সাদা কালো আর ম্যাটম্যাটে নানা রঙের ঘুড়ির মত ফাইটারগুলোতে আকাশ ছেয়ে গেছে। বারো তেরটা তো হবেই। থেকে থেকে কানের পাশে অথবা ঘাড়ের পেছনে ঠিক যেন কাপড় ছেঁড়ার শব্দ হচ্ছে। ছাদগুলো থেকে উল্লাসের শব্দ, ভীষণ গোলযোগ সবদিকে। উত্তেজনায় শরীরের সবকটা রগ যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। চিৎকার করতে করতে গলা ভেঙে যাচ্ছে। শোঁ শোঁ শব্দ কখনো রূপান্তরিত হচ্ছে তীক্ষ্ণ বাশীর মত শব্দে। শুনতে পাচ্ছি আব্বার কণ্ঠে ধমকের আওয়াজ, বড়বু’র আকুল কণ্ঠে ঢেউ খেলানো ডাকাডাকির শব্দ, সোনাভাইয়ের ভয় পাওয়া হিসহিসে কণ্ঠে নেমে আসবার হুমকির ডাক। এতসবের মাঝেও ঠা ঠা ঠা ঠা শব্দ, ভূপ ভুপ ভূপ ভূপ আওয়াজ, অনেক মানুষের দৌড়োদৌড়ির শব্দ, আরো নতুন অদ্ভূত সব রোমাঞ্চকর শব্দগুলোকে মনে হচ্ছে লক্ষ নতুন শব্দ। কখনো একাকার হয়ে যাচ্ছে আবার কখনো আলাদা হয়ে যাচ্ছে শব্দগুলো। দুঃসাহসী ছোট বড় ছেলেগুলো, যাদেরকে ঘুড়ি ওড়াবার সময় দেখি, ওদের অনেককেই দেখছি আমার মত করেই লাফালাফি করে যাচ্ছে যার যার বাড়ীর ছাদে। কখনো উল্লাস উদ্বাহু নৃত্য করছি আমরা, কখনো একটানা চিৎকার চলছে আমাদের। ঘুড়ি ধরবার লম্বা লগ্গিটা তাক করে গেণ্ডারিয়ার বাড়ীর ছাদে এক মহা দুরন্ত কিশোর আমি, লম্বা বাঁশটাকে বন্দুক ভেবে আমিও এক একটা ফাইটারের ডানায় গুলি ছুঁড়ে আগুন ঝরাচ্ছি। ঠা ঠা ঠা ঠা ঠা, ভূপ্ ভুপ্ ভূপ্ । সময়টা দুপুর, ডিসেম্বরের ৩ তারিখ, ১৯৭১ সাল ।
পরদিন, ডিসেম্বরের ৪ তারিখে সকাল দুপুর দিনভর, গতকালের মত ঢাকার আকাশের উত্তর-পশ্চিম কোনে অত্যন্ত দ্রুত গতির অনেকগুলো ফাইটার ছুটে বেড়াচ্ছে । ভয়ঙ্কর কালো কয়েকটাকে দেখছি। খুবই গম্ভীর আওয়াজ করছে। আবার চকচকে রূপালী ঝিলিক মারা কয়েকটা জেত ফাইটার তাড়া খেয়ে বেজায় জোরে ছুটছে এঁকেবেঁকে। ম্যাটম্যাটে রঙের দুটো ফাইটার আবার সাহসী ঘুড়ির মত খাড়া উঠে যাচ্ছে। প্রায় আলিঙ্গনরত বুকে বুকে লেগে থাকা রুপালীটা অন্য ফাইটারকে নিয়ে খাড়া উঠে যাচ্ছে দূর আকাশে। বেয়াড়া-বদ তৃতীয় ঘুড়ির মত আর একটি ফাইটার ম্যাট্ম্যাটেদের দু’পাশটায় আর পেছনে সাদা সাদা ধোঁয়ার কদমফুল বানাচ্ছে। ঠা ঠা ঠা ঠা, ভূপ্ ভূপ্। হঠাৎ যেন পেছনের এই বেয়াড়াটার নিতম্বে কশে লাত্ মারলো কেউ। চরকির মত পাক খেতে খেতে আর বিকট আওয়াজ করতে করতে দূরে হারিয়ে গেলো ওটা। বুকে লাগা দুটো ততক্ষণে অনেক উঁচুতে কালো বিন্দু হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল এক সময়। একটু পরেই দেখা গেল দূরে সেদিকটা ব্যাঙের ছাতার মত কুঁচকুঁচে কালো ধোঁয়া, তাঁর ভেতর