লিখেছেনঃ কফিল কাঙ্গাল

এক সময়ে আমেরিকার শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নিগৃহীত, শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা নির্যাতিত ও কালো বানর বলে খ্যাত নিগ্রো পরিবারে জন্মগ্রহণকারী বিখ্যাত সাহিত্যিক রিচার্ড রাইটের একটি উক্তি দিয়ে শুরু করছি “দিনের আলোয় ওরা অন্ধকারের সাক্ষাৎ পায় এবং ভর দুপুরে হাতড়ে বেড়ায় যেন গভীর রাত।”

জাতি হিসেবে আমরা ধার্মিক এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে সন্দেহ করার সাহস এ পৃথিবীতে কারো থাকে তো বলুক, মাথাটা ফাটিয়ে দিতে কোনোরূপ কার্পণ্য করবে না এ জাতি! আমরা নিঃসন্দেহে ধার্মিক কিন্তু নৈতিকতা, মানবতার দিকে থেকে আমরা কি মানুষের সংজ্ঞার মধ্যে এখনো আছি? মান+হুশ, অর্থ নাকি- মানুষ! এই মান এবং হুশ এর একটিও কি আমাদের এ জাতির অবশিষ্ট আছে? অর্থ-প্রতিপত্তির নেশায় আমাদের মান ও হুশ কবেই বিলীন হয়ে গেছে জাতি কি তার কোনো খোঁজ রেখেছে? মান এবং হুশ না-ই থাক, আমরা ধার্মিক এতে একবিন্দু পরিমাণ সন্দেহ নেই!

এখানে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ সাহেবের লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া হলো- “…শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের আগাছা বেশি। ভোর বেলায় এতো মক্তবে আর্তনাদ ওঠে যে, মনে হয় এটা খোদাতাল্লার বিশেষ দেশ।” “…ন্যাংটা ছেলেও আমসিপারা পড়ে, গলা ফাঁটিয়ে মৌলবীর বয়স্ক গলাকে ডুবিয়ে সমস্বরে চেঁচিয়ে পড়ে। গোফ উঠতে না উঠতেই কুরান হেফজ করা সারা। সঙ্গে সঙ্গে মুখেও কেমন একটা ভাব জাগে। হাফেজ তারা। বেহেস্তে তাদের নির্দিষ্ট স্থান।” (মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)।

ধর্ম সম্পর্কে আলডাস হাক্সলি কি বলেছেন তাই দেখি। তিনি বলেছেন, “…দেবত্বারোপিত জাতি আয়তন, শক্তি এবং রহস্যময় মর্যাদার দিক দিয়ে স্বর্গীয় কিন্তু নৈতিক চরিত্রের দিক থেকে পশু প্রকৃতির। …রহস্যজনকভাবে সে যে ঐশ্বরিক রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ সেই রাষ্ট্রের তর্জন-গর্জন ও প্রবঞ্চনা এবং হাম্বি-তাম্বি ও ভীতিপ্রদর্শন তার প্রচ্ছন্ন ইতর প্রকৃতির জন্যে অতিশয় তৃপ্তিকর। …মানুষ গর্ব ও ঘৃণাবোধ করার উপলক্ষ্য খোঁজে- লোক পরম্পরার মাধ্যমে হলেও দুষ্কৃতিজাত পুলক শিহরণ পেতে চায়।”

অন্যদিকে জাতি হিসেবে আমরা লোভ আর লাভের নেশাসক্ত এতেও কোনো সন্দেহ নেই। কোনো কিছুতেই আমরা হারতে চাই না। কি ব্যবসা, কি ধর্ম, কি অধর্ম…! সবকিছুতেই চাই কেবলই লাভ। উন্নত বিশ্বের ব্যবসা-বাণিজ্যে লাভ-লোকশান আছে কিন্তু আমাদের দেশে তা নেই। এখানে ব্যবসা মানেই লাভ। শুধু লাভ নয় অতি লাভ! লোকশান দিতে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা রাজি নয় এবং অল্প লাভেও খুশি নয়! অতিরিক্ত লাভ ও লোভ আমাদের জাতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তা আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি? আন্তর্জাতিক বাজারে একবার কোনো জিনিষের দাম বাড়লেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা তাৎক্ষণিকভাবে তার দাম আকাশে তুলে দিতে কালবিলম্ব করে না। অথচ কমলে তারা সহজে কমায় না। যেমন বর্তমানে গমের দামের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। রাশিয়ার গম রফতানী বন্ধ করার কথা শুনেই এখানে আটার দাম দ্বিগুণ করে ফেলেছে ব্যবসায়ীরা অথচ তাদের গোদামে তো পূর্বের কেনা গমই আমাদের খাওয়াচ্ছে। এতে এসব ব্যবসায়ীরা কি পরিমাণ টাকা লুটে নিচ্ছে তা কি কেউ হিসেব করে দেখেছেন? তাই আমি মনে করি, ধর্ম এখন আর লাভ ও লোভের কোনোটির বিরুদ্ধেই কার্যকর নয়! যদি তাই হতো তাহলে আমরা দুর্নীতিবাজ জাতি হিসেবে বিখ্যাত হতে পারতাম না! আমাদের ধারণা এরকম যে, ধর্ম রক্ষা করেই তো আমরা লোভ আর লাভের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি তাতে পাপ বা অন্যায় কিসের?

