এটি একটি যৌথ রচনা, আমার (ফরিদ আহমেদ) এবং অভিজিৎ এর। সেই পাঁচ বছর আগে মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে বইটা এক সাথে লিখেছিলাম আমরা। তারপর আর একসাথে কোনো কিছু লেখা হয় নি দুজনে। অনেকদিন পরে আবার আরেকটা প্রচেষ্টা নিলাম। কেমন হয়েছে জানি না। পাঠকদের কাছ থেকে আগ্রহ এবং সাড়া মিললে দুজনে মিলে এই ধরনের কিছু লেখা লিখবার আশা আছে ভবিষ্যতে।
:line:
কোনো এক বিচিত্র কারণে আমাদের দেশে প্রায় সব খ্যাতিমানদের একটা সময় পরে মাথায় তোলা শুরু করি আমরা। মানব থেকে প্রথমে মহামানব, পরে দেবতা বানিয়ে ফেলি তাঁদের। হয়তো নিজেরা অক্ষম বলে, দুর্বল বলে যে হীনমন্যতায় আমরা ভুগি, সেই হীনমন্যতা লুকোনোর জন্যই দেবতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে আমাদের। একটা সময় পর্যন্ত হয়তো কেউ এটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি। কিন্তু আজকের এই যুগে এসে এটাকে আর মেনে নেওয়া যায় না। সময়ের প্রয়োজনেই আজকে দরকার হয়ে পড়েছে দেবোত্বের দেয়ালকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে আসল মানুষগুলোকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা। শুধু ভাল ভাল দিক নয়, তাঁদের কোনো অন্ধকার দিক থাকলেও সেটাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। এই কাজটা করা হবে কোনো প্রতিহিংসা থেকে নয়, তাঁদেরকে অবমাননা করা বা অপমান করার মানসিকতা থেকে নয়। বরং সত্যকে কঠিন এবং নির্মমভাবে তুলে ধরাটাই হবে মূল উদ্দেশ্য। রবি ঠাকুরের ভাষাতেই, সত্য যে কঠিন, সেই কঠিনরে ভালবাসিলাম।
আবর্জনাকে রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করলেও আবর্জনাই থাকে- হুমায়ুন আজাদ
১
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্রষ্টা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মত করে এরকম দুহাত উজাড় করে বাংলা সাহিত্যকে এত রত্নভাণ্ডার আর কেউ উপহার দিতে পারে নি। ঊনিশ শতকের এক দরিদ্র সাহিত্যের অধিকারী বাংলাকে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই জাতে তুলেছেন, সমৃদ্ধকর করে তুলেছেন। বিশ্বসভায় বাংলা সাহিত্যকে সগৌরবে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। নিরন্তর সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর মত এরকম ঐকান্তিক একাগ্রতায় সারা জীবনব্যাপী শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি আর কোনো সাহিত্যিকের দ্বারা সম্ভবপর হয় নি। না এই অঞ্চলে, না সারা বিশ্বে। সচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে জীবিকা নিয়ে তাঁকে তেমন করে ভাবতে হয় নি কখনো। ফলে, আমৃত্যু তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অফুরান সময় পেয়েছেন। আর সেই সুযোগকে পূর্ণভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর অবিরাম আগ্রহ, নিরলস প্রচেষ্টা এবং ক্লান্তিহীন লেখালেখির মাধ্যমে। সেই কৈশোর বয়স থেকে যে তরী তিনি ভাসিয়েছেন সাহিত্যের স্রোতস্বিনীতে, তার সফল সমাপন ঘটেছে মরণ সাগরের তীরে এসে।
দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্র মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয় নি। একদল যেমন ভক্তিরসে ভরপুর হয়ে তাঁকে পুজো করে ছাড়ছে, অন্য দল তেমনি তাঁর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিষোদগার বর্ষণ করে চলেছে, মূলতঃ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। এই দুয়ের মাঝামাঝি থেকে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নির্মোহ এবং নৈর্ব্যক্তি আলোচনা নেই বললেই চলে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই সমস্যাটা আজকের নয়। তিনি জীবিত থাকা অবস্থা থেকেই এটা চলে আসছে। নীরদ চৌধুরী তাঁর আত্মঘাতী বাঙালী গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্ব আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ এর ভূমিকাতে লিখেছিলেন :
তাঁহার (রবীন্দ্রনাথের) সম্বন্ধে সত্য আবিষ্কারের চেষ্টা আজ পর্যন্ত হয় নাই। যাহা হইয়াছে তাহা একপক্ষে হিন্দুর মূর্তিপূজার মত, অন্য পক্ষে মুসলমানের মূর্তি ভাঙার মত। জীবিতকালে তিনি যেন হিন্দু হইয়া মুসলমানের রাজত্ব বাস করিয়াছিলেন, অর্থাৎ প্রধানত আক্রমণেরই লক্ষ্য ছিলেন। এই অবস্থার জন্য তাঁহার ব্যক্তিত্ব, মতামত ও রচনা সম্বন্ধে যেসব কথা বলা ও লেখা হইয়াছিল তাহাকে মিথ্যা নিন্দা ভিন্ন আর কিছু বলা যাইতে পারে না। আবার এই বিদ্বেষপ্রসূত নিন্দার পরিমাণ, তীব্রতা ও ইতরতা এমনই হইয়াছিল যে উহার ভারে ও ধারে বেশীর ভাগ বাঙালির কাছেই তাঁহার আসল রূপ চাপা ও কাটা পড়িয়াছিল।
অবশ্য ইহাদের প্রতিপক্ষও যে ছিল না তাহা নয়, অর্থাৎ ভক্তও তাঁহার জুটিয়াছিল। ইহারা বিদ্বেষীদের তুলনায় সংখ্যায় অনেক কম হইলেও দলে নিতান্তই অল্পসংখ্যক ছিল না। তবে ইহাদের দ্বারাও রবীন্দ্রনাথের হিত হয় নাই। ইহারাও তাঁহার যে রূপ প্রচার করিয়াছিল তাহা অন্ধ স্তাবকের প্রশস্তি ভিন্ন কিছু নয়। এমন কি এই রবীন্দ্রভক্তি এমনই বাক্যভঙ্গি ও আচরণে প্রকাশ পাইত যে, উহাকে হাস্যাস্পদ করা নিন্দাকারীদের পক্ষে খুবই সহজ হইত। ফলে, রবীন্দ্র ভক্তেরাও রবীন্দ্র বিদ্বেষীদের মতই মিথ্যারই প্রচারক হইয়াছিল।
বর্তমানে অবশ্য অবস্থাটা উল্টা হইয়াছে, অর্থাৎ রবীন্দ্র নিন্দুকেরা লোপ না পাইলেও রবীন্দ্রভক্তেরাই প্রবল হইয়াছে। কিন্তু না ভক্তি না নিন্দা, কোনটাই উচ্চস্তরে উঠে নাই। এখনও রবীন্দ্রনাথের সত্যরূপ আত্মপ্রকাশ করিতে পারিতেছে না।
নীরদ চৌধুরী যে কথাগুলি বলে গিয়েছেন তার কী আশ্চর্য প্রতিফলন আজকের যুগে। রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের মধ্যে অগ্রগন্য। তাঁর অসীম মেধা, সীমাহীন সৃষ্টিশীলতা, শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন অঙ্গনে গ্রীবা উন্নত রাজহংসের মত সাবলীল বিচরণ অন্য সব বাঙালিদের থেকে তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। কিন্তু এই অনন্যতা তাঁকে নিশ্চয়ই দেবত্ব দেয় নি। অথচ আজকের যুগে অনেক বাঙালিই রবীন্দ্রনাথকে প্রায় দেবতার আসনে বসিয়ে ফেলেছেন। তাঁকে নিয়ে ভক্তি গদ্গদ হয়ে পূজোর আসর বসিয়েছেন তাঁরা। রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা, ক্ষীণতম ত্রুটি-বিচ্যুতি্র উল্লেখ তাঁদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। উন্মাতালের মত ঝাপিয়ে পড়তে চান সমালোচনাকারীর উপরে। অথচ এঁরা কখনোই বিবেচনায় নেন না যে, রবীন্দ্রনাথও রক্তমাংসে গড়া একজন মানুষ ছিলেন। তাঁরও অন্য আর দশটা মানুষের মতই মানবীয় সীমাবদ্ধতা ছিল। ছিল লোভ, ছিল হিংসা, ছিল ক্ষুদ্রতা, ছিল মহত্ব, ছিল ভালবাসা, ছিল প্রেম। ছিল অনেক ধরনের প্রশংসনীয় মানবীয় গুণাবলী এবং সেই সাথে সাথে নিন্দাযোগ্য অগুণাবলীও।
এই সমস্ত অন্ধ স্তাবক এবং গুণমুগ্ধ প্রেমিক পূজারীদের কারণে রবীন্দ্রনাথের সঠিক মূল্যায়ন আজকের যুগে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের উজ্জ্বল অংশকে উদ্ভাসিত করে দিতে এঁরা যেমন তৎপর, তেমনই তাঁর অন্ধকার অংশগুলোকে অতি যত্নে আড়াল করতেও এঁদের কোনো কার্পণ্য নেই। সে কারণেই জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথের যে সমস্ত সমালোচনা হয়েছে, সেগুলোকে এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ নীরদ চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথের জীবিত থাকার সময়ে তাঁর গুণমুগ্ধ স্তাবকের তুলনায় বিরূপ সমালোচকের সংখ্যাই অনেক বেশি ছিল। প্রায় সব রবীন্দ্র গবেষকই অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে রবীন্দ্রনাথের আঁধার অংশগুলোকে অপসারিত করে দিয়েছেন। ধর্ম অনুসারীরা যেরকম করে তাঁদের ধর্মীয় নেতাকে মহামানব তৈরি করে তাঁর মহৎ গুণগুলোকে শুধুমাত্র উল্লেখ করে, ঠিক সেরকম করেই রবীন্দ্র ভক্তরাও রবীন্দ্রনাথকে প্রেরিত পুরুষ বা অবতার বানানোর আয়োজন প্রায় সুসম্পন্ন করে ফেলেছে। কেউ রবীন্দ্রনাথের সামান্যতম সমালোচনা করলেই লাঠিসোঠা হাতে হা-রে-রে-রে বলে তেড়ে এসেছেন তাঁরা। আহমদ শরীফ তাঁর রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে লিখেছেন :
তাঁর লঘু-গুরু ত্রুটি-বিচ্যুতি, মন-মননের সীমাবদ্ধতা বিমুগ্ধ-বিমূঢ় ভক্ত-অনুরক্তেরা এতো কাল চেপে রেখেছেন, অন্য কেউ উচ্চারণ করতে চাইলেও মারমুখো হয়ে উঠেছেন। প্রমাণ ষাটের দশকে বুদ্ধদেব বসুকে এবং ইদানীং সুশোভন সরকারকে ও সুভোঠাকুরকে গালমন্দ শুনতে হয়েছে। আর পঞ্চাশের দশকে কম্যুনিস্টরাও হয়েছিল নিন্দিত রবীন্দ্র বিরোধিতার জন্যে।
এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিরুপ আলোচনা একটু বিপদজনকই বটে। তবুও কিছুটা ভরসা আছে আমাদের এই লেখার জায়গাটা মুক্তমনা বলেই। এর অধিকাংশ পাঠকই মুক্তবুদ্ধির, মুক্তচেতনার এবং মুক্তমনের মানুষ। অন্ধ ভক্তি-শ্রদ্ধার উর্ধ্বে উঠে গুণীর কদর এঁরা যেমন করতে জানেন, ঠিক সেরকমই যে কোনো মান্যবরের মানবীয় সীমাবদ্ধতাকেও না লুকিয়ে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতেও অভ্যস্ত তাঁরা। রবীন্দ্রনাথও ইন্দ্রিয়চালিত মানুষ ছিলেন। কাজেই, নানা প্রয়োজনে তাঁরও দোষগুণ নানা প্রসঙ্গে উচ্চারণ করতে হয়, হবে। এতে বাধা দেওয়াটা কোনো কাজের কথা নয়।
রবীন্দ্রনাথ যে দোষেগুণে মিলিয়ে আমাদের মতো এক রক্তমাংসের মানুষই ছিলেন তার প্রমাণ আছে তাঁর নিজের জীবনেই। তাঁর ভক্তদের মত রবীন্দ্রনাথ নিজেও নিজের বিরূপ সমালোচনা সইতে পারতেন না। সমালোচনায় উদ্বেলিত হয়ে, উৎকণ্ঠিত হয়ে তা খণ্ডনের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়তেন তিনি। তাঁর হয়ে কেউ প্রতিবাদ করুক, সেই আশায় বসে থাকতেন তিনি। সেরকম কাউকে পাওয়া না গেলে নিজেই ছদ্ম কোনো নাম নিয়ে প্রতিবাদ, প্রতিকারে নেমে পড়তেন। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ বলেন :
রবীন্দ্রনাথ বিরূপ সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না, প্রতিবাদ করার লোক পাওয়া না গেলে বেনামে লিখে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতেন। রবীন্দ্রানুরাগী ও রবীন্দ্রস্নেহভাজন অন্নদাশংকর রায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ত্রুটি-নিন্দা-কলঙ্কের সাক্ষ্য প্রমাণ সতর্ক প্রয়াসে অপসারিত বা বিনষ্ট করতেন। তা সত্ত্বেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সুশোভন সরকার তাঁর প্রণাম-প্রীতিরূপ দুর্বলতার কথা বলে গেছেন। তাঁর সেজো ভাইয়ের পৌত্র সুভোঠাকুর [সুভগেন্দ্রনাথ ঠাকুর] জমিদার পরিচালনায় তাঁর স্বার্থবুদ্ধির কথা বর্ণনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষের কবিতার নায়ক অমিতের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন যে, কবি মাত্রেরই পাঁচ বছরের জন্য কবিত্ব করা উচিত। তা না হলে শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি দিকে ব্যূহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে। তাদের লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার ‘রিসীভর্স্ অফ স্টোল্ন্ প্রপার্টি’। রবীন্দ্রনাথ নিজেও ঈর্ষণীয় রকমের দীর্ঘায়ু ছিলেন। এই দীর্ঘ জীবনে তিনি অসংখ্য সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির পরিমাণের দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তাঁর ধারে কাছেও কেউ নেই। তাঁর সমতুল্য সৃষ্টি বিশ্বের অন্য কোনো সাহিত্যে আর কেউ করেছে কি না বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই বিপুল সৃষ্টিতে কতখানি তিনি তাঁর নিজের লেখা থেকেই নকল করে লিখেছেন, সেটা রবীন্দ্র গবেষকরাই ভাল বলতে পারবেন। তবে, যেখানে কবি সাহিত্যিকদের বেশিরভাগেরই প্রতিষ্ঠা আসে জীবনের প্রথম চল্লিশ বছরের মধ্যে, তারপর তাঁদের জীবনে মোটামুটি বন্ধ্যাত্ব নেমে আসে, সেখানে রবীন্দ্রনাথ আমৃত্যু লিখে গিয়েছেন অকাতর। শুধু লিখে গিয়েছেন বললে ভুল হবে, উৎকর্ষের দিক দিয়ে এই শেষের বছরগুলো বরং ছাড়িয়ে গিয়েছে আগের রবীন্দ্রনাথকে। এ বিষয়ে নীরদ চৌধুরী লিখেছেনঃ
ওয়ার্ডসওয়ার্থ, টেনিসন, ব্রাউনিং কেহই পরবর্তী জীবনে আগের রচনার তুলনায় উৎকৃষ্টতর কবিতা লেখেন নাই –ইঁহাদের কবিকীর্তি চল্লিশ বৎসরের আগে রচিত কাব্যের উপর প্রতিষ্ঠিত। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ ও হুগো শেষ জীবনে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহা আগের জীবনে যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার সমানতো বটেই, কোনো কোনো রচনায় উচ্চতর।
আহমদ শরীফও একই ধরণের মতামত দিয়েছেন। তবে এই বিভাজনকে তিনি চল্লিশ বছরের আগে আর পরে করেন নি। বরং নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির সময়টাকে বিভাজন রেখা হিসাবে বিবেচনা করেছেন। আহমদ শরীফের মতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আগের রবীন্দ্রনাথের কাঁচা লেখা প্রাজ্ঞ হয়ে উঠেছে নোবেল প্রাপ্তির পরের সময়ে। তাঁর ভাষাতেইঃ
নোবেল পুরস্কারের মান রক্ষার খাতিরেই রবীন্দ্রনাথকে বৈশ্বিক ও বিশ্বমানবিক চিন্তা-চেতনার অনুশীলন করতে হয়েছে। তাঁর দীর্ঘায়ু তাঁকে এ সুযোগ-সৌভাগ্য দিয়েছে। পুরস্কার প্রাপ্তির পরে তিনি সুদীর্ঘ আটাশ বছর বেঁচে ছিলেন, তার আগে বাল্য-কৈশোরের যৌবনের মধ্যবয়সের জীবনদেবতা চালিত কাঁচা-পাকা লেখায় ঊনিশ শতক ও এ শতকের এক দশক কেটেছে বটে, প্রায় সমসংখ্যক বছরব্যাপী, কিন্তু পরিচ্ছন্ন ও পরিপক্ক জ্ঞান-প্রজ্ঞা, মন-মনন এবং মনীষা ও নৈপুণ্য নিয়ে বিশ্ববোধ অন্তরে জাগ্রত রেখে লিখেছেন জীবনের স্বর্ণযুগে আটাশ বছর ধরে। বলতে গেলে পুরস্কার পূর্বকালের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ঊনিশ শতকী কবি আর পুরস্কার উত্তরকালের রবীন্দ্রনাথ হলেন বিশ শতকের মনীষা মানুষ।
তবে এই রকম বিপুল বিক্রমে লিখে গেছেন বলে এটা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না যে তিনি কাউকে অনুসরণ করেন নি, অনুকরণ করে নি, বা নকল করেন নি কখনো। কবি সাহিত্যিকরা তাঁদের জীবনের কোনো না অংশে কারো না কারো দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন। এতে দোষের কিছু নেই। দোষ হয় তখনই, যখন কেউ অন্যের সৃষ্টিকে সচেতনভাবে নিজের নামে চালাতে চায়। রবীন্দ্রনাথের নামে এই ধরনের অভিযোগ তেমন একটা আসে নি। এর মানে অবশ্য এই না যে তিনি কুম্ভিলকতার দোষ (plagiarism) থেকে মুক্ত। আমাদের মত অর্বাচীন লেখকদের চোখে তো বটেই, বহু বিদগ্ধ গবেষকদের চোখেও সেগুলো পড়েছে। কিন্তু ধর্মপ্রচারকদের অনুসারীদের মতোই অধিকাংশই কেবল ‘ঠাকুর পুজো’ আর ‘নিভৃত প্রাণের দেবতার’ স্তব করে গেছেন অহর্নিশি, আর কঠিন, নির্জলা এবং রূঢ় সত্যগুলোকে আড়াল করে ঠেলে দিয়েছেন কৃষ্ণগহ্বরের গহীন আধাঁরে। হ্যা, স্তাবক দলের মোহনীয় পরিবেশনায় আমরা রবীন্দ্রাকাশে এতোদিন কেবল চাঁদের একটি পিঠই দেখে এসেছি। আজ আমরা মুক্তমনা লেখকেরা চাঁদের উলটো পিঠটাও দেখতে আগ্রহী। তাই, এই প্রবন্ধে আমরা রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে কুয়াশার কালো চাঁদর সরানোর সংকল্প করেছি। তবে, তার আগে এটুকু বলে নিতে চাই যে, রবীন্দ্র বিদ্বেষ থেকে এই প্রবন্ধটি লেখা হয় নি। বরং আমাদের মধ্যে অনেকের মধ্যেই অহেতুক যে পূজো করার বাতিক আছে, সেই পূজারীদের রবি ঠাকুরের মুর্তি গড়ে আড়ম্বরপূর্ণ পূজোতে বাগড়া দেওয়াটা এখানে মূল উদ্দেশ্য। রবীন্দ্রনাথকে আমরা দেখতে চাই নির্লিপ্ত এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে, পূজারীদের প্রেমকাতরতাময় কিংবা বিদ্বেষীদের বিষ মাখানো বিষাক্ত দৃষ্টিতে নয়।
২
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন সে কথা কারো অজানা নয়। বাংলার সেরা বিজ্ঞানী জগদীশ্চন্দ্র বসু তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। নীরদ চৌধুরীর আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ থেকে জানা যায় এই ঘনিষ্ঠতা এমনই পর্যায়ের ছিল যে, জগদীশ বসু প্রায়শই রবি ঠাকুরের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ ইউরোপে এসে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সাথেও সাক্ষাৎ করে গিয়েছেন। এর সবকিছুই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল ভালবাসার প্রমাণ হিসাবে আমরা নিতে পারি। কিন্তু, এতেও যাঁরা সন্তুষ্ট হবেন না বলে মনে হয়, তাঁদের কারণেই হয়তো বিজ্ঞানের উপর চমৎকার এবং অত্যন্ত উন্নত মানের একটা বই লিখে গিয়েছেন তিনি জীবনের শেষপ্রান্তে এসে। ছিয়াত্তর বছর বয়সে লেখা একশ পনের পৃষ্ঠার সেই বইটির নাম ছিল বিশ্বপরিচয়। তিনি যে বিজ্ঞানপ্রেমিক ছিলেন, বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে তাঁর যে লোভের অন্ত ছিল না, সেটা আমরা এই বইয়ের উৎসর্গপত্র থেকেও জানতে পারি। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। সেই উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছিলেন :
আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত [ ঘোষ ] মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ বলে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা নয় এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার পরে বয়স তখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙ-কানা থাকে আমি তেমনি তারিখ-কানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো) পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।
তার পরে বয়স আরো বেড়ে উঠল। ইংরেজি ভাষা অনেকখানি আন্দাজে বোঝবার মতো বুদ্ধি তখন আমার খুলেছে। সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই যেখানে যত পেয়েছি পড়তে ছাড়ি নি। মাঝে মাঝে গাণিতিক দুর্গমতায় পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে, তার কৃচ্ছ্রতার উপর দিয়ে মনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছি। তার থেকে একটা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে, জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার পথে সবই যে আমরা বুঝি তাও নয় আর সবই সুস্পষ্ট না বুঝলে আমাদের পথ এগোয় না এ কথাও বলা চলে না। জলস্থল-বিভাগের মতোই আমরা যা বুঝি তার চেয়ে না বুঝি অনেক বেশি, তবুও চলে যাচ্ছে এবং আনন্দ পাচ্ছি। কতক পরিমাণে না-বোঝাটাও আমাদের এগোবার দিকে ঠেলে দেয়। যখন ক্লাসে পড়াতুম এই কথাটা আমার মনে ছিল। আমি অনেক সময়েই বড়োবয়সের পাঠ্যসাহিত্য ছেলেবয়সের ছাত্রদের কাছে ধরেছি। কতটা বুঝেছে তার সম্পূর্ণ হিসাব নিই নি, হিসাবের বাইরেও তারা একরকম করে অনেকখানি বোঝে যা মোটে অপথ্য নয়। এই বোধটা পরীক্ষকের পেনসিলমার্কার অধিকারগম্য নয় কিন্তু এর যথেষ্ট মূল্য আছে। অন্তত আমার জীবনে এইরকম পড়ে-পাওয়া জিনিস বাদ দিলে অনেকখানিই বাদ পড়বে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলুম। এই বিষয়ের বই তখন কম বের হয় নি। স্যার রবর্ট বল-এর বড়ো বইটা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দের অনুসরণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নিউকোম্ব্স, ফ্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি – গলাধঃকরণ করেছি শাঁসসুদ্ধ বীজসুদ্ধ। তার পরে এক সময়ে সাহস করে ধরেছিলুম প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্সলির এক সেট প্রবন্ধমালা। জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান কেবলই এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করেছে। তাকে পাকা শিক্ষা বলে না, অর্থাৎ তাতে পাণ্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনি নেই। কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক পরিমাণে রক্ষা করেছে। অথচ কবিত্বের এলাকায় কল্পনার মহলে বিশেষ যে লোকসান ঘটিয়েছে সে তো অনুভব করি নে।
কাজেই, রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান প্রেম নিয়ে আর কোনো সন্দেহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। বিজ্ঞানের প্রতি প্রেমের কারণে বিশ্বপরিচয় লেখার আগে বেশ কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধও তিনি লিখেছিলেন। যদিও সেগুলোর মান ছিল শিশুতোষ পর্যায়ের। সেই প্রবন্ধগুলো আসলেই যে শিশুতোষ ছিল তার উদাহরণ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ লিখিত একটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধকে এখানে তুলে দিচ্ছি।
মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব
পৌরুষ সম্বন্ধে স্ত্রী-মাকড়সার সহিত পুরুষ-মাকড়সার তুলনাই হয় না। প্রথমত, আয়তনে মাকড়সার অপেক্ষা মাকড়সিকা ঢের বড়ো, তার পর তাহার ক্ষমতাও ঢের বেশি। স্বামীর উপর উপদ্রবের সীমা নাই, তাহাকে মারিয়া কাটিয়া অস্থির করিয়া দেয়। এমন-কি, অনেক সময় তাহাকে মারিয়া ফেলিয়া খাইয়া ফেলে; এরূপ সম্পূর্ণ দাম্পত্য একীকরণের দৃষ্টান্ত উচ্চশ্রেণীর জীবসমাজে আছে কি না সন্দেহ।
না, এটি কোন আনাড়ি স্কুল ছাত্রের শুরু করা এবং পথিমধ্যে হাল ছেড়ে দেয়া কোন প্রবন্ধের একাংশ নয়। এটি পরিণত বয়সে লেখা তাঁর একটি পুরো প্রবন্ধই। অবাক লাগছে? বিস্ময়কর হলেও এটাই সত্যি। বিশ্বপরিচয় বাদ দিলে বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি যে সকল প্রবন্ধ লিখেছেন সেগুলো এই মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব ধরণের। এই প্রবন্ধটি নিয়ে মুক্তমনায় একটি ধাঁধা জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, এই প্রবন্ধটি যদি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মুক্তমনায় পাঠাতেন প্রকাশের জন্য সেক্ষেত্রে মুক্তমনার মডারেটররা এটাকে প্রকাশ করতেন কি না? এর উত্তরে আদিল মাহমুদ বলেছিলেন যে, “প্রকাশ করতেন। তবে বিজ্ঞান বিভাগে নয়, রম্য বিজ্ঞান বিভাগে”।
তো এই রবীন্দ্রনাথের হাত দিয়েই শেষ বয়সে বেরিয়ে এসেছিল বিশ্বপরিচয়ের মত সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানের উন্নত একখানা বই। এতেও কোনো সমস্যা ছিল না, বরং আমাদের জন্য তা সৌভাগ্যেরই বিষয়। এর মধ্যে তিনি হয়তো বিজ্ঞানের উপরে আরো পড়াশোনা করেছেন, নিজের উৎকর্ষতা বাড়িয়ে নিয়েছেন, নিজেকে সমৃদ্ধতর করেছেন। তাঁর মানের একজন ব্যক্তি তা করতেই পারেন। কিন্তু বিশ্বপরিচয়ের উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথ কিছু কথা বলেছিলেন, যা অনেকটা ছন্দপতনের মতই ছিল। যদিও তিনি আন্তরিক অকপটতায় কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু এর মধ্য থেকেই বেরিয়ে এসেছিল ভয়ংকর এক সত্য। সেই ভয়ংকর সত্যকে জানার আগে আসুন দেখি রবীন্দ্রনাথ কী বলেছিলেন। উৎসর্গপত্রের শেষের দিকে এসে তিনি এই গ্রন্থটি লেখার কারণটি ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে তিনি লিখেছেনঃ
শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এম. এসসি. তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র। তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-অধ্যাপক। বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম। ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল। তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তাছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি সাহায্যও পেয়েছি।
এখানেই এসেই মূলত খটকাটা শুরু হয়। যে বই লেখার ভার পড়েছিল প্রমথনাথের উপরে সেই বই লেখার ভার হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথের ঘাড়ে গিয়ে পড়লো কেন? তাছাড়া কথা হচ্ছে, প্রমথনাথ ঠিক কতখানি শুরু করেছিলেন? যতটুকু শুরু করেছিলেন তাতে করে সহলেখক হিসাবে তাঁর নাম আসাটা যুক্তিসঙ্গত ছিল কি না? এটি অনুসন্ধান করতে গিয়েই বেরিয়ে আসে চরম এবং ভয়ংকর সত্যটা; যে সত্যটাকে দীর্ঘকাল গোপন করে রাখা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ইমেজকে তাঁরই পরনের সাদা আলখাল্লার মত পুতপবিত্র রাখার বাসনায়।
মূল ঘটনায় যাবার আগে ‘বিশ্বপরিচয়’ গ্রন্থটি শুরুর ইতিবৃত্তটুকু একটু জেনে নেয়া যাক। রবীন্দ্রনাথের এক সময় ইচ্ছে হয়েছিলো পশ্চিমের ‘হোম ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি’র অনুকরণে ‘লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা’ তৈরির – যেটি জনপ্রিয় ভাষায় বিজ্ঞানকে সর্বসাধারণের কাছে পোঁছিয়ে দেবে। কাজেই ভাষা হতে হবে যথাসম্ভব সহজ সরল, পাণ্ডিত্যবিবর্জিত। তিনি ভেবেছিলেন মহাবিশ্বের সাথে সাধারণ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য একটা বই লেখা হবে, এবং বইটির ভার তিনি দেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকের কাজ নিয়ে বিশ্বভারতীতে যোগ দেয়া তরুণ অধ্যাপক প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর।
রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে বলেছেন [প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক’ ৪র্থ খণ্ড, বিশ্বভারতী,১৪০১, পৃ ৯৬]-
‘আমাদের আলোচ্যপর্বে রবীন্দ্রনাথকে আর-একটি বিষয়ে আলোচনা করিতে দেখিতেছি, সেটি হইতেছে লোকশিক্ষার ক্ষেত্রে। পাঠকদের স্মরণে আছে বহু বৎসর পূর্বে Home University Libraryর অনুরূপ গ্রন্থমালা বাংলাভাষায় প্রকাশনের কথা কবির মনে আসিয়াছিল। এতকাল পরে বিশ্বভারতী প্রকাশন-বিভাগের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র ভট্টাচার্যের উদ্যোগে লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা প্রকাশের পরিকল্পনা গৃহীত হইল। কবির মতে, ‘সাধারণজ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকার আরম্ভ হইবে বিজ্ঞানচর্চায়। তদুদ্দেশে কবির ইচ্ছা যে, এই লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার প্রথম গ্রন্থ হইবে বিশ্বপরিচয়। কবি বলেন, ‘বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার। … জ্ঞানের এই পরিবেশনকার্যে পাণ্ডিত্য (pedantry) যথাসাধ্য বর্জনীয় মনে করি। এই প্রথম গ্রন্থখানি লিখিবার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর। প্রমথনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র, সত্যেন বসুর প্রিয় শিষ্য, শিক্ষাভবনে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক।’
তরুণ শিক্ষক প্রমথনাথ শান্তিনিকেতনে চাকরী পেয়েছিলেন সত্যেন বোস এবং জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের সুপারিশে। তিনি বিজ্ঞানের ভাল ছাত্র ছিলেন। কিন্তু বাংলায় খুব বেশি দখল ছিল না, (অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথের সমপর্যায়ের নন বলে তিনি মনে করতেন)। । রবীন্দ্রনাথ প্রমথবাবুকে ব্রিটিশ পদার্থবিদ জেমস জিনসের একটা বই – ‘থ্রু স্পেস অ্যান্ড টাইম’ পড়তে দিয়েছিলেন। জেমস জিন্স খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে কিছু সুনাম তাঁর ছিল। ফলে, তার বই থেকে জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই কিভাবে লিখতে হয় তার একটা রসদ পাবেন প্রমথবাবু – সেরকম একটা ধারণা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কাজেই, রবীন্দ্রনাথ যখন প্রমথবাবুকে বই লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন (তখন কি তিনি কস্মিনকালেও জানতেন, তার এই রসদ রবিবাবু পুরোটাই নিজের বইয়ের কাজে ব্যবহার করবেন) যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন। কী রকম উচ্ছ্বাস তার হয়েছিল, তা প্রমথবাবুর ভাস্য থেকেই শোনা যাক –
‘সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ। সে এক বিপর্যয় কান্ড। কোনদিন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ বাংলা রচনায় হাত দেইনি, দু একটা ছোটখাট রচনা যা লিখেছি তা ছিলো ইংরেজীতে। তাই এই অনভ্যস্ত পথে প্রতিপদে কেবল হোঁচট খেতে হল। এগোন আর হচ্ছিলো না। নিজের লেখা নিজেরই এত খারাপ লাগতে লাগল যে, দু এক পাতা লিখেই তা ছিঁড়ে ফেলতাম। ফলে ছিন্ন কাগজের পাতায় ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উঠল। খাতাখানাও সম্বল হারিয়ে ক্রমশঃ শীর্ণকায় হয়ে উঠল। অবশ্য এতে একজন খুব খুশি হলেন, উনুন ধরাবার কাজে অনায়াসলব্ধ এই ছিন্নপত্রগুলো আমার স্ত্রী যথাযথ সদ্গতি করে চললেন।
এই উদ্ধৃতিটি আছে প্রমথনাথ সেনগুপ্তের আনন্দরূপম বইয়ে, যা বাসুমতি, কলকাতা থেকে একসময় প্রকাশিত হয়েছিল (এখন বইটি দুর্লভ, খুঁজলেও পাওয়া যায় না)। বইয়ের এই উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় লেখক বাংলা নিয়ে অতটা আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, কিন্তু এটি অন্ততঃ ভেবেছিলেন বইটি তাঁরই হবে।
এ সময় পাঠভবনের অধ্যাপক তনয়বাবু (তননেন্দ্রনাথ ঘোষ, পাঠভবনের অধ্যাপক) এসে বললেন –
এভাবে তো হবে না, আপনি যা পারেন লিখুন। তবে তথ্যের দিক থেকে যেন হাল্কা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। আমাদের বিচারে যে ভাষা সাধারণতঃ ভালো বলে আখ্যা পায়, গুরুদেবের হাতে পড়লে তার খোল-নলচে বদলে গিয়ে এক নতুন ভাষা প্রকাশ পায়। কাজেই বৈজ্ঞানিক তথ্য পর পর সাজিয়ে দিন, ভাষার ভার গুরুদেব নেবেন। গুরুদেব সেই ভাষা দেখে পরবর্তী পর্যায়ে লিখতে শুরু করবেন।’
পাঠক, বুঝতেই পারছেন, কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কেবল ভাষার মাধুর্য বাড়িয়ে প্রমথনাথের মূল তথ্যগুলো হাতিয়ে নেবার পায়তারা চলছে। কিন্তু তারপরেও বই লেখার এ পদ্ধতি ঠিক হবার পরেও হতভাগ্য প্রমথবাবু কিন্তু ভাবছেন বইটা তাঁরই হবে। তিনি বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন – ‘বিশ্বরচনা’। তাই তিনি লিখলেন –
‘ওদের উপদেশ মেনে নিয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু হল। বইটার নামকরণ করলাম “বিশ্বরচনা” । ধীরে ধীরে কাজ এগুতে লাগল। ‘পরমাণুলোক’ দিয়ে শুরু হল বইয়ের প্রথম অধ্যায়, এটা শেষ করে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যেতে হবে।’
প্রথম অধ্যায় লেখা শেষ করে প্রমথনাথ রবীন্দ্রনাথের কাছে নিয়ে গেলেন। রবীন্দ্রনাথ দেখে বললেন,
“রচনাটি আমার কাছে রেখে যাও, কাল ফেরৎ পাবে। বিজ্ঞানের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটাতে হলে ভাষাটা কীরকম হবে, তাই শুধু দেখিয়ে দেব”।
শুধু পরমাণুলোক নয়, এর পর নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার সব অধ্যায়ই লিখেছেন প্রমথবাবু। আর রবীন্দ্রনাথ খোল নলচে বদলে দিয়েছেন। সেই সংশোধন করা পাণ্ডুলিপিগুলো প্রমথনাথ অবশ্য আনন্দরূপম বইয়ে ছাপিয়েছিলেন কিছু কিছু ।
প্রমথবাবু পুরো বইটি এবং তার উপসংহার শেষ করার পরে রবীন্দ্রনাথ ঠিক করেন বইটার নাম “বিশ্বপরিচয়” হবে। কিন্তু প্রমথনাথকে ঘূর্ণাক্ষরেও তিনি জানতে দেননি একথা। বরং ভিন্ন একধরণের নাটকের অবতারণা করলেন ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে নিয়ে এসে। নাটক বলছি কেন সেটা পাঠকেরা শুনেই বুঝতে পারবেন আশা করছি।
ডঃ সেন হঠাৎ ওকে (প্রমথ বাবুকে) বললেন,
বিশ্বপরিচয় নিয়ে আপনি যে পরিশ্রম করেছেন তাতে বইটার যুক্তগ্রন্থকার হওয়া উচিৎ – রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ।
‘গুরুদেব’ সাথে সাথে বললেন,
সে কীরে, বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে। আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথেরই হওয়া উচিৎ। তবে আমার নামের সাথে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চান, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে।
নিঃসন্দেহে এটা প্রমথবাবুর জন্য বড় রকমের ধাক্কা ছিল। তিনি প্রথমে ভেবেছিলেন তার নামেই বইটা হবে। বইয়ের সব তথ্য যে তাঁরই যোগাড় করা! তারপরেও রবীন্দ্রনাথ যেহেতু ভাষার সবকিছু ঢেলে সাজিয়েছেন, সেহেতু যুক্তগ্রন্থকার হলেও খুব বেশি হারাবার নেই বলেই ভেবেছিলেন হয়তো। সেই বিহবল অবস্থা ধরা পড়ে প্রমথবাবুর লেখায় –
তারপর পান্ডুলিপি নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করলেন, তারপর ওখান থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ডক্টর সেন বললেন যে, সম্ভব হলে ঐ গ্রীষ্মের ছুটির মধ্যেই যেন ‘পৃথ্বী-পরিচয়’ বইটা আমি শেষ করি। ওর কথা বলার ধরণ দেখে মনে হচ্ছিল ‘বিশ্বপরিচয়’ বইটার লেখকের নাম নিয়ে কোথায় যেন একটা সংশয় জেগেছে, অবশ্য এ ব্যাপারে ওঁকে খোলাখুলি কিছু জিজ্ঞেস করাও সম্ভব নয়।’
এর বেশ কিছুদিন পর নাটকের আসল যবনিকাপাত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিক করলেন প্রমথবাবুকে জানাবেন ব্যাপারটা যে, নিজেই বইয়ের লেখক হতে চান, প্রমথবাবুকে বাদ দিয়ে। কীভাবে সেটা প্রমথবাবুর মুখেই শোনা যাক –
গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যার সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়নে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহনবাবু ও শাস্ত্রীমশায়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, “দেখো, বিশ্বপরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না। ” একটু থেকে বললেন, “অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তা ছাড়া বিজ্ঞানের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষপর্যন্ত এই অধ্যবসায়ীর সাহসে কুলাতো না। তুমি ক্ষুন্ন হয়ো না।
এই হচ্ছে বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত। রবীন্দ্রনাথের বিশাল পরিচিত এবং ব্যক্তিত্বের কাছে নতজানু প্রমথনাথ ক্ষুন্ন হয়েছিলেন কি না জানা নেই আমাদের। তবে, এই ঘটনা জেনে আমরা যে ভয়ংকর রকমের ক্ষুব্ধ, ক্ষুন্ন এবং ক্ষীপ্ত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহই নেই। রবীন্দ্রনাথের মত একজন বিশাল ব্যক্তিত্ব তাঁরই অধীনস্থ সামান্য একজন শিক্ষকের সাথে এরকম প্রতারণা করবেন, তাঁর লেখা বইকে নিজের নামে ছাপিয়ে দেবেন কোনো ধরনের চক্ষুলজ্জার ধার না ধেরে, সেটা মেনে নেওয়াটা আসলেই কষ্টকর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই ‘রাহাজানির’ (হ্যা, এটি আমাদের চোখে রাহাজানিই, ছোটখাট ‘জোচ্চুরি’ নয়) ঘটনার পুরো বিবরণ আছে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের লেখা ‘রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান’ [ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০০০] বইয়ে। দীপঙ্কর চট্টোপাধায় পেশায় পদার্থবিদ, দাপটের সাথে এক সময় অধ্যাপনা করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৫৮ -৬১), এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরেও তিনি রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরুতে পারেননি, বরং ‘দেশ পত্রিকার’ অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রস্তাবকদের একজন ছিলেন তিনি। যথারীতি আর সব সমসাময়িক রাবীন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের মতোই রবিঠাকুরকে মাথায় তুলে নেচেছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ কত বড় বিজ্ঞানমনস্ক, কত পরিশীলিত ছিলো তার জ্ঞান, কত আধুনিক ছিলো তার দৃষ্টিভঙ্গি, সে সময়কার কত বড় বড় বিজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথের সাথে পরিচিত হবার জন্যে পাগল হয়ে বসেছিলো – তা নিয়ে ফেনিয়ে ফেনিয়ে লিখে গেছেন পাতার পর পাতা। এমনকি আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথের সংলাপের পরিপ্রেক্ষিতে আইনস্টাইনের চেয়ে রবীন্দ্রনাথই যে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ক্ষেত্রে বেশি সঠিক ছিলেন সেটাও আকারে ইঙ্গিতে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এ ক্ষেত্রে দীপঙ্কর বাবুকে একলা দোষ দেয়া যায় না। যুগটাই রবীন্দ্রবন্দনার, রবিঠাকুরের মিছে ভাবমূর্তি গড়ে চোখ মুদে স্তব করার। মডারেট শিক্ষিত ইসলামিস্টরা যেমন কোরাণের মধ্যে বিগব্যাং থেকে শুরু করে সমাজ এবং অর্থনীতির যাবতীয় সূত্র খুঁজে পান, ঠিক তেমনি মডারেট শিক্ষিত রবীন্দ্রস্তাবকেরাও সেই কাজটি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অতীব নিষ্ঠার সাথে পালন করে চলেছেন, ভারত এবং বাংলাদেশ – দু জায়গাতেই। রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, মানবতাবাদ, কৃষি, সমাজতন্ত্র, কোয়ান্টাম ফিজিক্স – এমন কোন ক্ষেত্র নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথের নিত্য নতুন অবদান আবিস্কৃত হয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সমজ-সভ্যতা ধন্য হচ্ছে না তার স্তাবককূলের হাতে পড়ে। ‘সমাজতন্ত্র কেন কাজ করেনি?’ – রবীন্দ্রনাথ নাকি সেই বিশের দশকেই রাশিয়ার চিঠিতে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক সংকেত উত্থাপন করে আমাদের জানিয়ে গিয়েছিলেন – একদিন সমাজতন্ত্র ভেঙ্গে পড়বে। আইনস্টাইনের মতো জগদ্বিখ্যাত পদার্থবিদের চেয়ে রবীন্দ্রনাথ নাকি ভৌত বাস্তবতার প্রকৃতি আরো ভাল বুঝতেন, আর তার ইঙ্গিত নাকি দিয়ে গেছেন শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের ‘আমি’ কবিতায় ‘আমারি চেতনার রঙে পান্না হলো সবুজ’ চরণের মাধ্যমে। শুধু সমাজতন্ত্র কিংবা পদার্থবিজ্ঞান নয়, পত্রপত্রিকার রবীন্দ্রভক্ত বুদ্ধিজীবীদের কলাম থেকে আমরা আজ শুনছি – আধুনিক ক্ষুদ্র ঋণের আবিস্কারকও নাকি রবীন্দ্রনাথ। পাশাপাশি কৃষিকর্মকাণ্ড, সমবায় প্রচেষ্টা, নারীশিক্ষা সবকিছুরই আদি অকৃত্রিম অগ্রদূত রবিঠাকুর। আজকের জামানায় রবীন্দ্রনাথ আবির্ভূত হয়েছেন যেন নতুন এক পয়গম্বর হিসেবে। কাজেই দীপঙ্কর চট্টোপাধায় নতুন কিছু করেননি, বহমান বাতাসেই নিজ নৌকার পাল তুলে দিয়েছেন, নিজেকে ভাসিয়েছেন গড্ডালিকা প্রবাহে। বিনিময়ে পেয়েছেন দেশ পত্রিকায় লেখার এবং আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বই বের করার দারুণ সুযোগ। বাংলাদেশের নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী শমশের আলীরা যেমন ‘কোরানিক বিজ্ঞান’ থেকে বেরুতে পারেন না, কোরানের প্রাচীন আয়াতের মধ্যে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্বেষণ করেন, ঠিক তেমনি দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের মতো রবীন্দ্র স্তাবকেরা ধর্মগুরুর মতোই রবীন্দ্রনাথকে জ্ঞান করেন, তাকে সঠিক মনে করেন, আর রবীন্দ্র রচনাবলীর মধ্যে সন্ধান করেন আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের। তারপরেও তার গুরুজির এভাবে রাহাজানি করে মেধাসত্ত্ব মেরে দেয়ার এই লজ্জা দীপঙ্করবাবুও লুকাতে পারেন নাই। যেমন দীপঙ্কর মশাই বলছেন –
কিন্তু একটা কথা মানতেই হবে। গোড়া থেকেই প্রমথনাথের মনে কবি একটা প্রত্যাশা জাগিয়ে তুলেছিলেন। প্রথমে তো বলেছিলেন বইটা প্রমথবাবুকেই লিখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই তাকে সাহায্য করবেন, বিশেষ করে ভাষার ব্যাপারে। এটা বলা কতদূর সঙ্গত হয়েছিল সেটাই প্রশ্ন।
তারপরেই আবার পূজারী রবীন্দ্রনাথের সাফাই গেয়েছেন এই বলে –
রবীন্দ্রনাথের একটা মজার ব্যাপার ছিল। অনেককেই তিনি গল্পের প্লট দিতেন, গল্প লিখিয়ে নিতেন। অনেক কবিযশঃপ্রার্থীর কবিতা সংশোধন করে দিতেন। এসব তিনি করেছেন খ্যাতির চূড়ায় বসেও। অত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি এসব কী করে করতেন কে জানে!
প্রিয় পাঠক, উক্তিটা শুনে সেই ব্যাঙ-এর গল্পের কথা মনে পড়ছে না? ছেলেপিলেরা পুকুর পাড়ে বসে ব্যাঙদের উপর ঢিল ছুঁড়তো। ছেলেদের জন্য নির্দোষ ঢিল ছোঁড়া – যেটা তাদের কাছে স্রেফ মজার ব্যাপার ছিলো, সেটাই কিন্তু ছিলো ব্যাঙদের জন্য মরণের কারণ। বুঝতে কী এটি খুব বেশি সমস্যা – রবীন্দ্রনাথ একে তাকে দিয়ে যেটা “মজার ব্যাপার” মনে করে লিখিয়ে নিতেন, আর তারপর নিজের নামে চালিয়ে দিতেন – সেটা প্রমথনাথের মত নবীন লেখকদের জন্য হয়েছিলো সর্বনাশের কারণ?
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের দীপঙ্ককর চট্টোপাধ্যায় – যারাই রবীন্দ্রনাথের জীবনের এই কলঙ্কিত অধ্যায়টি নিয়ে কাজ করতে গিয়েছেন, তারাই কিছুটা হলেও লজ্জিত হয়েছেন, কিন্তু তারপরেও ‘গুরুদেব’ রবীন্দ্রনাথ থেকে তাদের মোহমুক্তি ঘটেনি। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, প্রমথনাথের ভাষার চেয়ে রবীন্দনাথের ভাষা ছিলো অতুলনীয়, খোলনলচে বদলানোর পর লেখাটা এতোটাই বদলে গেছে যে সেটা প্রমথনাথের বই হবার যোগ্যই ছিলো না। তাই তাকে লেখকের পদ থেকে বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সঠিক কাজই করেছেন। যুক্তি বটে! তাদের কথা মানা যেত, যদি বইয়ের কাজটি রবীন্দ্রনাথই প্রথম থেকে শুরু করতেন, পাণ্ডুলিপিটি নিজে লিখতেন, এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের জন্য প্রমথনাথের সাথে কেবল আলোচনা করে ভুলচুক থাকলে সেটা শুধরে নিতেন, অথবা তাকে দিয়ে রিভিউ করাতেন। তা রবীন্দ্রনাথ করেনিনি। বরং পুরো বইটি লিখিয়েছেন প্রমথনাথকে দিয়েই। একটি দুইটি অধ্যায় নয় – পুরো গ্রন্থের সবগুলো অধ্যায় – পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভুলোক, এমনকি উপসংহার পর্যন্ত তাকে দিয়ে লিখেছেন। কিন্তু মূল গ্রন্থাকার হিসেবে প্রমথনাথকে কৃতিত্ব দেয়া দূরের কথা – সহগ্রন্থকার হিসেবেও তাকে ঠাঁই দেননি ‘ঋষিপ্রতিম’ রবীন্দ্রনাথ, কেবল ভূমিকায় একটি বাক্যে তার নামের উল্লেখ করে দায় সেড়েছেন। একে রাহাজানি ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?