থেকে মাঝে মাঝে আবার ব্যাঙের ছাতার মত সাদা ধোঁয়া দেখছি । কয়েকখানা ফাইটার প্লেনকে দেখছি জান-পরান নিয়ে লড়তে। আমার শিরায় শিরায় তখন ছুটছে পৃথিবীর প্রবলতম উত্তেজনার স্রোত। উম্মাদনায় আর আনন্দে গলা চিড়ে ক্রমাগত চিৎকার করে চলেছি । অন্য আরো চার পাঁচটা আমার দৃষ্টি সীমায় তখন। ওরা কেউ কাউকে দাবড়াচ্ছে আবার কোনটা বা লেজ তুলে পালাচ্ছে। আরো দুটো ফাইটার কাটাকাটি খেলতে খেলতে পাঁয়তারা কষছে বুকে বুক লাগিয়ে ঊর্ধ্বাকাশে মারামারি করবার। আকাশ বাতাসে ভাসা বিচিত্র শব্দগুলো নতুন সব রোমাঞ্চে কাঁপাচ্ছে সবাইকে । শব্দগুলো আলাদা হচ্ছে, ফেটে পড়া উল্লাসে নতুন কাঁপন উঠছে, তারপর আবার একাকার যাচ্ছে । চলছে তো চলছেই । ঢাকাবাসীর সাথে আমিও দেখছি, শুনছি, চিৎকার করছি, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় বাংলা, অস্থির উন্মাদনায় ফেটে পড়ছি সবাই। আগুনে ধোঁয়ায়, আলোতে আওয়াজে আনন্দে বেদনায় গড়াচ্ছে চোখের পানি । এত সবের মধ্যেও ভাবছি মুক্তিযুদ্ধে চলে যাওয়া আমার বড় ভাই দুটো ওদিকটায় নেই তো ? ওরা আসবে তো ফিরে? আমার বাইপোলার মা হঠাৎ হঠাৎ রান্না করে দুটো প্লেটে খাবার বেড়ে বসে থাকে ওদের জন্যে । দেশ তা’হলে কি সত্যিই স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে? কেউ তা’হলে ইচ্ছে করলেই আমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারবে না আর? মিলব্যারাকের মিলিটারি মিলিটারি ক্যাম্পের পাশে সাইকেল চালাবার অপরাধে সেদিনের মত ওরা আমাকে পিটিয়ে চামড়া ফাটাতে পারবে না তো আর? নতুন দুলাভায়ের জন্য কার্ফু ব্রেকে পেঁয়াজু শিঙাড়া তেলেভাজা আনতে গিয়ে রাজাকার রাজা গুণ্ডার রাইফেলের বাঁটের মার খাবো না তাহলে আর? পাঞ্জাবীপুলিশ নামের মিলিটারি ‘বাচ্চালোগ ছোড় দো রাজা’ বলা অফিসারের বুটের প্রচন্ড লাথি খেয়ে ড্রেনে মুখ থুবড়ে পড়তে হবে না আর তা’হলে? আমার বড় বুবু দু’জনকে নিয়ে তাহলে আর আতঙ্কে থাকবে না দাদু? খিঁড়কী দরজার মত ভাঙ্গা পাচিলের ফোঁকর গলে বোনগুলোকে বাঁচার জন্য অন্য বাড়ীতে পালাতে হবে না আর? বাজারে তা’হলে খাবার পাওয়া যাবে অনায়াসে? ব্যাটারী, চিনি, চাল, ডাল, তেল, নুন, কাঠ, কেরসিন সব? বড় রাস্তার দুপাশের ডোবায় ফুলে থাকা কাক ঠোকরানো চক্ষুবিহীন অনেকগুলো ছ্যাদা হয়ে যাওয়া লাশ দেখতে হবে না তা’ হলে আর। স্বাধীনতা সত্যিই আসছে? ঘুরপাক খাচ্ছে কত কথা মাথায়। আহাহা কী উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, আহা কী আনন্দ।
