কথারম্ভ


কীর্তিমান কবি কালিদাস এবং তাঁর সুপ্রভ সৃষ্টি মেঘদূতের মহিমাকীর্তন নিয়ে এই কথিকা।


কাব্য বিষয়ে আমার অনুরাগ যেমন অপরিমেয় কিছু নয়, বিরাগও তেমনই বিপুল পরিমাণে নয়। পদ্য বিষয়ে পড়াশোনার মানটাও সে কারণে মধ্যবর্ত, প্রবলতর কিছু নয়। এরকম অপ্রবলতর অবস্থানে থেকে কালিদাস বা তাঁর কাব্য নিয়ে আলোচনা করাটা একটু কঠিন কার্যই বটে। তারপরেও সাহস করলাম এই ভেবে যে, মুক্তমনার পাঠকেরা আমার কাব্য বিষয়ে কৃশ জ্ঞান সম্পর্কে সম্যকভাবে সুপরিচিত। ফলে, প্রত্যাশার কোনো পর্বতশিখরস্পর্শী পারদদণ্ড নিয়ে তাঁরা বসে থাকবেন না আমার জন্যে জনারণ্যে।


শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় আমার কাছে খুব লোভনীয় একজন লেখক। সে্টা শুধুমাত্র বাংলায় সবচেয়ে সফল গোয়েন্দা গল্প ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজ লেখার কারণে নয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, তিনি একগাদা অসাধারণ মানের ঐতিহাসিক উপন্যাসও লিখে গিয়েছেন। ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার দিক থেকে তাঁর মত উত্তুঙ্গ অবস্থানে আর কোনো বাঙালি লেখক এখন পর্যন্ত যেতে পারেন নি।


কালিদাসের জীবনী নিয়ে কল্পনাশ্রয়ী একটা উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি। শুরুতে এর নাম ছিল কবির নামেই। পরবর্তীতে তিনি এর প্রচ্ছদনাম পালটে করেন ‘কুমারসম্ভবের কবি’। বলা আবশ্যক যে, এই উপন্যাসটি আমার অসম্ভব আদরের। তবে, তার চেয়েও অধিক আদরণীয় হচ্ছে এর কাব্যধর্মী আবেশী আখ্যাটা।


সেকারণেই এই কবত্বপূর্ণ শিরোনামকেইই কুম্ভীলকবৃত্তি করে বেছে নিলাম আমার লেখার কণকমুকুট হিসাবে।


সতর্কীকরণঃ হস্তিকূলসর্দারসদৃশ সুবিস্তৃত সমাচার এটি। পাঠকদের দয়াপরবশ ধৈর্যশীলতার দাক্ষিণ্য নিদারুণভাবে কাম্য।


সংস্কৃত সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম কবিদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন কালিদাস। ব্যাস এবং বাল্মিকীর পরেই তাঁর স্থান। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে, এত বিশাল মাপের কবি হবার পরেও তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না আমরা। সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে অসংখ্য কবি রয়েছেন কালিদাস নামে। ফলে, এক লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়ে গিয়েছে আসল কালিদাসকে নিয়ে। কালিদাস তাঁর নিজের রচনাতেও নিজেকে অপ্রকাশিত রেখেছেন। অন্য লেখকদের লেখাতেও তিনি অনুপস্থিত। ফলে, তাঁর সম্পর্কে যা কিছু জানা সবই গৌণ উৎস থেকে উৎসারিত, অনুমান নির্ভর এবং বেশিরভাগই অসমর্থিত। এর সুযোগে তাঁকে নিয়ে অনেক ধরনের গালগল্পও গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে একটা হচ্ছে এরকম।


কান্তিময় পুরুষ ছিলেন কালিদাস। তবে ওই কান্তিটুকুই ছিল শুধু, ছিল না কোনো কার্যকর গুণ। মহামূর্খ এবং মহাগর্দভ ছিলেন তিনি। একদিন গাছের ডালে বসে সেই ডালকেই কুঠার দিয়ে কাটার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তাঁর এই গাধামি নজরে পড়ে কয়েকজন পণ্ডিত মন্ত্রীর। এই পণ্ডিতেরা রাজপকন্যার ঔদ্ধত্যে অতিষ্ট হয়ে ছিলেন। রাজকন্যা তাঁদের চেয়ে জ্ঞানে গরিমায় উচ্চ বলে প্রায়শই তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের শিকার হতেন তাঁরা। ফলে, রাজকন্যাকে শায়েস্তা করার ফন্দিফিকির নিয়ে ঘুরতেন তাঁরা সবসময়। কালিদাস তাঁদের জন্য অযাচিত সুযোগ হয়ে এলেন। রাজকন্যা তাঁর চেয়েও বিদ্বান কাউকে বিয়ে করার জন্য মনস্থির করেছিলেন। পণ্ডিতেরা কালিদাসকে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে রাজকন্যার সামনে এনে হাজির করলেন বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি হিসাবে। রাজকন্যা কালিদাসের পাণ্ডিত্যের পরীক্ষা নেবার জন্য তাঁকে কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। পণ্ডিতদের চাতুর্যে সবগুলো প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর দিয়ে দিলেন কালিদাস। মুগ্ধ রাজকন্যা বিয়ে করলেন কালিদাসকে। কিন্তু বিয়ের রাতেই কালিদাসের মূর্খতা প্রকাশিত হয়ে যায় রাজকন্যার কাছে। ফলে, তিনি রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করেন কালিদাসকে। অপমানিত কালিদাস আত্মহননের জন্য নদীর পাড়ে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখেন তিনি। মেয়েরা যে পাথরের উপরে কাপড় পরিষ্কার করে সেটি মসৃন। অন্যদিকে আশেপাশের পাথরগুলি সব রুক্ষ। এই দৃশ্য চাবুকের মত আঘাত হানে তাঁকে। কাপড়ের আঘাতে যদি পাথর ক্ষয়প্রাপ্ত হতে পারে, তবে তাঁর নির্বোধ ঘিলু কেন ধারালো ছুরির মত ঝকঝকে তকতকে হবে না কেন? নিজেকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্বান ব্যক্তিতে পরিণত করার শপথ নেন তিনি। এর জন্য শুরু করেন পড়াশোনা, ধ্যান এবং উপাসনা। সেই উপাসনা দেবী কালীর কাছে। অবশেষে একদিন তাঁর প্রচেষ্টা সফল হয়। দেবী কালীর বদান্যে বিদ্বান হবার সুবাদে তাঁর নাম হয়ে যায় কালিদাস।