৩
রবীন্দ্রনাথের মত অতুলনীয় সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে খুব কম সাহিত্যিকই জন্মেছেন। তাঁর রচনাসমূহ নিয়ে ভক্তদের মাতামাতি, উচ্চ প্রশংসা, জীবনের সর্ব আবেগের প্রকাশ রয়েছে রবীন্দ্রনাথে বা রবীন্দ্রনাথ ছাড়া বাঙালিত্ব অসম্পূর্ণ ইত্যাদি উচ্ছ্বাসভরা কথাবার্তা খুব স্বাভাবিক ঘটনা। তবে, তাঁর গান নিয়ে যা হয় সেটাকে ঠিক মাতামাতি শব্দটা দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। রবীন্দ্রনাথের গানকে একরকম প্রার্থনা সংগীত বানিয়ে ফেলেছেন তাঁর পূজারীর দল। যে ভাবগম্ভীর পবিত্রতা নিয়ে রবীন্দ্র সংগীত পরিবেশন করা হয় বা শোনা হয়, তা দেখলেই যে কেউই একে পূজোর আচার আচরণ ভেবে ভুল করে বসে থাকতে পারেন। ভেবে বসে থাকতে পারেন যে, একদল পূজারী গভীর ভক্তিভরে তাঁদের কোনো প্রাণপ্রিয় দেবতার উদ্দেশ্যে নৈবেদ্য পরিবেশন করে চলেছেন। এর পূজারীর দল রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া পৃথিবীতে যে অন্য কোনো সংগীত থাকতে পারে, আর সেগুলো যে এর থেকেও ভাল হতে পারে সেটা কোনোভাবে মেনে নিতে রাজী নন। অনেকেই খুব ‘গৌরবের সাথে’ এবং নির্দ্বিধায় বলে দেন যে, রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া অন্য কোনো সংগীতই শোনেন না। বাংলা গান শোনার ক্ষেত্রে কিছু বাঙালির এই একপেশে আচরণ সম্পর্কে কবীর সুমন (সুমন চট্টোপাধ্যায়) তাঁর লিখিত বই কোন পথে গেল গান-তে বলেছেনঃ
বাংলা গান শোনা আমাদের সমাজে বরাবরই একপেশে। ফলে, কালক্রমে কিছু জনপ্রিয় গায়ক গায়িকা ও তাঁদের স্মৃতি ঘিরেই আমাদের গানপ্রেম আবর্তিত। সেই সঙ্গে ‘আমি বাপু রবীন্দ্র সংগীত ছাড়া কিছু শুনি না’, ‘আমি বাবা রবীন্দ্র-নজরুল-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্তর বাইরে কিছু মানতে রাজি নই’,…. গোছের বেরসিক, একদেশদর্শী, সুরবধির মানসিকতার শুধু বহির্প্রকাশই নয়, সগর্ব উচ্চারণ।
ভক্তি এবং ভাবে গদগদ ভক্তদের এক্ষেত্রে অবশ্য এককভাবে দোষ দেওয়াটাও অনুচিত। রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বিরল ব্যক্তিত্ব, যাঁর দুটো গান দুটো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত। রবীন্দ্রনাথের নিজেরও তাঁর গান সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা ছিল। তাঁর অন্য কোনো সাহিত্যকর্ম দীর্ঘস্থায়ী না হলেও গান যে হবে সে বিষয়ে তিনি নিঃসন্দেহ ছিলেন। তাইতো তিনি বলেছিলেন, “জীবনের আশি বছর অবধি চাষ করেছি অনেক। সব ফসলই যে মরাইতে জমা হবে তা বলতে পারি না। কিছু ইঁদুরে খাবে, তবু বাকি থাকবে কিছু। জোর করে বলা যায় না, যুগ বদলায়, তার সঙ্গে তো সবকিছু বদলায়। তবে সবচেয়ে স্থায়ী আমার গান, এটা জোর করে বলতে পারি। বিশেষ করে বাঙালীরা, শোকে দুঃখে সুখে আনন্দে আমার গান না গেয়ে তাদের উপায় নেই। যুগে যুগে এ গান তাদের গাইতেই হবে। [লেখক সমাবেশ, ৫ম বর্ষ সংখ্যা – ১৩, প্রথম পক্ষ মে ১৯৮৫, পরেশ ধর – উদ্ধৃত]
রবীন্দ্রনাথের কথা আপাত সত্য। তবে, আজীবনের জন্য সত্য নয়। কোনো জিনিসই চিরস্থায়ী হয় না, তা সে সেই সময়ের জন্য যতই উৎকৃষ্ট হোক না কেন। এর জ্বলন্ত প্রমাণ মধুসুদন। এরকম একজন অসাধারণ মেধাবী কবি এখন শুধু টিকে আছেন পাঠ্য বইয়ে। কাল সবকিছুকেই গ্রাস করে নেয়। রবীন্দ্রনাথও একসময় প্রাচীন কবি হবেন, তাঁর অধিকাংশ রচনা মূল্য হারাবে- রবীন্দ্র-মহিমাও হবে ম্লান থেকে ম্লানতর। তাঁর উপন্যাস কিংবা গল্পের অনেক কিছুতেই ‘সেকেলের ছাপ’ লেগে গেছে ইতোমধ্যেই, এমনকি বহু আধুনিক মেধাবী কবিদের কবিতা কিংবা গীতিকারদের গান রবীন্দ্ররচনার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিচ্ছে, কখনো বা উৎরে গেছে রবীন্দ্র সংগীতকে পিছনে ফেলে দিয়ে।
সমস্যা হচ্ছে যে রবিন্দ্রভক্তরা এই কথাটা মানতে রাজি নন। এই পরিস্থিতিটাকে উপলব্ধি করতে সক্ষম নন। ফলে, বিভিন্ন নিষেধ জারি করে রবীন্দ্রনাথের গানকে বিশুদ্ধ রাখার, আজীবন টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন তাঁরা।
দেবব্রত বিশ্বাস ছিলেন কিশোরগঞ্জের মানুষ। ব্রাহ্ম পরিবারে জন্মেছিলেন তিনি। সে কারণে হিন্দুরা তাঁদেরকে ম্লেছ বলে অভিহিত করতো। স্কুলে তিনি যে বেঞ্চে বসতেন সেই বেঞ্চে অন্য কোনো হিন্দু ছেলে বসতো না। গ্রামের কয়েকজন মুসলমান রাখাল ছিল তাঁর বন্ধু। অসাধারণ দরাজ গলা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। গানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না। ব্রাহ্মসমাজের মন্দিরে প্রার্থনা সংগীত গাইতে গাইতেই রবীন্দ্র সংগীত শিখেছেন তিনি। এই দেবব্রত বিশ্বাসকে রীতিমত জ্বালিয়ে মেরেছিল ‘রবীন্দ্রভারতী মিউজিক বোর্ড’। রবীন্দ্রনাথের গানের কপিরাইট তাঁদের হাতে ছিল। ফলে, রবীন্দ্র সঙ্গিতের যে কোনো রেকর্ডকেই বিশ্বভারতীর অনুমোদন নিতে হতো বাজারজাত করার আগে। রবীন্দ্রভারতী একাধিকবার দেবব্রত বিশ্বাসের গানকে অনুমোদন দেয় নি বিচ্যুতি এবং অতিরিক্ত বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের অজুহাত তুলে। এর ফলে, হতাশ হয়ে ১৯৭০ সালের পরে তিনি আর কোনো রবীন্দ্র সংগীত রেকর্ড করান নি। কেনো তাঁর গাওয়া গানকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে না, এ বিষয়ে জানতে চাইলে একবার তাঁদের চিঠির সাথে রবীন্দ্র সংগীতের সাথে কী কী ধরণের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতে হবে তার একটা তালিকা দিয়ে দিয়েছিলেন তাঁরা। সেই তালিকাটা এরকম।
রবীন্দ্রসংগীতের উপযোগী যন্ত্রঃ
১। (ক) এস্রাজ, বাঁশী, সেতার, সারেঙ্গী, তানপুরা, বেহালা, দোতারা, একতারা, বাসবেহালা বা অর্গান।
(খ) পাখোয়াজ, বাঁয়াতবলা, খোল, ঢোল ও মন্দিরা।২। প্রতি গানের মূল আবেগটির প্রতি লক্ষ্য রেখে অনুকূল আবহসংগীত যন্ত্রে রচনা করে, আরম্ভে এবং যেখানে গায়কের কণ্ঠের বিশ্রাম প্রয়োজন, সেখানে তা প্রয়োগ করতে হবে।
৩। যে কটি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, গানের সঙ্গে তার সব কটিকেই বাজান যেতে পারে কিন্তু কোন যন্ত্রটি কিভাবে আবহ সংগীতে বাজবে সংগীত রচয়িতাকে তা স্থির করতে হবে গানের প্রতি ছত্রের ভাবটির প্রতি লক্ষ্য রেখে।
৪। আবহ সংগীত গায়কের গলার শব্দকে ছাড়িয়ে যাবে না কখনো। কণ্ঠের বিশ্রামের সময় বা গান আরম্ভের পূর্বে যখন যন্ত্রে আবহসংগীত বাজবে তখনও এই দিকটার প্রতি বাজিয়েরা যেন বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখেন।
৫। তালযন্ত্রের সঙ্গতের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, তালের ছন্দ বা বোল যেন কথার ছন্দ ও লয়ের বিপরীত না হয়। অর্থাৎ দ্রুত ছন্দের গানে যেমন দ্রুত লয়ের ঠেকার প্রয়োজন ঢিমালয়ের গানে তেমনি ঢিমালয়ের ঠেকার প্রয়োজনকে মানতেই হবে।
৬। কথার উপরে ঝোঁক দিয়ে অনেক গান গাইতে হয়। এই সব গানের সঙ্গে সঙ্গতের সময় তালবাদ্যেও কথার ছন্দের অনুকূল ঝোঁক প্রকাশ পাওয়া দরকার। তাতে গানের ভাবের সঙ্গে কথার ভাবের সঙ্গতি থাকে।
রবীন্দ্রভারতীয় মিউজিক বোর্ডের এই সব হাস্যকর নিয়মকানুনকে মানতে পারেন নি দেবব্রত বিশ্বাস। সে কারণে সিদ্ধান্ত নেন যে, রবীন্দ্রসংগীত আর রেকর্ড করবেন না। রবীন্দ্রপূজারী এবং রবীন্দ্র শুদ্ধবাদীদের এই বাদ্যযন্ত্রের নিয়মাবলী যে কতটা হাস্যকর যে বিষয়টা দেবব্রত বিশ্বাস তাঁর আত্মজীবনী ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত এ এভাবে তুলে ধরেছেন-
রেকর্ডে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় উপর্যুক্ত নির্দেশগুলি কে বা কারা দিয়েছেন আমি জানি না। তবে বেশ সহজেই বোঝা যায় যে, যিনি বা যাঁরা ওই নির্দেশগুলি জারী করেছেন তাঁর বা তাঁদের রেকর্ডিঙের ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই। উপরে উল্লিখিত ৪নং নির্দেশটি পড়লে মনে হবে রেকর্ড করার সময় যাঁরা বাদ্যযন্ত্র বাজান, আবহসংগীত বাজাবার সময় বাজিয়েদের ওপরেই সমস্ত দায়িত্ব চাপানো হয়েছে। উপর্যুক্ত নিয়ামকরা জানেন না যে এই ব্যাপারে বাদ্যযন্ত্রীদের কোনো দায়িত্বই নেই। রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার তাঁর ঘরে বসে রেকর্ডিং যন্ত্রের নানা ধরনের চাবিকাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কণ্ঠের এবং বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজগুলি নিয়ন্ত্রণ করেন এবং প্রয়োজন হলে ইঞ্জিনিয়ার ইশারা করে অথবা নিজে এসে নির্দেশ দিয়ে যান। ৫নং নির্দেশটিতে তালযন্ত্রের ব্যবহার সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা পড়ে মনে হবে সেগুলি খুব বিশেষ চিন্তাপ্রসূত নয়। তালযন্ত্র বিশেষ করে তবলা বাজাবার ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল এবং খুব সূক্ষ্ণ অনুভূতির ব্যাপার। তাই হিন্দুস্থান রেকর্ডিং কোম্পানী যখন এই চিঠিগুলি আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন তখন ভেবেছিলাম এই ব্যাপারে কোনো মন্তব্য বা করাই ভাল। তাছাড়া রবীন্দ্রসংগীত আর রেকর্ড করবো না বলেই স্থির করেছিলাম।
এই বিশুদ্ধবাদীরা কিছু জানুক বা না জানুক, একটা জিনিস খুব ভাল করেই তাঁরা জানে। তা হচ্ছে যে, কেমন করে তাঁদের দেবতাতুল্য মহামানবের ঐশ্বর্য এবং সম্পদকে অবিকৃত এবং অক্ষুন্ন রাখা যায়। তাতে করে দেবব্রত বিশ্বাসের মত দুইচারজন রবীন্দ্রসংগীত না গাইলেও কিছু এসে যায় না তাঁদের।
কয়েক বছর আগে ব্যাণ্ড সংগীত শিল্পী মাকসুদ আধুনিক বাদ্যযন্ত্র সহযোগে রবীন্দ্রনাথের একটা গান “না চাহিলে যারে পাওয়া যায়” এই গানটি নিজস্ব ঢং এ ফিউশন বানিয়ে গেয়েছিলেন। তখন রবীন্দ্রপুজারীরা, যারা রবীন্দ্রনাথকে নশ্বর মানব থেকে অবিনশ্বর ঈশ্বরে উপনীত করে ফেলেছেন, তাঁরা রবীন্দ্র সংগীতের জাত গেল, জাত গেল বলে শোরগোল তুলেছিলেন। কোরানের আয়াতের সামান্য বিচ্যুতি যেমন মোল্লাদের সহ্য হয় না, নারী নীতির বিরুদ্ধে হুঙ্কার পেড়ে রাস্তায় নামেন আমিনী গং, ঠিক একই রকমভাবে আমাদের দেশের রবীন্দ্রমোল্লারা রাস্তায় নেমেছিলেন ‘পবিত্র রবীন্দ্র সঙ্গীতের’ শুদ্ধতা রক্ষার জন্য। শুদ্ধবাদীদের মধ্য থেকে ওয়াহিদুল হক পত্রিকায় কলম ধরেছিলেন মাকসুদের পিণ্ডি চটকানোর জন্য। অথচ গান নিয়ে নিরন্তর গবেষণা, গানকে ভেঙেচুরে সাজানো বহমান সংস্কৃতিরই অংশ। পশ্চিমা বিশ্বে রক এণ্ড রোল, রেগে, ব্লুজ, জ্যাজ, কান্ট্রি মিউজিক নিয়ে নিরন্তর ভাঙ্গাচোরা চলে। এলভিস প্রিসলী কিংবা চাক বেরি একসময় যে ঢং এ রক এন্ড রোল সংগীত পরিবেশন করতেন, আজকের শিল্পীরা সেভাবে সংগীত পরিবেশন করেন না। তারা বরং পুরোন গানগুলোকে নিজদের মতো করে ঢেলে সাজান, প্রয়োগ ঘটান নতুন নতুন বাদ্যযন্ত্রের, কখনো নতুন তাল এবং ছন্দেরও। এতে করে কারো জাত যায় না, কারো মাথায় আকাশও ভেঙে পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশের রবীন্দ্র-মোল্লারা রবীন্দ্রনাথকে রাখতে চান সমস্ত গবেষণা এবং কাটাছেড়ার উর্ধ্বে। বেদ পাঠ করার অপরাধে মহাত্মা রাম যেমন একসময় শিরোচ্ছেদ করেছিলেন নীচু জাতের শম্বুকের তার তথাকথিত ‘রাম রাজ্যে’, ঠিক তেমনি সমস্ত রবীন্দ্রপূজারীরা শিরোচ্ছেদ করার ফতোয়া দিতে চান কারো মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতের সামান্যতম বিচ্যুতি লক্ষ্য করলে। রবীন্দ্রনাথকে যেন রাখতে হবে মাথার পরে একেবারে দেবতার আসনে বসিয়ে, দিবানিশি কেবল পায়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে, আর করজোড়ে স্তব করে। মাকসুদের ফিউশন করার প্রচেষ্টাটি ভাল ফলাফল বয়ে এনেছিলো নাকি খারাপ, সেটি আমাদের প্রশ্ন নয়, তাকে সমালোচিত হতে হয়েছিলো রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কোন রকম নাড়াচাড়া করার চেষ্টার কারণেই। মাকসুদও থেমে থাকেন নি। এর পাল্টা জবাব দিয়েছিলেন তিনিও কলাম লিখে। মাকসুদ বলেছিলেন, ’এদেশ আগে রবীন্দ্রনাথকে বুঝুক তারপর তর্ক করবো। এদেশে এখনো রবীন্দ্র সংগীত মানেই হারমোনিয়াম ধরে প্যা প্যা…. অথচ অবাক বিষয় শান্তিনিকেতনে হারমনিয়াম ঢুকতে পারেনা।’ সচেতন পাঠক হয়তো খেয়াল করেছেন যে বিশ্বভারতী মিউজিক বোর্ডের দেওয়া ‘রবীন্দ্রসংগীতের উপযোগী’ বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় আসলেই হারমোনিয়াম নেই, সেক্ষেত্রে গিটার, কি-বোর্ড, স্যাক্সোফোনের অনুপ্রবেশ তো দূর অস্ত!।
রবীন্দ্রনাথ বাইশ শ’-র উপরে গান লিখেছেন। বাঙালিরা গভীর ভক্তিভরে, সশ্রদ্ধ চিত্তে এগুলোকে শুনে থাকে, গেয়ে থাকে। এর ভাবসম্পদকে আবিষ্কার করা চেষ্টা করে। পরম পূজনীয় ভেবে এর বিশুদ্ধতা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু এরাই জানে না যে, রবীন্দ্রনাথের এই বাইশ শ’ গানের অনেকগুলোই বিশুদ্ধ নয়, রবীন্দ্রনাথের মৌলিক গান নয়। অন্য কোনো গানের সুর থেকে সরাসরি নকল করা বা সেগুলোকে ভেঙে চুরে রবীন্দ্রনাথ নিজের মত করে নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য গান আছে বিদেশী সুর থেকে নেয়া, অনেক গান আছে লোকসংগীত থেকে নেয়া, অনেক গান আছে বাউল সুর থেকে নেয়া। নীচে একটা বিদেশী গান দিচ্ছি। একটা খুব জনপ্রিয় রবীন্দ্র গানের সুর নেয়া হয়েছে এই গানটা থেকে। যাঁরা রবীন্দ্র সংগীত শোনেন, খুব বেশি দেরি হবে না তাঁদের সুরটাকে সনাক্ত করতে। যাঁরা পারবেন না তাঁদের জন্য রবীন্দ্রনাথের গানটাও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার নীচেই।
|
গান -Ye banks and braes (স্কটল্যান্ডের ফোক গান)
|
গান -ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
ইউটিউবেও আছে গান দুটি। শোনা যাক, আর দেখা যাক –
httpv://www.youtube.com/watch?v=OzWsxv0Uae8
Ye banks and braes
httpv://www.youtube.com/watch?v=y57FdECaQss
ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে
পৃথিবীর প্রায় সব বিখ্যাত সাহিত্যিক বা সংগীত স্রষ্টাই অন্যের সৃষ্টি দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়। এতে দোষের কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথও তাঁর ভক্তদের ভাষায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তবে, হুবহু অন্যের সৃষ্টিকে নকল করা অর্থাৎ সরাসরি কুম্ভিলকতা বা চৌর্যবৃত্তি কীভাবে ‘অনুপ্ররেরণা যোগ্য’ হয় সেটা অবশ্য আমরা জানি না। রবীন্দ্রনাথের এই সমস্ত “অনুপ্রাণিত” গানকে ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করা হয়। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের একটা তালিকা করেছিলেন। সেখানে তিনি ২৩৪টি ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। ইন্দিরা দেবীর বক্তব্যকে যদি সত্যি বলে ধরে নেই, তাহলেও দেখা যাচ্ছে যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের এক দশমাংশেরও বেশি অন্যের সৃষ্ট সুর থেকে “অনুপ্রাণিত”। যে রবীন্দ্রনাথে নিজেই অন্যদের সুরকে ভেঙেচুরে বা অবিকলভাবে নকল করেছেন, সেই রবীন্দ্রনাথের অনুসারীদের তাঁর গানকে অবিকৃত রাখা বা বিধিনিষধের বেড়াজাল দিয়ে বিশুদ্ধ রাখার প্রচেষ্টা যে অনুচিত এবং অভব্য কাজ, সেটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না।
রবীন্দ্রনাথ এই রকম অনুপ্রাণিত হতে গিয়ে বহু দেশি-বিদেশি সুরস্রষ্টার সৃষ্ট সম্পদকে নিজে ব্যবহার করেছেন। হিন্দি ছবির কিছু নির্লজ্জ সুরকারেরা যেমন অন্যের সুর বেমালুম ‘আত্মীকরণ’ করেন (প্রীতম যেমন মেরে দিয়েছেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গানের সুর), ব্যাপারটা সেরকমেরই। এঁরা বিগত হয়েছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথের অন্যায় ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা ক্ষেত্রে এই অনুপ্রাণিত হওয়াকে কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সে বিষয়ে যাওয়ার আগে আসুন একটা গান শুনি। এই গানটির সুরকে সনাক্ত করতে, বিশেষ করে বাংলাদেশের কোনো মানুষেরই বিন্দুমাত্র সমস্যা হবার কথা নয়। কারণ, এই সুরটা আমরা অহরহ শুনি, গভীর আবেগে এই সুরের গাওয়া গানটার সাথে গলা মেলাই।
|
গান -আমি কোথায় পাবো তারে
এবার আসুন মূল গানটা শুনি, বহুবার শোনা এবং গীত গান এটি।
|
গান -আমার সোনার বাংলা
অবাক হচ্ছেন, বিস্মিত হচ্ছেন, তাই না? ভাবছেন কার এত বড় দুঃসাহস যে, এরকম করে অবিকল রবীন্দ্রনাথের গানের সুরটাকে, আমাদের জাতীয় সংগীতটাকে নকল করেছে। কিন্তু আপনাদের এই অবাক এবং বিস্ময়ের মাত্রা অনেকগুণ বেড়ে যাবে যখন জানবেন যে আমি কোথায় পাবো তারে এই গান রচিত এবং সুর করা হয়েছিল আমার সোনার বাংলা গানটি রচিত এবং সুর করার অনেক আগে। চাপাবাজি নয়, মিথ্যাচার নয়, সত্যের অপলাপ নয়। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। আমি কোথায় পাবো তারে গানটির রচয়িতা এবং সুরকার একজন হতদরিদ্র ডাক পিওন। গগন হরকরা তাঁর নাম। লালনের সমসাময়িক, কুষ্টিয়ার এক বাউল তিনি। কীভাবে গগন হরকরার সুরকে নিজের নামিয়ে রবীন্দ্রনাথ চালিয়ে দিয়েছিলেন, আসুন সে বিষয়টা দেখি আমরা।
রবীন্দ্রনাথদের পৈত্রিক জমিদারী ছিল কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। ১৮৮৯ সাল থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত জমিদারী দেখাশোনার জন্য এখানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চারপুরুষ ধরে তাঁদের জমিদারীর প্রজাদের উপর পীড়ন চালিয়েছেন জোড়াসাকোর এই ঠাকুর পরিবারটি। তিনিও তাঁর ব্যতিক্রম ছিলেন না। কবি হিসাবে তিনি যত রোমান্টিকই হোন না কেন, বৈষয়িক বিষয়ে তাঁর স্বার্থবুদ্ধি ছিল একেবারে টনটনে। ১৮৯৪ সনে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা আদায়ও করেছিলেন [শচীন্দ্র অধিকারি, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ পৃঃ ১৮, ১১৭]। নতুন জমিদারী ক্রয় করেছিলেন [মার্টিন কোম্পানী থেকে নদীয়ার ডেব্রাকোল ক্রয়]। করবৃদ্ধির ও বলপ্রয়োগে কর আদায়ের ফলে প্রজাবিদ্রোহ ঘটলে তাও তিনি সাফল্যের সঙ্গে দমন করেন। বিশশতকের বিশ দশকে প্রজাপীড়ক শোষক রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে শিলাইদহের ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজার বিদ্রোহ এ সূত্রে উল্লেখ। [অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ, দেশ শারদীয়া, ১৩৮২।]
তাঁর এই বুর্জোয়া, শোষণপ্রিয় মানসিকতার ছাপ পড়েছে তাঁর লেখালেখিতেও। রবীন্দ্রনাথের সীমাহীন রচনাতে সাধারণ মানুষ প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। সামান্য যেটুকু এসেছে, সেটা নিজেকে গরীবের পক্ষের লোক হিসাবে প্রমাণের তাগিদ থেকেই এসেছে, আন্তরিকতা থেকে নয়। আজীবন শোষক হয়ে শোষিতের পক্ষে কলম ধরাটা একটু কষ্টকরই বটে। আহমদ শরীফ তাঁর ‘রবীন্দ্র সাহিত্য ও গণমানব’ প্রবন্ধে লিখেছেনঃ
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরের গভীরে প্রোথিত সামন্ত-বেণে-বুর্জোয়াচেতনা ও স্বার্থবোধ শেষাবধি পরিহার করতে সমর্থ হননি। একজন কারখানা মালিক যেমন তার শ্রমিকদের দাবি আদায়ের মিছিলে সামিল হতে পারে না, সামন্ত বেণে-বুর্জোয়া-জমিদার রবীন্দ্রনাথও তেমনি পারেননি দুস্থ-দুঃখী-চাষী-মজুরের শোষণ-পীড়ণ জর্জরিত জীবনের আলেখ্য আঁকতে। এ হচ্ছে শ্রেণীক ও ব্যক্তিক স্বার্থ চেতনার বন্ধন। নইলে যে রবীন্দ্রনাথ প্রমত্তা পদ্মায় জেলে-মাঝিকে ডুবে মরতে দেখেছেন, পদ্মার যমুনার তীর ভাঙনে হাজার হাজার গরিব চাষী-মজুরকে নিঃস্ব হতে উদ্বাস্তু হতে দেখেছেন, দেখেছেন স্বচ্ছল চাষীকে সপরিবারে পথে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতে, প্রত্যক্ষ করেছেন দুর্ভিক্ষে অনাহারে-অপুষ্টিতে-তুচ্ছ রোগে ভুগে ভুগে অকালে অপমৃত্যু কবলিত হতে হাজার হাজার নিঃস্ব-নিরন্ন-নিরক্ষর-নির্বিরোধ মানুষকে। আরো দেখেছেন তাঁরই হুকুমে বা সম্মতিতে তাঁরই গোমস্তাদের খাজনার দায়ে তাঁরই গরিব প্রজার ঘটি-বাটি ক্রোক করতে, প্রজাকে ভিটে-ছাড়া করতে, বারবার দেখেছেন ঝড়-খরা-বন্যা তাড়িতি মানুষের চরম দুঃখ-দুর্দশা ও অপমৃত্যু – সেই রবীন্দ্রনাথের বিপুল-বিচিত্র রচনায় এদের নাম-নিশানা মাত্র নেই কেন! বোঝা গেল, শোষক তিনি যত বড়ো মহাপুরুষই হোন, শোষিতের পক্ষে লড়াই দূরে থাক, তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশেও অনীহ।
শুধু সহানুভূতি প্রকাশে অনিচ্ছুকই নয়, নিজেদের শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন তিনি। ফলে, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। জমিদারী প্রথা যে প্রজা মঙ্গলের জন্য উত্তম সেটাকেই বিশ্বাস করতেন তিনি। সেকারণেই বলেছেন, “জমিদারী উঠে গেলে গাঁয়ের লোকেরা জমি নিয়ে লাঠালাঠি কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে। [প্রমথ চোধুরী – রায়তের কথা]
রবীন্দ্রনাথের প্রজা পীড়নের কাহিনি কিছুটা জানা যায় আহমদ শরীফের রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধে। রবীন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ন সম্পর্কে জানার জন্য তিনি তাঁর ছাত্র আবুল আহসান চৌধুরীকে চিঠি লিখে তথ্য সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। আহমদ শরীফের চিঠির উত্তরে আবুল আহসান চৌধুরী এ বিষয়ে নানা তথ্য দিয়ে একটা পত্র লেখেন। আহমদ শরীফ তাঁর প্রবন্ধের তথ্য নির্দেশ অংশে সেই চিঠিটা হুবহু প্রকাশ করেছিলেন। সেই চিঠিটা এরকমঃ
শ্রদ্ধাভাজনেষু
স্যার, সালাম জানবেন। অসুস্থতার জন্যে আপনার চিঠির জবাব দিতে কয়েকদিন দেরী হলো। অনুগ্রহ করে মাফ করবেন আমাকে।
ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকার কোন বর্ষ কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমার সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে গ্রামবার্তার যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। প্রজাপীড়নের এই সংবাদ-সূত্রটি পাওয়া যায় কাঙাল-শিষ্য ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র একটি প্রবন্ধে। কাঙালের মৃত্যুর পর অক্ষয় কুমারের এই প্রবন্ধটি সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রবন্ধে মৈত্রেয়বাবু কাঙাল হরিনাথের সংবাদপত্র পরিচালনায় সততা ও সাহসের পরিচয় প্রসঙ্গে প্রজাপীড়নের সংবাদ ‘গ্রামবার্তায়’ প্রকাশের উল্লেখ করেন। ঠাকুর-জমিদারদের অত্যাচার সম্পর্কে হরিনাথ নিজে অক্ষয়কুমারকে যে পত্র লেখেন, তিনি এই প্রবন্ধে তা উদ্ধৃত করে দেন। এই প্রবন্ধ প্রকাশের ফলে রবীন্দ্রনাথ বিশেষ রুষ্ট ও অপ্রসন্ন হন এবং তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায়কে বলে অক্ষয়কুমারের ‘রানী ভবানী’ গ্রন্থপ্রকাশের অর্থ-সাহায্যের প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করান। কাঙাল-পুত্র সতীশচন্দ্র মজুমদার সূত্রে জানা যায়, ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ-প্রকাশের অপরাধে (?) তাঁরা লাঠিয়াল-গুণ্ডা লাগিয়ে কাঙালকে শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এইসব ঘটনা ঠাকুর জমিদারীর ইতিহাসের দুঃখজনক কালো অধ্যায়।
এ ছাড়া অন্যত্র যেমন মীর মশাররফ হোসেন সম্পাদিত ‘হিতকরী’ পত্রিকায়, ঠাকুর-জমিদাররা যে প্রজাসাধারণের দুঃখ-কষ্ট মোচনে তেমন তৎপর ও মনোযোগী ছিলেন না তার ইঙ্গিত আছে। ঠাকুরবাবুরা তাঁদের জমিদারী এলাকায় গো-কোরবানী নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং এই নির্দেশ অমান্যকারীদের নানাভাবে নিগৃহীত হতে হয়। শিলাইদহ ঠাকুর-জমিদারীর এই ভূস্বামী-স্বার্থরক্ষার কৌশল-ব্যবস্থা ও প্রজাপীড়নের ঐতিহ্য চারপুরুষের, দ্বারকানাথ থেকে সুরেন্দ্রনাথ পর্যন্ত। কাঙাল হরিনাথের দিনলিপিতেও এর ইঙ্গিত মেলে।
শিলাইদহ জমিদারীতে রবীন্দ্রনাথের আমলেও কিছু অবাঞ্ছিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। চরের মুসলমান প্রজাদের ঢিঢ করবার জন্যে নমঃশুদ্র প্রজা এনে বসতি স্থাপনের সাম্রদায়িক-বুদ্ধিও রবীন্দ্রনাথের মাথা থেকেই বেরিয়েছিল। এ-ছাড়া পুত্র রথীন্দ্রনাথের নিরীক্ষামূলক শখের কৃষি-খামারের প্রয়োজনে গরীব মুসলমান চাষীর ভিটেমাটি দখল করে তার পরিবর্তে তাকে চরের জমি বরাদ্দের মহানুভবতাও রবীন্দ্রনাথ প্রদর্শন করেছিলেন। এ-সব কথা ও কাহিনী উক্ত জীবনীকারদের যত্ন ও সৌজন্যে চাপা পড়ে গেছে। সত্য ইতিহাসকে তুলে ধরতে গেলে অনেককেই হয়তো সাম্প্রদায়িক বা রবীন্দ্র-বিদ্বেষী শিরোপা, নয়তো সুভো ঠাকুরের (বিস্মৃতিচারণার প্রতিক্রিয়া দ্রষ্টব্য) মতো ধিক্কার ও তিরস্কার অর্জন করতে হবে।
ঠাকুর-জমিদারদের প্রজা-পীড়নের বিষয়ে আমি রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের জীবনের নিপুণ ভাষ্যকার শ্রীশচীন্দ্রনাথ অধিকারীকে (তিনি নিজে শিলাইদহবাসী ও ঠাকুর-এস্টেটের কর্মচারী ছিলেন এবং এই বিষয়গুলো জানতেন) চিঠিপত্রে নানা প্রশ্ন করে ছিলাম। তিনি এ-সব জিজ্ঞাসার জবাব এড়িয়ে ও অস্বীকার করে এই ধরণের কৌতুহলকে রবীন্দ্র-বিদ্বেষী বলে অভিহিত করেছিলেন।
উপরি-বর্ণিত বিষয়গুলোর কিছু কিছু তথ্য আমার সংগ্রহে আছে। আপনার প্রয়োজন হলে সেগুলো পাঠাতে পারি। আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রইলাম। এই বিষয়ে আপনি কোন প্রবন্ধ লিখেছেন কী না জানিয়ে বাধিত করবেন। আমার গবেষণার কাজ (‘মীর মশাররফ হোসেনের শিল্পকর্ম ও সমাজচিন্তা’) চালিয়ে যাচ্ছি। এ বছরের মধ্যে থিসিস জমা দেবো এমন আশা আছে। আমার লেখার কাজে আপনার প্রশ্রয় ও প্রেরণার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আপনার জবার প্রত্যাশায় রইলাম। আন্তরিক শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে শেষ করি।
স্নেহসিক্ত,
আবুল আহসান চৌধুরী
এই শিলাইদহ, শাহজাদপুরে জমিদারী দেখাশোনা করতে গিয়েই বাউলদের সংস্পর্শে আসেন রবীন্দ্রনাথ। বাউলদের গান শুনে সেগুলোর ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। শুধু মুগ্ধই নন, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল গানের সুর রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের গানের মধ্যে নিয়ে আসেন। তাঁর নিজের ভাষাতেই :
আমার লেখা যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন বাউল-পদাবলীর প্রতি আমার অনুরাগ আমি অনেক লেখায় প্রকাশ করেছি। শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখা-সাক্ষাৎ আলাপ আলোচনা হত। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি। এবং অনেক গানে অন্য রাগ-রাগিনীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল-সুরের মিল ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে, বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময় আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। (শান্তিদেব ঘোষ- রবীন্দ্রসংগীত)
এখানেই গগন হরকরার সাথে পরিচয় ঘটে রবীন্দ্রনাথের। গগন হরকরার জন্ম শিলাইদহের আড়পাড়া গ্রামে। কাজ করতেন ডাক বিভাগে ডাক হরকরা হিসাবে। তিনি একজন বিশিষ্ট বাউল গীতিকার ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ প্রায়শই গগন হরকরাকে কাছারিতে ডেকে নিয়ে আসতেন গান শোনার জন্য। গগন হরকরাও সানন্দে গান শুনিয়ে যেতেন তাঁদের জমিদারবাবুকে। গ্রামের এই সহজ সরল বাউল তখনও ভাবেন নি জমিদারবাবুর মনের মধ্যে কী রয়েছে। গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গানটার অনুকরণে রবীন্দ্রনাথ কবিতা লেখেন আমার সোনার বাংলা বলে। এই অবিশ্বাস্য কথাটা যাঁদের বিশ্বাস হচ্ছে না, তাঁদের জন্য গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারের গীতি কবিতাটা এখানে তুলে দিচ্ছি, সেই সাথে আমার সোনার বাংলার গীতিও। আপনারা মিলিয়ে দেখতে পারেন।
আমি কোথায় পাব তারে
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে –
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগৎ সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে –
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে –
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে –
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত
আমার সোনার বাংলা
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে
ঘ্রাণে পাগল করে–
(মরি হায়, হায় রে)
ও মা, অঘ্রাণে তোর ভরা খেতে,
(আমি) কি দেখেছি মধুর হাসি।।
কী শোভা, কী ছায়া গো,
কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ
বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।।
মা তোর মুখের বাণী
আমার কানে লাগে
সুধার মতো–
(মরি হায়, হায় রে)
মা, তোর বদনখানি মলিন হলে
আমি নয়ন জলে ভাসি।।
শুধু এই গানের কাঠামো অনুসরণে কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হন নি তিনি। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় আমার সোনার বাংলাতে হুবহু গগন হরকরার সৃষ্ট সুর বসিয়ে দেন। আমাদের জানামতে গগন হরকরা সেই সময় জীবিত থাকার পরেও তাঁর কাছ থেকে অনুমতি নেওয়া বা তাঁকে জানানোর প্রয়োজনটুকুও তিনি বোধ করেন নি। এ যেন তাঁর নিজের লিখিত দুই বিঘা জমির সেই জমিদারের মত। রাজা হয়েও ‘যার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি’। এত বড় একজন কবি এবং সংগীতকার হয়েও গ্রামের একজন দরিদ্র ব্যক্তির মেধাপ্রসূত সম্পদকে চুরি করতে তাঁর বিন্দুমাত্রও বাধে নি। যোগাযোগের অপ্রতুলতা এবং এখনকার মত তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেই সময়ে না থাকার কারণে কারো পক্ষেই এত বড় একটা চুরি ধরা সম্ভবপর হয় নি। পরে যখন বিষয়টা জানা গেছে, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। এর মধ্যেই রবীন্দ্রনাথ পরিণত হয়ে গিয়েছেন মহাকাশস্পর্শী এক মহীরুহে। তাঁর বিশাল এক স্তাবকবাহিনী তৈরি হয়ে গিয়েছে। এই স্তাবকবাহিনী তাঁদের পূজনীয় ঠাকুরকে বাঁচানোর জন্য গালভরা এক শব্দ ‘অনুপ্রেরণা’কে বেছে নিয়েছেন, ভাঙা গানের ভরাট ঢালের আড়ালে অত্যন্ত সুকৌশলে নিয়ে গিয়েছেন শতাব্দীর সেরা চৌর্যবৃত্তিকে।
রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যের অনেক কিছুই মৌলিক নয়, বরং বলা যায় বিদেশী সাহিত্যের ছায়া-অবলম্বনে লেখা । যেমন, গবেষক প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস তার লেখা ‘রবীন্দ্রনাথের রহস্য গল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ নামের একটি বইয়ে বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের চারটি অতি পরিচিত গল্প -যেমন মহামায়া, গুপ্তধন, নিশীথে, এবং সম্পত্তি সমর্পণ – বিখ্যাত মার্কিন রহস্য গল্পলেখক এডগার অ্যালান পো’র সে সময়কার চারটি গল্প থেকে ‘অনুপ্রাণিত’। ফরাসি লেখক তেওফিল গতিয়ের লেখা Le Pied de Mome (১৮৬৬) গল্পের প্রভাব আছে তার বিখ্যাত গল্প ক্ষুধিত পাষাণের ওপর; আর রক্তকরবীর ওপর আছে সুইডিশ নাট্যকার অগাস্ট স্ট্রিণ্ডবার্গের ‘A Dream Play’-এর ছাপ [প্রতাপনারায়ণ বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী : তত্ত্ব ও তথ্য, অনুষ্টুপ, ১৯৮৯]। কিন্তু এগুলোর ক্ষেত্রে কেবল ‘বিদেশী গল্পের ছায়া’ থাকায় সরাসরি প্লেইজারিজমের অভিযোগ থেকে না হয় তাকে অব্যাহতি দেয়া যায়, কিন্তু হতদরিদ্র গগন হরকরার সাথে জমিদারবাবু যা করেছিলেন তার কোন তুলনা নেই। ২০০৬ সালে বিবিসি সর্বকালের সেরা বাংলা গান কোনটি তাঁর একটি জরিপ চালিয়েছিল। সেই জরিপে বিপুল ভোট পেয়ে সেরা গান হয়েছিল আমার সোনার বাংলা। অথচ কী আশ্চর্য! সর্বকালের সেরা গানের সুরস্রষ্টা গগন হরকরাকে আমরা চিনি-ই না, চিনি একজন কুম্ভিলক রবীন্দ্রনাথকে। এর চেয়ে দুঃখজনক বিষয় আর কী হতে পারে। এই গানটা আবার আমাদের জাতীয় সংগীতও। শত শত বছর ধরে এটা গাওয়া হবে, অনাগত দিনের বাংলাদেশিরা সকৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করবে রবীন্দ্রনাথ নামের একজন মহান কবি এবং সংগীতকারকে, এরকম একটি অসাধারণ শ্রুতিমধুর গানকে সৃষ্টি করার জন্য। এর পিছনের বঞ্চনার ইতিহাস, চুরির ইতিহাস ঢাকা পড়ে যাবে অন্ধ পূজারীদের পরম মিথ্যায় এবং রবির কিরণের তীব্র কষাঘাতে। বেচারা গগন হরকরা। তাঁর সৃষ্ট সম্পদ অন্যে চুরি করেছে বলে যে হতাশামাখানো দীর্ঘশ্বাসটুকু ফেলবেন, তাঁর সুযোগও নেই। জানতেই পারেন নি যে, নিজের অজান্তেই সর্বকালের সেরা বাংলা গানের সুর সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন তিনি। আর সেই অনন্য সুরটাকে নির্দ্বিধায় মেরে দিয়েছিল, তাঁর গানের কথাকে অনুকরণ করে কবিতা লিখেছিল, তাঁদেরই গানপাগলা জোড়াসাঁকোর জমিদারবাবু ছোটো ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথ এই ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন প্রায় সত্তর বছর আগে। তাঁকে নিয়ে যে অনন্ত আবেগ তৈরি হয়েছিল, সেই আবেগকে অতিক্রম করার জন্য যথেষ্ট সময় এটি। তারপরেও সেই আবেগ যায় নি। তবে, একেবারে না গেলেও কমে আসছে ঠিকই। দ্রুতগতিতে না হলেও তাঁর ভক্ত অনুরক্তের সংখ্যা দিন দিন কমছে। এমন একদিন আসবে যখন তাঁর ভক্ত, স্তাবক বলতে কেউ-ই থাকবে না। তখন নতুন প্রজন্মের মানুষ নতুনভাবে রবীন্দ্র মূল্যায়ন করতে পারবে। সেই মূল্যায়ন হবে নিরপেক্ষ। ভাল মন্দ কোনো ধরনের তথ্যকেই চেপে রাখবে না নতুন মানুষেরা। অনাসক্ত এবং অভ্রভেদী নির্মোহ দৃষ্টিতে বিচার করবে সবকিছুকে। কোনো তথ্যকেই আবেগের রসে রসসিক্ত করে বিকৃত করার চেষ্টা করবে না তারা। সেই দিন শুধু আমাদের জন্যই নয়, রবীন্দ্রনাথের জন্যও শুভ হব্ মঙ্গলময় হবে। আসল রবি ঠাকুরকে চেনা হবে তখন। সম্মানিত করা হবে প্রকৃত মানুষটিকে, তাঁর সঠিক সৃষ্টিকে।
পশ্চিমা বিশ্বে অ্যারিস্টটলেরও একসময় এরকমই অনেকটা দেবতার আসন ছিলো। তাঁর চিন্তা ভাবনা, দর্শন নীতি সব কিছুকেই মানুষ বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে নিতো। সমাজে তার প্রতিপত্তি ছিলো বিশাল, অনুরাগীর সংখ্যাও ছিলো বিপুল। তার বাণী সমাজে গৃহীত হতো অনেকটা যেন ‘ঈশ্বরের বাণী’র মতোই। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে চারটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে, মাটি, বায়ু, আগুন এবং পানি দিয়ে, অতএব সেটাই ঠিক। অ্যারিস্টটল ভেবেছিলেন, সূর্যই পৃথিবীর চারিদিকে ঘরে। অতএব সেটাই হতে হবে ঠিক। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন, ভারী বস্তু আর হাল্কা বস্তু উপর থেকে ছেড়ে দিলে সব সময় ভারী বস্তুই নীচে পড়বে। অতএব সেটাকেই ঠিক হতে হবে। ঠিক ঠিক ঠিক!
কিন্তু জামানা বদলায়। দেবতারও পতন হয়। বিশেষতঃ গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীদের হাত ধরে পর্যবেক্ষণমূলক পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নের সাথে সাথে মানুষ বুঝতে পারলো অ্যারিস্টটলের অনেক কথাই আসলে ভ্রান্ত। তার চিন্তা চেতনা পশ্চাৎগামী, তার বহু ভাবনা অবৈজ্ঞানিক শুধু নয় রীতিমত হাস্যকর। আসলে জ্ঞান বিজ্ঞান যত এগিয়েছে ততই কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বে প্লেটো এবং এরিস্টটলের ভুতকে ঘার থেকে নামিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার প্রয়োজন পড়েছিলো। বার্ট্রান্ড রাসেল তার হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলোসফি গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘Almost every serious intellectual advance has had to begin with an attack on some Aristotelian doctrine; in logic, this is still true at the present day”। অর্থাৎ, সহজভাবে বললে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস আসলে এরিস্টটলকে হটানোরই ইতিহাস। সমালোচকেরা চাঁছাছোলা ভাবেই বলেছিলেন – ‘এরিস্টটল আসলে যা শিখিয়েছিলেন, তা সবই ছিলো ভুল’। এ ধরণের তীক্ষ্ণ সমালোচনা করতেও দ্বিধান্বিত হননি পাশ্চাত্যের সমালোচকরা এরিস্টটলকে নিয়ে। অ্যারিস্টটলের মতো ব্যক্তিত্বকে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন বলেই সভ্যতা এগুতে পেরেছে।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও এটি করা দরকার। আমাদের এগোনোর স্বার্থেই এটি দরকার। সেজন্যই মুক্তমনা লেখকদের সংকলন ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’র (চারদিক, ২০০৮) ভূমিকার একটি অংশে লেখা হয়েছিলো –
‘চিন্তার দাসত্ব’-এর ক্ষেত্রে কেবল মৌলবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য তা ভেবে নিলে কিন্তু ভুল হবে। ভ্রান্ত চিন্তা, কুপমুন্ডুকতা আর অন্ধবিশ্বাস কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আজকের বাংলাদেশের তথাকথিত প্রগতিশীল নামধারী বুদ্ধিজীবী সমাজকেও। কার্ল মার্ক্স, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রী রামকৃষ্ণ, মাদার টেরেসা, শেখ মুজিবুর রহমান, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ বড় বড় নামগুলো তৈরী করেছে ইতিমধ্যেই তৈরী করে ফেলেছে কিছু অযাচিত মিথ; জন্ম দিয়েছে শত সহস্র স্তাবকের। এ সমস্ত মনীষীদের আনেকেই অনেক ক্ষেত্রেই প্রগতিশীল চিন্তা করেছেন সত্যি, কিন্তু সেই সাথে আবার তৈরী করেছে কিছু অন্ধবিশ্বাসীদের যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের বাণী মানেই অভ্রান্ত সত্যি। তাদের ‘আরাধ্য দেবতাদের’ ন্যুনতম সমালোচনাও তাদের কাছে অসহনীয়। গনহিস্টিরিয়াগ্রস্ত এ সমস্ত স্তাবকদল বোঝে না যে, যুক্তির কাছে ‘ব্যক্তিপূজা’র প্রাবল্য অর্থহীন। রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রহ্মের অস্তিত্ব। শুধু দার্শনিক চিন্তার ক্ষেত্রেই নয়, কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথ ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকদের প্রশস্তি করেছেন, ভেবে নিয়েছেন ব্রিটিশ শাসন ছাড়া ভারতবাসীর মুক্তি অসম্ভব। আবার কখনও বা নারী স্বাধীনতা ও নারী মুক্তিকে অস্বীকার করে বলেছেন, ‘প্রকৃতি বলে দিচ্ছে যে, বাইরের কাজ মেয়েরা করতে পারবে না।’এধরনের বিশ্বাস কিংবা মন্তব্যগুলোর কোনটিই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের অভ্রান্ততা তুলে ধরে না, বরং প্রমাণ করে যে চিন্তা-চেতনায় রবীন্দ্রনাথেরও সীমাবদ্ধতা ছিলো। একজন প্রকৃত যুক্তিবাদীর দায়িত্ব হচ্ছে ব্যক্তি পূজার উর্ধ্বে উঠে নির্মোহ দৃষ্টিতে ব্যক্তি, সমাজ ও সভ্যতাকে বিশ্লেষণ করা।
হ্যা, বল্গাহীন আবেগে আর লাগাতার রবীন্দ্র স্তবে গা ভাসিয়ে দিয়ে আত্মহারা না হয়ে বরং রবীন্দ্রনাথের পুরোটুকু জানাটাই বেশি জরুরি। তার ভুলগুলো জানাটা, জানানোটা, স্পষ্ট সমালোচনা করাটা তাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আমাদের সময়ে। যারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নারীস্বাধীনতার অগ্রদূত, তাদের দেখানো দরকার নারীদের নিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কুৎসিৎতম একটি প্রবন্ধ ‘রমা বাঈ এর বক্তৃতা উপলক্ষে’ শিরোনামে, যেখানে তিনি প্রকৃতির দোহাই পেড়ে নারীদের ঘরে অবরুদ্ধে রাখতে চেয়েছেন, আর ভদ্র ভাষায় ওয়ার্কিং ওম্যানদের গালাগালি করেছেন। যারা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দারুণ বিজ্ঞানমনস্ক, আইনস্টাইনের চেয়েও বিজ্ঞান ভাল বুঝতেন, তাদের দেখানো দরকার রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে কীভাবে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করেছেন, কিভাবে হোমিওপ্যাথির মত অপবিজ্ঞানকে শুধু বিশ্বাসই করেননি, নিজেও হাতুরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন। তার চেয়েও বড় কথা, নিজের বিবেক বুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে প্রমথনাথ কিংবা গগন হরকরার মেধাসত্ত্ব লোপাট করেছেন, অনুভব করেননি কোন বিবেকের দংশন। এ ব্যাপারগুলো জানা দরকার। আমরা মনে করি, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তৈরি হওয়া অর্ধসত্য এবং অতিকথন নয়, পুরো সত্যটি জানলেই ভক্তদের তৈরি কৃত্রিম প্রাসাদ ছেড়ে তিনি ফিরে আসবেন তাঁর নিজস্ব আলয়ে। সঠিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবেন তিনি সেদিন। আহমদ শরীফকে দিয়ে শেষ করি এই প্রবন্ধ-
রবীন্দ্রনাথসম্পৃক্ত আবেগের কাল অপগত। এখনো যাঁরা আবেগে, ভক্তিতে, শ্রদ্ধায় কিংবা গৌরবে গর্বে অভিভূত, রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে বৈষ্ণবসূলভ আবেগে-ভক্তিতে বিগলিত হন, রবীন্দ্রত্রুটি কেউ উচ্চারণ করলেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন, তাদের মন-বুদ্ধি, রুচি-চিন্তা-চেতনা-বিবেক-বিবেচনার পরিপক্কতায় আস্থা রাখা সম্ভব হয় না। আজ আত্মকল্যাণেই, আত্মবিকাশের ও প্রগতির প্রয়োজনেই ব্যক্তি নিরপেক্ষ ও অনাসক্ত মন নিয়ে যুক্তি-বুদ্ধি-চিন্তা-চেতনা প্রয়োগে সমাজ-সদস্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের মন-মেজাজ, সামাজিক-নৈতিক কর্ম ও আচরণ, বিশ্বাস-সংস্কার চালিত রুচি ও স্বভাব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ যোগে জানতে ও বুঝতে হবে। (রবীন্দ্র সাহিত্য ও গণমানব)
:line:
প্রাসঙ্গিক লিঙ্ক :
Tagore without Illusion -Mukto-Mona Archive
এ লেখাটি বিডিআর্টসের পাতায়ও প্রকাশিত হয়েছিল, এবং সেখানেও অবধারিতভাবে কুলদা হাজির ছিলেন। তবে তার মন্তব্যের চেয়ে ফাহিম এবং কামরুজ্জামান জাহাঙ্গির সহ অনেকের মন্তব্যই খুব তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল। সেখানে আমি (আর ফরিদ ভাই) যে উত্তর দিয়েছিলাম সেটা এখানেও তুলে রাখছি –
:line:
প্রথমেই সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি যারা লেখাটি পড়েছেন এবং মন্তব্য করেছেন। আমাদের এই প্রবন্ধটিকে ঘিরে যে পক্ষে বিপক্ষে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে সেটা শুভ লক্ষণ। আমাদের সংস্কৃতিতে এ ধরণের বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা একরকম দুর্লভই বটে। একদিকে মৌলবাদী ধর্মান্ধদের সাম্প্রদায়িক দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের বিদ্বেষ যেমন আছে, তেমনি আবার রয়েছে ‘প্রগতিশীলতার’ তকমা-ধারিদের রবীন্দ্রনাথের আগা গোঁড়া সব কিছু নির্লজ্জভাবে সমর্থন করার বাতিক। রইসউদ্দিন আরিফ তার উপমহাদেশে ধর্ম, রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা বইয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন–রবীন্দ্রনাথের অবস্থান আমাদের সংস্কৃতির আকাশে এক কথায় অনন্য। কিন্তু তা বলে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ও দর্শনের যে কোন ভুল ত্রুটি রাহাজানি সবকিছুই নির্লজ্জ ভাবে সমর্থন করতে হবে, এই ধারণাও এক ধরনের মৌলবাদ। কুলদা রায় সহ কিছু মন্তব্যকারীর মন্তব্যে সেই ধরনের মৌলবাদিতার ছাপ স্পষ্ট। যাহোক, পাঠকদের মতামতের উপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি মন্তব্যকারীদের মন্তব্য সম্বন্ধে দু-চার কথা বলতে মনস্থ করেছি।
[বিডিআর্টসে] ফাহিমের মন্তব্যটি তাৎপর্যপূর্ণ এবং চিন্তার উদ্রেককারী। কিন্তু একটি ছোট তথ্যগত ভ্রান্তি আছে (কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার মন্তব্যে এর কিছুটা সংশোধন দিয়েছেন যদিও) । ফাহিম বলেছেন যে, “তিনি সিপাহী বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, ওহাবী বিদ্রোহ, দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহ, কোল বিদ্রোহ সবই দেখেছিলেন অথচ সেই সব মহাবিদ্রোহ নিয়ে একটি লাইনও লেখেন নাই।” উক্তিটির মূলভাবটি সত্য, কিন্তু এটি মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের চার বছর পরে। সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছিলো ১৮৫৭ সালে আর রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে। কাজেই আক্ষরিক অর্থে ধরলে রবীন্দ্রনাথ সিপাহী বিদ্রোহ দেখেননি। কিন্তু না দেখলেও তিনি সিপাহী বিদ্রোহের ঘূর্ণিঝড় বুকে ধারণ করেই বড় হয়েছেন। এটি ছিলো মূলতঃ ভারতবর্ষের জনসাধারণের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম, ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা অবশ্য এর নাম দিয়েছেন ‘সিপাহী বিদ্রোহ’। কিন্তু এ কেবল সিপাহীদের একেলার বিদ্রোহ ছিল না, বরং পলাশীর যুদ্ধের একশত বছর পরে সংগঠিত হওয়া এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো ইংরেজদের অত্যাচারে অবিভক্ত বাংলা ও ভারতের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতিরাই। এমনকি সংগ্রামের নেতৃত্বে সিপাহীরাও ছিলো সেই সব গরীব খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিক আর তাঁতিদেরই সন্তান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও রবীন্দ্রনাথের লেখায় বিদ্রোহ নিয়ে কোনো উচ্ছ্বাস বা আগ্রহ কখনোই পরিলক্ষিত হয়নি। ১৮৫৭ সালে ঘটে যাওয়া বড় ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কখনোই তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি; বিশাল রবীন্দ্রসাহিত্যে এটি প্রায় অনুল্লেখ্যই থেকে গেছে। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর তার মন্তব্যে ‘মিউটিনি’র কথাটি বলেছেন। এটি সত্য। গোরা উপন্যাসে (১৯০৯) খুব প্রচ্ছন্নভাবে একে ‘মিউটিনি’ হিসেবে উল্লেখ করলেও (ব্রিটিশ রাজ প্রবর্তিত এবং প্রচারিত এই শব্দটির ব্যবহার তার অন্য দু একটি গল্প বা প্রবন্ধেও পাওয়া যায় যেমন, ‘পয়সার লাঞ্ছনা’ কিংবা ‘আবদারের আইন’ ইত্যাদি), তা মূলতঃ নেতিবাচক ভাবে কিংবা বড়জোর নিস্পৃহভাবে ব্যবহার করেছেন। যেমন গোরা উপন্যাসে আমরা দেখি, রবীন্দ্রনাথ গোরার জন্ম পরিচয় জানানোর জন্য কৃষ্ণদয়ালের মুখ দিয়ে ‘মিউটিনি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত ভাবলেশবিহীনভাবে। কৃষ্ণদয়াল বলছে:
এ যেন অনেকটা একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কে ভুল করে কেউ কেউ ‘গণ্ডগোলের সময়’ বলে ফেলে, অনেকটা সেরকমের। ‘পয়সার লাঞ্ছনা’তে মিউটিনির ব্যবহার আরো মারাত্মক, ইচ্ছাকৃত, আরো ব্যঙ্গাত্মক:
তার কাছে সিপাহী বিদ্রোহর মতো উন্মাতাল বিদ্রোহগুলো যেন তার কাছে কাজ ফেলে ‘মিউটিনি করা’ কিংবা ‘স্টেটস্ম্যান কাগজে একটা বেনামি পত্র’ লেখার সমতুল্য। এটি বলা দরকার যে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের পর থেকে ১৯০০ সাল অবধি ভারতে ১৪টি কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল তার মধ্যে ছয়টি ছিল বাংলা ও আসাম অঞ্চলের। নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের কৃষক শ্রমিকদের উপর লাগাতার ইংরেজ শোষণ আর নিপীড়ন কিছু নিজ চোখেও দেখেছিলেন, প্রান্তিক প্রজাদের উপর নিপীড়ন এবং নির্যাতনের কিছু খবর, তাদের ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদতে কাঁদতে’ নিশ্চয় জমিদারবাড়ির অচলায়তন ভেদ করে কখনো সখনো ভেদ করে তার কানেও পৌঁছাত। ১৮৬২ সাল থেকে আঠারো শতকের শেষভাগে নীলচাষীদের উপর যখন নীলকরদের অমানুষিক অত্যাচার চলছিলো ইংরেজ শাসকদের অকুণ্ঠ সমর্থনে, কিংবা আঠারো শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতকের প্রথম পর্যন্ত দক্ষিণ মালাবারে তালুকের খাজনা নিয়ে মামলা, হিন্দু চাষিদের নানা দুর্ভোগের কথা–এগুলো কোনোটাই তার অবিদিত থাকার কথা নয়। না জানার কথা নয় ১৮৭৫ সালে ঘটে যাওয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাক্ষিণাত্যের বিশাল কৃষক বিদ্রোহের কথা কিংবা ১৯০০ সালের দিকে ঘটা মুণ্ডা বিদ্রোহ এবং টিকেন্দ্র সিং-এর নেতৃত্বে মণিপুর বিদ্রোহের কথা, আর সেই বিদ্রোহগুলো দমনের জন্য ইংরেজদের পাইক পেয়াদা লাগিয়ে এবং বিদ্রোহীদের ধরে ধরে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে নির্মমভাবে বিদ্রোহ দমনের ইতিবৃত্ত। আর ঊনবিংশ শতকের শুরু থেকে আমৃত্যু বিভিন্ন ইংরেজ-বিরোধী নরম এবং চরমপন্থি সংগ্রামী ঐতিহ্যের তো ছিলেন চলমান সাক্ষী। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, রবীন্দ্র সাহিত্যে সেদিকগুলো তেমনিভাবে প্রতিফলিত হয়নি। তার পরবর্তীকালের সাহিত্যগুলোতে বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ সংগ্রামের প্রতি বিরাগ আরও স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়েছে। তার ঘরে বাইরে (১৯১৪) এবং চার অধ্যায় (১৯৩৪) তারই বলিষ্ঠ প্রমাণ। আরও একটি দৃষ্টান্ত হল ১৯৩১ সালে প্রকাশিত কলকাতার উন্নাসিক মাসিক [প্রথমে ত্রৈমাসিক] সাহিত্যপত্র পরিচয়। সেখানে সমকালীন গান্ধী-পন্থী জাতীয়তাবাদ এমনকি কৃষক আন্দোলন সম্বন্ধেও রবীন্দ্রনাথের নানা অনীহা প্রকাশিত হয়েছে। পথ ও পাথেয় আর পূর্ব পশ্চিম (১৯০৮)-এর মত প্রবন্ধগুলো তো বিপ্লবীদের প্রতি রীতিমত অবমাননাসূচক। এমনকি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে শান্তিকামী ‘আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব’ হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় তাও মুখ থুবড়ে পড়ে ১৯২৬ সালে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনীর সরকারী আপ্যায়নে রবিঠাকুরের ইতালি ভ্রমণ পর্যালোচনা করলে। সেখানে তিনি মুসোলিনীকে দেখে অভিভূত হয়ে তার দেহ ও আত্মা যেন ‘মাইকেল এঞ্জেলোর বাটালি দিয়ে খোদাই করা’ বলে স্তব করেছিলেন। তিনি সে সময় মুসোলিনীকে তুলনা করেছিলেন আলেকজান্ডার এবং নেপোলিয়নের মত বীরদের সাথে। মুশকিল হচ্ছে এগুলো বললেই রবীন্দ্র-বিদ্বেষী খেতাব পেতে হবে–যা কুলদা রায় ভজন সরকার প্রমুখেরা দেয়ার চেষ্টা করেছেন উপরে। হিটলার ছাড়া মুসোলিনীর তুলনীয় ফ্যাসিস্ট এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী নেতা কেউ ছিলো না সে সময় পৃথিবীতে, অথচ রবীন্দ্রনাথের চোখে তিনি ছিলেন উদার, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সবার জন্য অনুসরণীয় একজন আদর্শ নেতা।
নয়ন মজুমদারের মন্তব্যটি আরও মজার। তিনি জিগ্যেস করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে গগন হরকারের গানের সুর চুরি করেছেন তা আপনি কোথা থেকে জানলেন?
ওয়েল, ভদ্রলোকের নামটি গগন হরকার নয়, গগন হরকরা। আর প্রশ্নটি যেন ‘সাত কাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা কার বাপ’-এর মতো অবস্থা। আমাদের লেখাটিতেই তো এর অসংখ্য প্রমাণ আছে। গগন হরকরার আমি কোথায় পাবো তারে গানের ইস্নিপ্স লিংক আর আমার সোনার বাংলা গানের ইস্নিপ্স লিংক পাশাপাশি দেয়া আছে। মিলিয়ে দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। ঠিক যেভাবে হিন্দি ছবি মার্ডারের ‘জানা তেরে পেয়ার মেরা’ এই গানটা মাইলসের ‘নিঃস্ব করেছ আমায়’ এই গানটার নকল বলে বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না, কিংবা প্রীতমের ‘ভিগি ভিগি’ রাতের সুর শুনলে যেভাবে বোঝা যায় সেটা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীটা যেন ছোট হতে হতে’র সুর থেকে চুরি করা, সেভাবেই গগন হরকরার ‘কোথায় পাবো তারে’ গানের সুর আর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের সুর পাশাপাশি শুনলেই বুঝতে পারার কথা। এছাড়া মুহম্মদ মনসুর উদ্দিনের বাউল গানের সংকলন হারামণি গ্রন্থের ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথে ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ এই গানটি নাম উল্লেখ না করে শিলাইদহের অঞ্চলের একজন বাউলের কণ্ঠে শুনেছিলেন বলে উল্লেখ করছেন। তাঁর ভাষাতেই:
স্পষ্টতঃ এই নাম উল্লেখ না করা শিলাইদহের বাউলটিই হচ্ছেন গগন হরকরা। কিন্তু এমনভাবে বলা হচ্ছে যেন কোলকাতার রাস্তার ধারে কোনো গান গাওয়া কোনো বাউলের কণ্ঠে তিনি এটা শুনেছেন। অথচ আমরা খুব ভালো করেই জানি যে, রবীন্দ্রনাথের সাথে গগন হরকরার বেশ ভালো পরিচয় ছিলো। তিনি কোলকাতায় এসে নয়, বরং শিলাইদহের কাছারিতে এসে প্রায়শঃ তাঁর জমিদারবাবু রবীন্দ্রনাথকে গান শুনিয়ে যেতেন। অথচ জমিদারবাবুর কতো কুণ্ঠা তাঁর নাম নেওয়ার বিষয়ে।
বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ কখনোই তাঁর ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের মূল সুরটি যে আসলে গগন হরকরার গান থেকে নেওয়া–সে কথা কোনো লেখাতেই স্পষ্ট করে বলেননি। এ ব্যাপারটি পীড়াদায়ক। রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের ব্যাপারে যে সাবধানতা অবলম্বন করেছেন (কীভাবে গাইতে হবে, কীভাবে সুর অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে ইত্যাদি), ঠিক ততটাই যেন নিস্পৃহ ছিলেন অন্যের গান আত্তীকরণের বেলায়। শুধু তো ‘আমি কোথায় পাব তারে’ নয়, বহু গানের সুরই এভাবে বাউল গান থেকে ধার করা। ‘গ্রাম ছাড়া ঐ রাঙা মাটির’ গানটি এসেছে বাউল গান ‘মন মাঝি সামাল সামাল’ গান থেকে, ‘ও আমার দেশের মাটি’ গানটি এসেছে বাউল গান ‘আমার (সোনার) গৌর ক্যানে’ গান থেকে; ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ গানটি এসেছে ‘যমুনে, এইকী তুমি যমুনে’ গানের সুর থেকে ইত্যাদি। বহু বিদেশী গানের সুর থেকেও যে অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীতের সুর নেওয়া হয়েছে সেটি বোধ হয় না বলে দিলেও চলবে। আমদের লেখাতেই বলা আছে–বিখ্যাত ‘ফুলে ফুলে ঢলে’র সুর নেয়া হয়েছে স্কটল্যান্ডের ফোক গান ‘Ye banks and braes’ থেকে। ঠিক তেমনি ভাবে কেউ খোঁজ খবর করলেই জানতে পারবেন, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ গানটির সুর নেয়া হয়েছে স্কটিশ লোকগীতি ‘Auld Lang Syne’ থেকে; ‘কতবার ভেবেছিনু’ নেওয়া হয়েছে ‘Drink to me only’ থেকে; ‘আহা আজি এ বসন্তে’ গানটি নেওয়া হয়েছে ‘Go where glory waits’ থেকে ইত্যাদি। ড. আশিস বসুমল্লিকের একটি হিসেব অনুযায়ী ২২৩২টি রবীন্দ্রসংগীতের মধ্যে ২৮০টি গান রবীন্দ্রনাথ নিয়েছিলেন (রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর গণনা অনুযায়ী অবশ্য এই সংখ্যা ২৩৪) অন্য সুর হতে কিংবা অন্যের কথা হতে। অর্থাৎ প্রায় ১২.৫ ভাগই হচ্ছে মারা গান, থুড়ি, ‘ভাঙা গান’। সংখ্যা নেহাত কম নয়। আমরা আমাদের লেখায় ইন্দিরা দেবীর রক্ষণশীল হিসেবটিই নিয়েছি আমাদের সমালোচকদের প্রতি যথেষ্ট উদারতা দেখিয়ে।
কুলদা রায় সহ কেউ কেউ আমাদের যুক্তিগুলো খণ্ডন না করে বাউল গানের পিছনে এখন লেগে গেছেন। তারা বলতে চাইছেন, বাউল গান নাকি আলাদা কোনো টিউন নয়। বাউল সুর বারোয়ারি, এর কোনো বাপ-মা নেই। যে কেউ ইচ্ছে করলেই নাকি এই সব গান থেকে সুর নিয়ে নিতে পারে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ কোনো অন্যায় করেননি। এটি একটি ভুল যুক্তি, অনেকটা ডুবন্ত মানুষের খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার অন্তিম চেষ্টা যেন। এ ব্যাপারটি মুক্তমনাতেও এটি পরিষ্কার করা হয়েছিলো। লালন শাহ, দুদ্দু শাহ, পূর্নদাস বাউল, পবন দাস বাউল, শাহ আব্দুল করিম বয়াতী সবাই বাউল, কিন্তু সবার গানের সুর এক নয়। এমনকি লালনেরও সব গানের সুর এক নয়। লালনের ‘জাত গেল জাত গেল’ আর ‘পাপ-পুণ্যের কথা আমি কারে বা শুধাই’ গানের সুর কারো কাছেই এক মনে হবে না। এমন নয় যে, ‘জাত গেল জাত গেল’ গানটি বানিয়ে তার সুরই ব্যবহার করে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানের সুর তৈরি করেছিলেন লালন। গানগুলোর সুর আলাদা আলাদা ভাবে তৈরি করেছিলেন বলেই সেগুলো শুনতে আলাদা লাগে। এর পেছনে আলাদাভাবে সৃষ্টিশীলতা এবং সৃজনশীলতা দেখাতে হয়েছে। আব্দুল করিম বয়াতীও বাউল। কিন্তু তা বলে কি তিনি লালন শাহ এর ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গান থেকে সুর নিয়ে তার ‘বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে’ কিংবা ‘একখান চাবি মাইরা’ গানের সুর কি বানিয়েছিলেন? না তা কিন্তু নয়। বাউল টিউনের উপর হলেও তাকে আলাদাভাবে সুর করতে হয়েছিলো গানে।
পশ্চিমা বিশ্বের সংগীতের কথাই ধরা যাক। সেখানে রেগে, রক এণ্ড রোল, ব্লুজ, কান্ট্রি–এগুলো কিছু জানা টিউন। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, একজন সুরকারের করা ব্লুজের একটি সুর আরেকজন হুবহু ব্যবহার করে দেবেন আরেকটা গানে আরেকজন সুরকার; কিংবা একজনের কান্ট্রি গানের সুর নিয়ে আরেকজন কাট্রিসং বানিয়ে বাজারে ছেড়ে দেবেন। ব্যাপারটার পার্থক্য বুঝতে হবে। গগন হরকরার গানটির সুর তৈরিতে গগনকে সৃজনশীলতা দেখাতে হয়েছিল, কষ্ট করতে হয়েছিল। কেবল ‘বাউল সূর সর্বজন স্বীকৃত’ বলে আরেক গানে কেউ কপি করে দিতে পারে না, ঠিক যেমনি আমি এখন রবীন্দ্রসংগীতের একটি গানের সুর আমার লেখা একটা গানে বসিয়ে বলতে পারি না যে, আমি একটা রবীন্দ্রসংগীত বানিয়েছি। এটা অন্যায় শুধু নয়, হাস্যকরও হবে । যে কুলদাবাবু এখন রজনীকান্ত-রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল-পান্নালাল এনে রবি ঠাকুরের পিঠ বাঁচাতে চেষ্টা করেছেন, তিনিই কিন্তু আমাদের বুকে ছুরি মারতেন রবিঠাকুর যে কাজটি করেছেন, সেটা আমরা শুরু করলে। রবীন্দ্রসংগীত চুরির অপবাদ আসতো সবার প্রথমে তার কাছ থেকেই। অথচ রবিঠাকুরের বেলায় এটি ‘কৃষ্ণলীলা’ হয়েই থাকবে!
