::পর্ব ২::

উন্নত বিশ্বে সুন্দর করে কথা বলাটা শিল্পের পর্যায়ে পড়ে। ভুল বললাম। উন্নত-অনুন্নত-অবনত সকল বিশ্বেই সুন্দর করে কথা বলতে পারাটা শিল্প। কথা বলার সময়, বিশেষ করে আপাতদৃষ্টিতে শ্রুতিকটূ কথাগুলো বলার সময় শব্দ-বাক্যগুলোকে রীতিমতো হাস্যকরভাবে শৈল্পিকরূপ দেয়ার প্রয়োজন পড়ে। সেটা কতটুকু প্রয়োজন সেই বিতর্কে না গিয়ে বরং নির্দ্বিধায় এইটুকু বলে দেয়া যায় যে, শ্রুতিমধুর করে কথা বলে অন্তত সমব্যথী হবার ব্যর্থ চেষ্টাটুকু করা যেতে পারে। একটু উদাহরণ দেবার চেষ্টা করি। ধরুণ, আপনি মোটামুটি ধরণের একটা রেজাল্ট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করলেন। কিন্তু, আপনার শখ হলো উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করবেন বিদেশের সবচেয়ে নামী কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। চান্স পাবার ১% সম্ভাবনা নিয়ে আবেদন শেষে আপনি যখন সেই আবেদনের কথা ভুলেতেই বসেছেনে, তখন আপনাকে অবাক করে দিয়ে আপনার করা আবেদনের উত্তর আসলো। উত্তরটার বাংলা তর্জমা করলে মোটামুটি দাঁড়ায় এরকমঃ

প্রিয় স্টুডেন্ট,
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আবেদন করে যে সন্মান আমাদের দেখিয়েছ, তার জন্য কৃতজ্ঞতায় আমাদের পাগল হবার দশা। এবার আমাদের এখানে এত বেশি স্টুডেন্ট আবেদন করেছে যে (যাদের মধ্যে বিশজন প্রায় নোবেল পাওয়ার মত), তোমার মত দুর্দান্ত মেধাবী আর যোগ্যদের মধ্যেও যোগ্যতম স্টুডেন্টকেও আমরা নিতে পারছিনা। আমাদের এই মরার বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন যে আরো বেশি সিট থাকলো না, সেজন্য এখন আমাদের মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তোমাকে না নিলে কি হবে, চিন্তার কোনো কারণ নেই; তোমার অ্যাপ্লিকেশান আমাদের কম্পিউটারাইজড্‌ সিস্টেমে আগামী তিন-তিনটা বছর রেখে দেব। তবে আগেভাগে বলে রাখা ভালো, সিস্টেমে তোমার অ্যাপ্লিকেশান রেখে দিলেও, পরের বছর তোমাকে আবার একশো ডলার খরচ করে নতুন করে অ্যাপ্লাই করতে হবে।
ইতি,
তোমার সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্খী।

উপরের লাইনগুলোর নির্ভেজাল বাংলা করলে দাঁড়ায় সর্বমোট দুই লাইন-

তোমার কি বুদ্ধি-সুদ্ধি কিছুই নাই? টাকা নষ্ট করার ইচ্ছে থাকলে পরের বছর আবারো আবেদন করতে পারো।

কিন্তু আমি ভাবছিলাম, এই মিষ্টি কথা গুলো আমাদের বাংলাদেশে কি একদমই কেউ বলে না? নিশ্চিত করে চিঠি কিংবা ইমেইলের উত্তরে বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠান বা তার কর্তামহাশয় এমন মধু বর্ষণ করবেন না। বাঙালি পারতপক্ষে ইমেইলের উত্তরই দিবে না। আর অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হলেতো কথাই নেই, ইমেইল চেকই করবেন না। তাহলে আমাদের বাংলাদেশের লোকজন কোথায়, কি উপলক্ষ্যে কিছুটা মিষ্টি করে কথা বলে? প্রশ্ন মনে আসতে না আসতেই উত্তরও খুঁজে পেলাম, কোথায় আবার- নিউমার্কেটের শাড়ীর দোকানে। নিতান্তই বেমানান আপামনিরাও, তাদের ফেয়ার এন্ড লাভলীর অভাবসম্পন্ন অঙ্গে যখন মাটি কালারের শাড়ী উঁচিয়ে ধরেন, একমাত্র বঙ্গদেশে অবস্থিত ‘নিউমার্কেট’ নামক রঙ্গশালার দোকানদাররাই এমন একটা ভাব করতে পারেন যে, মনে হয় এইমাত্র ঐশ্বরিয়া রায় তাদের সামনে ‘ইশক্‌কামিনা’ গান গেয়ে প্রস্থান করলো। সে না-হয় বাদই দিলাম। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মুগ্ধ ভাব করা কঠিন কিছুতো নয়। কিন্তু, এলিফ্যান্ট রোডের বিখ্যাত এক টেইলর্সের সেই বিখ্যাত বাক্য শোনার সৌভাগ্য যাদের হয়েছে, তারা ভালো করেই টের পেয়েছেন, মিষ্টি কথা শুধু মুগ্ধই করে না, কখনো কখনো তাজ্জবও করে ফেলে।