কোনো কোনো পণ্ডিত দেখাতে চেয়েছেন যে তাঁর জীবৎকাল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক। আবার কেউ কেউ বলেছেন খ্রিস্টিয় প্রথম শতক। বলা হয়ে থাকে যে, তিনি সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজদরবারের নবরত্নের এক রত্ন ছিলেন। প্রাচীন ভারতে অনেক সম্রাটেরাই বিক্রমাদিত্য নাম নিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন ‘সম্ভাত যুগের’ প্রতিষ্ঠাতা। এই যুগ শুরু হয় খ্রিস্টিয় ছাপ্পান্ন সালে। এই ধারণা নিয়ে যারা এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন এম আর কেল (M. R. Kale) এবং সারদারঞ্জন রায়। কেল কুমারসম্ভবের এবং সারদারঞ্জন শকুন্তলার অনুবাদের ভূমিকায় কালিদাসকে এই সময়কার কবি হিসাবে চিহ্নিত করেন। এর মূল কারণ ছিল প্রাচীন ভারতের আরেক কবি অশ্বঘোষ। এই কবির সময়কাল সুস্পষ্টভাবে খ্রিস্টিয় প্রথম শতক। অশ্বঘোষের লিখিত কবিতার অনেক শ্লোক কালিদাসের শ্লোকের সাথে মিলে যায়। কালিদাসের মানের একজন মৌলিক কবি অশ্বঘোষের কবিতার চরণ নকল করেছেন এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। বরং তাঁর চেয়ে কম মেধাবী অশ্বঘোষেরই কালিদাসের নকল করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। কেল অশ্বঘোষ এবং কালিদাসের ভাষা এবং স্টাইলের সামঞ্জস্যও তুলে ধরেছেন, দুজনেই যে একই সময়ের বা খুব কাছাকাছি ব্যবধানের কবি তা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে।


অনেক আধুনিক পণ্ডিতই এই ধারণার সাথে একমত নন। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে কালিদাস গুপ্ত সাম্রাজ্যের কোনো এক সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় বিকশিত হয়েছেন। গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কাল ছিল ৩০০ থেকে ৬৫০ সাল পর্যন্ত। সংস্কৃত ভাষা এবং শিল্পের স্বর্ণ সময় এটি। ভিনসেন্ট স্মিথ তাঁর Early History of India গ্রন্থে দেখানোর চেষ্টা করেন যে, গুপ্ত বংশের তিন রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৫৭ -৪১৩), দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত (৪১৩ -৪৫৫) এবং স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫ – ৪৮০), এঁদের যে কোনো একজন বা একাধিক জনের সময়ে কালিদাস খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি বলেন যে, কালিদাসের প্রথম দিককার রচনা ঋতুসংহার এবং মেঘদূত রচিত হয়েছে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়ে। শেষের দিকের রচনাগুলো রচিত হয়েছে দ্বিতীয় কুমারগুপ্তের সময়ে। এই তিন সম্রাটের মধ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এবং দ্বিতীয় কুমারগুপ্ত দুজনেই বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়েছিলেন। কাজেই, এটা নিশ্চিত যে, বিক্রমাদিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাতেই কালিদাস বিকশিত হয়েছিলেন, তবে কোন বিক্রমাদিত্যে সেটা বলাটা একটু মুশকিলই।


গুপ্ত যুগ হচ্ছে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের যুগ। ভারতে তখনও বৌদ্ধ প্রভাব এবং বিদেশী সংস্রবের অবসান হয় নি যদিও। তবুও হিন্দু ধর্ম তখন সগৌরবে ফিরে আসছে। আর এই আবহটিই অনুভব করতে পারা যায় কালিদাসের কবিতার ছত্রে ছত্রে। অশ্বঘোষ ‘’বুদ্ধচরিত’’ লিখেছিলেন। তারপরেও উপমাস্থলে প্রায়শই হিন্দু দেব-দেবীর নাম করেছেন। কিন্তু, কালিদাস অনেক বেশি উল্লেখপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও কখনই কোনো বৌদ্ধ প্রসঙ্গ টানেন নি তিনি। তাঁর এই সচেতন প্রয়াসটিই তাঁকে গুপ্ত যুগের কবি হিসাবে দাঁড় করিয়ে দেয়। খ্রিস্ট পূর্ববর্তী সময়ে জন্মালে বুদ্ধকে বা বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করা তাঁর পক্ষে হয়তো সম্ভবপর হতো না।


