আমি নিতান্তই একজন কেরানী, আমেরিকা সরকারের কেরানী। প্রজাতন্ত্রের এবং জনগনের চাকর। এতে আমার গ্লানির শেষ নেই। সব চাইতে কাছের মানুষ সহ আশে পাশের তামাম মানুষ ক্রমাগত স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কতখানি মধ্যবিত্তের জীবন যাপন আমার। কোন এক অতীত কালে একদা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি , তাতেও রক্ষা নেই, আমার সকল আবেগে জল ঢেলে আলাপচারীতার মাঝ পথেই শুনতে হয়েছে “মাস্টারনী “। শিক্ষতায় আসবার আগে দাতা সংস্থার অনুদানে রিসার্চ আর কন্সালটেন্সী করেছি। তখন ছিলাম “দেশ বেচে দেয়া দালাল”। তার ও আগে যখন একটি বিদেশী রেডিও সংস্থায় বাংলা অনুষ্ঠান করেছি তখন হলাম “ধর্মীও চেলা”। দর্শনীর বিনিময়ে যখন আবৃত্তি করেছি তখন কপালে তকমা জুটলো “বিদ্রোহী ” বলে। ভালো লাগার বিষয় কে পেশা হিসেবে বেছে নেয়া সবার তো আর কপালে জোটে না তাই বারংবার কপালে করাঘাত করে আমি কেয়া রোজারীও রোজ কাক ডাকা ভোরে ছুটতে থাকি আমার কলম পেষা চাকরীর জায়গায়।

কি আশ্চর্য ! আমার কাজটাও কিন্তু পেশা কেন্দ্রীক তাই নিত্য নতুন পেশার সঙ্গে আমার জানাশোনা হয় রোজ। আমি জানি এ লেখাটি যদি এখনও দুচ্ছাই বলে ফেলে রেখে আপনি চলে না গিয়ে থাকেন তাহলে আপনিও এরি মধ্যে অভিনব কিছু পেশার কথা ভেবে ফেলেছেন, মন্তব্যে সেই পেশার কথা লিখুন, আগাম আমন্ত্রণ রইলো।

আমাদের দেশে আমরা কিছু পেশাকে ধরেই নিয়েছি কিছু মানুষের জন্যে বরাদ্দ। যেমন মহিলাদের জন্যে শিক্ষকতা, ব্যাংকের চাকরী, হিন্দুদের জন্যে হিসাব তহবিল, ক্রীস্টান মহিলাদের জন্যে নার্সিং। এর হয়ত সামাজিক ব্যাখা আছে , সে কথা পরে হবে। আজ বলতে চাইছি এ দেশের কিছু অভিনব পেশার কথা । সহভাগীতা করতে চাইছি আমার কিছু উপলব্ধি।

ছেলেবেলায় আইস্ক্রীম বিক্রেতা অথবা পাইলট কিংবা রেল গাড়ীর চালক কেই বা হতে চাই নি, আমি চেয়েছিলাম সারাদিন পোস্ট অফিসের স্টাম্প গুলোকে সার বাঁধা ছিদ্র ধরে ছিড়ঁবো এমন একটা চাকুরী। এর চেয়ে আনন্দের কিছু হতে পারে বলে আমার ধারণাই ছিলো না।

আমার কাজের প্রয়োজনে প্রতিদিন আমায় কম বেশী ৫০ টি স্কুলের উঠতি বয়েসের ছেলে মেয়েদের পেশা নিয়ে পরিপক্ক অপরিপক্ক আগ্রহ শুনতে হয়। পরিকল্পনা গুলো কাগজে কলমে স্বীকৃতি দিয়ে গৌরী সেনের বিশাল তহবিল থেকে খানিকটা রসদ অনুমোদন করে স্বপ্ন বীজ বপনে সাহায্য করতে হয়।