অন্যদিকে গর্ব ও ঘৃণাবোধ এ দু’টো প্রতিটি ধর্মের মধ্যে অত্যন্ত প্রকট। শুধু প্রকট বললেও ভুল হবে, এ দু’টো ছাড়া যেন ধর্ম টিকে থাকতে পারে না! ধর্মীয় গর্ব এবং ঘৃণাবোধ থেকেই তথাকথিত ধর্মযুদ্ধ, ধর্ম রক্ষার নামে প্রতিনিয়ত রক্তপাত, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ… ইত্যাদি ঘটেই চলছে। ধর্ম সম্পর্কিত কোনো সমালোচনা কেউ করতে চায় না, তা যতোবড় মিথ্যা এবং কুসংস্কারপূর্ণ হোক না কেন। এমনকি বুদ্ধিজীবি, সাংবাদিক, টিভি, রেডিও ইত্যাদির লোকজনও এসব সত্য কথা এড়িয়ে যায়।

একটি শিশু যখন তার মাকে প্রশ্ন করে মা আমি এলাম কোথা থেকে? মা তখন বিব্রত হন। মানুষের বাচ্চা কিভাবে জন্ম নেয় তা তো আর বলা যায় না। আবার কিছু না বললে মুরুব্বিয়ানাও থাকে না, তাই হয়তো তিনি বলেন- তোকে কুড়িয়ে পেয়েছি, তোর বাবা তোকে রাস্তায় পড়ে পেয়েছে অথবা ভগবান দিয়েছে… ইত্যাদি। ঠিক এই প্রশ্নটি যদি আমরা করি যে- ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহ… এসব সৃষ্টিকর্তাদের আমরা পেলাম কিভাবে? একটু চিন্তা করলেই এর উত্তর পাওয়া অতি সহজ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত সৃষ্টির যদি একজন (ধর্মানুসারে বহুজন) স্রষ্টা থাকে তবে সেই স্রষ্টাকে সৃষ্টি করলো কে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পূর্বে এই স্রষ্টা ছিলো কোথায়? কারণ ধর্মানুসারে- ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। পক্ষান্তরে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিকদের মতানুসারে- স্থান, কাল ও শক্তি এসবও অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। আবার “…ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন কোন এক সময়ে। কিন্তু ‘সময়’কে সৃষ্টি করেছেন কোন সময়ে, এর কোন হদিস পাওয়া যায় না। …সৃষ্টির পূর্বে যে ‘কাল’ ছিল না, তা কল্পনা করা যায় না। …কাল অনাদি। …ধর্মানুসারে মহাপ্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হবার পর- কাল আর থাকবে না, তাও কল্পনার বাইরে। সুতারং বলতে হয়, কাল অনন্ত।” তদ্রুপ শক্তিও অনন্ত। কারণ জগতে এমন কোনো বস্তু নাই যার মধ্যে কোনরূপ শক্তি নাই। “…মূল কথা এ জগৎটিই শক্তির লীলাখেলা। অর্থাৎ শক্তি জগৎময় এবং জগৎ শক্তিময়। ঈশ্বর, স্থান, কাল ও শক্তি সকলেই অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। এখন প্রশ্ন হলো যে, স্থান, কাল ও শক্তি এগুলো কি সৃষ্ট না অসৃষ্ট। …অর্থাৎ ঈশ্বর কি এদের সৃষ্টি করেছেন, না অনাদিকাল হতে এরা স্বভাবতই বিদ্যমান আছে? যদি বলা হয় যে, এরা স্বভাবতই বিদ্যমান আছে, তাহলে এরা ঈশ্বরের সৃষ্টি নহে; এবং যদি বলা হয় যে, এরা ঈশ্বরের সৃষ্টি- তবে পরমেশ্বর ‘স্থান’কে সৃষ্টি করলে কোন স্থানে বসে, ‘কাল’কে সৃষ্টি করলেন কোন কালে এবং ‘শক্তি’কে সৃষ্টি করলেন কোন শক্তি দ্বারা?” অতএব প্রশ্ন জাগে- মানুষকে ঈশ্বর সৃষ্টি করেছে, নাকি মানুষই ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লাহকে… সৃষ্টি করেছে?

