বিপ্লব পালের বিভিন্ন লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখিত হয়েছে এই লেখাটি। এমন কি হয়ত উনি না থাকলে এ লেখা লেখাই সম্ভব হত না। :))
তার কাছে চরমভাবে কৃতজ্ঞ। 🙂

ক) আমি মোটেও একজন অর্থনীতিবীদ না। কিন্তু ভাগ্য এতই নিষ্ঠুর যে অর্থনীতির মিথ্যে মেঝের উপর দিয়ে চলতে থাকা মরনশীল জীব আমরা। একটু ভুল করলেই যে কোন মুহূর্তেই তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়তে পারে জীবনের সমস্ত সঞ্চয়। বাজার অর্থনীতির এই প্রক্রিয়ায় আমরাও পণ্য হিসেবে গন্য। যত আগেভাগে আমরা এই কথা বুঝব আমাদের বিপর্যয় এড়ানো ততই সহজ হবে। মার্কেটের ভাঙা গড়ার সাথেই আমাদের বাচা মরা।

২০০৮ সালের সাবপ্রাইম সঙ্কটের আতঙ্ক মিলিয়ে যাবার আগেই সম্ভবত আবার আমরা মন্দায় পড়তে যাচ্ছি। আজ বিশ্বের বৃহত্তম শেয়ার বাজারে ডাওজোন্স পড়ল ৫০০ পয়েন্ট। তিন দিন মাত্র সময়ের মধ্যে বিনিয়োগকারীদের সবার আয় হাওয়া কয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন বিনিয়োগকারীরা শেয়ার বিক্রী করে দিচ্ছেন, বাজার থেকে তাদের আত্নবিশ্বাস কেন চলে যাচ্ছে?

খ) সমস্যাটার শুরু হল, ওয়েলফেয়ার ইকোনমিক্স নামের অর্থনীতির মতবাদটা থেকে। প্রত্যেকটি দেশের রাজনৈতিক দল তাদের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়া সত্বেও ক্ষমতায় এসেই দুকুল ছাপিয়ে বিভিন্ন সামাজিক খাত আর সামরিক খাতে ব্যয় শুরু করে। ঠিক এই কাজটি করতে গিয়েই আমেরিকা ঋণ করেছে প্রায় ১৪ ট্রিলিয়ন যা আমেরিকার জিডিপির সমান। ব্যাপার যদি এভাবে ভাবি আমরা তাহলে দেখব, আমেরিকার জিডিপি ১৪ ট্রিলিয়ন ডলার আর আয় আছে ২ ট্রিলিয়ন ডলার। তাহলে একটি পরিবারের যদি আয় থাকে এক লাখ টাকা, তাহলে বিপরীতে তার ঋণ ৭ লাখ টাকা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসবে তাহলে সে সেই ঋণ দেবে কোথার থেকে। কারন হল ৭ লাখ টাকার সুদই তো অনেক। যদি ৫% হারেও সে সুদ দেয় তাহলে সরকারী আয়ের ৩৫%ই চলে যাবে সুদ দিতে। মূল আমানত দেয়ার দায় থাকলে আয়ের ৭০-৮০ভাগ চলে যাবে শুধুমাত্র ধার দিয়েই।

তবে কথা হল আমেরিকান সরকারের সুদের জন্য খুব একটা সমস্যা হয় না। কারন হল, মন্দার এই সময়েও সব আমেরিকানই সরকারী বন্ড কিনতে আগ্রহী এই চিন্তা থেকে যে, আমেরিকান সরকার দেওলিয়া হতে পারে না। যার জন্য পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ব্যাংকগুলোও আমেরিকান সরকারকে ১ বা ২% হারে ঋণ দেয়। আমেরিকার সরকারী ব্যাংক হল পৃথিবীর সিন্দুকের মতন যেখানে টাকা রাখলে হারানোর চিন্তা নেই।