খুব সম্ভবত মধ্য প্রদেশের মালবাতে তাঁর জন্ম। উজ্জয়িনী নগরীর প্রতি তাঁর বিপুল ভালবাসা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ গভীর বর্ণনা দেখে অনুমান করা যেতে পারে যে এই নগরীর বাসিন্দা ছিলেন তিনি । উজ্জয়িনীকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীনে নিয়েছিলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। অবশ্য কেউ কেউ তাঁকে কলিঙ্গের (বর্তমান উড়িষ্যা) বা হিমালয়ের কোনো অংশের লোক বলেও মনে করেন।


তাঁর রচনা থেকে বোঝা যায় যে, কাশ্মীর থেকে দক্ষিণসাগর পর্যন্ত ভারতভূমিকে জানতেন তিনি। হয় নিজে ভ্রমণ করেছেন ব্যাপকভাবে, অথবা কোনো পর্যটকের কাছ থেকে এই জ্ঞান পেয়েছেন তিনি। হিমালয়ের বিভিন্ন অংশের যে নিখুঁত বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তাতে করে তিনি হিমালয়ের ওই সব অংশ চাক্ষুস দেখেছেন বলেই প্রতীয়মান হয়।


আগেই উল্লেখ করেছি যে, কালিদাস নামে অনেক কবিই আছেন সংস্কৃতে। ফলে, কালিদাসের নিজস্ব রচনা কোনটি সেটা বোঝা একটু ঝামেলাসাধ্য কাজ। মাত্র সাতটি লেখাকে কালিদাসের নিজের বলে মনে করা হয়। এর মধ্যে কুমারসম্ভব, রঘুবংশ হচ্ছে মহাকাব্য, মালবিকা ও অগ্নিমিত্র, শকুন্তলা এবং বিক্রম ও উর্বশী হচ্ছে নাটক, আর মেঘদূত এবং ঋতুসংহার হচ্ছে খণ্ডকাব্য।


মেঘদূত লিরিক্যাল খণ্ডকাব্য। মন্দাক্রান্তা মাত্রায় লেখা এটি। প্রতিটি স্তবক বা শ্লোকে চারটি করে চরণ। ক্ষুদ্রাকৃতি এবং এই গঠনশৈলীর কারণেই পাঠক এবং অনুবাদকদের কাছে মেঘদূত অত্যন্ত জনপ্রিয়। পুরো কাব্যটি দুটি অংশে বিভক্ত, পূর্বমেঘ এবং উত্তর মেঘ। সংস্কৃত কাব্যের ইতিহাস বহু পুরোনো এবং বহু সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধ কাব্যের মধ্যেও মেঘদূত অনন্য, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতই দীপ্তিমান। মেঘদূতের বর্ণনা এতই জীবন্ত যে, কবির সাথে সাথে পাঠকও সমস্ত দৃশ্যাবলীকে নিজের চোখেই যেন দেখতে পায়। এই কাব্যের মূল চরিত্র দুটি। প্রকৃতি এবং প্রেম। এ দুটো আবার প্রায়শই মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে উর্বশীয় সৌন্দর্যে।


ঐশ্বর্যের দেবতা কুবের। হিমালয়ের অলকা নগরীতে তাঁর বাস। তাঁর ধনসম্পদ পাহারা দেয় যক্ষেরা। এরকমই এক যক্ষ তার দায়িত্বে অবহেলা করেছিল। কুবের যক্ষের উপর কুপিত হয়ে তাকে নির্বাসনদণ্ডে পাঠায় রামগীরিতে। যক্ষের প্রিয়তমা স্ত্রী থেকে যায় অলকা নগরীতে। রামগীরিতে দীর্ঘ আট মাসে প্রিয়া বিচ্ছেদে নিঃসঙ্গ যক্ষ যখন বিরহ ব্যথায় প্রবল কাতর, তখনই দেখতে পায় বর্ষার আগমনে পাহাড়চূড়ার উপরে হাতির মত বিশালাকায় উত্তরমুখী মেঘ জমে আকাশে। এই মেঘ যাবে হিমালয়ের দিকে, যাবে অলকা নগরীতে, এটা যক্ষ জানে। জানে বলেই প্রেমান্ধ যক্ষ মেঘকে দূত হিসাবে তার প্রিয়ার কাছে পাঠানোর জন্য মনস্থির করে। মেঘ যাতে এই কাজ করে সেজন্য মেঘকে চাটুবাক্য শোনায় যক্ষ। দেখায় নানান প্রলোভন। অলকা নগরীতে যাবার জন্য নিখুঁত পথনির্দেশ দেয় মেঘকে। অলকা নগরীতে যাবার পথে কিছুটা বাঁক নিয়ে তার প্রিয় নগর উজ্জয়িনী হয়ে যাবারও অনুরোধ জানায় সে মেঘকে। ছন্দময় গতিতে অনুকুল বাতাসে ভেসে মেঘ যাত্রা শুরু করে অলকা নগরীর দিকে। কাব্যের ছন্দে মেঘের সাথে সাথে পাঠকও ভেসে যেতে থেকে অলকা নগরীর দিকে। এই ছন্দময় গতিই মেঘদূতের প্রাণ। বুদ্ধদেব বসু মেঘদূতের অনুবাদ করেছিলেন। এই অনুবাদ গ্রন্থের শুরুতে তিনি ‘সংস্কৃত কবিতা ও মেঘদূত’ নামে একটা প্রবন্ধ জুড়ে দিয়েছেন। সেখানে তিনি মেঘদূতের এই ছন্দময় গতি সম্পর্কে লিখেছেনঃ