ইদানীং লক্ষ্য করেছি পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে মাইন বা এক্সপ্লোসিভ নিয়ে কাজ করার, গেইম বা ভিডিও মেশিন সারানোর কাজ, চীনা বা জাপানী ভাষা শেখার প্রবণতা বেড়েছে যাতে গেইম ডিসাইনার হওয়া যায়। সেই সাথে আছে রোলার কোস্টার ডিসাইনার হবার সাধ। কেউ শুধু মাত্র সিনেমা হলে টিকিট কাউন্টারেই কাজ কে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহী। উপরি হিসেবে ছায়াছবি গুলো দেখে নেয়াই উদ্দেশ্য।

যে আমি পেশা মানেই জেনেছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী, সৈ্নিক আইনজীবি অথবা সরকারী বেসরকারী কেরানী সে আমি অবাক হয়ে দেখি কত না পেশা আছে যা চিরাচরিত ধারনার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। ভাবি যারা সহজেই অন্যের জীবিকার ব্যাপারে নির্দ্বিধায় মতামত দিয়ে ফেলেন তারা কি ভাবছেন!

আজকে যা অভিনব পেশা কাল কিন্তু সেটি ই সাধারন আর দশটি পেশার মতন ই বিবেচিত হচ্ছে। নইলে মানুষের নখ সাজিয়ে দেয়াকে কখনো কেউ কি ভেবেছিলো লেখা পড়া করে সার্টিফিকেট নিয়ে একটা স্বাধীন পেশা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে?

বিশেষ একটি কোর্স করে কেউ দক্ষ হচ্ছেন কুকুর হাঁটানোর চাকরীতে, অধুনা কোর্স দেয়া হচ্ছে কিভাবে কুকুর কে স্নান করানো যাবে তার ওপর। অনেকে পেশা হিসেবে গ্রহন করছে একেও।

কারো পেশা সারাদিনমান দুর্বা বা মধুকুপী অথবা নাম না জানা ঘাস লতা থেকে খুঁটে খাওয়া , ডানা মেলে দেয়া, স্থবির্‌ , চঞ্চল পাখী দেখা আর গতিবিধি লিখে রাখা। আবার কোন কোন দুঃসাহসী বেপরোয়া মানুষ ঝড়ের ইঙ্গীত পেলেই ছুটে যাচ্ছেন ঝড়ের ভেতরে প্লেন চালিয়ে , ঝড়ের গতিবিধি দেখছেন, ছবি তুলছেন।

কিছু দুর্দান্ত , দুর্জয় কৌতুহলী মানুষ আছেন যারা , আইনের চোখ কে এড়িয়ে পালিয়ে বেড়ানো সাজাপ্রাপ্ত ব্যাক্তিদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন ,আইনের হাতে সপে দেবার জন্যে। এটি ই তার পেশা।

আমার এক বন্ধু কাজ কোরত একটি ফিউনারাল হোমে। মৃত মানুষের প্রিয়জনের অনুরোধে বিশাল দেহী , অকম্পিত , অনড়, বরফ শীতল ভার সহ মরদেহ কে কালো প্যান্ট আর আসমান সেঁচে নিয়ে আসা নীল সার্ট পরিয়ে টাই এর নট বেঁধে দিতো , চুল আচঁড়ে আর জুতো পরাতে পরাতে আমার পাঁচ ফুটি বন্ধুটি ঘর্মাক্ত হোত, ক্লান্ত হোত ।

সেদিন পত্রিকায় দেখলাম একজনের পেশাই হচ্ছে কুয়াশা ভোরে , চাঁদ আর দিনের প্রথম সুর্যের ভাগ করে নেয়া মিটি মিটি আলোতে ডুবুরীর পোষাকে দিব্যি নেমে যাওয়া সমুদ্রে, তলদেশ থেকে তুলে আনা একটি কোরাল, কোরাল টি পৌঁছে দেয়া গবেষক দের কাছে, পরদিন আবারো আর একটি কোরাল , আবারো গবেষণা।