কুলদা রায় স্বর্গ-মর্ত-পাতাল ফুঁড়ে বহু তথ্য এনেছেন। সেগুলোর বেশিরভাগই এতো অপ্রাসঙ্গিক এবং বিষয়-বহির্ভূত যে সে সব দেখে কোনো সুস্থ মানুষের হাসা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই। এত কষ্ট করেছেন, এতো তথ্যের পাহাড় ঢেলে দিয়েছেন, এগুলো না করে এর চেয়ে ঢের সহজ একটি ব্যাপার তিনি করতে পারতেন, তাহলেই এই অধম কৃতার্থ হতো। তিনি যদি এক লাইনে দেখাতেন–এই যে এখানে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ গানটি যে গগন হরকরার ‘কোথায় পাব তারে’ গানের সুর থেকে নিয়েছেন তা উল্লেখ করেছেন (রবীন্দ্র রচনাবলীর অমুক সংস্করণের অমুক পৃষ্ঠা ইত্যাদি)। ব্যাস ল্যাঠা চুকে যেত। রবীন্দ্রনাথের সম্মানও বাঁচতো, আমাদেরও এতো কষ্ট করে গলদঘর্ম হয়ে এই নিকৃষ্ট-মানের লেখা লিখতে হত না। কিন্তু কুলদা তা করতে পারেননি; সে না পারারই কথা। কারণ রবীন্দ্ররচনাবলী কিংবা রবীন্দ্র-ইতিহাসের কোথাও এর উল্লেখ নেই। রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানতঃ গগন হরকরার সুরের স্বীকৃতি দিয়ে যাননি। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ কিংবা তার মা সারদা দেবী কোথায় কীভাবে তাকে পরিচিত করেছেন তা ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলা এবং সেগুলো বসে বসে শোনা রীতিমত পীড়াদায়ক। এ অনেকটা ‘গরু মেরে জুতা দান’-এর মতো শোনায়। অবশ্য গরু মেরে জুতা দানের মতো কাজ রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেকই পাওয়া যাবে। এর কিছুটা ইঙ্গিত মিলে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের মন্তব্য থেকেও। যেমন তিনি উল্লেখ করেছেন,
এ বিষয়টার সামান্য একটু উল্লেখ আনিসুজ্জামানের লেখাতেও পাওয়া যায়:
যদিও আনিসুজ্জামানের এই লেখাটি রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগনামা বা সমালোচনা হিসাবে লেখা হয় নি, বরং স্তব হিসাবেই লেখা হয়েছে; রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই সকল অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি যে কত মহৎ সেটিই প্রমাণ করা উদ্দেশ্য ছিলো তাঁর। তারপরেও এ বিষয়টাকে এখানে উল্লেখ করা হলো এ কারণে যে, লালনের গানের খাতা নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে চুরি করার একটা গুরুতর অভিযোগ রবীন্দ্রনাথ জীবিত থাকা অবস্থাতেই ছিলো।
কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরও উল্লেখ করেছেন যথার্থভাবেই–‘রবিঠাকুর বা জ্যোতিরিন্দ্রনাথরা তাদের ব্রাহ্মধর্মের স্বার্থেই বাউল-সঙ্গীত সংগ্রহ করতেন। তাদের ব্রাহ্মত্বের ব্রহ্মসাধনার সাথে এসবের যোগ করতেন। কিন্তু তা তারা খুব একটা স্বীকার করতেন না।’ অথচ এই রবীন্দ্র-বন্দনার যুগে রবীন্দ্র-স্তাবকেরা ফেনিয়ে ফেনিয়ে লিখে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ লালন কিংবা গগন হরকরার মতো বাউলদের কতটা কদর করতেন, কতটা মাথায় করে রাখতেন, ইত্যাদি।
প্রমথনাথ সম্বন্ধে যত কম কথা বলা যায় ততোই মনে হয় ভাল। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক থেকেই পাওয়া যায় যে ‘গ্রন্থখানি লিখিবার ভার অর্পণ করা হইয়াছিল প্রমথনাথ সেনগুপ্তের উপর।’ হতভাগ্য প্রমথনাথ বইয়ের নামও ঠিক করে রেখেছিলেন–‘বিশ্বরচনা’। প্রথম অধ্যায় পরমাণুলোক থেকে শুরু কয়রে নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার সব অধ্যায়ই লিখেছেন প্রমথবাবু। আর রবীন্দ্রনাথ ‘খোল নলচে’ বদলে শেষ অধ্যায় লিখে গুরুদেবের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার কথা প্রমথনাথ নিজেই বলেছেন এভাবে:
রবীন্দ্রনাথ নিজেও কিন্তু প্রথমে প্রমথনাথের অবদান স্বীকার করে বলেছিলেন:
অথচ আলমোড়া থেকে ফিরেই তিনি ভোল পালটে বললেন:
অবশ্য কুলদার মতো রবীন্দ্র-স্তাবককে এগুলো বলে লাভ নেই। উনি আমাদের এক সামান্য প্রবন্ধের ধাক্কায় চারটি মন্তব্য করে ফেলেছেন একদিনের ব্যবধানে। এখানে ওখানে গিয়ে নানা পদের জিগির করেছেন। এ থেকেই তার পেছনের জ্বালা বোঝা যায়। তার জ্বলুনি লাগাই উচিৎ। আমি একবার রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট বিষয়ে একটি লাইন লিখেছিলাম আমার ‘স্বতন্ত্র ভাবনা’ (চারদিক, ২০০৮) বইয়ের ভূমিকায় । লাইনটা এরকমের – রবীন্দ্রনাথের প্লানচেটে বিশ্বাসের ওপর প্লানচেট কিংবা আত্মার অস্তিত্ব কিংবা অনস্তিত্ব নির্ভর করে না। ‘রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসঙ্গীতের ওপর নির্ভর করে প্রমাণিত হয় না পরম ব্রহ্মের অস্তিত্ব’। ব্যাস কুলদা বাবু আরেক ব্লগে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্ল্যানচেট করাকে ডিফেণ্ড করতে শুরু করে দিলেন। বলতে থাকলেন তার ছোট ছেলে শমীর মৃত্যুতে এতোটাই ভেঙ্গে পড়েছিলেন যে তারা প্ল্যানচেট করে আত্মা ফাত্মা নামানোতে বিশ্বাস করা জায়েজ ছিল। তাকে কী করে বোঝাই যে, আমাদের অনেকরেই ছেলে মেয়ে, পিতা কিংবা নিকটাত্মীয় মারা যায়, কিন্তু কোন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করে আত্মা নামিয়ে শান্তি খোঁজে না। যদি খোঁজেন তিনি বিজ্ঞানমনস্ক নন, বরং কুসংস্কারাচ্ছন্ন। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ তার বহুল আলোচিত ‘রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘ভুতে ভগবানে তাঁর (রবীন্দ্রনাথের) সমান বিশ্বাস। আমৃত্যু ভৌতিক প্ল্যানচেটে ছিল তাঁর গভীর আস্থা। আর কে না জানে, এ ধরণের আস্তিকতা মানস-মুক্তির একটি বড়ো অন্তরায়’। সহজ কথায়, ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’ যেমন অবাস্তব তেমনি অবাস্তব প্ল্যানচেটে বিশ্বাসী -বিজ্ঞানমনস্ক এবং প্রগতিশীল ব্যক্তিত্ব। কিন্তু কুলদা রায় কাঁঠালের আমসত্ত্ব শুধু নিজে দেখছেন না, রীতিমতো অদৃশ্য আমসত্ত্বের চাটনি বানিয়ে অন্যদের পরিবেশন করার মহান দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের কুসংস্কার সম্বন্ধে যখন বলা হচ্ছেই আরও একটি কথা এ প্রসঙ্গে না বললেই নয়। সম্প্রতি ডা. শ্যামল চক্রবর্তীর রবি ঠাকুরের ডাক্তারি (সাহিত্য সংসদ, ২০১১) নামের বইটি পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের হোমিওপ্যাথিতে বিশ্বাসের কথা জানা ছিলো কিন্তু হোমিওপ্যাথি নিয়ে এমন বাতিকগ্রস্থতার বিষয়টা এমনিভাবে জানা ছিলো না এই অধমের। লেখক দাবি করেছেন যে, রবিঠাকুরের বাতিকগ্রস্থতা (লেখকের মতে ‘চিকিৎসাবায়ুগ্রস্ততা) এমন পর্যায়ে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলো যে তিনি মৃণালিনী দেবীর অসুস্থতার সময় কোনো এলোপ্যাথিক চিকিৎসা গ্রহণ করতে দেননি, নিজের হোমিও-জ্ঞান প্রয়োগ করে গেছেন দিনের পর দিন তার স্ত্রীর উপর। ‘চিকিৎসক’ রবিঠাকুরের এই ভুল চিকিৎসায় মৃণালিনী দেবী জোড়াসাঁকোর একটি আলো-বাতাস-হীন ঘরে প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে মারা যান। এ সময় কোনো আধুনিক চিকিৎসাই মৃণালিনীকে দেয়া হয়নি। কেবল অসুস্থ স্ত্রীকে পাখার বাতাস করে গেছেন, আর নিজের হোমিওপ্যাথির উদ্ভট ঔষধ খাইয়ে গেছেন। ডাক্তার শ্যামল চক্রবর্তীর মতে মৃণালিনী দেবীর রোগটি ছিলো গর্ভপাত-পরবর্তী জরায়ু ও সন্নিহিত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংক্রমণ যা চিকিৎসা শাস্ত্রে ‘পোস্টঅ্যাররটাল সেপসিস’ নামে চিহ্নিত। অথচ এই রোগের ভাল চিকিৎসা তখন এলোপ্যাথিতে ছিলোই। তিনি তা নেননি, বরং শ্যামল চক্রবর্তী লিখেছেন:
এই বইটি প্রসঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে (নির্মোহ, বিরল রবীন্দ্রচর্চা, বইপোকা, ৪ কার্তিক ১৪১৮ শনিবার ২২ অক্টোবর ২০১১) – “…বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য, ‘মৃণালিনীর মৃত্যু ও রবীন্দ্রনাথ’ অধ্যায়টি। সেখানে ঠিক কোন অসুখে মৃণালিনীর মৃত্যু হয়েছিল সে সম্পর্কে যুক্তিপূর্ণ অনুমান আছে, আছে এই তথ্যভিত্তিক ইঙ্গিতও যে মৃণালিনীর মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী রবীন্দ্রনাথই… রবীন্দ্রচর্চায় এমন নির্মোহ গবেষকের দৃষ্টি বিরল।”
কিন্তু কুলদার কাছে এই ‘নির্মোহ দৃষ্টি’র ব্যাপারটাই অন্যায়। তার পয়গম্বরের ব্যাপারে কেউ ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণ হাজির করলেই তাকে তিনি ছাগু, সাম্প্রদায়িক, রাজাকার, জামাতি ইত্যাদি বলে ট্যাগ করেন–ব্লগে, ফেসবুকে নানা জায়গায়। তার কাছে সবকিছুই খুব সাদা কালো, অনেকটা আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বুশের মতো–‘আইদার উইথ মি অর উইথ দেম।’ হয় রবীন্দ্রনাথের স্তব করে প্রগতিশীল বনে যেতে হবে, কিংবা আপনি হবেন পাকিস্তানপন্থী রাজাকার। এর বাইরে কিছু থাকতে পারবে না। সেটাই চান যেটা তিনি এবং তার ভক্ত-কূলেরা দিনের পর দিন করে গেছেন, করে যাচ্ছেন অহর্নিশি–রবিঠাকুরের ভাল ভাল কথামালার মালা বানিয়ে দেদারসে জাবর কাটা। জাবর কাটুন, ক্ষতি নেই, কিন্তু এতে করে কেবল ‘ষণ্ড’ খেতাবই জুটবে, সামনে এগুবার আশা করা একেবারেই বৃথা। রবীন্দ্রনাথেরই ভাষায় –
ফাহিম, নয়ন মজুমদার, কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর, ভজন সরকার, কুলদা রায়, Md. Ali Azam, ইয়াসির, তুহিন তালুকদার সহ যারা মন্তব্য করেছেন সবাইকে ধন্যবাদ।
মার্ক্সবাদি ভবানী সেনের ‘রবীন্দ্র বিরোধিতা কেন’ প্রবন্ধটি এখানে প্রাসঙ্গিক-
রবীন্দ্র বিরোধিতা কেন
* লেখাটা পড়ে কিছু নতুন তথ্য পেলেও উদ্দেশ্য-বিচারে নতুন কিছুই পাইনি। সেসবের অনেক উদাহরণ প্রতিক্রিয়াগুলোয় এসেছে। ধনঞ্জয় দাশগুপ্ত(?-সম্পাদিত ‘মার্ক্সবাদী সাহিত্য বিতর্ক’ গ্রন্থে শব-ব্যবচ্ছেদকারী অনেক লেখা রয়েছে।
* তারপরও বলবো এরকম লেখার প্রয়োজন আছে । কারণ এই লেখার প্রতিক্রিয়ায় ভালো আরো কিছু লেখা এসেছে । যুক্তি আর বোধের উৎকর্ষের জন্য জানা কথার পুনরাবৃত্তির দরকার আছে।
* রবীন্দ্রনাথের অন্ধ-ভক্ত, অন্ধ-বিদ্বেষীর পাশাপাশি রয়েছে মুক্তমনা অনুরাগী এবং মুক্তমনা সমালোচক। আলোচ্য প্রবন্ধটি পড়ে মনে হতে পারে রবীন্দ্রনাথের প্রতি অশ্রদ্ধা বাড়ানোই মূল উদ্দেশ্য। অন্ধবিশ্বাসীরা দুর্বল হবে না আর অন্ধ-বিদ্বেষীর ঘৃণা বাড়তি কিছু হবেনা যেহেতু না জেনে বুঝেই এরা ঘৃণায় পরিপূর্ণ। গগন হরকরা বিষয়টিকে এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে যেন এটা এক্ টা পাবলিক সিক্রেট! আজ থেকে প্রায় পনের বছর আগে ঢাকায় একুশের বই মেলায় একটা অডিও সিডি কিনেছিলাম যেটিতে বিতর্কিত গান দুটি ছিলো পরিচিতি-সহ।
* বিশ্বপরিচয় – বিষয়ক আচরণ নিন্দনীয়, কিন্তু এতে তাঁর লেখার বা গানের প্রতি আকর্ষণ মোটেও কমেনি আমার।
* আমি বলছিনা যে রবীন্দ্রনাথ কি খেতেন, কবেলা ব্যায়াম করতেন এসব নিয়ে গবেষণার মতো অপ্রয়োজনীয় তাঁর নীতি বা মানবিক বোধ নিয়ে আলোচনা। কিন্তু এনিয়ে যুদ্ধংদেহী হবার কোন প্রয়োজন দেখিনা।
* অন্যান্য সূত্র থেকে ধার নেয়া বা অনুকরণ করা প্রসঙ্গে বলবো, আমাদের কপাল ভালো যে করেছিলেন।
* রবীন্দ্রনাথের চাইতে উন্নততর বিজ্ঞান-বোধ সেকালে অনেকের এবং একালে অনেক স্কুল-বালকের-ই হয়তো রয়েছে। অন্ধ-ভক্তদের ঘায়েল করতে গিয়ে এক রকম অন্ধ আক্রোশ থেকেই এবিষয়ে কথা বলা হয়েছে। একই রকম অন্ধ আক্রোশের প্রকাশ ঘটেছে রবীন্দ্রনাথের লেখার আবেদন কখন বিলুপ্ত হবে তা নিয়ে অতিকথনে।
* মুক্তমনাকে ধন্যবাদ জানাই যুক্তিবুদ্ধির চরচার একটা জায়গা করে দেবার জন্য। না চাইলেও এক্ সময় মুক্তমনার-ও অনেক অন্ধ ভক্ত জুটে যাবে। আমি মনে করি ভাল-মন্দ দুই রকম আন্দোলনেই অন্ধ-ভক্তির প্রয়োগ থাকে। এড়াতে পারলে ভালো।
@চার্বাক,
চমৎকার বলেছেন। ঠিক এ জায়গাটাতে আস্তিক-নাস্তিক সব এক একাকার হয়ে যায়।
বিঃদ্রঃ
উপরের মন্তব্যে পুরুষ এবং বেটাগিরী শব্দদুটি আমি রুপকার্থে ব্যবহার করেছি, জেন্ডার ডিসক্রিমিনেটোরি নয়। ধন্যবাদ।
@ ফরিদ ভাই এ্যন্ড অভিজিৎদা,
ভাগ্যিস আপনারা রবিবাবুকে সমালোচনার কাঠগড়ায় তুলেছিলেন, নইলে এত্তকিছু জানতাম কি করে? আমরা যারা নতুন প্রজন্মের তারা রবির বইই পড়িনা ঠিকমত, সমালোচনামুলক লেখাতো বহু দুরের ব্যাপার। এই লেখার বিপরীতে সমালোচনা এবং মন্তব্যগুলোই বলে দিচ্ছে আপনারা যে অভিপ্রায়ে এই লেখার সূচনা করেছিলেন তা স্বার্থক। আপনারা আবার প্রমাণ করলেন মুক্তমনাদের কাছে কোনো মহামানব-ই সমালোচনার উর্দ্ধে নয়। এই দুর্দান্ত পৌরুষ আর বেটাগিরীর জন্যেই তো মুক্তমনা এত ভালো লাগে। আপনাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন কষ্টসাধ্য, নির্মোহ এবং দুর্দান্ত সাহসী লেখার জন্য। (F) (F)
প্রিয় অভিজিত্ ও ফরিদ,
দুঃখিত যে দশ/বারোদিন আগে লেখাটি হাতে এসেছিল কিন্তু পড়ার সুযোগ হয়নি গত উইকেণ্ডের আগ পর্যন্ত। পড়ার পর বেশ খানিক সময় লাগল মানসিক ধাক্কাটা সামলে নিতে। আমি পুরনো দিনের মানুষ—বলতে গেলে রাবীন্দ্রিক আবহাওয়াতেই আমি এবং আমার সমসাময়িক যুগের অল্পবিস্তর শিক্ষাপ্রাপ্ত বাঙ্গালিসমাজটি বড় হয়ে উঠেছি। সেযুগে (অনেকটা বর্তমান যুগেও) রবীন্দ্রনাথের মত বিশাল ব্যক্তিত্ব বাংলাবাষাভাষী জগতে জন্মগ্রহণ করেননি। আমরা জীবনের প্রায় প্রতিটি আবেগ-অনুভূতিরই প্রকাশ খুঁজি তাঁর কবিতায়, তাঁর গানে, তাঁর পর্বতপ্রমান সৃষ্টিসম্ভারে। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ’ও বিশ্বাস করি যে আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি জনক হলেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকি এ’ও বলতে প্রস্তুত আমি যে বাঙ্গালির ‘বাঙ্গালিত্ব’টি প্রধানত তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া।
তা সত্বেও আমি নিজেকে ‘রবীন্দ্রপূজারী’ বলে মানতে নারাজ। রবীন্দ্রানুরাগী আমি অবশ্যই, কিন্তু না, পূজারী আমি তাঁর নই—অন্ধভাবে মন্দির-মণ্ডপে গিয়ে পূজা অর্চনা করার মানসিকতা থেকে আমি মুক্ত। ‘মূর্তিপূজা’ আর ‘ব্যক্তিপূজা’ দুটোই আমার বিচারে একধরণের দাস্যমনষ্কতার পরিচায়ক। ঐতিহাসিক কারণে প্রথমটিকে তবুও সহ্য করা যায়, দ্বিতীয়টি পুরোপুরিই ন্যাক্কারজনক।
রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ ব্যক্তিত্ব আমাদের মধ্যে এখনও আবির্ভূত হননি, তা ঠিক, কিন্তু ভবিষ্যতে কোনদিন হবেন না এমন আজগুবি বিশ্বাস নিয়ে যারা বাড়িতে পূজাঘর রচনা করে নিত্য জপসাধনাতে মগ্ন থাকেন তারা যদি তেমন কোন ব্যক্তির সাক্ষাত্ পেয়েও যান তাহলেও তারা মানতে রাজি হবেন না। এখানে ধর্মবিশ্বাসীদের সঙ্গে তুলনাটি এসেই যেতে পারে।
অভিজিত্ আর ফরিদের এই লেখাটি আমার খুবই ভাল লাগল। তার প্রধান কারণ এর পেছনে যে যথেষ্ঠ গবেষণা আর চিন্তাভাবনা আছে তার স্বাক্ষর এর প্রতিটি লাইনে। এধরণের লেখা সবসময়ই ঝুঁকিপুর্ণ—–বিতর্কের ঝড় যে একটা তুলবেই তারা এতে সন্দেহ নেই। এবং তুলেছেও, তার প্রমাণ তো মুক্তমনার পৃষ্ঠাতেই দেখতে পাছহি। এবং বিতর্ক যে উঠছে সেটা অত্যন্ত শুভ লক্ষণ। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্মের মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠুক বা না উঠুক, আমরা যেন কেউ ভুলে না যাই যে প্রশ্ন বা বিতর্কতে তাঁর বিশালত্ব বিন্দুমাত্র খর্ব হবে না—-তিনি যে গিরিশৃঙ্গে আসন গ্রহণ করে আছেন যুগ যুগ ধরে সেখান থেকে তাঁকে অপসারিত করবার সাধ্য কারুর নেই। সত্যিকার মহত্ব প্রশ্নের আলোতে মলিন হয়না, বরং তার উজ্জ্বলতা আরো বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। ব্রিটেনের স্যার আইজ্যাক নিউটনের জীবনী যাঁরা পড়েছেন তারা ভাল করেই বুঝবেন আমি কি বলতে চাইছি। মধ্যযুগের বিজ্ঞানজগতে নিউটনের মত বিশাল প্রতিভা যেমন জন্মগ্রহণ করেনি, তেমনি তাঁর মত জটিল, কুয়াসাচ্ছন্ন চরিত্রও ইতিহাসে বিরল। পাক-ভারত উপমহাদশে রবীন্দ্রনাথকে দেবতা হিসেবে দেখাটা হয়ত আমাদের দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গেই সম্পৃক্ত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে ব্রিটেনেও ঠিক একইভাবে মহামতি নিউটনকে প্রায় গগনাশ্রয়ী দেবতার মত পূজা করা হয়েছে তিনশ’ বছর ধরে। নিউটনের কোনরকম সমালোচনা তারা সহ্য করতে পারত না। তাঁর সঙ্গে ইউরোপের গণিতজ্ঞ-দার্শনিক লাইনিজের ঐতিহাসিক বিবাদটিতে দুজাতির বুদ্ধিজীবিরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ার বড় ক্ষতিটা ইউরোপের হয়নি, হয়েছিল ব্রিটানের, বিশেষ করে গণিত জগতের। সেই ক্ষতিটা এখনও পুরোপুরি পূরণ হয়নি।
আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত প্রশ্ন-বিতর্ক ওঠে ততই মঙ্গল, ততই দ্রুততার সঙ্গে বাঙালি জাতির মধ্যে নবজাগরণের প্রেরণা সঞ্চার হবে, ততই রবীন্দ্রনাথের বিশাল ছায়াতল থেকে বহিষ্কৃত হয়ে নব নব সৃষ্টির সন্ধানে ভূলোক-দ্যুলোক বিচরণ করে বেড়াতে পারবে। রবীন্দ্রনাথের ন্মহত্বকে ইতিহাসের স্বর্ণলিপিতে সংরক্ষিত করে বাঙালি জাতি ইউরোপের মত জ্ঞানসাধনার শীর্ষচূড়াতে আপন আসনটি আবার দখল করে নিতে পারবে।
লেখাটির সার্বিক গুণ আমাকে মুগ্ধ করলেও এখানে ওখানে দুচারটে অসংযত শব্দ যে খানিক খটকা লাগায়নি আমার মনে তা নয়। যেমনঃ “রবি বুড়ো”, “হাতিয়ে নেবার পায়তারা” ইত্যাদি। বিতর্কমূলক লেখা লিখতে গিয়ে ব্যক্তিগত চিন্তাগুলো যাতে বিষয়টাকে অযাচিতভাবে ঘোলাটে করে না ফেলে সেজন্যে লেখককে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হয়।
@মীজান রহমান,
অসাধারণ এই মন্তব্যটার জন্য কৃতজ্ঞতা রইলো।
আমাদের এই লেখাটাকে কিছু লোক যেভাবে নির্দ্বিধায় চটুল, গভীরতাবিহীন, হীন মানসিকতার বহির্প্রকাশ, কাট এন্ড পেস্ট, নতুনত্ববিহীন, বা বহু পুরোনো বিষয়ের চর্বিত চর্বন বলে চলেছিল তাতে করে আমরাও প্রায় সেগুলোকে বিশ্বাস করে ফেলার উপক্রম করে ফেলেছিলাম। আপনার এই মন্তব্যের পরে আবারো মনে পড়লো যে, এই লেখাটা তৈরি করতে গিয়ে আমি আর অভি কীভাবে দিনের পর দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেছি।
লেখার শুরু ও শেষ দারুণ হয়েছে। আমিও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ নয়, তার কর্মেরই ভক্ত। কিন্তু মূল আলোচনায় লেখাটা খুব একতা নির্মোহ থাকেনি। কেমন যেন “চোর ধরেছি” টাইপ একটা বাজে টোন এসে গেছে যেখানে চরম ভাবে রবীন্দ্রনাথ ব্যাশিং চলেছে কদর্য ভাষায়। এডাপ্টেশনকেও কেমন যেন গর্হিত একতা টন দিয়ে ফেলা হয়েছে। তুচ্ছ অভিযোগে অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে তুলোধুনো করার সুযোগ পেয়েছেন। প্রমথনাথের ব্যাপারটা নিয়ে আমারো খারাপ লেগেছে খুব। এটা আমি একেবারেই পছন্দ করিনি। আমিও চাই এই তথ্যটা ছড়াক এবং গগণ হরকরা রবীন্দ্র সঙ্গীতের সুরকার হিসেবে স্বীকৃতি পাক।
কেন যেন বারবার মনে হয় আমরা ভক্তি দিয়েও মানুষকে অপমান করি, আবার তুচ্ছ বিষয়ে ছোট করেও মানুষকে অপমান করি। তবে আপনাদের এ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই এ কারণে যে রবীন্দ্রনাথের কাজ ও ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে আলাদা করে দেখাটা আমাদের জন্য খুবই জরুরি, তার কাজকে যথাযোগ্য সম্মান দেবার জন্যই।
মুক্তমনা ব্লগ শিখাগোষ্ঠীর শ্লোগান তাদের ব্যানারে রেখেছেন–
জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, যুক্তি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।
আহমেদ ফরিদ এবং অভিজিৎ রায়ের এই নোটটি পড়ে মনে শিখাগোষ্ঠীর এই মূলমন্ত্রটি চরিত্রটি এদের দুজনের মধ্যেই প্রবলভাবে অভাব আছে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান, আড়ষ্ট যুক্তি নিয়ে নিয়ে বুদ্ধির মুক্তি নেমেছেন। ফলে তাঁদের হাতে শিব গড়তে বান্দর তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এটা সুখের কথা নয়–অসুখের বার্তা। এই অসুখের ফলে এদের দুজনের বুদ্ধির মুক্তি ঘটেনি।
এই অসুখের কারণ আকাশচুম্বী আত্মরম্ভীতা। এই অসুখ থেকে এদের বেরিয়ে আসার দরকার। এদের কাজ করার ইচ্ছে আছে। আয়োজন আছে। কিন্তু সমস্যা তাদের মনের গভীরতর অসুখ।
কিন্তু মুক্তমনা ব্লগের একটি সামাজিক গুরুত্ব আছে। এখানে অনেকেই বুদ্ধির মুক্তির দিকে আসছেন। তাদের এই আসাটা সুখের।
এই নোট থেকে আশা করা যায় এরা দুজনেই তাদের অসুখ থেকে নিরাময়ের পথে হাঁটবেন। তাতে তাদের কতোটুকু লাভ হবে জানিনা–তবে মুক্তমনাদের লাভ হবে। তারা বিভ্রান্ত তথ্যের বিষবাষ্প থেকে রেহাই পাবেন। সত্যিকারের বুদ্ধির মুক্তির পথে চলতে পারবেন। অন্ধকার হাতে আলোকের যাত্রী হয়ে লাভ নেই রে ভাই।
আশা করছি অভিজিৎ রায় এবং ফরিদ আহমেদ এই অভিজ্ঞানটা গ্রহণ করবেন। সত্য যে কঠিন। আসুন কঠিনেরে ভালাবাসতে শিখি।
১.
২. রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের প্রথম পর্বটা পড়ে বুঝলেন–প্রথমনাথ লেখক হিসাবে দুর্বল। তখন তিনি কিভাবে লিখতে হবে সেটা বলে দিলেন। সেটা অনুসরণ করেও যখন লেখাটি রবীন্দ্রনাথের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী পাণ্ডুলিপি হচ্ছে না তখন তাকে রবীন্দ্রনাথ লেখা বন্ধ করে দিতে বলতে পারতেন। সেটা করেননি। তিনি তাকে লিখে যেতে বললেন। ধীরে ধীরে প্রমথনাথ লেখায় উন্নতি করলেও তা রবীন্দ্রনাথের নিজের ফিলসফির মত হয়ে ওঠে নি। সেজন্য রবীন্দ্রনাথই নিজের মত করে বইটি আবার লেখেছেন। বিশ্বপরিচয়ে ৩টি জিনিস আছে–
১. বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য যা বিদেশী বই থেকে সংগৃহীত। বইগুলি রবীন্দ্রনাথ সংগ্রহ করেছেন। পড়েছেন।
২. জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথে নিজের ফিলসফি।
৩. রবীন্দ্রনাথের ভাষা।
তাহলে তিনি প্রমথনাথকে লেখা বন্ধ করতে বললেন কেন? তাকে দিয়ে লেখালেন কেন? এটা কোটি টাকার প্রশ্ন।
উত্তর–রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন প্রমথনাথ পুরোটা লিখতে লিখতে লেখা শিখুক। শিখে তার অধিত জ্ঞানকে ভাষায় প্রকাশের দক্ষতা অর্জন করুক। সেজন্যই তিনি তাকে দিয়ে লিখিয়েছেন। তার পাণ্ডুলিপি কেটেছেটে দেখিয়ে দিয়েছেন–লেখার সমস্যাটি কোথায়। কিভাবে লেখার সহজবোধ্য ভাষাটি হতে পারে।
এই হাতে কলমে ট্রেনিংটা কিন্তু প্রমথনাথের কাজে লেগেছিল। তিনি লেখায় উন্নতি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে দিয়ে আরেক বই লিখিয়ে সেটা প্রমথনাথের নিজের নামেই প্রকাশ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণাতেই সেটা তিনি লিখেছেন। আনন্দরূপম বইটির ভাষাটি খেয়াল করলেই সেটা বুঝবেন।
দেখুন, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রনাথ কাঁচারিবাড়ি থেকে শান্তি নিকেতনে শিক্ষক হিসাবে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ হরিচরণকে দায়িত্ব দিলেন বঙ্গীয় শব্দকোষ সঙ্কলন করতে। হরিচরণ ৩০ বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুখণ্ডে শব্দকোষটি লেখা শেষ করেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু বইটি নিজের নামে নেননি। কারণ হরিচরণের হাতে তথ্য এবং ভাষা–দুটোই ছিল। রবীন্দ্রনাথ বইটিতে তার পরিকল্পনারই স্বার্থক রূপায়ন দেখতে পেয়েছিলেন। তাকে নতুন করে লিখতে হয়নি। ঘটনাচক্রে এই অধম হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ বার্যকাল থেকেই ব্যবহার করে আসছে।
@কুলদা রায়,
(Y)
কেউ মানব, মহামানব যাই হন না কেন এই দুনিয়ায় কেউ ভুল ত্রুটির উর্ধে নয় এটাই বাস্তব, এটা না মেনে কোন উপায় নাই। রবীন্দ্রনাথের সৃস্টি বাংলা সাহিত্যে অবিশ্বরনীয় হয়ে থাকবে এটা স্বীকার করার সাথে সাথে এটাও মানতে হবে যে তিনি এই পৃথিবীর দোষ-গুন যথা হিংসা-দ্বেষ, রাগ-পরশ্রীকাতরতা ইত্যাদির উর্দ্ধে ছিলেন এমন কথা স্বতস্বিদ্ধভাবে বলা যাবেনা। এটাই স্বাভাবিক, এটা না হলেই বরং অস্বাভাবিক হতো ।
আমরা যদি ধরেও নেই যে এখানে লেখকদ্বয় যে সব দোষের কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলো থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন (যেমন প্রতিপক্ষ বলছেন অত্যন্ত যুক্তি সহকারে), কিন্তু তাহলেও কি কেউ বলতে পারবেন যে উনি সম্পুর্ন দোষমুক্ত অবস্থায় এই পৃথিবিতে বিরাজ করছিলেন, এটা কি কখনও সম্ভব? হয়তো আমরা জানিনা এমন কিছু দোষ তাঁর চরিত্রের মধ্যে থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে কি যায় আসে? দোষে গুনে রবিন্দ্রনাথ তাঁর সৃস্টির মাঝে অমর হয়ে থাকবেন এটা বলাই বাহুল্য।
কোন ব্যক্তিবিশেষ তাঁকে নিয়ে ভক্তি করুক, বা অতি ভক্তিতে পুজার আসনে বসাক, সেটা সেই ব্যক্তির ব্যক্তিগত দৃষ্টিভংগীর বহিপ্রকাশ মাত্র। তাতে কারোই কিছু যায় আসেনা। মুশকিল হলো যাঁরা তাঁকে পুজোর আসনে বসাচ্ছেন তাঁদের এটা করার জন্য কোন জবাবদিহিতার প্রয়োজন পড়েনা, কিন্তু যাঁরা তাঁর সমালোচনা বা দোষ-ত্রুটির সদ্ধান করছেন তাঁদেরকে উপযুক্ত কারন দর্শনো ব্যতিত সেটা সম্পন্ন করা দূরহ ব্যাপার হয়ে দাড়ায়। আর এই দূরুহ ব্যাপারটি ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ রায় এখানে করতে চেয়েছেন।
এখানে পক্ষে বিপক্ষে প্রত্যেকের বক্তব্যগুলোতে অনেক যুক্তি আছে বলতে হবে। আসলে এইসব বিষয়ে কোন দৃঢ় উপসংহারে আসা খুব কঠিন আর রবীন্দ্রনাথের তীরোধানের এতগুলো বছর পর এই বিষয়ে কোন সিন্ধান্তে আসতেই হবে এমন কোন কারন বা দরকার আছে বলেও আমার মনে হয়না, কারন সবচেয়ে বড় কথা হলো তাঁর দর্শন বা রচনাবলী কোরান-হাদীসের বানীর মতো বাধ্যতামুলকভাবে আমাদের জীবনকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রন করছেনা, আর এটাই যা রক্ষা। 🙂
@ব্রাইট স্মাইল্, কে মহামানব আর কে অতিমানব এটা নিয়ে ভাবনা নাই। রবীন্দ্রনাথের ভুল থাকতে পারে। সেটা রবীন্দ্রনাথের দায়। আমাদের নয়। কিন্তু যারা হীনউদ্দেশ্য বানানো গপ্প দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চোর অথবা রাহাজানকারী বলছেন–তাদের এই অসাধু অতিদানবতার দিকে আঙ্গুল তোলা দরকার। আপনাকে ধন্যবাদ।
@ব্রাইট স্মাইল্,
(Y)
@নৃপেন্দ্র সরকার, (Y)
[img]http://a3.sphotos.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-ash4/s720x720/321366_2196056432296_1573787229_32236193_5186754_n.jpg[/img]
@কুলদা রায়,
আপনিও প্রমথনাথের মূল পান্ডুলিপি থেকে স্ক্যান করেননি, স্ক্যান করেছেন দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের বই থেকে। অবশ্যই দীপঙ্ককর চট্টোপাধ্যায় কেবল একটি অংশ উঠিয়ে দিয়ে বলতে চেয়েছেন যে, রবীন্দ্রনাথ তার লেখা এতোটাই রদবদল করে ফেলেছিলেন যে, প্রমথনাথকে আর রাখার সুযোগ নেই। এটা সুলভ যুক্তি। পুরো বই তো আর এই এক অংশের উপর নির্ভর করে লেখা নয়। আর দীপঙ্কর চটোপাধ্যের এই অংশটুকুর ইন্টারপ্রিটেশনের ফলে তো ইতিহাসও বদলায় না। কাজটি প্রমথনাথই শুরু করেছিলেন, শেষও করেছিলেন তিনি। সব চ্যাপ্টারগুলো (নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার) যে প্রমথনাথই লিখেছিলেন সেটা দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের বইয়েও খুব স্পষ্ট করেই বলা আছে। আলমোড়া থেকে আসার পর রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথকে বাদ দেন পাণ্ডুলিপি থেকে। আমরা সেটাই বলতে চেয়েছি।
@অভিজিৎ, হা হা হা। অন্যর মুখে ঝাল খেলেন দাদা!!! এখন অপেক্ষা করে আছি–কবে বলবেন, রবীন্দ্রনাথ তার বউকে সুইসাইড করিয়েছিলেন অথবা খুন করেছিলেন!
@কুলদা রায়,
আপনার প্রদত্ত স্ক্যান কপিতে স্পষ্ট করে দেওয়া আছে
কথাতো স্পষ্ট, তারপরেও আপনাদের অস্বীকার করা কিসের জন্যে বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি :-Y । ধরুন, আমাকে আমার সুপারভাইজার একটি কাজ করতে দিয়েছেন, আমি সেই কাজ শেষ করে সব ডাটা সহ, একটি রিপোর্ট জমা দিলাম। আমার মাতৃভাষা যেহেতু ইংরেজী নয় এবং ভাষার প্রতি দখলও বেশি নেই তাই রিপোর্টটি তেমন মান-সম্মত হলো না। তারপর দেখলাম যে আমার সুপারভাইজার সেই কাজটিকে তিনি জার্নালে ছাপালেন, কিন্তু কোথাও আমার নাম নেই। এই ক্ষেত্রে তিনি মূল কাজের চিন্তা করলেও, এবং আমার সব কিছু না নিলেও, আমি যতটুকু করেছি তার হিসেবেও আমার দ্বিতীয় অথরের মর্যাদা দিতে বাধ্য। আপনি নিজে মনে হয় গবেষণার সাথে জড়িত, এবং এই সহজ বিষয়টুকু জানেন। কিন্তু তারপরেও মানতে চাচ্ছেন না যে এই ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ আসলেই প্রমথনাথ বাবুর কাছে অন্যায় করেছেন তার নাম না দিয়ে। অনেকে আবার বলতে চেয়েছেন যে ঐ সময়কার হিসেবে এগুলোকে প্ল্যাজিয়ারিসম বলা হয় না। সেরকম অনেকেই করেছে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু বর্তমান বিচারে এটা এক প্রকার প্ল্যাজিয়ারিসমই।
@স্বাধীন,
উপরের মন্তব্যের কিছু কারেকশানঃ
সঠিক শব্দটা প্ল্যাজিয়ারিসম হবে না। প্ল্যাজিয়ারিসম হচ্ছে অন্যের কাজ নিজের বলে চালানো। এই ক্ষেত্রে বুঝা যাচ্ছে দু’জনে মিলেই একটি কাজ করা হয়েছে কিন্তু অন্যকে তার প্রাপ্য হতে বঞ্চিত করা হয়েছে। উপরের উদাহরণটি দেখলে বুঝা যাবে যে সুপারভাইজার আমার প্রাপ্য আমাকে দেননি। ইউনিভার্সিটিতে অনেক সময় এই সকল ঘটনা ঘটে। প্রমথনাথ বাবুর ক্ষেত্রটাও সেরকম। এই ক্ষেত্রে প্ল্যাজিয়ারিসম এর চেয়ে যোগ্য হবে যথাযত প্রাপ্য হতে বঞ্চিত করা হয়েছে প্রমথনাথ বাবুর নাম বিশ্বপরিচয়ে না দিয়ে।
@স্বাধীন,
তুমি যে উদাহরণটি দিয়েছ তাতে ফাঁক রয়েছে। তুমি যে ডেটা তোমার সুপারভাইজার কে দিলে সেটা কী তোমার আবিষ্কার? যদি তাই হয় তাহলে সুপারভাইজার নিশ্চিত ভুল করছেন। কিন্তু যদি তা তোমার আবিষ্কৃত না হয়, এবং সেই তথ্য যদি পাঠ্য বই থেকে সংগৃহীত হয়, (যেটি এই ক্ষেত্রে ঘটেছে) তাহলে সেই তথ্যের ওপর তোমার কোন অধিকার নেই। তাই তোমার সুপারভাইজার যদি সে ভাষা পুরোপুরি বদলে ফেলে একটি রিভিউ বিশেষ লিখে জার্নালে ছাপান তাহলে তোমার কিছু বলার আছে কী?
@যাত্রী,
উহু, ফাঁক নেই। আমি তাহলে আবারো উদাহরণ দেই যেটা বরং রবী বাবু এবং প্রমথনাথ বাবুর ক্ষেত্রটার সাথে মিলবে। এই বার আমাকে আমার সুপারভাইজার একগাদা পেপার ধরিয়ে বলিলেন যে একটি লিটেরাচার রিভিউ লিখ দিতে। এখানে আমার আবিষ্কার বেশি নেই, শুধু কষ্ট করে পেপারগুলো পড়া এবং সেখান থেকে মূল বিষয়গুলো ছেঁকে আনা ছাড়া। মূল তথ্যের ব্যাপারে আমার কোন অধিকার নেই। একই ভাবে আমি আমার রিপোর্ট জমা দিলেম। একই ভাবে আমার সুপারভাইজার আমার সেই লেখায় যথেষ্ট পরিবর্তন সহকারে জার্নালে প্রকাশ করিলেন, কিন্তু আমাকে কো-অথর হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন না। এটাও কি অন্যায় নয় বর্তমান হিসেবে? আপনি কি বলেন?
@স্বাধীন,
এবার আরেকটি উদাহরণ দেই। এটা বেশি খাটে অনুবাদের ক্ষেত্রে। ধরুন অভিজিৎ’দা একটি বই অনুবাদ করবেন বলে চিন্তা করছেন অনেকদিন ধরে। কাজটি উনি করতে পারলে নিঃসন্দেহে অনেক ভালো করতেন, কিন্তু সময় করে উঠতে পারছেন না। তাই আমাকে দিলেন অনুবাদ করতে। কিন্তু আমার অনুবাদের হাত খানা ভালো নয়, তারপরেও করে দিলাম, এবং সেটা উনার বেশি মনঃপূত হলো না। তাই উনি আমার অনুবাদে যথেষ্ট কাঁচি চালিয়ে সেটাকে একটা ভদ্রস্ত অবস্থায় নিয়ে আসলেন। যেহেতু আমার অনুবাদ তেমন সুবিধের হয়নি আর উনি বড় মানুষ, তাই আমার নাম আর নেওয়ার চিন্তা করলেন না। কিন্তু আমি ছোট মানুষ হলেও এতে কষ্ট পাবো, কারণ উনি আমার অনুবাদেই কাঁচি চালিয়ে সেটাকে প্রকাশ করেছেন। উনি যদি সেটা না করে, সম্পূর্ণ অনুবাদ আবার মূল বই থেকে করতেন তাহলে আমার কষ্ট পাওয়ার অধিকার থাকতো না। এখন আমাকে বলেন রবীবাবু কোনটা করেছেন, দ্বিতীয়টা নাকি প্রথমটা?
@স্বাধীন,
@অনুবাদে কাঁচি চালিয়ে যদি পুরোটাই অভিজিত বাবু বাদ দেন, এবং তার পরিবর্তে যদি উনি নিজে পুরোটাই লেখেন, তাহলে তোমার কিছু বলার থাকে কী? নীচে কুলদা রায় যে স্ক্যান কপি গুলো দিয়েছেন সেগুলি লক্ষ্য করে দেখ। এই জন্যই তো বারবার বলছি প্রমথনাথের লেখা মূল পান্ডুলিপিটি খুঁজে বার করতে।
@স্বাধীন,
(Y) রবীন্দ্রনাথের পক্ষাবলম্বনকারীরা “মৌলিকত্ব” জিনিসটার ওপর ধর্মীয় গুরুত্ব দিয়ে ফেলছেন। সংগ্রহও মৌলিক হতে পারে, গুছিয়ে একটি সংকলন করাও সৃজনশীল কাজ। নইলে অভিধানের কপিরাইট থাকতনা।
@রৌরব,
সেটাই (Y)
@রৌরব,
ধর্মীয় গুরুত্ব আবার কী? যুক্তি ও পালটা যুক্তির মাঝে এসব কোথা থেকে আসে? গুছিয়ে সংকলন করা যেমন সৃজনশীল কাজ, ঠিক তেমনই এই সংকলন পৃথিবীতে মাত্র একজনই করেননি। তাহলে জগতে যেকোন ভাষার একটিই অভিধান থাকত। অন্য কেউ অভিধান বার করত না। তলিয়ে দেখো ভাই।
@যাত্রী,
আমার পয়েন্টটা খুবই সোজা। রবীন্দ্রনাথ চুরি করেছেন কিনা, তার পক্ষে বা বিপক্ষে অনেক যুক্তিই থাকতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে নিম্নে উল্লেখিতগুলি অন্তর্ভুক্ত নয়:
১. রবীন্দ্রনাথ আইনস্টাইনকে ইমেইল করে পদার্থবিদ্যার তথ্য জেনে নিতে পারেন, তার জন্য প্রমথনাথের প্রয়োজন পড়ে না। অবান্তর।
২. তথ্যগুলি “মৌলিক” নয়। অবান্তর।
এসব trope বাদ দিলে বাকি কথা নিয়ে আলোচনা শুরু হতে পারে।
@রৌরব,
মূল প্রশ্ন যেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের কাছে থেকে তথ্য হাতিয়েছেন, সেখানে তথ্য টি আসলে কোথা থেকে পাওয়া গেছে বা কোন বইকে আকরগ্রন্থ হিসেবে উনি ব্যবহার করেছেন, এইসব প্রশ্ন অবান্তর বললে কী করে হবে। আপনি বোধহয় যুক্তি ও পালটা যুক্তি কোন পথে চলছে তা দেখেননি।
@স্বাধীন,
যদি সুপারভাইজার, তোমার মূল লেখার আদ্যোপান্ত পরিবর্তন করে তাহলে তোমার কাছে কী প্রামাণ্য উপায় থাকবে? বাইরের লোক যে তোমার লেখা এবং সুপারভাইজারের লেখা দেখছে, এবং এটাও দেখছে যে দুটো লেখার মধ্যে কোন মিলই নেই, তাহলে তার কাছে সুপারভাইজারের লেখাটি কেন গ্রহণযোগ্য হবে না বলতে পারো?
একটা জিনিস বোঝা গেল, বিশ্বপরিচয় থেকে যা তথ্য এই নোটে ফরিদ আহমেদ দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান বই থেকে বেছে বেছে তার যতটুকু দরকার সেটুকু নিয়ে টুকে দিয়েছেন। আগ্রহী পাঠকগণ চাইলে আমি এখানে পুরোটার পিডিএফ তুলে দিতে পারি।
বিশ্বপরিচয় বইটি বিশেষজ্ঞদের জন্য লেখা হয়নি। এমন কি বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যও নয়। বইটি লেখা হয়েছিল লোকশিক্ষার উদ্দেশ্যে। লেখার উদ্দেশ্য বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ বলছেন–
১. বইটির রচনার ভাষাকে হতে হবে সহজ সরল।
২. যথাসম্ভব পরিভাষা বর্জিত।
৩.অথচ তার মধ্যে বিষয়বস্তুর দৈন্য থাকবে না।
৪. এই রচনা শিক্ষণীয় নানা বিষয়কে বাংলাদেশর সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার মত হতে হবে।
প্রমথনাথ সেনগুপ্ত তাঁর আনন্দরূপমে লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ বলেন–’গল্প এবং কবিতা বাংলাভাষাকে অবলম্বন করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত মনে মননশক্তির দুর্বলতা এবং চারিত্রিক শৈথিল্য ঘটবার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে।
এর প্রতিকারের জন্য সর্বাঙ্গীন শিক্ষা অচিরাৎ আবশ্যক। বুদ্ধিকে মোহমুক্ত ও সতর্ক করবার জন্য প্রধান প্রয়োজন বিজ্ঞানচর্চার। লোকশিক্ষা গ্রন্থ প্রকাশে তার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
এ ভাবনা থেকেই রবীন্দ্রনাথ লোকশিক্ষা গ্রন্থমালা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।
রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথকে বলেন, সাধারণ জ্ঞানের সহজবোধ্য ভূমিকা করে দেওয়াই হবে তোমার কাজের উদ্দেশ্য। তাই, জ্ঞানের এই পরিবেশকার্যে পাণ্ডিত্য যথাসাধ্য বর্জন করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিয়য়ক রচনাকে জনপ্রিয় করার জন্য ভাষাকে এবং সাহিত্যকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই বিজ্ঞান বিষয়টি কোনো বিশেষজ্ঞকে দেখানো আগে এমন একজনকে পড়তে দিতে হবে, যিনি বিজ্ঞানের কিছুই জানেন না। তিনি এজন্য বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার অধ্যাপক গোঁসাইজীর নাম করেন। গোঁসাইজী যদি খসড়া রচনা পড়ে বিষয়টি বুঝতে পারেন তবে–সেটা গ্রহণীয় হবে।
পরমাণুলোক অধ্যায় কিভাবে লিখতে হবে তার ভাষার সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের কিছু অংশ লিখিত পাণ্ডলিপির গায়ে লিখে দেন।
[img]http://a1.sphotos.ak.fbcdn.net/hphotos-ak-ash4/s720x720/310236_2195923548974_1573787229_32236095_1008432_n.jpg[/img]
পড়ে দেখুন–প্রমথনাথ আর রবীন্দ্রনাথের লেখাটা কি এক?
দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় বলছেন, আসলে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন বস্তুজগতের গড়ন সম্বন্ধে আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর চিন্তাভাবনার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে। আজকাল যাকে মৌল গবেষণা বলা হয়, বিশ্বপরিচয়কে তো তারই সর্বোজনবোধ্য বিবরণ করে তুলতে চেয়েছেন। প্রমথনাথের লেখা অই অনুচ্ছেদে তার আভাস পাওয়া যায় না।
বিশ্বপরিচয় বইটি লিখতে প্রমথনাথকে রবীন্দ্রনাথ পড়তে দেন–
১. জিনস-এর থ্রু স্পেস এনড টাইম
২. এডিংটনের জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটি বই।
এবং লেখার শুরুতেই নক্ষত্রলোক নিয়ে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা করেন।
এসব আলোচনায় ক্ষিতিমোহন সেন এবং বিধুশেখর শাস্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া সে সময় জর্জ গ্রের নিউ ওয়ার্ল্ড বইটির সাহায্য নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
বিশ্বপরিচয় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে। পঞ্চম সংস্করণ হয় পৌষ ১৩৪৬ এ। বইটি লিখতে রবীন্দ্রনাথের চার বছর সময় নিয়েছিলেন। অন্তত ছয় বছর রবীন্দ্রনাথ এই কাজে জড়িত ছিলন।
এ সময় আরও কয়েকটি বই পড়েন তিনি–
১. দি ইউনিভার্সেস সার্ভেয়ড
২. নারায়ণস ডায়েরি–রাধারমণ ব্যানার্জি
এই সব বই সংগ্রহ করেছেন প্রথম প্রকাশের পর। অন্যান্য সংস্করণে সেগুলো থেকে তথ্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ পরিমার্জন, সংযোজন করেছেন বিশ্বপরিচয়কে।
—————————————————-
(এই মন্তব্যের সকল তথ্যই বিজ্ঞান ও রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থ থেকে কুলদা রায় চুরি ও রাহাজানি এখানে টুকে দিয়েছেন)।
১। প্রথম স্বতঃসিদ্ধের পিছনে যুক্তিটি প্রমথনাথের নিজেরই উদ্ধৃতি,
‘‘সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ। সে এক বিপর্যয় কান্ড। কোনদিন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে সুসংবদ্ধ বাংলা রচনায় হাত দেইনি, দু একটা ছোটখাট রচনা যা লিখেছি তা ছিলো ইংরেজীতে। তাই এই অনভ্যস্ত পথে প্রতিপদে কেবল হোঁচট খেতে হল। এগোন আর হচ্ছিলো না। নিজের লেখা নিজেরই এত খারাপ লাগতে লাগল যে, দু এক পাতা লিখেই তা ছিঁড়ে ফেলতাম। ফলে ছিন্ন কাগজের পাতায় ঝুড়ি ভর্তি হয়ে উঠল। খাতাখানাও সম্বল হারিয়ে ক্রমশঃ শীর্ণকায় হয়ে উঠল। অবশ্য এতে একজন খুব খুশি হলেন, উনুন ধরাবার কাজে অনায়াসলব্ধ এই ছিন্নপত্রগুলো আমার স্ত্রী যথাযথ সদ্গতি করে চললেন।’
২। কার্ল সাগান, মিশিও কাকুর লেখা পড়ে যদি কোন লেখক একই তথ্য নিয়ে নিজের মতো করে লেখেন তাহলে কী সেক্ষেত্রে ওঁদের নাম সহলেখক হিসেবে রাখতে হবে? নাকি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করলেই চলবে? কেউ যদি বইয়ের কোন অংশ লিখে থাকেন তবেই তিনি সহলেখকের কৃতিত্ব দাবী করবেন।
আপনি লিখেছেন, “কিন্তু মৌলিক হোক, না হোক এটা তাদেরই বই, কারণ তারাই বইগুলো শুরু করেছিলেন, শেষও করেছিলেন।” খুবই খাঁটি কথা, প্রমথনাথও শুরু করেছিলেন শেষ করেছিলেন, তার কিছু কিছু বইয়ে ছাপিয়েছিলেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথও লেখা পরিমার্জন করে শুরু করেছিলেন, শেষ করেছিলেন এবং বইয়ে ছাপিয়েছেন।
তর্কের খাতিরে ধরুন, আমি একটি পান্ডুলিপি লিখলাম তাতে একটি মাত্র বাক্য, বাঙালীরা ভাত খায়। এরপর আপনাকে সেটি শোধরানোর জন্য দিলুম। আপনি শুধরিয়ে সেটাকে করলেন, বাঙালীদের অন্যতম প্রিয় খাদ্য হল অন্নব্যঞ্জন। এরপর বইটি নিজের নামে ছাপালেন, এবং আমাকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। এখন তাহলে দুটো পান্ডুলিপি তৈরী হল, একটিতে লেখা আছে ‘বাঙালীরা ভাত খায়’, আরেকটিতে অন্যটি। যেহেতু বাক্য দুটোই আলাদা, এবং তথ্যটিও খুব সাধারণ, তাই আমি আপনার সহলেখক হওয়ার দাবী জানাতে পারব কী?
আসলে এতসমস্ত বিতর্কের অবসান হবে যদি প্রমথনাথের মূল পান্ডুলিপিটি উদ্ধার করে আপনারা দেখান যে, রবীন্দ্রনাথ তথ্যের ক্রমপর্যায় একরেখে শুধুমাত্র ভাষার অদলবদল করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ‘বাঙালীরা ভাত খায়’ এটিকে ‘বাঙালীরা খায় ভাত’ করেছেন।
৩। আমি যেখানে তথ্যের উৎসের কথা বলেছি আপনি সেখানে ভাষার উৎকর্ষতার কথা বলেছেন। (“এরকম ভাবার কারণ…”) মাকড়সা ইত্যাদি নিয়ে উনি যা লিখেছেন তাতে ভাষা কাঁচা থাকতে পারে, কিন্তু তথ্যটি সঠিক ছিল নিশ্চয়ই। এবিষয়ে পুরাতন বাংলা ভাষার যা উদাহরণ আমি দিয়েছি সেবিষয়েও পর্যালোচনা করে থাকতে পারেন। তাছাড়া বিশ্বপরিচয় গ্রন্থ, এবং এই মাকড়সা রচনার মধ্যে সময়কালের কত ফারাক ? তাছাড়া জগদানন্দ রায়, জগদীশ বোস, বিভিন্ন বই যে তথ্যের উৎস নয় একথা আপনি জোর দিয়ে বলছেন কী ভাবে। জেমস জীন্সের বইয়ের কিছু অংশের প্রতিফলন তো আমি বিশ্বপরিচয়ে দেখতে পাই।
৪। আপনি বোধহয় আমার ঐ কোয়ান্টাম তত্ত্ব ও আইন্সটাইন রবীন্দ্রনাথ আলোচনার অংশটুকু ঠিক মতো পড়েন নি। আমি এ কথাই বলেছি, যে ‘আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’ এই কথার উপর ভিত্তি করে কেউ যদি বলেন রবীন্দ্রনাথ কোয়ান্টাম তত্তের মূল সুত্রগুলি বুঝতেন তবে তা কষ্ট কল্পিত আরোপ হবে। এবং এই আরোপের কারণ মেধা ও বোধের অভাব।
৫। শিশুসূলভ এর ব্যাপারটিতে আসা যাক। কী করা যাবে বলুন, আপেল আর কমলালেবুর সাথে তো সত্যই তুলনা চলে না। ধরুন কেউ খুব সাংঘাতিক বিশ্লেষণী মনোবৃত্তির নয়। রবীন্দ্র সাহিত্য তার অবচেতনে গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাতে সে সম্পৃক্ত বোধ করে। মনে করুন সে চিন্তার ‘ক’ স্তরে আছে। ‘খ’ স্তরে আছেন গবেষক মনোবৃত্তির মানুষজন, যাঁরা সবকিছু তলিয়ে দেখতে চান, যাঁদের কাছে অবচেতনের কার্যকলাপের নির্দিষ্ট হদিস আছে। এখন এই দুই স্তরের মানুষজনের মধ্যে তুলনা টানা কী ঠিক। ‘ক’ স্তরের রবীন্দ্রপ্রেমী ও ‘ক’ স্তরের অন্যান্য চিন্তাবিলাসীদের মধ্যে বিরোধ বাধতে পারে। ‘খ’ স্তরের রবীন্দ্রপ্রেমী ও ‘খ’ স্তরের রবীন্দ্রসমালোচকদের মধ্যেও বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু ক বনাম খ স্তর কিছুতেই তুলনীয় নয়। আমার মনে হয়েছে চিন্তার স্তরের উপরে উঠে আপনারা যাদের দিকে স্তবকতার আঙুল তুলছেন তাঁরা হয়তো অন্য স্তরে রয়েছেন।
৬। আমি আগেই বলেছিলাম বড়মাপের বলতে ঠিক কী বোঝানো হয়েছে তা যখন বলা হয়নি তখন কাউকে ছোটোমাপের বলাটা যুক্তিযুক্ত নয়। আপনি যদি বলতেন ‘আইন্সটাইনের তুলনায় উনি বড়মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন না’ তাহলে এই প্রসঙ্গটি উঠত না। এ বিষয়ে দীপঙ্কর বাবুও যদি বড় মাপ টি ঠিক কী তা না বলে এরকম লিখে থাকেন তো তিনিও ভুল করেছেন।
৭। রাশিয়ার চিঠি সংক্রান্ত আমার লেখা বাক্যটি আপনি কোট করেছেন কিন্তু পড়েননি বলেই মনে হয়। আমি কোথাও বলিনি যে রবীন্দ্রনাথ পতনের চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন। আমি বলেছি এটি গবেষকদের ধারণা। সেই ধারণাকে খন্ডন করে আপনারা যদি কিছু লিখতেন তাহলে সেটিই যুক্তিযুক্ত হত। বদলে আপনারা স্রেফ হেসে উড়িয়েছেন। এই জন্যই ঐ আক্ষেপটি ছিল। আমার অনুরোধ রইল আপনাকে, একজন গবেষকের দৃষ্টিতে রাশিয়ার চিঠির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা ও চলতি মতবাদ কে ভুল প্রমাণ করা।
৮। রবীন্দ্রানুরাগ পরিত্যাগ সংক্রান্ত আপনি যে বাক্যটি লিখেছেন তার যুক্তিটি কাঁচা। পরে অবশ্য বিস্তারিত লিখেছেন যে আসলে কী বলতে চেয়েছেন। এটি প্রথমে লিখলে বাক্যের নিতান্ত ‘আইদার অর’ লজিক নিয়ে সমস্যা হত না।
আপনাকে সরল প্রশ্ন, কেউ যদি জীবনভর রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে মেতে থাকেন, সেই সাহিত্যের মধ্যে আধুনিক জীবন বোধ খোঁজেন তাতে অসুবিধা কী? সবাইকেই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্কেপ্টিক্যাল হতে হবে কেন? অন্যপথের যাত্রীদের স্তাবক বলাই বা হবে কেন?
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন, তাই তাঁর ভাবনা চিন্তার সাথে আধুনিক
দর্শনের মেল বন্ধন ঘটালে চাইলে স্তাবক বলে গালাগালি কেন, বরং যুক্তি দিয়ে প্রতিহত করুন।
আরো বলি, কেউ বেদ কোরান উপনিষদের মধ্যে আধুনিক দর্শন যদি খুঁজতে চান তাহলে অসুবিধা তো নেই। এগুলি যখন সৃষ্টি হয়েছে তখন মানবসমাজের আদিদশা। সেই সময়কার অ্যাবস্ট্রাক্ট ভাবনা চিন্তা থেকে বর্তমান আধুনিক দর্শন কিছু শিক্ষণীয় খুঁজে পেলে তা মন্দ কী? তাই বলে ভাববেন না আমি কোরানে বিজ্ঞান, বা আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সাথে পৌরাণিক যুগের যোগসূত্র খোঁজাকে প্রশ্রয় দিই, বা অন্যান্য জোর করে কষ্টকল্পিত ধারনাকে গুরুত্ব দিই। কিন্তু আমি মনে করি পিওর চিরকালীন কিছু দর্শনকে মনে রাখাটাও একপ্রকার কর্তব্য।
ভাল থাকুন।
@যাত্রী,
আমি আপনার সবগুলো প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছি। এখন যা চলছে একই বৃত্তে ঘুরপাক। যা হোক এটার শেষ হলেই ভাল।
উদ্ধৃতি পড়ে কি আপনার ভাষাটা খারাপ মনে হচ্ছে? আমার তো মনে হচ্ছে না। লেখক হিসেবে উনি বিনয় করে কিছু বললেই সেটাকে আপনিও ‘অপাঠ্য’ হিসেবে জাস্টিফাই করবেন কেন?
আপনার প্রশ্নের মধ্যেই কিন্তু এর উত্তর লুকিয়ে আছে। কারো বই পড়ে সেই তথ্য নিয়ে বই লেখা আর কাউকে দিয়ে পুরো পাণ্ডুলিপি লিখিয়ে শেষ বাদ দেয়া এক হল? আপনার কথা মানা যেত, যদি রবীন্দ্রনাথ মূল পাণ্ডুলিপি প্রথম থেকেই নিজে লিখতেন, আর প্রমথনাথকে কেবল বলতেন – তার লেখায় বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো ঠিক আছে কিনা দেখে দিতে (বশীকে দিয়ে যেটা করিয়েছিলেন), অর্থাৎ বইটির রিভিউ করালে। তাহলে নাম না দিলেও চলতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ করেছেন উলটো কাজ। পুরোটাই লিখিয়েছেন প্রমথনাথকে দিয়ে। শেষে নিজে ঘষামাজা করেছেন। তাকে সহলেখক হিসেবেও রাখননি।
বই তো আর একটি লাইন দিয়ে হয় না। বিশ্বপরিচয়ের সবগুলো অধ্যায়ের মূল লেখক ছিলেন প্রমথনাথ। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছেন। কী কারণে তাকে সহ লেখক হিসেবেও রাখার অধিকারটুকু তিনি দিলেন না তা আসলেই আমি বুঝতে অক্ষম, আপনার এই ‘আমি ভাত খাই’ উপমা শোনার পরেও। বইটিতে উনার খুব সিগনিফিকেন্ট কন্ট্রিবিউশন আছে।
ঠিক আছে শুনলাম আপনার অভিমত। আপনার অভিমত অনুযায়ী তারা যদি অন্য স্তরে থাকেন, তাহলে তো আর বলার কিছু নেই। কিন্তু ক স্তরে থাকুক, আর খ স্তরে থাকুক, তারা যে বক্তব্য দেন, বা মিডিয়ায় লেখেন – তা সমস্ত স্তর অতিক্রম করেই গণমানুষের কাছে পৌঁছায়। কাজেই সেখানে দেখা কিংবা পড়া বাক্য কিঙ্গাব অভিমত সমালোচনার বাইরে কিছু নয়। সেভাবে ভাবাটাই আমার কাছে শিশুসুলভ।
‘আইনস্টইনের তুলনায়’ – না বলার কারণে যদি ভুল মনে করেন, তবে এই ভুল স্বীকারে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তাকে জনপ্রিয় বিজ্ঞান বইয়ের লেখক হিসেবে তো স্বীকৃতি দেওয়াই হয়েছে।
হ্যা আপনি বলেননি, কিন্তু যে গবেষকেরা রাশিয়ার চিঠি পড়ে সমাজতন্ত্র পতনের চিহ্ন পেয়েছিলেন সেটাকে আমি ভুল মনে করছি। এ ব্যাপারে তো আমার অভিমত আমি দিয়েছিই। রাশিয়ার চিঠিতে বহু জায়গায় তিনি তাদের সমাজ ব্যবস্থার (মানে সমাজতন্ত্রের) প্রশংসা করেছিলেন। কেবল যে অংশের সমালোচনা করেছিলেন তার প্রেক্ষিতে সেটাকে ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্রের পতনের চিহ্ন ভাবা সরলীকরণই।
ঠিক আছে, শুনলাম আপনার বক্তব্য।
অসুবিধা নেই। কিন্তু আমাদেরও অভিমত থাকতে পারে। ‘স্কেপ্টিক্যাল হতে হবে কেন’ যেমন আপনি প্রশ্ন করেছেন, তেমনি উলটো প্রশ্নও করা যায় – স্কেপ্টিকাল হলেই বা সমস্যা কি? অন্য অনেক বিষয়ই তো স্কেপটিকালি আমরা দেখি। রবীন্দ্রসাহিত্য, তার কীর্তিও বা এই ধারার বাইরে রাখতে হবে কেন?
ঠিক আছে। এখানে আর দ্বিমত করলাম না। তবে, ব্যাপারটা একপেশে যে সবসময় হবে, সেটা তো নয়। আপনি যেমন ভাবছেন, ‘পিওর চিরকালীন কিছু দর্শনকে মনে রাখাটাও একপ্রকার কর্তব্য’ – ভিন্ন কেউ ভিন্নমত দিতেই পারে।
ভাল থাকুন, সুন্দর থাকুন। আলোচনা করে ভাল লাগলো খুব।
@অভিজিৎ,
১। ‘অপাঠ্য’ কেবলমাত্র লোকশিক্ষার জন্য রবীন্দ্রনাথ যেমন চেয়েছিলেন সেই রেফারেন্স অনুযায়ী।
২। আপনি এই যে বার বার বলছেন ‘কাউকে দিয়ে পান্ডুলিপি লিখিয়ে শেষে বাদ দেওয়া’ এর মানে দাঁড়াচ্ছে ঐ পান্ডুলিপিটিই ছাপা অবস্থায় এসেছে। কিন্তু বাস্তবে তা তো নয়। দুটি পান্ডুলিপির হদিস তো দেখতেই পাওয়া যাচ্ছে। কাউকে দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া মানে তো তারটিকে অবিকৃত অবস্থায় রেখে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ তো তা করেননি বলেই মনে হচ্ছে। কুলদা রায় যে বইয়ের অংশ স্ক্যান করে দিয়েছেন তাতে দুটি পান্ডুলিপিতে দুরকম আছে বলেই মনে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে এই অন্যকে দিয়ে পান্ডুলিপি লিখিয়ে ছেপে দেওয়ার যুক্তি কোথায়?
৩। আপনি বলছেন রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছেন। বেশ, তাহলে সম্পাদনার পরিমাণটিও বিচার্য বিশয়। এই জন্যই তো বার বার বলছি প্রমথনাথের মূল পান্ডুলিপিটির খোঁজ করুন। রবীন্দ্রনাথ ঠিক কতখানি সম্পাদনা করেছিলেন নাকি পুরোটাই নিজে লিখেছিলেন তাতেই প্রমাণ হয়ে যাবে।
৪। ওই একটি লাইনের উদাহরণের বদলে ১০০০ লাইনের উদাহরণ ও দিতে পারি। থট এক্সপেরিমেন্ট ১ লাইনের জন্য হলে ১০০০ লাইনের জন্যই বা হবে না কেন?
আলোচনা করে ভালো লাগল। সুস্থ থাকুন।
@যাত্রী,
আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর দিব বলেছিলাম। আজ একটু সময় পেলাম, কিছু কিছু দিলাম –
‘তাঁর রচনা যে অপাঠ্য হবে সে আর রবীন্দ্রনাথ আগেভাগে কী করে জানবেন’ এর উত্তরে বলা যায় তার রচনা মোটেই অপাঠ্য ছিলো না। তিনি আনন্দরূপম বইটা তো লিখেছিলেনই, পরে ‘পৃথ্বীপরিচয়’ নামে আরেকটা বইও নিজ নামে লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে মাথায় তুলতে প্রমথনাথকে অখ্যাদ্য, অপাঠ্য এগুলো বলা যেতেই পারে, আমার অন্ততঃ মনে হয়েছে রবীন্দ্রনাথের অরিজিনাল ‘মাকড়শা সমাজে স্ত্রী জাতির গৌরব’ ধরনের লেখার চেয়ে প্রমথনাথের লেখা মোটেই অখ্যাদ্য গোছের কিছু ছিলো না। আপনিই বা কেন ‘স্বতঃসিদ্ধ’ভাবে ধরে নিলেন প্রমথনাথের লেখা অপাঠ্য ছিলো? কেবল রবীন্দ্রনাথের কাজের বৈধতা দেওয়াটাই কি উদ্দেশ্য নয়?