পরদিন, ডিসেম্বরের ৫ তারিখ, উল্টো দিকে, পাগলার দিকে, বুড়ীগঙ্গার ওপর, আবার শব্দ, আবার ফাইটার, আবার কালো ধোঁয়া, উত্তেজনা, ফাইট ফাইট ফাইট। ডিসেম্বর ৬, এবার কান ফাটিয়ে শুরু হল ঢাকার আকাশে মারামারি, ছাতার মত কালো ধোঁয়া, তীক্ষ্ণ চিঁইই চিঁইই চিঁইই করে বোমা পড়বার শব্দ, আবার প্রায় প্রথম দিনের মত বুকে বুকে লাগা ডগ ফাইট, ফাইটারের মেশিনগান কড়্কড়্ কড়্কড়্ , এন্টি এয়ারক্রাফট গানের ভূপ্ ভূপ্ ভূপ্, ব্যাঙের ছাতার মত সাদা ধোঁয়া, টেনিস বলের মত সাদা ধোঁয়া আকাশে, আনন্দ উত্তেজনায় পাগল হয়ে যাচ্ছি আবার।
সেদিন, পরদিন, তারপর, তার পরদিন আরো তিন চার দিন, চারিদিক থেকে খবর আসছে এয়ার আট্যাকের, সাফল্যের, আনন্দের, স্বাধীনতার। দেশজোড়া প্রচন্ড এয়ারএট্যাক হচ্ছে। মিত্র বাহিনী, মুক্তি বাহিনী জিতে চলেছে। আহা কি আনন্দ।
দু’দিন পর, ১৪ ডিসেম্বর । ভয়ঙ্কর দেখতে সেই কালো ফাইটারগুলো আকাশে শিষ দিচ্ছে। এত কাছে যে মনে হচ্ছে পাইলটকে দেখা যাবে। অসম্ভব দ্রুত গতির ঝিলিক মারা কয়েকটা ফাইটার গভর্নর হাউস মানে বঙ্গভবনকে কেন্দ্র করে সুবিশাল ব্যাসার্ধের চক্কর মারছে। কড়কড় করে গুলি ফাটাচ্ছে। দূর আকাশে ডগ্ফাইট দেখতে পাচ্ছি। এদিকে আবার সেই চেনা তীক্ষ্ণ চিঁইই চিঁইই চিঁইই বোমা পড়বার শব্দ পেলাম। অনেক কাছে, অনেক জোরে। মনে হল যেন গুলিস্তান সিনেমা, স্টেডিয়াম, ডিআইটি কিংবা গভর্নর হাউসের মাথায় কয়েকটা বোমা পড়লো। ওদিকে আকাশ ফাইটারে ফাইটারে ছেয়ে আছে। কিন্তু কোন ডগ ফাইট নেই, নেই কোন পাল্টা আক্রমণ। থেকে থেকে আবার শুনছি ঐ সব মহাউত্তেজনাকর শব্দ। দূরে বহু দূরে সাদাকালো ধোঁয়া । অনেকক্ষণ পর দেখলাম সবাই হঠাৎ খুব হাসি খুশী হয়ে কথা বলছে। সবাই ব্যাস্ত যেন কী সব নিয়ে । আব্বা বলছেন ফুল লাগবে কাল, অনেক ফুল। আশেপাশের বাড়ীগুলো থেকে অনেক ফুল জোগাড় করতে হবে, শব্দ হচ্ছে, ভাইগুলো কোথায়? ওরা মরে যায়নি তো, ওদের চোখগুলো কাক খেয়ে ফেলেনি তো? ওরা আসবে তো? স্বাধীনটা আসবে, সবাই বলছে, বলছে বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেয়েছে, ভারত, জাতিসঙ্ঘ, ভয়ঙ্কর সেভেন্থ ফ্লিট, আরোরা নিয়াজী সারেন্ডার, স্বাধীনতা, কত কথা যে ভাসছে বাতাসে, সবাই অনেক অনেক কথা বলছে। আমার মাথায় শুধু একটাই ভাবনা আর পেটের ভেতর প্রজাপতি, ভাইগুলো কখন আসবে? কখন স্বাধীন হব? আব্বাকে বার বার বলতে শুনলাম, ফুল, ফুল লাগবে।