কিন্তু সমস্যা এ জায়গাতেই। আইন অনুযায়ী(আমেরিকার আইন) আমেরিকান সরকার একটা সীমানার বাইরে ঋণ করতে পারে না। এবং যদি সেই সীমানা বাড়াতে চান তাহলে কংগ্রেস এবং সিনেটের অনুমুতির দরকার হয়। আমেরিকান সরকারের দেনার পরিমান চরম হারে বাড়ছিল তার জনস্বাস্থ খাতে খুব বেশী খরচ করার ফলে। ফলশ্রুতিতে দেশে টিপার্টি বলে একটা রক্ষনশীল আন্দোলনের সূচনা হয়। যাদের কথা ছিল, যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে সরকার দেউলিয়া হয়ে যাবে এবং এমন খরচ করা চলবে না। গত ২০১০ সালের নির্বাচনে তারা কংগ্রেসের ৬০ জনকে জেতায় যার ফলে ডেমক্রেটরা হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। ফলে আমরা গত দু সপ্তাহে একতা হলিউডী মুভি দেখতে পাই ডেটলিমিট বা ধারের পরিসীমা বাড়ানোকে কেন্দ্র করে। মোটামুটি ধারের লিমিট বাড়ালেও নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় যে প্রথম ধাক্কায় সরকার ৯০০ বিলিয়ন ডলার কমাবে আর পরের বার কমাবে ১২০০ বিলিয়ন ডলার।

গ) এখন দেখা যাক মন্দার এই সময়ে সরকার খরচ বাঁচালে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে। এমনিতে আমেরিকায় মাত্র ৯% চাকরী সরকারী বা তার অনুদানের উপরে নির্ভরশীল হলেও এর প্রভাব অর্থনীতির উপরে অনেক। স্বাস্থ, শিক্ষা, রিসার্চ সহ ডিফেন্স সবগুলো খাতের উপরে এর প্রভাব পড়বে। সবচেয়ে বেশী খারাপ অবস্থা হবে স্বাস্থখাতে বা বায়ো রিসার্চে। উচ্চ শিক্ষার জন্যে ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের আমেরিকায় আসা কঠিন হবে। কারন হল, এই সব শিক্ষার্থীরা আমেরিকায় আসে সাধারনত টিচিং এসিস্টেন্স হিসেবে আর টাকাটা আসে এক সরকারের থেকে নয়ত শিক্ষার্থীদের টুশন থেকে। আর এই টিউশন আসে স্টুডেন্ট লোন থেকে। কিন্তু এখন যে সবজায়গাতেই কাটছাট করা হচ্ছে।

ও্যাশিংটন এবং এর আশেপাশের এলাকায় এই প্রভাব পড়বে খুবই প্রকটভাবে। যেহেতু এই সব এলাকায় সরকারী বা তার অনুদান থেকে চলা চাকরী বেশী সেজন্য শুধুমাত্র ৯০০ বিলিয়ন ডলার কাটছাটেই প্রায় ২৫০০০০ লোক চাকরী হারাবে। যা এখানে কার্যক্ষম লোকের প্রায় ১৫-২০০ শতাংশ।

সুতরাং, আমেরিকার ভবিষ্যত যে খুব একটা ভালো না তা বলা বাহুল্য।

ঘ) কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে সরকারী অনুদান ছাটাই হচ্ছে কেন? কারন আয়ের সাথে ব্যয় ,মেলাতে হবে! কিন্তু তাহলে বড়লোকদের উপরে কেন বেশী আয়কর বসানো হচ্ছে না? পৃথিবীর ৪০% ধনী আমেরিকাতে। তাদের উপরে বাড়তি আয়কর না চাপিয়ে কেন এই চাকরী ছাটাই? এই বিতর্ক এখন আমেরিকার সবখানেই। টিভিতে শুধু একই বিতর্কের ট্রেন কিন্তু স্টেশন পাওয়া যাচ্ছে না।

রিপাবলকানদের কথা দুটো,

১.আয়কর বাড়ালে অর্থনীতি ও চাকরীর বৃদ্ধি কমবে। কারন হল আমেরিকাতে ৭০% চাকরী আসে ছোট ব্যাবসা থেকে। তাদের উপরে বাড়তি কর অর্থনীতিতে খারাপ প্রভাব ফেলবে।

