লিখেছেনঃ মিলন আহমেদ

আমার মা। বাল্যকাল কাটিয়েছেন তাঁর বাবার বাড়িতে। সেই সংসারে তাঁর বাবা ছাড়াও ছিল তাঁর মা, ছিল ভাই-বোন। সেখানে সকল কর্তৃত্ব ছিল তাঁর বাবার। খেয়েছেন, পরেছেন বটে কিন্তু তা অবশিষ্টাংশ। মাছ হয়ত খেয়েছেন তবে মাছের মাথার স্বাদটা তিনি সেখান থেকে কোনদিন পাননি। ভাল মাছটা, ভাল মাংসটুকু খেয়েছেন তাঁর বাবা অথবা তাঁর ভাই। তারপর আমার মায়ের বিয়ে হল, এলেন আমার বাবার বাড়িতে। শুরু হল কলুর বলদের মত ঘানি টানা।  সংসারে হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম, কিন্তু কর্তৃত্ব তাঁর স্বামীর। চরম দারিদ্রতা। সিংহভাগ কষ্ট আমার মায়ের। বাসি, পচা, পান্তা ছিল তাঁর কপালের সাথে জোড়া লাগানো। ননদ-জায়ের অত্যাচারের সাথে ছিল অনাহার-অর্ধাহার। কাউকে বুঝতে দিতে চাননি তাঁর সীমাহীন কষ্টের কথা। দীর্ঘদিনের স্বামীর সংসারে ছিল দুঃখ-কষ্টের পাহাড়। মাছ-মাংস সব-সময় জুটতো না। যদি কখনও জুটতো তা তাঁর স্বামীকে অথবা ছেলেকে দিয়ে খাওয়াতেন। অবশিষ্টাংশ হয়ত কোনোদিন দু’একটু পেতেন, কিন্তু মাছের মাথা যে তাঁর পেটে কোনোদিন যায়নি সে কথা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। এরপর আমার বাবার মৃত্যু হল। আমার মা এখন থাকেন ছেলের সংসারে। তিনি এখন বাড়ির অতিরিক্ত মানুষ। তাঁর নিজের কোনো বাড়ী কখনও ছিল না এবং এখনও নেই। বাল্যকালে পিতার, যৌবনকালে স্বামীর এবং বৃদ্ধকালে সন্তানের উপর নির্ভরশীল। শুধু আমার মা নয়, এদেশের সকল মা-ই মানুষের মর্যাদা পায় না। কারণ সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার এ দেশে নেই। দেশটা চলছে মনুসংহীতা অনুযায়ী এবং তা টিকিয়ে রাখার এজেন্সি নিয়েছে ফজলুল হক আমিনীরা। আমিনীরা সবাই মনুর প্রেতাত্মা। মনু বলেছেন,

‘পিতা রক্ষতি কৌমারে, ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে।

রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা, ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমর্হতি।’

মনুসংহীতা অনুযায়ী নারীকে কুমারীকালে রক্ষা করবে পিতা, যৌবনে  রক্ষা করবে স্বামী এবং বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা। নারী কখনই স্বাধীন থাকার যোগ্য নয়। নারী অসম্পূর্ণ মানুষ, যার নিজের শক্তি নেই নিজেকে রক্ষা করার। তবে মজার বিষয় হল, মনুসংহীতা হিন্দু ধর্মের বিষয় হলেও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলো মনুর বক্তব্যকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে অনেক আগেই। আমার জানামতে, ভারতে Uniform family code জারির মাধ্যমে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা পিতার সম্পত্তিতে পুত্র-কন্যার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে অনেক আগেই। হিন্দুরা যখন মনুসংহীতাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিচ্ছে তখন আমাদের আমিনীরা তা রক্ষা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। আমার বিশ্বাস তারা সুযোগ পেলে নারীকে আবার চিতায় তুলবে। মাদ্রাসার ছাত্রদের এক হাতে কুরআন শরীফ আর এক হাতে লাঠি দিয়ে পাঠাচ্ছে যাও মনুসংহীতাকে রক্ষা কর। হরতালের নামে ভাংচুর কর। মানুষের জান-মালের ক্ষতি কর। কিসের রাষ্ট্র। কিসের গণতন্ত্র। ফতোয়ার রাজত্ব কায়েম কর। মহিলারা মানুষ না। মানুষ হলেও অর্ধেক মানুষ। সম্পত্তিতে তাদের কোনো অধিকার থাকবে না। পুরুষের সেবা করার জন্য তারা দুনিয়ায় এসেছে। নারী অশুভ, নারী দূষিত, নারী কামদানবী। গত ৪ এপ্রিল এভাবেই হরতালের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল আমিনী বাহিনী। হরতাল যদিও পালিত হয়নি কিন্তু তারা শত শত গাড়ী ভাংচুর করল। পুলিশের গাড়ীতে আগুন দিল। পুলিশকে মারধর করল, অস্ত্র লুট করল, ওয়াকিটকি লুট করল। যেখানে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার ক্ষমতায় এবং নির্বাচিত কোনো বিরোধী দল হরতাল ডাকেনী, সেখানে চললো তাণ্ডব। শিক্ষানীতি তারা মানবে না। মানবে কেন ? বিজ্ঞান শিক্ষায় শিক্ষিত হলে জাতি তো এগিয়ে যাবে। আর জাতি এগিয়ে গেলে, সচেতন হলে ধর্ম ব্যবসা চলবে না। তাদের কথা ফতোয়া চালু করতে হবে, আমরা র্দোরা মারবো। তাদের আরও কথা প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতি বাতিল করতে হবে। নারী উন্নয়ন নীতির ২৩.৫ নং এবং ২৫.২ নং ধারায় তাদের আপত্তি। দেখা যাক, সেখানে কি আছে। ধারা ২৩.৫ ঃ “সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশিদারিত্ব দেয়া।” এবং ধারা ২৫.২ ঃ “উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত স¤পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা।”

ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান একথা যেমন সত্যি, তেমনি আজকের বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়ন ছাড়া জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নহে এ কথাও ধ্রুববসত্য। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে সেইদেশ তত উন্নত যেদেশের নারী বেশি ক্ষমতায়িত। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার জনগণের কাছে অগ্রগতির প্রতিশ্র“তি দিয়ে ম্যাণ্ডেড নিয়েছে। ছোট্ট একটু দেশে ১৭ কোটি মানুষ। কাজেই হাজারও সমস্যায় জর্জরিত এই দেশকে একটি সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে অবশ্যই নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করতে হবে সবার আগে। নারীর উন্নয়নের অর্থ দেশের উন্নয়ন। সমাজের উন্নয়ন। দেশের প্রতিটি মানুষের উন্নয়ন। ধর্মের নামে দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে নিচে চাপা দিয়ে রেখে জাতীয় উন্নয়নের শ্লোগান হাস্যকর এবং স্ব-বিরোধী। ধর্ম ব্যবসায়ীদের মুখে কত কথাই না আমরা শুনেছি। কত হাজার বার যে শুনেছি ‘ইসলামে নারী নেতৃত্ব হারাম’। আমিনী সাহেবের কাছে প্রশ্ন করতে চাই বেগম খালেদা জিয়ার সাথে জোট করা হারাম কি না। ইসলামে কত কিছু হারাম ছিল বলে মৌলভী সাহেবরা বক্তৃতা বিবৃতি দিয়েছেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। একসময় তারা বলত ইংরেজী পড়া হারাম। নবাব আব্দুল লতিফ ১৮৭০ সালে উত্তর প্রদেশ থেকে মাওলানা কেরামত আলীকে এনে গড়ের মাঠে বক্তৃতা করিয়েছিলেন ইংরেজীকে হালাল করার জন্য। এখন দেখি ধর্ম ব্যবসায়ীরাও ইংরেজীতে কথা বলে এবং তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে ইংরেজী মাধ্যমে পড়ায়। এক সময় ছবি তোলা হারাম ছিল। এখন তারা ঠিকই টেলিভিশনে নুরানী চেহারা দেখায়।

এই দেশটি ধর্ম-নিরপেক্ষ চেতনা নিয়েই স্বাধীন হয়েছে। একমাত্র স্বাধীনতা বিরোধীরাই নারী অধিকারের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারে। প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী কোনো সময়ই জাতীয় অগ্রগতি মেনে নেয় না। আমি আতংকগ্রস্থ, আমার মনে হচ্ছে একটি অশুভ রাজনীতি আমাদের গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। বিরোধী দল অবশ্যই সুস্থ ধারায় সরকারের বিরোধীতা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, কারণ প্রকাশ্য বক্তৃতায় শুনতে পাচ্ছি, ‘পিতার যে পরিণতি, কন্যারও তা হবে।’ তার মানে তারা বলছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ঠিক ছিল এবং শেখ হাসিনাকেও হত্যা করা হবে। দেশের এই পরিস্থিতি সরকারকে  অত্যন্ত শক্তহাতে মোকাবেলা করতে হবে। পাশাপাশি কয়েক ডজন নারীবাদী ও মানবতাবাদী সংগঠনকে আঙ্গুল চুষলে হবে না। এছাড়া সকল প্রগতিশীল এবং বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মায়েরা যেভাবে সম্পত্তিহীন এবং অসহায় জীবন পার করেছেন, সারা জীবনে মাছের মাথার স্বাদটা পাননি, আমাদের মেয়েদের যেন তা না করতে হয়।

লেখকঃ নারীবাদী কলামিস্ট, ঈশ্বরদী, বাংলাদেশ।

ই-মেইল- [email protected]