১৫ ই ডিসেম্বর, ফুলবাড়িয়ার সেই পূরোনো রেললাইন ধরে আব্বার সাথে গিয়েছি হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির পাশে টিকাটুলির মোড়ে, খুব অস্থির অবস্থা, সবাই অস্থির, উল্লাস, উত্তেজনা ভয় কান্না আর আনন্দ একসাথে জড়িয়ে একটা অদ্ভূত অবস্থা। হঠাৎ হঠাৎ টাঁশ্শ্ টাঁশ্শ্ কিংবা ট্যাঁট্ ট্যাঁট্ ট্যাঁট্ গুলির শব্দ। ভিক্ষে করতো যে মেয়েটা, ফাতু, ওর হাতে নাকি গুলি লেগেছে। রক্তাক্ত বাহু নিয়ে কেঁদে উঠবার বদলে হাসাহাসি করছে ফাতু। ক’জনা গজগজ করতে করতে ওরই আচল ছিঁড়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো। মেয়েটাও দিব্ব্যি ন্যাংটো বাচ্চাটাকে কোলে তুলে হেসে হেসে ভিক্ষে করতে চলে গেল। বহুদিন পর আজ অনেক অনেক আনন্দিত মানুষ তাই অনেক ভিক্ষে পাবে ফাতু।
পরদিন ১৬ই ডিসেম্বর গেলাম পুরোনো রেললাইন ধরে সেই একই যায়গায়, এবার হরদেওর পেছনে মোড়টায়, বিকালে। হাতে অনেক ফুল, পাঁচ ছটা মালা আর সীমাহীন উত্তেজনা। দেখছি একের পর এক ট্রাক, হুড খোলা জীপ, উঁচু উঁচু ট্রাক, ভারতীয় সেনারা ঢুকছে শহরে, মাথায় হেলমেট, ঢুকছে অল্প কিছু মুক্তিযোদ্ধাও, কেউ কেউ আবার আকাশের দিকে থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি ছুঁড়ছে আর হাসিমুখে চারিদিকে তাকাচ্ছে। সবাই হাসিমুখে হাত মেলাচ্ছে ধীরগতির ট্রাকে বসে বা দাঁড়ানো ভারতীয় সেনা আর মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে, ফুল নিচ্ছে, মালা নিচ্ছে। জীপগুলোতেই মুক্তিযোদ্ধারা বেশি, প্রাইভেট কারে উপচে পড়া মুক্তিযোদ্ধারা আরো বেশি। সবাই হাসছে, নীচে কেউ কেউ কাঁদছে। ভাইগুলোকে দেখতে না পেয়ে আমারও কান্না পাচ্ছে। একটু পরপর উত্তেজনায় কান্না ভুলে যাচ্ছি। সবাই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে জয় বাংলা, সবাই হাসছে, লাফাচ্ছে হাত নাড়ছে। আব্বাকে বার বার জিজ্ঞেস করছি ভাই আর ভালভাই এখনো আসছে না কেন? মালা আর ফুল শেষ হয়ে গেলো কিছু বুঝতে না বুঝতেই। তারপরও অনেক্ষণ আব্বা আর আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। মুগ্ধ চোখে, সম্মোহিতের মত হাটখোলার মোড়ের দিকে ছুটে চলা শয়ে শয়ে অবিরাম ট্রাক জীপ গাড়ী প্রাইভেট কার, লাল সবুজে হলদে ম্যাপ আঁকা পতাকা, আর মুক্তিযোদ্ধাদের দেখছি। ভাই দুটো নেই এদের মধ্যে। এতো মুক্তিযোদ্ধা এলো, ওরা তো এলো না। ওরা কেন বুঝতে পারছে না ওদের ছোট্ট একটা কিশোর ভাই ভেজা চোখে কী অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে? অন্তত এক ডজন প্রজাপতি আমার পেটের ভেতর অবিরাম উড়ে চলেছে। ভাই দুটো আসছে না কিছুতেই।
