেই। সমাজবিজ্ঞানের শাখাগুলোর মধ্যে মোটাদাগে রয়েছে দু’টি প্রবল রিডাকশনিস্ট ভাবধারা। একভাগ মনে করেন সব কিছুই সামাজিক কাঠামোর দ্বারা নির্ধারিত হয় আবার বিপরিতে রয়েছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা যেখানে সমষ্টির চরিত্রকে ব্যক্তির চরিত্রের যোগফল হিসাবেই কেবল দেখা হয়। সামাজিক মনোবিজ্ঞানের বিভাগটিও এই দুই এক্সট্রিমিটির যাতাকল থেকে মুক্ত নয়। সেই বিচারে সামাজিক মনোবিজ্ঞানের প্রাক্সিস কিভাবে কাজ করবে সেটা নিয়ে জল আরো অনেকদিকেই গড়াবে অনুমান করা যায়।
মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টায় বিবর্তনবাদি ধারণার ব্যবহার খুব বেশি দিনের নয়। মানুষের সমাজে কেন চিড়িয়াখানা তৈরি হয়, প্রকৃতির কাছে যেতে কেন আমাদের মন কাতর হয়, কাঠামোবদ্ধ জীবন কেন ক্লান্ত করে আমাদের, সভ্যতার এত আরাম আয়েশের ভেতরে সময়ে সময়ে কেন আমাদের মন প্রতিবাদ করে হয়ে ওঠে — এসব পরিচিত ধারনাগুলিকে আমাদের ফেলে আসা জীবনের ধারাবাহিকতায় সহজেই স্থাপন করা যায়। বিশেষ করে ত্রিশ চল্লিশ লক্ষ বছরের অভ্যাস, কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবেই — যেখানে মানুষের জীন নাকি আবার স্বার্থপর। এছাড়া কাটিয়ে ওঠাটা যে জরুরী সেটাই বা বলা যায় কি করে? কেননা অভ্যাস গুলোতো তৈরিই হয়েছে টিকে থাকার প্রয়োজনে। অন্যদিকে সমাজের কাঠামোতেও হচ্ছে পরিবর্তন — জিনের বার্তার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া সমাজের পরিবর্তনের সাথে তাল মেলাতে পারছে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। একশ বছরে সমাজ যতটা পালটায় বিবর্তনের হিসাবে সেখানে একচুল অগ্রগতিও হয় না হয়ত। এটারও কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। ফলে সমাজের পরিবর্তনের গতির সাথে দৌড়ে পেরে ওঠে না বিবর্তন। তবে জিনের স্বভাব আর তার প্রকাশভঙ্গী বোঝার চেষ্টাও থেমে নেই। অধুনা বিবর্তনবাদ থেকে তৈরি নানা ব্যখ্যা মনস্তাত্তিক গবেষনায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। মনস্তত্বের নানা বিষয় বস্তুর পাশাপাশি পারিবারিক নিরব নির্যাতনের ব্যখ্যাতেও এই দৃষ্টিভংগির প্রয়োগের দরুন পাওয়া গেছে কিছু কৌতুহল জাগানো ফলাফল।
পারিবারিক নির্যাতনের ব্যখ্যা খুঁজতে গিয়ে পুরুষকেন্দ্রিক সমাজে পুরুষের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার একটা মাধ্যম হিসাবেই প্রধানত দেখা হয়েছে বিষয়টি — সেই আদলের ব্যখ্যাবিশ্লেষনই প্রচলিত মাধ্যমগুলিতে বেশি দেখা যায়। এর বিপরীতে বিবর্তনীয় ব্যখ্যাগুলো আসার পর প্রচলিত ধারনাগুলো আরো বাস্তব সম্মত এবং পরিমার্জিত করার সুযোগ তৈরি হয়। সেগুলো নিয়ে একাডেমিক পর্যায়ে নানা আলোচনার ধারা চলছে। সেটার একটা অংশ থেকে এখানে উপস্থাপন করব তাদের মূল প্রস্তাবনাগুলো — মোটাদাগে ইম্পিরিকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা সেগুলোর পক্ষেই যাচ্ছে। অনেকের মতে এই নতুন ধারনাগুলোর ভবিষ্যতে পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে সাহায্য করবে।
জৈব প্রতিক্রিয়াঃ হিংসার জ্বলন
ক্ষুধা-তৃষ্ণা-রাগ-ভয় মানুষের জন্য অত্যন্ত দরকারি প্রতিক্রিয়া। এর যেকোনটি ছাড়াই মানুষের পক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব– বিবর্তনের হাত ধরেই এই প্রতিক্রিয়াগুলো মজ্জাগত ভাবে ঢুকে আছে মানুষের মধ্যে। একই রকমের অনুভূতি হিংসার জ্বলন — যেটা সংগীকে ঘিরে বাস্তব বা কাল্পনিক প্রতিযোগীর প্রতি তৈরি হয়। বিবর্তনবাদিরা বলছেন এই জ্বলনের ফলেই নারী-পুরুষের মধ্যে এমন প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় যেটা একই সাথে সাম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিকে নিরাপদ দূরত্বে রাখতে এবং সঙ্গীকে সম্পর্ক ছেড়ে চলে যাবার পথে বা বিশ্বাস ভঙ্গের ক্ষেত্রে বাঁধা সৃষ্টি করে। যেহেতু নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আদিম মানুষ এই রকমের অনুভূতির মুখোমুখি হয়েছে — এখনকার মানুষের হিংসার জ্বলনের অনুভূতি অটুট আছে আগের মতই, যেভাবে আছে ক্ষুদা-তৃষ্ণা-ভয়-ক্ষোভের মত দরকারি অনুভুতি গুলো। আর এগুলোর ওপর ভিত্তি করে মানুষের সমাজে মোটাদাগে বহুগামীতাকে ঘৃনার চোখে দেখা হয় — এবং সম্পর্কের মধ্যে যুগলের ধারনা তৈরি হয়। সন্তানের যদি সনাক্তযোগ্য বামা-মা না থাকে তাহলে কিভাবে মানুষ টিকে থাকবে এই পৃথিবীতে — কে নিজের খেয়ে পরের বাচ্চা মানুষ করতে যাবে? ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের হাত ধরে আসা এই চিরন্তনতার জন্যেই জীবনান্দের “ঐ যুবকের” সাথে কথা না বলার আকুতি নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবার কাছে গভীর আবেদন রাখতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন এই আবেদনের ধরন নারী এবং পুরুষ ভেদে কিছুটা ভিন্ন। মানুষ হিসাবে টিকে থাকার প্রয়োজনে নিজের জীনকে পরবর্তি প্রজন্মে বাহনে নারী-পুরুষের ভূমিকার পার্থক্য থেকেই এই জ্বলুনির ধরনে গুনগত পার্থক্যটা তৈরি হয়।
নারীর হিংসার জ্বলনের ধরণ