এটা নিয়ে আগেই আলোচনা হয়েছে। বিস্তৃত আলোচনা নিষ্প্রয়োজন এখানে। পুলার সায়েন্সের বহু বইই মৌলিক নয়, সেটা কার্ল স্যাগান, মিচিও কাকু থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত সবার বইয়ের ক্ষেত্রেই তা বলা যায়। কিন্তু মৌলিক হোক, না হোক এটা তাদেরই বই, কারণ তারাই বইগুলো শুরু করেছিলেন, শেষও করেছিলেন। কার্ল স্যাগানের ‘কসমস’ বইয়ের কোন তথ্যগুলো মৌলিক? কিন্তু সেটা কার্ল স্যাগানের অনিন্দসুন্দর সৃষ্টি, সবাই জানেন, মানেন। তথ্যের অমৌলিকতার দোহাই দিয়ে কেউ এর কৃতিত্ব নিজের বলে দাবী করতে পারবেন না।
ভাবার কারণ, রবীন্দ্রনাথের আগেকার করুণ লেখাগুলো। মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব, গ্রহগন জীবের আবাসভূমি, সামুদ্রিক জীব, বৈজ্ঞানিক সংবাদ এই লেখাগুলো পড়ে নিজেই যাচাই করে দেখুন। নিজেই বুঝবেন, প্রমথনাথের সাথে মিলে লেখা বিশ্বপরিচয় লেখার আগে রবিঠাকুরের বিজ্ঞান লেখার হাত ঠিক কেমন ছিলো। আর তাছাড়া আগেই বলেছি তথ্যের অমৌলিকতার দোহাই দিয়ে কেউ মূল লেখককে বাদ দিয়ে বইয়ের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবী করতে পারেন না।
সেটা আপনার অভিমত। আমাদের মতে এটা সঠিক বিশ্লেষণই ছিলো। সেজন্যই দেখা গেছে পান্ডুলিপির পুরোটুকু প্রমথনাথ শেষ করার পরে বিশ্বপরিচয় থেকে প্রমথনাথকে বাদ দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথের একটা মেকি নাটক তৈরি করতে হয়েছিলো।
শোনেন, আইস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম সাক্ষাৎ হয় ১৯২৬ সালে, কবিগুরুর দ্বিতীয়বার জার্মানী ভ্রমণের সময়। এই প্রথম সাক্ষাৎকারের অবশ্য কোন লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় না। কিন্তু এই সাক্ষেতের প্রেক্ষিতে আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে চিঠিও লিখেছিলেন। তবে, আইনস্টাইনের সঙ্গে ‘বিজ্ঞানের দর্শন’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের আলোচনা হয়েছিলো প্রধানতঃ ১৯৩০ সালে। সেই সময় চার বার তাদের মধ্যে দেখা হয়েছিলো। তিনবার জার্মানীতে, একবার নিউইয়র্কে। সেগুলো আমি সবই জানি।
আইনস্টাইনের আস্থা ছিলো পর্যবেক্ষণ অনপেক্ষ ভৌত বাস্তবতায়। তিনি বিশ্বাস করতেন না মানুষের পর্যবেক্ষণের উপর কখনও ভৌতবাস্তবতার সত্যতা নির্ভরশীল হতে পারে। বোর প্রদত্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কোপেনহেগেনীয় ব্যাখ্যার সাথে তার বিরোধ ছিল মূলতঃ এখানেই। কাজেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোন ব্যাপার এখানে ছিলো না তা সঠিক নয়। আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, -মনুষ্য প্রত্যক্ষণ-নির্ভর সত্যের কথা, যেটা তিনি আইনস্টাইনকেও বলেছিলেন একটি স্মরণীয় উক্তির মাধ্যমে – ‘সত্য তো মানুষের ভেতর দিয়েই প্রতিভাত হয়। (Truth is realized through man)’। এই মনুষ্য প্রত্যক্ষণ-নির্ভর এই সত্যের ব্যাপারটাকে রবীন্দ্রগবেষকেরা শ্যামলী কাব্যগ্রন্থের আমি কবিতার সাথে জুড়ে দিয়েছেন। তিনি নাকি আইনস্টাইনের ভৌতবাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, নিলস বোর, হাইজেনবার্গ, শ্রোয়েডিংজার যে সেসময় কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণাকে বিকশিত করছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তার মর্মার্থ বুঝতে পেরেছিলেন এ নিয়ে প্রথম আলোর মত পত্রিকায় ফেনিয়ে ফেনিয়ে এক সময় লিখেছিলেন জাবেদ সুলতান এবং মুহতাশিম বিল্লাহ । মেধা এবং বোধের অভাব যদি কিছুতে থেকে থাকে সেটা এই প্রবণতাই। কোরানিক বিজ্ঞানের মতোই রবিঠাকুরের পেট থেকে তারা কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বের করতে চান!
তাহলে তো ভালই। শিশুসুলভ আলোচনায় না অংশ নিলেই হয়। আমি নিশ্চিত রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভক্তিগদ গদ লেখা লিখলে আপনি এখানে এসে বলতেন না কোন স্তর ভালো আর কোন স্তর খারাপ, আপেল কমলালেবুর প্রসঙ্গও উহ্য থেকে যেতো তখন । সমস্যা হয়েছে কেবল সমালোচনামূলক কিছু দিক নিয়ে লেখাতেই। ভক্তিগদ গদ গলে গলে পড়া লেখাই বরং আমার কাছে অধিকতর শিশুসুলভ মনে হয়। কী আর করা।
জেমস জীনসের সময় সুপরিচিত প্রতিভা ছিলেন আনস্টাইন। সেই প্রেক্ষাপটে জেমস জীনস অনেকটা আড়ালেই ছিলেন, সে প্রসঙ্গেই এটি বলা। কিন্তু পপুলার সায়েন্সের বেশ কিছু প্রণেতা হিসেবে তার সুনাম ছিল। এটা বলায় দোষের কি হল? আপনি যে দীপঙ্করবাবুকে নিয়ে এত পেরেশন হয়েছেন, তিনিও তার বইয়ে জেমস জীনস সম্বন্ধে একই কথাই বলেছেন – ‘বড় মাপের বিজ্ঞানী না হলেও বিজ্ঞানের জনপ্রিয় গ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে তার খ্যাতি ছিলো। তাঁর লেখা স্নাতকোত্তর শ্রেনীর পাঠ্য হিসেবেও বেশ চলত।‘
না রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার চিঠিতে সমাজতন্ত্রের পতন চিহ্ন দেখতে পাননি। বিপ্লবের মাত্র তের বছর পর রবীন্দ্রনাথ সেখানকার অবস্থা দেখে বরং বহুক্ষেত্রেই অভিভূত হয়েছিলেন। সেখানকার শিক্ষা, সমাজব্যবস্থা নিয়ে অকুণ্ঠ প্রশংসাও করেছেন অফুরন্ত, বলেছেন – ‘রাশিয়ায় এসেছি। না এলে এ জগতের তীর্থ দর্শন অত্যন্ত অসমাপ্ত থাকত’। সেই সঙ্গে তিনি রাশিয়ার কিছু সমালোচনাও করেছিলেন, কিন্তু তারমানে এই নয় যে তিনি দিব্যচোখে সমাজতন্ত্রের পতন দেখতে পেয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে আংশিকভাবে কোট করে ‘নস্ট্রাডামুস’ বানানো অনেকটা ধর্মবাদীদের মতোই। যারা ‘আকাশ ও পৃথিবী এক সাথে মিশে ছিলো’ এই আয়াত উদ্ধৃত করে কোরানে বিগ ব্যাং খোঁজেন, এই মনোভাব তাদের থেকে আলাদা কিছু নয়।
না রবীন্দ্রানুরাগ পরিত্যাগ করতে বলিনি, প্রশ্ন করেছি রবীন্দ্রনাথের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞান দর্শন এ সব খোঁজার মেকি প্রবণতাকে। বাংলাদেশের নামকরা পদার্থবিজ্ঞানী শমশের আলীরা যেমন ‘কোরানিক বিজ্ঞান’ থেকে বেরুতে পারেন না, কোরানের প্রাচীন আয়াতের মধ্যে যাবতীয় আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের অন্বেষণ করেন, ঠিক তেমনি দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের মতো রবীন্দ্র স্তাবকেরা ধর্মগুরুর মতোই রবীন্দ্রনাথকে জ্ঞান করেন, তাকে সঠিক মনে করেন, আর রবীন্দ্র রচনাবলীর মধ্যে সন্ধান করেন আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের। কথাটা ত মিথ্যে বলিনি। অনেক রবীন্দ্রস্তাবকদের মধ্যেই এই প্রবণতাটি লক্ষ্য করা যায়। সাদৃশ্যগত প্যাটার্ণটি উল্লেখ করতেই এটি বলা। অন্য কিছুর জন্য নয়।
ভাল থাকুন।
কুলদা রায়,
মূল প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে মন্তব্যের ফ্লাডিং করছেন দেখছি। বিশ্বপরিচয় চ্যাপ্টারওয়াইজ এখানে তুলে দেওয়ার কোন কারণ খুঁজে পেলাম না। বিশ্বপরিচয়ের ভাষা যে রবীন্দ্রনাথের সেটা তো আমাদের জানাই। কিন্তু বইটার ইতিহাস জানুন। প্রমথনাথকে দিয়ে পান্ডুলিপি লিখিয়েছিলেন সবগুলো চ্যাপ্টারই প্রমথনাথকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন, সেটা আনন্দরূপম বইয়েও আছে, আছে এর উল্লেখ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণেও। আর বাকী কৃতিত্ব – মানে কেবল ‘রবীন্দ্রনাথের বই’ হবার জন্য যতটুকু করার তিনি তো তা পরে করেছেনই।
@অভিজিৎ,
মহামূর্খ লোকতো আমরা। ধরেই নিয়েছেন যে বিশ্বপরিচয় আমরা পড়ি নি। সে কারণেই হয়তো এ কাজ করছেন তিনি।
@ফরিদ আহমেদ, এবার আপনি চ্যাপ্টার ওয়াইজ প্রমথনাথ সেনগুপ্তর বইটি তুলে দিন। চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি–আপনি পারবেন না। কারণ বইটি আপনি চোখেই দেখেননি। কানে শুনেছেন।
@কুলদা রায়,
“এবার আপনি চ্যাপ্টার ওয়াইজ প্রমথনাথ সেনগুপ্তর বইটি তুলে দিন। চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি–আপনি পারবেন না। কারণ বইটি আপনি চোখেই দেখেননি। কানে শুনেছেন।”
এখানে কোন বইটার কথা বাব্রবার বলা হছেছ ? , বিশ্বপরিচয় , আনন্দরুপম , নাকি অন্য কোন বই … যা কিনা প্রমথনাথ এর একান্ত নিজস্ব যাকে …প্রমথনাথ এর বইটা… বলেছেন? । প্রমথনাথ কি নিজের নামে ও বিশ্বপরিচয় এর কোন ভার্সন বের করেছিলেন ?…একটু খোলাসা করুন না দাদা ।
@সপ্তক, প্রমথনাথের বইটির পাণ্ডলিপি আর রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় থেকে চ্যাপ্টারওয়াইজ তুলে দিলে বলছি।
@অভিজিৎ, তথ্যকে চেপে গিয়েছিলেন। সেটাই হাজির করা হচ্ছে। —
@কুলদা রায়,
তো এতে তথ্য চেপে যাওয়ার কি হল? বশী সেনকে দিয়ে পুরোটুকু পড়িয়েছেন। সে ভালকথা। কিন্তু বইটির উপকরণ যে প্রমথনাথ তৈরি করেছিলেন, এবং সেটিই যে তিনি আলমোড়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেটি তো মিথ্যে নয়।
আলমোড়ায় যাবার ঠিক আগের দিন ঠিক কি হয়েছিলো ভাল করে খোঁজ নিন। সেদিন রবীন্দ্রনাথই ডঃ ধীরেন্দ্রনাথকে প্রমথনাথের বাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আর তারপর থেকেই ভিন্ন নাটক করে প্রমথনাথকে বাদ দেয়া হয়ছিল, তার উল্লেখ আনন্দরূপম বইয়ের ১৫০ পৃষ্ঠায় আছে। উদ্ধৃত করি –
গুরুদেরবের আলমোড়া যাবার আগের দিন অপরাহ্নে ‘বিশ্বপরিচয়’র সমগ্র পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে পৌঁছিয়ে দিতে হবে এই ছিল তার নির্দেশ। পাণ্ডুলিপি তৈরি করে গুরুদেবকে দিয়ে আসব বলে বাড়ি থেকে বের হতেই দেখি ডকটর সেন দরজার সামনে। বললেন, ‘আপনার বইয়ের ম্যানাসক্রিপ্ট নিয়ে গুরুদেবের কাছে যাচ্ছেন বুঝি, আমাকেও ডেকেছেন, চলুননা একসঙ্গে যাই।’ …খুব আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেব পাণ্ডুলিপিটা গ্রহন করলেন।, বললেন যে, আলমেড়ায় নিভৃতে বসে ভাষার দিকটা আরো ঘষামাজা করার সময় পাবেন। ডক্টর সেন হঠাৎ ওঁকে বললেন, বিশ্বপরিচয় নিয়ে আপনি যে পরিশ্রম করেছেন তাতে বইটার যুক্তগ্রন্থকার হওয়া উচিৎ – রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ। ‘গুরুদেব’ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, সে কীরে, বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে। আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথেরই হওয়া উচিৎ। তবে আমার নামের সাথে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চান, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে।
এখানে রবীন্দ্রনাথ নাটক করে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ ঠিক করলেও আসলে ঠিকই করে ফেলেছিলেন যে, বইয়ের লেখক হিসেবে প্রমথনাথকে রাখবেন না। সেজন্যই প্রমথনাথ লিখেছেন –
ওঁর কথা বলার ধরণ দেখে মনে হল, কোথায় যেন একটা সংশয় জেগেছে, অবশ্য এ ব্যাপারে তাকে খোলাখুলি জিজ্ঞাসা করাও সম্ভব নয় (পৃঃ ১৫০)
গুরুদেব প্রমথনাথকে বাদ দেয়ার ব্যাপারটা পরিস্কার করেন আলমোড়া থেকে ফিরে এসে। প্রমথনাথ লিখেছেন (পৃঃ ১৫১) –
‘গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন। উত্তরায়ণে গিয়ে দেখি ক্ষিতিমোহনবাবু ও শাস্ত্রীমহাশয়ের সঙ্গে তিনি কথা বলছেন, আমাকে ডেকে সস্নেহে পাশে বসালেন, কুশল প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, “দেখো, বিশ্বপরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না। ” একটু থেকে বললেন, “অবশ্য তুমি শুরু না করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না, তা ছাড়া বিজ্ঞানের অনভ্যস্ত পথে চলতে শেষপর্যন্ত এই অধ্যবসায়ীর সাহসে কুলাতো না। তুমি ক্ষুন্ন হয়ো না।
এ বিষয়ে আমার আর কিছু বলার নেই। বাকিটা পাঠকেরাই বুঝবে।
@অভিজিৎ,
প্রমথ নাথ এর মূল পাণ্ডুলিপি যা রবিন্দ্রনাথ এর খোল-নলচে বদলানোর পুরবেরটি এখন আমাদের পাঠকদের জন্য হুবহু দরকার , যদি কিনা শেষ বিচার এর দায়িত্ব পাঠক এর উপরে দেয়া হয় । বিশ্বপরিচয় ( রবিন্দ্রনাথ এর নামে প্রকাশিত ) এবং প্রমথ নাথ এর মুল পান্দুলিপিটি ( খল-নলচে বদলানো্র আগেরটি )মুক্তমনাতে আপলোড করা যায় না ?(নাকি মামার বাড়ির আব্দার হয়ে গেল ? ) 😉
@অভিজিৎ,
এটা কি রবীন্দ্রনাথের প্রেতাত্মা অভিজিত রায়ের কানে কানে বলে গেছেন??? :lotpot:
না অভিজিত রায় কোন টাইম মেশিন আবিস্কার করেছেন? :clap থুরি-মনে হয় কোন মাইন্ড স্কানার ও আবিস্কার করেছেন 😉 এই দুই আবিস্কারের জন্যে আমরা উনাকে নোবেল প্রাইজের জন্য মনোনীত করতে পারি :guru:
কুলাদার রায়ের দেওয়া তথ্য এবং রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য থেকে কি বোঝা যাচ্ছে?
(১) প্রমথনাথ এর আগে বাংলায় কোন প্রবন্ধ লেখেন নি-সুতরাং উনি যা লিখেছিলেন, তার মান কি হবে, বোধগম্য।
(২) রবীন্দ্রনাথ আলমোড়াতে গেলেন-দেখলেন, সবটাই প্রথম থেকে লিখতে হচ্ছে। পুড়ো লেখাটাই আবার নিজে লিখলেন।
(৩) এবং সেটা জানালেন ও- যে যেহেতু পুরোটাই তাকে নিজে লিখতে হয়েছে, লেখক হিসাবে প্রমথনাথের নাম যাবে না।
এর মধ্যে অনৈতিক কিছুই নেই। প্রমথনাথ রবীন্দ্রসান্নিধ্যে এর পড়েও বই লিখেছেন।
যা তথ্য দেওয়া হয়েছে, তার ভিত্তিতে এটা বোঝা কি খুব কষ্টের?
তবে এই প্রবন্ধে অভিজিত রায় যে যুক্তি দিচ্ছেন, তাতে তিনি যুক্তিবাদি আন্দোলন বন্ধ করে রটনাবাদি আন্দোলনের জন্যে অধিকতর যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন :rotfl:
@বিপ্লব পাল,
টাইম মেশিন লাগবে কেন? আলমোড়া যাবার আগেরদিনই তো রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন –
‘বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ তো প্রমথই করেছে। আমি শুধু ভাষার দিকটা দেখে দিয়েছি। গ্রন্থকার তো প্রমথেরই হওয়া উচিৎ। তবে আমার নামের সাথে যদি প্রমথ যুক্ত করতে চান, তাহলে প্রমথনাথ-রবীন্দ্রনাথ হওয়াই ঠিক হবে’।
অথচ আলমোড়া গিয়ে সাথে সাথেই একেবারে পুরো বই নতুন করে লিখে ফেললেন, যে প্রমথনাথের করা ‘বইটার বিষয়বস্তু রচনার কাজ’ একেবারে উধাও হয়ে গেল। পুরোটাই হয়ে গেল রবীন্দ্রনাথের। ভাগ্যিস Ye banks and braes, কিংবা পুরানো সব দিনের কথার মূল গানগুলো ইউটিউবে আছে, গগন হরকরার মূল গানের সুর ইস্নিপ্সে আছে, নাহলে ওগুলোও এভাবে বলে দেওয়া হত যে, সুরগুলো পুরোটাই এমনভাবে নতুন করে তৈরি করেছিলেন যে ক্রিডিট না দিলেও চলে, কি বল?
হ্যা, রটনাবাদী আন্দোলন আর বলা হত না,
-যদি আমরা বলতাম – প্রমথনাথ বিশ্বপরিচয়ের সাথে একেবারেই যুক্ত ছিলেন না, পুরোটাই আগাগোড়া লিখেছিলেন রবিঠাকুর।
– যদি বলতাম – Ye banks and braes থেকে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলের সুর আসে নি, বরং রবীন্দ্রনাথের সুরটাই বসিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে Ye banks and braes।
– যদি লিখতাম রবীন্দ্রনাথের জমিদারী শাসন এমন শান্তিময় ছিলো যে কাঙাল হরিনাথ কেন, কোন প্রজার বুকে একটি আঁচরও লাগেনি। ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দুশ ঘর প্রজার বিদ্রোহ ফিদ্রোহ সব বানানো।
-যদি বলতাম আমাদের জাতীয়সংগীতের সুর পুরোটাই রবীন্দ্রনাথের। গগন হরকরার সুরের সাথে মিল স্রেফ কাকতালীয়, কিংব ঘটনাচক্রের সমাপতন।
কি বল? একেবারে পার্ফেক্ট আন্দোলন হত তোমাদের জন্য।
@অভিজিৎ,
এটাই হয়েছে। প্রমথ নাথে কথা অনুযায়ী এর আগে তিনি বাংলায় কোন প্রবন্ধ লেখেন নি-এমন একজনের বাংলা লেখা যদি রবীন্দ্রনাথ পরিমার্জনা করতে যান- এবং যেখানে দেখা যাচ্ছে বই টির ১০০% ভাষা রবীন্দ্রনাথেরই-তাহলে এটা অসম্ভব কোথায়?
প্রমথনাথের নথিটিত নেই।
সুতরাং অপরাধের বিচারে সারকামস্টানশিয়াল বা করোবোরেটিভ এভিডেন্স ছারা আর ত কিছু পেশ করার নেই তোমার।
সেক্ষেত্রে এটা পরিস্কার ওই ভাষা এবং থিম তৈরী করা প্রমথনাথের পক্ষে অসম্ভব। সুতরাং একে ত তোমাদের হাতে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই-তারপর রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথনাথ দুজনের কথা থেকে পরিস্কার রবীন্দ্রনাথ যা পরিমার্জনা করেছেন, তাতে বইটির এ টু জেড তাকে নতুন করেই লিখতে হয়েছে। :-Y
বিশ্বপরিচয়ের প্রথম পর্ব–
পরমাণুলোক
আমাদের সজীব দেহ কতকগুলি বোধের শক্তি নিয়ে জন্মেছে, যেমন দেখার বোধ, শোনার বোধ, ঘ্রাণের বোধ, স্বাদের বোধ, স্পর্শের বোধ। এইগুলিকে বলি অনুভূতি। এদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ভালোমন্দ-লাগা, আমাদের সুখদুঃখ।
আমাদের এই-সব অনুভূতির সীমানা বেশি বড়ো নয়। আমরা কতদূরই বা দেখতে পাই, কতটুকু শব্দই বা শুনি। অন্যান্য বোধগুলিরও দৌড় বেশি নয়। তার মানে আমরা যেটুকু বোধশক্তির সম্বল নিয়ে এসেছি সে কেবল এই পৃথিবীতেই আমাদের প্রাণ বাঁচিয়ে চলার হিসাবমত। আরো কিছু বাড়তি হাতে থাকে। তাতেই আমরা পশুর কোঠা পেরিয়ে মানুষের কোঠায় পৌঁছতে পারি।
যে নক্ষত্র থেকে এই পৃথিবীর জন্ম, যার জ্যোতি এর প্রাণকে পালন করছে সে হচ্ছে সূর্য। এই সূর্য আমাদের চার দিকে আলোর পর্দা টাঙিয়ে দিয়েছে। পৃথিবীকে ছাড়িয়ে জগতে আর যে কিছু আছে তা দেখতে দিচ্ছে না। কিন্তু দিন শেষ হয়, সূর্য অস্ত যায়, আলোর ঢাকা যায় সরে; তখন অন্ধকার ছেয়ে বেরিয়ে পড়ে অসংখ্য নক্ষত্র। বুঝতে পারি জগৎটার সীমানা পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে গেছে। কিন্তু কতটা যে দূরে তা কেবল অনুভূতিতে ধরতে পারি নে।
সেই দূরত্বের সঙ্গে আমাদের একমাত্র যোগ চোখের দেখা দিয়ে। সেখান থেকে শব্দ আসে না, কেননা, শব্দের বোধ হাওয়ার থেকে। এই হাওয়া চাদরের মতোই পৃথিবীকে জড়িয়ে আছে। এই হাওয়া পৃথিবীর মধ্যেই শব্দ জাগায়, এবং শব্দের ঢেউ চালাচালি করে। পৃথিবীর বাইরে ঘ্রাণ আর স্বাদের কোনো অর্থই নেই। আমাদের স্পর্শবোধের সঙ্গে আমাদের আর-একটা বোধ আছে, ঠাণ্ডা-গরমের বোধ। পৃথিবীর বাইরের সঙ্গে আমাদের এই বোধটার অন্তত এক জায়গায় খুবই যোগ আছে। সূর্যের থেকে রোদ্দুর আসে, রোদ্দুর থেকে পাই গরম। সেই গরমে আমাদের প্রাণ। সূর্যের চেয়ে লক্ষ গুণ গরম নক্ষত্র আছে। তার তাপ আমাদের বোধে পৌঁছয় না। কিন্তু সূর্যকে তো আমাদের পর বলা যায় না। অন্য যে-সব অসংখ্য নক্ষত্র নিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সূর্য তাদের মধ্যে সকলের চেয়ে আমাদের আত্মীয়। তবু মানতে হবে, সূর্য পৃথিবীর থেকে আছে দূরে। কম দূরে নয়, প্রায় ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইল তার দূরত্ব। শুনে চমকে উঠলে চলবে না। যে ব্রহ্মাণ্ডে আমরা আছি এখানে ঐ দূরত্বটা নক্ষত্রলোকের সকলের চেয়ে নীচের ক্লাসের। কোনো নক্ষত্রই ওর চেয়ে পৃথিবীর কাছে নেই।
এই-সব দূরের কথা শুনে আমাদের মনে চমক লাগে তার কারণ জলে মাটিতে তৈরি এই পিণ্ডটি, এই পৃথিবী, অতি ছোটো। পৃথিবীর দীর্ঘতম লাইনটি অর্থাৎ তার বিষুবরেখার কটিবেষ্টন ঘুরে আসবার পথ প্রায় পঁচিশ হাজার মাইল মাত্র। বিশ্বের পরিচয় যতই এগোবে ততই দেখতে পাবে জগতের বৃহত্ত্ব বা দূরত্বের ফর্দে এই পঁচিশ হাজার সংখ্যাটা অত্যন্ত নগণ্য। পূর্বেই বলেছি আমাদের বোধশক্তির সীমা অতি ছোটো। সর্বদা যেটুকু দূরত্ব নিয়ে আমাদের কারবার করতে হয় তা কতটুকুই বা। ঐ সামান্য দূরত্বটুকুর মধ্যেই আমাদের দেখার আমাদের চলাফেরার বরাদ্দ নির্দিষ্ট।
কিন্তু পর্দা যখন উঠে গেল, তখন আমাদের অনুভূতির সামান্য সীমানার মধ্যেই বৃহৎ বিশ্ব নিজেকে নিতান্ত ছোটো করে একটুখানি আভাসে জানান দিলে, তা না হলে জানা হতই না; কেননা, বড়ো দেখার চোখ আমাদের নয়। অন্য জীবজন্তুরা এইটুকু দেখাই মেনে নিলে। যতটুকু তাদের অনুভূতিতে ধরা দিল ততটুকুতেই তারা সন্তুষ্ট হল। মানুষ হল না। ইন্দ্রিয়বোধে জিনিসটার একটূ ইশারা মাত্র পাওয়া গেল। কিন্তু মানুষের বুদ্ধির দৌড় তার বোধের চেয়ে আরো অনেক বেশি, জগতের সকল দৌড়ের সঙ্গেই সে পাল্লা দেবার স্পর্ধা রাখে। সে এই প্রকাণ্ড জগতের প্রকাণ্ড মাপের খবর জানতে বেরল, অনুভূতির ছেলেভুলোনো গুজব দিলে বাতিল করে। ন’কোটি ত্রিশ লক্ষ মাইলকে আমরা কোনোমতেই অনুভব করতে পারি নে, কিন্তু বুদ্ধি হার মানলে না, হিসেব কষতে বসল
বিশ্বপরিচয়ের ভূমিকা–
শ্রীযুক্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু
প্রীতিভাজনেষু
এই বইখানি তোমার নামের সঙ্গে যুক্ত করছি। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে এমন বিজ্ঞানসম্পদ নেই যা বিনা সংকোচে তোমার হাতে দেবার যোগ্য। তা ছাড়া, অনধিকারপ্রবেশে ভুলের আশঙ্কা করে লজ্জা বোধ করছি, হয়তো তোমার সম্মান রক্ষা করাই হল না।
শিক্ষা যারা আরম্ভ করেছে, গোড়া থেকেই বিজ্ঞানের ভাণ্ডারে না হোক, বিজ্ঞানের আঙিনায় তাদের প্রবেশ করা অত্যাবশ্যক। এই জায়গায় বিজ্ঞানের সেই প্রথমপরিচয় ঘটিয়ে দেবার কাজে সাহিত্যের সহায়তা স্বীকার করলে তাতে অগৌরব নেই। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি এ কাজ শুরু করেছি। কিন্তু এর জবাবদিহি একা কেবল সাহিত্যের কাছেই নয়, বিজ্ঞানের কাছেও বটে। তথ্যের যাথার্থ্যে এবং সেটাকে প্রকাশ করবার যাথাযথ্যে বিজ্ঞান অল্পমাত্রও স্খলন ক্ষমা করে না। অল্প সাধ্যসত্ত্বেও যথাসম্ভব সতর্ক হয়েছি। বস্তুত আমি কর্তব্যবোধে লিখেছি কিন্তু কর্তব্য কেবল ছাত্রের প্রতি নয় আমার নিজের প্রতিও। এই লেখার ভিতর দিয়ে আমার নিজেকেও শিক্ষা দিয়ে চলতে হয়েছে। এই ছাত্রমনোভাবের সাধনা হয়তো ছাত্রদের শিক্ষাসাধনার পক্ষে উপযোগী হতেও পারে।
আমার কৈফিয়তটা তোমার কাছে একটু বড়ো করেই বলতে হচ্ছে, তা হলেই এই লেখাটি সম্বন্ধে আমার মনস্তত্ত্ব তোমার কাছে স্পষ্ট হতে পারবে।
বিশ্বজগৎ আপন অতিছোটোকে ঢাকা দিয়ে রাখল, অতিবড়োকে ছোটো করে দিল, কিংবা নেপথ্যে সরিয়ে ফেলল। মানুষের সহজ শক্তির কাঠামোর মধ্যে ধরতে পারে নিজের চেহারাটাকে এমনি করে সাজিয়ে আমাদের কাছে ধরল। কিন্তু মানুষ আর যাই হোক সহজ মানুষ নয়। মানুষ একমাত্র জীব যে আপনার সহজ বোধকেই সন্দেহ করেছে, প্রতিবাদ করেছে, হার মানাতে পারলেই খুশি হয়েছে। মানুষ সহজশক্তির সীমানা ছাড়াবার সাধনায় দূরকে করেছে নিকট, অদৃশ্যকে করেছে প্রত্যক্ষ দুর্বোধকে দিয়েছে ভাষা। প্রকাশলোকের অন্তরে আছে যে অপ্রকাশলোক, মানুষ সেই গহনে প্রবেশ করে বিশ্বব্যাপারের মূলরহস্য কেবলই অবারিত করছে। যে সাধনায় এটা সম্ভব হয়েছে তার সুযোগ ও শক্তি পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই নেই। অথচ যারা এই সাধনার শক্তি ও দান থেকে একেবারেই বঞ্চিত হল তারা আধুনিক যুগের প্রত্যন্তদেশে একঘরে হয়ে রইল।
বড়ো অরণ্যে গাছতলায় শুকনো পাতা আপনি খসে পড়ে, তাতেই মাটিকে করে উর্বরা। বিজ্ঞানচর্চার দেশে জ্ঞানের টুকরো জিনিসগুলি কেবলই ঝরে ঝরে ছড়িয়ে পড়ছে। তাতে চিত্তভূমিতে বৈজ্ঞানিক উর্বরতার জীবধর্ম জেগে উঠতে থাকে। তারই অভাবে আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতার্থ করে রাখছে।
আমাদের মতো আনাড়ি এই অভাব অল্পমাত্র দূর করবার চেষ্টাতেও প্রবৃত্ত হলে তারাই সব চেয়ে কৌতুক বোধ করবে যারা আমারই মতো আনাড়ির দলে। কিন্তু আমার তরফে সামান্য কিছু বলবার আছে। শিশুর প্রতি মায়ের ঔৎসুক্য আছে কিন্তু ডাক্তারের মতো তার বিদ্যা নেই। বিদ্যাটি সে ধার করে নিতে পারে কিন্তু ঔৎসুক্য ধার করা চলে না। এই ঔৎসুক্য শুশ্রূষায় যে-রস জোগায় সেটা অবহেলা করবার জিনিস নয়।
আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য। কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না। আমার বয়স বোধ করি তখন নয়-দশ বছর; মাঝে মাঝে রবিবারে হঠাৎ আসতেন সীতানাথ দত্ত [ ঘোষ ] মহাশয়। আজ জানি তাঁর পুঁজি বেশি ছিল না, কিন্তু বিজ্ঞানের অতি সাধারণ দুই-একটি তত্ত্ব যখন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিতেন আমার মন বিস্ফারিত হয়ে যেত। মনে আছে আগুনে বসালে তলার জল গরমে হালকা হয়ে উপরে ওঠে আর উপরের ঠাণ্ডা ভারী জল নীচে নামতে থাকে, জল গরম হওয়ার এই কারণটা যখন তিনি কাঠের গুঁড়োর যোগে স্পষ্ট করে দিলেন, তখন অনবচ্ছিন্ন জলে একই কালে যে উপরে নীচে নিরন্তর ভেদ ঘটতে পারে তারই বিস্ময়ের স্মৃতি আজও মনে আছে। যে ঘটনাকে স্বতই সহজ বলে বিনা চিন্তায় ধরে নিয়েছিলুম সেটা নয় এই কথাটা বোধ হয় সেই প্রথম আমার মনকে ভাবিয়ে তুলেছিল। তার পরে বয়স তখন হয়তো বারো হবে (কেউ কেউ যেমন রঙ-কানা থাকে আমি তেমনি তারিখ-কানা এই কথাটি বলে রাখা ভালো) পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে। সমস্ত দিন ঝাঁপানে করে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় পৌঁছতুম ডাকবাংলায়। তিনি চৌকি আনিয়ে আঙিনায় বসতেন। দেখতে দেখতে, গিরিশৃঙ্গের বেড়া-দেওয়া নিবিড় নীল আকাশের স্বচ্ছ অন্ধকারে তারাগুলি যেন কাছে নেমে আসত। তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন। শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন। তিনি যা বলে যেতেন তাই মনে করে তখনকার কাঁচা হাতে আমি একটা বড়ো প্রবন্ধ লিখেছি। স্বাদ পেয়েছিলুম বলেই লিখেছিলুম, জীবনে এই আমার প্রথম ধারাবাহিক রচনা, আর সেটা বৈজ্ঞানিক সংবাদ নিয়ে।
তার পরে বয়স আরো বেড়ে উঠল। ইংরেজি ভাষা অনেকখানি আন্দাজে বোঝবার মতো বুদ্ধি তখন আমার খুলেছে। সহজবোধ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই যেখানে যত পেয়েছি পড়তে ছাড়ি নি। মাঝে মাঝে গাণিতিক দুর্গমতায় পথ বন্ধুর হয়ে উঠেছে, তার কৃচ্ছ্রতার উপর দিয়ে মনটাকে ঠেলে নিয়ে গিয়েছি। তার থেকে একটা এই শিক্ষা লাভ করেছি যে, জীবনে প্রথম অভিজ্ঞতার পথে সবই যে আমরা বুঝি তাও নয় আর সবই সুস্পষ্ট না বুঝলে আমাদের পথ এগোয় না এ কথাও বলা চলে না। জলস্থল-বিভাগের মতোই আমরা যা বুঝি তার চেয়ে না বুঝি অনেক বেশি, তবুও চলে যাচ্ছে এবং আনন্দ পাচ্ছি। কতক পরিমাণে না-বোঝাটাও আমাদের এগোবার দিকে ঠেলে দেয়। যখন ক্লাসে পড়াতুম এই কথাটা আমার মনে ছিল। আমি অনেক সময়েই বড়োবয়সের পাঠ্যসাহিত্য ছেলেবয়সের ছাত্রদের কাছে ধরেছি। কতটা বুঝেছে তার সম্পূর্ণ হিসাব নিই নি, হিসাবের বাইরেও তারা একরকম করে অনেকখানি বোঝে যা মোটে অপথ্য নয়। এই বোধটা পরীক্ষকের পেনসিলমার্কার অধিকারগম্য নয় কিন্তু এর যথেষ্ট মূল্য আছে। অন্তত আমার জীবনে এইরকম পড়ে-পাওয়া জিনিস বাদ দিলে অনেকখানিই বাদ পড়বে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলুম। এই বিষয়ের বই তখন কম বের হয় নি। স্যার রবর্ট বল-এর বড়ো বইটা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে। এই আনন্দের অনুসরণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নিউকোম্ব্স, ফ্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি – গলাধঃকরণ করেছি শাঁসসুদ্ধ বীজসুদ্ধ। তার পরে এক সময়ে সাহস করে ধরেছিলুম প্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে হক্সলির এক সেট প্রবন্ধমালা। জ্যোতির্বিজ্ঞান আর প্রাণবিজ্ঞান কেবলই এই দুটি বিষয় নিয়ে আমার মন নাড়াচাড়া করেছে। তাকে পাকা শিক্ষা বলে না, অর্থাৎ তাতে পাণ্ডিত্যের শক্ত গাঁথুনি নেই। কিন্তু ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধবিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক পরিমাণে রক্ষা করেছে। অথচ কবিত্বের এলাকায় কল্পনার মহলে বিশেষ যে লোকসান ঘটিয়েছে সে তো অনুভব করি নে।
আজ বয়সের শেষপর্বে মন অভিভূত নব্যপ্রাকৃততত্ত্বে – বৈজ্ঞানিক মায়াবাদে। তখন যা পড়েছিলুম তার সব বুঝি নি। কিন্তু পড়ে চলেছিলুম। আজও যা পড়ি তার সবটা বোঝা আমার পক্ষে অসম্ভব, অনেক বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতের পক্ষেও তাই।
পাণ্ডিত্য বেশি নেই সুতরাং সেটাকে বেমালুম করে রাখতে বেশি চেষ্টা পেতে হয় নি। চেষ্টা করেছি ভাষার দিকে। বিজ্ঞানের সম্পূর্ণ শিক্ষার জন্যে পারিভাষিকের প্রয়োজন আছে। কিন্তু পারিভাষিক চর্ব্যজাতের জিনিস। দাঁত-ওঠার পরে সেটা পথ্য। সেই কথা মনে করে যতদূর পারি পরিভাষা এড়িয়ে সহজ ভাষার দিকে মন দিয়েছি।
এই বইখানিতে একটি কথা লক্ষ্য করবে – এর নৌকোটা অর্থাৎ এর ভাষাটা যাতে সহজে চলে সে চেষ্টা এতে আছে কিন্তু মাল খুব বেশি কমিয়ে দিয়ে একে হালকা করা কর্তব্য বোধ করি নি। দয়া করে বঞ্চিত করাকে দয়া বলে না। আমার মত এই যে, যাদের মন কাঁচা তারা যতটা স্বভাবত পারে নেবে, না পারে আপনি ছেড়ে দিয়ে যাবে, তাই বলে তাদের পাতটাকে প্রায় ভোজ্যশূণ্য করে দেওয়া সদ্ব্যবহার নয়। যে-বিষয়টা শেখবার সামগ্রী, নিছক ভোগ করবার নয়, তার উপর দিয়ে অবাধে চোখ বুলিয়ে যাওয়াকে পড়া বলা যায় না। মন দেওয়া এবং চেষ্টা করে বোঝাটাও শিক্ষার অঙ্গ, সেটা আনন্দেরই সহচর। নিজের যে-শিক্ষার চেষ্টা বাল্যকালে নিজের হাতে গ্রহণ করেছিলুম তার থেকে আমার এই অভিজ্ঞতা। এক বয়সে দুধ যখন ভালোবাসতুম না, তখন গুরুজনদের ফাঁকি দেবার জন্যে দুধটাকে প্রায় আগাগোড়া ফেনিয়ে বাটি ভরতি করার চক্রান্ত করেছি। ছেলেদের পড়বার বই যাঁরা লেখেন, দেখি তাঁরা প্রচুর পরিমাণে ফেনার জোগান দিয়ে থাকেন। এইটে ভুলে যান, জ্ঞানের যেমন আনন্দ আছে তেমনি তার মূল্যও আছে, ছেলেবেলা থেকে মূল্য ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস হতে থাকলে যথার্থ আনন্দের অধিকারকে ফাঁকি দেওয়া হয়। চিবিয়ে খাওয়াতেই একদিকে দাঁত শক্ত হয় আর-একদিকে খাওয়ার পুরো স্বাদ পাওয়া যায়, এ বই লেখবার সময়ে সে কথাটা সাধ্যমতো ভুলি নি।
আমার অসুখ অবস্থায় স্নেহাস্পদ শ্রীযুক্ত রাজশেখর বসু মহাশয় যত্ন করে প্রুফ সংশোধন করে দিয়ে বইখানি প্রকাশের কাজে আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন; এজন্য আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ।
শান্তিনিকেতন
২রা আশ্বিন ১৩৪৪
@অভিজিত, সেক্রেটারীর উদাহরণ একটি নিছকই উদাহরণ, সেটার সাথে প্রমথনাথকে ছোট করে দেখার কোন সম্পর্ক নেই। বরং জেমস জীনস সম্পর্কে আপনার উক্তিই অবমাননাজনক। আসলে এমনটাই হয়, ছিদ্র অণ্বেষণ করতে গিয়ে সবকিছুতেই ভূত দেখা স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়। আপনি যদি ভাবেন ঐ উদাহরণটি দিয়ে আমি প্রমথনাথ কে সেক্রেটারী বানানোর চেষ্টা করেছি, তাহলে আপনি নিতান্তই ভুল বুঝেছেন, বা এটিও আপনার অন্যান্য অভিযোগের মতো কষ্ট কল্পিত।
মূল প্রশ্নটি আপনি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছেন, সেটি হল তথ্য গুলি কতটা দূর্লভ বা সহজলভ্য ছিল? রবীন্দ্রনাথের কাছে তথ্যগুলি একেবারেই অপরিচিত ছিল কিনা?
‘মাকড়সা সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব’ এই লেখাটি রবীন্দ্রনাথ কাদের জন্য লিখেছেন? সেটি অখাদ্য না সুখাদ্য সেটির ধারণা ব্যক্তিনিরপেক্ষ। তাছাড়া লেখাগুলিকে সেই সময়কার প্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। একটি উদাহরণ দিই, বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা ভাষায় পাংচুয়েশনের অস্তিত্ব ছিল না। সুতরাং সেই সময়কার লেখা পড়ে আপনার অখাদ্যও মনে হতে পারে। কিন্তু সেগুলির বিচার অন্যভাবে করতে হবে।
রবীন্দ্রনাথকে চোখ বুজে সমর্থন করতে গিয়ে আমি কোথাও চলে যাই নি রে ভাই। আশ্চর্য হচ্ছি আপনি মৌলিক অবদানের প্রশ্নটি বুঝতে পারছেন না দেখে। আমার বইতে যদি আমার আবিষ্কৃত কোন মৌলিক তথ্য থাকে, এবং সেগুলি কেউ যদি নিজের নামে ছাপানোর ব্যবস্থা করে তাহলে অবশ্যই তা আপত্তিজনক। কিন্তু প্রশ্ন এইটাই যে, যে তথ্য আমার মৌলিক অবদান নয়, তার উপর আমি কোন ক্লেম করতে পারি কীনা। এই প্রসঙ্গেই ঐ উদাহরণটি দিয়েছিলাম।
আপনাকে বরং বলব, জেমস জীনসের বইটি ডাউনলোড করে দেখুন। ঐ বইটির অধ্যায় ইত্যাদির সাথে বিশ্বপরিচয়ের কী অদ্ভুত মিল। কোন সন্দেহ নেই, রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথনাথ দুজনেই আকর গ্রন্থ হিসেবে এই বইটিকে ব্যবহার করেছিলেন।
আর একটা কথা বলি, এই সমস্ত তর্ক আলোচনা চলবেই। কিন্তু বিরুদ্ধমতের লোকেদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আক্রমণ শোভন নয় নিশ্চয়ই। একথা শিক্ষিতমাত্রেই একমত হবেন। একজন বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে যাঁরা প্রকৃত বিজ্ঞানী তাঁদেরকে আমি শ্রদ্ধা করি অন্তর থেকে। তাই সে বিষয়ে কোন ‘নীচে নেমে যাওয়ার’ মতো কাজ আমি করতেই পারি না। আপনার অভিযোগ একদেশদর্শীতায় সম্পৃক্ত। জেমস জীন্স ও দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন আপনি যে ভাষায় করেছেন আপনি বরং সেটা নিয়ে চিন্তিত হোন। ভেবে দেখতেই পারেন সেটি আপনাকে কোথায় নিয়ে গেছে।
যাই হোক, এই পত্রের প্রত্যুত্তরে নিশ্চয়ই কিছু শাণিত ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ভেসে আসবে। তবে সেই সম্পর্কে আমি বিচলিত নই (কারণ, আমার কিছু এসে যায় না)। সেসবের জবাবও দিতে ইচ্ছুক বোধ করছি না (বিশেষত ‘সেক্রেটারী’ কান্ডের পর, যেখানে একটি সাধারণ উদাহরণের মানে বোঝা যাচ্ছে না )। তবে আপনাদের বলব, একরোখা ও লঘু অভিযোগে সময় নষ্ট না করে, প্রকৃত গবেষকের মতো আপনারা বরঙ প্রমথনাথের লেখা পান্ডুলিপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। বিপ্লববাবু যেমন বলেছেন, শান্তিনিকেতনে গিয়েও খুঁজতে পারেন। সেটি প্রকাশ পেলেই একমাত্র বিতর্কের অবসান হবে। ততদিন, হ্যাপি রবীন্দ্রনাথ হান্টিং।
@হেলাল, আপনি কি মিশিও কাকু ইত্যাদির বইটই পড়েছেন। পড়লে দেখতেন, যে ওখানে অনেক তথ্য আছে যা ওঁদের নিজেদের আবিস্কৃত। বিশেষতঃ, মিশিও কাকুর স্ট্রীং থিয়োরীর বইটিতে তো আছেই। সুতরাং ওঁদের সংগ্রাহক বলে দেওয়াটা নিতান্তই বোকামো। অভিজিত রায়ের ব্যাপারে বলতে পারব না, ওঁর কোন বই আমি পড়ি নি, বা জানিও না স্বক্ষেত্রে উনি মৌলিক কিছু অবদান রেখেছেন কী না।
প্রায়শই দেখা যায় বিভিন্ন পাঠ্য বইতে অধ্যায় গুলির ক্রমপর্যায় একই। অধ্যায় গুলির নামও কিছু ক্ষেত্রে এক। কিন্তু ভেতরের লেখা সবক্ষেত্রেই আলাদা।
এই প্রসঙ্গে আরো বলি ইন্টেলেক্টুয়াল প্রপার্টি রাইটস অনুযায়ী, মিশিও কাকুর কোন লেখা আপনি হুবহু নিজের নামে ছেপে দিলে বিপদে পড়বেন, কিন্তু সেই তথ্যগুলি নিয়ে আপনার নিজের মতামত প্রকাশ করলে কেউ কিছু বলবে না। তাই পৃথিবীতে একই বিষয়ের উপর নতুন কোন কিছুর সংযুক্তি না ঘটিয়েও অংখ্য বই লেখা হয়, কারণ প্রতিটিতেই লেখকরা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীকে ব্যক্ত করেন।
Plagiarism কথাটির অর্থ close imitation, রবীন্দ্রনাথকে সেই দায়ে অভিযুক্ত করলে মূল লেখাটিকেও একই সাথে হাজির করলেই ভালো হত না কী? তাহলেই সমস্ত তর্কের মীমাংসা হত।
খোল নলচে কথাটির অর্থ হল, ‘to change something so completely and thoroughly as to give it a new look’। সুতরাং আপনি বইয়ের খোল নলচে বদলাবেন অথচ ‘বই তথ্যের সিকুয়েন্স, অধ্যায় ইত্যাদি ঠিক রেখে আমার ভাষায় লেখতে চাই’ এটা কী সোনার পাথরবাটি র মতো শোনাচ্ছে না। যুক্তি দিয়ে ভাবুন।
@যাত্রী,
“প্রকৃত গবেষকের মতো আপনারা বরঙ প্রমথনাথের পান্ডুলিপিটি সংগ্রহের চেষ্টা করুন। ‘
এই পানডুলিপিটির কথা ই কি বার বার বলতে চাছেছেন কুলদা রায় ? । পাণ্ডুলিপিটি আবিষ্কার বা জোগাড় বা উদ্ধার এর উদ্যোগ গ্রহন করিবার জন্য আকুল আবেদন জানাইতেছি
খোল নলচে ( কি অদ্ভুদ শব্দ! আর কোন প্রতিশব্দ নাই?) একটু বদল করে মিচিও কাকু, স্টিফেন হকিং, ব্রাইন গ্রিন , রিচার্ড ডকিন্স এবং অভিজিৎ রায় ইত্যাদি লেখকদের বই তথ্যের সিকুয়েন্স, অধ্যায় ইত্যাদি ঠিক রেখে আমার ভাষায় লেখতে চাই। উল্লেখ্য এসব লেখকদের বিজ্ঞানের বইয়ের সব তথ্য তারা নিজেরা আবিষ্কার করেনি, বরং সংগ্রিহিত। আইনি ঝামেলা হলে মু্ক্তমনার কোন কোন সদস্যকে ফাসাইয়া দেব, বলব তারা বলছে- এতে কোন সমস্যা নাকি নাই। হক মাওলা, বিখ্যাত হওয়ার গন্ধ পাইতেছি।
@অভিজিত
মূল প্রশ্ন তো এড়িয়ে যাই নি। আপনারা দাবি করছেন প্রমথনাথের পান্ডুলিপি এবং বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তা এক। এই দাবি তখনই তর্কাতীত ভাবে প্রমাণিত হত যদি প্রমথনাথের পান্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আপনারা তুলে ধরতেন।
বিশ্বপরিচয়ের ভাষা একান্তই রাবীন্দ্রিক, একথা মানতে নিশ্চয়ই অসুবিধা নেই। এরপর আসে ব্যবহৃত তথ্যের উৎস। আমার বক্তব্য হল, রবীন্দ্রনাথ সেই সময়ে যে সমস্ত বই পড়েছিলেন, যা তাঁর সংগ্রহে ছিল তার মধ্যে বিশ্বপরিচয়ে উল্লিখিত সমস্ত তথ্যাদিই ছিল। এই তথ্যগুলি খুবই সাধারণ। এগুলি একমাত্র কোন পদার্থবিদই দিতে পারতেন রবীন্দ্রনাথকে, এমনটা মনে হয় না।
আপনারা বলছেন ‘একজনের বই আরেকজন দাবী করতে পারেন না’। প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘একজনের বই’ মানে কী? আপনারা কী বলতে চাইছেন, বিশ্বপরিচয়ের ভাষা প্রমথনাথের? বিশ্বপরিচয়ে উল্লিখিত তথ্যের আবিষ্কারক প্রমথনাথ নন, উনি সংকলন করেছিলেন মাত্র। তার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথের নাম উল্লেখ করে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেওছিলেন। সুতরাং এরপর আর জল ঘোলা করার যে কী মানে?
মনে করুন পৃথিবী সূর্যের চারধারে ঘোরে, এই নিয়ে একটি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ রচনার ভার আপনি আপনার সেক্রেটারীকে দিলেন। সে একটি অপাঠ্য রচনা উপহার দিল। বাধ্য হয়ে আপনি নিজেই রচনাটি নতুন করে লিখলেন। তাহলে প্রবন্ধকার হিসেবে সেক্রেটারীর নামও কি আসবে? এখানে মূল তর্ক হচ্ছে তথ্যটি কতটা সাধারণ বা দূর্লভ, সেই বিষয়ে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বলা যাক, ধরুণ আপনি গ্রাফ থিয়োরীর উপর একটি পেপার লিখলেন। ধরা যাক, পেপারটিতে রেফারেন্স হিসেবে ইউলারের কাজকে উল্লেখ করতে হবে। ইউলারের থিয়োরেম পৃথিবীর প্রায় সমস্ত গ্রাফ থিয়োরীর বইতে আছে, কিন্তু আপনি উল্লেখ করলেন একটির। এখন তাহলে বাকী জনতা যদি এই বলে যে তাদের বইতেও একই তথ্য আছে, সুতরাং তাদের নামও রেফারেন্সে দিতে হবে তাহলে সেটি কী কোন গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব?
বইয়ের কাজ প্রমথনাথ শুরু করেছিলেন, শেষও উনি করেছিলেন। কিন্তু সেই পান্ডুলিপি আর রবীন্দ্রনাথের লেখা পান্ডুলিপি দুটো কী এক? আপনারা যা বলছেন, বই থেকে টুকে দেওয়া বা অন্যের লেখাকে নিজের বলে চালানো, এ যুক্তি ধোপে টেকে না। প্রমথনাথের পক্ষে ঐ ভাষায় লেখা সম্ভব হত না। তাই প্রমথানাথের পান্ডুলিপি আর রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটো প্রকৃতপক্ষেই আলাদা। বাকী বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো রবীন্দ্রনাথের পক্ষেও আহরণ করা কী খুব জটিল বা শক্ত কাজ ছিল? বিশেষতঃ যখন বইপত্র তাঁর কাছেও ছিল। উনি তথ্যগুলো সম্পর্কে অবশ্যই ওয়াকিবহাল ছিলেন। আর ভূমিকা পত্রে প্রমথনাথের প্রতি কৃতজ্ঞতাও কবি জ্ঞাপণ করেছেন।
দেখুন, আমার মনে হয় বিশ্বপরিচয় না লিখলে রবীন্দ্রসম্মানের কিছুমাত্র ক্ষতি হত। তাই রবীন্দ্রনাথ, এর লেখক হওয়ার জন্য এত মরিয়া হয়ে থাকবেন কেন? পুরো-ব্যাপারটাই বড়জোর কষ্টকল্পিত মনে হচ্ছে।
এছাড়া আমি যেসমস্ত বাকী কথা বলেছি, যেমন ৪,৫,৬,৭,৮,৯ ইত্যাদি পয়েন্ট, সেগুলিকে খন্ডন করে আপনি যদি যুক্তি দিতে পারেন তো দিন, তবে আমার মনে হয় এগুলির উত্তরে আপনার বলার কিছু নেই।
@যাত্রী,
আপনি রবীন্দ্রনাথকে ডিফেন্ড করতে গিয়ে কোথায় নেমেছেন সেটা বোধ হয় আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন না। প্রমথনাথ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা পদার্থবিদ। বিশ্বপরিচয়ের মূল পান্ডুলিপি তিনিই লেখা শুরু করেছিলেন, সেটার বহু রেফারেন্স লেখায় দেওয়া হয়েছে লেখায়। আপনি তাকে তুলনা করলেন সেক্রেটারীর সাথে –
ব্যাপারটা কি একটু উলটো নয়? প্রমথনাথ যুক্ত হবার আগে রবীন্দ্রনাথের যে ‘বিজ্ঞান লেখা’ আমরা পাই তাই বরং রীতিমত অখ্যাদ্য – ‘মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব’ ধরনের। এই প্রবন্ধটা অখাদ্য না সুখাদ্য তা আপনিই বিবেচনা করে দেখুন। প্রথম থেকে প্রমথনাথ যুক্ত হওয়াতেই বরং বিশ্বপরিচয়ের মত সুখাদ্য একটা বই আমরা পেয়েছি। আর তাকেই দেয়া হয়েছে বাদ। শুধু তাই নয় ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা হচ্ছে তিনি ছিলেন সেক্রেটারী পর্যায়ের।
আর সেক্রেটারী, ডাকপিওন এদের প্রতি এত বিরাগ কেন, বলতে পারেন? সেক্রেটারী পাণ্ডুলিপি লিখে দিলে, মূল তথ্যের যোগান দিলে, এমনকি পুরো বইয়ের সবগুলো অধ্যায় লিখে দিলেও তার নাম বাদ দিয়ে নিজেকেই লেখক হয়ে যাব, ডাকপিওন গান সুর করে দিলে সেটা টুকে নিজেই আরেকটা গানে সুর দিয়ে দিব কোন ক্রেডিট না দিয়ে, ব্যাপারগুলোর মধ্যে যে একধরণের চিরন্তন জমিদারী মনমানসিকতা কাজ করছে, তা কি খেয়াল করেছেন? 🙂
তা হবে কেন? খোদকারি তো করা হয়েছে ঐ ভাষাতেই। সেজন্যই তো রবিঠাকুর সেই স্মরণীয় উক্তি করেছেন – ‘এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না।’, যদিও এর আগেই ধীরেন্দ্রমোহন সেনকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ-প্রমথনাথ যুক্তগ্রন্থাকার বানানোর মেকি নাটক করেছেন।
না, কারো ভাষা বদলে দিলেই বই থেকে তার অবদান মুছে যায় না। রবীন্দ্রনাথকে চোখ বুজে সমর্থন করতে গিয়ে কোথায় চলে গিয়েছেন সেটার দিকে আসলেই আপনার খেয়াল নেই। যেদিন দেখবেন, আপনার কোন পান্ডুলিপি আরেকজন স্বনামধন্য লেখক কেবল ‘ভাষা বদলে’ নিজের নামে ছাপিয়ে দিবেন, সেদিন বুঝবেন এর অর্থ কি, তার আগে নয়। যেমন, মুজিব মেহদী বুঝেছিলেন। পলাশ আর এমাজউদ্দিন মিলে তার ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’র পান্ডুলিপির ‘খোল নলচে’ একটু বদলে নিজেদের নামে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। আমি নিশ্চিত পলাশ-এমাজউদ্দিনের ন্যাক্কারজনক ঘটনা আমি আপনি সবাই ধিক্কার জানিয়েছি, কিংবা জানাবো, স্রেফ রবীন্দ্রনাথ বলেই আপনার প্রমথনাথকে বঞ্চিত করার খায়েশটুকু এখনো আছে, আমি নিশ্চিত রবিঠাকুরের জায়গায় অন্য কেউ হলে সেটা আর আপনার মধ্যে থাকতো না, আর এ নিয়ে অযথা তর্ক করে অনাবশ্যক জল ঘোলা করতেন না।
সামনে দেয়ার প্রত্যাশা করছি। সময় করে দিব অবশ্যই।
@অভিজিৎ, একটু পার্থক্য আছে মুজিব মেহদীর মুক্তিযুদ্ধে নারী আর রবীন্দ্রনাথের বিশ্বপরিচয় বইটির মধ্য। মুজিব মেহদী বইটি মৌলিক। তিনি নারী প্রগতি সংঘের হয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নারীদের নিয়ে লিখেছেন। সেটি কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক বই নয়। বলা যায় মৌলিক বই। আর বিশ্বপরিচয় বিজ্ঞানবিষয়ক বই। কোনো মৌলিক বই নয়। পৃথিবী এই বিষয়গুলি নিয়ে বহু বহু বই পত্র লেখা হয়েছে। সুতরাং মুজিব মেহদীর মৌলিক বইটি যখন পলশ মেহদী নিজের নামে ছাপেন সেটা রাহাজানি। আর রবীন্দ্রনাথ যখন তার ভাষায় বিশ্বপরিচয় করেন–সেটা তার লেখা। একই বিষয় নিয়ে দুজনেও লিখলেও ক্ষতি নেই। চারজনে চারটি বই লিখলেও চারটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বই হবে। কোনোটিকে রাহাজানির অভিযোগে যুক্ত করা যাবে না।
ঘটনাচক্রে মুজিব মেহদী যখন মাঠে এই নারীদের বিষয়ে অনুসন্ধান করছিলেন–তখন আমি সে এলকাতেই চাকরী করতাম। তাঁর একটি চরিত্র ছিল ভাগিরথীর নামে এক মুক্তিযোদ্ধার–যাকে মোটর সাইকেলের পিছনে বেঁধে খানসেনারা মেরে ফেলেছিল। আমিও এই ভাগিরথীকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছি। তাতে কি মুজিব মেহদী আমাকে রাহাজানির দায়ে অভিযুক্ত করবেন? মুজিব মেহেদীর পুরো বইটিরই আমার কাছে পিডিএফ কপি আছে। চাইলে এখানে লিংক দিতে পারি।
@কুলদা রায়,
মুজিব মেহদী এবং রোকেয়া কবিরের বইটি আমি পড়েছি। পাঠানোর দরকার নেই। আমি যেটা বলছি সেটা হল – একটি বই লিখতে হলে অনেক কষ্ট করতে হয়। মুজিব মেহদী আর রোকেয়া কবির পাণ্ডুলিপি লেখার কাজটি শুরু করেছিলেন, তারাই শেষ করেছিলেন। এর কতটুকু মৌলিক, আর কতটুকু অমৌলিক, সেটি খুব বেশি প্রযোজ্য নয়। তাদের বইটিতে অনেক তথ্য এবং ছবিই আছে, যেগুলো আগে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বইয়েও রয়েছে। কিন্তু সেটা তাদেরই বই। কেউ খোল নলচে বদলে মূল লেখকদের বাদ দিয়ে নিজেই লেখক হয়ে যেতে পারেন না, সেজন্যই এমাজউদ্দিন আর পলাশের ক্ষেত্রে এত প্রতিবাদ হয়েছে। অথচ বিশ্বপরিচয়ের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছে, যিনি পাণ্ডুলিপি লিখেছেন তিনি নেই। তিনি হয়ে গেলেন সেক্রেটারী! শোনেন, পপুলার সায়েন্সের বহু বইই মৌলিক নয়, সেটা কার্ল স্যাগান, মিচিও কাকু থেকে শুরু করে স্টিফেন হকিং পর্যন্ত সবার বইয়ের ক্ষেত্রেই তা বলা যায়। কিন্তু মৌলিক হোক, না হোক এটা তাদেরই বই, কারণ তারাই বইগুলো শুরু করেছিলেন, শেষও করেছিলেন। এই যে, স্টিফেন হকিং এবং ম্লোডিনো মিলে যে ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ নামে বইটি লিখেছেন – সেটা একেবারেই পপুলার লেভেলের বই। বইয়ে যে তথ্যগুলো ব্যবহৃত হয়েছে – সেগুলো কোনটিই মৌলিক নয়, পদার্থবিদরা তো বটেই এমনকি অপদার্থবিদেররাও তথ্যগুলো সম্বন্ধে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সেই সূত্র ধরে ম্লডিনো হকিং কে বাদ দিয়ে বই ছাপিয়ে দিতে পারেন না এই বলে – আরে এই তথ্যগুলো কোনটাই মৌলিক কিছু নয়। কার্ল স্যাগানের ‘কসমস’ বইয়ের কোন তথ্যগুলো মৌলিক? কিন্তু সেটা কার্ল স্যাগানের অনিন্দসুন্দর সৃষ্টি, সবাই জানেন, মানেন। তথ্যের অমৌলিকতার দোহাই দিয়ে কেউ এর কৃতিত্ব নিজের বলে দাবী করতে পারবেন না। এইটুকুই নিবেদন।
@অভিজিৎ,
“তিনি হয়ে গেলেন সেক্রেটারী” এই ভাবে দয়া করে আমার কথাকে ভুল ভাবে ব্যবহার করবেন না। আপনাকে আগেই বলেছি ওটি নিছক উদাহরণ। প্রমথনাথ কে আমি সেক্রেটারী তো বলিনি। উদাহরণের অপব্যাখা করে ওঁকে সেক্রেটারীর আসনে বসিয়ে আপনি কী তাহলে রবীন্দ্রনাথের আসনে বসতে চান।
@যাত্রী,
কেন? তথ্যটি আর কেউ দিতে পারতেন কিনা সেটা অবান্তর। তথ্যটি কে দিয়েছিলেন সেটাই প্রাসঙ্গিক। আপনি আপনার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সেটা স্বীকার করব না, কারণ হরিপদ পোদ্দারও আমাকে টাকা ধার দিতে রাজি ছিল?
প্রমথনাথ যে বইটি শুরু করেছিলেন, এটাতো রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টই স্বীকার করেছেন।
@রৌরব,
মূল তথ্যটি সাধারণ বা দূর্লভ বলে বোঝাতে চেয়েছি যে এগুলো রবীন্দ্রনাথ নিজেও তো জেনে থাকতে পারতেন। প্রমথনাথ শুরু করেছিলেন ঠিকই কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন কিছু পরে দায়িত্ব পুরোটাই তাঁর ঘাড়ে এসে পড়েছিলো।
তাছাড়া প্রমথনাথের কাছ থেকেই তিনি একমাত্র তথ্য নেননি নিশ্চয়। ভূমিকাতে এবিষয়ে প্রমথনাথকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
রচনাটি পড়ে কিছু কথা লেখার প্রয়োজন বোধ করছি। এই মতামত শুধুমাত্র রচনাটির ১ ও ২ নং অনুচ্ছেদের উপর ভিত্তি করে লেখা।
১। প্রথমে স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথের চেয়ে প্রমথনাথের বিজ্ঞান শিক্ষা অনেক বেশী ছিল। তিনি ছিলেন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক। সূতরাং ওঁর হাতে শিশুপাঠ্য বিজ্ঞান রচনার ভার দেওয়ার প্রস্তাব যুক্তিযুক্ত। রবীন্দ্রনাথ তো চাইবেনই তাঁর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের লোকশিক্ষা প্রসারে উজ্জীবিত করার। তাঁর রচনা যে অপাঠ্য হবে সে আর রবীন্দ্রনাথ আগেভাগে কী করে জানবেন।
২। রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন যে উনি ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানের বই পড়তে আগ্রহী ছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানের বেশ কিছু বই উনি পড়েছেন। প্রমথনাথ বাবুকে, জেমস জীনসের বই, যখন পড়ার জন্য দিয়েছিলেন তাহলে এটা ধরাই যায় যে বইখানি উনি নিজেও পড়েছিলেন। প্রাবন্ধিকরা কী এরকম কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে বিশ্বপরিচয়ে ব্যবহৃত কোন তথ্য এইসমস্ত বই গুলো থেকে আহৃত করা নয়। এমন কোনো তথ্যের উদাহরণ যা কেবলমাত্র কোন পদার্থবিদের পক্ষেই জানা সম্ভব? প্রাবন্ধিক-রা যখন ‘রাহাজানি’ র অভিযোগই তুলছেন তাহলে বরং তাঁরা প্রমথানাথের মূল পান্ডুলিপি খুঁজে বার করে লাইন বাই লাইন উল্লেখ করে মিলটুকু দেখান।
৩। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্বপরিচয় গ্রন্থে শুরুতেই উল্লেখ করেছেন,
‘ছেলেদের পড়বার বই যাঁরা লেখেন, দেখি তাঁরা প্রচুর পরিমাণে ফেনার জোগান দিয়ে থাকেন। এইটে ভুলে যান, জ্ঞানের যেমন আনন্দ আছে তেমনি তার মূল্যও আছে, ছেলেবেলা থেকে মূল্য ফাঁকি দেওয়া অভ্যাস হতে থাকলে যথার্থ আনন্দের অধিকারকে ফাঁকি দেওয়া হয়। চিবিয়ে খাওয়াতেই একদিকে দাঁত শক্ত হয় আর-একদিকে খাওয়ার পুরো স্বাদ পাওয়া যায়, এ বই লেখবার সময়ে সে কথাটা সাধ্যমতো ভুলি নি।’—অর্থাৎ যেমন তেমন করে বই লেখা নয়, ছোটোদের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং কৌতূহলোদ্দীপক রচনা পেশ করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। সেজন্য যেমন তেমন ভাবে লেখা তিনি ছাপানোর অনুমতি দিতেন না। প্রমথনাথের লেখা সংশোধনের উদ্দেশ্য ছিল সেটাই। এখন সংশোধনের সময় দেখেছেন যে প্রায় পুরোটাই বদলাতে (ভাষাগত) হয়েছে। তাই ওটি নিজের নামে ছেপেছেন, এবং প্রমথনাথকে ঋণস্বীকার করেছেন। এতে ক্ষতি কোথায়? বইটিতে যেসমস্ত তথ্য রয়েছে সেগুলি কোনটাই প্রমথনাথের নিজস্ব আবিষ্কার নয়, এবং যার রেফারেন্স রবীন্দ্রনাথের কাছেও ছিল। বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের সমস্ত তথ্যই রবীন্দ্রনাথ পঠিত বইগুলির মধ্যে রয়েছে। সেই হিসেবে প্রমথনাথের দেওয়া তথ্য ছাড়া ওঁর আর উপায় ছিল না, এরকম ভাবার কারণ কি?