এই ক’দিনে শিখে গেছি ফাইটারের বুকে বুক লাগা যে যুদ্ধ ওটা ডগফাইট। প্লেনগুলো মিগ টুয়েন্টি ওয়ান, ঝাপসাগুলো হান্টার, আরো কত কি । তাড়া খাওয়াগুলো ৭১ ডিসেম্বরের ৪ থেকে ১৪, ঢাকার আকাশদৃশ্য আর ১৫ এবং ১৬ই ডিসেম্বরের ঢাকার ঘটনা এইগুলো শত্রুদের স্যাবর জেট । লোহারপূলের তাজ ডেকোরেটরের মিনু ভাইয়ের বাবা আর বড় ভাই নিজের বাড়ীতেই ফাইটারের ছোঁড়া গুলীতে স্বাধীনতার মাত্র দু’দিন আগে মরে গেল । মানুষ এখনও মরছে কেন? আব্বা বললেন ইউনিভার্সিটি এলাকায় নাকি অনেক ভাল বড় মানুষদের ধরে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলেছে গেছে আলবদররা। অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা, ভয়, আনন্দ, উত্তেজনা, অশ্রু, হাসি, কান্না আরো অনেক কিছু একাকার হয়ে এসে গাল মহান স্বাধীনতা ।
আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাই দুটো আলাদা ভাবে ফেরে হপ্তাখানিক পর । আব্বার দুই খালাত ভাই, নেওয়াজ পরিবারের ছোটবাবুচাচা আর বড়বাবুচাচা, সেই চা বাগানের হিলি চাচারা আজো ফেরেনি। দাদুর শেয়ার সার্টিফিকেটগুলো মুক্তিযুদ্ধের সময় পোকারা খেয়েছে, ওগুলো আর লুকিয়ে রাখা অনেক অনেকগুলো পাকিস্তানি টাকা কোনকালেই আর ক্যাশ করা যায়নি। আমাদের বাড়ীতে রয়ে যাওয়া বড়’বু, ওর ছেলে হল। দাদু ছোটবুর বিয়ে দিতে পেরেছিলেন ওই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই, বলতেন ঘরে মিলিটারির দেখবার আগে নাতজামাই দেখাই ভালো। ও হ্যাঁ, আমার অবিরাম ঘ্যানঘ্যানানির চোটে ভাই (বড় ভাই) গুলিবিহীন একটা রিভলভার, আর ভালোভাই (মেজভাই) দারুণ ভারী একটা পিস্তল আমাকে হাতে নিয়ে দেখেতে দিয়েছিলো পরে। আমি ভেবেছিলাম রাজাগুন্ডাকে ওটা দিয়ে মারবো। তা হবার ছিলো না, হয়ওনি। ওকে অন্য কেউ মেরে ফেলেছিলো শুনেছি। ভাই দুটো যথাসময়েই অস্ত্র ফেরৎ দিয়েছিলো।
(দুরন্ত একটি কিশোরের স্মৃতিনির্ভর এই লেখাটাতে যেটুকু মনে পড়েছে সেটুকুই লিখেছিলাম ২০১১’তে, মুক্তমনা ব্লগে । প্রত্যক্ষদর্শী, আপনাদের যা কিছু মনে পড়ে, অনুগ্রহ করে মন্তব্যে লিখে দিন। ওগুলো দিয়েই এই লেখাটি পূর্ণতা পাক, থেকে যাক নতুনদের জন্য । ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে)
লেখাটি এক কিশোরীর স্মৃতিকেও উসকে দিল। দেখা যাক, স্মৃতির সাথে কলম ছুটে কিনা।
@কাজী রহমান
“হে পুরাতন, পুরনো বলো তবে নুতনকে শোনো,
হে নুতন, নুতন বলো তবে পুরনোকে শোনো”
একটি হিন্দি কবিতার বাংলা অনুবাদ করলে মোটামুটি যা দাঁড়ায়…
সব নুতনদের এক কাতারে দাঁড় করিয়ে বিচার করলে যারা ওই কবিতার প্রতিটি অক্ষর আর বাক্যের সাথে তাল মিলিয়ে চলে, (যা হয়ত জন্মগত) এবং প্রতিনিয়ত জীবনচর্চার মাঝে সে বিশ্বাস অনুশীলন করে তখন তাদের প্রতি কি অবিচার করা হয় না?