সন্তান প্রতিপালনের মাধ্যমে জীনকে প্রজন্মান্তরে বাঁচিয়ে রাখার যে তাগিদ তাতে একজন নারীর উদ্বেগের প্রধান যায়গা হোল তার স্বামী যেন সেই নারীর সন্তানকে প্রতিপালনের পেছনেই একনিষ্ঠভাবে তার মনযোগ দেয়। অন্য নারীর গর্ভে যদি তার স্বামীর সন্তান হয়ও সেই সন্তান বা তার মায়ের প্রতি কোন আবেগীয় আকর্ষন যেন তার পুরুষসংগী অনুভব না করে সেটা নিশ্চিত করতে একজন নারী অনেক দূর পর্যন্ত যেতে পারে। ফলে তার পুরুষ সংগী যদি পরনারীতে আসক্ত থাকে সেটা যদি মূলত যৌন আকর্ষনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক এটাই নারীসঙ্গীটির কাম্য থাকে। পুরুষ সংগীটি যদি অন্য নারী গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়েও তার প্রতি আবেগের টান বোধ না করে নারী সঙ্গী তাতে কিছুটা আস্বস্ত থাকে। ফলে বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় নারীদের ক্ষেত্রে প্রকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া আবেগিক বিশ্বাসভঙ্গের ব্যপারেই বেশি স্পর্শকাতর হয়ে থাকে।
পুরুষের হিংসার জ্বলন
পুরুষের উদ্বেগের ধরনটা আবার অন্যরকম। সে চায়না তার বাসায় কোন কোকিল এসে ডিম পেরে যাক আর সেটা থেকে বের হয়ে আসা ছানা তাকে নিজের ছানা মনে করে প্রতিপালন করতে হোক । ফলে নারিসঙ্গী যদি আবেগের দিক থেকে কোন পুরুষের প্রতি আসক্তও থাকে সেটাতে ততটা বিচলিত না হলেও যৌন সংসর্গের সম্ভাবনার ব্যপারে পুরুষেরা বেশি স্পর্শকাতর হয়ে থাকে। কোকিল যেন ডিম পারার সুযোগ না পায় সে জন্য পুরুষসঙ্গীটি অনেক কৌশল নিয়ে থাকে যার একটা হচ্ছে নির্যাতন — মার খাবার ভয়ে সঙ্গী বিশ্বাস ভঙ্গ করতে সাহস করবে না। কোকিলাক্রান্ত হবার ব্যপারে তার ভয় অনেক রকম — কোকিল ছানা পালনের ঝুঁকিতো আছেই পাশাপাশি তার নারীসঙ্গীটির মনোযোগের ভাগও নিয়ে নিচ্ছে সেই কোকিল ছানা; আর অন্যরা যদি এটা সম্পর্কে জানতে পেরে যায় তাতে থেকে যাচ্ছে লোকলজ্জার ভয়। মানুষকে খাদ্যগ্রহনে প্রবৃত্ত করার জন্য ক্ষুদা নামের অনুভূতি তাকে খাদ্যের অনুসন্ধানে ব্রতি করে জীবন বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে — একইভাবে নিরাপদ নিশ্চিন্ত পিতৃত্বের তাড়না একজন পুরুষের মধ্যে মধ্যে হিংসার জ্বলন তৈরি করে তাকে মারমুখি হতে তাড়িত করে। পিতৃত্বজনিত নিরাপত্তাহীনতার বোধ থেকে সঙ্গিনীর যৌনজীবন নিয়ন্ত্রনের উদ্দেশ্যে মারমুখি আচরনের প্রবনতা দেখা দেয় পুরুষ সঙ্গীটির মধ্যে। পুরুষদের আচরনের আরো কিছু দিক নিয়েও আলোচনা করেছেন বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা — যার কিছু এখানে বিবৃত করার চেষ্টা করব।
মারমুখি হবার আগে হিসাব নিকাশ!
পুরুষরা প্রকৃতিগতভাবে এমন ভাবে বিবর্তিত হয়েছে যাতে করে সঙ্গিনীর যৌন বিশ্বাস ভঙ্গের সম্ভাবনা এবং ঝুকি নিরূপনে সে সবিশেষ পারঙ্গম। এর মধ্যে রয়েছে সঙ্গীনি যৌনতা ঘটিত বিশ্বাস ভঙ্গের মত সময় তার কাছ থেকে দূরে থাকল কিনা সেটার মূল্যায়ন করা, সঙ্গিনীকে পটিয়ে বিশ্বাসভঙ্গে বাধ্য করতে পারে এরকম অন্যপুরুষদের উপস্থিতি আঁচ করতে পারা, তার স্ত্রীর প্রজননঘটিত উৎপাদনশীলতা যাচাই করা অথবা সঙ্গিনীর দিক থেকে বিশ্বাস ভঙ্গ করার সম্ভাবনা কতটা প্রকট সেটার আঁচ করা ইত্যাদি। তবে অনেক ক্ষেত্রে এই সব ব্যপারে পুরুষের মন অতিস্পর্শকাতর হতে পারে। মানে যদি তার আঁচ করার ক্ষেত্রে ভুল হয়, ভুলটা সে নিরাপদ এলাকায় থেকে করে। মানে “ফলস পজিটিভ” (False Positive) হতে পারে কিন্তু “ফলস নেগেটিভ” (False Negative) হবার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ সঙ্গিটি কোকিলের পাল্লায় পড়ে নি কিন্তু পুরুষটি ভাবছে পড়েছে — এমনটা হবার সম্ভাবনাই বেশি — তার বিপরীতের চেয়ে। তবে পুরুষটি মারমুখি হবে কিনা সেটা নির্ভর করে আরো কিছু নিয়ামকের ওপরও । সেগুলো সম্পর্কেও সে মনে মনে কিছুটা হিসাব করে নিয়ে তবে মারমুখি হয়। যেমন সামাজিকভাবে সঙ্গিনীকে পেটানো কতটা খারাপ চোখে দেখা হয়, সঙ্গিনীর অত্মীয়রা কতটা প্রতিশোধ পরায়ন হতে পারে, আর পুরুষটি তার সঙ্গিনীর ওপর আর্থিকভাবে কতটা নির্ভর করছে সেগুলোও নিয়ামক হিসাবে কাজ করে নির্যাতনের সম্ভাবনার নিরূপক হিসাবে। এছাড়া সঙ্গিনী কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটা যাচাই করতেও পুরুষরা কিছুটা পাহাড়াদারি কৌশল প্রয়োগ করে থাকে।
পাহারাদারি
সঙ্গিনী কখন কোথায় যাচ্ছে সেটার খোঁজখবর রাখা, সঙ্গিনী কি করছে যাচাই করতে হঠাৎ করে না বলে বাসায় ফিরে আসা, সম্ভব হলে অন্য পুরুষদের দৃষ্টির আড়ালে সঙ্গিনীকে লুকিয়ে রাখা। এই পাহাড়াদারি যে মূলত পিতৃত্বের নিরাপত্তার খাতিরে, সেটার প্রমান হিসাবে দেখা গেছে পুরুষেরা মুলত তখনই পাহারাদারি কড়া করে যখন তার সঙ্গিনীর প্রজনন সম্ভাবনা অথবা অন্য পুরুষের হাতে পরার ভয় বেশি থাকে। আপাত নির্ভেজাল রোমান্টিক একটা ভঙ্গিও মারমুখি অবস্থার পূর্বাভাস হতে পারে। যেমন পাহারাদারি তুঙ্গে থাকার সময়কালের পরেই সঙ্গিনীকে মারধর করার ঘটনা বেশি দেখা যায়। আবার যেসব পুরুষ সঙ্গি হঠাৎ না বলে বাড়িতে ফিরে এসেছে অথবা স্ত্রীকে বলছে “তোমাকে ছাড়া বাঁচবনা” (প্রেমিকদের কাছে ক্ষমা চাই!!) তাদের পক্ষে সঙ্গিনীর প্রতি মারমুখি হবার সম্ভাবনা বেশি। অপর দিকে যারা তার সঙ্গিনীকে ধরে রাখার জন্য নিজের ভালবাসা বা নিজের যোগ্যতার দোহাই দেয় তাদের ক্ষেত্র সঙ্গিনীর প্রতি নির্যাতনের সম্ভাবনা কম। এগুলোর পক্ষে নারী এবং পুরুষ সঙ্গিদের প্রশ্ন করে যে উত্তর পাওয়া গেছে তা এই ব্যাখ্যাগুলিকেই সমর্থন করে। এর বাইরেও আছে যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত আলোচনা।
দুইতত্ত্বের ঠোকাঠুকিঃ শুক্রানুর প্রতিযোগীতা