যে গুণে ‘মেঘদূত’ আমাদের আদ্যন্ত ধরে রাখে আমি তার নাম দিতে চাই গতি; কাব্যে উক্ত মেঘটিকে যে অনুকূল বায়ু ধীরে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে, তা আমাদের এই সুন্দর তরণীটিরও সহায়। মেঘ চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও চলেছি; কিন্তু মেঘ মাঝে মাঝে বিশ্রামের জন্য থামলেও কাব্যের তরী, ছন্দের ঢেউয়ে স্বনিত হতে হতে, হেলে দুলে এগিয়েই চলে। তার গতি অত্বর ও সমলয়সম্পন্ন, প্রথম থেকে সে জানে তার গন্তব্য কোথায়, সেখানে পৌঁছবার আগে অন্য কোথাও একবারও ঠেকে যায় না, আর পৌঁছনোমাত্র, দড়িদড়ার আর্তনাদ না তুলে, বিনম্রভাবে থেমে যায়। আমরা তার আরোহী হয়ে পথে পথে আলোচনার অবকাশ পাই, কিন্তু ক্লান্তি বা অন্যমনষ্কতা সম্ভব হয় না।


আগেই উল্লেখ করেছি যে, মেঘদূত মন্দাক্রান্তা ছন্দে লিখিত। মন্দাক্রান্তা ছন্দই এই কাব্যের প্রাণ। যেহেতু বর্ণনা প্রধান কবিতা এটি, সে কারণেই ছন্দ এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাঠককে শুধুমাত্র বর্ণনা দিয়ে ধরে রাখাটা কষ্টকর। ছন্দের আনন্দে তাকে ভাসিয়ে দিতে না পারলে পুরো কাব্যটাই ব্যর্থতার আবর্তে তলিয়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তা যায় নি। মেঘদূতের এই ছন্দময়তা নিয়ে বুদ্ধদেব বসু বলেনঃ


ছন্দের গম্ভীর আন্দোলন, হ্রস্ব ও দীর্ঘ স্বরের সুনিয়ন্ত্রিত কল্লোল, অনুপ্রাসের অপ্রকট সৌষম্য, দীর্ঘ সমাসের বিরলতা – এই লক্ষণগুলিতে ‘মেঘদূত’ হয়ে আছে আবৃত্তিযোগ্য, পুনরাবৃত্তিযোগ্য, উচ্চারণের পক্ষে পরম অনুকূল। এর প্রতিদ্বন্দ্বী অংশ ‘রঘুবংশে’ বা ‘কুমারসম্ভবে’ পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু কালিদাস অন্য কোথাও মন্দাক্রান্তা ব্যবহার করেননি, কিংবা অন্য কোনো সংস্কৃত কাব্য, শুধুমাত্র তার ধ্বনির দ্বারা, এমন আবেশের সৃষ্টি করতে পারে না। আমি জানি, ধ্বনি প্রকৃতপক্ষে অর্থের প্রতিধ্বনি হতে পারে না, আমাদের অজানা ভাষার কবিতায় ধ্বনিবিন্যাসে যত চাতুরী থাক তা থেকে কোনো সংবাদই নিতে পারবো না আমরা, এবং কাব্যের দিক থেকে নিছক শ্রবসুভগতার কোনো মূল্য নেই। কিন্তু ‘মেঘদূতে’ আরো বেশি পাওয়া যায়; ঢেউয়ের পর ঢেউ তার মন্দাক্রান্তা যখন আমাদের কান ও মনের উপর দিয়ে গড়িয়ে চলে, তখন আমরা ধীরে ধীরে আক্ষরিক অর্থে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ি – কবিতা আর মন্ত্র যখন অভিন্ন ছিল, যখন ডাইনি – পুরুতের অর্থহীন ও ছন্দোবদ্ধ প্রলাপই ছিল কবিতা – সেই অতি দূর অতীতের স্মৃতি অবচেতনায় হানা দেয় যেন১ ‘মেঘদূত’ অর্থহীন নয়, কিন্তু তার যে সব শ্লোক আমরা স্মরণীয় বলে স্বীকার করি, অনেক সময় তাদের অর্থ অতি সাধারণ – এমনকি তুচ্ছ। তুচ্ছকে গম্ভীরভাবে প্রকাশ করলে, ফল সাধারণত হাস্যজনক হয়; কিন্তু ‘মেঘদূতে’ উল্টোটা দেখতে পাই; সেখানে ধ্বনির গৌরবে তুচ্ছ হয়ে উঠে শ্লাঘনীয়।