@কাজী রহমান,
আপনাকে একটি অনুরোধ করি? ৭১ কে কেন্দ্র করে ছোট বড় সব স…ব স্মৃতি যখনই মনে আসে লিখে ফেলবেন?
মনে বোধ হয় সব সময়ই থাকে, তবে তা প্রকাশের একটি কারন, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা এসব লাগে। উদ্দেশ্য আর ইছার কথা বলতে পারবনা, তবে একটি বছর যারা এক যুগের মতন পার করেছে ৭১-এ, সেই বছরের খুঁটিনাটি কোন কিছুই যেন কিছু যুগ পর বিলীন না হয়ে যায়। শুধুমাত্র এ কারণটি যথেষ্ট হোক?
আসলে এ অনুরোধ সবার কাছে। আমার যে মা লিখা বন্ধ করে দিয়েছেন তাকে প্রায়শই ৭১ এ নিয়ে যাই, তার অতীতে নিয়ে যাই, তার চোখে ওই সময়টা দেখার তাড়নায়। আমাদের সকলের মূল্যবান অতীত যেন প্রাণ না হারায় সে তাগিদে। আপনার এ লিখাটি অসাধারণ এক উপহার আপনার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে। যারা এ উপহারের মূল্য দিতে জানবেন তারা আপনারই মতন ভাগ্যবান।
****এমন লিখা শুধুমাত্র ডিসেম্বার মাসে কেন লিখতে হবে? ভাষা নিয়ে কেন শুধুমাত্র ফেব্রুয়ারী মাসে লিখতে হবে? এটা অনেকটা নিজ মাকে শুধু “মা দিবসে” মনে করার মতন হয়ে যায়। আপনাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার এত পূর্ণ! সে আপনারাই যদি বিশেষ মাসের অপেক্ষায় থাকেন সত্য আর সুন্দর কে তুলে ধরতে তাতে করে বঞ্ছিত হই আমরা সকলেই।****
****অনেক অনেক ভালো থাকবেন, আরো অনেক অনেক এমনই সুন্দর কিছু দেবেন আমাদের এ প্রত্যাশায়…****
@ছিন্ন পাতা,
প্রথমতঃ আগেই লেখাটিকে পোস্ট না দেবার অপরাধ স্বীকার করে নিলাম।
অভিমান আমার কেটে গেলো এই দেখে যে নতুনরা দাবী জানাচ্ছে লেখা চেয়ে।
যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছে তাদের লেখা বেরিয়ে আসুক, স্মৃতি কিংবা পাণ্ডুলিপির থলে ছাড়িয়ে।
আপনার মন্তব্য দেখে, আমি নিশ্চিত, যারা লেখা দিচ্ছেন না, তারা তৃপ্ত চিত্তে উৎসাহ বোধ করবে।
খুব ভালো থাকুন (F)
আপনাদের পরিবারটিকে বাংলাদেশ মনে রাখুক কৃতজ্ঞচিত্তে (F)
প্রচন্ড হারে জ্বালাও পোড়াও লুটপাট ধর্ষণ করেছে স্স্থানীয় রাজাকারেরাই খুব বেশি। মিলিটারিরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে ভয় পেত ভীষণ। পালাবার পথ খোলা থাকলেই শুধু ওরা রাজাকার, পিস কমিটি, দালাল বদমাশদের ব্যাবস্থা করা পরিবেশে গিয়ে চালাতো ধংসযজ্ঞ, ধর্ষণ খুন। আজকেও ঐ সব দালাল রাজাকারেরা ক্ষমতাবানদের ছত্রছায়ায় চেহারা বদলে বা স্বমূর্তিতেই সাধারণ মানুষদের ওপর দোর্দণ্ড প্রতাপে অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে।