৪। প্রাবন্ধিকরা লিখেছেন, ”পাঠক, বুঝতেই পারছেন, কোথাকার জল কোথায় গড়িয়ে যাচ্ছে। কীভাবে রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে কেবল ভাষার মাধুর্য বাড়িয়ে প্রমথনাথের মূল তথ্যগুলো হাতিয়ে নেবার পায়তারা চলছে। ” এই লাইনটিকে আর যাই হোক নির্মোহ বিশ্লেষণ বলা চলে না। এর মাধ্যমে যেন বলা হল রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের বিষয় কিছুই জানতেন না। আরো একবার বলা যাক, বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের বেশিরভাগ তথ্যই জেমস জীনসের বইতে রয়েছে। যার ফলে এই তথ্যগুলি রবীন্দ্রনাথও জানতেন, যেহেতু তিনি বইটি পড়েছিলেন।
৫। আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের বাক্যালাপ কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সূত্র নিয়ে হয়নি, হয়েছিল বিজ্ঞানের মূল অব্যক্ত দার্শনিকতা কে নিয়ে। এই বাক্যালাপ দর্শন জনিত তত্ত্বের আলোচনার জন্যই বিখ্যাত। এটির সাধারণ সরলীকরণ যাঁরা করেন (আমারই চেতনার রঙে…ইত্যাদি) তাঁরা অবশ্যই মূল দর্শনের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যান। এটির কারণ হয়ত সেই পরিমাণ মেধা ও বোধের অভাব।
৬।রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ব্যক্তিপুজো যেমন হয়েছে, তেমনি নিন্দা সমালোচনাও হয়েছে এবং হয়ে যাচ্ছে। কেউ রবীন্দ্রনাথকে পূজনীয় ভেবে নিলে তাতে তাঁর দোষ কেন? চিন্তার এক স্তরে থেকে রবীন্দ্রনাথকে পূজনীয় মনে হতে পারে, অন্যস্তরে গেলে তাঁর বক্তব্য গভীরভাবে বিশ্লেষণযোগ্য মনে হতে পারে। কে কোন স্তরে থাকবে সেটী ব্যক্তিবিশেষের নিজস্ব পছন্দ। আপেলের সাথে যেহেতু কমলালেবুর তুলনা চলে না তাই কোন স্তর ভালো আর কোন স্তর খারাপ এই আলোচনা নেহাত শিশুসূলভ।
৭। রাশিয়ার চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়ার সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে যা দেখেছেন তাঁর ভিত্তিতে মতামত রেখেছেন। সেই সব মতামতের ভিত্তিতে যদি কোন গবেষকের এই ধারণা হয়ে থাকে যে তিনি সমাজতন্ত্রের পতন চিহ্ন দেখতে পেয়েছিলেন, তাহলে সেটিকে বিশ্লেষণ করে ভুল প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা ছেড়ে সাধারণ কিছু বিদ্রুপ করা কেন হল, সেটি বোঝা গেল না। যে চিন্তার লঘুতা নিয়ে প্রাবন্ধিকদের এত আক্ষেপ, তাঁরা সেই দোষে নিজেরাও দোষী হয়ে পড়লেন না কী?
৮। একটি কথায় চোখ আটকাল, ‘পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ শিক্ষা অর্জনের পরেও তিনি রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরুতে পারেননি, বরং ‘দেশ পত্রিকার’ অনুগ্রহপ্রাপ্ত প্রসিদ্ধ রবীন্দ্রস্তাবকদের একজন ছিলেন তিনি।’ –পদার্থবিজ্ঞানে সর্বোচ্চ শিক্ষা লাভ করলে রবীন্দ্রানুরাগ পরিত্যাগ করতে হবে বুঝি! এই ধরণের ব্যক্তিবিদ্বেষ পড়ে মনে হল, ট্যাগ লাইনে যতই যুক্তি যুক্তি করে চেঁচান হোক, সেই যুক্তির মূলেতেই আঘাত পড়ল বুঝি। ব্যক্তিগত ভাবে মনে হল, এ নিতান্তই ইদানীংকালের ‘শূন্যগর্ভ প্রকৌশলীদের’ মতো কথাবার্তা। যা কিনা রচনাটির বাকী জ্ঞানগর্ভ অংশের সাথে কার্যত মিলহীন। রচনাটিতে নির্লিপ্ত থাকার যে প্রয়াসের কথা বলা হয়েছে সেটির দূর্বলতা এইখানেই ধরা পড়ে। বস্তুত ১ ও ২ অংশের বারংবার রবীন্দ্রস্তুতি পড়ে মনে হল, ‘এ যেন ঠাকুরঘরে কে রে, আমি কলা খাইনি’ জাতীয় ব্যাপার। সমালোচনা করার আগে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার ভান। প্রাবন্ধিকরা নিজেদের সম্পর্কে নিশ্চিত থাকলে পাঠকের কাছে নিজেদের নিরপেক্ষতার এই মরণপণ প্রয়াস চালাতেন না হয়তো।
৯। জেমস জীনস সম্পর্কিত একটি উক্তি চোখে পড়ল যেমন, ‘জেমস জিন্স খুব বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু জনপ্রিয় বিজ্ঞানগ্রন্থের প্রণেতা হিসেবে কিছু সুনাম তাঁর ছিল।’ যেহেতু বড়মাপের বলতে এখানে কী ঠিক বোঝানো হচ্ছে তার উল্লেখ নেই, তাই এই জাতীয় বালখিল্য মন্তব্য না করাই ভালো। কে কতবড় পন্ডিত তার বিচার স্থূল যুক্তি দিয়ে করা যায় না। এই বিষয়ে প্রকৌশলী বাবুদের হাত না পোড়ানোই ভালো। প্রকৃত বিজ্ঞানীদের উপযুক্ত সম্মান দিতে শিখুন, তাতে লোকসমাজ কম তালেবর ভাববে।
১০। সবশেষে বলি, রবীন্দ্ররচনার ছিদ্রান্বেষণ করে ফেলার পর প্রাবন্ধিকরা এরকম ভাবছেন না তো, যে নিরপেক্ষ রবীন্দ্রসমালোচনার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ কার থেকে কী টুকেছিলেন তা খুঁজে বার করা। বাংলা সাহিত্যে উপযুক্ত রবীন্দ্রবিশ্লেষণের যখন বড় অভাব, তাহলে প্রাবন্ধিকরাই তো এই কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। রবীন্দ্রনাথের স্বজাত ও নিষ্পাপ (প্রাবন্ধিকদের কাছে) কবিতা গল্প উপন্যাস গান নাটক গুলির যদি এরকম নির্মোহ বিশ্লেষণ করে দেখাতে পারতেন তবে বড়ই উপকার হত। ভদ্রলোক বাংলাসাহিত্য কিছু ভাল কাজ তো অবশ্যই করেছেন, তাই প্রাবন্ধিকরা যদি জোড়ায় জোড়ায় সেগুলিকে নিয়ে কিঞ্চিত মতামত দেন তো বিগলিত হই। তখন আবার ‘ও তো অনেকেই করেছে ’ বলে পিছিয়ে যাবেন না তো। নিরপেক্ষ রবীন্দ্রসমালোচনা করতে গেলে মাঝে মাঝে প্রশংসার গু ও মাড়াতে হতে পারে কিন্তু।
@যাত্রী, যুক্তিপূর্ণ মন্তব্য। (Y) (Y)
@যাত্রী,
এতগুলো প্রশ্ন করলেন, কিন্তু মূল প্রশ্নটাই এড়িয়ে গেলেন। কেন এই প্রশ্নটি আপনার দশটি প্রশ্নের তালিকার একটিতেও নেই –
* যাকে দিয়ে পান্ডুলিপির প্রতিটি অধ্যায় লেখানো হল – পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভূলোক এবং উপসংহার সবই, অথচ যিনি কেবল ভাষা ঘষে মেযে ‘খোল নলচে’ বদলানোর কাজটুকু করলেন, তিনিই হলেন গিয়ে লেখক, আর পাণ্ডুলিপির পুরোটুকু যিনি লিখলেন, তিনি সহলেখক হিসেবেও থাকার অধিকারটুকু রাখলেন না?
আপনার নিজের প্রশ্নগুলোর উপরও প্রশ্ন করা যেতে পারে – “প্রাবন্ধিকরা কী এরকম কোন প্রমাণ দেখাতে পারবেন যে বিশ্বপরিচয়ে ব্যবহৃত কোন তথ্য এইসমস্ত বই গুলো থেকে আহৃত করা নয়। এমন কোনো তথ্যের উদাহরণ যা কেবলমাত্র কোন পদার্থবিদের পক্ষেই জানা সম্ভব?” এর উত্তরে বলা যায় – বাজারে যত পপুলার লেভেলের বিজ্ঞানের বই আছে – সে সব বইয়ে লেখা তথ্য সবাই কমবেশি জানেন। কিন্তু একজনের বই আরেকজন দাবী করতে পারেন না। স্টিফেন হকিং য়ার ম্লোডিনোর লেখা ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইনের’ তথ্যগুলো আমার জানা – সেই সূত্রে যদি আমি দাবী করি সেটা আমি লিখেছি – কেমন শোনাবে তখন?
মূল পয়েন্টটা হল – বইটার কাজ প্রমথনাথই শুরু করেছিলেন, শেষও করেছিলেন তিনি। অথচ তিনিই বইটাতে নেই। মজার না? এভাবে সবগুলো প্রশ্ন ধরে ধরেই কাউন্টার দেয়া সম্ভব। সেদিকে আর না যাই বরং।
আপনার অভিমতের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
আপনারা কেউ কি হুমায়ুন আজাদের “নারী” পড়েননি। হুমায়ুন আজাদ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অনেক লিখেছেন, এবং দারুণ লিখেছেন।
অভিজিৎ ভাই আপনিও লিখে চলুন।
@আদনান,
হা । নারী কী এইবার কুরান হয়ে যাবে? :-O
@আফরোজা আলম,
না না, তা হবে কেনো?
কিন্তু আপনাকে তো তাঁর যুক্তির ভুলটা দেখাতে হবে। আর যদি না দেখান, তবে আপনার কথা কিন্তু হুমকির মতো শোনাচ্ছে।
@ আফরোজা , রৌরব এবং বিপ্লবদা,
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার মন্তব্যটি আসলেই দৃষ্টিকটু মনে হচ্ছে। এ ঘটনাটি সত্যি হলেও মানুষ হিসেবে তথা সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সামান্যও ছোট হবেনা ।
কিন্তু তার প্রতি অতি ভক্তি দেখে মনে হয় সে মানুষ না , অতি মানব। আমরা তাকে শ্রেষ্ঠ মানুষ হিসেবেই দেখতে চাই, অতি মানব নয়। তাই মানুষ হিসেবে যে তার হিংসা, লোভ থাকতে পারে তা বুঝতে চাই।
তাছাড়া আমি এও বলেছিলাম-
জামাতীবাদে এখন রবীন্দ্র বিরোধী খুব একটা না থাকারই কথা।
তারপরও এ কথাটি প্রায়ই শুনা যায় রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে, ষড়যন্ত্র হচ্ছে ইত্যাদি। এসব জুজুর ভয় কি অতি ভক্তি হতে আসে না?
রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা গুলো মেনে নিলেও তার অবস্থান থেকে কেউ কি পারবে তাকে নিচে নামাতে?
তবে যাই হোক বিপ্লবদার এ কথাটি মনে ধরেছে-
বাঙালী রবীন্দ্রভক্তরা এমন ভিক্টরিয়ান ঘুঘরে পোকা, কবি সত্তর বছর বয়সে একজন যুবতী নারীর স্তন নিয়ে খেলা করছেন, এমনটা ভাবার আগে তারা অজ্ঞান হয়ে যাবেন।
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন,
বাল্মিকীপ্রতিভা গীতিনাট্য রচনা বিষয়ে লেখেন, দেশী ও বিলেতি সুরের চর্চার মধ্যে বাল্মিকীপ্রতিভার জন্ম হইয়াছিল। ইহার সুরগুলি অধিকাংশই দেশি, কিন্তু গীতিনাট্যে তাহাকে তাহার বৈঠকি মর্যাদা হইতে অন্য ক্ষেত্রে বাহির করিয়া আনা হইয়াছে; উড়ায়া চলা যাহার ব্যবসায় তাহাকে মাটিতে দৌড় করাইবার কাজে লাগানো গিয়াছে।
তিনি গান রচনার এই পদ্ধতিকে বলেছেন সঙ্গীতের বন্ধন মোচন। এই গীতিনাট্যটির অনেকগুলি গানই বৈঠকি-গান-ভাঙা, অনেকগুলি জ্যোতিদাদার রচিত গতের সুরে বসানো এবং গুটি তিনেক গান বিলাতি সুর হইতে লওয়া।
জ্যোতিদাদার সুরে রবীন্দ্রনাথের বসানো গানের তালিকা গানের বহি ও বাল্মিকীপ্রতিভার লেখা আছে। ২৫টির সন্ধান পাওয়া যায় গীতবিতানে।
এর মধ্যে–
গানের বহিতে–হিন্দিগান বিশেষের রাগ-রাগিনীর অনুসরণে রচিত হয়েছে এরূপ গানের সংখ্যা ৯০/৯২টি। আরও কিছু তালিকা করেছেন রবীন্দ্রনাথের স্নেহ ধন্য ইন্দিরা দেবী। পুরাতন গানকে ভাঙিয়াও রবীন্দ্রনাথ অসংখ্য রচনা করেছেন। তার তালিকাও পাওয়া যায়। কোনো কিছুই গোপন করা হয় নাই। কারণ এটা গান রচনারই একটি প্রচলিত পদ্ধতি।
এবার দেখুন কালমৃগয়া ও বাল্মিকীপ্রতিভা গীতিনাট্যে কতকগুলি গানে ইংরেজি স্কচ আইরিশ সুর দেওয়া হয়েছে। তার তালিকা–
কালমৃগয়া শুনতে ক্লিক করুন– লিংক
লোকপ্রচলিত বা পুরাতন বাংলা গানের সুরে রচিত গানের তালিকা–
বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস, বঙ্কিমচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয়কুমার বড়াল, সুকুমার রায়, হেমলতা দেবীর ৮টি গানের সুর নিয়েও তিনি গান করেছেন। তার তালিকাও আছে
বেদমন্ত্র ও বৌদ্ধ মন্ত্রেও তিনি সুর দিয়েছেন।
এই তালিকা তুলে দেওয়ার উদ্দেশ্য হল–রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন গানের সুর নিয়েছেন বিভিন্ন ভাণ্ডার থেকে। কোথা থেকে কোন সুরটি নিয়েছেন সব তথ্যই দেওয়া আছে। কথা কিন্তু নেননি। গানের বানী তার নিজের।
রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গানের সুর হিন্দি মুভিতেও ব্যবহার করা হয়েছে। শচীনদেব বর্মন করেছেন। যেমন, অভিমান ছবিতে তেরে মেরে মিলন কি এ রয়না–লিংক
রবীন্দ্রনাতের জীবিতকালেই রবীন্দ্রনাথের গানের পেশাজীবী বাইজী বা গায়করা গেয়েছেন তাদের ইচ্ছে মত। সে গানগুলো আপলোড করে দেওয়ার ইচ্ছে রাখি অচিরেই।
@কুলদা রায়, তেরে মেরে মিলন কি রয়না গানের মূল রবীন্দ্র সঙ্গীতটির লিংক–
লেখাটায় সবার মূল্যবান মন্তব্য পড়ে অনেক জানতে পারলাম।
আমরা সবাই সত্য সন্ধানের পথিক!
সেই ক্ষ্যাপা খুঁজে ফিরে পরশ পাথর… আবারও রবীন্দ্রনাথ!
মহাপুরুষদের লীলা আর সাধারনের জন্য অন্য খেতাব!
আমি অনেকদিন আগে একটা বৃটিশ ছবিতে বিছানায় প্লাষ্টিকের সাপ রেখে ভয় দেখানো এরকম একটা দৃশ্য ছিল, কাকতালীয় কিনা জানিনা হুমায়ুন আহমেদের “আজ রবিবার” সিরিয়ালে ঠিক একই দৃশ্য দেখেছি!
আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে এগুলো নূতন না!
চলে আসছে!
তবে বড় গাছকে ঝড়ের মোকাবেলা একটু বেশীই করতে হয় মনে হয়!
আসলে পৃথিবীটা গোল নয়, গোলের মত!
সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা!
@লাইজু নাহার, (F)
গগন হরকরা বিষয়ে কিছু তথ্য দেওয়া যাক–
কুষ্টিয়ার কুমারখালীতে ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে শিলাইদহের নিকটে আড়পাড়া প্রামের এক কৃষিজীবি কায়স্থ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন এই রবীন্দ্র বন্ধু মহাপুরুষ গগন হরকরা। তার প্রকৃত নাম গগন চন্দ্র দাস হলেও সবাই তাকে গগন হরকরা নামেই চেনে। গগনের পিতা ও মাতা সম্পর্কে কোন খোঁজ জানা না গেলেও কিরণ চন্দ্র নামে তার এক পুত্র ছিল বলে জানতে পারা যায়। গগন হরকরা প্রথমে পেশায় কৃষি কাজ করতেন। দুই যুগ আগেও গগনের ভিটার অস্তিত্ব ও ফলের বাগানের সাদৃশ্য ছিল। লোকমুখে জানতে পারা যায় যে, গগন হরকরা’র একটি বড় ফলের বাগান ছিল। উল্লেখ্য যে, গগনের বাস্তুভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন এবং সেই বাড়িটি আজও ‘দামের ভিটা’ নামে পরিচিত (রবীন্দ্র উত্তরসূরি– পৃষ্ঠা ৯৪,প্রফেসর ড.আবুল আহ্সান চৌধুরী)।
গগন সামান্য শিক্ষা দীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন এবং তারই ফলশ্রুতিতেই তৎকালনি শিলাইদহের ডাক ঘরের ডাক হরকরা’র চাকুরী পেয়েছিলেন।
গগন সম্পর্কে পন্ডিত ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রি অবশ্য বলেছেন: লালন এর শীর্ষ ধারার একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা–যাঁর নাম গগন।
রবীন্দ্রনাথ গগনকে সবার মাঝে বিভিন্ন ভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত করে যথাসাধ্য মূল্যায়ন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের আগেই সরলা দেবী (১৮৭২-১৯৪৫) ‘‘ভারতী’’ পত্রিকায় (ভাদ্র-১৩০২) গগনের কয়েকটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। সরলা দেবী উক্ত প্রবন্ধের শেষ অংশে আবেদন করেছিলেন যে, ‘‘প্রেমিক গগনের ভক্ত জীবনীর বিবরণ সংগ্রহ করিয়া কেহ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশার্থে পাঠাইয়া দিলে আমাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা ভাজন হইবেন’’। রবীন্দ্রনাথ তার বিভিন্ন বক্তৃতা- প্রবন্ধে গগনের গানের কথা ও গগনের নাম উল্লেখ করেছেন একাধিক বার। রবীন্দ্র সংগৃহীত গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’ এই গানটি দিয়েই ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ‘হারামণি’ বিভাগের (বৈশাখ- ১৩২২) সূচনা হয়েছিল। শিলাইদহে এসে রবীন্দ্রনাথ যেমন সাঁইজি লালন কতৃক প্রভাবিত হয়েছিলেন এবং লালনের পরেই প্রভাবিত হয়েছিলেন গগন হরকরা কর্তৃক। গগনের ‘আমি কোথায় পাব তারে’ এই গানের সুরে রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছিলেন ‘‘আমার সোনার বাংলা/ আমি তোমায় ভালোবাসি’’।
গগনের সাংগীতিক প্রতিভা সম্পর্কে শিলাইদহের শচীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেছেন
“গগন হরকরা ছিলেন শিলাইদহ পোষ্ট অফিসের পিওন, অতি সামান্য বাংলা লেখাপড়া জানতেন, গাঁয়ে গাঁয়ে চিঠি বিলি করতেন, কিন্তু তাঁর বুকের মধ্যে পোরা ছিল রসের নির্ঝর, কন্ঠে ছিল কোকিলের ঝংকার আর তাঁর গানে ছিল অরূপ-রতনের জন্যে চির-মধুর বিরহ-ব্যাথা।তিনি শিলাইদহে ‘সখীসংবাদের’ গানে এমন করুণ আখর লাগিয়ে গাইতেন যে, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনতেন। রবীন্দ্রনাথও তাঁর গান শুনতেন- বিরলে আদর করে কাছ বসিয়ে।”
উল্লেখ্য যে‘প্রবাসীর’ পরবর্তী সংখ্যায় অর্থ্যাৎ (জোষ্ঠ্য-১৩২২) ‘হারামণি’ বিভাগের পূর্ব সংখ্যায় প্রকাশিত গগনের গানটি পুনরায় পাঠ দেওয়া হয়েছিল।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময় গীত হয। প্রমান্ত পাল লিখেছেন, ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ-রচিত নূতন স্বদেশী গান ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ (দ্রষ্টব্য গীত ১।২৪৩; স্ব ৪৬) নিয়ে কলকাতা উত্তাল হয়ে পড়েছে। গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি।, রচনার তারিখও জানা নেই। সত্রেন রায় লিখেছেন : বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট (১৯০৫ খৃ:) কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়েছিল, সেই উপলক্ষ্যে .. রবীন্দ্রনাথ নূতন সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গীত হয়েছিল। …১৯০৫ খৃ: ৭ই সেপ্টেম্বর (১৩১২ সনের ২২শে ভাদ্র) তারিখের ‘সঞ্জীবনী পত্রিকায় এই গানটি রবীন্দ্রনাথের স্বাক্ষরে প্রথম প্রকাশিত হয়। সঞ্জীবনীর উক্ত সংখ্যাটি দেখার আমরা সুযোগ পাইনি, গানটি আশ্বিন-সংখ্যা বঙ্গদর্শন-এ (পৃষ্ঠা ২৪৭-৪৮) মুদ্রিত হয়।
প্রশান্ত পাল জানাচ্ছেন শিলাইদহের ডাক-পিওন গগন হরকার ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটির সুরে রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা গানটি রচনা করেন। সরলা দেবী ইতিপূর্বে শতগান (বৈশাখ ১৩০৭) এ মূল গানটির সরলিপি প্রকাশ করেছিলেন।
গগণ হরকরা বিষয়ে বিপ্লব পাল বলেছেন। একটু তথ্য যোগ করি। রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহে যান ১১ অগ্রহায়ণ, ১২৯৬ বঙ্গাব্দ/ ২৫ নভেম্বর ১৮৮৯ সালে। সঙ্গে ছিলেন মৃণালিনী দেবী, তাঁর একজন সহচরী, বড় মেয়ে বেলা ও পুত্র রথীন্দ্রনাথ। আরও ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। সে সময় রবীন্দ্রনাথ জমিদারী পরিচালনা করতে ব্যস্ত থাকতেন। বলেন্দ্রনাথ সিলাইদহ/ সুনাউল্লাহর-গান শীর্ষক লেখায় লিখেছেন,
বলেন্দ্রনাথ সে সময় সুনাউল্লাহর মুখ থেকে শোনা ১২টি গান খাতায় নকল করে রেখেছেন। ৪ ও ৭ সংখ্যক গানের পাশে মার্জিনে লেখা যথাক্রমে ২৩শে ও ২৫ শে অগ্রাহয়ণ ‘৯৬–অনুমান করা যায় অন্তত এই দুটি গান উক্ত তারিখগুলিতে শুনেছিলেন। এর মধ্যে ২ সংখ্যক গানের রচয়িতা গগন মণ্ডল, বলেন্দ্রনাথ তার নামের পাশে ব্রাকেটে গগন মণ্ডলের পরিচয় লিখেছিলেন–সিলাইদহের ডাক হরকরা। এই গগণহরকরা ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যেরে’ গানটি রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল, এর সুর অবলম্বনে তার বিখ্যাত স্বদেশী সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রচিত হয়।
( পড়ুন–রবিজীবনী/ প্রশান্ত পাল/ তৃতীয় খণ্ড। )
বলেন্দ্রনাথ রবিঠাকুরের স্নেহের পাত্র ছিলেন। তাকে দিলেই শান্তিনিকতনের গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছিলেন খসড়টি। বলেন্দ্রনাথ অকালে মারা যান। বলেন্দ্রনাথ গগন হরকরার গানটির কথা এবং রবীন্দ্রনাথের সোনার বাংলা রচনার ইতিহাসটি বলছেন। এখানে কোনো তথ্যই লুকানো হয়নি। রাহাজানি করলে গোপন করার বিষয় থাকে। সেটাতো করা হয়নি। রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই গানটির সুর কোথা থেকে নিয়েছেন–তা অকুণ্ঠ চিত্তে বলেছেন। সেগুলো ঠাকুরবাড়ির লোকজনই গেয়েছেন। লালন করেছেন। মূল গান এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট গান –সবই রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় গীত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কি কখনো কোথাও বলেছেন–আমার সোনার বাংলা গানটির সুর তার নিজের সৃষ্ট? এরকম প্রমাণ কি দিতে পারবেন ফরিদ আহমেদ? যিনি তার গান রচনার বিষয়ে বলে গেছেন–তাঁকে কিভাবে রাহাজানি করেছেন অভিযোগ করা যায়?
সঙ্গীতের বিষয়টিই সেকালে এরকম ছিল। রজনীকান্তের কোনো কোনো গান আছে–যেগুলো রবীন্দ্রনাথের গানের সুরকে হুবহু নেওয়া হয়েছে। সেগুলো তিনি রবীন্দ্রনাথকেও গেয়ে শুনিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ শুনে তারিফ করেছেন। নজরুল তার গজল গানের সুরগুলো কোথা থেকে নিয়েছেন? পারস্য গজল থেকে নিয়েছেন। সেগুলো কি রাহাজানি? শ্যামা সঙ্গীতের কথাই ভাবুন। শ্যামা সঙ্গীতের সুরের একটা ঘরানা আছে। দেখবেন, একই সুরে বহু গীতিকার সাধক তাঁদের নিজেদের কথা বসিয়েছেন। কেউতো কখনো বলেনি–তারা চুরি বা রাহাজানি করেছেন। কীর্ত্তনেরও বিষয়টাও তাই। রবীন্দ্রনাথ পদাবলী থেকে সুর নিয়েছেন। সেখানে কথা বসিয়েছেন। অন্য পদকর্তাদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। আর রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণ ভারতীয় রাগাশ্রয়ী গানগুলোকে ব্যবহার করেছেন নিজের মত করে। তার টপ্পা গানগুলোর কথাই ভাবুন। শুনে দেখুন। তিনি কোন গান থেকে তিনি নিয়েছেন–সবই বিবৃত আছে। কিছুই লুকোনো হয়নি। জ্ঞানপ্রসাদের বাংলা রাগাশ্রয়ী গানগুলো শুনে দেখুন। আর মূল রাগগুলিও শুনে দেখুন। প্রমাণ পাবেন।
রবীন্দ্রনাথ শুরুইতো করেছিলেন গান রচনা এভাবে। জ্যোতিদাদা পিয়ানোতে সুর তুলতেন–আর রবি সে সুরে কথা বসাতেন। রবীন্দ্রনাথের নিজের জবানীতে এই ইতিহাস আছে। এমনকি জ্যোতিদাদা নিজেও সেভাবে অনেক গান রচনা করেছেন। আর জ্য্যতিরিন্দ্রনাথতো পাশ্চাত্য সঙ্গীতে কৃতবিদ্য ছিলেন। পিয়ানোতে তিনি পাশ্চাত্যগানের সুরই বাজাতেন।
আমার সোনার বাংলা গানটি আটজনের কণ্ঠে শুনুন–লিংক। শুনে দেখুন আটজনের সুরের মধ্যে সূক্ষ পার্থক্য আছে।
অমর পালের কণ্ঠে আমি কোথায় পাব তারে শুনুন–গগন হরকরার গানটিও শুনুন।
@কুলদা রায়, (Y)
@কুলদা রায়,
এই ব্যপারটাই লেখকরা মিস করে গেছেন। আসলে সেই সময়টা বুঝতে, তাদের রবীন্দ্রনাথের লেখা অনেক চিঠি-এবং রবীন্দ্রনাথের জীবনী খুব গভীরে গিয়ে পড়তে হত। সেটা না করে, তারা হুমায়ুন আজাদ, নীরদ সি ইত্যাদির স্বরণাপন্ন হলেন। সেখানেই উনারা ভুল করেছেন। কারন হুমায়ুন আজাদ নিজে কতটা রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন, সেটা নিয়ে আমার সংশয় আছে -তার রবীন্দ্রসাহিত্য সমালোচনা বেশ ফালতু ( যেটুকু পড়েছি তার ভিত্তিতেই বলছি ) ।
সুতরাং লেখকদের প্রথমে এটা শিখতে হবে, রবীন্দ্রনাথ এত ওয়েল ডকুমেন্টেডে বা নিঁখুত ভাবে নথিবদ্ধ, এখানে ক্রস রেফারেন্সে পা ফেললে, ক্রস ফায়ারে লেখাটি অক্কা পাবে :guli:
@বিপ্লব পাল, (Y)
@বিপ্লব পাল, পদাবলী কীর্ত্তনগুলো খেয়াল করলেই বোঝা যাবে। একটা কীর্ত্তন শোনাই–পর্ব ১. লিংক
পর্ব. ২. লিংক
পদাবলী শুনুন –লিংক
কাজি নজরুলের একটি কীর্ত্তন–লিংক
নাম সংকীর্ত্তন–লিংক.
এই গানটির সঙ্গে পান্নালালের গাওয়া বলরে জবা বল কোথায় ঘন শ্যাম-গানটির সুরের কি মিল খেয়াল করুন।
@বিপ্লব পাল,
আচ্ছা হুমায়ুন আজাদ কে নিয়েও কী আমরা একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছিনা?
মানে তিনি ও কী গড ফাদার হয়ে গেলেন ? by god তবে কেই তো ৪৯ হয়ে যাবে :-s
দুঃখিত উপরের মন্তব্য এ কথাটি বলার জন্য।
ইতালীতে এক নারীর শরীরেও তিনি হাত দিয়েছেন
আসলে হবে তা-
টেবিলে রাখা কাগজটির উপর ঝুঁকে তাকালাম। আমার দিকে মাথা না তুলেই তাঁর হাতটি বাড়িয়ে দিলেন, যে-ভাবে কেউ গাছের ডাল থেকে ফল পাড়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, তেমনিভাবে তিনি একটি হাত আমার স্তনের উপর রাখলেন। মনে হয় এক ধরনের প্রত্যাহারের শিহরণ অনুভূত হলো; মালিকের কাছ থেকে যখন কোনো ঘোড়া আঘাত আশা করে না তেমন মনে হলো আমার কাছে। আমার মধ্যে তৎক্ষণাত একটা পশু চিৎকার করে উঠলো, ‘‘না, এ তো চাই নি।
রেফারেন্স:
http://arts.bdnews24.com/?p=3641
-ফরাসি মেয়ে ওকাম্পো, (Flower-Garden, পৃ.-২৭২)
@হেলাল,
হ্যা এই ঘটনাটি সত্য। যেহেতু ব্যাপারটা মলেস্টেশন না প্রেম-তাই এতে কবির মানবিকতা বিকশিত।
তবে, বাঙালী রবীন্দ্রভক্তরা এমন ভিক্টরিয়ান ঘুঘরে পোকা, এটা খাওয়ার পাকস্থলী তাদের নেই। কবি সত্তর বছর বয়সে একজন যুবতী নারীর স্তন নিয়ে খেলা করছেন, এমনটা ভাবার আগে তারা অজ্ঞান হয়ে যাবেন। :guru:
ভিক্টরিয়া ওকাম্পো একজন ল্যাটিনো বলে, এই বিবৃতি দিতে পেরেছিলেন এবং তা বেশ কাব্যিক প্রেমের মতন তিনি লিখেছিলেন। তবে আমার ধারনা, বাকী আরো অনেক মহিলার সাথেই রবীন্দ্রনাথের এমন দৈহিক সম্পর্ক ছিল-শুধু তারা বাঙা্লী রক্ষণশীলতার কারনে ভিক্টরিয়ার মতন লিখে যেতে পারেন নি। যেহেতু প্রমান নেই-তাই এই ব্যাপারে কথা বলা অর্থহীন।
@হেলাল,
ঘটনাস্থল আর্জেন্টিনা। ইটালি না। কবি তখন অসুস্থ। ভিক্টরিয়া ওকাম্পোর সেবা শুশ্রসা করছিলেন। উনার বয়স তখন সত্তর। ভিক্টরিয়ার ৩৮।
@হেলাল,
–ফরাসি মেয়ে ওকাম্পো, এই মহিলা সত্য বলেছে তারই বা প্রমাণ কী? স্রেফ মিথ্যে আর গাজাখুরি কথা লিখে স্মার্ট, আর বিখ্যাত হবার প্রবনতা আজকের নয় অনেক পুরানো হয়ে গিয়েছে।
ইদানীং রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে কু-রুচিকর কথা বলা, মিথ্যে অপবাদ দিয়ে হাতে তালি দেয়া এইটাও তার একটা অংশ ছাড়া আর কিছু না।
আরো কতো মানুষের কত কু-কীর্তি আছে তা কেনা জানে।
একজন বিখ্যাত মানুষের সৃষ্টির কথা হোক। তার ব্যক্তি জীবন নিয়ে এমন ঘৃ্ন্য আলোচনা দেখে মনে হচ্ছে
বাঙালি আসলেই পরচর্চা বৈ আর কিছু জানে না। যা কিন্তু শেষ মেষ অন্তঃসার
শূণ্য এক হাস্যকর প্রচেষ্টা-
@আফরোজা আলম,
ভিক্টরিয়া ওকাম্পো কোন সাধারন নারী নন- তিনি স্পানিশ ভাষার অন্যতম সেরা লেখিকা এবং রবীন্দ্রনাথ যে সময় তার বাসায় ছিলেন, সেই সময় তিনি সূর বলে একটি স্পানিশ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, যা কালের বিচারে স্পানিশ সাহিত্যের অন্যতম সেরা সম্পদ।
রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে কেচ্ছা লিখে বিখ্যাত হবার তার কোন দরকার ছিল না-তিনি তখন স্পানিশ সাহিত্যের অন্যতম নক্ষত্র।
তাছার আমি ওকাম্পোর ওই লেখাটা পুরোটাই পড়েছি। ওটা না কেচ্ছা রচনা -না অভিযোগ কবির বিরুদ্ধে। সেদিন আকাশে চাঁদ উঠেছিল-দুই সপ্তাহ রোগভোগের পর কবি বারান্দায় বসে ভিক্টরিয়ার সাথে পূর্নিমার অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছিলেন। তাছারা, ভিক্টরিয়া ছিলেন অসাধারন সুন্দরী-পুরুষসঙ্গের ব্যাপারে ছিটেফোঁটা রক্ষণশীলতাও তার ছিল না-তিনি নারীর যৌন স্বাধীনতা নিয়ে ছিলেন যতার্থ বিদ্রোহী এবং আর্জেন্টিনার সমাজ তার আচরন ভাল ভাবে মেনে নেয় নি।
এমন পরিবেশে কোন কবি যদি কামবিহ্বল হয়ে ওঠেন-তাকে দোষ দেওয়া যায় না 😛
@বিপ্লব পাল,
তা ভালো আজকাল যখন জোরে শোরে আন্দোলন চলছে নারীর জরায়ুর স্বাধীনতা বলে তসলিমা হাতে তালি পাচ্ছে সে ক্ষেত্রে এ বিষয়টা এমন দোষনীয় কিছু নয়। কেউ বহু বিবাহ করে উদ্যেশ্য চরিতার্থ করে, কেউ বা – যাজ্ঞে- মানুষের ক্ষিধে থাকতেই পারে। 😕
লেখাটি মুক্তমনায় আসার পর থেকেই নিবিড়ভাবে লক্ষ্য রাখছি কে কি বলে।
এসব লেখাতে আমার মত মূর্খ কিবোর্ড না ধরাই নিরাপদ। তবু লেখাটি পড়ে আমি কি বুঝেছি তা জানিয়ে গেলাম।
বিপ্লবদা, কুলদা রায় এবং ভজন সরকার থাকাতে লেখাটির মান বৃদ্ধিই পেয়েছে বলে আমার ধারনা। তা না হলে সন্দেহ থেকে যেত রবীন্দ্রনাথের মত পাহাড় সমান প্রতিভার বিরুদ্ধে এত বড় সাংঘাতিক অভিযোগগুলো কি আদৌ সত্যি।
১। বিপ্লবদার মন্তব্যগুলি থেকে যা বুঝেছি-
* গুরুজী ‘বাউলদের কাছে ঋণী’ বলে জাতীয় সংগীতের গানটির মূল স্রষ্টাকে ঠিকই সম্মান দিয়েছেন।
কিন্তু গগন হরকরা যেহেতু নির্দিষ্টভাবে এ গানটির সুরকার, তার নাম সরাসরি বলাটাই ভাল হত।
* গগনের গানটিও মৌলিক ছিলনা, বাউলদের কাছ থেকে ধার করা।
তার মানে রবীন্দ্র নাথের যে গান ও কবিতা গুলি অন্যের কাছ থেকে ধার করা, সে গুলিই আমি লিখে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া যাবে, যেহেতু তার গান ও কবিতাও অন্যের কাছ থেকে ধার করা।
২। কুলদা রায় থেকে যা বুঝলাম, তিনি বলেছেন-
* আবুল আহসান চৌধুরী বলছেন, রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়ক ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং প্রজারা তাঁকে ভালই বাসতেন। তাহলে? তাহলে কাকে বিশ্বাস করব? সেই ডঃ আহমদ শরীফের জীবিতকালের অনুগত ছাত্রের চিঠিকে, না একালের পরিশ্রমী গবেষক শিক্ষক আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্যকে?
এ কথাটি ভাববার বিষয়। তবে জমিদারদের খাজনা নিয়ে সে যুগে কোন কৃষক খুশি না থাকারই কথা। আর জমিদার যদি কৃষকের খাজনা মওকুপ করে নিজের পকেট থেকে বছর বছর ইংরেজদের হিস্যাটা দিয়ে নিজে ফকির হয়ে যান তাহলে ভিন্ন কথা। যেহেতু তিনি তা করেন নি ( আমিও তা করতাম না। রিসেসন দেখা দিলে খাজনা বাড়িয়ে দিতাম অবশ্যই।) তাই তার একটু প্রজাপীড়ক অপবাদ যে নিতেই হবে। এমনকি আবুল আহসান তাকে ফেরেস্তা বললেও না।
কিন্তু মুল লেখাটি প্রধান দুটি অভিযোগ “বিশ্ব পরিচয়” ও জাতীয় সংগীতের ( এবং অন্য আরো বহু গান) ব্যাপারে এখনও কোন মৌলিক প্রতিবাদ করেন নি।
৩। ভজনদা লেখাটির কিছু ক্রুটির কথা বলেছেন-
* এ ব্যাপারে অনেকটা একমত।
* তবে তিনি আরো একটি কথা বলেছেন-
সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্র-পূজারীদের চেয়ে রবীন্দ্র-বিরোধীদের সংখ্যা কী কম?
এটা এক সময় হয়তো সত্যি ছিল কিন্তু আমিতো রবীন্দ্র বিদ্বেষী তেমন দেখেনি বরং উল্টোটাই বেশী দেখি। তার গান এবং সাহিত্য হয়তো অনেকের কাছেই ভাল লাগেনা ( তার কবিতা আমার কাছে করল্লার সরবত মনে হয়। ছোট থাকতে রেডিও-টিভিতে তার গান শুনলে আমার একটাই কম্ম ছিল রেডিও বা টিভিটি বন্ধ করে দেয়া। এখন অবশ্য তার কিছু গান ভালো পাই। ) , কিন্তু জামাতীবাদে এখন রবীন্দ্র বিরোধী খুব একটা না থাকারই কথা।
লেখকদ্বয়কে ধন্যবাদ গুরুজীর থলের বিড়ালটিকে এক নজর দেখানোর জন্য।
যদিও সাহিত্যের মধ্যে ব্যাক্তিগত বিষয় নিয়ে টানাটানি ঠিক না, তবু গুরুজীর গানের অনুষ্ঠানে যেভাবে ধুপ জ্বালিয়ে পুজা অর্চনা করা হয় এবং কেউ কেউ গুরুজিকে ইশ্বরের সাথে তুলনা করা হয় ( যদিও গুরুজি আকাইম্ম্যা ইশ্বরের চেয়ে বহুগুনে শ্রেষ্ঠ) , তা থেকেই সেই ইশ্বরকে জানতে মন চায় তার নারী প্রীতি নিয়ে। বিডি নিউজ২৪ এ একবার পড়েছিলাম- ইতালীতে এক নারীর শরীরেও তিনি হাত দিয়েছেন। দুঃখিত রিফারেন্স দিতে না পারায়। এ ব্যাপারে কারো জানা থাকলে এবং তার বউদি বা অন্যদের সাথে আরো কোন কুকির্তী থাকলে জানাবেন। গুরুজিকে প্রতিদিন উদুম করা ঠিক না, একদিন করাই ভাল। তাছাড়া তাকে আমরা ভালবাসি বলেই তার সমালোচনা করার অধিকার রাখি।
@হেলাল,
নারীর শরীরে শুধু হাত কেন, অন্য কিছু রাখতে সমস্যা কোথায় ঠিক বুঝতে পারছিনা। “কুকীর্তি” শব্দটিও আমার কাছে স্পষ্ট নয়।
অস্তাবক এবং অপূজারীদের রবীন্দ্রনাথের সঠিক মুল্যায়নের নমুণাটা কি ফরিদ আহমদের এই দুর্বল লেখাটা? না, আরও কিছু নমুণা হাজির করে দেখাবেন ফরিদ আহমেদ? মনে পড়ে মেজর জেনারেল আব্দুল মতিন বলেছিলেন–
এইটা কি নমুণা ফরিদ আহমেদ? দেখুন, ঐ তারিখে রবীন্দ্রনাথ কোথায় ছিলেন? ছিলেন শিলাইদহে।
বারো বছর আগের পড়া সুনীলের “প্রথম আলো ” (আনন্দ পাবলিশার্স ) থেকে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রচনার যে ইতিহাস জেনেছি , আজ মুক্ত-মনায় তার “নতুন আবিষ্কারে ” একটু অবাক হলাম। ইউটিউব আসার আগেই বাংলাদেশ এর কোনো একটা টিভি চ্যানেলে সাদী মহম্মদ (শান্তিনিকেতন এর সাবেক ছাত্র ) কে গাইতে শুনেছি “আমার মনের মানুষ যে রে…..”। . উইকি তে এর উল্লেখ আছে (লিঙ্ক) . একটু গুগলিং করে আরো কিছু তথ্য জানতে পারলাম। রবীন্দ্রনাথেরই স্নেহধন্য রবীন্দ্র গবেষক শান্তিদেব ঘোষ এর লেখায় আছে এই গানের সুর adopt করার তথ্য (লিঙ্ক )। ড: করুনাময় গোস্বামী (লিঙ্ক) , সাদী মহম্মদ (লিঙ্ক) এর লেখায় দেখতে পাচ্ছি এই তথ্য। কোন রবীন্দ্র পুজারী এই তথ্য অস্বীকার করেছে আমি জানি না. আরেকটি সাইটে (লিঙ্ক) জানতে পারলাম, রবীন্দ্রনাথ নিজেই গগন হরকরার এই গান সাময়িক পত্রে প্রথম প্রকাশ করিয়েছিলেন। তাঁর ভাগ্নি সরলা দেবী প্রকাশ করেছিলেন আরেকটি গান। রবীন্দ্রনাথ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি তে দেওয়া লেকচারে quote করেছিলেন গগন হরকরাকে (লিঙ্ক). সম্ভবত গগন হরকরা সম্পর্কিত আর কোনো তথ্য, গান বা রচনার কথা জানা যায় না. তাই ধরে নেওয়া যায়, তথ্যটির একমাত্র উৎস স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
প্রশ্ন থাকতে পারে গানটির সুরের কতটুকু অংশ গ্রহণ করা। এটি নিশ্চিতভাবে মনে করার যথেষ্ট কারণ নেই যে, গগন হরকরা গানটি অবিকল এই সুরেই গেয়েছিলেন। কারন সেই গানের সম্ভবত কোনো সংরক্ষণ নেই. প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই গান সম্ভবত লোকে গেয়েও আসছেনা। আজকে যারা গানটি গাচ্ছে, তারা হয়ত গানটার বাণী (রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক প্রথম প্রকাশিত) নিয়ে তাতে জাতীয় সঙ্গীত এর সুর (যার নোট সংরক্ষিত আছে ) শুধু বসিয়ে দিয়ে গাচ্ছে। এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানলে ভালো লাগবে।
যদি গানটার সুর অবিকল একই হয়ে থাকেও তাতেও এতে রবীন্দ্রনাথের শিল্প অবদান কে খাটো করা যায় না। সুরের সাথে বাণী মিলে যে গান সেই গান ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্মের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার মানুষকে অনুপ্রানিত করতে পেরেছিল বলেই এটি অন্যতম সার্থক শিল্প. ( ড: করুনাময় গোস্বামীর লেখার উপরোক্ত লিঙ্ক দ্রষ্টব্য ). সার্থক অনুবাদ তো সাহিত্য হিসেবে বিবেচিত. রবীন্দ্রনাথ এর নষ্টনীর কে নিয়ে চারুলতা বানালে সত্যজিত এর শিল্প অবদান খাটো হয় না, স্কটিশ সুর নিয়ে “আমি চিনি গো চিনি তোমারে …” লিখলে গানটির আবেদন নষ্ট হয় না, আবার চারুলতায় এই গানে কিশোর কুমারের কন্ঠ গায়কীর জন্য এখনো জনপ্রিয় হয়ে আছে.
এবার “বিশ্ব পরিচয় ” রচনা সম্পর্কে একটু বলতে চাই. কোথাও কি প্রমথনাথের করা পান্ডুলিপি টা পাওয়া যায়? এটি না দেখে কি এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে বইটার লেখক হওয়ার স্বীকৃতি উনি ডিসার্ভ করেন ? “বিশ্ব পরিচয় ” কোন সিরিয়াস বিজ্ঞান প্রবন্ধ বা টেক্স্ট বই নয় . এতে কোনো নতুন অবসার্ভেশন বা তত্ব নেই. এটি নিতান্তই (লেখকের কথায় ) “মহাবিশ্বের সাথে সাধারণ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য” একটা বই. নিহারিকা কি জিনিস , পৃথিবী সুর্যের চারদিকে কতদিনে ঘুরে, এসব তথ্য সাজানোটাই লেখক স্বীকৃতির জন্য মনে হয় যথেষ্ট নয়. সাধারণের কাছে একে হৃদয়গ্রাহী করার চেষ্টাটাই এই ধরনের লেখার মূল . তাই বইয়ের অন্তত কিছুটা অংশের বাক্য বা অন্ততপক্ষে তার বাক্য গঠন যদি “বিশ্ব পরিচয় ” গ্রন্থের সাথে না মিলে যায়, তাহলে লেখক স্বীকৃতি দেওয়া কি নৈতিক? উদাহরণ হিসেবে “বিশ্ব পরিচয় ” এর একটি অংশ এখানে তুলে ধরছি.
“একদিন মানুষ ঠিক করেছিল বিশ্বমণ্ডলের কেন্দ্রে পৃথিবীর আসন অবিচলিত, তাকে প্রদক্ষিণ করছে সূর্যনক্ষত্র। মনে যে করেছিল, সেজন্যে তাকে দোষ দেওয়া যায় না – সে দেখেছিল পৃথিবী-দেখা সহজ চোখে। আজ তার চোখ বেড়ে গেছে, বিশ্ব-দেখা চোখ বানিয়ে নিয়েছে। ধরে নিতে হয়েছে পৃথিবীকেই ছুটতে হয় সূর্যের চার দিকে, দরবেশী নাচের মতো পাক খেতে খেতে। পথ সুদীর্ঘ, লাগে ৩৬৫ দিনের কিছু বেশি। এর চেয়ে বড়ো পথওয়ালা গ্রহ আছে, তারা ঘুরতে এত বেশি সময় নেয় যে ততদিন বেঁচে থাকতে গেলে মানুষের পরমায়ুর বহর বাড়াতে হবে।”
একটু আধটু কাটা ছেড়া করা লেখা একে আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয় না. বরঞ্চ রবীন্দ্রনাথের অন্যান্য রচনার সাথে সঙ্গতি পূর্ণ বলেই মনে হয়. অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত ধারণা. বছর দুয়েক আগে একটি গ্রাজুয়েট কোর্সে টার্ম প্রজেক্ট থেকে একটি পেপার লিখেছিলাম . project এর কাজ শুরু করেছিল (যা পরে কাজে আসে নি) আরেকজন ছাত্র. পেপার লেখার শেষে প্রফেসর ওই ছাত্র কে authorship দেওয়ার বেপারে reluctant ছিল. কারন উনার মতে ওর authorship এর জন্য যথেষ্ট contribution ছিল না. পরে যদিও বুঝাতে সমর্থ হই যে তার আসলেই contribution ছিল. কিন্তু এখানে উল্লেখযোগ্য হলো, প্রজেক্ট টা শুরু করেই বা তাতে যুক্ত থেকেই author হওয়ার দাবি করা যায় না .
যদিও কেউ বলতে পারে, “বিশ্ব রচনা ” যত খারাপ ই হোক তা ই প্রকাশ করা উচিত ছিল. কিন্তু তাতে হয়ত বইটা লেখার উদ্দেশ্যই ব্যাহত হত. অথবা দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের কথায়, “প্রত্যাশা জাগিয়ে ” তুলাটা “কতদূর সংগত” হয়েছিল সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ.
রবীন্দ্রনাথ কে নিয়ে এত লোক এত দিন ধরে কাজ করেছে যে, তাকে নিয়ে কোনো উপসংহারে পৌছানো সম্ভবত অনেক পরিশ্রম, সময় এবং সতর্কতা সাপেক্ষ. সবাইকেই এক ধাক্কায় biased বলে ফেলা , তার বিপুল রচনা এবং কাজ কে এক পাশে সরিয়ে একটি দুটি উদাহরণে “রাহাজানি “, “কুম্ভীলক ” শব্দ সেঁটে দেওয়াটা কতটা “নির্মোহ ” চিন্তাধারার প্রতিফলন তাতে সন্দেহ জাগে.
@পথিক,
অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনার সুচিন্তিত মতামতের জন্য। খুব ভাল লাগলো।
আমি সবচেয়ে বেশি যার কবিতা অ্যাপ্রেশিয়েট করি তিনি রবীন্দ্রনাথ…দেবতা,ফেরেশতা,পবিত্র এই সব তত্ত্বের প্রতি আমার কোনকালেই মোহ ছিল না। কিন্তু রবি সম্পর্কে আমার অনুভুতি ছিল ‘পবিত্র দেবত্ব’এর কাছাকাছি।
উনার সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদ ও আহমদ শরীফ লেখা পড়ার পর আস্তে আস্তে মোহ ভাঙ্গে।
আজ মুক্তমনায় এই অত্যাধিক সাহসী পোষ্টটি পড়ে আরো অনেক ‘ভয়াবহ’ জোচ্চুরির কথা জানলাম। অভিজিৎ ও ফরিদ দা কে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ।
এক জায়গায় রবিন্দ্রনাথকে ‘রবীবাবু’ সম্বোধন করায় এক রবীন্দ্রপুজারী খেচকি মেরেছিল এই বলে- ‘রবীবাবু কে ‘কবিগুরু রবীন্দনাথ ঠাকুর’ এই পুরোনামে ডাকবেন। নয়ত তাকে তাকে অশ্রদ্ধা করবেন না।’ :lotpot: :lotpot:
ভেবেছিলাম কিছুই বলবোনা। তবু কেনো যে লিখতে এলাম।
অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য (N)
আহমেদ শরীফ আর হুমায়ুন আজাদ আমার ও শ্রদ্ধাভাজন। তাই বলে তারা যা বলবেন অন্ধের মত মেনে নেয়া একজন বিবেকবান মানুষের হতে পারেনা।
মুক্তমনায় মুক্ত মতামত দিচ্ছি বলে আমার বিরুদ্ধে কিছু একশান নিলে নিরুপায় 🙁
বিপ্লব দার এবং কুলদা রায়ের সাথে সহমত পোষণ করছি।
বিস্তারিত লেখায় গেলাম না। তাহলে আলাদা রচনা লিখতে হবে। একটা অনুরোধ মুক্তমনা মুক্ত চিন্তা করতে গিয়ে এমন – এমন ব্যক্তিকে আঘাত করলেন , যার গান আমাদের জাতীয় সঙ্গীত।
অহং বোধ থাকা ভালো, কিন্তু মুক্তমনার লেখকদের অহংকার যেন না আসে, আমার বিনীত অনূরোধ।
আর রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আরো পড়তে অনুরোধ করছি।
আশা করি আবার ও বলছি মুক্ত বক্তব্য দেবার স্বাধীনতা সবার ই আছে।
আমীন-
ইস, কদিন ইন্টারনেটেই আসতে পারিনি।। এর মাঝে এমন একটা লেখা চলে এসেছে মুক্তমনায়… !
জমিয়ে রাখলাম ভাইয়া, ফ্রি হয়ে পড়ব… আপাতত অনুসরণ করে যাই…:)
ব্যক্তিপূজা সম্পূর্ণভাবেই বর্জনীয়, সে রবীন্দ্রনাথ হোক বা যেই হোক। অথচ এই মুক্তমনাতেই কয়েকজনকে দেখা যায় অলীক ঈশ্বরবিশ্বাস থেকে মুক্ত হয়ে ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছেন জীবিত বা মৃত ব্যক্তিকে এবং তার বা তাদের পূজো করতে একাধিক পোস্ট লিখছেন এবং সেখানে সেই পূজনীয় ব্যক্তির কোনো সমালোচনাই সহ্য করা হচ্ছে না। ধর্মবিশ্বাসীর ঈশ্বরপ্রেমের সঙ্গে এই ব্যক্তিপূজার সম্পূর্ণ তুলনা চলে না্, তবে আদল প্রচন্ডরকমভাবে এক।
বর্তমান লেখা বিষয়ে আমার মতামত, বেশি গরম কিছু কথা বলে বাজার গরম করার চেষ্টা। অনেক যুক্তিই দুর্বল (স্বঘোষিত রবীন্দ্রবিরোধীদের কথা কোট করা দেখেই তা মনে হয়েছে, নিজেদের গবেষণালব্ধ যুক্তি খুবই কম) হলেও সেগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্যতা পেত ভাষা নমনীয় হলে। রুক্ষ ভাষার কারণে লেখাটিকে সৎ উদ্দেশ্যমূলক মনে হচ্ছে না। হিন্দুদের অন্ধ রবিপ্রেমকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যেই এই লেখা, তা অনুমান করা যায়। লক্ষ্য ঠিক আছে, কিন্তু প্রকাশভঙ্গি রীতিমতই বায়াসড মনে হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে গৎবাঁধা ভাল কথা বলে নিরপেক্ষ থাকার প্রচেষ্টা একেবারেই ভান মনে হয়েছে। ফলে লেখাটির গ্রহণযোগ্যতা খুব বেশি বলে মনে হল না। মনে হল, স্টান্টটাই লক্ষ্য ছিল।
আমার ব্যক্তিগত মতামত, রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক কীর্তির জন্য সম্মানীয় ও শ্রদ্ধেয় হতে পারেন, তবে তিনি কোনোভাবেই মহাপুরুষ নন। পূজনীয় তো ননই। ভাল-মন্দ দুই দিকই তাঁর আছে। আর তাই লেখার মূল বক্তব্যের সঙ্গে একমত। কিন্তু প্রদর্শিত যুক্তির দৌর্বল্য ও ব্যবহৃত প্রকাশভঙ্গি লেখার মান নিচু করে দিয়েছে।
শুরুর কথাটাই আবার বলি- ব্যক্তিপূজা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। যারা ব্যক্তিপূজা করে, তাদের সঙ্গে অমুক্তমনা হিসেবে বিবেচিতদের পার্থক্য খুব বেশি নেই।
@রা নাহি দেয় রাধা,
আমি এই রকমই একটা মন্তব্য করতে যাচ্ছিলাম | ধন্যবাদ আগেই সেটা করে দেওয়ার জন্য | (Y)
তাহলে অভিজিৎ রায়ের কথায় বোঝা যাচ্ছে–তার যুক্তিবাদিতার সুতোয় জোর নেই। এও হতে পারে–ও-ও হতে পরে মধ্যে দিয়ে চলে গেলেন। এবং সময় নেই-এর মধ্যে দিয়ে চলে যেতে চাইছেন। বক্তব্যের দায়টা ফরিদ আহমদের উপর চাপিয়ে দিয়ে গেলেন। এও হতে পারে–ও-ও হতে পরে –কোনো যুক্তিবাদি পন্থা নয়। কি বলেন অভিজিৎ রায়?
এখান থেকে দুটো বিষয় বোঝা যাচ্ছে, ১. এই লেখাটা ফরিদ আহমদের উৎপাদন। গ্রেট। ২. দুর্বল যুক্তির উপরে লেখা হয়েছে।
ফরিদ আহমদের লেখাপড়ার উপরে যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। বলা যায়–আমি যার-পর-নাই মুগ্ধ। আমার ধারনা তার তুল্য জ্ঞানী এ ভুবনে খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি এই নোটে বহুদিন পরে আরেকবার রবীন্দ্রনাথ বধ করে ফেলেছেন। ইউরেকা। আশা করছি তিনি তার অমিত জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে আমার প্রশ্নের উত্তরটা দেবেন। এবং তরুণ বন্ধুরা তা বিবেচনা করে দেখবেন।
৩. আর যে যুক্তি দুর্বল–মাজা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সে যুক্তি দিয়ে কিভাবে আভিজিৎ রায়ের মত অবিজ্ঞান সংস্কারক এই ধরনের একটি বিপ্লবী লেখার সহলেখক হিসাবে নাম লেখালেন? এইখান থেকে এই নোটের আরেকটি জবাব আসলেও আসতে পারে। খুল খুল সীম যা।
আশা করছি, ফরিদ আহমদের জ্ঞানগর্ভ উত্তর থেকে সন্তুষ্ট পেয়ে আরও কিছু প্রশ্ন করার খায়েস পোষণ করছি। প্রশ্নগুলো অবশ্যই লেখকদ্বয়ের নোটসংশ্লিষ্ট। প্রভু যীশু সহায় হোন। আমার অবিজ্ঞানজনোজিত ভক্তিবাদিতা থেকে আমাকে মুক্ত হওয়ার তৌফিক দান করুন। আমীন।
@কুলদা রায়,
বক্তব্যের দায় ফরিদ আহমেদের উপর চাপিয়ে দিয়ে যায় নি। আপনি আরেকটু ঠান্ডা মাথায় যদি মুক্তমনায় আসতেন তাহলে বুঝতে পারতেন যে এই লেখাটি আমাদের দুজনের। অভি তার বক্তব্য দিয়েছে। ওই প্রসঙ্গে আমার কোনো অভিমত থাকতেও পারে, সেই বিষয়টাই সে বোঝাতে চেয়েছে। দায় এড়াতে নয়।
আপনার বোঝাতে খুবই গন্ডগোল আছে। এই লেখা ফরিদ আহমদের একক উৎপাদন হলে অভিজিৎ রায়ের নাম এখানে থাকতো না। সে নিজেই আমার বা আপনার চেয়ে অনেক ভাল লিখতে পারে। অন্য কারো লেখায় খামোখা ঝুলে থাকার প্রয়োজন তার অন্তত নেই।
লেখা সবল যুক্তি না দুর্বল যুক্তির উপরে হয়েছে সে বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করছি না। আপনার যদি মনে হয় দুর্বল যুক্তির উপরে, তবে দুর্বল যুক্তির উপরেই হয়েছে।
এই অশোভন বিদ্রুপের পরে আপনার মন্তব্যের উত্তর দেওয়াটাই উচিত নয় আমার। তবুও দিচ্ছি, শুধুমাত্র এই লেখাটা আমাদের বলে। লেখক হিসাবে দায়িত্বের বশে। আপনার প্রশ্নের উত্তর আমার আগের মন্তব্যেই আমি দিয়েছি। তারপরেও যখন বলছেন, তখন আবারও বলছি, রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়ক ছিলেন না প্রজাদরদী ছিলেন, সে বিষয়ে কোন আবুল আহসান চৌধুরীকে বিশ্বাস করবেন, নাকি আহমদ শরীফকে বিশ্বাস করবেন, সে আপনার বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের কোনো মতামত নেই। আপনার ব্যক্তিগত বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ করতে আমরা রাজি নই। আর নিজে যদি সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন, তবে কোনো রবীন্দ্রপূজারীকে জিজ্ঞেস টিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। আপনার মনমতো উত্তর পেয়ে যাবেন হয়তো।
এক্ষেত্রে প্রভু যীশু আপনাকে কোনো সহায়তা দিতে পারবে বলে মনে হয় না। নিজেকেই চেষ্টা করতে হবে।
@ফরিদ আহমেদ, মাথা আমার যথেষ্ট ঠাণ্ডা। আপনার বক্তব্য শুনে আমার মাথা পুরো বরফ। মনে হচ্ছে, কেনরে রায় মশাই, কেন আরও আগে আসলি না মুক্তমনায়। এখানে যুক্তিবাদের নামের সংশয়বাদকে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে চালানো হচ্ছে।
বলেছেন,
হা হা হা। যুক্তিকে যখন একজন ভক্তিবাদি যুক্তিবাদির সামনে হাজির করল, তখন ফরিদ আহমদ
বলে কেটে পড়লেন। ফরিদ আহমদের এই অপযুক্তিকে কিভাবে যুক্তিবাদি তরুণ বন্ধুরা গ্রহণ করবেন কেবল পীরতন্ত্রের সমর্থক ছাড়া?