২. ইউরোপে আয়কর বাড়িয়েও লোন ডিফল্ট আটকানো যাচ্ছে না। গ্রীসকে অক্সিজেন দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইটালী আর স্পেন এখন লোন ডিফল্টের দিকেই যাচ্ছে। তারমানে সরকারী খরচ কমানো ছাড়া উপায় নাই।

বলা বাহুল্য, একনাম্বার যুক্তির কোন সংখ্যাতাত্তিক প্রমান এখনও পাওয়া যায় নাই।

কিন্তু তাহলে রিপাবলিকানদের কথা কেন শুনতে হচ্ছে যেখানে বেশিরভাব(৬০%) আমেরিকান বলছে বড়লোকদের উপরে আয়কর বাড়ুক?

এটাই হল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের আসল দূর্বল পয়েন্ট। দুই বছর আগে ডেমক্রেটদের হাতেই ছিল সিনেট এবং কংগ্রেস। কিন্তু গত ৮০০ দিনে তারা বড়লোকদের উপরে কর না বাড়িয়ে সরকারী খরচ বাড়িয়ে চলেছিল এবং কোন প্রকার বিল পাশ না করেই।

ডেমক্রেটদের এই ভন্ডামী আজকের সঙ্কটের অন্যতম প্রধান কারন। ডেমক্রেটদের প্রধান ভোট ব্যংক হল গরীব অংশ যাদের সরকারী ভাবে শিক্ষা আর চিকিৎসা দরকার। যার জন্য তারা তাদের ভোট ব্যঙ্ক অক্ষুন্ন রাখতে সরকারী খরচ বাড়িয়ে চলেছিল। তাতে অবশ্য কোন আপত্তি নেই। কিন্তু ব্যয় বেশী হলে আয়ও বেশী দরকার। যার জন্য তাদের উচিত ছিল বড়লোকদের উপরে আয়কর বাড়ানোর। কিন্তু তারা সেটা করেনি এবং তার ফলশ্রুতিতে সংকট এবং সেই সুযোগে রিপাবলিকানদের জয়। সহজ হিসাব।

কিন্তু তাহলে ধনীদের উপরে ডেমক্রেটরা কেন কর বসালো না যেখানে তারা কেউই ডেমোক্রেটদের ভোত দেবে না? কাহীনিটা কোথায়?

এটা আমেরিকান(শুধু আমেরিকান না, সমস্ত জায়গাতেই এই একই ব্যাপার) অর্থনীতির একটা অন্ধকার দিক। নির্বাচনী ফান্ড সাধারনত আসে ধণীদের কাছ থেকেই। সুতরাং ধনীদের উপরে কথা বলার সাহস ডেমোক্রেটদের নেই। তারা বড় বড় কথা বলেই খালাস। একথা সাধারন মানুষও জানে।

ঙ) আমেরিকার বাজেট কমানো এই মন্দার একমাত্র কারন নয়। তার সঙ্গে গোদের উপরে ক্যন্সার-ইটালীতে লোন ডিফল্ট হতে পারে। গ্রীসের মত ছোট একটা দেশকেই বাঁচান যাচ্ছে না। তার উপরে যদি তার প্রায় ১০গুন বড় একটা অর্থনীতি দেউমিয়া হয় তাহকে ইউরোপের অর্থনীতি ধ্বসে পড়বে। ইউরোপের অয়েল ফেয়ার অর্থনীতির দিন শেষ বলা যায়।

তবে মন্দের ভালো হল এই যে, বর্তমানে বেসরকারী খাত বেশ লাভজনক। মন্দার সময় প্রচুর ছাটাই এর ফলে এখন বেসরকারী কোম্পানীগুলো লাভ করছে। বর্তমানের মন্দা আসলে হিসাব ছাড়া রাজনীতির জন্য। কিছুটা সরকারী ছাটাই আর কর বৃদ্ধি করে এই অবস্থা কাটানো যেত। কিন্তু ডেমোক্রেটরা একথা এখন বললেও সময় থাকতে এই বিল তারা পাশ করেনি।

তবে কথা হল অবস্থা যে দিকেই যাক না কেন, আমেরিকার অর্থনীতিতে খারাপ অবস্থা হলে এর প্রভাব বিশ্ববাজারেও পড়বে।