কাজী ভাই, কাশেম ভাই আপনারা খুবি সৌভাগ্যবান সেই অস্থিরতার, সেই উল্লাসের, সেই কান্নার, সেই আরাধ্য স্বাধীনতার খুবি দূর্লভ সেই ক্ষনের সাক্ষী হতে পেরেছেন। আমাদের গ্রামে এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করার জন্য স্থানিয় একটা কমিটি গঠন করা হয়েছিল বাবা ছিলেন সেই কমিটির প্রধান দায়িত্বে। স্থানিয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্যের যোগান যেত আমাদের বাড়ি থেকে আর চাচা ছিলেন একজন সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা।আমাদের বাড়ির লোকজনের অপরাধ ছিল সাংঘাতিক গুরুতর অবশ্যই পাকিস্থানি ও তার দোসর রাজাকারদের দৃষ্টিতে। এই সব দেশ দ্রোহী! গুরুতর অভিযোগের কারণে আমাদের বাড়িটা পাকিস্থানি আর্মিরা আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে মনের ঝাল মিটায়। তবে রক্ষে কেউ হতাহত বা মারা যায়নি কারণ পাকিস্থান রক্ষক পাকিস্থানিরা আসছে শুনে সবাই ঘর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে প্রাণে বেঁচেছিল। বলা বাহুল্য আমাদের গ্রামটা পাহাড়ী এলাকার কোল ঘেঁসে থাকায় কিছুটা দূরেই ঘন বন জঙ্গল ছিল।
অবশ্য একটা দিকে আপনাদের চেয়ে কিছুটা সৌভাগ্যবান বলা যায় আমাকে সেটা হল সদ্য স্বাধীন বাংলার মাটিতেই আমার জন্ম আর বয়সে আপনাদের চেয়ে ছোট হওয়ায় পৃথিবীর আলো বাতাস ভোগ করার সুযোগটা খানিটা বেশী বৈকি
পরিশেষে বিজয়ের মাসে এরকম একটা আনন্দ বেদনার স্মৃতি চারণের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
কী আশ্চর্য্য! আপনার আমার অভজ্ঞতা এক–মানে সমগ্র ডিসেম্বর, ১৯৭১।
আমরাও ছাদে উঠে দেখতাম ডগ ফাইট, নিজের চক্ষে দেখলাম কেমন করে পাকিস্তানি বৈমানিক বেল আউট করছে। জানিনা সেই পাকিস্তানী বৈমানিকের ভাগ্যে কি ঘটছিল। যে পল্লীতে সে প্যারাসুট সহ পড়ল, সেই পল্লীর বাসিন্দারা তাকে নিয়ে কি করেছিল–আমরা জানতে পারি নাই।
আমরাও শুধু ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি–দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। সকালের নাস্তা বলতে কিছুই ছিল না—হাতে পাকানো রুটি ছাড়া। কিন্তু তা সবই অমৃতের মত লেগেছে।
আমরাও ভাবতেই পারতাম না স্বাধীনতা আমাদের কাছে–অতি কাছেই, একেবারে হাতের মুঠোয়।
ধন্যবাদ, আপনি সেই সব দিন রাত্রির স্মৃতি মনে করিয়ে দিলেন।
আমি তখন বুয়েটের শেষ বর্ষের ছাত্র। আমাদের ছাত্রাবাস থেকে আমাদের অনেক ঘনিষ্ট বন্ধুকে আল-বদর ধরে নিয়ে গেল। আজ পর্য্যন্ত তাদের কোন খোঁজ কেউ দিতে পারে নি।
কী সৌভাগ্য আমার! আমি বেঁচে গেলাম–আমি যে ঐ কয়টি দিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যাই নি।
@আবুল কাশেম,
সত্যিই অদ্ভূত, কিন্তু আবার অদ্ভূত নাও বটে। ওই সময় যারা ঢাকায় ছিলো তারা দেশ আকাশ বিজয়ের সেই মহা উত্তেজনাকর দৃশ্য দেখেছে। প্রায় একই ভঙ্গীতে উল্লাস করেছে প্রচণ্ড। আপনিও ও যে সেই সময়ের সরাসরি সাক্ষী তা জেনে অসম্ভব ভালো লাগছে। হ্যাঁ, ওই পাকি পাইলট দুটোর কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ওরা নাকি টঙ্গি না কালিয়াকৈরের কাছে প্যারাশূট নিয়ে নামার পর পাব্লিকের হাতে আলুভর্তা হয়ে পটল তুলেছিল।