ঘনিষ্ট সঙ্গিনীর প্রতি যৌন নিপীড়ন, জবরদস্তি বা মেরিটাল রেপ নিয়ে প্রচলিত তত্ত্ব হচ্ছে — এটা কিছু কিছু পুরুষের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যে প্রতিষ্ঠার একটা মাধ্যম — Dominance and Control hypothesis। এর এর বিপরীতে বিবর্তনবাদি তত্ত্ব হচ্ছে শুক্রানুর প্রতিযোগীতা তত্ত্ব বা Sperm Competition Hypothesis। এখানেও কোকিলাক্রান্ত হবার ভয়ে পিতৃত্ব ঘটিত অনিশ্চয়তা বোধ থেকে জবরদস্তি হয়। অর্থাৎ যখন পুরুষ সঙ্গী জবরদস্তি করে তখন তার মনে সঙ্গিনী সম্পর্কে বিশ্বাসভঙ্গের সন্দেহ কাজ করে। কোকিল এসে ডিম পেরে গেছে বা যেতে পারে এই ভয়ে পুরুষটি মরিয়া হয়ে ওঠে তার নারী সঙ্গীর দেহে শুক্রানু প্রবেশ করিয়ে দিতে। তখন সঙ্গিনী বাঁধা দিলে পুরুষটির সন্দেহ আরো দানা বাঁধে এবং সে জবরদস্তি বাড়িয়ে দেয়। দেখা গেছে যখন পুরুষরা তার নারিসঙ্গীর ব্যপারে বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ করছে তার পরপরই জবরদস্তির ঘটনা ঘটছে বেশি। যুগল পর্যায়ে এই ধরনের জবরদস্তির ঘটনা যাচাইয়ের জন্য অন্য প্রানীদের আচরনও বিশ্লেষন করে দেখেছেন বিজ্ঞানীরা। যেহেতু বেশিরভাগ প্রানীর ক্ষেত্রেই এই যুগলের ধারনা নেই — ফলত যুগলের মধ্যে জবরদস্তির ব্যপারটি যাচাই করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দেয়। তবে দেখা গেছে পাখিদের কিছু কিছু প্রজাতির মধ্যে সামাজিক একগামিতার বা Social Monogamy-এর প্রচলন আছে — মানে এরা যুগলবদ্ধ থাকে। কারন যুগল বদ্ধ না থাকলে এই তুলনার কোন অর্থ হয়না। তাদের ওপর পর্যবেক্ষন থেকে পাওয়া যায় চমকপ্রদ ফল। দেখা গেছে এইসব পাখিগুলোর ক্ষেত্রে মিলনের জবরদস্তির ঘটনা তখনই ঘটে যখন অন্য পুরুষকে আশে-পাশে বেশি দেখা যায়। অল্পসময়ের ব্যবধানে এক নারী একাধিক পুরুষের সাথে মিলিত হবার সম্ভাবনার যখন বেশি থাকে তখন পুরুষসঙ্গীটি চায় মিলনের পরে একাধিক পুরুষের শূক্রবীজের মধ্যে যেন অন্তত প্রতিযোগীতা হতে পারে; সেজন্যেই জবরদস্তির ঘটনা ঘটে। ইতিহাস বিশ্লেষনে দেখা গেছে মানুষের বিবর্তনীয় ধারাক্রমে একই নারীর ক্ষেত্রে কাছাকাছি সময়ে একাধিক পুরুষের সাথে মিলিত হবার ঘটনা অহরহ ঘটেছে যাতে একই নারীর প্রজনন অঙ্গে একাধারে একাধিক পুরুষের বীর্য বর্তমান ছিল। যুগল বদ্ধ কিছু পাখির ক্ষেত্রে দেখা গেছে বিশ্বাস ভঙ্গের সময়ে নারীর প্রজনন অঙ্গে অন্যসময়ের চেয়ে বেশিবীর্য ঢেলে দেবার ক্ষমতাও দেখা যায়। হিংসার জ্বলনের সাথে এই ধরনের জবরদস্তির সম্পর্ক আছে বলে প্রমান মিলেছে। আর পুরুষ এবং নারিদের বক্তব্য থেকেও অবিশ্বাস এবং জবরদস্তির সময়কালের মিল পাওয়া গেছে — অর্থাৎ অবিশ্বাস থেকেই যে এধরনের জবরদস্তি হয় সেটার পক্ষে প্রমানের পাল্লা ভারী হয়েছে। তবে হিংসার জ্বলন থেকে নারীর ওপর আক্রমনের ক্ষেত্রে পুরুষদের মধ্যেও রকম ফের দেখা গেছে। বিশেষ করে হীনমন্য পুরুষদের এই ধরনের অবস্থায় বেশি আক্রমনাত্মক হতে দেখা গেছে।
হীনমন্য পুরুষের বিশেষ ক্ষেত্র
সঙ্গির মধ্যে যেসব গুন থাকলে একজন নারী তাকে বেঁছে নিতে পারে সেগুলোর বিচারে যেই পুরুষ পিছিয়ে থাকে মানে Competitively Disadvantaged Male — তাদের আচরন ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেছেন বিজ্ঞানীরা। এদের পিছিয়ে থাকাও নানারকমের হতে পারে। যেমনঃ এরা হয়ত মেয়ে বন্ধুদের মন জয় করার কৌশল জানেনা কারন তাদের সামাজিক দক্ষতা কম; অথবা শারিরীকভাবে এরা তেমন আকর্ষনিয় নয় অথবা এদের অর্থিক সঙ্গতি কম। এরকম নানাকারনে “প্রেমের বাজারে” এদের কদর কম থাকে যেটার ব্যপারে এরা নিজেরাও মোটামুটি সচেতন। দেখা গেছে এধরেনের পুরুষেরা তাদের স্ত্রীদের ওপর জবরদস্তি বেশি করে থাকে। ইম্পিরিকাল গবেষনার ফল থেকে পাওয়া যায়, এই ধরনের ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার নারী-পুরুষের মিলনের সাথে বিপরীতানুপাতিক, যুগলের সন্তানের সংখ্যার সাথে সমানুপাতিক। পুরুষটি পিছিয়ে থাকলেও যদি স্বামী-স্ত্রীর নিয়মিত দৈহিক মিলন ঘটে সেক্ষেত্রে নির্যাতনের হার কম হয়। হয়ত পুরুষটি নিরাপদ বোধ করে বলে। আবার যদি এই যুগলের সন্তানের সংখ্যা বেশি হয় তাহলে সঙ্গিনী ছেড়ে চলে যাওয়াটা বেশি ঝুকির। সেই ক্ষেত্রে পুরুষটি বেশি আগ্রাসী আচরন করে থাকে।
আগ্রাসী আচরনের সাথে বয়সের সম্পর্ক
আগ্রাসি আচরনের ধরন সম্পর্কে দু’টি বিকল্প তত্ত্ব ছিল। একটার বক্তব্য ছিল — সাধারনত কম বয়সের পুরুষেরাই বেশি আগ্রাসী হয় — কারন তাদের নিজেদের আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রন কম। তবে এই ক্ষেত্রে বিবর্তন বাদি ব্যখ্যা হচ্ছে — যেকোন পুরুষই নারিদের প্রজনন ক্ষমতা যখন বেশি থাকে অর্থাৎ যুবা নারি সঙ্গীদের প্রতি বেশি স্পর্শকাতর হয়। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের পুরুষও যদি বিশ বছর বয়সি নারির সঙ্গী হয় সেও নির্যাতন প্রবন আচরন করে। কারন মেয়েদের মনোপজ পেরিয়ে গেলে প্রজনন গত কারনে বিশ্বাসভঙ্গের ফলাফল বেশি ক্ষতিকর হয় না। যেহেতু নারি সঙ্গীটির প্রজনন ক্ষমতা ততদিনে প্রায় বা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয় ফলে পুরুষ সঙ্গীটি তেমন একটা পাত্তা দেয়না আগের মত। যেহেতু যুবা বয়সের পুরুষদের নারী সঙ্গীরাও বয়সে যুবা সেই কারনে হয়ত প্রথম তত্ত্বটি এসে থাকতে পারে। তবে এই ক্ষেত্রে দু’টো তত্ত্বের পক্ষেই প্রমান পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক শহরের পুলিশের নির্যাতন সংক্রান্ত তথ্য পরিসংখ্যানিকভাবে যাচাই করে যে ফল পাওয়া গেছে তার ফলাফল মোটামুটি এরকমঃ (ক) মেয়েদের বয়স বাড়ার সাথে পারিবারিক নির্যাতনে হার কমতে থাকে (খ) যুবা পুরুষদের নির্যাতক হবার সম্ভাবনা বেশি (গ) প্রজনন ক্ষম যুবা নারিসঙ্গীদের নির্যাতনের শিকার হবার সম্ভাবনা প্রজননে অক্ষম বয়স্কা নারীদের চেয়ে ১০ গুন বেশি (ঘ) প্রজননক্ষম বয়সের মেয়েদের বেশি নির্যাতনের শিকার হবার ক্ষেত্রে যুবা বয়সের দুর্বল আত্মনিয়ন্ত্রনক্ষম পুরুষের সঙ্গী হওয়া একমাত্র কারন নয়।