যাহোক, একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, আমরা সবাই ধার্মিক এবং ধর্মাসক্ত; তাই ধর্মভীরু জাতি বলে আমাদের সুখ্যাতি আছে, গর্ব আছে। কিন্তু তা হৃদয়ে, নাকি বাহ্যিক সেটাই দেখার বিষয়! এমন ক’টি দেশ আছে, যারা আমাদের ন্যায় ধর্মভীরু? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা আমাদের ন্যায় ধর্মরক্ষক? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা আমাদের ন্যায় প্রতিটি কথায় কথায় ধর্মাশ্রয়ী? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা ধর্ম রক্ষায় জিহাদ ঘোষণা করে রেখেছে? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা ধর্মের গায়ে সামান্য টোকা লাগতে দেয় না? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা নিজ নিজ ধর্মের জন্য অকাতরে আত্মাহুতি দিতে সদা প্রস্তুত? এমন ক’টি জাতি আছে, যারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ হাতে ধর্মরক্ষায় সদাজাগ্রত নয়…? অথচ আমরাই বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দুর্নীতিবাজের সার্টিফিকেটধারী! আবার আমাদেরকেই ধর্ম পালন করতে হয় পুশিলী প্রহারায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে! ধর্ম পালনে যদি পুলিশী নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় তাহলে সেইসব ধর্মের কৃতিত্ব কি? আমরাই ধর্মানুষ্ঠানকে সামনে রেখে সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের মূল্য বৃদ্ধি করে দেই, যা স্বয়ং ভগবানও থামাতে পারে না! প্রকৃত মানুষ হতে হলে, মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ থাকতে হয়, কিন্তু ধার্মিক হতে এর কোনোই প্রয়োজন নেই! ধর্মকর্ম ঠিকভাবে করলেই মানুষ তাকে ধার্মিক বলে আখ্যা দেয়, কিন্তু সম্পূর্ণরূপে মানবতাবোধ থাকা এবং মানবতাকে মেনে চলা সত্ত্বেও মানুষ তাকে কখনোই ধর্মিক বলে না, শ্রদ্ধা করে না…! শ্রদ্ধা করে, সম্মান করে ওইসব ধার্মিকদের যারা এভাবে নিজ গৃহ থেকে শুরু করে সমাজের নানারূপ অত্যাচার, লুণ্ঠন, স্বার্থপরতা, দুর্নীতি… করে এবং একই সঙ্গে ধর্মকর্মও ঠিকভাবে পালন করে! সমাজের মানুষ ধর্মিকতা এবং মানবতার মধ্যে পার্থক্য জানে না, জানে ধার্মিক হলেই খাঁটি মানুষ হয়, অন্যথায় খাঁটি মানুষ হওয়া যায় না! অন্যদিকে ধর্মজীবিরা ধর্ম সম্পর্কে কেউ সামান্য সমালোচনা করলে তাকে খুন করার জন্য ফতোয়া দিয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কিন্তু এই যে এতো দুর্নীতি হচ্ছে এর বিরুদ্ধে একদিনও রাস্তায় নামেনি এবং এর বিরুদ্ধে একটি ফতোয়াও জারি করেনি!

আলডাস হাক্সলি বলেছেন- “…যীশু খ্রীস্ট থেকে কার্লমার্কস অবধি …শান্তি, ন্যায় ও সৌভ্রাতৃত্বপূর্ণ এমন এক স্বর্ণালী যুগের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে যুগে ‘জাতিতে জাতিতে থাকবে না কোন বিরোধ’। প্রতিটি জাতির অবাধ উন্নয়নের মাধ্যমে নির্বিঘ্নে উন্নয়ন ঘটবে নিখিল মানব জাতির। …সমুদ্র জুড়ে যেমন থাকে কেবল জল, তেমনই বিশ্ব জুড়ে থাকবে কেবল এক ঐশ্বী জ্ঞান। …এরূপ লক্ষ্য সম্পর্কে মতৈক্য থাকলেও লক্ষ্যে পৌঁছার পথ সম্পর্কে নানা মুনির নানা মত। এক্ষেত্রে মতৈক্য ও নিশ্চয়তার পরিবর্তে দেখা যায় গোঁড়ামির সঙ্গে লালিত ও অন্ধ জবরদস্তির সঙ্গে অনুষ্ঠিত পরস্পরবিরোধী মতামতের সংঘাতময় এক চরম বিশৃংখল অবস্থা।” আলডাস হাক্সলি যদিও মানব জাতির সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে এক কথাগুলো বলেছিলেন তথাপিও একথাগুলো বিভিন্ন ধর্মের বেলাতেও সমভাবে প্রযোজ্য।