সেই সময়টাতে খাওয়া দাওয়া সহ সব কিছুই তো সঙ্কটাপ্নন ছিলো, শধু সঙ্কট ছিলো না আশার, স্বাধীনতার আশার।
আল বদর আপনাকে এবং আরো অনেককে সেদিন মারতে পারেনি বটে, কিন্তু ওরা এবং ওদের চ্যালারা চল্লিশ বছর ধরে মেরেই চলেছে। বোধহীন আমরা মার খেয়েই চলেছি। ওদের এজেন্ডা প্রচার করেছে সব সুবিধাবাদীরা। আর নিরীহ মানুষ, লাজুক জনতা, ভীতু আতঙ্কিত সাধারন মানুষ, আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অপপ্রচারে জেনে না জেনে সহায়তা করেছে। জ্বলে উঠতে ব্যর্থ হয়েছি বার বার। এক সময় আমাদের বারূদ মাটি হয়ে গেছে।
@কাজী রহমান,
ভালো মন্দের উর্ধে আপনার এই লেখা। অতি মূল্যবান দলিল। একে স্বযত্নে লালিত করবেন।
অনেক অভিজ্ঞতার ঝুড়ি আমার “ফানুস” এ আছে।
খুব ভালো লাগলো বিজয়ের মাসে এই লেখা পড়ে।
@আফরোজা আলম,
ধন্যবাদ পড়বার জন্য আর আপনার মন্তব্যের জন্য।
আপনার ফানুসের লিঙ্কগুলো দিয়ে দিন না এখানে। রেফারেন্স পেতে সুবিধা হবে। কাশেম ভাইয়েরটাও রইলো। আরো যারা লিঙ্ক দিতে চান তারা দিয়ে দিলে কিন্তু মন্দ হয় না।
নতুনদের বিজয়ের কাহিনী শোনান। ভালো থাকুন
@আবুল কাশেম,
তো আমাদেরও তো একটু-আধটু শুনতে ইচ্ছে করে। কষ্টের দিনগুলো ভুলে গেলে, মানুষ না জানলে কার লাভ হয়, এ নিশ্চয়ই আপনার জানা।
@স্বপন মাঝি,
দেখুন এখানে আমার জবানবন্দি সেই সব দিন রাত্রির -অনেক দিন আগে লেখা–তাও ইংরাজিতে; তখনকার সময় মুক্তমনায় বাঙলা লেখার ব্যবস্থা ছিল না–কাজেই বুঝতেই পারছেন কত পুরানো এও লেখা।
http://www.mukto-mona.com/Articles/kasem/december16_71.htm
একজন দুরন্ত কিশোরের চোখ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম পর্বের উত্তেজনা-রোমাঞ্চ-আবেগ অসাধারণ দক্ষতায় তুলে আনা হয়েছে। লেখককে এজন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
এখন এখানে আছে শুধু আলিশান বহুতল ভবন, সাথে কিছু টিন-শেডের জীর্ণ ঘর; অস্থিরতা এখনো আছে এই মোড়ে, যদিও তা সাংসারিক ব্যস্ততা-নির্ভর আর খুব বেশি বৈষয়িক এবং আসছে ১৬ ডিসেম্বরে নিশ্চিতভাবেই এর কোন পরিবর্তন হবে না; তাছাড়া, এখনকার অধিবাসীদের কয়জনই বা জানে বা জানার আগ্রহ বোধ করে, এই টিকাটুলির মোড় ইতিহাসের কি সোনালি স্মৃতি ধারণ করে আছে?
@কাজি মামুন,
পড়েছেন, মন্তব্য করেছেন সেজন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকুন (F)
একবেলা পেঠের ভাত না হলেও, হয়তো চলে কিন্তু চলতে ফিরতে কারো লাথি খেয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মাস্টারদা বা ক্ষুদিরাম বা বাদল বা বাঘা যতিন হয়ে, মরে যাওয়াও ভাল।
খুব ভাল লেগেছে, একেবারে স্মৃতি থেকে, বলা; তাই । নিজের দেখা। এই দেখাটা এবং মনে রাখাটা অনেক বড় ব্যাপার।
ভুলে যাবার প্রতিযোগিতায় আমরা সব সময় এগিয়ে। আমরা ‘৭১ জয়ী হয়েছি। এবার ভুলে যাবার প্রতিযোগিতায় আমরা পরাজিত হ’তে চাই।
@স্বপন মাঝি,
(F)