ভারতের উত্তরাঞ্চলের কোন একটি গ্রাম, চারদিকে লু হাওয়া , চাঁদা মাছের পিঠের মত চকচকে , রোদ্দুরে তেতে থাকা টিনের চালার ক্লিনিকের সামনে অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় পুরো পরিবার, কারো মুদী দোকানের কাঁচামাল কিনতে হবে , কারো বা জমির বীজ। এদের সবার কপালের বলি রেখা জুড়ে জন্মান্ধ ব্যার্থতা , তবু চোখের কোটরে আশার জোনাকী , হতোদ্যম, পা হড়কে পরা জীবন থেকে থেকে মুক্তির জন্যে এসে দাড়িয়েছে গর্ভ ভাড়া দিতে, এটিও একটি পেশা। নারী দেহের ব্যাবহার , যাতে সম্মতি রয়েছে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও। নাড়ী ছেড়া ধন অথবা মায়ের চোখের মণি-এসব আবেগ এখানে বাহুল্য। সন্তান চোখ মেলতেই চুক্তি মোতাবেক অন্যের পরিবার ভুক্ত হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্ব আগ্রহী হয়ে উঠছে এই অঞ্চলটার এই পেশার মানুষের ওপর। এখানকার মহিলাদের পরিমিত জীবন যাপন পেশার ক্ষেত্রে একটি গুডউইল ।

সব শেষ যে পেশার কথা গতকাল ই শুনলাম তা দিয়ে এ এলেবেলে লেখার ইতি টানছি।

ইদানিং কিছু মানুশের পেশা হচ্ছে বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে হাজির হয়ে দেখা তারা প্রতিবন্দীদের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহন করেছেন কিনা, উইলচেয়ার ব্যাবহারকারীর জন্যে দরজা আপনি খুলে যাচ্ছে কিনা, র‍্যাম্প আছে কিনা, টয়লেটে অথবা করিডরে বিশেষ ব্যাবস্থা আছে কিনা, না থাকলে ঠুকে দিচ্ছেন কেইস। অর্থাৎ ছিদ্রানেষ্বণ একটি পেশা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।

এবারে আমার উপলব্ধিটা বলি, প্রথাগত জীবিকার বাইরে হলেই তা’ পেশা হতে পারে না এটি ভাবতে পারছি না। ভাবতে পারছি না জানা পেশার আওতায় না পড়লে তা’ ছোট চাকরী অথবা মুল্যহীন। আমরা কত সহজে মানুষের ক্ষুদ্রতা দেখলেই বলে ফেলি চামারের মত কাজ। চামার সিদ্ধ হস্তে চামড়ার কাজ করেন অথচ আমি এমন শল্য চীকিৎসকের কথা জেনেছি যিনি রোগীর অপারেশন মাঝ পথে থামিয়ে আগাম টাকা দাবী করেন। আমরা বলি ব্যটা স্যাঁকড়া মায়ের গয়নার সোনাও চুরি করে অথচ এমন ইঞ্জিনিয়ার আছেন যিনি বদ হজমের তোয়াক্কা না করেই অবলীলায় হজম করে ফেলেন ইট কাঠ শুড়কী সিমেন্ট, ফলশ্রুতীতে জনগনের মাথার ওপর ভেঙ্গে পড়ে সদ্য বানানো ব্রীজ। আমার কম্প্যুটারের জ্ঞান সীমিত তাই বলে ফেললাম আমার কম্প্যুটারের জ্ঞান একজন রিক্সোওয়ালা অথবা ঠ্যালা গাড়ীওয়ালার সমান অথচ এমনও স্কুল কলেজের শিক্ষক রয়েছেন যারা কম্প্যুটারের সামনে বসতে ভয় পান।

আমার দ্বিধা টা ওখানেই মানুষ কে পেশা দিয়ে সজ্ঞায়িত করা। পেশা দিয়ে তার সামাজিক ওজন মাপা।