পরিশেষে
উপরের অনেক ক্ষেত্রেই আলোচনায় মনে হতে পারে পুরুষটি ইচ্ছা করে জেনে শুনে তার প্রতিক্রিয়াগুলো দেখায় — কিন্তু বিবর্তন সংক্রান্ত আলোচনায় একটা বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার যে আচরনগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় সহজাত — কারন লক্ষ লক্ষ বছরের অভ্যাসের দরুন মানুষের আচরনে এই ধরনের প্রতিক্রিয়াগুলো এমন ভাবে গেঁথে আছে যে একটা নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে এখনকার সমাজব্যবস্থায় সেটা প্রযোজ্য না হলেও সঙ্গি বা সঙ্গিনীর আচরনে হেরফের হয় না। যেমন আধুনিক সমাজে বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্কের অনিশ্চয়তা অনেকটা কমিয়ে আনা হয়েছে ফলে প্রাচীন সমাজের তুলনায় বহুগামীতার ভয় কম। আবার যেখানে পরকিয়ায় শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে জন্মনিরোধক ব্যবহার করার সুযোগ থাকার দরুন পুরুষ সঙ্গিটির পক্ষে স্ত্রীর দিক থেকে বিশ্বাসভচঙ্গের ঘটনা ঘটলেও অন্যের সন্তান পালনের ঝুঁকি কম। কিন্তু তাতে কি, বিবর্তনিয় আচরনের ধারাবাহিকতায় কাল্পনিক শুক্রানুর প্রতিযোগীতার জন্য স্ত্রীর ওপর জবরদস্তি যৌন নির্যাতন চালাতে পারে আবার সন্দেহের বশবর্তি হয়ে স্ত্রীর ওপর শারিরীক নির্যাতনও চালাতে পারে।
—————————
বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু বক্তৃতার লিঙ্কঃ
অন্য কিছু গবেষনার ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদি মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ নিয়ে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পাওয়া যাবে নিচের লিংকগুলোতে।
(এক) মানুষ বুদ্ধিমান প্রানী হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা আচরনগত ভাবেই বোকার মত আচরন করবে। মানে এমনটাই করার কথা আরকি। কাজেই অর্থনীতি গবেষনায় রাশনাল মানুষের ধারনা প্রশ্নের মুখে পড়ছে এই ধারনা। এই ধরনের সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত ব্যখ্যা রয়েছে এরিয়ালির “প্রেডিক্টেবলি ইর্যাশনাল” বইতে। এখানে এই প্রথাবদ্ধ বোকার মত আচরনের পেছনে বিবর্তনিয় ব্যখ্যা দিচ্ছেন লিরি স্যান্টস। বানরদের জন্য কৃত্রিমভাবে বাজার তৈরি করে তিনি দেখার চেষ্টা করছেন তাদের আচরনে মানুষের আচরনে যেরকম অস্বাভাবিকতাগুলো আছে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে কিনা।
httpv://www.youtube.com/watch?v=Rb11zdIqOi0
(দুই) সাফল্য চাইলেও সবাই সফল হয়না। যারা সফল হয়না তারা কেন ভেঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যায়না, সেই কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিবর্তন কিভাবে সাহায্য করেছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সে প্রশ্নের উত্তর খুজতে গিয়ে ড্যান গিলবার্ট গত বিশ লক্ষ বছরে মানুষের মস্তিষ্কের বিবর্তনের সাথে মানুষের সুখবোধের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছেন এখানে। দুঃখকে জয় করার চেষ্টাতেও বিবর্তনের একটা ভূমিকা রয়ে গেছে। মানুষে অদ্ভুত মানিয়ে নেবার ক্ষমতা কেবল একজীবনে নয় জন্মান্তরে বাহিত হয় জীনের ভেতর দিয়ে।
httpv://www.youtube.com/watch?v=LTO_dZUvbJA
(তিন) শিশুকাল থেকে পূর্ণ বয়স্ক মানুষ হিসাবে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে জন্মগত ভাবে পাওয়া স্বভাব আর চারপাশের পরিবেশের প্রভাব বুঝতে গিয়ে প্রশ্ন আসে মানব শিশুর মন/মস্তিষ্ক কি একটা সাদা খাতার মত — যার গায়ে সমাজ এবং চারপাশের পরিবেশ লিখে দেবে তার আচরন কি হবে — নাকি জন্মের সময়েই সেখানে অনেক কিছু লেখা থাকে যেটা তার আচরনকে প্রভাবিত করে। এই প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টাতেই স্টিভেন পিঙ্কার লিখেছেন “The Blank Slate: The Modern Denial of Human Nature” — এই বই সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন এই টেড বক্তৃতায়ঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=CuQHSKLXu2c
(চার) মানুষের হিংস্র আচরনের একটা উদাহরন গনহত্যা। সেটার আলোচনাতেও এসেছে বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞানের চমৎকার প্রয়োগ। তবে এখানে মানব সমাজের কাঠামোগত পরিবর্তন কিভাবে হত্যার হারকে কমাতে সাহায্য করেছে সেই ব্যখ্যা থেকে আশার বানীও খুজে পাওয়া সম্ভব। দেখা গেছে সমইয়ের সাথে সমাজে হত্যার হার কমেছে — আবার সভ্য দেশগুলোতে বাস করলে অন্য কারো হাতে হত্যার শিকার হবার সম্ভাবনা কম থাকে। সেগুলোর আচরন গত ব্যখ্যা দিয়েছেন পিঙ্কার। সরাসরি বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের প্রয়োগ না থাকলেও আজকের আলোচনার সাথে এর একটা যোগাযোগ রয়েছে। নিচে এনিয়ে পিঙ্কারের বক্তৃতার ভিডিওঃ
httpv://www.youtube.com/watch?v=ramBFRt1Uzk