মেঘদূতের কাব্যময় বর্ণনা এবং অপূর্ব ছন্দ নিয়ে রবীন্দ্রনাথও আপ্লুত ছিলেন। তিনি তাঁর ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে লিখেছিলেনঃ


রামগিরি হইতে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন ভারতবর্ষের যে দীর্ঘ এক খণ্ডের মধ্য দিয়া মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দে জীবনস্রোত প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে, সেখান হইতে কেবল বর্ষাকাল নহে, চিরকালের মতো আমরা নির্বাসিত হইয়াছি। সেই যেখানকার উপবনে কেতকীর বেড়া ছিল, এবং বর্ষার প্রাক্কালে গ্রামচৈত্যে গৃহবলিভুক্‌ পাখিরা নীড় আরম্ভ করিতে মহাব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছিল, এবং গ্রামের প্রান্তে জম্বুবনে ফল পাকিয়া মেঘের মতো কালো হইয়াছিল, সেই দশার্ণ কোথায় গেল! আর, সেই-যে অবন্তীতে গ্রামবৃদ্ধেরা উদয়ন এবং বাসবদত্তার গল্প বলিত, তাহারাই বা কোথায়! আর, সেই শিপ্রাতটবর্তিনী উজ্জয়িনী! অবশ্য তাহার বিপুলা শ্রী, বহুল ঐশ্বর্য ছিল, কিন্তু তাহার বিস্তারিত বিবরণে আমাদের স্মৃতি ভারাক্রান্ত নহে—আমরা কেবল সেইযে হর্ম্যবাতায়ন হইতে পুরবধূদিগের কেশসংস্কারধূপ উড়িয়া আসিতেছিল তাহারই একটু গন্ধ পাইতেছি, এবং অন্ধকার রাত্রে যখন ভবনশিখরের উপর পারাবতগুলি ঘুমাইয়া থাকিত তখন বিশাল জনপূর্ণ নগরীর পরিত্যক্ত পথ এবং প্রকাণ্ড সুষুপ্তি মনের মধ্যে অনুভব করিতেছি, এবং সেই রুদ্ধদ্বার সুপ্তসৌধ রাজধানীর নির্জন পথের অন্ধকার দিয়া কম্পিতহৃদয়ে ব্যাকুলচরণক্ষেপে যে অভিসারিণী চলিয়াছে তাহারই একটুখানি ছায়ার মতো দেখিতেছি, এবং ইচ্ছা করিতেছে তাহার পায়ের কাছে নিকষে কনকরেখার মতো যদি অমনি একটুখানি আলো করিতে পারা যায়।


এই আপ্লুতার কারণেই রবীন্দ্র-সাহিত্যে মেঘদূত প্রসঙ্গ পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মেঘদূত তাঁর শিল্পভাবনার অনুকূল বলেই কালিদাসের কবিকল্পনার প্রতি তাঁর পক্ষপাত প্রকাশিত। প্রভুশাপে রামগিরি পর্বতে যক্ষের নির্বাসন কালিদাসের কল্পনাপ্রতিভার পরিচায়ক হলেও, এই বানানো গল্প অবলম্বনে মানুষের বিরহভাবনার শাশ্বত দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। বিরহী মানুষও প্রকৃতির সৌন্দর্য আস্বাদন করে আনন্দ লাভ করে। তাই কালিদাস মেঘদূতের ‘পূর্বমেঘে’ মেঘকে যেন বিশ্বভ্রমণে নিযুক্ত করেছেন। বিরহ ঘনীভূত হলেও, মেঘের যাত্রাপথ তিনি সংক্ষিপ্ত করেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন :


‘আষাঢ়ের প্রথম দিনে অকস্মাৎ ঘন মেঘের ঘটা দেখিলে আমাদের মনে এক সৃষ্টিছাড়া বিরহ জাগিয়া ওঠে, মেঘদূত সেই অকারণ বিরহের অমূলক প্রলাপ। তা যদি না হইত, তবে বিরহী মেঘকে ছাড়িয়া বিদ্যুৎকে দূত পাঠাইত। তবে পূর্বমেঘ এত রহিয়া বসিয়া, এত ঘুরিয়া ফিরিয়া, এত যূথীবন প্রফুল্ল করিয়া, এত জনপদবধূর উৎক্ষিপ্ত দৃষ্টির কটাক্ষপাত লুটিয়া লইয়া চলিত না।


বিরহ এবং বর্ষা, এই দুটো বিষয় ভারতীয় কাব্যের অন্যতম দুটি প্রধান অংশ। এর মূখ্য কারণ অবশ্য মেঘদূত। যদিও এর উৎপত্তিস্থল আরো পুরোনো। বাল্মিকীই এই বিরহ এবং বর্ষার স্রষ্টা। তবে, বাল্মিকীর বিরহী রাম বর্ষা পেরিয়ে শরতে এসেও বেদনাবিধুর। শুধুমাত্র বর্ষার সাথে বিরহকে একত্রীভূত করার প্রথম একক কৃতিত্ব কালিদাসেরই। চণ্ডীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত, বর্ষার সাথে প্রেম ও বিরহের যোগসূত্র স্থাপিত হয়ে গিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সদ্য-আগত বর্ষার মধ্যেও তাই কালিদাসের মেঘকেই দেখেছেন : ‘কালিদাস উজ্জয়িনী প্রাসাদশিখর হইতে যে আষাঢ়ের মেঘ দেখিয়াছিলেন আমরাও সেই মেঘ দেখিতেছি’। তাঁর মতে,