আমাকে বোঝাতে আপনি কেন গণ্ডগোলে পড়েলেন? নাকি নিজের কুযুক্তিতে ধরা পড়ে গেছেন? আমার আশঙ্কা হচ্ছে আপনি কায়দা করে তিলে তিলে গড়া মুক্তমনার নামে একটি মুক্তবুদ্ধির প্লাটফর্মকে ব্যক্তিবাদের আখড়া বানিয়ে যুক্তিবাদি পীর বানানোর কোসেস করে যুক্তিবাদকে পঙ্গু করে দেওয়ার কায়দা করছেন। আপনার গণ্ডগোলটি পরিস্কার করুন। এবং খুব স্পেসিফিক প্রশ্ন করা হচ্ছে আপনাকে। আশা করি আপনি গরম মাথায় উত্তর দেবেন। আমার ঠাণ্ডা মাথার বরফ গলিয়ে দেবেন, যাতে আমি যক্তিবাদি পীরের সাঙ্গাৎ হয়ে পারি। আর আলাপের দরোজাটা খোলা রাখবেন। আপনার প্রবণতা আছে, অতীতে দেখেছি, আমার মন্তব্য করার অধিকারকে হরণ করেছিলেন। লোকজনকে আমার উপরে গালিগালাজের ফোয়ারা বইয়ে দিয়েছিলেন। আশা করছি –সে পথে যাবেন না। এতদিনে আপনার বোধোদয় ঘটার কথা। আমি আগে এই নোটে উল্লেখিত আলাপ থেকেই আপনাদের উদ্দেশ্যবাদকে তুলে ধরতে চাই। তারপর অধম মুর্খ ভক্তিবাদি কুলদা রায় কিছু প্রলাপের নমুণা রেফারেন্স সহকারে আপনাদের উদ্দেশ্যে পেশ করবেন। এই ফাঁকে একটু বন্দিশ করে নেওয়া হচ্ছে। প্রভু কার্ল ডারউইন আমাদের সহায় হোন। আমীন।
@কুলদা রায়,
কলহের জায়গা এটা নয় কবিকূলশিরোমণিপূজক কুলদা রায় বাবু। এই রকম কলহ-বিবাদ করতে গিয়েই একদা কী পরিমাণে লোকজনের কটুবর্ষণ এই কুরুক্ষেত্রে খেয়েছিলেন, সেটা কষ্ট করে একটু স্মরণ করুন। কাজে দেবে এই কলিকালে।
@ফরিদ আহমেদ, এই মুক্তমনায় আপনার ভূমিকা জন্মদাত্রী–আপনি সেভাবেই একে লালন পালন করেন বলেছিলেন, মনে আছে। আমি এইজন্য আপনাকে সোর্ড অব অনার দেয়ার প্রস্তাব করি। কিন্তু সেই যে আমার মন্তব্য করার অধিকার হরণ করে আপনার স্তাবক দিয়ে আমাকে অভিমণ্যু বানিয়েছিলেন–সেটা মনে আছে। মনে থাকবে। এবং আপনাকে শকুনী বই অন্য কিছু মনে হয়নি আপনাকে আপনার কথিত অই কুরুক্ষেত্রে। শকুনির পরিণতিটা মহাভারত থেকে পড়ে নেবেন এবং আনন্দিত চিত্তে থাকবেন আশা করছি।
এইসব কুটকাটব্য থাক। আপনার সাহিত্য জ্ঞান দেখে আমি যারপর নাই পুলকিত। মনে হচ্ছে, মুক্তমনার অর্জিনাল গরুর দুধে একফোটা গরুর চোনাবৎ আপনার অবস্থান। সেটা অচিরেই প্রমাণিত হবে।
আপনাকে ঘোর কলিকালের অবস্থানটা দেখানোর চেষ্টা করা যাবে। আপনাকে ধন্যবাদ। শুধু আলাপে আসুন। তথ্যে আসুন। আমার কপাল খারাপ–আমি নিজে এক মুর্খ, কিন্তু কথা বলতে হচ্ছে আমার চেয়েও অধিকতর মুর্খের সঙ্গে। তাই সই। তবে কথা বলব ফরিদ আহমদের ভণ্ডামো খুলে ফেলার জন্য। আসেন।
@কুলদা রায়,
আপনার কথা অনুযায়ী আপনার সাহিত্যজ্ঞান ফরিদ আহমেদের চেয়ে বেশী। তবে এসব কী ভাষা বলুন তো?
@তামান্না ঝুমু, ফরিদ আহমদের এই ভাষাটি কেমন–‘কবিকূলশিরোমণিপূজক’?
@তামান্না ঝুমু, আমি নিজে মুর্খ। কিন্তু এই নোট পড়ে মনে হচ্ছে এই দুর্বল প্রপাগাণ্ডামুলক লেখাটার জনক ফরিদ আহমেদ আমার চেয়েও মূর্খ। আমি তো নিজেকে কখনো জ্ঞানী বলে দাবী করিনি। মুর্খই বলেছি। পড়ে দেখুন আমার মন্তব্যটি।
আমার কথায় কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি আপনার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। আমি শুধু মনে করিয়ে দিতে চাই–এই ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ রায় আমার মন্তব্য করার অধিকারকে ফ্যাসীবাদিদের মত হরণ করে আমাকে গালিগালাজের শিকারে পরিণত করেছিলেন। আমার আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ফরিদ আহমেদ সে ঘটনা এখানেই আমাকে স্মরণ করিয়ে বলেছেন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। এই মুক্তমনাতে আমার লেখার কোনো ইচ্ছেই নেই। কিন্তু ফরিদ আহমদের প্রপাগাণ্ডা মূলক নোটের একটা জবাব দেওয়ার জন্যই এখানে ফিরে এসেছি। এখানে তাঁর জ্ঞানের বহরটা শেষবার দেখে চলে যাব।
@কুলদা রায়,
এই লেখাটিতে মূলত দুটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। ১ গগন হরকরার গানের কথা ও সুরের অনুকরণে তাঁর অনুমতি ছাড়াই ‘আমার সোনার বাংলা’লেখা ও সুর দেয়া। এবং ২’বিশ্বপরিচয়’ প্রবন্ধটি প্রমথনাথের লেখা হওয়া স্বত্তেও শুধু মাত্র ভাষার মাধুরী বর্ধনের জন্য কবি প্রমথনাথের নাম না দিয়ে নিজের নামে চালিয়ে দেয়া। এখানে পুরো কৃতিত্বই তো প্রমথনাথের, ভাষার জন্য কবিরও কৃতিত্ব আছে। তাই বইটির লেখক প্রমথনাথ নন কি? কবিতা, গল্প,উপন্যাস,গান,নাটক, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের কোন শাখায় কবির অবদান নেই? সব শাখাতেই আছে এবং বেশী বেশী করেই আছে। একটি মাত্র প্রবন্ধ যা অন্যের লেখা তা তিনি নিজের মানে চালিয়ে না নিলেও তাঁর কীর্তিতে কোন ঘাটতি পরত কি? আমাদের জাতীয় সংগীত যা কেবল আমরা মুখেই গাইনা, যার সুর আমাদের অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে;এমন কি আমরা যারা গান গাইতে জানিনা সে আমরাও জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আবেগে ,গভীর দেশপ্রেমে হেসে কেঁদে একাকার হয়ে যাই; সেই জাতীয় সংগীতের সঠিক ইতিহাস আমাদের জানার দরকার নেই কি? এ দুটি বিষয় ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হোক সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে।
@কুলদা রায়,
আপনার মন্তব্যে আমি ব্যথিত। আপনাকে বুঝতে হবে ফরিদ ভাই মুক্তমনার পেছনে বিরাট সময় দিয়ে থাকেন এবং আমরা সবাই তার এই নিঃস্বার্থ কাজের জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞ।
দুর্ভাগ্য এই যে নিঃস্বার্থ কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার বদলে, বাঙালী সমাজে, কর্মীদের কপালে গালাগালই জোটে।
অভিজিত এর আগে রামমোহন বা বিবেকানন্দ নিয়ে যে মিথ ব্লা্সটিং করেছে, আমার ব্যক্তিগত এবং বস্তুনিষ্ঠ অবস্থান তার বিরুদ্ধেই। কিন্ত তার জন্যে অভিজিত গালা্গাল না, বরং প্রশংসারই যোগ্য। কারন এই নাম গুলো নিয়ে যেসব অচলায়তন তৈরী হয়েছে, তা বাঙালীর প্রগতির অন্তরায়।
তবে হ্যা, আমি এটাই বলেছি এবং বলবো, যে এই নামগুলির পেছনে লাগতে গেলে, যে পরিমান পড়াশোনা এবং গবেষণা করা দরকার, সেটা না করে মাঠে নামলে, হিতে বিপরীত হবে। যেটা এক্ষেত্রে হয়েছে। তবে মাঠে নামতেই হবে-তাতে ভুল নেই।
কিন্ত আপনার মতন একজন সাহিত্য কুশীলব এমন মন্তব্য করে কি প্রমান করতে চাইছেন? বরং আপনি একটু ভাবুন-একজন মানুষ অফিস, সংসার সামলিয়ে যে বাংলা সংস্কৃতির উন্নতির জন্যে সময় দিচ্ছেন-সেই জন্যে ধন্যবাদ নাই বা দিতে পারলেন-কিন্ত এই ধরনের বস্তির কাজিয়া এখানে না করলেই কি না?
তারা ভুল করেছে-ভুলটা ধরিয়ে দিন। কিন্ত ব্যক্তিগত আক্রমন করছেন কেন? :-Y
@বিপ্লব পাল,
ঠিক এই কথা আমিও বলতে চাইছিলাম, কিন্তু কুলদা হয়তো আবার আমাকেও বলে বসবেন ফরিদকে ডিফেণ্ড করতে এসেছি। না ডিফেণ্ড টিফেণ্ড কিছু নয়, আমাদের ভুল হলে যে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেন, কিন্তু কথায় কথায় কাউকে ভণ্ড, মহামূর্খ বলাটা যে ঠিক নয়, এটা কুলদা হয়তো বুঝবেন।
বিপ্লব এবং তামান্না – আপনাদের ধন্যবাদ। আলোচনা চলুক, কিন্তু ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়।
@বিপ্লব পাল, দেখেন কেউ কোনো প্রতিষ্ঠান গড়লেই তাঁকে অন্যায় সুযোগ দিতে হবে, তাঁর অন্যায় আব্দার মেনে নিতে হবে, তাঁর ছড়ি ঘোরানো মেনে নিতে–কোন যুক্তিবাদে এটা সমর্থন করে? ব্যক্তি যখন প্রতিষ্ঠান গড়েন–তখন সেখান থেকে ব্যক্তিসত্বাকে তুলে নিতে হয়। তা না হলে প্রতিষ্ঠান কেন? আর যখন কোনো প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কারো ব্যক্তিত্বকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়, তখন তার প্রাতিষ্ঠানিক চরিত্রটি হারায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হয়। এতকাল তাইতো জানি। আমাদের দুর্ভাগ্য আমরা এই হনুদের পাল্লায় পড়েই গেলাম। প্রতিষ্ঠানকে আমরা কখনো রক্ষা করতে পারছি না ব্যক্তির ছোবল থেকে।
সেকারণে আমাদের একাত্তরে অর্জিত চেতনা গেছে। কারো বাপের সম্পত্তি হয়েছে, কারো স্বামীর পড়ে পাঔযা ধন হয়েছে। কিন্তু এই কাণ্ডটা যুক্তিবাদিরা কেন করবেন?
@কুলদা রায়,
আপনার কথাটা ঠিক। কিন্ত ফরিদ ভাই এমনটি করেন নি। বরং উনি মডারেটর বলে, আমিই উনাকে কড়া কথা শুনিয়ে দিই-উনি হয়ত পাল্টা ভাষা ব্যবহার করতে পারেন না। ফরিদের সাথে আমার বিতর্ক আগেও হয়েছে-কিন্ত তার জন্যে ব্যক্তিগত আক্রমনে নামার প্রয়োজন দেখি নি।
মুক্তমনা কোন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান না।
মুক্তমনা অভিজিত রায়কে প্রতিষ্ঠা করতে কাজ করছে? এই যদি আপনার বক্তব্য হয়, তাহলে বলবো, মুক্তমনার এডভান্টেজ অভিজিতের থেকে আমিই বেশী পেয়েছি নেটিজেন সমাজে। এই ধরনের ভুল ধারনা মনে রাখবেন না। তাই জমিয়ে কষ্ট পাবেন না।
সুস্থ ভাবে মত প্রকাশ করতে চাইলে, সবাইকেই এখানে সেই সুযোগ দেওয়া হয়। আপনি নিজে ব্যক্তিগত আক্রমন পরিহার করে নৈর্বাত্বিক এবং বস্তুনিষ্ঠ ভাবে বক্তব্য রাখুন, আপনাকে এখানে সবাই সমর্থনই করবে। অনেকেও অলরেডি করেওছে। সুতরাং আপনার সমস্যাটা কোথায়?
আপনি নিজগুণে , নিজ কলমের জোরে স্বপ্রতিষ্ঠিত-আপনার কাব্যখ্যাতি ফেসবুকের ওয়াল বিদীর্ন করেছে-এমন অবস্থায় ফরিদ আহমেদ কি বললো তাই দিয়ে লোকে আপনাকে বিচার করবে না। বিচার করছে এবং করবে আপনার লেখা দিয়ে। এবং আপনি যেধরনের ব্যক্তিগত আক্রমন চালাচ্ছেন, তাতে আপনার ভক্তবৃন্দ আপনার ওপর রুষ্টই হবে-ফরিদ ভাই নয়, আপনি নিজের কলমের জোরেই উঠেছেন-এবং নিজেই নিজেকে নামাচ্ছেন। এটা বুঝুন প্লিজ।
@বিপ্লব পাল,
(Y)
আমি আশ্চর্য হই, কুলদা রায় এখানে আসলে কেন এমনটা করেন ভেবে। অন্যান্য ব্লগে তাকে কারো প্রতি এমন তীব্র আক্রোষ দেখাতে বা ব্যক্তিআক্রমণ করতে দেখেছি বলে মনে পড়েনা। তার বেশ কিছু লেখা অন্য ব্লগে (বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা এর জবাবে) পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছি। এই প্রবন্ধে যে সকল অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে, তা যে অনেকেরই অজানা, সে কথা কুলদা রায় নিজেও স্বীকার করেন। আর তিনি এর জবাবে যে সকল তথ্য হাজির করেছেন, তা আমরা জানতাম কী ভাবে যদি অভিযোগগুলো আদৌ উত্থাপিত না হতো? তাহলে সমস্যাটা কোথায়? যুক্তি ও তথ্যনির্ভর আলোচনা থেকে পাঠক উপকৃত হউক এটাই তো সকলের কাম্য। আপনি কুলদা রায়ের মুখের কথায় কেউ যেমন ফরিদ বা অভিজিতকে স্বল্প-জ্ঞানী, অসৎ, তথ্যবিকৃতকারী বলে মেনে নিবেনা, তেমনি ফরিদ বা অভিজিতের কথায় রবীন্দ্রনাথকে মিথ্যেবাদী বা চোর বলেও কেউ বিশ্বাস করবেনা।
সুতরাং আপনাদের কাছে আমরা সাধারণের দাবী রইলো, ব্যক্তি-বিদ্বেষ, ব্যক্তি-আক্রমণ পরিহার করে ইস্যুভিত্তিক আলোচনা সমালোচনা চালিয়ে যান, বিচারের ভার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিন।
@বিপ্লব পাল,
একমত (Y)
@কুলদা রায়,
পরাজিত এবং পর্যুদস্ত পৌরুষের অহংবোধের অঙ্গারচাপা অনল থেকে নির্গত গরল কী রকম হতে পারে তার প্রজ্বল্যমান প্রমাণ হচ্ছে এই মন্তব্যটি। কুলদা রায়ের কথামালার সাথে সাথে তার মনের কলুষতাও কুৎসিত এবং কদর্যভাবে বের হয়ে আসছে এখন। আমার কিছু করা লাগছে না। পর্যুদস্ত হবার গ্লানি বড় বিশাল গ্লানি। সেই গ্লানি দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আজকে উবু হয়ে উগরে দিয়েছেন সবকিছু উজাড় করে। আশা করি আংশিকভাবে হলেও আনন্দ জমেছে তার অন্তরে। দীর্ঘদিন অনিদ্র রজনী পার করেছেন তিনি অপমানের অনলে পুড়ে। আজ রাতে সুনিশ্চিত সুনিদ্রা হবে তাঁর।
আমার দুঃখ, মুক্তমনার মডারেটর আমি। এই সূত্রে হাত পা বাধা আমার। নাহলে ওইটুকু আনন্দও তাঁর কপালে জুটতো না। কেউ ভদ্র আচরণ করলে আমি যেমন ভদ্রতর আচরণ করি, তেমনি অভদ্র আচরণের পাল্টা জবাবও হয় অভদ্রতর আচরণ দিয়েই। ফোঁস ফোঁস করে ফণা তোলা সাপের চিবুকে চুম্বন চর্চা করা আমার ধর্ম নয়, বরং সেই সাপকে সপাটে পিটিয়ে পিঠের হাড় ভেঙে দেওয়াই আমার প্রকৃতি। কিন্তু মডারেটরের শৃঙ্খলিত বেশ সেই সুকর্ম সমাধানে সাহায্য করে না।
আপনি যে একজন অসত্যভাষী মানুষ, সেটা মনে হয় আপনি নিজেও জানেন না। আপনার মন্তব্য করার অধিকার কখনোই হরণ করা হয় নি। হলে আজকে আপনি জিঘাংসামূলক যে সব মন্তব্য করছেন, সেগুলো করতে পারতেন না। আসুন একটু রিফ্রেশ করি মেমরিকে। আপনি আমার বিরুদ্ধে ব্যক্তি কুৎসামূলক একটা পোস্ট দিয়েছিলেন। সেই পোস্টটা আমার চোখে পড়ার আগেই আপনাকে তুলোধুনো করে ছেড়েছিল মুক্তমনার সদস্যরা। মুক্তমনার পাঠকদের পিটুনি খেয়ে আপনি পোস্টটাকে মুছে দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। এর পর আপনি অন্যব্লগে প্রকাশিত আপনার লেখাকে প্রকাশ করা শুরু করেন নীতিমালাকে উপেক্ষা করে, চ্যালেঞ্জ করে। একাধিকবার মডারেটর আপনাকে নীতিমালা অনুসরণের অনুরোধ জানালেও আপনি তা মানতে রাজি হননি। এরপরই আপনি আমার বিরুদ্ধে আরেকটি পোস্ট দেন ব্যক্তি আক্রমণ করে। সেই পোস্টেও পিটুনি খাওয়া শুরু করেন আপনি। এই পিটুনির ভয়ে আবারও পোস্ট মুছে দেবেন এই আশংকায় মডারেটর আপনার পোস্টটাকে সরিয়ে নেয় আপনার নাম থেকে, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এই আশায়। আজকে সত্যি সত্যিই সেটা কাজে লেগে গেল। এখানে আছে সেই পোস্টটা। এখন পাঠকেরাই বিচার করে দেখুক যে আপনার মন্তব্য করার অধিকার হরণ করে আপনাকে অভিমণ্যু বানানো হয়েছিল, নাকি আপনার ব্যক্তি আক্রমণের প্রমাণকে সযত্নে রক্ষা করা হয়েছিল।
এই রকম আকাম আপনি শুধু আমাদের এখানেই করেন নি। অন্য জায়গাতেও করেছেন। এইতো সেদিনই অভির নামে বিষোদগার করে একটা পোস্ট দিয়েছিলেন সচলায়তনে। তারপর সেখানকার সচলদের সজোর বেত্রাঘাত খেয়ে সেই যে চুপিচুপি চলে গিয়েছিলেন, ফিলিপস বাত্তি জ্বালিয়েও আর আপনাকে খুঁজে পাওয়া যায় নি।
আপনি মনে হয় আয়না টায়না তেমন দেখেন না। দেখলে এই কুরুক্ষেত্রে শকুনী খোঁজার আর প্রয়োজন পড়তো না। আপনার আয়নার আয়তক্ষেত্রেই তা আপনি দেখে নিতে পারতেন।
আমাকে গরুর চোনা প্রমাণের আগে নিজের দিকে একটু দেখুন। আপনি যে এর মধ্যেই অসংখ্যবার গরুর চোনা হিসাবে প্রমাণিত হয়েছেন, সে খেয়াল কি আছে?
এরকম কী হনু ধরনের হুংকার বহু হনুমান দেবতাই আমাকে দিয়েছে। ওই হুংকারটুকু সম্বল। পরে হারিকেন দিয়ে খুঁজেও সেই সব হুংকারবাদীদের আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। হাওয়া হয়ে গিয়েছে তারা।
আপনার সাথে এটাই আমার শেষ সংলাপ। ভদ্রতা শিখে যদি কোনো দিন কথা বলতে আসেন, তবে বলবো। আর অভব্য এবং অশালীন আচরণ নিয়ে এলে উপেক্ষা করা ছাড়া অন্য কোন উপায় আপাতত আমার হাতে নেই। মুক্তমনার মডারেশন থেকে সরে দাঁড়ালে অবশ্য ভিন্ন কথা। সমতল ক্ষেত্রে সমানে সমানে কুস্তি লড়া যাবে তখন না হয়।
ঠাকুর দেবতা দীর্ঘজীবি হোক।
@ফরিদ আহমেদ,
সচলায়তনে অভিজিৎ দার নামে বিষোদাগার করে কুলদা রায়ের লেখাটি যদি আগে পড়তাম, কসম আল্লাহর তাকে উদ্দেশ্য করে কোন মন্তব্য এখানে করতাম না। আহমদ শরীফ যথার্থই বলেছিলেন, ধর্ম চর্চা করে একজন ভাল ধার্মিক হওয়া যায়, শিক্ষা অর্জন করে একজন ভাল শিক্ষিত হওয়া যায় কিন্তু ভাল মানুষ হওয়া যায়না। ফেইসবুক থেকে স্টেটাস চুরি করে যে মানুষ আরেকজনের নামে বিষোদাগার ব্লগে ছড়াতে পারে, সে আর যা’ই হউক ভাল মানুষ নিশ্চয়ই হতে পারেনা। তার এই অসদাচরণের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করি আর সেই সাথে কুলদা রায়ের সদস্যপদ বাতিলের জোর দাবী জানাই।
@আকাশ মালিক, কুলদা রায় খুব খারাপ লোক। অসভ্য লোক।
হা হা হা।
@কুলদা রায়,
কুলদা দাদা আমি মুক্তমনার একজন সাধারন পাঠক মাত্র । আপনার মত আরও একজন কে আমি দেখেছি এখানে মাসুদ রানা নামে ।।যিনি মুল বিষয়ে যাবার আগে লেখক কে লম্বা ধোলাই দেবার চেষ্টা করেন যা কিনা অনেক সময় ব্যক্তিগত বলে মনে হয়। এ রকম অপ্রাসঙ্গিক এবং দৃষ্টিকটু কাজ থেকে বিরত থাকা যায় না ?। আপনাদের বা আপনার যদি লেখকদের সাথে কোন ব্যক্তিগত সমস্যা থাকে তা মুক্তমনার বাইরে এমনকি ব্লগ লিখার বাইরে মিটান । ব্লগ এ আমরা সুস্থ আলোচনা তে সীমাবদ্ধ থাকলে ভাল ।
@কুলদা রায়,
ভুল কথা। গতকাল সীমিত সময়ের মধ্যেও আপনার কথার আমি উত্তর দিয়েছি। আপনিই সম্ভবতঃ বোঝেননি। কেন ডঃ আহমদ শরীফ আর আবুল আহসান চৌধুরীর ‘যেকোন একজনকেই’ সঠিক হতে হবে? এটা যে ‘ফ্যালাসি অব বাইফারকেশনের’ উদাহরণ সেটা তো স্পষ্ট করেই অভিমত দিয়েছি। আপনার পছন্দ না হলে কিছু করার নেই।
সুতোয় কার জোর কতটুকু সেটা না হয় পাঠকদের উপরেই ছেড়ে দিন।
@কুলদা রায়,
অনেক দিন মুক্তমনার বাইরে ছিলাম ব্যস্ততার কারণে। মূল লেখাটাই পড়তে পারিনি। কিছু মন্তব্য পড়লাম। ভালই লাগছিল। তোমার মন্তব্যে ভিন্ন স্রোত এল। তোমার ব্যক্তিগত খেদ আছে হয়ত। কিন্তু তা এখানে কেন?
লেখাটা আর মন্তব্যগুলো পড়ে (বিশেষ করে বিপ্লব আর লেখকদ্বয়ের মন্তব্য প্রতিমন্তব্য পড়ে) আমার আগের দুটো লেখার “যুক্তি, বিশ্বাস, অভিমত ও অনুভূতি” ও “শিল্পানুরাগে আত্মনিষ্ঠতার বিষয়ে কিছু ভাবনা” প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাচ্ছি। যে কোন বিতর্কে তথ্য আর উপাত্তই মুখ্য। সেখানেই বস্তুনিষ্ঠভাবে দ্বিমত বা একমত হওয়া যায়। বিপ্লব, অভিজিৎ আর ফরিদ রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা প্রসঙ্গে তথ্য উপাত্তে মোটামুটি একমত, যেটুকু দ্বিমত আছে তা উপযুক্ত রেফেরেন্স দিয়ে মেটানো সম্ভব। কিন্তু একই তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে দুপক্ষ দুরকম সিদ্ধান্ত টানলে সেটা আত্মনিষ্ট ব্যাপার হয়ে যায় বিধায় সেখানে বস্তুনিষ্ট তর্ক সম্ভব নয়। সমস্যাটা হল, কিছু ঢালাও বিশেষণ নিয়ে, “চোর”, প্রতারক, শোষক ইত্যাদি। সেখানেই একপক্ষ আপত্তি তুলছেন। তথ্য উপাত্ত নিয়ে বিপ্লব/অভিজিত/ফরিদের মধ্যে বিরোধ নেই। কিন্ত গগন হরকরার গান নকল করে তার নাম উল্লেখ না করে স্বীকৃতি না দেয়াকে অভিজিৎ/ফরিদ চৌর্যবৃত্তি বলছে আর বিপ্লবের রায় হল রবীন্দ্রনাথ গানটার সুত্রটা যে ১০০ ভাগ নিজের, সেরকম দাবী করেননি তাই এটাকে চুরি বলা যাবে না। এখানে চুরির সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিমত সেটাই স্পষ্ট। এটা আত্মনিষ্ঠ একটা পার্থক্য, কাজেই নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। দুজনঅই ঠিক বলা যায়। বিজ্ঞানে একটা ব্যাপার মেনে চলা হয়, একটা তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অনেক অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ লাগে। কিন্ত একটা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে একটা উদাহরণই যথেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ যে দেবতা নন সেটা প্রমাণ করা সহজ, যা করা হয়েছে এই লেখায় খুবই কার্যকরীভাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে একটা সামগ্রিকভাবে কোন বিশেষণে ভূষিত করলে সেটা প্রমাণের জন্য অনেক কিছু জানতে হবে। বিপ্লব হয়ত সেটাই বোঝাতে বলেছিল রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে শান্তিনিকেতনে ন্যূনপক্ষে বছরখানেক কাটাতে হবে । সেখানে অনেক তথ্যসূত্র আছে যা অন্য কোথাও নেই। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে দেবত্বের যে অধ্যাস তৈরী হয়েছে সেটা ভঞ্জন করতে অতদূর যেতে হবে না। যেট আগেই উল্লেখ করছি, তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে অতদূর যেতে হয় না। আবার একজন মানুষকে সম্পূর্ণভাবে জানা সোজা নয়। মনের গভীরে প্রবেশ করা সম্ভব নয়। এটা আত্মনিষ্ট একটা ব্যাপার। সম্পুর্ণভাবে জানা মানে সেই লোক প্রতিটি ধাপে কি সিদ্ধান্ত নেবেন বা বলবেন সেটা প্রেডিক্ট করতে পারা। কখনই সম্ভব নয়। তাই ্রবীন্দ্রনাথ বা যে কোন ব্যক্তিকে সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় না কিছু নেতিবাচক উদাহরণ দিয়ে। তাছাড়া কন্টেক্সটের প্রশ্নও আসে। রবীন্দ্রনাথের গানের সুর নকল করা বা লেখকের কৃতিত্ব কুক্ষিগত করা এগুলো তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করা গেছে, যদি অবশ্য এই তথ্য প্রমাণ তর্কাতীত না হয়। এই তথ্য উপাত্ত দিয়েই লেখা শেষ করলে বতর্ক হত না। কিন্তু তথ্য উপাত্তের পর লেখকেরা নিজের কিছু আত্মনিষ্ট রায়ের কারণে বিতর্কের সুত্রপাত। তাত্বিকভাবে এটা সম্ভব যে তথ্য উপাত্ত দিয়েই ইতি টানা, তারপর পাঠকই রায় দেবেন। পেশাদার সাংবাদিক, ঐতিহাসিকেরা বা উকিলেরা যা করেন। কিন্তু আবেগ সবারই কম বেশী আছে, তাই এটা আশা করা অবাস্তব। কিছু আবেগজনিত বিশেষণ এসেই যায়।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ভাবাবেগের আতিশয্যের একটা দিক নিয়ে লেখাতে আলোকপাত করা হয়নি, সেটা হল অনেক রবীন্দ্র ভক্তের “তুমি বুঝবে না। এটা বোঝা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়” জাতীয় উক্তি। তারা রবীন্দ্রনাথের অনেক লেখার কিছু কিছু অংশের গূঢ় অর্থ বের করে মনে করেন শুধু তারাই এটা ধরতে পেরেছে, অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা প্রমাণ করতে অন্যরা যে সেই গূঢ় অর্থে বুঝতে অক্ষম এটা বলে তারা।
গগন হরকরার সুরও খুব মৌলিক কিছু না-উনিও বাউল ব্যাকারন মেনেই গানটির সুর দিয়েছেন-যার মধ্যে আমি নতুনত্ব কিছু দেখছি না-গানটির নোটের প্রায় সবটাই কোন না কোন বাউল টিউনেই পাওয়া যাবে।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ এই গানটির ক্ষেত্রে গগন হরকরাকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করে, সমগ্র বাউলদের সুর স্বীকার করে ঠিক কাজ করেছেন। চুরি ত উনি করেন ই নি-যেহেতু বলেই দিয়েছেন এটি বাউল গান এবং সুর বাউলদের কাছ থেকেই সংগ্রীহিত। কারন গগন হরকরার গানেও গগনের মৌলিকত্ব কিছু নেই-তার অধিকাংশ নোটই খুবই জনপ্রিয় বাউল গানের সুর থেকেই টোকা।
গগন হরকরার গানটি শোনার পর, আমি বিতর্কের আর কোন অবকাশই দেখি না। রবীন্দ্রনাথ এই গানটির ক্ষেত্রে সুরকার হিসাবে বিশেষ কোন বাউলকে ক্রেডিট না দিয়ে সমগ্র বাউল জাতিকে ক্রেডিট দিয়েছেন এবং এই গানটির ক্ষেত্রে এটিই সবচেয়ে সঠিক পদক্ষেপ।
সুতরাং চুরিত দূরের কথা, গানটির ক্ষেত্রে সমগ্র বাউল জাতির ঋণ স্বীকার করে কবি সব থেকে উত্তম কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন-কবিকে সেই গভীরতাই বুঝতে গেলে, আমার লেখক বন্ধুদ্বয়কেও বাউল গান এবং তার নানান সুর কবির মতন গভীরে বুঝতে হবে-যা বুঝতে তারা দৃশ্যতই অক্ষম।
পল্লবগ্রাহীতা দিয়ে অন্যান্য লেখা হতে পারে-কবির বিচার একটু দূরাশা :guru: তার জন্যে অনেক গবেষণা এবং সাধনার দরকার :clap
@বিপ্লব পাল,
একেবারে খাঁটি কথা বলেছো। শুধু কবির না, যে কারো বিচার করতে গেলেই অনেক গবেষণা এবং সাধনার দরকার হয়। শুধু পুজো করতে গেলেই এগুলোর কিছুই লাগে না। সাদা আলখেল্লা পরা লম্বা দাঁড়ির একজন দীর্ঘদেহী বুড়ো মানুষ হলেই চলে। 😛
আমার মনে হয় নাস্তিকদের দেবতা ও আস্তিকদের দেবতার মাঝে অনেক পার্থক্য আছে। আস্তিকগণের দেবতা হচ্ছে ঈশ্বর, ঈশ্বরপ্রেরিত পুরুষ,ঈশ্বরের অবতার ইত্যাদি। তারা দেবতার পূজা করে থাকে পরকালে স্বর্গে যাবার জন্য। নাস্তিকদের যেহেতু এসবে বিশ্বাস নেই,সেহেতু তারা যখন কাউকে দেবতা মনে করে সে দেবতা হন লৌকিক। আমি শতভাগ নাস্তিক, তারপরেও আমি সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করি। আমার কাছে সৃষ্টিকর্তার মানে হচ্ছে, যিনি যে জিনিসটি সৃষ্টি করেন তিনি সে জিনিসটির সৃষ্টিকর্তা। যিনি একটি উপন্যাস লিখলেন তিনি সে উপন্যাসের সৃষ্টিকর্তা,যিনি একটি ছবি আঁকলেন তিনি সে ছবিটির সৃষ্টিকর্তা। কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী,শিল্পী,দার্শনিক এঁরা সেদিক থেকে একেক জন সৃষ্টিকর্তা। নিজেদের চেষ্টায় সাধনায় ও কর্মে পৃথিবীর সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে যুগে যুগে কিছু মানুষ অসাধারণ হয়েছেন। কোন নাস্তিক যদি কোন মনীষীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা লাভ ক’রে,জীবনের সৌন্দর্য সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ক’রে,স্বার্থ ত্যাগের মহিমা লাভ ক’রে জীবনকে সুন্দর ক’রে সাজাতে সক্ষম হয় তাহলে সেই মনীষীর কাছে একটু কৃতজ্ঞতা একটু ভালবাসা জ্ঞাপন করলে ক্ষতি কি? প্রকাশ ভঙ্গীটা একেকজনের একেক রকম হতে পারে। কেউ যদি তার অতি প্রিয় মহামানবের ছবি বা প্রতিকৃতির সামনে গভীর শ্রদ্ধা কৃতজ্ঞতা ও ভালবাসায় একটু মাথা নোয়ায় বা তাঁর চরণে সামান্য কয়েকটি ফুল নিবেদন করে তাতে ক্ষতি কি?
আপনাকে ধন্যবাদ। আমার প্রশ্নের উত্তরটি দেননি। সেই যুক্তিবাদি উত্তরের আশায় আছি। তারপর আপনাদের যাবতীয় বিষয়ে এই অধম ভক্তিবাদি কথা বলবে।
তাহলে কাকে বিশ্বাস করব? সেই ডঃ আহমদ শরীফের জীবিতকালের অনুগত ছাত্রের চিঠিকে, না একালের পরিশ্রমী গবেষক শিক্ষক আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্যকে?
@কুলদা রায়,
আপনিও লেখাটিতে যে মূল দুটো অভিযোগ নিয়ে কথা উঠেছে সেগুলোর কোন উত্তর দেননি, আপনি যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চান, সেদিকেই টেনে নিচ্ছেন, সেটা কেন তা বুঝতে পারছি।
আমার হাতে এই মুহূর্তে সময় খুব কম। তার পরেও দু চার কথা বলি, আপনি যখন চাইছেনই।
আপনি জানতে চেয়েছেন, ডঃ আহমদ শরীফ আর আবুল আহসান চৌধুরীর মধ্যে কে সঠিক। দেখুন, ব্যাপারটা ‘আইদার’ ‘অর’ নয়। হয় ডঃ আহমদ শরীফের কথা সঠিক, নয়ত ‘আবুল আহসান চৌধুরীর’ এভাবে দেখে পুরো ব্যাপারটাকে ‘ফ্যালাসি অব বাইফারকেশনের’ দিকে ঠেলে না দেওয়াই শ্রেয়। এমন কি হতে পারে না যে, দুজনের কথারই কিছু কিছু সত্যতা আছে? রবীন্দ্রনাথ চাষীদের খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেটা তো শচীন্দ্র অধিকারির শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের সময় ইসলাইল মোল্লার নেতৃত্বে দু’শঘর প্রজার বিদ্রোহের উল্লেখ করা হয়েছে অমিতাভ চৌধুরী, জমিদার রবীন্দ্রনাথ বই থেকে। প্রমথ চোধুরীর ‘রায়তের কথা’ থেকে উদ্ধৃত হয়েছে কীভাবে রবীন্দ্রনাথ জমিদারী জিইয়ে রাখতে চাইতেন , না হলে নাকি গ্রামবাসীরা ‘লাঠালাঠি কাড়াকাড়ি ও হানাহানি করে মরবে’। কাজেই রবীন্দ্রনাথের জমিদারীর সময়ে সবকিছু একেবারে শান্তিপ্রিয় ছিলো তা তো নয়। এখন, কাঙাল হরিনাথের উপর ঠাকুর বাড়ির আক্রোশের ব্যাপারটাও মিথ্যে নাই হতে পারে। রেফারেন্স হিসেবে তো এসেছেই ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র প্রবন্ধ, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্পাদিত ‘সাহিত্য’ পত্রিকা ইত্যাদি, যেগুলো আহমদ শরীফ তার লেখায় ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তা বলে এই নয় যে, আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্য মিথ্যা আর আহমদ শরীফই সঠিক। আবুল আহসান যে কথাগুলো বলেছেন সেটারও সবকিছু কিংবা অনেক কিছুই সত্য হতেই পারে। রবীন্দ্রনাথ অবশ্যই বহু মানুষের জন্যি সংবেদশীল হয়েছিলেন, তাদের উন্নতির জন্য কাজ করেছিলেন। কিন্তু তা বলে কখনোই তিনি বা তার ঠাকুরবাড়ির কেউ ব্যক্তিগত আক্রোশে কারো কোন ক্ষতি করতে পারবেন না, সে দিব্যি তো কেউ দেয় নি। বস্তুতঃ মানুষের হাতে যখন প্রভুত ক্ষমতা থাকে তখন কিছু না কিছু অপব্যবহার হতেই পারে, এবং হয়ও। ঠাকুর বাড়ির যাদের উপর আক্রোশ ছিলো তাদের কিছু না কিছু ক্ষতি তারা শক্তি প্রয়োগ করে করতেই পারেন, হয়তো করেছেনও। ‘যেহেতু কিছু মানুষের প্রতি তারা সদয় ব্যবহার করেছেন, সেহেতু তারা কারো কোন ক্ষতিই কোনদিন করতে পারবেন না’, এভাবে ভাবা তো অন্ধ ভক্তি। সেজন্যই বলছি পক্ষে বিপক্ষে এ নিয়ে অনেক আলোচনা করা যায়। আর এ ব্যাপারে আমার ইনপুট আমি দিলাম, ফরিদ আহমেদ-এরও কিছু বলার থাকতে পারে। হয়তো তিনি বলবেনও।
আবারো, ভাল থাকুন। পরে আবার কথা বলার ইচ্ছে প্রকাশ করি।
এই লেখাটা অসাধারণ। রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে অনেকেই লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ নিজেও লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের বউও কিছু কিছু চিঠি পত্রে লিখেছেন। তার পুত্রও লিখেছেন। মুশকিল, রবীন্দ্রনাথের বংশধর কেউ নেই। থাকলে তারাও লিখতেন। তবে এত ভাল লেখা হত কিনা সন্দেহ আছে। এই লেখার সমালোচনা সাহিত্যে নবতর সংযোজন। অভিনন্দন লেখকদ্বয়কে।
আমি, কুলদা রায় অতীব রবীন্দ্র ভক্ত এবং পূজারী হিসাবে নিজের জীবনপাত করছিলাম। এই লেখা পড়ে মনে হল–ব্যাটা রায়, তোমার দেখি ষোল আনাই মিছে। রবীন্দ্রনাথ খুউব খারাপ ছিলেন। এই সত্যটা তুমি জানিও। বিশ্বাস করিও। ভাই, তাই বিশ্বাস করিলাম। আশা করছি ষোল আনা হোক, কআনা ফেরত আসবে এই বিশ্বাস স্থাপনের কারণে।
এই লেখার দুটি রেফারেন্স। এক. ডঃ আহমদ শরীফ। দুই. নীরদচন্দ্র মজুমদার। আরও কিছু রেফারেন্স হয়তো আছে।
ডঃ শরীফ যখন রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে নোটে উল্লেখিত রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন প্রবন্ধ লেখেন–বলার চেষ্টা করেন যে, রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন, তখন তিনি তা প্রমাণের জন্য তাঁর ছাত্র আবুল আহাসান চৌধুরীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সেটার সরেজমিন প্রমাণ সংগ্রহের জন্য। ডঃ শরীফ সেকালে একটা উত্তর দিয়েছিলেন। কি উত্তর দিয়েছিলেন, তাও ফরিদ সাহেব এই নোটে তুলে দিয়েছেন। লেখাটা পড়ে সেকালে অনেকেই অট্টহাস্য করেছিলেন। বলেছিলেন, আবুল আহসান চৌধুরী শিক্ষকের কথায় বড় আমতা আমতা করে সায় দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শত হলেও শিক্ষক, পিএইচডির থিসিসের কাজও তিনি দেখাশুনা করছেন। সুতরাং শিক্ষককে চেতানো ঠিক নয়। এদেশে কে না ভাল রেজাল্টের আশায় শিক্ষকের অনুগ্রহ পেতে চায়?
আবুল আহসান এখন নামী গবেষক এবং শিক্ষক। শাশ্বতকির মোজাফ্ফর হোসেন রবীন্দ্রনাথের প্রজানিপীড়ন বিষয়ে আবুল আহসান চৌধুরীর সাম্প্রতিককালের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। সেখানে এখন কী পাচ্ছি?
তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়ক ছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং প্রজারা তাঁকে ভালই বাসতেন। তাহলে? তাহলে কাকে বিশ্বাস করব? সেই ডঃ আহমদ শরীফের জীবিতকালের অনুগত ছাত্রের চিঠিকে, না একালের পরিশ্রমী গবেষক শিক্ষক আবুল আহসান চৌধুরীর বক্তব্যকে? আশা করছি এই জবাবটি অভিজিৎ রায় এবং ফরিদ সাহেব দিয়ে আমাকেও নোবেল পাওয়ার সুযোগ করে দেবেন। হক মাওলা। আশা করছি এই উত্তরের মধ্য দিয়ে আমি আরও কিছু প্রশ্ন করার সাহস অর্জন করব। আলাপের দরোজাটা খোলা রাখুন শুধু। আমিন।
@কুলদা রায়,
আপনার দিক থেকে মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগল। যে টোনে এবং যে স্বরে মন্তব্য দিয়েছেন সেটা প্রশংসনীয়। এইটুকু প্রয়াস আপনার তরফ থেকে সব সময়ই চাই। আমি খেয়াল করেছি যে, আপনি আমাকে নিয়ে ফেসবুকে বার কয়েক স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘জামাতী ছাগু’ ,’ভণ্ড’ ইত্যাদি বলে, অন্য জায়গায়ও লেখা পোস্ট করেছেন। এগুলো বিশেষণ প্রয়োগ করলে কখনোই আলোচনার দরজা যে খোলা থাকে না তা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। যা হোক, এত গালাগালি খেয়েও আমি কিন্তু কখনোই আপনার বিরুদ্ধে কোন কুৎসিৎ স্ট্যাটাস দেইনি। এইটুকু প্রয়াস আপনার থেকেও চাই।
না এ লেখার রেফারেন্স কেবল ডঃ আহমদ শরীফ কিংবা নীরদচন্দ্র (মজুমদার নয়, চৌধুরী) নয়। আসলে, আপনি যদি দেখেন রবীন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ন কিংবা প্রজা তোষন এ লেখার উপজীব্য নয়। হ্যা এগুলো কথা আণুষঙ্গিকভাবে এসেছে বটে (আর স্বীকার করছি এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে তর্ক করাই যায়), কিন্তু এ লেখায় মূলতঃ প্রমথানাথের বিশ্বপরিচয়ের সাথে সম্পৃক্ততা আর গগন হরকরার গানের সুরের ব্যাপারটাই ছিলো মূখ্য । আমাদের অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে এটুকু বলতে পারি – রবিঠাকুর অরিজিনাল রিসোর্সগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাননি। প্রমথনাথকে দিয়ে পুরো পাণ্ডুলিপি দীর্ঘদিন ধরে লেখানোর পরেও তাকে এমনকি সহলেখক হিসেবেও রাখেননি, পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন। আর গগন হরকরার সুরটি তিনি ব্যবহার করেছেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে, মূল সুরকারের প্রতি কোনরকম স্বীকৃতি না দিয়েই। সেগুলোর রেফারেন্স হিসেবে প্রমথনাথ সেনগুপ্তের আনন্দরূপম, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক, দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের লেখা ‘রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান’, সুমন চট্টোপাধ্যাইয়ের কোন পথে গেল গান, দেবব্রত বিশ্বাসের ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত সহ অনেক রেফারেন্সই এসেছে। আপনি একটু অভিনিবেষ সহকারে পড়লেই বইগুলোর রেফারেন্স লেখায় খুঁজে পেতেন। এ ব্যাপারগুলোকে ফোকাস করাই ছিলো মূখ্য।
রবীন্দ্রনাথ অসামান্য সাহিত্যিক, বাংলাভাষায় তার মত প্রতিভা আসেনি, আগামীতেও আসবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তার শ্রেষ্ঠত্ব মেনে নিয়েই আমাদের এই নিবেদন, বিদ্বেষ থেকে নয়। বাকী আলোচনা পরে হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
আবারো, আপনার মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগলো।
@কুলদা রায়,
আর্দ্র কিছু কথা বলার জন্য ধন্যবাদ আপনাকেও।
এগুলো আপনার ব্যক্তিগত ভাবনা। আপনার জীবন ষোল আনা মিছে না আঠারো আনা মিছে সে বিবেচনা আপনার। কাজেই ও বিষয়ে আমি কোনো মতামত দিছি না। শুধু এটুকু বলে যাচ্ছি যে রবীন্দ্রনাথ খুউব খারাপ ছিলেন এটা প্রমাণ করার জন্য এই লেখা লেখা হয় নি। বরং তিনি যে দোষে গুণে মিলিয়েই একজন মানুষ, হয়তো সাধারণ নন, অসাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু কোনো দেবতা নন, সেটাই দেখানোরই চেষ্টা করা হয়েছে এখানে।
আপনি কাকে বিশ্বাস করবেন না করবেন না সেটা আপনার ব্যাপার। বিভিন্ন ধরনের তথ্য প্রমাণ দেওয়া হয়েছে এখানে, পক্ষে এবং বিপক্ষে। এখন আপনার সিদ্ধান্ত। আমার বা অভির কথা শুনেতো আর আপনি রবীন্দ্র ভক্ত এবং পূজারী হন নি, যে আমরা যা বলবো সেটাই বিশ্বাস করতে হবে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে সব জমিদারকেই প্রজাশোষক মনে করি। কারণ, প্রজার রক্ত চুষে খাওয়াটাই এই পরজীবি শ্রেণীর বৈশিষ্ট্য। কেউ একটু কম রক্ত চোষে, কেউ একটু বেশি চোষে, এই যা পার্থক্য। ওই কম চোষাগুলোকেই আমরা প্রজাদরদী বলে চালিয়ে দিতে চাই। রক্ত কম চুষেছে এই কৃতজ্ঞতায়। গরুর কাছ থেকে অতিরিক্ত দুধ পাওয়ার জন্য তাকে আদর-যত্ন করা যেমন গরুর প্রতি দরদ বোঝায় না, তেমনি জমিদারদের প্রজাহিতকর কাজকর্মও আসলে প্রজাহিতকরণ নয়, বরং প্রজাকে হৃষ্টপুষ্ট করে আরো মজা করে তার হাড্ডি মাংস চিবোনোর উদ্দেশ্যেই করা হয়।
এখানে আপনার নোবেল পুরস্কারের বিষয় আসলো কেন? তীর্যক বক্তব্য ছাড়া কী আপনি আপনার মতামত জানাতে পারেন না?
সাহস অর্জনের কিছু নেই। আমরা ভয়ংকর কোনো প্রাণী নই। নিতান্তই নিরীহ দুজন মানুষ। আলাপের দরজা খোলাই রইলো। জয়, রবি দেবতার জয়।
@ফরিদ আহমেদ,
সংসার সকল সর্বনাশের সার! তবুও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই আলোচনায় অংশ নেয়ার ইতর লোভ সামলাতে পারলাম না|( ইতর বললাম এ জন্যে যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তির চেয়ে প্রবৃত্তির ইতরামি-ই আলোচনা-সমালোচনার অংগচ্ছেদ করে) | এই প্রবন্ধটির জন্যে লেখকদ্বয়কে ধন্যবাদ জানানো অবশ্যই আবশ্যিক মনে করছি| যে রবীন্দ্রনাথকে পড়া এক জীবনে কারো পক্ষে সম্ভব নয়,তারঁ সামগ্রিক সমালোচনা করা সে তো বিশালত্বের একবিন্দুকে ছোঁয়ার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়| অভিজিত আর ফরিদ তাদের দ্বৈত প্রচেষ্টায় সেটা করতে চেয়েছেন আন্তরিকভাবেই| লেখকদ্বয়কে ধন্যবাদ সে জন্যে|
আলোচনা শুরুর আগে এ প্রবন্ধটিতে যে দু’টো ত্রুটি আছে বলে আমি মনে করি সেগুলো আগে বলে নেই| প্রথম ত্রুটিঃ এই লেখার প্রায় সবগুলো উদ্দ্বতিই অন্যের কাছ থেকে ধার নেয়া; কোথাও রবীন্দ্রনাথ থেকে সরাসরি নেয়া নয়| অর্থ্যাত এই প্রবন্ধটি অসংখ্য রবীন্দ্র সমালোচকের রচনার সন্নিবেশ| শুধু সমালোচনা পড়ে এ ধরনের প্রবন্ধ লেখা এক মহাঝুঁকিপূর্ণ | যেটা আবুল হোসেন চোধুরীর বাঁকবদল থেকেই বোঝা যায়| ডঃ আহমদ শরীফও একদার কট্টর রবীন্দ্রসমালোচক থেকে কিছুটা হোলেও পরবর্তীতে সরে এসেছিলেন -যা আমি পরে বলছি| আর নিরোদ সি চোধুরী , এক রবীন্দ্রনাথকে নিয়েই যে বিচিত্র ভিন্ন কথা বলেছেন ভিন্ন ভিন্ন সময়ে সেটা আলোচনা করলেও এক বিশাল বই লিখতে হবে| আমি তা থেকেও কিছু উদ্ধতি দেবো,যদি হাতে সময় থাকে|
আর দ্বিতীয় ত্রুটি, যেটা আমি মনে করি লেখকদ্বয় তাদের পরবর্তী প্রবন্ধে বলবেন | আর তা হোলো, কারা রবীন্দ্রনাথকে “মানব থেকে প্রথমে মহামানব, পরে দেবতা বানিয়ে” ফেলেছেন তা বলা| তা না বললে এ প্রবন্ধটি লেখার সারসত্ত্বা কোথায়? সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষাভাষি মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্রপূজারীদের চেয়ে রবীন্দ্রবিরোধীদের সংখ্যা কী কম? পশ্চিমবংগের নকশাল আন্দোলন থেকে বাম-জমানার প্রায় সবখানেই তো রবীন্দ্রনাথকে বংশদন্ড বানিয়ে পাথর মারার প্রচেষ্টা হয়েছে| পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই প্রতিপক্ষ বানানো হয়েছে অসংখ্যবার| আর বাংলাদেশের মাকসুদের মতো তৃতীয় শ্রেনীর কোন শিল্পীর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে মসকরা করা যে স্রেফ নিজের আত্মপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়, সেটা লেখকদ্বয়ও বেশ ভালোভাবেই জানেন হয়তো| তবু এ প্রবন্ধে সে প্রসংগ টেনে আনা প্রবন্ধটির মানহানী ঘটেছে বলেই আমি মনে করি|
এ প্রবন্ধটি নানা বাহুল্য এবং বিপরীত উক্তিতে ভরা | যেমন,” দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্র মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয় নি।“ অথচ প্রবন্ধটির ভূমিকা এবং প্রথমদিককার বেশীরভাগ অংশই ডঃ আহমদ শরীফের “রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন” প্রবন্ধ থেকে ভাব ধার করে নেয়া| তা হোলে “রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্র মূল্যায়ন সঠিকভাবে হয় নি” কিভাবে?ডঃ আহমদ শরীফের প্রবন্ধটি পড়লে এই প্রবন্ধটি পড়ার প্রয়োজনীয়তা থাকে না| কারণ, এই প্রবন্ধে বাড়তি যে অংশটা আছে ,তা নিতান্তই লেখকদ্বয়ের মনগড়া| রবীন্দ্রনাথকে দার্শনিক বা বিজ্ঞানী বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন কে, কবে? কারো উদ্ধতি না দিয়ে সরাসরি লেখকের লেখা থেকে উদ্দ্বতি দেয়াই সমীচিন| ডঃ আহমদ শরীফ “রবীন্দ্রোত্তর তৃতীয় প্রজন্মে রবীন্দ্র মূল্যায়ন” প্রবন্ধ শেষ করেছেন এভাবে,”স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে এবং বিষয়ী ও সমাজ-সদস্য ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথকে সব সময় অভিন্ন করে দেখা অযোক্তিক ও অসংগত |” আলোচ্য প্রবন্ধে সেই অসংগতিটিকেই অভিন্ন করে দেখানোর প্রচেষ্টা হয়েছে বলে আমি মনে করি| এ প্রবন্ধ থেকে বলছি, “যারা মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন দারুণ বিজ্ঞানমনস্ক, আইনস্টাইনের চেয়েও বিজ্ঞান ভাল বুঝতেন, তাদের দেখানো দরকার রবীন্দ্রনাথ তার জীবনে কীভাবে প্ল্যানচেটে বিশ্বাস করেছেন, কিভাবে হোমিওপ্যাথির মত অপবিজ্ঞানকে শুধু বিশ্বাসই করেননি, নিজেও হাতুরে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন।“ এটা কে বা কারা মনে করেন, প্রবন্ধে সেটা উল্লেখ আছে কী?
নিরোদ সি চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ নিয়ে নানা সময়ে নানা রকম কথা বলেছেন,তাই এ নিয়ে আলোচনা করে সময় ক্ষেপন না করাই ভালো| তবে রবীন্দ্রনাথের “ একরাত্রি” গল্পের সতীশ আর সুচরিতার মতো করেই যে তিনি জীবনাতিপাত করতে চেয়েছিলেন এবং করেছেনও সেটা তিনি শেষ জীবনে “অক্ষমের ক্ষমতা “ প্রবন্ধে বলেছেন,”আমিও বাল্যকাল থেকেই এইরূপ মনোভাবই পোষন করি|” এ রকম অসংখ্য উদ্দ্বৃতি আছে নিরোদ সি চৌধুরীর রচনায়|
হুমায়ুন আজাদের কথা রচনায় না এলেও (?) মন্তব্যে এসেছে|তাই সে প্রসংগেও বলা আবশ্যক | হুমায়ুন আজাদের স্ব-বিরোধীতার শুধু একটা উদাহরণ দেই| বুদ্ধদেব বসু সম্পাদনা করলেন আধুনিক বাংলা কবিতা (১৯৫৪) রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে| হুমায়ুন আজাদ তার আধুনিক বাংলা কবিতা সম্পাদনায় রবীন্দ্রনাথকে বাদ রেখে বললেন,” রবীন্দ্রনাথ মহত কবি সন্দেহ নেই, আর এতেও সন্দেহ নেই যে তিনি আধুনিক নন, রোমান্টিক ; তাই তিনি স্থান পেতে পারেন না আধুনিক বাংলা কবিতার সংগ্রহে|”হুমায়ুন আজাদ বললেন না রবীন্দ্রনাথ আধুনিক নন কেনো| বললেন রোমান্টিক,তাই আধুনিক নন| অথচ অসংখ্য রোমান্টিক কবিতা এবং কবিদের স্থান দিলেন এই সংকলনে|আল মাহমুদ সহ আরো অনেককে বাদ দিলেন মৌলবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলদের দোসর চিহ্রিত করে , অথচ দু’টো নিম্নমানের কবিতা নিলেন আরেক মৌলবাদী আর প্রতিক্রিয়াশীলদের সহযোদ্ধা ও দোসর ফরহাদ মাজহারের|
ভালো থাকবেন সবাই|ধন্যবাদ|
@ভজন সরকার,
দাদা, শুধু ভালো লাগা আর মন্দ লাগার বাইরে গিয়ে সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে যে চমৎকার মন্তব্যটি করেছেন, লেখাটির ত্রুটিগুলোকে চিহ্নিত করেছেন, সে জন্য অত্যন্ত খুশি আমি। আপনাকে বিরাট একটা ধন্যবাদ না জানালেই নয়।
এই খুশির মাত্রাটা আরেকটু বাড়তো যদি বিশ্বপরিচয় এবং আমার সোনার বাংলা গান নিয়ে যে চলমান বিতর্ক হচ্ছে সে বিষয়ে কিছু বলতেন।
তবে, নিদারুণ দুঃখ পেয়েছি মাকসুদকে তৃতীয় শ্রেণীর শিল্পী বলায়। বাংলাদেশের ব্যান্ড শিল্পীদের মধ্যে মাকসুদ আমার সবচেয়ে প্রিয়। নিয়মিতই তাঁর গান শুনি আমি। মাকসুদকে নিয়ে একটা লেখা লিখবো বলে কিছুদিন ধরে পরিকল্পনা করছিলাম। সেই লেখাটা আর লেখা হবে না আপনার এই মন্তব্যের কারণে। 🙁
@ফরিদ আহমেদ,
সহসা মন্তব্য করেই আবার আপনাকে নিদারুণ দুঃখ দিয়ে ফেললাম বলে আমিও দুঃখিত! মাকসুদকে নিয়ে আপনার লেখা পড়ে আমার অবস্থান বদলে যেতে কতক্ষন?অপেক্ষায় রইলাম আপনার লেখা এবং সংযুক্ত নমূনা সংগীতের;সেই সাথে আমার অক্ষ (?) বদলেরও!
আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বির্তককে খুব একটা গুরুত্ব দেই না, এতে গুরুত্বহীন কথা সামনে চলে আসে, তলিয়ে যায় আসল কথা। আমার মন্তব্যেও বলেছি,সংখ্যা বিচারে বাংলা ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে রবীন্দ্রপূজারীদের চেয়ে রবীন্দ্রবিরোধীদের সংখ্যা কী কম?আরেকটা প্রবন্ধে রবীন্দ্রপূজারীদের কথা বলুন,তারা কিভাবে রবীন্দ্রনাথকে দেবতার আসনে বসিয়েছেন?
এ প্রবন্ধটি শরীফ স্যারের প্রবন্ধটির অনুবর্তী ( জানি না, শব্দ প্রয়োগটি ঠিক হোলো কিনা?)। তবে পাঠক আকর্ষী বটে! আমি নিজেও কাটিয়ে দিলাম অনেকটা সময়। রবীন্দ্রনাথ এখনো আমাদের মোহের আবেশে জড়িয়ে রাখেন । তাই নির্মোহ সমালোচনা বেশ দুস্প্রাপ্য।
আবুল আহসান চৌধুরীর নামটা ভুল লিখেছিলাম আগে। ভালো থাকবেন।ধন্যবাদ!!!
@ভজন সরকার,
লেখাতো আর সহসাই দিতে পারবো না। একটা গান দিচ্ছি এখনই। অক্ষ বদল করার প্রয়োজন নেই, শুধু শুনলেই হবে। ওতেই খুশি আমি।
httpv://www.youtube.com/watch?v=aI9j_TpXgcg
@ভজন সরকার,
ভাল লাগলো আপনার মন্তব্য পেয়ে। লেখাটির বেশ কিছু সমালোচনা যৌক্তিক। তবে সমালোচনারও সমালোচনা সম্ভব। তবে সেদিকে আর যাচ্ছি না। বরং মনে করি, বেশ কিছু ব্যাপারে আমি নিজেদের ডিফেণ্ড করতে পারব নিঃসন্দেহে। শুরু করা যাক।
অনেকেই। আমি এখানে একটিমাত্র উদাহরণ দেই। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান’ বই্টি দেখতে পারেন। আইনস্টাইন-রবীন্দ্রনাথ সংলাপের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথই যে সঠিক ছিলেন, তা প্রিগোঝিনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন। এ ধরণের অসংখ্য বইপত্রই আছে।
আর আপনি যদি আনন্দ পাবলিশার্স, দেশ পত্রিকা এবং ঢাকা এবং ভারতের রাবীন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্ম দেখেন, তাহলে বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথকে কেবল সাহিত্যের আসরেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়নি, বরং বিরাট এক দার্শনিক বানানোরই চেষ্টা করা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে । বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জনাব খলিকুজ্জামান তো বলেইছেন রবীন্দ্রনাথই ছিলেন ‘ক্ষুদ্র ঋণের জনক’ , পত্রিকায় এই খবর এসেছে। আওয়ামিলীগও সেটা খুব জোরে সোরে প্রচার করে ইদানিং। গান, কবিতা, গল্প, নাটক এগুলোতো আছেই – এমনকি সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, কোয়ান্টাম ফিজিক্স, দর্শন, অর্থনীতি, কৃষিকর্মকাণ্ড, সমবায় প্রচেষ্টা, নারীশিক্ষা, ক্ষুদ্র ঋণ – সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ। এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে ‘রাবীন্দ্রিক জ্ঞান’ দ্বারা আমরা ধন্য হই নাই। তারপরেও বলবেন যে, তাকে দার্শনিক বানানো হয় নাই?