এলিফ্যান্ট রোডে এরিয়াতে যারা শার্ট বানাতে যান, তারা এই নামকরা টেইলর্স এর কথা জেনে থাকতে পারেন । এমনিতেই ব্যাক্তিগতভাবে আমার রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট পরা অভ্যাস। দর্জির দোকানে প্যান্ট বানাতে গেলে তারা এমন সব জায়গায় গিয়ে মাপ নিতে আরম্ভ করে, মনে হয়- ধরণী দ্বিধা হও। একজন জোরে জোরে বলে, আরেকজন আবার লিখে। কিসের মাপ যে লিখে সেটা সাধারণ মানুষ-বঙ্গদেশে যারা ‘পাবলিক’ নামে পরিচিত- তাদের বুঝার উপায় নেই। একমাত্র শার্ট বা প্যান্ট লম্বা কত ইঞ্চি দেয়া হবে, সে ব্যাপারে পাবলিকের মতামত বিবেচ্য। দেশের প্রেসিডেন্ট এর জন্যও একই সিস্টেম, এ-নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। অবশ্য প্যান্ট এর সাথে তুলনা করলে শার্ট বানানো তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম অস্বস্তিকর।

এইসব গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা মাথায় রেখেও কোনো এক অশুভদিনের, পড়ন্ত বিকেলের কোনো এক কুক্ষণে চলে গেলাম সেই নামকরা টেইলর্স এর দোকানে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর প্রধান ব্যক্তিটি আমার শার্টের মাপ নেয়ার জন্য বিনীতভাবে কাছে ডাকলেন। হাত-টাত ধরে, উপরে উঠিয়ে, নীচে নামিয়ে কি সব মাপ নিতে থাকলেন আর সহকারীকেও সাথে সাথে বলতে থাকলেন। আমি পাথরের মত শক্ত হয়ে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে আছি। কবে শেষ হবে সেই আশায় যখন সেকেন্ড-মিনিট পার করছি, ঠিক তখনটাতেই জনাব কিছুটা কাছে এসে, একটু নীচু স্বরেই বললেন-“মাশাল্লাহ, খুব সুন্দর শরীর আপনার”। নাউজুবিল্লাহ্‌, ব্যাটা বলে কি! ততক্ষণে আমার কপাল থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। বিব্রত ভঙ্গিতে কোনো রকমে মাপটা দিয়েই, তড়িঘড়ি করে কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়িয়েছি শার্ট ডেলিভারির তারিখটা জানতে। মনে মনে স্থির করে ফেলেছি, ইহজনমে আর শার্ট বানাতে আসবো না। দরকার হলে চাদর পরে ঘুরে বেড়াবো। ভিতরে ভিতরে যখন আরো ক্ষেপে উঠছি, তখনই সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শুনতে পেলাম, আমার পরবর্তী অত্যন্ত বেঢপ ধরণের ভদ্রলোককেও জনাব এবার মিষ্টি করে নীচু গলায় বলছেন-“মাশাল্লাহ, খুব সুন্দর শরীর আপনার”। আহ্‌! শুনেই মনে হলো এই বুঝি আমার চারপাশ দিয়েই শান্তির সুবাতাস বয়ে গেলে। বুঝতে পারলাম, তিনি তার মিষ্টি কথার অংশ হিসেবে সকল কাস্টমারকেই এই মিষ্টবাক্য উপহার দিয়ে থাকেন। হোক আর না-হোক, হিতে না-হয় বিপরীতই হোক, কিন্তু একটু চেষ্টাতো করেন। তথাকথিত ভদ্দরনোকেরা কিন্তু মিষ্টি করে কথা বলার চেষ্টাটুকুও করেন না।

চেষ্টাটুকু না-হয় করাই হবে, তবে তার আগে মিষ্টি শব্দ বলার জন্য বর্ণগুলোতো জানতে হবে। আমার নিজ জন্মভূমি নোয়াখালীতে বর্ণগুলো, বিশেষ করে ব্যঞ্জণবর্ণগুলো, অন্য জেলার থেকে কিছুটা আলাদা। ছোটোবেলায় প্রাইমারি স্কুলে স্যাররা আমাদের পড়াতেন, “ফ ফ ভ ভ ম”। ছোট্ট আমাদের মনে প্রশ্ন আসতো, দুইটা ‘ফ’ আর দুইটা ‘ভ’ কেন? স্যার বলতেন, ফ্রথমটা ছোটো ‘ফ’, ফরেরটা বড় ‘ফ’। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, ‘দুইটা ‘ফ’ থাকার দরকার কি?’ স্যার অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘এটা কোনো ফ্রশ্ন হলো’। উল্টো জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোর ফরিবারে যদি একটা বড় ভাই আর একটা ছোটো ভাই থাকে তাহলে কি কোনো ফ্রব্লেম আছে।’ আমরা বলতাম, ‘না’। তখন স্যার বলতেন, ‘তাহলে এখানে দুইটা ‘ফ’ থাকলে কি ফ্রব্লেম?’ উত্তর শুনে আমাদের মন খুশীতে ভরে উঠতো। তাইতো, এর থেকে বড় কি আর যুক্তি থাকতে পারে। দুইটা ‘ফ’ আমাদের দুইটা ভাইয়ের মত। দুই ভাইকে আলাদা করা কখনোই উচিৎ হবে না; চুলোয় যাক মিষ্টি করে কথা বলা।

(চলবে)

মইনুল রাজু (ওয়েবসাইট)
[email protected]