মেঘদূত কাব্যে বর্ষার সমস্ত অন্তর্বেদনা চিরকালের ভাষায় মুদ্রিত হয়ে আছে। মেঘদূতের পূর্বমেঘ পৃথিবীর বিচিত্র সৌন্দর্য নিংড়ে নিয়ে প্রেমিকহৃদয় পূর্ণ করে তোলে, আর সেই পূর্ণতার পরিতৃপ্তি নিয়ে উত্তরমেঘ প্রেমিকহৃদয়ে প্রিয়তমার সান্নিধ্য লাভের আশ্বাস নিয়ে আসে। মেঘ আসিয়া বাহিরে যাত্রা করিবার জন্য আহ্বান করে, তাহাই পূর্বমেঘের গান; এবং যাত্রার অবসানে চিরমিলনের জন্য আশ্বাস দেয়, তাহাই উত্তরমেঘের সংবাদ।


মেঘদূতের প্রথম পাঠে বিভ্রম জাগতে পারে এই ভেবে যে, এটা বোধহয় যক্ষের বিরহগাথা। কিন্তু ,মেঘদূতে যক্ষের বিরহ আসলে একটা অছিলামাত্র। কালিদাসের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাঁর প্রিয় ভূদৃশ্য এবং ভূস্বর্গের চিত্র রচনা। পূর্বমেঘে তিনি যে সব নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, নগরালয় পার করাচ্ছেন মেঘকে, তারা সকলে অপূর্ব সৌন্দর্যমণ্ডিত। এই পার্থিব সৌন্দর্যের সর্বশেষ ধাপে অপেক্ষায় রয়েছে অলকা নামের এক অপরূপ রূপসী নগরী এবং সেই নগরীর বাসিন্দা এক অনিন্দ্যসুন্দরী তিলোত্তমা নারী, কবির মানস প্রতিমা। এই নারীকে উদঘাটনের জন্যই কবির এত সব আয়োজন, এত সব চলমান চিত্রকল্প তৈরির প্রচেষ্টা।


শুধু বর্ণনার উপর নির্ভর করে এমন অবিস্মরণীয় কাব্য বোধহয় পৃথিবীতে আর লেখা হয় নি। সে কারণেই আমরা যখন কাব্যটি একাধিকবার পাঠ করি, আমাদের বিভ্রম ক্রমশ কেটে যেতে থাকে এবং আমরা অনুধাবন করতে সক্ষম হই যে, মেঘদূত কাব্য যক্ষের বিরহকে কেন্দ্র করে লেখা হয় নি, বরং এখানে কবির মূল উদ্দেশ্য ছিল পারিপার্শ্বিক দৃশাবলীর দিকে।


বুদ্ধদেব বসুও যক্ষকে বিরহকাতর প্রেমিক হিসাবে গ্রহণ করতে নারাজ। তাঁর ধারণা মেঘদূত কাব্যে যক্ষের বিরহসূলভ অপ্রকৃতিস্থতার চেয়ে তাঁর বিচক্ষণ, সুবুদ্ধিসম্পন্ন সুচতুর হিসেবী মনের পরিচয়ই বেশি পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেনঃ


যক্ষ তার পত্নীবিরহে সত্যি কাতর হয়েছে, এ-বিষয়ে – কবি যা-ই বলুন – কাব্যের আরম্ভে আমরা ঠিক নিশ্চিত হ’তে পারি না। সে রোগা হয়ে গেছে, তার মাথার ঠিক নেই – এ-সবই তথ্য হিশেবে বলা হ’লো আমাদের – কিন্তু তার বাক্যে বা ব্যবহারে অপ্রকৃতিস্থতার নামগন্ধ পাই না, বরং পাই একটি বিচক্ষণ, সুবুদ্ধিসম্পন্ন, এমনকি প্রায় হিশেবি মনের পরিচয়, যে-মন কোনো প্রয়োজনীয় ছোটো তথ্য ভোলে না, তথ্যগুলিতে গাণিতিক যাথার্থ্য দিতে চায়, এবং যা শিষ্টাচার বিষয়ে অবহিত, আর কিসে নিজের সুবিধে হবে সে-বিষয়েও সর্বতা সচেতন। প্রেমিক বলতে আমরা যা বুঝি, রেনেসাঁস-পরবর্তী য়োরোপীয় সাহিত্য আর আমাদের বৈষ্ণব ও আধুনিকতার কাব্য থেকে এ-বিষয়ে যে- ধারণা আমাদের মনে নিবিষ্ট হয়ে আছে, তার সঙ্গে এই যক্ষের কিছুই মিল নেই; সে পদে-পদে যুক্তি ও প্রথা মেনে চলে, কাণ্ডজ্ঞান হারায় না, লজিকে ভুল করে না, ‘লাখ-লাখ যুগ হিয়ে হিয়ে রাখলুঁ তব হিয়ে জুড়ন না গেল’ – এ-রকম একটা অসম্ভব কথা তার পক্ষে বলা অসম্ভব। সে যে মেঘকে বার্তাবহ করে পাঠাতে চাইলো এতে আমরা দেখতে পাই তার কবিস্বভাব, কিন্তু কালিদাসের কাছে এটাই তার অপ্রকৃতিস্থতার লক্ষণ, তাই তিনি তখনই মন্তব্য করেন – ‘কামার্তা হি প্রকৃতিকৃপণাশ্চেতনাচেতনেষু’। এই জবাবদিহিটা কবির, আর সেইজন্যেই আমাদের কাছে গ্রাহ্য; – আরো বেশি। এই মন্তব্যের মধ্যে যক্ষের অবস্থার কারুণ্যের স্পর্শ পাওয়া গেলো। কিন্তু, আমরা সন্দেহ করি, এই মন্তব্য যক্ষ নিজেও করতে পারতো, কেননা আসলে সে কবির উক্ত বিহবলতা থেকে আশাতীতভাবে মুক্ত, তার কথা শুনে তাকে আমাদের মনে হয় – প্রেমিক নয়, রাজপারিষদ, উন্মাদ নয়, সংসারধর্মী। অর্থ ও কাম, এই দুই বর্গে সে সিদ্ধপুরুষ; মেঘের উদ্দেশ্যে যে –আবেদন সে উচ্চারণ করছে তাতে রোমিওশোভন প্রলাপের লেশ নেই, আছে চাটুবাক্য, নীতবাক্য, অনুনয়, প্রলোভন, বিবেচনা, আর পুঙ্খানুপুঙ্খ পথনির্দেশ।