মাকসুদ তৃতীয় শ্রেণীর নাকি প্রথম শ্রেনীর শিল্পী সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য ছিলো না। তাকে সমালোচিত হতে হয়েছিলো রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কোন রকম নাড়াচাড়া করার চেষ্টার কারণেই। পশ্চিমা বিশ্বে হেভি মেটাল, থ্রাশ, রক এণ্ড রোল, রেগে, ব্লুজ, জ্যাজ, কান্ট্রি মিউজিক নিয়ে নিরন্তর ভাঙ্গাচোরা চলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আর তার গানকে কেন ব্যতিক্রম হিসেবে রাখতে হবে, সেটাই ছিলো প্রশ্ন। ব্যক্তিগতভাবে আপনার মাকসুদের গান ভাল নাই লাগতে পারে, কিন্তু ফিউশন করার অধিকারটি আপনি কেড়ে নিতে পারেন না। ফিউশন করার পরে আপনি বলতে পারেন যে, হ্যা- গানটি আপনার চোখে মানীত্তীর্ণ হয়নি। আর তৃতীয় শ্রেনীর কথা বললে, আমিও নিজেকে একজন তৃতীয় শ্রেনীর লেখকই মনে করি, অন্ততঃ রবীন্দ্রনাথের তুলনায় তো বটেই। সে হিসেবে আমারও সম্ভবতঃ এ ধরণের সমালোচনা লেখা উচিৎ হয়নি।
এ নিয়ে আগে বিস্তৃত আলোচনা করা হয়ছিল। তাই এর পুনরুক্তি বাহুল্য মনে করেছি। তিনি নিজেই প্ল্যানচেটে অংশগ্রহণ করতেন, এবং জমিদারি দেখভালের জন্য পতিসর কিংবা শিলাইদহর কুঠিবাড়িতে থাকাকালীন লেখালেখির ফাঁকে প্রজাদের হোমিওপ্যাথির চিকিৎসাও করতেন তিনি। আপনি চাইলে বহু রেফারেন্সই হাজির করতে পারব।
যাহোক সমালোচনার ক্ষেত্রে বলা যায়, আমাদের লেখায় যে মূল দুটি অভিযোগ করা হয়ছে – প্রমথনাথ এবং গগন হরকরাকে নিয়ে সে নিয়ে তেমন কোন ফীডব্যাক এখানে পাওয়া গেল না। তারপরেও চমৎকার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ পাওনা ভজন সরকারের।
মুক্ত মনায় ব্যক্তি পুজা কথাটা বারবার ঘুরেফিরে আসে । ব্যক্তি পুজা কে তখন ই পুজা বলা যায় যখন কোন ব্যক্তির প্রশংসা করা হবে আসলে যার প্রশংসা পাবার কোন যোগ্যতা নেই , যেমন আমাদের পির সাহেব রা । কিন্তু কারো সৃষ্টিশীল কোন কাজ এ আমি গদগদ হয়ে যারপর নাই প্রশংসা করলে কি পুজো হবে ? । বরং আমি ত দেখি মুক্তমনা তে অভিজিৎ এবং ফরিদ সাহেবদের লিখার কেও গদগদ প্রশংসা করলে তারা ৩২ দাঁত কেলানো হাসি ই দেন ধন্নবাদ সহ :)) । কখনও ত বলতে শুনলাম না যে তারা বলছেন যে ,”আপনি ভাই আমাকে পুজো করছেন ,এটা ঠিক না, আগে সমালচনা করুন তারপর প্রশংসা করুন !!”। রবিন্দ্রনাথ এর সমালচনার কি আকাল পরেছে নাকি ? । সমালচনা ছাড়া রবিন্দ্রনাথ পার পেয়েছেন একথা মনে করবার কোন কারন নেই। রবিন্দ্রনাথ এর সমসামিয়ক মোহিত লাল মজুমদের ও রবিন্দ্রনাথ এর বর সমালোচক ছিলেন, রবিন্দ্রনাথ এর সময় ই । লেখকবৃন্দ স্বীকার অ করেছেন সমালোচনা বা জটিল সমালোচনা কাওকে খাটো করে না বরং সমৃদ্ধ ই করে । সেক্ষেত্রে এ লেখার সুত্র ধরে রবিন্দ্রনাথ আরও সমৃদ্ব হবেন হয়ত ! , । বলছিলাম পুজোর কথা, ব্যক্তি পুজোর কথা । এ বেপারটা আমার কাছে পরিস্কার না কখনই …। বঙ্গবন্ধু কেও কৃতিত্ব দিতে গেলে বেক্তি পুজোর দায় কাধে এসে পরে । শুধু মাত্র পাকিস্তান এর প্রধানমন্ত্রী হবার লোভ ত্যাগ করতে পেরেছিলেন এজন্য তাকে ধন্নবাদ দিতে গেলেও পুজোর দায় এসে পরে কাধে !…।।জাই কই ??… 🙁 ।
@সপ্তক,
কই আপনি তো দিব্যি দাঁত ঢেকে রেখেই আমাদের বিরাট সমালোচনা করে ফেললেন। কেউ বাধা দেয়নি। অভিজিৎ ফরিদ কেন, অযৌক্তিক কথা বললে সবারই সমালোচনা হবে এখানে। এটাই তো হওয়া উচিৎ। গুরুবৃত্তির বলয় থেকেই তো সবাইকে বের করতে চাইছি আমরা, পাল্টা গুরু তৈরি নয়।
@অভিজিৎ,
রবিন্দ্রনাথ এর সমালোচনা কি হয় না …বা হয় নাই?… কেউ কবিগুরু বললে বা বিশ্ব কবি বললে , যে বলবে তার দায় । কেউ কেউ গুরু মানবে বলে আমি ত মানব না , কিন্তু আমাকে মানাতে চাইলে যে মানাতে চাইবে তাকে বকা দেব বা বোঝাব । রবিন্দ্রনাথ এর কলঙ্ক বের করে বোঝাতে হবে কেন? , রবিন্দ্রনাথ ত কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিএ ঠগবাজি করেন নাই । সাহিত্য নিএ ঠগবাজি প্রমান করা বিশেষ করে রবিন্দ্রনাথ এর ক্ষেত্রে যে কতটা কঠিন কাজ তা ত বুঝতে ই পারছি , মন্তব্বের পাহাড় থেকে । আপনারা সফল হলে আমি সবচেয়ে খুশী হব । কারন একজন জমিদার কে এত বড় মাপের মানুষ ভাবতে আমার ও কষ্ট হয় বৈকি ! , কিন্তু যার পাওনা তাকে না দিলেও যে চলে না ।
সমুদ্রে শুধু মনি মুক্তা ই থাকে না অনেক ধরনের সনপদ থাকে , তারপরেও বিভিন্ন নদী এসে মিশে যায় সাগরে। এতে করে সাগর এর সম্পদ কতটা বৃদ্বি পায় কে জানে তবে সাগর নদিকে গ্রহন করতে না চাইলে নদীর হয়ত বা একটু অসুবিধা হতে পারে । ফারিদ এবং অভিজিত দুটি পয়েন্ট নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন ।১) গগন হরকার ২) প্রমথ নাথ । গগন হরকার এর গানের সুর আমার সোনার বাংলার…সুর এক ই। এখন কথা হচ্ছে সুর কি বিজ্ঞান ?,কিভাবে সৃষ্টি হয় সুর ?। সৃষ্টিশীল যেকোনো কাজ কোথায় কিভাবে শুরু এবং শেষ হয় তা সৃষ্টিকারী নিজেও ঠিকভাবে জানে? । বিজ্ঞান নয় ত এটা। এমন কি জনপ্রিয় বিজ্ঞান ও না । গগন হরকার এর সুর বাউল সুর । বাউল সুর গগন হরকার এর সৃষ্টি নয় । বাউল সুর অনেক প্রাছিন, রবিন্দ্র সংগীত এর ও নিজস্ব একটা গায়কি ঢং আছে। যদি অন্য কারও লিখা গান এ রবিন্দ্রইও ঢং ধরা পরে এবং তা কোন নির্দিষ্ট একটি রবিন্দ্র সঙ্গীত এর সাথে কিছুটা মিলেও যায় তাইলে কি বলতে হবে তা রবিন্দ্রনাথ থেকে চুরি করা?।বিপুল সংখ্যক রচনার মাঝে ২।৩ টি গান নিয়ে তোলপাড় করার পিছনে কি কোন উদ্দেশ্য আছে?।মনে হয় না খারাপ কোন উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু কিছুদিন আগে সুনীল গঙ্গপধ্যায় এর একটা সাক্কাতকার পরছিলাম।একসময় সুনিল রবিন্দ্রনাথ এর প্রচণ্ড সমালোচনা করতেন , সে প্রসঙ্গে তাকে প্রস্ন করা হলে সুনিল এর সরল সিকারুক্তি ছিল ,” আমরা এমন একটা সময় পার করেছি যখন বাঙালি মনে করত নতুন করে আর রচনা করবার কিছু নেই, সব ই রবিন্দ্রনাথ রচনা করে ফেলেছেন। আমাদের সব রচনা তুছছ,হিংশা থেকে রবিদন্রনাথ কে কোন কারন ছাড়া ই বা তুছহ কোন কারনে আক্রমন করেছি”। হুমাউন আজাদ ও তাই করেছিলেন ।হুমায়ন আজাদ এর অবশ্য ধারনা ছিল বাংলা সাহিত্য ই আসলে মৌলিক নয়, যে অর্থে এউরপিও সাহিত্য মৌলিক। সাহিত্য বোদ্বা আমি না (মনে হয় না লেখক ব্রিন্দ ও)।রবিন্দ্রনাথ কে জোচ্চর প্রমান করা সত্যি খুব কঠিন। জালিওয়ানবাগ এর হত্তাকান্দের পর রবিন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন,কিন্তু গান্ধী তার কাইজার ই হিন্দ খেতাব আরও কিছু বছর ধরে রেখেছিলেন যতদিন না কংগ্রেস দলিও ভাবে ব্রিটিশ খেতাব বরজন এর সিধান্ত না গ্রহন করে । নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর যেন ভারতীও বাঙালি সমাজ রবিন্দ্রনাথ কে স্বীকৃতি দেবার মওকা পায় । এর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর গ্রাজুয়েট রা রবিন্দ্রনাথ কে যে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখত তা বুঝা যায় মহিতলাল মজুমদের এর মত শিক্ষিত রা যখন নোবেল লরিয়েট রবিন্দ্রনাথ কে সম্ম্মনা জানাতে বোলপুরে যান সেখানে দেয়া রবিন্দ্রনাথ এর আখেপ মুলক বক্তিৃতা থেকে ,”কুকুর এর লেজে টিনের কৌটোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে লাগিয়ে দিলে জেভাবে কুকুর দৌড় দেয়,কিছু লোক তেমনি আজ এসেছ আমাকে অভিবাধন জানাতে।”..।। অর্থাৎ রবিন্দ্রনাথ এর চুরি করার ধান্দা আসলে মজ্জাগত ছিল কি না তা প্রমান করার চেষ্টা থাকলে ভাল হত এই লেখায় । বিছিন্ন দুই/চারটি উদাহরন দিয়ে বাটপারির পরযায় ফেলা কি ঠিক ? । চোর সে চোর ই , সে যে ই হোক না কেন,একথা সাহিত্যে বলা খুব কঠিন , যদি তা পুরনাঙ্গ চুরি না হয়।অরথাত লিখা,সুর সব ই যদি নকল হত তা হলেও না হয় কথা ছিল। এক্ষেত্রে নুস্রাত ফতেহ আলি খান এর সুর মেরে দেয়া র সাথে মেলান ঠিক হবে না যার সাথে বাণিজ্যিক প্রস্ন জরিত। রবিন্দ্রনাথ নিশ্চয় গগন হরকার এর সুর এর বিনিময় এ বেবসা ফাদেন নাই। প্রমথনাথ এর সৃষ্টি চুরি নিয়ে কি আর বলব ? ,তাইলে মার্ক টোয়েন কেও বই চুরির দায়ে ধরতে হয়।মার্ক টোয়েন বই চুরি করেছিলেন নাকি জ্ঞান চুরি করেছিলেন আবার জ্ঞান চুরি বৈধ কিনা সে বিতর্কে কে যাবে ? :-X ।। বানান ভুল থেকে বের হতে অনেক সময় লাগবে বুঝতে পারছি আবার এডিট করতে গেলে লিখা এ যাবে না।কেউ কি বলবেন বাংলা কীবোর্ড কিভাবে পাব এবং ইন্সটল করব?।। :-Y
@সপ্তক,
আপনার যুক্তিটা খুব মনে ধরেছে আমার। আমিও এখন থেকে প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথের একটা করে কবিতা চুরি করে মুক্তমনায় নিজের নামে ছাপাবো। এখান থেকে আমি কোনো টাকা পয়সা পাই না, কাজেই ব্যবসা ফাদার কোনো প্রশ্নই উঠছে না, কী বলেন?
@ফরিদ আহমেদ,
খুব মজা পেলাম । রবীন্দ্রনাথ এর কবিতা নকল করলে কি ই বা আর আসবে যাবে ?……। হা…হা…হা… রবিন্দ্রনাথ এর বিশ্বভারতি মনে হয় না এখন আর যুদ্ব করার মনোভাব আগের মত পোষণ করে…। কিন্তু পাঠক বা রবিন্দ্র পূজারী রা রাম দা হাতে নিয়ে নেমে পরলে আমি নাই… :-O । পুজারি রা মৌলবাদী । আমি পুজারি নই । যারা পুজারি তারা পুজার জন্য কোন কিছু ই বাদ দেন না…গরু , ছাগল , মোষ ,…আগুন , পানি…। সেক্ষেত্রে কেও রবিন্দ্রনাথ কে পুজো করলে তাকে করুনা করা ছাড়া আর কিই বা করার আছে ? ।
এ বিষয় অর্থাৎ মুল লেখার বিষয় এ আমার আর খুব বেশি কিছু বলার নেই ,আমি শুধু যেসব মন্তব্বের সাথে সহমত বা যুক্তির সাথে ঐক্য খুজে পাছছি তা তুকে দিলাম
১) বিপ্লব পাল ঃ
গগন হরকরার সুরও খুব মৌলিক কিছু না-উনিও বাউল ব্যাকারন মেনেই গানটির সুর দিয়েছেন-যার মধ্যে আমি নতুনত্ব কিছু দেখছি না-গানটির নোটের প্রায় সবটাই কোন না কোন বাউল টিউনেই পাওয়া যাবে।
সুতরাং রবীন্দ্রনাথ এই গানটির ক্ষেত্রে গগন হরকরাকে বিশেষ ভাবে উল্লেখ না করে, সমগ্র বাউলদের সুর স্বীকার করে ঠিক কাজ করেছেন। চুরি ত উনি করেন ই নি-যেহেতু বলেই দিয়েছেন এটি বাউল গান এবং সুর বাউলদের কাছ থেকেই সংগ্রীহিত। কারন গগন হরকরার গানেও গগনের মৌলিকত্ব কিছু নেই-তার অধিকাংশ নোটই খুবই জনপ্রিয় বাউল গানের সুর থেকেই টোকা।
২)অপার্থিব ঃ
বিপ্লব, অভিজিৎ আর ফরিদ রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা প্রসঙ্গে তথ্য উপাত্তে মোটামুটি একমত, যেটুকু দ্বিমত আছে তা উপযুক্ত রেফেরেন্স দিয়ে মেটানো সম্ভব। কিন্তু একই তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে দুপক্ষ দুরকম সিদ্ধান্ত টানলে সেটা আত্মনিষ্ট ব্যাপার হয়ে যায় বিধায় সেখানে বস্তুনিষ্ট তর্ক সম্ভব নয়। সমস্যাটা হল, কিছু ঢালাও বিশেষণ নিয়ে, “চোর”, প্রতারক, শোষক ইত্যাদি। সেখানেই একপক্ষ আপত্তি তুলছেন। তথ্য উপাত্ত নিয়ে বিপ্লব/অভিজিত/ফরিদের মধ্যে বিরোধ নেই। কিন্ত গগন হরকরার গান নকল করে তার নাম উল্লেখ না করে স্বীকৃতি না দেয়াকে অভিজিৎ/ফরিদ চৌর্যবৃত্তি বলছে আর বিপ্লবের রায় হল রবীন্দ্রনাথ গানটার সুত্রটা যে ১০০ ভাগ নিজের, সেরকম দাবী করেননি তাই এটাকে চুরি বলা যাবে না। এখানে চুরির সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিমত সেটাই স্পষ্ট। এটা আত্মনিষ্ঠ একটা পার্থক্য, কাজেই নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। দুজনঅই ঠিক বলা যায়। বিজ্ঞানে একটা ব্যাপার মেনে চলা হয়, একটা তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অনেক অনেক সাক্ষ্য প্রমাণ লাগে। কিন্ত একটা তত্ত্বকে ভুল প্রমাণ করতে একটা উদাহরণই যথেষ্ঠ। রবীন্দ্রনাথ যে দেবতা নন সেটা প্রমাণ করা সহজ, যা করা হয়েছে এই লেখায় খুবই কার্যকরীভাবে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে একটা সামগ্রিকভাবে কোন বিশেষণে ভূষিত করলে সেটা প্রমাণের জন্য অনেক কিছু জানতে হবে। বিপ্লব হয়ত সেটাই বোঝাতে বলেছিল রবীন্দ্রনাথকে জানতে হলে শান্তিনিকেতনে ন্যূনপক্ষে বছরখানেক কাটাতে হবে ।
হাঁ…উপরের মন্তব্য গুলর সাথে সহমত একারনে যে কে কাকে পূজ্য করল সে অজুহাতে সমালোচনার জন্য ই সমালোচনাতে নামা ত ঠিকক না রে ভাই ।গান্ধি কেও অনেক মানুষ পুজো করে রে ভাই , যে পুজো করবেই বলে ধনুরভঙ্গ পন করেছে তাদের সুমতি হক…আমরা করব না ।
একটা বিশয় লক্ষ্য করা যায় যে মাঝে মাঝে ই অনেক লিখায় মোহাম্মাদ এর সাথে তুলনায় চলে যাই আমরা । এব্যাপারে অপ্রসাঙ্গিক মনে হলেও আমি একটা তুলনামুলক উদাহরন দেই ঃ কিছুদিন আগে আনা নিকলস নামে হলিউড এর পর্ণ অভিনেত্রি মারা যান , তার মৃত্যুর পর পশ্চিমা মিডিয়া গুলো অন্তত ২ বছর তার মৃত্যুর কারন , ড্রাগ…সন্তান এর সঠিক পরিচয়য় …এগুলো নিয়ে লাগাতার প্রোগ্রাম করে কিছু পয়সা কামিয়েছে । পাবলিক ও খেয়েছে । মাইকেল জ্যাকসন এর মৃত্যুর আমার ধারনা ছিল পশ্চিমা মিডিয়া গুলো অন্তত ৫ বছর মাইকেল কে নিএ বেবসা করবে । শুরু ও করেছিল । কিন্তু ৪/৫ মাস এর বেশি [পারে নাই , কারন পাবলিক খায় নাই । পাবলিক না খেলে ই কি সব মাফ ? , তাও নয় , আসলে মানুষ দেবতা না মানুষ তা জানে , চাঁদের ও কলঙ্ক আছে …ইত্তাদি…। কথা হল কারও কর্ম তার সেসব কলঙ্ক কে যদি ছাপিয়ে যায় তাহলে কে কেয়ার করে ?……… । সেক্ষেত্রে আনা নিকলস এর সাথে মাইকেল এর যে পার্থক্য , মহাম্মাদ এর সাথেও রবিন্দ্রনাথ এর সে পার্থক্য । এখানে অবশ্য মোহাম্মাদ এর সাথে সরাসরি নয় , কোরানের কথা উল্লেখ করে , রবিন্দ্র মোল্লা দের কথা বলা হয়েছে । মহাম্মাদ কেও ত একরকম পুজাই করা হয় নাকি ? , প্রত্তক্ষ্য ভাবে না হলেও পরোক্ষ ভাবে ।
বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য স্রষ্টা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর মত করে এরকম দুহাত উজাড় করে বাংলা সাহিত্যকে এত রত্নভাণ্ডার আর কেউ উপহার দিতে পারে নি। ঊনিশ শতকের এক দরিদ্র সাহিত্যের অধিকারী বাংলাকে তিনি প্রায় একক প্রচেষ্টাতেই জাতে তুলেছেন, সমৃদ্ধকর করে তুলেছেন। বিশ্বসভায় বাংলা সাহিত্যকে সগৌরবে উচ্চ আসনে বসিয়েছেন। নিরন্তর সৃষ্টি করেছেন তিনি। তাঁর মত এরকম ঐকান্তিক একাগ্রতায় সারা জীবনব্যাপী শুধুমাত্র সাহিত্য সৃষ্টি আর কোনো সাহিত্যিকের দ্বারা সম্ভবপর হয় নি। না এই অঞ্চলে, না সারা বিশ্বে। সচ্ছল পরিবারে জন্ম হওয়ার কারণে জীবিকা নিয়ে তাঁকে তেমন করে ভাবতে হয় নি কখনো। ফলে, আমৃত্যু তিনি সার্বক্ষণিক সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অফুরান সময় পেয়েছেন। আর সেই সুযোগকে পূর্ণভাবে তিনি কাজে লাগিয়েছেন তাঁর অবিরাম আগ্রহ, নিরলস প্রচেষ্টা এবং ক্লান্তিহীন লেখালেখির মাধ্যমে। সেই কৈশোর বয়স থেকে যে তরী তিনি ভাসিয়েছেন সাহিত্যের স্রোতস্বিনীতে, তার সফল সমাপন ঘটেছে মরণ সাগরের তীরে এসে।
এখানে ই আপনারা সত্তিকারের , ফরিদ এবং অভিজিৎ ই থেকে গেছেন । আপনাদের ধন্যবাদ এমন একটি লিখার মাধ্যমে আমাদের কে নতুন করে কিছু ভাবানোর জন্য ।
আমি মুক্তমনা নিয়মিত পড়ি গত ২ বছর যাবত । এর মাঝে সুধু ২/১ বার কিছু মন্তব্য করা ছাড়া আমার আর কোন অবদান নেই । কিন্তু অভিজিত বা ফরিদ এর মত ভাল লেখক দের কোন উত্তর পাই নাই মন্তব্বের বিপরীতে , এবার ই প্রথম পেলাম । খুব ই উতসাহ পাছ্ছি , হয়ত ব্লগ ও লিখে ফেলব :rotfl: । আমি বিশেষ করে অভিজিৎ এর খুব ভক্ত আরও অনেক এর মত , :-O ( ফরিদ না আবার পুজা ভেবে বসে ! ) । অভিজিৎ এর বিজ্ঞান বিষয়ক লিখাতে নাক গলানোর জ্ঞান বা সাহস আমার নেই , ফরিদ এর পাল্লায় পরে এমন একটা কাঁচা লিখা না লিখলে নাক গলানোর সুযোগ ই বা কোথায় পেতাম ? :-s ।
@সপ্তক,
একটা লেখা কাঁচা না পাকা, এই সিদ্ধান্ত দেবার অধিকার পাঠক হিসাবে আপনার আছে। কিন্তু কে কার পাল্লায় পড়ে কাঁচা লেখা লিখেছে, আর আপনি নাক গলানোর অধিকার পেয়েছেন এই ধরনের কল্পনাশ্রয়ী অমার্জিত মন্তব্য করে লেখকদের অপমান করার অধিকার আপনার নেই। এই বিষয়টুকুর প্রতি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন বলে আশা রাখছি।
মুক্তমনায় নিয়মিত মন্তব্য করছেন বলে আপনার আন্তরিক একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
@ফরিদ আহমেদ,
আমার মন্তব্বঃ
“অভিজিৎ এর বিজ্ঞান বিষয়ক লিখাতে নাক গলানোর জ্ঞান বা সাহস আমার নেই , ফরিদ এর পাল্লায় পরে এমন একটা কাঁচা লিখা না লিখলে নাক গলানোর সুযোগ ই বা কোথায় পেতাম ?”
আপ্নার উত্তর ঃ”… আপনি নাক গলানোর অধিকার পেয়েছেন এই ধরনের কল্পনাশ্রয়ী অমার্জিত মন্তব্য করে লেখকদের অপমান করার অধিকার আপনার নেই। এই বিষয়টুকুর প্রতি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন বলে আশা রাখছি।”
মুক্তমনায় নিয়মিত মন্তব্য করছেন বলে আপনার আন্তরিক একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।
ভাই অধিকার এর কথা ত বলি নাই , সুযোগ এর কথা বলেছিলাম , নিজেকে ধন্য মনে করেছিলাম তা এমন ধমক দিলেন যে একটু দমেই গেলাম:-( । ব্লগ এ আপনার নাম আগে , অভিজিত এর নাম পরে দেখে আমার মনে হয়েছিলো আপনই হয়ত লেখার মুল পরিকল্পনাকারি তাই …” পাল্লায় পরে …” লিখেছি ।অপমান এর প্রস্ন কেন আসল বুঝলাম না ।
আরও লিখেছি , “…
অভিজিত বা ফরিদ এর মত ভাল লেখক দের কোন উত্তর পাই নাই মন্তব্বের বিপরীতে , এবার ই প্রথম পেলাম । খুব ই উতসাহ পাছ্ছি , হয়ত ব্লগ ও লিখে ফেলব ”
মানে আমার মন্তব্বের বিপরীতে আপনাদের মন্তব্য আমাকে চরম উৎসাহিত করেছে । খুব খারাপ কিছু লিখে থাকলে এবং এতে আপনি কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দুঃখিত , কিন্তু যখন বললেন “…এই ধরনের কল্পনাশ্রয়ী অমার্জিত মন্তব্য করে লেখকদের অপমান করার অধিকার আপনার নেই। এই বিষয়টুকুর প্রতি ভবিষ্যতে খেয়াল রাখবেন বলে আশা রাখ…” । ভাই অমার্জিত মন্তব্যের কথা বলে ত আপনিই আমাকে অপমান করলেন ! বরং মন্তব্য কিরকম হলে মার্জিত হত তা বলে দিলে আমার উপকার হত ।
সর্বশেষ “মুক্তমনায় নিয়মিত মন্তব্য করছেন বলে আপনার আন্তরিক একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য।”
ধন্যবাদ এর কাঙ্গাল আমার মত নবীশ কেন হতে যাবে ? শুধু একটু উৎসাহিত হয়েছিলাম বাংলা টাইপ টা একটু রপ্ত হলে ব্লগ লিখব মুক্তমনাতে , যেভাবে…প্রাপ্য…বুঝিয়ে দিলেন চেপে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই 🙁 ।
@সপ্তক,
ধমক দেই নি। বিষয়টি আমার কাছে অমার্জিত মনে হয়েছিল বলেই আপনাকে বলেছিলাম। এখন আপনার ব্যাখ্যা পড়ে বুঝলাম যে আমিই বুঝতে ভুল করেছিলাম। ভুল বুঝি আর যাই করি, এর জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখপ্রকাশ করছি আমি এখন।
এমনিতে যদি না লিখতেন, তাহলে হয়তো জানতামই না বিষয়টা। কিন্তু এখনতো আর যাওয়া যাবে না ভ্রাতা। সেক্ষেত্রে যে অপরাধবোধে ভুগবো আমি। লেখা আপনাকে লিখতেই হবে। টাইপ নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই। যেরকম হয় হোক, লিখে আমাকে পাঠিয়ে দিন। টাইপের সংশোধন আমি করে দেবো।
@ফরিদ আহমেদ,
ভাই ফরিদ মনটা খারাপ হয়েছিল একটু , কিন্তু আপনার দ্রুত এত সুন্দর বন্ধুত্ব পূর্ণ মন্তেব্বে মনটা যারপর নাই খুশী হয়ে গেল । আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ । অনেক কষ্ট করে নাস্তিক হয়েছি রে ভাই । আস্তিক হওয়া অনেক সহজ । কলেমা পরলে ই হয় । নাস্তিক হতে হলে নিজের সাথে যে যুদ্দ করতে হয় তা মুক্তমনাদের চেয়ে আর বেশি কে জানে বলেন ?। আমি আপনার , অভিজিৎ , বিপ্লব পাল , আকাশ মালিক এবং বন্যা আহমেদ এর লিখা পরে যে পরিমান অনুপ্রানিত হয়েছি তা না বলে শুধু এতটুকু এ বলব আমার নাস্তিক হবার যে ২৫ % বাকি ছিল তা মুক্তমনার এ কল্লান এ । প্রশস্তি প্রশংসা সহজে করতে পারি না , এক্তু আবেগ প্রবন হএ গেছি…কিছু মনে করবেন না । আমি লিখব ভাই…একটা লিখা পাঠিয়েছিলাম যায়নি ,নটিস ফাইলুর পেয়েছি । পাঠানোর নিয়ম ভালভাবে দেখে আবার চেষ্টা করব।(Y) ।
@সপ্তক,
গগন হরকার নয়, গগন হরকরা। বাউল সুর একটি নৈর্বক্তিক টার্ম। গগন হরকরা বাউল সুর তৈরি করেননি, কিন্তু ‘কোথায় পাব তারে’ গাননি খুব কষ্ট করে, সৃজনশীল উপায়েই তৈরি করেছিলেন, ঠিক যেমন লালন তৈরি করেছিলেন – ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’র সুর। আমি তো চাইলেও লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখির’ সুর আরেকটা গানে বসিয়ে দিয়ে বলে দিতে পারি না যে, বাউল সুর কারো একার সম্পত্তি নয়, তাই টুক্লিফাই জায়েজ। আমি যদি এখন রবীন্দ্রসংগীতই পুনরায় লেখা, কিংবা সেই সুর নিয়ে গান বাধা শুরু করি, তাহলে আপনিই প্রথম আমাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করবেন। সেক্ষত্রে রবীন্দ্রনাথ এ অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে পারন না, কেবল রবিঠাকুর বলেই। আর বাউল শিল্পী বলে যাদের ডাকা হয় তারা সব বাউল হলেও- বাউল গান সব এক নয়। লালন শাহ এর গান, দুদ্দু শাহ-এর গান, পুর্ণদাস বাউল, পবন দাস বাউল, শাহ আব্দুল করিম – সবাই নিজেদের বাউল বলেই পরিচিত করেন, কিন্তু সবার গান এক সুরে রচিত নয়। এমনকি লালনেরও সব গানের সুর একই রকম নয়। আপনি কি লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’ আর ‘জাত গেল, জাত গেল’ কিংবা ‘ শাহ আবুল করিমেরর ‘একখান-চাবি মাইরা দিছে ছাইড়া জনম ভইরা ঘুরতে আছে’ গানের মধ্যে পার্থক্য পান? কেন পান? পান কারণ, গানগুলো সবগুলোই আলাদা আলাদা ভাবে সুর করতে হয়ছে, সময় ব্যয় করে সৃজনশীলতা দেখাতে হয়েছে। এমন নয় যে বাউল গান বলে সব এক, তাই এটা থেকে ওটাতে টোকা যাবে।
হ্যা আমি তো বলেছিই আমি এখন রবীন্দ্রসংগীত বানাতে শুরু করলে আপনিই প্রথম প্রতিবাদ করবেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের নিজের ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম হবে কেন?
না, রবীন্দ্রনাথের এ ধরণের গান দু তিনটি নয়। আপনি লেখাটি পড়লে দেখবেন, রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীর রবীন্দ্রনাথের ভাঙা গানের একটা তালিকা করেছিলেন। সেখানে তিনি ২৩৪টি ভাঙা গান হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন। তার মানে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট গানের এক দশমাংশেরও বেশি অন্যের সৃষ্ট সুর থেকে নেওয়া। হ্যা আমরা ইচ্ছে করেই কেবল দু তিনটি নিয়ে কথা বলে আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে চেয়েছি।
হ্যা উদ্দেশ্য তো একটা আছে বটেই। এই যে আপনি গগন হরকরার কথা আগে তেমনভাবে জানতেন না (এমনকি যতবার তার নামটি লিখেছেন প্রতিবারই ভুলভাবে লিখেছেন; না এটা কি বোর্ডের দোষ নয়, কারণ অন্য অনেক ক্ষেত্রেই আকার খুব সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় দিতে পেরেছেন ), জানতেননা যে এই অখ্যাত লোকটিই আমাদের জাতীয় সংগীতের মূল সুরকার, রবীন্দ্রনাথ যার দ্বারা হয়েছিলেন ‘বিশালভাবে অনুপ্রাণিত’। ‘
এখন যতবারই আমাদের জাতীয় সংগীত আপনি শুনবেন, ততবারই আপনার দীন হীন ডাকপিওন গগন হরকরার কথা কাঁটার মতো বিধবে। মন চাইবে তাকে স্বীকৃতি দিতে। এটাই উদেশ্য আপাততঃ।
প্রমথনাথকে দিয়ে পুরো পাণ্ডুলিপি লিখিয়ে তাকে বই থেকে বাদ দেয়া আর জ্ঞান অর্জনের জন্য মার্ক টোয়েনের লাইব্রেরী থেকে বই চুরির একটা কোটেশন এক মনে হল আপনার কাছে!
@অভিজিৎ,
হ্যা উদ্দেশ্য তো একটা আছে বটেই। এই যে আপনি গগন হরকরার কথা আগে তেমনভাবে জানতেন না (এমনকি যতবার তার নামটি লিখেছেন প্রতিবারই ভুলভাবে লিখেছেন; না এটা কি বোর্ডের দোষ নয়, কারণ অন্য অনেক ক্ষেত্রেই আকার খুব সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় দিতে পেরেছেন ), জানতেননা যে এই অখ্যাত লোকটিই আমাদের জাতীয় সংগীতের মূল সুরকার, রবীন্দ্রনাথ যার দ্বারা হয়েছিলেন ‘বিশালভাবে অনুপ্রাণিত’। ‘
এখন যতবারই আমাদের জাতীয় সংগীত আপনি শুনবেন, ততবারই আপনার দীন হীন ডাকপিওন গগন হরকরার কথা কাঁটার মতো বিধবে। মন চাইবে তাকে স্বীকৃতি দিতে। এটাই উদেশ্য আপাততঃ।
একমত (Y)
অসাধারন একটি যৌথ রচনা। (Y)
রবি ঠাকুর নামের আইকনটির স্তবকারীদের গুরুশীর্ষের অন্ধভক্তির মনোভাবের দৌড়ঝাপ যদি এবার একটু বন্ধ হয় তাহলে আমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্যাঙ্গনে মুক্তবাতাসে নতুন দিগন্তের, নতুন প্রানের সঞ্চার হবে একথা অনাসয়ে আশা করা যায়। রবি ঠাকুরের সবগুনের পাশাপাশি যে অন্ধকার দিকও থাকতে পারে তা জেনে তাঁর অন্ধভক্তদের এবার যদি একটু চোখ খুলে!
অভিনন্দন লেখকদ্বয় কে।
(F)
ফরিদ, অভিজিৎ এবং মন্তব্যকারী বৃন্দ,
প্রত্যেককেই ধন্যবাদ ও প্রত্যেকের প্রতিই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি আমাকে রবীন্দ্র বিষয়ে আলোকিত করার জন্য, কারণ কারও সম্পর্কে বলতে গেলে যে জানতে হয়। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে যে ফরিদ ও অভিজিৎ জানে এর প্রমাণ তাদের লেখার ছত্রে ছত্রে অনুরণিত। কিন্তু কিছু মন্তব্যকারী অনর্থকই আস্ফালন করেছেন। যা পড়তে গিয়ে সময় ব্যয় হয়েছে। রবীন্দ্র নাথের গুণের দিক বলতে কিন্তু লেখকদ্বয় যে কার্পণ্য করেননি তা লেখাটির ভূমিকায় স্পষ্ট। কাজেই আমাদের আর রবীন্দ্র প্রেমের পরীক্ষা না দিলেও চলবে।
আবার যারা রবীন্দ্রবিরোধী তারা কিন্তু জামাতিদের নারী মুক্তির বিরোধিতার মতই রবীন্দ্র বর্জন করার কথা বলেছেন। মিথ্যা রুখতে তো দরজা বন্ধ করলে সত্য জানতে পারব না। ধ্যুৎ, আবারও রবীন্দ্র নাথের কবিতা থেকেই উদ্ধৃতি নেওয়া হয়ে গেল।
যাহোক, লেখাটি বেশ বড়। একবারে পড়ে হজম করতে একটু সময় লেগেছে। বিজ্ঞান পর্যন্ত রেখে পরে গান এবং পরে জমিদার রবীন্দ্র নাথ আনলে রয়ে সয়ে হজম হতো।
লেখাটিতে রমা বাঈ প্রসঙ্গটিও এসেছে। এ নিয়ে অভিজিৎ এর একটি লেখা আগে পড়েছি। তা স্বয়ং সম্পূর্ণ লেখা না কোন লেখা মন্তব্যে তা মনে নেই।
ফরিদ ও অভিজিৎ এর রবীন্দ্র গবেষণার ফসল আরও পাবার অপেক্ষায়।
ভাবতেই খারাপ লাগছে যে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত নকল করা সুর দিয়ে বানানো, যেটা নিয়ে এতদিন গর্ব করতাম। এখন হয়তো এই গান শুনে আবেগে আপ্লুত হব না। তবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সঠিক সুরকারের নাম সবার জানা উচিত।
ধন্যবাদ, ফরিদ আহমেদ এবং অভিজিৎ রায় কে।
আপনার এই মতামতের সাথে আমি পূর্ণ সহমত জ্ঞাপন করছি। আমাদের জাতীয় সংগীত অসাধারণ এক সৃষ্টি, কাজেই একে পরিবর্তনের কোনো কারণ নেই। শুধু দরকার গগন হরকরার স্বীকৃতি। রাষ্ট্রীয় ভাবে ঘোষণা করা যেতে পারে যে, এই গানের গীতিকার রবীন্দ্রনাথ এবং সুরকার গগন হরকরা। তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথেরও মান থাকলো, আবার গগন হরকরাও তাঁর প্রাপ্য সম্মান পেলেন।
@ফরিদ আহমেদ,
(Y)
ঠিক এই টুকুই আমরা দাবী করছি। (Y)
@ফরিদ আহমেদ, (Y)
স্তব্ধ হয়ে গেলাম…গতকাল ই পড়েছিলাম লেখাটা কিন্তু মন্তব্যের সুযোগ হয়নি। আমাদের জাতীয় সংগীত এবং আর কিছু গানে অন্য সুরের প্রভাব আগেই জানতাম। ভেবেছি কবিগুরুর বিশাল ভাণ্ডার সমৄদ্ধির জন্য “চুরি”র দরকার পড়ে না। সুতরাং ঐসব “অনুপ্রেরনা”ই ছিল আমার চোখে।
রবীন্দ্রনাথ আমার মননে শুধু তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার জন্য নন। তিনি আক্ষরিক অর্থেই কবিগুরু…আমার গুরু।এই বিদেশ বিভুয়ে কষ্টে কেনা বাড়িটাকে এখনো ঘর মনে হয়না শুধু তাঁর ছবি রাখতে পারিনি বলে। পরেরবার দেশে গিয়ে নিয়ে আসবো এই ছিল প্ল্যান।
সেই রবীন্দ্রনাথ অন্য কারো লেখা কৌশলে নিজের করে নেবেন, প্রজাপালন এর কথা লিখে প্রজা নির্যাতন করবেন…নিজেকে প্রতারিত মনে হয়…যেমন মনে হয়েছিলো মুক্তমনা এবং আর কিছু ব্লগ এ মুহম্মদকে নিয়ে লেখা গুলো পড়ে।
হায়রে জীবন এমন কিছু বা কেউ কি আসলেই নেয় যার কাছে নিজের এই শুদ্ধ সত্ত্বাকে গচ্ছিত রাখা যায়?
বড় বেশী হতাশ হয়ে যাই আজকাল…
তবু না বলে পারিনা “জয়তু মুক্তমনা”।
@একটি শিশিরবিন্দু,
অনেক ধন্যবাদ! আপনারাই আমাদের প্রেরণা। (Y)
অ্যারিস্টটল এবং রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনারা আলাদা ভাবে যা লিখেছেন তার সাথে মোটের ওপর একমত হলেও তুলনামূলক সংশ্লেষণটা বেঠিক মনে হচ্ছে। আপনাদের লেখা থেকেই উদাহরণ দিই। ধরুন, জমিদারির ব্যাপারটা। নিশ্চয়ই আপনারা বলতে চাননা, আজকের রবীন্দ্রভক্তরা রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে জমিদার প্রথার সমর্থক! Phenomenon টা বরং এরকম — রবীন্দ্রনাথ যে প্রজা বৎসল কমিউনিস্ট, সেটা প্রমাণের জন্য ঐতিহাসিক revisionism এর দ্বারস্থ তাঁরা। এরিস্টটলের ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। ওখানে ব্যাপারটি এরকম ছিলনা যে এরিস্টটলের মান-সম্মান রক্ষার্থে তাঁর ভক্তরা মিছে কথা বলে চলেছে, বরং তাঁর মতামতের প্রতি অতিভক্তি পশ্চিমা সভ্যতার পায়ে বেড়ি হয়ে ছিল।
একটি ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথে সাথে এরিস্টটলের তুলনা চলে। একটা সময় বাংলা কবিতা রবীন্দ্রপ্রভাবে ফর্মের দিক থেকে বন্ধ্যা হয়ে পড়েছিল সেটা অনেকটা তুলনীয় এরিস্টটলের সাথে। কিন্তু মোহিতলাল-সজনীকান্ত এরকম কিছু চামচার চেষ্টা সত্বেও সে সমস্যার সমাধান নজরুল ও কল্লোল গোষ্ঠীর কবিরা বহু আগেই করে গেছেন।
@রৌরব,
আপনি যদি আনন্দ পাবলিশার্স, দেশ পত্রিকা এবং ঢাকা এবং ভারতের রাবীন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের কাজকর্ম দেখেন, তাহলে বুঝবেন, আসলে রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির ‘অ্যারিস্টটল’ বানানোরই চেষ্টা করা হয়েছে বিগত বছরগুলোতে সুনিপুনভাবেই। তাই তুলনাটা অসঙ্গত নয়। দেখুনা না – গান, কবিতা, গল্প, নাটক এগুলোতো আছেই – এমনকি সমাজতন্ত্র, পুঁজিবাদ, কোয়ান্টাম ফিজিক্স, দর্শন, অর্থনীতি, কৃষিকর্মকাণ্ড, সমবায় প্রচেষ্টা, নারীশিক্ষা, ক্ষুদ্র ঋণ – সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ। এমন কোন ক্ষেত্র নাই যেখানে ‘রাবীন্দ্রিক জ্ঞান’ দ্বারা আমরা ধন্য হই নাই। সে অর্থে উনি অ্যারিস্টটলেরও বাবা! অ্যারিস্টটলের যে মতামতের প্রতি অতিভক্তি পশ্চিমা সভ্যতার পায়ে বেড়ি হয়ে ছিল, সেই একই ধরণের বেড়ি এখন অনেকটা আমাদের পায়েও, অন্ততঃ অনেক ক্ষেত্রেই । 🙂
@রৌরব, দুঃখিত ভাই, কবিতায় ত্রিশের চারজনের মধ্যে শুধু সাম্যবাদী কবি “দে” ব্যতীত আর কেউ কল্লোল গোষ্ঠীরই নয়। আর নজরুল, তিনি মহাপদ্যকার ও এক নিম্ন মাঝারি কবি(বলেছেন হুমায়ুন আযাদ;এছাড়া আহমেদ শরীফ, বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দের ব্যাখ্যাও পড়তে পারেন)। গদ্যে বাংলা এখনো রবীন্দ্র-অনুসারী; কমলকুমারের প্রয়াস এখনো ব্যতীক্রম হিসাবেই চিনহিত।
@শান্তনু সাহা,
নজরুল মাঝারি কবি, নজরুল রবীন্দ্রপ্রভাব মোচনে অগ্রণী, এদুটো কি পরস্পরবিরোধী?
@রৌরব,
নজরুল মাঝারি কবি, নজরুল রবীন্দ্রপ্রভাব মোচনে অগ্রণী, এদুটো শুনতে পরস্পরবিরোধী মনে হবে তখনই যখন ২য় অংশ সত্য হবে। কিন্তু তিনি তো তা নন; শুধু নজরুল নয় সত্যেন্দ্রনাথ, সুকান্তসহ অনেকেই মূলত কবিগুরুর পথের পথিক।ব্যাপারটা কার্বনের রুপভেদ আরকি। তিনি প্রচুর পদ্য লিখলেও কবিতা বোধহয় দশটিও হয়েছে কিনা সন্দেহ(একথা সত্যেন্দ্রনাথ-এর বেলাতেও সত্য )।
কবিতায় প্রথম বিদ্রোহ কল্লোলের যারা রবি-সাহিত্যের ঘোর বিরোধী(সত্যিই তাই! যদিও পরে তারা বোল পাল্টায়); কিন্তু প্রতিভায় হ্রস,তাই কবিতায় দে,দাশ,দত্ত ও চক্রবর্তী না এলে কবিতায় বিশশতক বোধহয় বেশ পরেই আসত।
আর একটি কথা- মোহিতলাল বোধহয় অমন অন্তত কাব্যে ছিলেন না।
ধুরো আরেকটা কথা মিস করেছি, রবীন্দ্রনাথ নিজের সুর নিয়ে অন্য কাউকে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ রহিত করে দেয়াটা আমার কাছে কেমন শিশুসুলভ মনে হয়। আর নিজের ক্ষতিও করে গেছেন কারন এটাই আবার নতুন প্রজন্মের কাছে তাকে অনাগ্রহ কুড়াতে হচ্ছে। বোস ইয়ারফোনে ক্রিস্টাল ক্লিয়ার টিউন না শুনতে পারলে ২১ শতকে থাকার মর্ম কি? ইন্সটুমেন্ট মানেই এখন ডিজিটালের কাছে অ্যানালগ হার মানবে…ঢোল-তবলার স্থান দখল করে ফেলেছে ইলেক্ট্রিক ড্রামস অথবা প্যাড, হারমোনিয়ামের স্থানে কীবোর্ড/ডিজিটাল পিয়ানো কারন এগুলো শ্রুতিমধুর, পরিস্কার মেলোডি আর বিলিয়ন বিলিয়ন ভ্যারিয়েশন সম্ভব যেটা গৎবাঁধা ঢোল তবলায় মরে গেলেও সম্ভব না।
উনি নিজে অ্যাডাপশান করেছেন, হাততালি :clap কিন্তু আমাদের অ্যাডাপশান করার সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে গেছেন, ভুউউউউ থাম্বস ডাউন (N)। এলভিস রক-এন্ড রোল শুরু করেছিলেন সেটা থেকে মেটাল, হেভি মেটাল হয়ে ব্ল্যাক মেটাল, ডেথ মেটাল…প্রগ্রেসিভ রকের সাথে মিলে প্রগ্রেসিভ মেটাল, হিপহপের সাথে মিলে ন্যু মেটাল, ফাংক মেটাল, ফোকের সাথে মিলে ফোক মেটাল হাজার রকমের রকের বিপ্লব ঘটিয়েছেন এবং বিপ্লবের রাস্তা করে দিয়ে গেছেন…রবীন্দ্রনাথ বিপ্লব ঘটিয়েছেন এবং সেই রাস্তার মাথায় একটা দেয়াল করে দিয়েছেন :-Y
ইসলামের কুরআন, বিশেষ করে হাদিস যেখানে আদিম অভিযোগ খেতে শুরু করেছে মডারেট মুসলমানদের কাছেই সেখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত নতুন প্রজন্ম মনে হয়না আর রবীন্দ্রনাথের ধারেপাশে যাবে…বিশুদ্ধবাদীরা যুগে যুগে শুধু ক্ষতিই করে গেছেন।
আর আরো খারাপ লাগে শুনতে উনি বাউল থেকে লিখলেন এইটা যখন অস্বীকার করার যো নেই তখন এইটা অ্যাডাপশান বলে চালিয়ে দেন অন্ধভক্তরা আর যখন উনার গান আমরা অ্যাডাপ্ট করা হইলে চোখ মুখ রাঙ্গায়া, খিইচ্যা, মেজাজ লোহিত কইর্যা চিল্লায়া উঠেন এইটা রবীন্দ্র-ধর্ষন!! আমি যদি অভিযোগ করি উনি বাউলগান ধর্ষন করেছেন তাহলে? আসলে আমি করিনা কারন জানি এইটা শিশুসুলভ আচরন কারন এই ইউনিভার্সাল বলে কিছু নেই। আলটিমেট পিস অফ আর্ট/কালচার বলেও কিছু নেই। সময়ের অসীম রেখার একটা বিন্দুতে আমাদের অবস্থান যেখানে চারপাশ সদা পরিবর্তনীয়।
কয়েক ধরণের মন্তব্য করতে হবে :))
১) যারা জানেন, শক্ত যুক্তি ও ঐতিহাসিক দলিল ইত্যাদি দেখাতে পারবেন তারা এই লেখাটা যুক্তিগুলো খন্ডাতে এগিয়ে আসুন…আমি লেখাটা পড়ে যতটা খুশি হয়েছি তার চাইতে ভাল লাগবে অন্যপক্ষের প্রতিউত্তর। এমনকি ডেভিলস অ্যাডভোকেসিও চলতে পারে। ফরিদ ভাই আর অভিজিৎ ভাই যা বলবে মেনে নিব কেন? :guli: :guli: অপরপক্ষের প্রতিউত্তর এক্ষেত্রে আমাদের জন্য ভ্যারিফিকেশনের কাজ করে দিবে। (I) তাই তাদের স্বাগতম জানাচ্ছি…এই উপলক্ষে আমার মত সাহিত্য-ইতিহাস নাদানদের দু-হাত ভরে কুড়ানোর সুযোগ নষ্ট করতে চাইনা। :))
২) @লেখকগণ আমার জন্য এখনো ঠু আর্লি টু কমেন্ট তাই সাইডবেঞ্চে বসে বসে দেখি কে কী বলে। তবে আপনাদের এই লেখাটা পড়তে গিয়ে মনে হলো লেখাটায় খানিক মেদ আছে, যেমনটা করেন পদার্থবিজ্ঞানীরা তাদের প্রিয় থিউরি নিয়ে বই লিখলে 😀 ব্রায়ান গ্রীনের বই পড়তে গিয়া দেখি স্ট্রিং থিউরি কী হাম্ফি ঝাম্ফি করসে এটাই ঘুরায়া ফিরায়া বলতে বলতে ৩০ পেজে ঠেকায়া দিসে :-Y এখানে তেমন কিছু নেই কিন্তু কেন জানি মনে হল একই কথা একাধিকবার বলা হচ্ছে…মুক্তমনায় এমনটা খুব একটা দরকার পড়েনা।
আর এক বড় ভাই বললো গিটার টিটার নিয়ে নাকি শিরোনামহীনের কিছু রবীন্দ্রনাথের গান আছে, এইটা কীভাবে গাইলো তাহলে?
আর সকল মানুষেরই ব্যক্তিগত কিছু নিন্দুক থাকে যেমন ধরুন একজন ব্যক্তি (নাম জানা থাকলেও কেউ উল্লেখ করবেন না) এক কালে সবার কাছে কাইন্দ্যা বেড়াইতেছিল যে মুক্তমনার একজন ব্লগার লিনা রহমান উনার ব্লগ থেকে চুরি করে লিখেছেন…বলাই বাহুল্য এর কোন দাম নেই কিন্তু আমি যদি এখন সেই ব্যক্তির কথাকে রেফারেন্স ধরে লীনা রহমানের নামে সমালোচনা শুরু করি তাহলে অন্যরা কীভাবে বুঝবে কে ভুল কে সঠিক? এর জন্য খুব সম্ভবত আরো কিছু ঐতিহাসিক দলিল দরকার হয়…প্রমথনাথের ব্যাপারে কীভাবে নিশ্চিত হলেন? উনার নিজের লেখা বই থেকেই শুধু?
যাক অনেক কথা হইলো, কিন্তু এত্ত সুন্দর একটা লেখার জন্য ধন্যবাদ না জানানো কিপ্টামি হয়ে যাবে :)) ধন্যবাদ! (F)
@টেকি সাফি,
এটাই হচ্ছে আসল মুক্তমনার পরিচয়। বিনা তথ্যে, বিনা যুক্তি্তে, বিনা প্রশ্নে কোনো কিছুকে না মানাটাই হচ্ছে একজন যুক্তিবাদীর জন্য সঠিক কাজ। এই মেনে না নেওয়া শুধু ফরিদ ভাই আর অভিজিৎ ভাইয়ের মত চুনোপুঁটির জন্য সীমাবদ্ধ থাকলেই চলবে না, বিস্তৃত হতে হবে সব রুই কাতলাদের ক্ষেত্রেও।
এই লেখায় নীরদ চৌধুরীর অনেক কথা কোড করা হয়েছে। নীরদ চৌধুরীর আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ বইটির শুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে অনেক আগেই। এ বিষয়ে একটা শক্তিশালী গদ্য লিখেছেন রবীন্দ্র আলোচক শঙ্খ ঘোষ। তার ভাষ্য হচ্ছে : ‘[…] রবীন্দ্র-সাহিত্যের চেয়ে রবীন্দ্র-জীবনের বিবরণের দিকেই তার এই শেষ বই আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ-এর বেশি ঝোক, এবং সেই বিবরণ আজও তিনি অনায়াসে গড়ে তুলনে পারেন ‘আমি অল্প বয়সে গল্প শুনিয়াছিলাম’-এর মত ‘প্রামাণ্য’ কোনও তথ্যের ওপর ভর করে। এবং তথ্যের উপর ভর করেই লেখা বইটির গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অধ্যায়। সম্ভব হলে আমি প্রবন্ধটার সম্পূর্ন অংশই এখানে তুলে দিতাম।
ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ অনেক ভুল ভাল কাজ করেছেন-কিন্ত তার সৃষ্টি কপিক্যাট এটা দাবী করলে, পৃথিবীর যাবতীয় সাহিত্যের পেছ্নেই সেই কপিক্যাটের ভুত লাগানো যায়। সাহিত্যে সৃজনশীলতার অধিকাংশটাই সংশ্লেষণ। চিত্রাঙ্গদার উৎস মহাভারত-তাহলে কি উনি মহাভারত থেকে টুকেছিলেন??? রবীন্দ্রনাথ এলিয়টের কিছু অনুবাদ করেছিলেন-শিল্পের বিচারে তা এলিয়টের অরিজিনাল কবিতার থেকে ভাল :kiss:
আর উনি প্রজা দরদী ছিলেন না!! যিনি নোবেল প্রাইজের সব টাকা দিয়ে গ্রামীন ব্যাঙ্ক খুলেছিলেন চাষীদের আর গ্রাম উন্নয়নের জন্যে , তিনি কবে বিশেষ কারনে খাজনা বাড়িয়েছিলেন, তাই প্রজা শোষক! শান্তিনিকেতন করতে গিয়ে কি প্রবল দারিদ্রের মধ্যে কাটিয়েছেন কবি, সেই নিয়েও মনে হয় লেখকরা জানেন না।
আমি জীবনে বেশ কিছু লোক দেখেছি, যারা সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ পড়েও, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে বিশেষ কিছু দাবী করেন না। কারন এটি করতে আরো পড়াশোনা করতে হয়। আমার মানতে আপত্তি নেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন রক্ষনশীল, ব্রাহ্মণ, জাতিভেদ মানতেন, শিশু বিবাহ দিতেন-এগুলো ঠিক আছে। কিন্ত তিনি প্রজা দরদি ছিলেন না-মুসলিম চরিত্র নিয়ে লেখেন নি-সমাজের গরীব অংশ নিয়ে সাহিত্য সৃষ্টি করেন নি-এই সব অভিযোগ খুবই হাস্যকর এবং সাহিত্যের পথে গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ একজন সাহিত্যিক বনাম এক্টিভিস্টের পার্থক্য স্পষ্ট করেছে্ন। শিল্পী আর এক্টিভিস্ট একজন একই সাথে হতে পারেন না-দুটো একসাথে করলে, সাহিত্যের মান নামতে বাধ্য।
আমার রবীন্দ্রজ্ঞান সামান্য-তাতেও লেখকদের প্রতিটা অভিযোগের উত্তর দিতে পারতাম। সুতরাং যারা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আরো বেশী চর্চা করেছেন, তারা লেখকদের এই প্রচেষ্টাকে সিরিয়াসলি নেবেন না-তা বলাই বাহুল্য। কারন প্রবন্ধটা পড়েই বোঝা যাচ্ছে অভিজিত এবং ফরিদ রবীন্দ্রনাথের ইতিহাস নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা না করেই, লেখাটা লিখছেন। এতে পরবর্তী কালে তারাই লজ্জিত হবেন।
রবীন্দ্রনাথের দর্শন/ রাজনীতি জ্ঞান আমি ভুল ভাল বলেই মনে করি। কিন্ত সাহিত্যিক, কবি, সুরকার রবীন্দ্রনাথের সমালোচনা করার গভীরতা বা জ্ঞান কোনটাই আমার নেই।
@বিপ্লব পাল,
শাশ্বতিকীর প্রকাশিতব্য রবীন্দ্রসংখ্যার দুটো সাক্ষাৎকার থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ এখানে উঠিয়ে দিচ্ছি।
••মোজাফ্ফর : জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ কেমন ছিলেন?
•আবুল আহসান চৌধুরী : আমি তো আগেই বলেছি যে ঠাকুর জমিদারদের কিছুটা নিন্দে ছিল দু’পুরুষ আগে, দ্বারকানাথ ঠাকুর ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়ে। প্রজানির্যাতনের অভিযোগ ছিল এবং এসব কথা কাঙাল হরিনাথ মজুমদার তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরীতে যেমন লিখেছেন তেমনি তাঁর পত্রিকা ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’-তেও তিনি উল্লেখ করেছেন। সেই কারণে এই জমিদারদের বিরাগ ভাজনও তাঁকে হতে হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে জমিদাররা এই লোক লস্কর লাঠিয়াল পাঠিয়ে নানাভাবে শায়েস্তা করার চেষ্টাও করেন। সেখানেও রক্ষা কর্তা হিসেবে এসে পড়েন লালন ফকির, তখন একতারা ফেলে তাঁর শিষ্য-শাবকদের নিয়ে লাঠি হাতে কাঙাল হরিনাথকে রক্ষা করেন। তো ঠাকুর জমিদারদের এই যে ভূমিকা এই ভূমিকাকে যেহেতু শুধু ঠাকুর জমিদার না, কোন জমিদারই অত্যাচার না করে রাজস্ব আদায় আদায় করতেন না এবং নতুন নতুন কর তারা অহেতুক অযৌক্তিক ভাবেও আরোপ করতেন। লাঠিয়াল পাঠিয়ে ঘরকে ঘর জালিয়ে দেওয়া হয়েছে—নিঃস্ব মানুষগুলো একেবারে নিঃস্বতরও হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল ছিলেন এবং তাঁর ভেতরে একটা গভীর মানবতাবোধ কাজ করতো। তিনি গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে অনেকখানি পরিচিত হতে পেরেছিলেন। সেই কারণে তিনি নানাভাবে চেষ্টা করেছিলেন যে প্রজাপীড়ন যাতে না হয়। তিনি চেষ্টা করেছিলেন যে প্রজার মঙ্গল কিসে হয়, প্রজারা সুখে থাকে কিসে। এবং সারা গ্রামগুলো, রবীন্দ্রনাথ নিজে বলেছেন, যেন মরে গেছে। সেই গ্রামগুলো তিনি জাগাতে চেয়েছেন। কিভাবে জাগানো যায়- তিনি সেখানে মেলার আয়োজন করেছেন এবং সেখানে তিনি স্বদেশী যাত্রা থেকে শুরু করে গ্রামীণ মেলায় যা যা হয়ে থাকে তার ব্যবস্থা করেছেন। তিনি অনেকবারই শিলাইদহে মেলার আয়োজন করেছেন। গান-বাজনা হত সেখানে, সেখানে কীর্তন হত, বাউল গান হত, কবি গান হত এইভাবে রবীন্দ্রনাথ গ্রামগুলোকে জাগাতে চেয়েছিলেন। একটা নিষ্প্রাণ, নির্জীব গ্রামের মানুষগুলোকে তিনি আনন্দ দিতে চেয়েছিলেন এবং তিনি তাদেরকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। এই যে খোকশার শিবু কীর্তনিয়া, সেই কীর্তনিয়াকে তিনি যথেষ্ট সমাদর করেছেন। তো রবীন্দ্রনাথের সময়ে এসে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে সেই পুরোনো কষ্টের যে ইতিহাস প্রজারা বংশ পরম্পরায় ভোগ করে আসছিল তা তারা ভুলতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথ কেমন জমিদার ছিলেন এ সম্পর্কে একটি বিবরণ মেলে রাজশাহীর ডিস্ট্রিক গেজেটিয়ারে। সম্ভবত, এই গেজেটিয়ারের সংকলক ছিলেন ও’ ম্যালি, সেখানে জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্বের কথা, তাঁর জমিদারি পরিচালনার পদ্ধতির কথা বলেছেন এবং প্রশংসা করেছেন। আর সমকালীন যে সাক্ষ্য তা থেকে তো বোঝাই যায় যে রবীন্দ্রনাথের সময়ে তিনি একটা পরিবর্তন এনেছিলেন, তা না হলে তাঁর কিসের দায় ঠেকেছে যে নোবেল পুরস্কারের সব টাকা তিনি এই গ্রামের মানুষের জন্য খরচ করবেন? তাদের জন্য ব্যাংক তৈরি করবেন? রবীন্দ্রনাথ যখন রাশিয়া থেকে ফিরে এলেন তখন রাশিয়ায় যে কৃষি বিপ্লব এবং রাশিয়ার যে কৃষিপদ্ধতি তা তাকে খুব অনুপ্রাণিত করেছিল এবং তিনি রাশিয়ার যে কমিউন প্রথা—তা মনে মনে ভেবেছিলেন যে যদি এমন আমাদের দেশে প্রবর্তন প্রচলন করা যায় তাহলে হয়ত আমাদের দেশের কৃষকেরা আরও সঠিক হতে পারবে, আরও সমৃদ্ধ হতে পারবে। কিন্তু এটি বিচ্ছিন্ন ভাবে নিরীক্ষা করার কোন বিষয় নয়। রাষ্ট্র যদি এ ব্যাপারে এগিয়ে না আসে, কেবল ছোট্ট একটি জমিদারি এলাকায় এটা করা সম্ভব না, আর সেখানে তো শুধু জমিদারের জমিতে স্বত্ব নেই কিছু ব্যাক্তি স্বত্ত্বও ছিল। তাই রবীন্দ্রনাথ পারেননি, করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাঁর মাথায় এ ব্যাপারগুলো এসেছিল। তিনি কৃষকদের জন্য চেষ্টা করেছেন। সেই চেষ্টার ফল যে খুব পাওয়া গেছে তা নয়, কিন্তু চেষ্টা করেছেন। যেমন, তাঁর ছেলেকে এবং জামাইকে আমেরিকায় কৃষিবিদ্যা শেখার জন্য পাঠিয়েছিলেন। রথীন্দ্রনাথ যখন ফিরে এলেন তখন শিলাইদহে তাঁর জন্য একটা কৃষি খামার করে দেওয়া হল, আলু চাষের ব্যবস্থা করলেন, এমনকি রাজশাহীর যে রেশম চাষ সেই রেশম চাষের জন্যও রবীন্দ্রনাথের একটা আগ্রহ জন্মেছিল অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়-এর সৌজন্যে। তিনি রবীন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন এবং তাঁর আসল বাড়ি তো কুষ্টিয়ার কুমারখালিতে কিন্তু ওকালতি করেছেন রাজশাহীতে এবং বরেন্দ্র রিসার্চ মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠার অন্যতম সহায়ক ছিলেন। তিনি কিছু গুটি পোকা নিয়ে এসে দিয়েছিলেন। লরেঞ্জ সাহেব একজন গৃহ শিক্ষক ছিলেন। তিনিও খুব মেতে ছিলেন এগুলো চাষের জন্য কিন্তু হয়নি। সেই সমযে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাথে রবীন্দ্রনাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল। ডি.এল. রায় কৃষি বিভাগে ছিলেন এবং তিনি নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছেন কৃষির উন্নতির ব্যাপারে। যে চেষ্টাটা তিনি এখানে শুরু করেছিলেন তার ফল পুরোপুরি পান নি, তা তিনি শেষও করতে পারেন নি। শ্রীনিকেতনে গিয়ে সেটির প্রয়োগ করেছিলেন এবং সেখানে অনেকখানি তিনি সার্থক হতে পেরেছিলেন।
••মোজাফ্ফর : নীরদচন্দ্র চৌধুরী বলেছেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের মনে স্বাদেশিকতা ও হিন্দুত্ব নিবিড়ভাবে সংশি¬ষ্ট ছিল।’’ তাই যদি হয়, তবে জানতে ইচ্ছে করছে, মুসলমান প্রজাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কেমন ছিল?