বিবর্তন দিয়ে ব্যাখ্যা করলে রুমানার স্বামী কেন গোলাম আজম সহ সবাই নির্দোষ, কারণ বিবরতনীয় মনোবিজ্ঞান অনুযায়ী তাদের অপরাধ করাটাই সাভাবিক।কিন্তু এর পাশাপাশি বিবরতনীয় বিচার ব্যবস্থার কথাও বলতে হবে। আইন এবং বিচার এবং শাস্তি প্রদান অপরাধ সংগঠন এর অনুকুল পরিবেশ তৈরি করতে বাধা প্রদান করে,তাই বিচার ও শাস্তি প্রদান সভ্যতার কাজ।পরকালে কেউ শাস্তি দেবার জন্য বসে নেই।অপরাধ এর শাস্তি হলে অপরাধ কমবে ,নিরমুল হয়ত হবে না।মানব সমাজ এর কাজ অপরাধ এর বিচার ও শাস্তি প্রদান।অনুকুল পরিবেশ না পেলে যেমন কোন রোগ জীবানু বংশ বিস্তার করতে পারে না , তেমনি ভাবে অনুকুল পরিবেশ না পেলে অপরাধি ও অপরাধ করতে পারে না। অপরাধ করার অনুকুল পরিবেশ ধংশ করা ই মানব সভ্যতার কাজ। এটা ই সভ্যতা।
প্রবন্ধটি অসম্ভব সুন্দর হয়েছে। তবে লেখাটাতে রুমানা সাইদের ঘটনাটিকে আলতো ভাবে স্পর্শ করে লেখার মোড় যেন অন্যদিকে ঘুরে গেছে । লেখার বিষয় বস্তু সার্বক্ষণিক রুমানা সাইদের সাথে থাকেনি ।থাকলে মনে হয় আর একটু ভাল হত । এই ধরনের সামাজিক কেস স্টাডি কে নিয়ে মুক্তমনাই নিয়মিত লেখা আসলে আমাদের মত গণ্ডমূর্খদের জন্য খুবই ভাল হয় । এব্যাপারে আমি মুক্তমনার সকল লেখকদের বিনিত অনুরধ করছি। অসংখ্য ধন্যবাদ রিয়াজ ভাইকে এমন একটা সুন্দর লেখা আমাদের উপহার দেবার জন্য । [img]d[/img][img]D:\soft-14-04-11\my photo[/img]
@মাসুদ রানা, যেমনটা বলেছি লেখাটা পুরোনো — তখন রুমানা সাইদের কথা ভেবে লিখলেও মনে হচ্ছিল রুমানা সাঈদের ব্যপারে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নানামুখি প্রবাহ রয়েছে, রয়েছে বিভিন্নমুখী ফ্যাক্ট। তবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার হচ্ছে সাঈদের আচরন অনেকটাই সিচুয়েশনাল — কিন্তু লেখার প্রথম লাইনেই যেমন বলেছি — এই প্যাথলজিকার দৃষ্টিভঙ্গীর কিছু বিপদ রয়েছে। তাই কোন উপসংহারে দ্রুত না পৌছে চেষ্টা করেছি প্রাসঙ্গিকতা বোঝার কাজটা পাঠকের ওপর ছেড়ে দিতে। আমি কোন অনুমিত অবস্থান নিতে চাইনি আরকি। সেটা করতে গেলে লেখাটায় আরো অনেক যত্নের দরকার পরত।
দারুণ লেখা! লিখতে থাকুন। শুধু অভিজিৎদার লেখা পড়লে তো আমাদের চলবে না,তাই না! 😛
@নিটোল, ধন্যবাদ, প্রেরণাদায়ি মন্তব্যের জন্য।
যৌক্তিক ব্যাখ্যাগুলো ভাল লেগেছে,সাথে প্রেক্ষিত রুমানা-সাইদ এর প্রাসঙ্গিকতাও স্পষ্ট।
@গীতা দাস, অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
পরিস্থিতি আপনা-আপনি তৈরী হয় বলে মনে হয় না, ন্যাচারালাস্টিক ফ্যালাসির শিকাররাই পরিস্থিতিটা তৈরী করে নেন। তাঁরা বুঝতে চান না যে প্রেসক্রিপশন আর ডেসক্রিপশনের মাঝে পার্থক্য আছে।
অভিজিতদার পাশাপাশি আপনিও লিখতে থাকুন। বাংলায় বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সম্ভার তো মোটে একজন সমৃদ্ধ করতে পারবেন না 🙂
@পৃথিবী,
বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞান ভিষন কৌতুহলের একটা যায়গা — কিন্তু তবু মাই কাপ অব টি বলতে পারব কিনা সন্দেহ আছে। তবে এই ক্ষেত্রে আমি অবশ্য সুবিধাবাদি ভাবি অন্যে কেউ করুক আমি একটু অন্য কিছু করি — এই আরকি!!
ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির ব্যপারটাতে কি বুঝিয়েছেন ঠিক ধরতে পারিনি। কিন্তু আমার এখন লেখার পেছনে মূল ভাবনা হচ্ছে বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞানের চমৎকার ব্যখ্যাগুলো থেকে আমরা যেসব ধারনা জানতে পারি সেগুলোকে কিভাবে সামাজিক সমস্যা মোকাবেলায় কাজে লাগানো যায় সেটা নিয়ে ভাবা। মানে সাইদকে পশু বলে আখ্যা দিয়ে আমি নিজে হয়ত একধরনের আত্মতৃপ্তি পেলাম — আবার এটাও স্বিকার করে নিলাম যে হয়ত সাইদের পরিস্থিতিতে একই আচরনে সবাই “হয়ত” করত না। কিন্তু বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞানের ব্যখ্যা সাইদের মনস্তত্বকে যেভাবে আমাদের সামনে এনে ফেলছে সেটাকে কেবল কিছু কৌতুহলি — বুদ্ধিবৃত্তিক গোষ্ঠীর আলোচনার বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকতে হবে এটা আমার কাছে অপরিহার্য মনে হচ্ছে না। মানে আমি একদিকে চাচ্ছি মাস এওয়্যার নেসের মতো কিছু আসুক অন্যদিকে চাচ্ছি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এই জ্ঞানগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য কিছু করা হোক — বিশেষ করে ক্লিনিকাল সাইকোলজি — প্রচার মাধ্যম এসব ক্ষেত্রে। বেশ একটু মোটাদাগের কথা হয়ে গেলো তবে আশা করি আমার অবস্থানটা বোঝাতে পারছি।
@পৃথিবী,
ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির বিষয়টি দেখলাম। এই ফ্যালাসির বিপদ্গুলিও লক্ষ্য করলাম। সেই দিক থেকে এই পোস্টের সাপেক্ষে একটা ক্লারিফিকেশান আমার দেবার আছে অবশ্য। আমার বক্তব্য হচ্ছে — যদি সাইদের আচরন ব্যাখ্যা করা যায় ন্যাচারালিস্টিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে তাহলে বলা যায় যে কোন পুরুষের জন্যেই সাইদের মত পরিস্থিতিতে সাইদের মত নির্যাতক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। নিশ্চিত ভাবে নির্যাতনের ঘটনা না ঘটলেও সম্ভাবনা বেড়ে যাবার ব্যপারটি সম্ভবত সবাই স্বিকার করবেন – কেননা তা না হলে বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানে আস্থা রাখার কোন অর্থই হয়না। আমি মনে করছি — বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞানের ব্যখ্যাগুলো গ্রহন করে আমাদেরকে এথিকস আর মোরালিটির ধারনা পাল্টানোর প্রয়োজন নেই — কিন্তু যেসব অপরাধ বিবর্তনিয় আচরনের কারনে কিছুটা প্রেডিক্টেবল হয়ে পরে সেগুলোকে ঘটার আগেই আটকে দেয়া যায় কিনা। এই ক্ষেত্রে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের বা প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার পরিবর্তনের দিকে তাকানো যেতে পারে। উপরে স্টিভেন পিঙ্কারের শেষ বক্তৃতাটি বিশেষ করে এই প্রসঙ্গে রেফারেন্স হিসাবে দেখাব। কিভাবে সময়ের সাথে হত্যার হার কমে এসেছে সেটার বর্ণনা দেখে আমরা স্বিকার করতে বাধ্য হব যে প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাসের মাধ্যমে অনেক সাইদের ভেতরের পশুটিকেই ঘুম পারিয়ে রাখা যায়। এর জন্য ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির ট্র্যাপে পরার প্রয়োজনও পরে না।