যক্ষ কতখানি বিরহকাতর সে বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মত আমরাও নিশ্চিত না হলেও, এটা নিশ্চিত যে, যক্ষ তার প্রিয়ার সাথে মিলনের জন্য উন্মুখ হয়েছিল। দীর্ঘদিনের বিচ্ছেদ তাঁকে প্রেমিকা দর্শনের জন্য আকুল করেছিল। তবে, এই আকুলতা কোনো নিষ্কাম প্রেম নয়। যক্ষ একজন কামুক প্রেমিক। তার প্রেমের ধারণা শৃঙ্গারবাসনায় সীমাবদ্ধ। আটমাসব্যাপী স্ত্রীর সাথে সম্ভোগহীনতাই তাকে মূলত ব্যাকুল করে তুলেছে প্রিয়াদর্শনের জন্য। তার এই অবরুদ্ধ কামনা ছড়িয়ে আছে মেঘদূতের চরণে চরণে। নৈসর্গের বর্ণনার মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে সেই কামজ ইচ্ছার প্রতিফলন। পথে পথে প্রতিটি পর্বতচূড়ায় মেঘের জন্য বিশ্রামের আদেশ আছে। আর সেই পর্বতচূড়াগুলো যে যুবতী নারীর পীনোন্নত স্তনের প্রতিরূপ তা বলে দিতে ভুল করে নি যক্ষ।


প্রান্ত ছেয়ে আছে আম্রবনরাজি, ঝলকে দেয় তাতে পক্ক ফল,
বর্ণে চিক্বণ বেণীর মতো তুমি আরূঢ় হলে সেই শৃঙ্গে
দৃশ্য হবে যেন ধরার স্তনতট, অমরমিথুনের ভোগ্য,
গর্ভসূচনায় মধ্যে কালো আর প্রান্তে পাণ্ডুর ছড়ানো।


শুধু পর্বতচূড়ায় বিশ্রাম নয়, যাত্রাপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে রূপসী নারীর মত নদীগুলো। তাদের কারো ঢেউ রূপসী রমণীর ভ্রুভঙ্গির মত, কেউ তার ঘূর্ণিরূপ নাভি দেখাচ্ছে, কেউ বিরহে কৃশ, কারো বায়ু মিলনোন্মুখ প্রিয়ার চপলা, কারো বায়ুতে যুবতীর জলকেলীর সৌরভ ভেসে আসছে। আর এই সব নদীতে মেঘকে অবগাহন করে মিলন সুখ নিতে বলছে যক্ষ। মেঘ এখানে যক্ষেরই প্রতিভূ। নিসর্গের সাথে রতিসম্ভোগে মেঘ নয়, তৃপ্ত হচ্ছে যক্ষ নিজেই। প্রিয়ার চিন্তা, স্মৃতি সবকিছুই যক্ষের মনে যৌন চিত্রকল্প তৈরি করছে। আর সেই যৌন চিন্তা যথা পাত্র থেকে বঞ্চিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নিসর্গে।


কালিদাস একান্তই সৌন্দর্যসম্ভোগের কবি। মেঘদূতে সেই সম্ভোগেরই রূপ দেখি আমরা। শুধু কালিদাস একাই নন, তার সংস্কৃত কবিরাও এই ধরনের সম্ভোগে মত্ত। নারীদেহের বর্ণনায় তাঁরা সকলেই অক্লান্ত। কালিদাসের এই সৌন্দর্যসম্ভোগতার মধ্যেও ভোগ বৈরাগ্য খুঁজে পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি তাঁর ‘কুমারসম্ভব ও শকুন্তলা’ প্রবন্ধে বলেনঃ


কালিদাসের সৌন্দর্যচাঞ্চল্যের মাঝখানে ভোগবৈরাগ্য স্তব্ধ হইয়া আছে। মহাভারতকে যেমন একই কালে কর্ম ও বৈরাগ্যের কাব্য বলা যায়, তেমনি কালিদাসকেও একই কালে সৌন্দর্যভোগের এবং ভোগবিরতির কবি বলা যাইতে পারে। তাঁহার কাব্য সৌন্দর্যবিলাসেই শেষ হইয়া যায় না; তাহাকে অতিক্রম করিয়া তবে কবি ক্ষান্ত হইয়াছেন।