•আবুল আহসান চৌধুরী : নীরদচন্দ্র চৌধুরীর কথাটি এক অর্থে বেঠিক নয়। কিন্তু আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, রবীন্দ্রনাথ আমার যতদূর মনে পড়ে যে যখন আদমশুমারি হল তখন তিনি তাঁর জাতীয় পরিচয় হিন্দুই লিখিয়েছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে কেউ যদি নিজের ধর্ম পালনে নিষ্ঠাবান হয় তাহলে তাকে সাম্প্রদায়িক বলা যাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবেন। রবীন্দ্রনাথ আচারিক ধর্ম নিয়ে খুব মাথা ঘামাতেন বলে মনে হয় না। আর হিন্দু ছিলেন, কি আংশিক হিন্দু ছিলেন, কি পুরোপুরি ব্রাহ্মণ ছিলেন এসব অনেক আলোচনার বিষয়, তর্কের বিষয়। বা তিনি এই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে কতখানি মান্য করতেন, কতটুকু স্বীকার করতেন, কতটুকু তাঁর জীবনে প্রতিফলন ঘটেছে সেগুলো ভিন্ন আলোচনার বিষয়। কিন্তু এখানে, নীরদ চৌধুরীর কথা দিয়ে প্রশ্নটি করার কোন প্রয়োজন নেই, সরাসরি প্রশ্নটি এইভাবে আসতে পারতো। আর যদি রবীন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার সাথে হিন্দুত্ব নিবিড়ভাবে মিশেও থাকে নীরদ চন্দ্রের কথা মত, তাহলেও কিছু যায় আসে না। তাঁর যে বিষবাস্প তা তো আমরা লক্ষ্য করিনি। মুসলমান প্রজাদের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়-গভীর-আত্মিক। চরের যে বিদ্রোহী প্রজা, এরা অধিকাংশ মুসলমান ছিল। এরা খাজনা দিতে চাইতো না, এরা নানাভাবে সমস্যার সৃষ্টি করতো। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এদেরকে বশ করেছিলেন-লাঠিয়াল পাঠিয়ে নয়, এদেরকে তাঁর ভালোবাসা দিয়ে, মমতা দিয়ে। এতটাই বশ করেছিলেন যে যখন শিলাইদহ জমিদারি রবীন্দ্রনাথের হাতছাড়া হয়ে গেছে, তখন শিলাইদহ জমিদারির মালিক তাঁর ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর—রবীন্দ্রনাথকে আসতে হল কেননা চরের প্রজারা আবার বিদ্রোহী হয়েছেন। চরের প্রজা মানে মুসলমান প্রজা আর কি। রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালে শেষ বারের মতন এলেন এই চরের প্রজাদের মনের পরিবর্তন ঘটনোর জন্য। তাদের যে অসন্তোষ, তারা যে জমিদারকে মানতে চাচ্ছে না বা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাদের সম্পর্ক যে খুব ভালো হয়ে উঠছে না, সেটা মেটানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন। একটি ছবি শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর বইতে আছে যে চরের প্রজাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ কথা বলছেন চরের ভেতরে। এ থেকে বোঝা যায় মুসলমান প্রজাদের সাথে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল এবং প্রভাব কতখানি ছিল। আর উনি ঐ যে ১৯২২ সালে এলেন শেষবার তখন সমস্ত শিলাইদহ জমিদারির প্রজাদের পক্ষ থেকে তাঁকে একটি মানপত্র দেওয়া হয়েছিল, সেই মানপত্রটি রচনা এবং পাঠ করেছিলেন জেহের আলী বিশ্বাস বলে কালুয়া গ্রামের একজন অধিবাসী। আবার রবীন্দ্রনাথকে ভারী সুন্দর একটি নকশী কাঁথা উপহার দিয়েছিলেন শিলাইদহের মুসলমান মেয়েরা। তাহলে বোঝায় যাচ্ছে কতটা নিবিড় সম্পর্ক তাঁদের মধ্যে ছিল। আবার পতিসরের একটা ঘটনার কথা অন্নদাশঙ্কর রায় বলেছেন, তখন অন্নদাশঙ্কর রায় নঁওগার এস.ডি.ও অথবা রাজশাহী ডি.এম। রবীন্দ্রনাথ এলে তিনি পতিসরে দেখা করতে গেছেন। একজন মুসলমান প্রজা রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন এই রকম যে আমাদের অনেক মহামানুষকেই আমরা দেখিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে দেখলে তেমন মনে হয়। এইরকম একটা মন্তব্য করেছিলেন আর কি। বিষয়টি একটু বিতর্কিত হতে পারে। তিনি সবেচেয়ে বড় যে কথাটি বলেছিলেন- আমি সাহাদের হাত থেকে শেখদের রক্ষা করার জন্য এসেছি জমিদারি দায়িত্বে। তার মানে কি? সাহারা হচ্ছে মহাজন, সুদখোর মহাজন গরীব প্রজাদের কড়া সুদে কর্জ দিয়ে তা যখন উশুল করতে পারে না তখন তার জমি-বাড়ি-ঘর সমস্ত নিয়ে নেয়। রবীন্দ্রনাথের মত এত বড় আর কথা কেউ বলার সাহস পাননি। সেইজন্য এই আমরা অনেক সময় হিন্দু মুসলামান প্রশ্নটাকে রবীন্দ্রনাথের সাথে নিয়ে এসে ভারি গুলিয়ে ফেলি। জমিদার হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ শুধু অসাম্প্রদায়িক নন, তাঁর ভেতরে মুসলিমপ্রীতি গভীরভাবে ছিল এবং তার প্রকাশ আমরা দেখেছি। যেমন, মুসলিম লেখকদের তিনি যেভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন, যেভাবে তাঁদের সমাদর করেছেন, যেভাবে তাঁদের তুলে ধরেছেন, তাঁদের বিখ্যাত হওয়ার পথে এগিয়ে দিয়েছেন তা আর কেউ করেননি। সেই সব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের সময়ে আরও যারা বিখ্যাত অমুসলিম লেখক ছিলেন তাঁরা নীরব ভূমিকা পালন করেছেন অথবা বিদ্বেষ পোষণ করেছেন। মনে রাখা প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথ একটা সময় পর্যন্ত তাঁর যত বই বের হয়েছে সেই বইগুলো তিনি উৎসর্গ করেছেন হয় তাঁর পরিবার পরিজনের ভেতরে অথবা ব্রাহ্ম সমাজের যারা নেতা তাঁদের অথবা তাঁর খুব প্রিয়ভাজন কাছের কবি লেখককে। তিনি প্রথম কাজী নজরুল ইসলামকে তাঁর বসন্ত নাটিকা উৎসর্গ করলেন। নজরুল যখন জেল খানায়, তিনি পবিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর হাতে সেই বই তুলে দিয়ে বললেন যে তুমি কাজীকে বলো সুযোগ থাকলে আমি নিজে গিয়ে তাঁকে বইটি দিতাম। এই যে স্বীকৃতি, নজরুল তখন কেবল লেখক বা কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন শুরু করেছে তখন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বই উৎসর্গ করেছেন। এবং শুধু তাই নই, নজরুল জেলে অনশন করছেন, তাঁর জীবন সংশয়। রবীন্দ্রনাথ তা জানতে পেরে টেলিগ্রাম করেছেন- Give up hunger strick our literature claims you.
••মোজাফফর : অনেকে বলেন রবীন্দ্রনাথ অত্যাচারী জমিদার ছিলেন, আবার অনেকে বলেন রবীন্দ্রনাথ প্রজার প্রতি সদা মঙ্গলকামী জমিদার ছিলেন। আসলে কোনটা সত্য ?
•আবদুশ শাকুর : বিশ শতকের প্রথম দশকের শুরুতে রবীন্দ্র-নিন্দুক গোষ্ঠীর সার্বিক কুৎসাপ্রচার যখন তুঙ্গে, তখন ‘অত্যাচারী জমিদার’ কথাটাও ছড়িয়েছিল তারা। ‘স্টিল ফ্রেম’ আই. সি. এস অফিসার ও মনস্বী লেখক অন্নদাশঙ্কর রায় ত্রিশের দশকে নওগাঁর মহকুমা-প্রশাসক থাকাকালীন তাঁর প্রশাসনাধীন কালীগ্রাম পরগনায় ব্যাপক খোঁজখবর নিয়ে লিখেছেন যে সেখানকার প্রজাবান্ধব জমিদার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন তুলনাবিহীন।
১৯৩৭ সালের জুলাই মাসে পতিসরে কবির শেষ ভ্রমণের সময় পুণ্যাহ পালিত হয়। সে-অনুষ্ঠানে প্রিয় জমিদারকে বহু বছর পরে দেখে প্রজাদের বুক-ভেজানো অশ্রুধারা অন্নদাশঙ্করকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। বস্ত্তত বহু পূর্বে ১৯১৬ সালেই রাজশাহী জেলাগেজেটীয়ার-সম্পাদক এল. এস. এস. ও-ম্যালে, আই. সি. এস এক পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিয়ে জানিয়েছেন- কবি তাঁর জমিদারি এস্টেটকে কি রকম ওয়েলফেয়ার এস্টেটে পরিণত করেছিলেন :
‘It must not be imagined that a powerful landord is always oppressive and uncharitable. A striking instance to the contrary is given in the Settlement Officer’s account of the estate of Rabindranath Tagore, the Bengali poet, whose fame is world-wide. It is clear that to poetical genius he adds practical and beneficial ideas of estate management, which should be an example to the local Zamindars.
A very favourable example of estate government is shown in the property of the poet, Sir Rabindranath Tagore. The proprietors brook no rivals. Sub-infeudation within the estate is forbidden, raiyats are not allowed to sublet on pain of ejectment. There are three divisions of the estate, each under a Sub-manager with a staff of tahsildars, whose accounts are strictly supervised. Half of the Dakhilas are checked by an officer of the head office.
Employees are expected to deal fairly with the raiyats and unpopularity earns dismissal. Registration of transfer is granted on a fixed fee, but is refused in the case of an undesirable transferee. Remissions of rent are granted when inability to pay is proved. In 1312 (BS) it is said that the amount remitted was Rs. 56,595. There are Lower Primary Schools in each division and at Patisar, the centre of management, there is a High English School with 250 students and a Charitable dispensary.
These are maintained out of a fund to which the estate contributes annually Rs. 1250 and the raiyats 6 pies to rupee in their rent. There is an annual grant of Rs. 240 for the relief of cripples and blind. An agricultural bank advances loans to raiyats at 12 per cent per annum. The depositors are chiefly Calcutta friends of the poet, who get interest at 7 per cent. The bank has about Rs. 90,000 invested in loans.’
জনৈক ঔপনিবেশিক ইংরেজ প্রশাসকের এই উচ্ছ্বসিত প্রশংসা প্রমাণ করে কেমন বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গিয়েছে এদেশের পল্ল¬ীতে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে, আমাদের বহু পুরুষ পূর্বে। যে-জনপ্রিয়তা চাকরিরক্ষার মাপকাঠি হিসেবে বিশশতকের শুরুতে রবীন্দ্রনাথের ‘জমিদারিতে প্রতিষ্ঠিত’ হয়েছিল বাংলাদেশেরই এক প্রামিত্মক অঞ্চলে, সে-জনমুখী মাপকাঠি তো একুশশতকের শুরুতেও বাংলাদেশের ‘সরকারিতে প্রচলিত’ হবার কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না আজো। জমিদারির বদলে আসমানদারি বলে অভিহিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর এহেন রূপামত্মরণ-কর্মকা-কেই।
@মোজাফফর হোসেন, বিজয় থেকে কনভার্ট করার কারণে কিছু ফ্রন্ট ভেঙ্গে গেছে। একটু কষ্ট করে দেখে নিন প্লিজ।
@মোজাফফর হোসেন,
আবদুশ শা্কুর রবীন্দ্রনাথের জমিদারি ইতিহাস নিয়ে যা লিখেছেন, সেটা আমি একদম ছেলে বেলায়, অমিয় চক্রবর্তীর রবীন্দ্রজীবনীতে পড়েছিলাম। রবীন্দ্রসাহিত্য এবং জীবন এত বৃহৎ সে্গুলো চর্চা না করে, পল্লবগ্রাহিতা দ্বারা এই প্রবন্ধ লেখা সম্ভব না।
আমি সেই জন্যে অভিজিত আর ফরিদকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে একটু পড়াশোনা করার পর লিখতে বলছি-নইলে তাদের মতন লদ্ধ প্রতিষ্ঠিত লেখকরা নিজেদের লেখা নিয়ে লজ্জিত হবেন ভবিষয়তে।
বিজ্ঞা্নের যে কোন টপিকে লেখা, রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখার থেকে ১০০ গুন সহজ। কারন রবীন্দ্রনাথের লেখা , জীবন ও কর্মকান্ড এত সুবিশাল এবং পরস্পর বিরোধি, সেগুলো সব না জেনে কোন সহজ সত্যে পৌঁছা্নো সম্ভব না। সবথেকে বড় কথা এসব তথ্য ইন্টারনেটেও লেখকরা পাবেন না-যা বিজ্ঞানের প্রবন্ধে বহুতাংশে সহজলভ্য।
এই লেখা লিখতে গেলে তাদের অন্তত এক বছর শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র গবেষণা করতে হবে-ইন্টারনেট গবেষণা করে রবীন্দ্রনাথের ওপর লেখা নামালে, তা গরুর বদলে বাছুর হওয়ার সম্ভাবনা সমাধিক।
@বিপ্লব পাল,
বিপ্লব, দয়া করে লেখাটা একটু ভালভাবে পড়ো। এই লেখায় শুধুমাত্র গানগুলো ছাড়া আর কোনো তথ্যই ইন্টারনেট থেকে নেওয়া হয় নি।। যে বইগুলো থেকে বা প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি নেওয়া হয়েছে, তথ্য নেওয়া হয়েছে সেগুলোর সবকিছুরই রেফারেন্স দেওয়া আছে প্রবন্ধের মধ্যে। তারপরেও যদি বলো যে, এটা ইন্টারনেট গবেষণাপ্রসূত বাছুর রচনা, তাহলে মনে বড় খেদ থেকে যাবে। 🙁
@মোজাফফর হোসেন,
সাক্ষাতকারটা পড়ে খুব ভালোলাগল। আব্দুশ শাকুর একজন খ্যাতনাম ও জনপ্রিয় লেখক। তার জ্ঞ্যান এর পরিধি অসীম। আমি খুব কাছে থেকে ছোট বেলায় তাকে জানার সৌভাগ্য হয়েছিল। তার জ্ঞ্যানের পরিধি এতো ব্যাপক কি বলবো-। ধন্যবাদ তোমাকে (Y)
@বিপ্লব পাল,
তাঁর সব সৃষ্টি নয়, কিন্তু কিছু সৃষ্টি অবশ্যই কপিক্যাট। ওই কিছু সৃষ্টি নিয়েই এখানে আলোচনা হচ্ছে, সবটুকু নিয়ে নয়। তবে, তারচেয়েও বেশি আলোচনা হচ্ছে অন্যের সৃষ্টিকর্মকে না বলে নিজের নামে চালানোর প্রচেষ্টাকে।
এই প্রবন্ধের মূল বিষয় দুটো। একঃ প্রমথনাথের লেখা বিশ্বরচনাকে রবিঠাকুর বিশ্বপরিচয় বলে চালিয়ে দিয়েছেন নিজের নামে। দুইঃ গগন হরকরার সুরকে হুবহু নিজের লেখা গানে ব্যবহার করেছেন। আমাদের ধারণা এই কাজটা তিনি করেছেন অনুমতি ছাড়াই, গগন হরকরাকে না জানিয়েই। বাকি যা কিছু এসেছে তা মূল লেখাকে সঙ্গত দেবার জন্যই এসেছে।
এই দুটো বিষয়ে স্পেসিফিক তোমার মতামত পেলেই খুশি হবো। সাহিত্যের বহু অংশ যে সংশ্লেষণ, এটা তুমি যেমন জানো, আমরাও তেমনি জানি। আবার একই সাথে এও জানি যে, আমি জীবনানন্দ বা সুনীল গাঙ্গুলির কবিতাকে কিংবা রবীন্দ্রনাথের গানের সুরকে হুবহু নিজের নামে চালিয়ে দিতে পারি না সংশ্লেষণের নামে।
দিতে পারতাম বলে পাশ কাটিয়ে গেলেতো হবে না বিপ্লব। দিয়ে দাও। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আসল তথ্য জানুক লোকে।
@ফরিদ আহমেদ,
প্রথমে গগন হরকরার প্রসঙ্গে আসি।
১৮৯০ সালে কবি যখন শিলাইদহে এলেন, তখন গগন বাবু সেখানের পোষ্ট মাস্টার এবং নামকরা সুরকার। তখন কেও গান রেকর্ড করত না। কবি তার ‘কোথায় পাবো তারে/আমার মনের মানুষ যেরে’-এই গানে মোহিত হন। সেখানেই ক্ষান্ত হননি। নিজে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’-এই বাণীর সঙ্গে গগনের গানের সুর যোজনা করেন।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিস্য, প্র-শিস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল। তিনি বাউল-ফকিরদের গান শুনে আপ্লুত – নিজে শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল হতে অনেক বাউল গান সংগ্রহ ও প্রচার করলেন। তারপরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। উদ্দেশ্য একটাই-যাতে- সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে।
কবি নিজে কি বলেছেন এই গগন হরকরাদের গান নিয়ে?
কবি নিজেই বলছেন , হ্যা আমি টুকেছি। নিয়েছি। নিয়েছি তাদের সুর। তিনি ত একবার ও দাবি করেন নি আমার সোনার বাংলার সুর তার নিজের। তিনি পরিস্কার করেই বলছেন এসব সুর সেই শিলাইদহের ফকিরদের কাছ থেকে সংগ্রহিত। সেকালে ত গানের মেধাসত্ত্ব চালু হয় নি-এগুলো মুখে মুখে রচিত হত। সুতরাং কবির উদ্দেশ্য ছিল মহৎ -উদ্দেশ্য ছিল এই সুরগুলিকে বিশ্বদরবারে পৌছে দেওয়া এবং তিনি স্বীকার করেইছেন, এদের সুর নিয়েই তৈরী করেছেন তাদের গান।
এর পরেও এই ধরনের ফালতু অভিযোগের মানে হয়?
এবার আসা যাক প্রমথনাথের কেসটা নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় নিয়ে নিজে কি বলেছেন?
কেসটা এই যে -রবীন্দ্রনাথের তখন চলিত ভাষায় , সর্বজনের ভাষা, প্রাকৃত ভাষা নিয়ে এক্সপেরিমেন্টে মেতে ছিলেন-এবং বিশ্বপরিচয় লিখেছেন মূলত নিজের সেই ভাষার মাধুরী মিলিয়ে-এবং স্বীকার করেছেন, সেই বই এর তথ্য পেয়েছেন অন্যদের কাছ থেকে। ওই ভাষা কি প্রমথনাথের হতে পারে?
অসম্ভব-কবি অত্যন্ত যত্ন নিয়ে লিখেছেন বিশ্বপরিচয়। বইত তারই হবে ভাষা দিয়েছেন যিনি-তথ্যগুলিত প্রমথনাথের আবিস্কার নয়-উনার ভূমিকা ছিল ওয়াকিপিডিয়ার র মতন!
এমন দাবি করলে এবার ওয়াকি থেকে তথ্য নিয়ে যত লেখা লিখেছি, তার সবগুলিতেই ওয়াকিপিডিয়াকে সহলেখক বানাতে হবে দেখছি-নইলে ফরিদ ভাই বলবেন রাহাজানি হয়েছে। :-Y
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে এই দুটি অভিযোগই শিশুসুলভ বাছুরের শিং উচিয়ে তেড়ে আসার মতন (L)
গগন হরকরা সংক্রান্ত কিছু তথ্য এখান থেকে টুকে দিলাম
http://www.shapludu.com/1418/02/article_details.php?article_serial=45
@বিপ্লব পাল,
হায়রে বিপ্লব! রবীন্দ্রপূজারীরা কীভাবে রবীন্দ্র বন্দনা করে, কীভাবে রবীন্দ্র ত্রুটির সাফাই গায়, সেটা দেখিয়ে দিলে তুমি।
অন্যের গান শুনে আপ্লুত হওয়াটা খুবই মহৎ একটা কাজ। তারচেয়েও মহৎ কাজ হচ্ছে, সেই কাজগুলোকে ছড়িয়ে দেওয়া। রবীন্দ্রনাথ সেই কাজটা বাউলদের জন্য করেছেন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। ধন্যবাদ প্রাপ্য তাঁর সে কারণে। কিন্তু, আপ্লুত হলেই যে তাঁদের সুরকে নিজের গানে ব্যবহার করতে হবে এমন কোনো কথা আছে কি? বাউল গানের সংস্পর্শে আসার পরে এর প্রভাব তাঁর পড়তেই পারে, সেটা নিয়ে আমরা কেউ-ই কথা বলছি না। বলছি হুবহু সুর চুরির কথা। তুমি বলছো যে রবীন্দ্রনাথ আপ্লুত ছিলেন দেখেই তাঁদের সুর ব্যবহার করে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে অন্য কেউ আপ্লুত হয়ে একই কাজ করলে রবীন্দ্রনাথ বা ভক্তবৃন্দ কিংবা তুমি একইভাবে এই কাজটাকে জাস্টিফাই করতে কি না সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার।
এরকম মহৎ ইচ্ছা তাঁর থাকলে স্রষ্টার নামেই সেগুলোকে প্রচারের ব্যবস্থা তিনি করতেন। নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। অন্যের মেধা সৃষ্ট শিল্পকে ছড়িয়ে দেবার জন্য নিজের নামে সেগুলোকে চালানোর প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় আন্তরিকতা এবং সততার।
না, কবি কখনোই স্বীকার করেন নি যে আমার সোনার বাংলার সুর তিনি নিয়েছেন গগন হরকরার কাছ থেকে। আসলে কোনো গানেই তিনি স্পষ্ট করে বলেন নি যে কোথা থেকে নিয়েছেন। ভাসা ভাসাভাবে শুধু বলে গিয়েছেন যে তাঁর রাগরাগিনির মধ্যে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতে বাউলদের সুরের মিশ্রন ঘটেছে। এ যেন বিপ্লবের কোনো লেখা পুরোপুরি চুরি করে সেই লেখার নীচে ছোট করে লিখে দেওয়া যে, বিপ্লবের কোনো কোনো লেখার প্রভাব জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এখানে এসে থাকতে পারে।
মেধাসত্ব অবশ্যই চালু ছিল। না হলে রবীন্দ্রনাথের গানকে এভাবে যক্ষের ধনের মত আগলে রাখা সম্ভব হলো কীভাবে? রবীন্দ্রনাথতো গান লিখেছেন ওই কালেই।
এত বড় একটা চুরি, প্রতারণা এবং বঞ্চনার ঘটনাকে ফালতু অভিযোগ বলে মনে হচ্ছে কেন তোমার? রবীন্দ্রনাথ এর সঙ্গে যুক্ত বলে? অন্য কোনো যদু মধু রবীন্দ্রনাথের সাথে এরকম একটা গর্হিত কাজ করলেতো মনে হয় সেটাকে আর ফালতু অভিযোগ বলে মনে হতো না তোমার, তাই না?
এরপর উদ্ধৃতি হিসাবে তুমি যেটাকে তুলে দিয়েছো সেটা রবীন্দ্রনাথ বিশ্বপরিচয় এ বলেন নি। এই কথাগুলো তিনি বলেছেন তাঁর বাংলাভাষা পরিচয় গ্রন্থে। সেখানে তিনি নিজের কৃতিত্ব জাহির করাতেই ব্যস্ত ছিলেন। সেই জাহির করার প্রবনতা থেকেই বিশ্বপরিচয়ের কথা এসেছে। এটাকে উদ্ধৃত করে তুমি কী বোঝাতে চাইলে, সেটা বুঝি নি আমি।
বিশ্বপরিচয়ের ভাষা নিয়েতো তর্ক হচ্ছে না। রবীন্দ্রনাথ এর ভাষা দেখে দিয়েছিলেন, কাজেই প্রমথনাথের বদলে রবীন্দ্রনাথের ভাষা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর তথ্য তিনি অন্যদের কাছ থেকে পান নি। পেয়েছেন সম্পূর্ণভাবে প্রমথনাথের কাছ থেকে। ভুল হলো তথ্য নয়, একেবারে পাণ্ডুলিপি পেয়েছেন তিনি প্রমথনাথের কাছ থেকে। রবীন্দ্রনাথ সেই পাণ্ডুলিপির ভাষা সম্পাদনা করে দেবার সুবাদে সহলেখক হিসাবে কোনোমতে আসতে পারেন সেখানে, প্রথম লেখক হিসাবে কোনোভাবেই নয়। অথচ আমরা দেখছি উল্টোটা। প্রমথনাথ সেখানে নেই, তিনি-ই এর লেখক হয়ে গিয়েছেন।
না, এটাকে রাহাজানি বলবো না। কোনটাকে রাহাজানি বলতে হয় সেটা খুব ভাল করেই জানি আমি। 🙂
আমাদেরতো তবু অল্প আধটু শিং আছে। সেগুলো নিয়েই গুঁতোতে চাই। কিন্তু তুমি যে একেবারে শিংবিহীন মৃগশাবক হয়েও মার মার কাট কাট করে তেড়ে আসতে চাও, সেটা কী খেয়াল করেছো কখনো? 😀
@ফরিদ আহমেদ,
তুমি কি জান, গগন হরকরাকে রবীন্দ্রনাথ গান শোনাতেন এবং রবীন্দ্রনাথ ও তার গান শুনতেন। তাদের গানের আড্ডা ছিল নিয়মিত এবং আমার সোনার বাংলা গানটা রবীন্দ্রনাথ গগনকে শোনান নি এমন ভাবার কোন কারন নেই-বরং এটাই সত্য হতে পারে, ওই সুর সংযোজনে গগন হরকরা সাহায্যই করেছিলেন।
আইনের পথে গেলে পুরো অভিযোগটা এখানেই নেমে আসে-গগন (১)হরকরা কি এই নিয়ে আপত্তি করেছেন কোন দিন? বা অভিযোগ জানিয়েছেন? (২) গগন হরকরা কি জানতেন তার সুরে বাজছে আমার সোনার বাংলা?
দ্বিতীয় উত্তর হ্যা এবং প্রথম উত্তর না। সুতরাং অভিযোগ ধোপেই টেকে না।
@বিপ্লব পাল,
তুমি মিয়া লেখাটা ঠিকমত পড়োই নাই। রবীন্দ্রনাথ যে গগন হরকরাকে ডেকে নিয়ে এসে কাছারিতে গান শুনতেন সেটা এই লেখাতেই উল্লেখ করা আছে। সেই গানের অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথও তাঁর গান গাইতেই পারেন। এটা অসম্ভব কোনো বিষয় না। কিন্তু যেটা অসম্ভব, সেটা হচ্ছে, আমার সোনার বাংলা গানটা গগন হরকরাকে শোনানো। এই অনুমান একান্তই তোমার। তোমার এই অনুমান কেন অসম্ভব বলছি শোনো। রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে ছিলেন ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল পর্যন্ত। আমার সোনার বাংলা রচিত এবং তাতে সুরারোপিত হয়েছে আরো পরে। কাজেই শিলাইদহে এই গান গগনকে শোনানোর কোনো প্রশ্নই আসে না, সুরারোপে গগনের সাহায্যতো বহু দূরের কথা। অবশ্য যদি রবি ঠাকুর গগনকে শিলাইদহ থেকেন ডেকে জোড়াসাঁকোতে নিয়ে গিয়ে থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। কিন্তু সেই রকম কোনো তথ্য আমরা পাই না রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে।
তারপরেও তোমার কথা যদি মেনেই নেই যে গগন হরকারাই রবীন্দ্রনাথকে আমার সোনার বাংলায় সুরারোপ করতে সাহায্য করেছিলেন, সেক্ষেত্রেও প্রশ্নই থেকেই যায়, তাহলে এর ক্রেডিটে গগনের নাম নেই কেন? কেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের সুরারোপকারীর নাম চেপে গিয়েছেন? গীতবিতান খুলে দেখো সেখানে গগনের নাম নেই। গোপন চুরির চেয়েও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আরো বড়ো বিপদে পড়ে গেছেন এখন তোমার কারণে। 🙂
তোমার দুই প্রশ্নের এবার আমি উত্তর দেই।
না, আপত্তি করেন নি। অভিযোগও জানান নি। কারণ, তিনি বিষয়টি জানতেনই না। শিলাইদহের মত প্রত্যন্ত একটা এলাকার একজন দরিদ্র মানুষের পক্ষে সেই যুগে কোলকাতায় কী হচ্ছে তা জানাটা একটু অসম্ভব ব্যাপারই ছিল। তারপরেও হয়তো একদিন তিনি জানতেন। কিন্তু ১৯১০ সালে তাঁর মৃত্যু ঘটে। ফলে, আপত্তি বা অভিযোগ জানানোর সুযোগ তাঁর ঘটে নি। কিন্তু, আমাদের দেশের একজন মেধাবী মানুষ হিসাবে তাঁর পক্ষ থেকে আমরাই এখন আপত্তি এবং অভিযোগ জানাচ্ছি।
না, জানতেন না। কারণ, পুরো চুরিটাই করা হয়েছিল তাঁর অগোচরে, তাঁকে না জানিয়ে।
@ফরিদ আহমেদ,
যেগুলো বললে সেগুলো কাল্পনিক ঐতিহাসিক না। একে একে এই তথ্য গুলো দেখ
(১) আমার সোনার বাংলার রচনা কাল ১৯০৫-গানটি ্রবীন্দ্রনাথ গেয়েছিলেন নিজে এবং গানের সুরের নোটেশন নিয়েছিলেন ইন্দিরা দেবী। এই গান গোটা বাংলায় গাওয়া হয়েছিল-উত্তাল করেছিল বঙ্গ ভঙ্গ বিরোধি আন্দোলন। গগনের মৃত্যুকাল ১৯১০। সুতরাং উনি এটি জানবেন না, তা হয় না। উনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, এমন হলে এটা জানা যেত। বরং উনার খুশী হওয়ার কথা, যে তার সুরে এটা গাওয়া হচ্ছে।
(২) রবীন্দনাথ এই গানটি বাউল সুর থেকে নিয়ছেন তা খুন স্পষ্ট ভাবে স্বীকার করেছেন। গানটি এবং সুর প্রকাশিত হয়েছিল বাউল পত্রিকাতে এবং এর সুর নিয়ে একটি প্রবন্ধ দেওয়া হয়েছিল সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা জার্নালে। সেখানে এই গানটির সুর কিভাবে বাউল সুর থেকে নেওয়া তা নিয়ে আলোচনা আছে। সেখানে উনি গগন হরকরা নাম নিয়েছিলেন কি না জানি না। কারন প্রবন্ধটা আমার কাছে নেই। কিন্ত এই ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই কবি গোটা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন -আমার সোনার বাংলা একটি বাউ্ল গান এবং সুরের পুরো কৃতিত্ব বাউলদের।
এর পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠাটা হাস্যকরই বটে।
@বিপ্লব পাল,
গগন হরকরা বেঁচে ছিলেন বলেই তিনি জানতেন, এই বিষয়টাতে তুমি নিশ্চিত হচ্ছো কীভাবে আমি জানি না। সেই সময় শিলাইদহ আর কোলকাতার যোগাযোগ ব্যবস্থা কী রকম দুঃসাধ্য ছিল তা কিন্ত তুমি একেবারেই ধর্তব্যের মধ্যেই নিচ্ছো না। এই দিকটা তোমার একটু চিন্তা করার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি করি।
তিনি প্রতিবাদ করেন নি, এটা আমরা জানি। কিন্তু, এই প্রতিবাদহীনতা সম্মতির কারণে হয় নি, হয়েছে না জানার কারণে। উনার সুরে গাওয়া হয়েছে বলেই উনি খুশি হতেন সেরকমও কোনো কিছু আমি মনে করি না। বরং বড় ধরনের দুঃখই পেতেন তিনি। কারণ, সুরটা যে উনার সেটা স্বীকার করা হয় নি।
বাউল সুর একটা ভেগ টার্ম। এর আড়ালে চলে যাওয়া হয়েছিল গগন হরকরাকে ঠকানোর সুচতুর অভিপ্রায়ে। যেখানে গগন হরকরা জীবিত রয়েছেন, রবীন্দ্রনাথের সাথে তাঁর সরাসরি পরিচয় রয়েছে, তাঁর বিষয়ে শিক্ষিত সমাজে একটু আধটু জ্ঞানও রয়েছে, সেখানে সরাসরি তাঁর নাম নিতে কী সমস্যা ছিল? তিনিতো আর রবীন্দ্রনাথের ভাসুর ছিলেন না যে তাঁর নাম নেওয়া যাবে না। এই বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলো আমাদের।
@ফরিদ আহমেদ,
সঙ্গীত বিজ্ঞান প্রবেশিকা জার্নালে সোনার বাংলার সুর নিয়ে রবীন্দ্রনাথ কি লিখেছিলেন, সেটা না জানলে এই বিচার সম্ভব না। যেহেতু অভিযোগ তোমাদের-তোমাদের প্রথম কাজ এই প্রবন্ধটি এবং বাউল পত্রিকাতে তিনি কি লিখেছিলেন তা উদ্ধার করা।এগুলো সামনে না এলে অপরাধ প্রমাণ সম্ভব না। আপাতত দেখা যাচ্ছে তিনি এই গানটির সুর নিজের বলে দাবী করেন নি-বাউলদেরই কৃতিত্ব দিয়েছেন-সুতরাং সুস্পষ্ট প্রমাণের অভাবে, তোমাদের অভিযোগ টিকছে না।
কাল্পনিক ইতিহাতে গা ভাসিয়ে এই অভিযোগ টিকবে না।
@বিপ্লব পাল,
সেটা তুমিই বা দায়িত্ব নিয়ে কর না কেন! আর তাছাড়া কেন রবীন্দ্রনাথ ‘কি লিখেছিলেন’ সেটা দিয়েই কেবল বিচার করতে হবে? গগন হরকরার গানের সুর আর রবীন্দ্রনাথের গানের সুরের প্রোডাকট পাশাপাশি দেয়া আছে ইস্নিপ্স থেকে। তুমি শুনে দেখো না কোন পার্থক্য পাও কিনা। এটা তো কেউই অস্বীকার করছে না যে গগন হরকরা সুরটি আগে দিয়েছিলেন, আর রবিঠাকুর অনেক পরে ‘আমার সোনার বাংলা’য় ব্যবহার করেছেন। এই ব্যাপারে গগন হরকরার স্বীকৃতিটুকুই আমরা চাইছি কেবল, যখন এই সুরটি অবিচ্ছেদ্যভাবে আমাদের জাতীয়সংগীতেরও অংশ হয়ে গেছে।
@অভিজিৎ,
সেটা চাইলে আমাকে লিখতে হত না, বা রবীন্দ্রনাথ ও আপত্তি করতেন না।
যেখানে রবীন্দ্রনাথ দাবী করছেন না, তিনি নিজে আমার সোনার বাংলার সুরকার, বলছেন সেটা বাউল সুর- আমার আপত্তি সেখানে রবীন্দ্রনাথ কে দোষ দেওয়াতে।
গগন হরকরাকে স্বীকৃতি দিলে রবীন্দ্রনাথ খুশীই হবেন-আগে এটা বোঝার মতন সমঝদার হও, তারপর রবীন্দ্রচর্চাতে নামলে ভাল হয়।
@বিপ্লব পাল,
তোমার একটা বড় সমস্যা হল না বুঝেই উপদেশ বর্ষণ কর। ‘সমঝদার হও, তারপর রবীন্দ্রচর্চাতে নামলে ভাল হয়’ – এগুলো বলে যদি যুক্তিতে চাও তাহলে কিছু বলার নেই। ইনফ্যাক্ট মানুষকে উপদেশ দেবার আগে নিজের দিকটা পরিস্কার কর।
এখন তোমার সমস্ত যুক্তি কেন্দ্রীভূত হয়েছে ‘বাউল সুর’ নামক নৈর্বক্তিক শব্দের উপর। তুমি কি আসলে বোঝ বাউল গান কি? তোমার কি ধারণা বাংলার সব বাউল গান এক ধরণের সুরে যে ‘বাউল গান দিয় অনুপ্রাণিত’ বলে দিলেই সমস্যা মিটে যাবে? লালন শাহ এর গান, দুদ্দু শাহ-এর গান, পুর্ণদাস বাউল, পবন দাস বাউল, শাহ আব্দুল করিম – সব এক? এমনকি লালনেরও সব গানের সুর একই রকম নয়। ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’ আর ‘জাত গেল, জাত গেল’ কি একই সুরে লেখা? আমি যদি লালনের খাঁচার ভিতর অচীন পাখি গানটার সুর নিয়তে একটা গান বেঁধে বলে দেই, বাউল সুর দিয়ে অনুপ্রাণিত – ব্যাস আমার চুরি জায়েজ হয়ে যাবে? আমি রবীন্দ্রসংগীতের যেমন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’র সুর নিয়ে আরেকটা গান সুর করে দিয়ে বলে দিতে পারব, আমি রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে অণুপ্রাণিত? তুমিই প্রথম আমাকে নকলবাজ বলবে। এ তো দেখছি – রবি ঠাকুরের বেলায় লীলা, আর আমার বেলেয় মাং… :))
একটু বোঝার চেষ্টা কর – ‘আমি কোথায় পাবো তারে’ গানটার সুর তৈরি করতে গগন হরকরাকে বহুৎ কষ্ট করতে হয়েছে, সৃজনশীলতা দেখাতে হয়েছে, মৌলিকত্ব আনতে হয়েছে – ঠিক যেমনি লালনকে কষ্ট করতে হয়েছে ‘খাঁচার ভিতর অচীন পাখি’র সুরটাকে বাঁধবার জন্য। একজন কষ্ট করে সুর বানালো, আর আরেকজন স্রেফ এখান থেকে টুকে ওখানে বসিয়ে দিল, আর ভক্তরা বলতে থাকল ‘অমুক দিয়ে অনুপ্রাণিত’ – এ করে দায়িত্ব শেষ হয়না। কাজের স্বীকৃতি লাগে।
@বিপ্লব পাল,
যাই লিখে থাকুক না কেন, গগন হরকরার নাম যে নেন নি সেটা আমি বলে দিতে পারি ওই লেখা না দেখেও। তারপরেও চেষ্টা করবো লেখাটা উদ্ধার করতে।
বাউলদের হয়তো কৃতিত্ব দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর সমসাময়িক গগন হরকরাকে দিতে নিদারুণ কার্পণ্য করেছেন তিনি। আমাদের অভিযোগ ওই যায়গাতেই। বাউলদের যত কৃতিত্বই তিনি দিন না কেন আমার সোনার বাংলার সুর যে তাঁর করা এই দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় একে রবীন্দ্র সংগীতের মর্যাদা দেওয়াতেই। কারণ, আমরা জানি যে গানগুলো রবীন্দ্রনাথ নিজে লিখেছেন এবং সুর করেছেন সেগুলোই শুধু রবীন্দ্র সংগীত হিসাবে স্বীকৃত, অন্যগুলো নয়।
এই ইতিহাস যে কাল্পনিক নয়, সেটা এর মধ্যেই প্রমাণ করেছি আমরা। ইতিহাস যেহেতু কাল্পনিক নয়, সেহেতু অভিযোগও টিকবে। শুধু টিকবেই না, একদিন গগন হরকরা তাঁর প্রাপ্য সম্মানও পাবেন এই সুরের জন্য। পশ্চিম বঙ্গে না হোক, বাংলাদেশে একদিন ঠিকই আমার সোনার বাংলা গানের সুরকার হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে গগন হরকরার নাম এসে যাবে। আমরা তুষার গোলকটাকে গড়িয়ে দিয়েছি, বিশালত্ব পেতে দেরি হবে না এর।
খ্রিস্টিয় চার্চের গ্যালিলিওর প্রতি করা অন্যায়ের ক্ষমা চাইতে সময় লেগেছিল পাঁচশো বছর। কিন্তু রবীন্দ্র পূজারীদের গগন হরকরার প্রতি করা অবিচারের ক্ষমা চাইতে অতো দেরি হবে না বলেই মনে হয়। 🙂
@ফরিদ আহমেদ,
এত শব্দ এবং বাক্য খরচ করে কিছুই প্রমান করো নি-সেটাই আগে বোঝ।
ওই গানটা যে গগন হরকরার সুর থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটা গানটার জন্ম লগ্ন থেকেই সবাই জানে, কবিও এটিকে নিজের সুর না বাউল সুরের গান বলেই স্বীকৃতি দিয়েছেন-মোদ্দা কথা সুরের উৎস তিনিও চাপা রাখেন নি। এবং তাতে মোটেই প্রমান হয় না রবীন্দ্রনাথ চোর।
গগন হরকরাকে স্বীকৃতি দেওয়া আর রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য-প্রথমটাতে কারুর আপত্তি থাকার কথা না-যেহেতু রবীন্দ্রনাথ মোটেও গানটির সুরকার বলে নিজেকে দাবী করেন নি।
কিছুতো নিশ্চয়ই প্রমাণ করেছি। তবে এত শব্দ এবং বাক্য খরচ করিয়াও তোমাকে যে বোঝাতে পারলুম না সেই দুঃখ অন্তরে চিরস্থায়ীভাবে রহিয়া গেলো। এর চেয়ে রবি ঠাকুরকে ধরে নিয়ে আসতে পারলে সহজ হতো। তিনি বললে তুমি ঠিকই বুঝতা। গুরুভক্তি বলে কথা। 🙂
ঠিকই প্রমাণ হয় যে রবীন্দ্রনাথ একটা চোর। এই কাজটা রবীন্দ্রনাথ করেছেন বলেই তুমি এত দ্বিধাগ্রস্ত। কোনো যদু মধু এরকম আকাম করলে তুমি ঠিকই তারে চোর বলতা। তোমার অতি রবীন্দ্রভক্তি সেই বলাকে বাধা দিচ্ছে।
এর সুরকার কাকে বলেছেন তিনি?
@বিপ্লব পাল,
তাই নাকি? হয় তুমি সত্য ইতিহাস জান না, নয়তো ইচ্ছে করে ভুং চুং করছ। লাভ হবে না ওতে। আমার কাছে বিশ্বপরিচয়ের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আছে। প্রমথনাথ সেনগুপ্তের আনন্দরূপম বইয়ের কথা তো লেখায় বলেছি, সাথে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য এবং আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের লেখা ‘রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান’ বইগুলোও দেখতে পার। না পড়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে কথা বললে হবে?
বইটির পাণ্ডুলিপি রবীন্দ্রনাথ লেখেননি। শুরুও করেননি। ওটা শুরু করেছিলেন প্রমথনাথ। শেষও করেছিলেন তিনি। পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভুলোক, এমনকি উপসংহার পর্যন্ত প্রমথনাথেরই লেখা। এমনকি বইটা যে প্রমথনাথেরই হবে, সেটা প্রমথনাথ নিজেও মনে করতেন, নয়তো কেন তিনি বইটার নাম ‘বিশ্বরচনা’ ঠিক করবেন? কেনই বা বই সম্পূর্ণ শেষ হবার পরে রবীন্দ্রনাথকে বলতে হল – “এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না”?
জলজ্যান্ত একটা মানুষকে দিয়ে বই লিখিয়ে, তার তথ্য সম্পুর্ণরূপে ব্যবহার করে, তাকে এখন ‘ওয়াকিপিডিয়া’ বানালে হবে? তুলনাটা শিশুশুলভ হল বিপ্লব। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবতঃ জানতেন তার বিশ্বপরিচয় নিজ থেকে লেখার ক্ষমতা কতটুকু। উনি লিখলে বড়জোর মাকড়সা-সমাজে স্ত্রীজাতির গৌরব ধরণের কিছু একটা বেরুতো, বিশ্বপরিচয় নয়। সেজন্যই প্রমথনাথকে তার দরকার হয়ে পড়েছিলো, কেবল রিভিউ করার জন্য নয়, বইয়ের পুরোটুকু লেখার জন্যই।
@অভিজিৎ,
তোমার অভিযোগের সপক্ষে কোন প্রমানই এখানে হাজির করো নি। পুরোটাই কল্পনা। তোমার অভিযোগ প্রমাণ করতে হলে দেখাতে হবে
বিশ্বরচনাতে প্রমথনাথ কি লিখেছিলেন বনাম বিশ্বপরিচয়ে কবি কি লিখেছেন। সেটা প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।
কারন কবি নিজে লিখেছেন, তিনি তার ভাষার মাধুরী দিয়ে লিখেছেন বিশ্বপরিচয়-অর্থাৎ এই গ্রন্থের সব ভাষা এবং সব কিছুই নিজের মতন সাজিয়েছেন তিনি। হতে পারে প্রথম পান্ডুলিপি ছিল প্রমথ নাথের যাতে কিছু তথ্য ছিল। সেই ওয়াকিপিডিআর মতন।
সুতরাং যতক্ষন না প্রমান করতে পারছ বিশ্চরচনা এবং বিশ্বপরিচয়ে ভাষার এবং থিমের পার্থক্য ঠিক ঠিক কি কি ছিল-এই অভিযোগ কোন কোর্ট অব ল তেই টিকবে না।
তাই এটাও আরেকটি অপ্রমাণিত অনুমান নির্ভর অভিযোগের বেশী কিছু না। আগে প্রমান দাও, তারপরে অভিযোগ জানাবে।
@বিপ্লব পাল,
তুমি অযথাই শিং দিয়ে গুতাগুতি করে যাচ্ছ বিপ্লব। লেখায় অজস্র প্রমাণ দেয়া হয়েছে যে কাজটি প্রমথনাথই শুরু করেছেন, শেষও করেছেন তিনি। তোমাকে রেফারেন্স দেয়া হয়েছে, কিন্তু তুমি উটপাখির মত বালিতে মুখ গুঁজেই রয়েছ।
যেমন প্রমথনাথের নিজের লেখা বই ‘আনন্দরূপম’ এর পৃষ্ঠা ২৪ এ আছে বই শুরুর কথা –
‘বইটার নামকরণ করলাম “বিশ্বরচনা”। ধীরে ধীরে কাজ এগুতে লাগল। ‘পরমাণুলোক’ দিয়ে শুরু হল বইয়ের প্রথম অধ্যায়, …’।
এভাবেই প্রতিটি অধ্যায় লিখছিলেন , আর রবীন্দ্রনাথকে পাঠাচ্ছিলেন, আর রবীন্দ্রনাথ তা সংশোধন করে কবির ভৃত্য বনমালীর হাত দিয়ে প্রমথনাথকে পাঠাচ্ছিলেন। এভাবেই পুরো বইটা শেষ করেন। প্রতিটি অধ্যায়ের কোটেশনে আমি আর যাচ্ছি না, একদম শেষ অধ্যায়ে চলে যাই, দেখি প্রমথনাথ কী বলছেন-
‘আনন্দরূপম’ এর পৃষ্ঠা ১৪৬ এ আছে বইয়ের শেষ অধ্যায় লিখে উপসংহার লেখার কথা –
‘বিশ্বপরিচয় -এর শেষ অধ্যায় লিখে দিয়ে এলাম গুরুদেবের হাতে। এটা সংশোধিত হয়ে ফিরে এলে তৈরি করতে হবে নতুন করে স্মগ্র পাণ্ডুলিপি সুন্দর নির্ভুলভাবে লিখে, তারপর তা তুলে দিতে হবে ওঁর হাতে, আলমোড়া যাবার আগে …’
কি বুঝলে ? এর চেয়েও বড় প্রমাণ আর কি হতে পারে, যেখানে লেখক নিজেই বলছেন যে সবগুলো অধ্যায় তিনি একে একে লিখেছেন, এমনকি উপসংহারও – এবং বইটার প্রাথমিক নাম বিশ্বরচনাও ঠিক করে রেখেছিলেন?
বইটার দায়িত্ব যে প্রথম থেকেই প্রমথনাথের হাতে ছিলো সেটা আছে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক’ বইয়েও। আর দীপঙ্কর চট্টোপাধায়ের লেখা ‘রবীন্দনাথ ও বিজ্ঞান’ বইয়েও কিছু বিস্তৃত বর্ণনা আছে।
আর তুমি বলে যাচ্ছে প্রমাণ দেইনি! তুমিই ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছ- রবীন্দ্রনাথ ভাষা ঠিক করেছেন – ইত্যাদি, তা আমরা আমদের লেখাতেই বলেছি, নতুন কিছুই শোনাচ্ছ না। কিন্তু কথা হচ্ছে, যদি একটি বইয়ের সবগুলো অধ্যায় – পরমাণুলোক, নক্ষত্রলোক, সৌরজগৎ, ভুলোক, এমনকি উপসংহার পর্যন্ত একজন লেখক লেখেন, আর অন্যজন কেবল ভাষার উপর মাস্তানি করে খোল নলচে বদলানোর ভার নেন, ২য় ব্যক্তি গ্রন্থকার হিসেবে যুক্ত হতে পারেন কিনা? এক্ষেত্রে শুধু গ্রন্থকারই হন নি, মূল লেখককে সরাসরি বাদই দিয়ে দিয়েছেন। শুধু ওয়াকিপিডিইয়া বলে পার পাওয়া যাবে না। আসলেই ‘রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি!’
@অভিজিৎ,
(১) প্রমথনাথ দাবী করছেন, তিনি পান্ডুলিপি পাঠাতেন, কবি তা সংশোধন করে পাঠাতেন
(২) রবীন্দ্রনাথ দাবী করছেন, তিনি বিশ্বপরিচয় লিখতে বসেছিলেন এবং তার জন্যে নানান ব্যক্তির কাছে তথ্য ভিক্ষা করেছেন কিন্ত বই এর থিম এবং ভাষা সম্পূর্ন তার।
(১) এবং (২) এর দাবীর মধ্য পার্থক্য অনেক।
এখন তুমি যখন প্রমথনাথে উকিল, প্রমথনাথের অভিযোগ প্রমান করার দ্বায়িত্ব তোমার। বার্ডেন অব প্রুফ তোমার ঘারে, যেহেতু অভিযোগ তোমার ( এবং প্রমথনাথ ও এই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন)।
এবং তা একমাত্র প্রমানিত হতে পারে যদি প্রমথ নাথের লেখা এবং বিশ্বপরিচয় লেখাটা দুটো স্বতন্ত্র ভাবে পাশাপাশি দেখা এবং বিশ্লেষণ করার সুযোগ হয়।
শুধু প্রমথনাথের অভিযোগের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণ হয় না-এবং তেমন করাটা বালখিল্যতাই হবে যেখানে রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য প্রমথনাথের সম্পূর্ণ বিপরীত।
@বিপ্লব পাল,
না রে ভাই, আমি উকিল টুকিল কিছু না। আর আইনী মামলা করতেও আমি যাচ্ছি না। আমি কেবল সেই ইতিহাসটিই তুলে ধরলাম যেটা অতীব যত্নের সাথে গোপন করে রাখা হয়েছিলো যুগের পর যুগ। আর কেবল ‘প্রমথনাথের অভিযোগের ভিত্তিতে’ কিছু বলিনি, অনুষঙ্গিক ইতিহাস এবং বইয়েরও রেফারেন্সও দেয়া হয়েছে পাশাপাশি। তোমার কথাও শুনলাম। এখন, বাকি ভার পাঠকদের উপরই থাকুক।
@বিপ্লব পাল,
দাদা, আমি আপনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। ‘বিশ্বরচনা’র আদি পাণ্ডুলিপি ছাড়া কিছুতেই প্রমাণ করা যায় না, ‘বিশ্বপরিচয়’ রবীন্দ্রনাথের হাতে কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছিল, না খোলনলচে বদলে গিয়েছিল।
অভিজিৎ-দা আমার একটি মন্তব্যের জবাবে লিখেছেন যে, “ধরুন, আপনি অনেক খেটে খুটে বৎস্রাধিক পরিশ্রম করে একটি বই লেখার উপকরণ যোগাড় করলেন। তারপর একদিন দেখলেন আমি সেতার ভাষা একটু বদলে (মানে খোল নলচে বদলে) সেটা বাজারে ছেড়ে দিয়েছি আমার নামে, আর ভুমিকায় একটু কৃতজ্ঞতা দিয়েছি আপনার। কেমন হত? আপনি বা আপনার সুহৃতেরা কি এটা সমর্থন করতেন?” অথচ রবীন্দ্রনাথ তো নিজেই বলেছেন, বিশ্বপরিচয়ের ভাষা একটু নয়, প্রায় পুরোই বদলে গেছে এবং কবিগুরুর মিথ্যা বলেছেন, এ কথা আমি বিশ্বাস করি না। আর তাছাড়া, অভিজিত-দা যদি আমাকে কিছু বিদেশী ভাষায় রচিত জনপ্রিয় বিজ্ঞান গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে ‘টাইম মেশিন’ সম্পর্কিত কিছু তথ্য যোগাড় করতে বলেন (যেহেতু তার হাতে যথেষ্ট সময় নেই), এবং পরবর্তীতে আমার দুর্বল লেখার উপর তার যাদুকরী ভাষার প্রলেপ লাগিয়ে অসম্ভব সুখপাঠ্য লেখা তৈরি করেন, তাহলে সেই লেখার কৃতিত্ব কার? উদ্যোক্তার এবং ভাষা-স্রষ্টার না তথ্য সংগ্রাহকের? মনে রাখতে হবে, বিজ্ঞান রচনাগুলি না মৌলিক গবেষণা পত্র, না কোন মৌলিক সাহিত্য। বিজ্ঞান রচনাগুলো সমসাময়িক জটিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারগুলোকে সহজবোধ্য করে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর একটি প্রয়াস। সুতরাং, বিজ্ঞান রচনায় ভাষাই প্রধান ফ্যাক্টর, তথ্য নয়। আমি অভিজিত-দার ভক্ত তাঁর লেখার গুণে, তার তথ্যের জন্য নয়; কারণ, তথ্য অন্য অনেক লেখকের লেখাতেও পেয়েছি, যা আমি বুঝতে পারিনি মোটেও।
আর তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ যখন গগন হরকরার সুর অ্যাডাপ্ট করেন তাঁর ‘সোনার বাংলা’ গানে, তিনি কিন্তু জানতেন না যে এটি একদিন স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হবে। তিনি হাজারো গানের মতো এটিও অ্যাডাপ্ট করেছেন এবং নিশ্চয় বাংলার গ্রামীণ সুর তার গানের মাধ্যমে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরে খুশি ছিলেন। আমরাও কিন্তু খুশি যে, আমাদের জাতিয় সংগীতের সুর আবহমান বাংলার জীবন ও প্রকৃতিকে ধারণ করে আছে। এ জন্য আমাদের রবীন্দ্রনাথের কাছে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত নয় কি? রবীন্দ্রনাথ ছাড়া হয়তো গগন হরকরার এ অসাধারণ সুর হারিয়ে যেত! বলা হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার কথা স্বীকার করেননি; কিন্তু উনি অস্বীকার করেছেন, বা গানটিকে সম্পূর্ণ নিজের বলে বর্ণনা করেছেন, এমন প্রমাণ কি কোথাও আছে? এটাতো গবেষকদের কাজ যে, তারা রবীন্দ্রনাথের হাজার হাজার গান কিভাবে কোন সুরকে ভেঙ্গে, জোড়া দিয়ে, বা ছায়া অবলম্বনে রচনা করেছেন, তা বের করা। নাকি আমরা আশা করব, কবিকে হাজার হাজার অমর সৃষ্টি উপহার দেয়ার পাশাপাশি ওগুলোর শানে নযুল লিখে যেতে হবে?
@বিপ্লব পাল,
টুদ্যা পয়েন্ট কথা না বলে আজাইরা ঝোপঝাড় পিটাইয়া কাম কি? এরা পড়াশুনা করে নাই, পড়াশুনা কইরা লিখো – এইগুলা খুব পুরানা স্ট্র্যাটিজি কামে দিব না। এইগুলা কথা তোমারেও কওন যায়, তো এই খেলায় জিতলো কে? আমি তো বলি নাই মহাভারতের চরিত্র নিয়া চিত্রাঙ্গদা লিখলে সেইটা চুরি হইব। কিন্তু একজনরে দিয়া টপ টু বটম – পুরা বই লিখাইয়া খোল নলচে বদলানোর নাম কইরা নিজের নামে চালায় দেওন তো শুধু চুরি না একেবারে রাহাজানি। বহু রেফারেন্স দেওন হইছে যে বিশ্বপরিচয় নামের বইয়ের কাজটা যে প্রমথনাথই শুরু করছিলো, শেষও কর্ছিলো উনিই। তুমি একটু খোঁজখবর নিলেই পাইবা। না ইন্টারনেটে খুঁজলে হয়তো পাইবা না, কিন্তু যে বইগুলার রেফারেন্স দেওয়া হইছে সেগুলো যোগাড় কইরা দেখ। আর গগন হরকরার গানের সুর যে তিনি পুরাটাই ব্যবহার করছেন, এইটা তো আর অস্পষ্ট নাই। এই লেখায় দুইটা বড় ব্যাপারে অভিযোগ দাখিল করা হইছে – প্রমথনাথ আর গগন হরকরা – একটারও জবাব না দিয়া আশে পাশে ঝোপঝাড়ে বাড়ি দিলে হইব নাকি?
এর মধ্যে একটা ব্যাপারেই তর্ক করা যেতে পারে। প্রজাপীড়ন নিয়া পক্ষে বিপক্ষে। কিন্তু আমরা যে রেফারেন্সগুলা দিছি সেই বইগুলা লিখছে আহমদ শরীফ, অমিতাভ চৌধুরী, প্রমথ চোধুরী , শচীন্দ্র অধিকারি, হুমায়ুন আজাদ – এদের রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে পড়াশোনা তোমার আমার চেয়ে বেশি বই কম মনে হয় না। আমার ধারণা তোমারই বরং একটু এদের রিসোর্সগুলো ঘাইটা দেখা দরকার।
@অভিজিৎ,
দাড়াও মিয়া, টাইমের অভাবে টু দ্যাপয়েন্ট এখনো দিচ্ছি না। শুধু ফরিদ ভাই দুটি টুদা পয়েন্ট চেয়েছিল-সেই দুটিই দিলাম। দেখে নিও 😉 -দরকার হলে আরো দেব-আপাতত লিখে যাও 😀
রবীন্দ্রসমালোচনা পড়ে রবীন্দ্রনাথ শেখা যায় না। কে কি রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কি বলেছেন, সেসব গল্প না পেড়ে, ইতিহাস ঘাঁটলেই বেড়বে, উনি কিছিলেন আর কি ছিলেন না। আর হুমায়ুন আজাদ একজন রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ছিলেন -জানতাম না- কারন আমার ধারনা ছিল, সারাজীবন শুধু রবীন্দ্রনাথ নিয়ে গবেষণা করার পরেও অমিয় চক্রবর্তীর মতন একজন প্রথম শ্রেনীর রবীন্দ্র গবেষকও বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, এক জীবনে তাকে বোঝা অসম্ভব। আশা করি বলবে না, হুমায়ুন আজাদ অমিয় চক্রবর্তীর চেয়ে রবীন্দ্রনাথ বেশী বুঝতেন বা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তার থেকে বেশী গবেষনা করেছেন। 😉
এত কথা বুঝি না, স্রেফ ব্লাসফেমির জন্য আপনাদের দুইজনের ফাঁসি চাই!
আর দ্বিতীয় কথা হল, আগে রবিঠাকুরের মত গান লিখে দেখান, তবে তাঁর সমালোচনা করতে আসবেন!
😛
তবে হ্যাঁ, যারা রবিবুড়োকে ফেলে নজরুলের গানকে জাতীয়সঙ্গীত করতে চায়, তারা লেখাটা ভালবাসবে… 😉
@কৌস্তুভ,
:))
ঠিক!
produce a sura like it,…
But if ye cannot – and of a surety ye cannot – then fear the Fire whose fuel is men and stones,- which is prepared for those who reject Faith.! 🙂
@অভিজিৎ স্যার,
আমরা শাশ্বতিকী থেকে রবীন্দ্রসংখ্যার কাজ করছি। আজকালের মধ্যে ছাপাখানায় যাবে। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের এই লেখাটি আমরা প্রকাশ করতে চাচ্ছি। প্রয়োজনে আমরা কাজ কয়েকদিন পিছিয়ে নিচ্ছি। আপনি চাইলে শাশ্বতিকীর সূচিটা একবার দেখে নিতে পারেন।
শাশ্বতিকী’র রবীন্দ্রসংখ্যার সূচিপত্রের এক অংশ
সূচিপত্র
বিষয়ভিত্তিক সাক্ষাৎকার
আবুল আহসান চৌধুরী : পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
আবদুশ শাকুর : চিন্তাবিদ ও সমাজকর্মী রবীন্দ্রনাথ
হাসান আজিজুল হক : আমার রবীন্দ্রনাথ
জুলফিকার মতিন : সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বজিৎ ঘোষ : নাট্যসাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ
অনুবাদ সাক্ষাৎকার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আইনস্টাইন, রোমাঁ রোলাঁ ও এইচজি ওয়েলস
অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ
প্রবন্ধ
মলয় রায়চৌধুরী
রবিঠাকুর আমাদের বাড়িতে নিষিদ্ধ ছিলেন
মোঃ হারুন-অর-রশীদ
রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তা : শিক্ষাচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ
আবদুর রউফ চৌধুরী
চির-নূতনেরে দিলো ডাক, পঁচিশে বৈশাখ
মাসুদ রহমান
রবীন্দ্রনাথের অর্থভাবনা : তাত্ত্বিক পর্যায়
আহমাদ মাযহার
আমাদের দুঃসময়ের ও রেনেসাঁসের রবীন্দ্রনাথ
অনুবাদ প্রবন্ধ
মোহাম্মদ এ. কাইয়ুম
কল্পিত ‘‘এক বিশ্ব’’: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিরচিত …
অনুবাদ : মীর ওয়ালীউজ্জামান
কল্যাণ কুণ্ডু
মুসোলিনি ও রবীন্দ্রনাথ
অনুবাদ : রাতুল পাল
আলফওনযো শাহ্কোন
বিস্মৃত শিলা : রবীন্দ্রনাথ ও ল্যাটিন আমেরিকা প্রসঙ্গ
অনুবাদ : হিশাম ম. নাজের
নিয়মিত বিভাগ : চলচ্চিত্র-প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ
রেজাউল করিম সিদ্দিকী
‘চোখের বালি’ : রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস ও ঋতুপর্ণের চলচ্চিত্র
অমিতাভ নাগ
‘চতুরঙ্গ’ বিষয়ে পাঁচটি কথা
আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম।
[email protected]
@মোজাফফর হোসেন,
লেখাটা আসলে দু’জনের। আমার তরফ থেকে কোনই আপত্তি নেই। ফরিদ ভাইয়েরও না থাকলে আপনি এখান থেকে নিয়েই ছাপাতে পারেন অবলীলায়।
আলাদা করে আপনার ইমেইলে লেখা পাঠাতে হবে কিনা জানাবেন।
আর হ্যা – একটা ব্যাপার আগেও বলেছি। এই স্যার ফ্যার আমাকে বলার দরকার নাই। আমি কারো স্যার না। অভিজিৎ ডাকলেই খুশি হব।
আপনার আগ্রহের জন্য ধন্যবাদ।
@অভিজিৎ,
আমার দিক থেকেও কোনো আপত্তি নেই। তবে, এখানে আমরা যে রকম গানের লিংক টিংক দিয়েছি, সেরকমতো আর পত্রিকায় দেওয়া যাবে না। সামান্য কিছু রদবদল নিশ্চয়ই করতে হবে পত্রিকার উপযোগী করার জন্য।
@ফরিদ আহমেদ, আচ্ছা, তাহলে আমার মেইলে একটু গুছিয়ে পত্রিকার উপযোগী করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাঠিয়ে দিন প্লিজ। ধন্যবাদ।
[email protected]
@কৌস্তুভ,
আলোচনায় এখনও কবিগুরু সম্বোধন দেখিনি কোথাও, বেশ মজা লাগছে :))
কোন সন্দেহ নেই। :))
মন্তব্য করতে ভয় ভয় করছে। রবীন্দ্রনাথ সম্মন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত। সীমিত জ্ঞান থেকে বলছি, তাঁর কিছু চিঠি পড়ে তাঁকে প্রজাপীড়ক নয় বরং প্রজাদরদী মনে হয়েছে আমার।
দুটি চিঠির আংশ বিশেষ
শিলাইদহ ১০ মে ১৮৯৩
আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোকে দেখলে আমার ভারি মায়া করে, এরা যেন বিধাতার শিশুসন্তানের মত নিরুপায়। এদের মুখে নিজের হাতে তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে কোনমতে একটুখানি ক্ষুধা ভাঙলেই আবার সে সমস্ত ভুলে যায়।—–
বিধাতা আমাদের এমনি একটি জীর্ণ দীন বস্ত্রখণ্ড দিয়েছেন, পৃথিবীর একদিক ঢাকতে গিয়ে আর এক দিক বেরিয়ে পড়ে দারিদ্র দূর করতে গেলে ধন চলে যায়, এবং ধন গেলে সমাজের কত যে শ্রীসৌন্দর্যের উন্নতির কারণ চলে যায় তার সীমা নেই।
শিলাইদহ ১১ মে ১৮৯৩
এক এক সময় এক একটি সরল ভক্ত প্রজা বৃদ্ধ আসে, তাদের ভক্তি এমন অকৃত্রিম! —-আমি যে এ ভক্তির অযোগ্য, কিন্তু এ ভক্তিটাতো সামান্য জিনিস নয়।
@তামান্না ঝুমু,
মানুষ এর মাঝে নাকি দ্বৈত সত্ত্বার বসবাস!!!
@তামান্না ঝুমু,
ভয়ের কিছু নেই তামান্না। কেউ এখানে আপনাকে লাঠি হাতে তাড়া করবে না। আমরা যেমন রবীন্দ্র পূজারী নই, তেমনি রবীন্দ্র বিদ্বেষীও নই। তথ্য প্রমাণ থাকলে সত্যকে সত্য বলে মেনে নিতে কোনো কুণ্ঠা আমাদের মধ্যে নেই।
রবীন্দ্রনাথের এই চিঠির সাথে তাঁর কর্মকাণ্ড মেলে না। এই চিঠিটা লেখা হয়েছে ১৮৯৩ সালে। অথচ যাঁদেরকে দেখলে তাঁর ভারি মায়া করতো, তাদের উপরই পরের বছর খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এবং সেই খাজনা আদায়ও করে ছেড়েছিলেন (সূত্রঃ শচীন্দ্র অধিকারী, শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ)।
খুব সম্ভত হুমায়ুন আজাদ একবার একটা কথা বলেছিলেন। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাতে সবসময় লেখা হয় ভণ্ড পীর কথাটা। তিনি বলেছিলেন যে, পীরের আগে ভণ্ড বিশেষণ দেওয়ার কোনো মানে নেই। পীর মানেই ভণ্ড। ঠিক সেরকমভাবেই প্রজাদর