@রিয়াজ উদ্দীন, আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম যে সাইদের আচরণকে বিবর্তন মনোবিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করার মধ্যে ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসির কোন অবকাশ নেই, কারণ প্রকৃতি নৈতিকতার দৃষ্টান্ত হতে পারে না, তাই সাইদের আচরণের কোন প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দিলেও সেটা সাইদের আচরণের জাস্টিফিকেশন হবে না। আমি বলছি না যে আপনি এই হেত্বাভাসের শিকার হয়েছেন, তবে সাধারণ মানুষের মাঝে ন্যাচারালিস্টিক ফ্যালাসিটা প্রবল। বস্তুত, আমজনতার মাঝে এই হেত্বাভাসের প্রাবল্যের পেছনে কোন বিবর্তনীয় কারণ আছে কিনা, সেটাও একটা কৌতূহলোদ্দীপক গবেষণা প্রকল্প হতে পারে।
@পৃথিবী,
আপনার অবস্থান বুঝেছি আর আমি মূলত আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ বিষয়টি সামনে আনার জন্য। প্রকৃতি নৈতিকতার দৃষ্টান্ত হতে পারে কিনা বা হওয়া উচিৎ কিনা এটা সেটা আসলে অনেক বড় একটা ফিলসফিকাল প্রশ্ন। এই বিষয়ে এক বাক্যে কোন সিদ্ধান্তে পৌছানো যাবে বলে আমার মনে হচ্ছে না। বাস্তব জগতে নৈতিকতার মাপকাঠি তৈরিতে প্রকৃতির সাথে সমঝোতা করেই যাবতিয় নৈতিকতার মাপকাঠিগুলো তৈরি হয় — কনভেনিয়েন্স সব ক্ষেত্রেই বড় একটা ফ্যাক্টর হয়ে থাকে। সম্প্রতি বিজ্ঞানের আলোকে নৈতিকতা নির্মানে একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে — প্রকল্পটা কতটা সফল সেটার মূল্যায়নের মত বিশদাকারে আমি বিভিন্নমুখি অবস্থানগুলি তুলনা করে দেখিনি। আমি স্যাম হ্যারিসের মোরাল ল্যান্ডস্কেপ বইটির কথা বলছিলাম (লিঙ্ক)। আলোচনা বেশ চমৎকার হয়েছে বইটিতে কিন্তু একটা কিছু সিদ্ধান্তে এখান থেকে পৌছানো সম্ভব কিনা বা বিজ্ঞান কে নৈতিকতার প্রধান এবং প্রথম মাপকাঠি হিসাবে মেনে নেয়া চলে কিনা এই প্রশ্নের উত্তর এসেছে কিনা আমি জানিনা। অনুমান করি মুক্তমনায় নিশ্চয়ই বইটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে বিজ্ঞানের রিডাকশনিস্ট দৃষ্টিভঙ্গী সমাজবিজ্ঞানিরা মেনে নেবেন কিনা সেটা নিয়ে আমার সংশয় রয়েছে।
@রিয়াজ উদ্দীন, আপনি বলছেন প্রকৃতি নৈতিকতার দৃষ্টান্ত হতে পারে কি না? অথবা হওয়া উচিত কি না । আমি মনে করি হওয়া উচিত তবে পারে কি না এব্যাপারটা ব্যাখ্যার দাবীদার । আশা করি এব্যাপারে পরবর্তীতে আপনি লেখবেন ।
@মাসুদ রানা,
আপনি আপনার অবস্থানটা ব্যখ্যা করতে পারেন — কিছু উদাহরন দিয়ে অথবা যেই নির্দিষ্ট চিন্তা থেকে আপনার এটা মনে হোলো সেটার ওপর ভিত্তি করে।
আমি মনে করি প্রকৃতি নৈতিকতা ভিত্তি হবে কিনা সেটা আসলে একটা বাইনারি দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখা সম্ভব নয়। কারন নৈতিকতার প্যারামিটার অনেক থাকবে। কারন প্রকৃতির মধ্যে অনেক বৈপরীত্য আছে একজনে আরাম বোধ অন্যের আরামবোধের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। ফলে কেবল মাত্র প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে এধরনের নৈতিকতা নির্মান করা সম্ভব নয়।
তবে প্রকৃতি নৈতিকতা নির্মানের একটা বড় বিবেচ্য হওয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাজার অর্থনীতি অনেকটাই মানুষের স্বভাব বা আচরনকে আমলে নেয় — সেই তুলনায় সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আমরা বলতে পারি একটা নর্মেটিভ এবং আরোপিত ব্যবস্থা।
তবে যেমনটা বললেন বিষয়টি অনেক বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে — কিন্তু সেটা আমার পক্ষে করা হয়ে উঠতে নাও পারে। তবে এখানে এই আলোচনা আসলে অংশগ্রহনের ইচ্ছা রাখি।
চমৎকার লেখা হয়েছে (Y)
@স্বাধীন ভাই,
অনেক ধন্যবাদ। আমার বিষয়না — কিন্তু অভিজিৎদা তার লেখাটা লিখতে দেরি করলেন বলে আমাকে এই এলাকায় ঢুকতে হোলো।
ভাগ্যিস, আমার লেখাটা আগে দেখেন নাই। না হলে এই চমৎকার লেখাটা থেকে আমরা বঞ্চিত হতাম।
আপনার এই লেখার কন্টেট আগেই জানাছিলো। আবার দেখে ভাল লাগলো ভিন্ন আঙ্গিকে। লেখাটা মুক্তমনায় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আরেকটি বিষয়, একটা প্রসঙ্গে মন্তব্য। এটা আপনার লেখার বিষয়ে নয়, সামগ্রিকভাবেই বলছি। হিংসা, রাগ, ঘৃণা কিংবা ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের লেখাগুলো লেখার সময় কিছু ব্যাপারে আমাদের সাবধানতা নিয়ে লিখতে হবে। এমনিতেই ব্যাপারগুলো স্পর্শকাতর, তার উপর যদি একটু এদিক ওদিক হোয়ে যায়, তবে অনেকের মনেই ‘জাস্টিফিকেশন’ এর ব্যাপার চলে আসতে পারে। যেমন, আপনার লেখার এই লাইনটি পড়তে পড়তেই মনে হচ্ছিলো –