মেঘদূত পড়লেই সহজেই বোঝা যায় যে, পুরো কাব্যটিই লেখার আগে কালিদাস মনে মনে পরিকল্পনা করে নিয়েছিলেন। শুরু থেকেই তিনি জানতেন, কাব্যটিকে নিয়ে তিনি কোথায় যাচ্ছেন এবং কেন যাচ্ছেন এবং কোথায় এর শেষ পরিণতি টানবেন। এর বিষয়বস্তু কী হবে, বিস্তার কেমন হবে সবকিছুই যেন ছককাটা। সে কারণেই সংস্কৃত কবিতার বাহুল্য মেঘদূতে নেই। নিটোল এবং নিখুঁত ছিপছিপে মেদহীন শরীর এর। আতিশয্যকে অগ্রাহ্য করে সামগ্রিক পরিকল্পনাকে সুষমভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। সাধারণ শিক্ষিত পাঠক ব্যাকরণ না জেনেও একমাত্র এই কাব্যটিকেই উপভোগ করতে পারেন। ব্যাকরণের চাতুরী এখানে যে নেই, তা নয়, কিন্তু কাব্যগুণ তারচেয়েও বেশি বলে পাঠকের আগ্রহে কখনোই তা ভাটা পড়ে না। আকারে ছোটো হবার কারণে এক বসাতেই এটি শেষ করা যায় বা বার বার পড়তে ক্লান্তি আসে না। একটি শ্লোকের সাথে আরেকটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত শ্লোক যুক্ত হয়ে এক ধরনের ঘন এবং সম্পূর্ণ বিন্যাস তৈরি হয়েছে। এই ধরনের মিতাচার সে সময়ের সংস্কৃত কাব্যে বিরল। এই ঘন বিন্যাসের কারণেই বিষয়বস্তুতে সামান্য হয়েও মেঘদূত অসামান্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ


মেঘদূতের বিষয়াংশ সামান্য হলেও কালিদাসের সৌন্দর্যভাবনা ও সৃজনকৌশল বিরহের বৈশ্বিক ও চিরন্তন রূপটিকেই শিল্পসংহতি দিয়েছেন। প্রকৃত সাহিত্যে ‘বাজে কথা’র ব্যক্তিত্বচিহ্নিত বুনন কেজো কথার আবর্জনাকে আঁস্তাকুড়ে ঠেলে দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের আসরে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করে। সাহিত্যক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গই চিরস্থায়ী আভিজাত্যে প্রোজ্জ্বল-প্রদৃপ্ত।


কুমারসম্ভব এবং রঘুবংশে-র যেরকম ঐতিহাসিক পটভূমিকা রয়েছে, মেঘদূতে তা অনুপস্থিত। সম্পূর্ণ কবির কল্পনা থেকে তৈরি হয়েছে মেঘদূতের পটভূমিকা। প্রিয়ার সাথে বিচ্ছেদ এবং সেই বিচ্ছেদ বেদনা থেকে মেঘকে দূত বানিয়ে প্রিয়ার কাছে পাঠানোর ধারণা সম্পূর্ণ মৌলিক, অনন্য। আগের কোনো কাব্যের সাথে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো কোনো সমালোচক বলে থাকেন যে, মেঘদূত মূলত কালিদাসেরই আত্মজীবনী। বিক্রমাদিত্যের রাজদরবারে দায়িত্ব পালনের অবহেলার কারণে তাকে রাজদরবার থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল এবং নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছিল। যক্ষের একাকীত্ব আসলে কবিরই একাকীত্ব। তবে, এই তত্ত্বের পিছনে কোনো যুক্তিনিষ্ঠ তথ্য পাওয়া যায় নি। কালিদাস কোন উপলক্ষে মেঘদূত লিখেছিলেন। এর পিছনে ব্যক্তিগত কোনো বেদনা লুকিয়ে ছিল কি না, সেসব আমরা জানবো না কোনো দিন হয়তো। কিন্তু এটুকু আমরা জানি যে, এই কাব্যের কাহিনিসূত্রটি তাঁর নিজেরই উদ্ভাবিত। কোনো পুরাণ বা ইতিহাস থেকে আহরিত নয়। এ ধরনের মৌলিক কাব্য সংস্কৃতে বিরল। এই বিরল মৌলিকত্বের কারণেই মেঘদূতের কাহিনিসূত্র ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল পরবর্তী কবিদের উপরে। পবনদূত, হংসদূত এইসব নামে অসংখ্য কাব্য রচিত হয়েছিল।


কালিদাস শুধু সংস্কৃত সাহিত্যেই নয়, বিশ্বসাহিত্যেরও একজন সেরা কবি। তাঁর অসামান্য সৃষ্টিশীলতা, দুরন্ত মেধা, সীমাহীন কল্পনাবিলাস, ছন্দের উপর অসাধরণ দখল, কাব্য রাজ্যে তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ, তাঁর উন্নত সংস্কৃতি তাঁকে সবযুগের সেরা কবিদের সম্মুখসারিতে অবস্থান করে দিয়েছে।