কেউ কেউ আপনার বলা ‘আচরণগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় সহজাত’ শুনে ভাবতে পারেন যে অপরাধকে হয়তো অবচেতন-মনেই জাস্টিফাইয়ের চেষ্টা হচ্ছে বধ হয়। সাইদের হিংসা সহজাত, লক্ষ লক্ষ বছরের অভ্যাসের দরুন মানুষের আচরণে প্রতিফলিত – আমাদের কীই বা করার আছে ভাব চলে আসতে পারে! কাজেই এই বিষয়ে স্পর্শকাতর লেখা লেখার সময় বার বারই পাঠকদের মনে করিয়ে দিতে হবে কী বনাম উচিৎ এর হেত্বাভাস (“Is” vs. “Ought” fallacy) -এর ব্যাপারটি। কেন সমাজ বা মানবপ্রকৃতির বড় একটা অংশ কোন একটা নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ থাকে সেটা বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যায়, সমাজ কিরকম হওয়া ‘উচিৎ’ তা নয়। আরো পরিষ্কার করে বললে বিবর্তন কোন অথোরিটি দাবী করে না। আমি সেজন্যই আমার আগের লেখাটা শেষ করেছিলাম এই বলে – ‘হ্যাঁ, আমরা সবাই সাইদের কৃতকর্মের শাস্তি চাই। কোন সুস্থ মাথার মানুষই প্রত্যাশা করবেন না যে, এ ধরণের নৃশংস ঘটনা ঘটিয়ে সাইদ অবলীলায় মুক্তি পেয়ে যাক, আর তৈরি করুক আরেকটি ভবিষ্যৎ-অপরাধের সুস্থিত ক্ষেত্র। বরং, তার দৃষ্টান্তমুলক শাস্তিই কাম্য। কিন্তু সমাজে যখন নারী নির্যাতন প্রকট আকার ধারণ করে, যখন নৃশংসভাবে একটি নারীর গাল নাক কামড়ে জখম করা হয়, রাতারাতি চোখ খুবলে নেয়া হয়, এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলোও আমাদের খুঁজে বের করা জরুরী। আমাদের বোঝা দরকার কোন পরিস্থিতিতে সাইদের মত লোকজনের আচরণ এরকম বিপজ্জনক এবং নৃশংস হয়ে উঠতে পারে। আমাদের অস্তিত্বের জন্যই কিন্তু সেগুলো জেনে রাখা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে একটি সুন্দর পৃথিবী তৈরির প্রত্যাশাতেই এটা দরকার’।
আমি যখন উপরের কথাগুলো লিখেছিলাম, তখন সাঈদ জীবিত ছিলেন, আর আপনার লেখটা মুক্তমনায় প্রকাশের সময় সাইদের মৃত্যু হয়েছে, তৈরি করেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট। অনেকের মধ্যেই দেখছি নানারকমের সহানুভূতি তৈরি হয়েছে এটাকে কেন্দ্র করে। এ প্রসঙ্গে ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাস ছিল এরকমের-
হাসান সাঈদ মরিয়া প্রমাণ করিলেন তিনি মরেন নাই। অসংখ্য পুরুষতান্ত্রিক শুয়োরের হৃদয়ে শুয়োর হইয়া ঘাপটি মারিয়া বসিয়া আছেন নির্লিপ্তে।
কথাগুলো উদ্ধত হলেও, মিথ্যে তা বলা যাবে না।
@অভিজিৎ, আপনি কিন্তু আপনার এই নিয়ে আগের লেখার লিঙ্ক টা দেন নি দিলে বেশী ভাল হত । আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে সাইদের মৃত্যুর পর রুমানাও কিন্তু ব্যাপারটিকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়নি। সাইদের মৃত্যুতে সে মর্মাহত এব্যাপারে সে সাংবাদিকদের বলেছে। আসল কথা হচ্ছে আমরা অনেকেই সাইদের মৃত্যুতে রুমানা উল্লসিত হবে বা হোক এটা আশা করেছিলাম হয়ত ।কিন্তু হইনি। আমি মনে করি এটাই আমাদের ‘আচরণগুলি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় সহজাত’ লেখকের এই উক্তিটির বাপারে পজিটিভ করেছে। এবং পুরুষের এই নৃশংস আচরণের মনস্তাত্ত্বিক কারন খুজে বের করার ব্যাপারে আগ্রহী করেছে। যেটা সাইদ বেঁচে থাকলে ভাবনাই নাও আস্তে পারত। [img]D:\soft-14-04-11\my photo[/img]
@মাসুদ রানা,
আপনি অভিজিৎদাকে প্রশ্ন করেছেন — উনি উত্তর দেবেন তবে আমি আমার কিছু অভিমত জানাই আলোচনার খাতিরে।
উপরে আমার লেখার শুরুর দিকে অভিজিৎদার লেখাটার লিংক আমি দিয়েছি। ওটা তখন একটা সিরিজের অংশ হিসাবে এসেছিল।
এখানে আমি একটা বিষয়ে কিছুটা স্পষ্ট করতে চাই — বিশেষ করে আমার লেখার প্রেক্ষিতে। আমি প্রথম যখন এই বিষয়ে লিখি তখন সাঈদ জীবিত ছিলেন। (লিঙ্ক)। সাঈদের মৃত্যুতে পরিস্থিতি কতটা পাল্টেছে আমি জানিনা — তবে আমার অবস্থান তেমন পাল্টেনি। আমি আগেও যেমনভাবে দেখছিলাম বিষয়গুলিকে এখনো একই ভাবে দেখছি। সাঈদের আচরনকে আচরনবাদি দৃষ্টিতে দেখাটা একটা পিচ্ছিল রাস্তা। অভিজিত দাও সেই দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করেছেন তার লেখায়।
তবে পশু আর মানুষের যেই ডাইকটমি তৈরি করা হচ্ছে এর অনেকটাই সামাজিক নির্মান (social construct) –ভালমন্দের দ্বৈততা এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রুমানা সাঈদের ব্যপারটাতে আইন আদালতের কথা বা সমাজভিত্তিক কনস্ট্রাক্ট নির্ভর বক্তব্য অনেক ভাবেই আসা সম্ভব এবং বিভিন্নমুখি এই অবস্থানগুলি সামনে আসাও উচিৎ। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের জন্য মানুষের আচরনের পেছনে জৈবিক প্রতিক্রিয়া এবং কার্যকারন জানা থাকলে অনেক অনাকাংখিত পরিস্থিতি এড়ানো যায়। সেই বিবেচনা থেকেই এই লেখাটি লিখেছি। আর আমার যতটুকু মনে পড়ে অভিজিত দার লেখাটাও (যেটার সাথে এই লেখার অনেক ওভার ল্যাপ রয়েছে আরো মৌলিক রেফারেন্স ব্যবহার করা হয়েছে) একই ধরনের।
@অভিজিৎ, আপনি বলেছেন ” হিংসা, রাগ, ঘৃণা কিংবা ধর্ষণ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিবর্তন মনোবিজ্ঞানের লেখাগুলো লেখার সময় কিছু ব্যাপারে আমাদের সাবধানতা নিয়ে লিখতে হবে” । হা ঠিক আছে সাবধানতা কিছু থাকা উচিত। কিন্তু সাবধান হয়ে লেখতে হবে এই আশঙ্কাই যাতে কলম থেমে না যায় অথবা কলমের গতি শ্লথ না হয়, এই ব্যাপারটিও সমানভাবে বিবেচনার দাবীদার। কথাই আছেনা ” দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটাকে রুখি সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি “। তাই সত্যকে সামনে নিয়ে আসার স্বার্থে একটু হলেও সাহস করে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে লেখা আসবে বলে আমি আশা করি । [img]D:\soft-14-04-11\my photo[/img]
@অভিজিৎ, আপনি লিখেছেন ” সাইদের মৃত্যুতে তৈরি করেছে ভিন্ন প্রেক্ষাপট। অনেকের মধ্যেই দেখছি নানারকমের সহানুভূতি তৈরি হয়েছে এটাকে কেন্দ্র করে “ব্যাপারটি আমার কাছে কিছুটা বোধগম্য নয় । সাইদের মৃত্যুতে ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে নানারকমের সহানুভুতি তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ ঠিক আছে । কিন্তু ফেসবুকের স্ট্যাটাস কি সহানুভূতির প্রমান। সহানুভুতি তৈরির উদাহরণ হিসেবে ফেসবুকের স্ট্যাটাস টা কি অপ্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছেনা? যেহেতু আপনি এটা কে নিজেই বললেন ” কথাগুলো উদ্ধত হলেও, মিথ্যে তা বলা যাবে না।” তাই উদ্ধত কথাগুলি কি সহানুভূতি তৈরি অথবা ভিন্ন প্রেক্ষাপট তৈরির উদাহরণ? কথাগুলি একদম সত্য কারন এক সাইদের মৃত্যু হলেও লক্ষ সাইদ এখনও জীবিত ।ভাববেন না যে আমি তিল কে তাল করছি অথবা সাইদের পক্ষ নিচ্ছি ।” কাদম্বিনী মরিয়াও প্রমান করিল সে মরে নাই ” রবি ঠাকুরের এই কথার সাথে ফেসবুকিও স্ট্যাটাসের কোন মিল রয়েছে বলে মনে হয় কি?[img]D:\soft-14-04-11\my photo[/img]
@অভিজিৎ দা,
রুমানার ওপর নির্যাতনের ঘটনার পর থেকে মন খচ খচ করছিল। একজন পাঠক হিসাবেই ভাবছিলাম আপনি কেন এই বিষয়ে লিখছেননা। বিবর্তনিয় মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে আমার তখন কিছুটা কৌতুহল দানা বাঁধছিল। তাই ভাবলাম ধুর না হয় লেখাটা ভাল না হোলো, কিছু একটা কারুর লেখা উচিৎ। কয়েকটা পেপার নামিয়ে এটা লিখে ফেললাম।
আর বিপদের কথা যেটা বলছেন সেটা চোখে পড়েছে। সে জন্যেই লেখার প্রথম প্যারায় এই কথা গুলো লিখেছিলাম।
আমার কাছে মনে হয়েছে এই বিষয়ে লেখাটি লেখার সময়ে আসলে “is vs ought” এর বিচারে আমি যে is এর দিকে আছি সেটা ভেবেই লেখাটি লিখছি এবং পাঠকও সেভাবে লেখাটা পড়ুক।
যদিও রুমানা সাইদ এই বিষয়টির একটা উপল্পক্ষ মাত্র তবু সবচেয়ে জরুরী প্রশ্ন হচ্ছে আমরা এই “স্বভাবজাত” বিষয়টির জ্ঞানকে কিভাবে praxis এর মধ্যে আনব?
আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়েছে সাইদের ফলস নেগেটিভের পাল্লায় পড়েছিল — আর এই ক্ষেত্রে তার মনে কাজ সন্দেহ দানা বাঁধার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় একসাথে ভূমিকা রেখেছিল। স্ত্রীর কানাডায় বসবাস যেখানে তার পক্ষে স্ত্রীকে “দেখে রাখা” সম্ভব ছিলনা, স্ত্রীর অশ্রদ্ধা যেটা হয়ত সাইদের আচরনেরই ফল, বাচ্চা থাকার কারনে অনিশ্চয়তা বোধ আরো বেড়ে যাওয়া, সাইদের তুলনায় রুমানার মেটিং ভ্যালু বেড়ে যাওয়ায় একধরনের অনিশ্চয়তা বোধ ইত্যাদি তার মানসিক অবস্থা তৈরির পেছনে ভূমিকা রেখেছিল। এই ধরনের পরসিস্থিতি তে সাইদের আচরন প্যাথলজিকাল ব্যপারগুলোতে ক্রমাগত নেগেটিভ ফিডব্যক দিচ্ছিল — তৈরি হয়েছিল একটা ফিডব্যাক লুপ। এই লুপের থেকে বের হবার কাজটি মূলত স্বামীস্ত্রীর হাতেই বর্তায়। প্রশ্ন হচ্ছে বাহ্যিক হস্তক্ষেপ ছাড়ে এই ধরনের পরিস্থিতি সম্ভবত বেশিরভাগ দম্পতির পক্ষেই সামলে নেয়া সম্ভব হয়না। উত্তর সুচিত্রার অভিনীত ইন্দ্রানী ছবিটির কথা মনে পড়ছে। সেখানে উত্তমকুমারের চরিত্রে যেই জটিলতা গুলো দেখা গিয়েছিল সেটা বাস্তব এবং বেশিরভাগ সমাজেই এই বিষয়টির রয়েছে। ১৯৫৪ তে তৈরি হলিউডের সিনেমা a star is born (ইউটিউব লিঙ্ক) থেকেও এই ধরনের থিম দেখতে পাই আমরা। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি স্টার জলসায় একটা সিরিজ ছিল গানের ওপারে সেখানেও এই ধরনের কিছু দম্পতি ছিল যেখানে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার খাতিরে মেয়েটি নিজের ক্যারিয়ারে ছাড় দেয়। ব্যপারটির মধ্যে মানুষের বায়োলজিকাল আর জেন্ডারড পরিচয়ের একটা ভূমিকা আছে এটা বোঝা যায়। আবার পোস্টে যেটা উল্লেখ করেছি — স্বামীর হিংস্রতা বাড়ার ক্ষেত্রে সন্তানের সংখ্যা একটা ফ্যাক্টর। এই জন্যেই স্বামী-স্ত্রীর (বা অন্য যেকোন এরেঞ্জমেন্টের যুগল) একার পক্ষে এই ধরনের পরিস্থিতি সব সময় হ্যান্ডেল করতে পারবে কিনা সেটা দেখার বিষয়।
উন্নত বিশ্বে ম্যরেজ কাউন্সেলিং বলে একটা ব্যপার আছে। এই ক্ষেত্রে সেটা হয়ত কাজে আসতে পারত হয়ত। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে সাইদের আর রুমানার যে ঘটনা সেটাকে পুরোপুরি দূর করা না গেলেও জটিলতাগুলো সম্পর্কে স্পষ্টতর ধারনা থাকলে হয়ত এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কমানো সম্ভব। আমার মতে সাইদ আর রুমানার ঘটনা থেকে এটাই আমাদের টেক হোম লেসন হওয়া উচিৎ। এখানে নর্মেটিভ এবং পসিটিভ গ্রাউন্ডে কয়েকটা পয়েন্ট পাইঃ
১) সাইদের আচরন কিছুটা হলেও প্রেডিক্টেবল ছিল — হীনমন্যতা, তুলনামূলক মেটিং ভ্যালু কমে যাওয়া সহ নানা কারনে ফলস নেগেটিভ সন্দেহের গ্রাউন্ড থাকা, একটি সন্তান থাকা ইত্যাদি মিলিয়ে
২) সাইদ রুমানার মত সেটিং অনেক দম্পতির বেলাতেই হতে পারে — কিন্তু আমাদের সমাজে এই ধরনের পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার মত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব রয়েছে। এই প্রাতিষ্ঠানিক শুন্যতা পুরনে কিছুর করার প্রয়োজনীয়তা বোঝার এখনি উৎকৃষ্ট সময়। পুরুষের ভেতরে পশু লুখিয়ে আছে এটা মেনে নিয়েই — এই পশুটিকে আজীবন লুখিয়ে থাকার সুযোগ দেয়াটাই আমাদের কালেকটিভ দায়িত্ব।
কেবল এটাই মনে হচ্ছে অনেক কিছু করার এবং বলার আছে কিন্তু বলা বা করা হচ্ছে না। আমরা সবাই একটা কাঠামোর মধ্যেই আটকে গেছি মনে হচ্ছে।
@রিয়াজ উদ্দীন,
কারেকশান —
বলতে চাইছিলাম *ফলস পজিটিভ*