সম্ভবত গত আগষ্ট ২০১০ সনের প্রথম সপ্তাহে দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত “সংবিধানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রাখাই জরুরি” শিরোনামে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুলউলায়ী সাহেবের লেখাটি পড়ে আমার এ লেখার অবতারণা। আমি অতি অল্প শিক্ষিত, জীবনে লেখাপড়ার সুযোগ বঞ্চিত অতি সাধারণ এক মানুষ। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের লেখার সমালোচনা করা অত্যন্ত অন্যায়। তবে আমার বিশ্বাসপ্রসূত এবং বিভিন্ন দার্শনিকদের উদ্ধৃতি দিয়ে এ লেখা কাউকে আঘাত করার জন্য নয়। আমাদের সমাজে ‘ধর্মানুভূতি’ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। ধর্মানুভূতি হলো একধরনের সুবিধাবাদ। ধর্ম সম্পর্কে কেউ সামান্য প্রশ্ন উত্থাপন করলেই মানুষ চিৎকার শুরু করে যে তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে, ধরো তাকে, মারো তাকে, খুন করে ফেলাও, তাতে খুনির বেহেস্ত বা স্বর্গ নিশ্চিত…! ধর্ম নিজেই এর সৃষ্টিলগ্ন থেকে এ ফতোয়া জারি করে রেখেছে। এই যে ধর্মানুভূতি এটি আমরা যেরূপ নিজের ধর্মের বেলায় মনে করি, অন্যের ধর্মের বেলায় সেরূপ মনে করি কি? মোটেও নয়। তা কেন? আজ যদি উল্লেখিত বিষয়টি জরুরি হয় তাহলে এদেশের নব্বইভাগ মানুষের মনপুত হবে বৈকি, কিন্তু বাকি সব ধর্মালম্বীদের যে মনপুত হবে না এটা নিশ্চিত। বাকি সব ধর্মালম্বীরা অহেতুক মনোকষ্ট পাবে এবং এতে তাদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে যে, রাষ্ট্র এটি করে তাদের ধর্মকে ছোট করেছে, হেয় করেছে। এটি করা কোনো রাষ্ট্রের উচিত নয়। যেমন করেনি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো। এতে কি তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে গেছে? তারা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছে এমনকি রাষ্ট্রের কোনো সম্পদ, টাকা-পয়সাও ধর্মীয় কাজে ব্যয় করা সেখানে নিষিদ্ধ। কিন্তু আমাদের দেশে এটিকে সংবিধানে না রাখলেও রাষ্ট্রের সম্পদ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাবেই। তাছাড়া, যে দেশ সর্বদাই অঘোষিত ধর্মরাষ্ট্র, সে দেশে ঘোষণা দেয়া বা এটিকে সংবিধানে যুক্ত রাখা জরুরি কেন? আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও অগাধ আস্থা আমাদের জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে এবং তা কখনোই কমেছে বলে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমার গ্রামে যেখানে একটি মাত্র মুসলিম পাড়া ছিলো এবং একটিমাত্র মসজিদ ছিলো। সেখানে আজ অন্তত দশটি মুসলিম পাড়া এবং বিশটি মসজিদ, তাহলে কি করে বলি আল্লাহর উপর বিশ্বাস ও আস্থা আমাদের কমেছে এবং তা বাড়ানোর জন্য তা সংবিধানে সংযুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি? এর পূর্বেও তা সংযুক্ত ছিলো এবং এখন পর্যন্ত আছে তাতে কি জাতি দুর্নীতিমুক্ত হয়ে গেছে? অতএব, এটি অবশ্যই কোনো জরুরি বিষয় নয়! জরুরি বিষয় হলো- এদেশের মানুষের লোভ নামক জিনটাকে উৎপাটন করা! লোভ জিনের সংখ্যা দিন দিন আমাদের মধ্যে বেড়েই চলেছে, এদের দাপটে আমরা এখন উম্মাদ তাই আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রেখেই আমরা দুর্নীতিতে বারংবার চ্যাম্পিয়ান হয়েই চলেছি!

তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেছেন- “মহান আল্লাহ সবার সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা। তিনি মুসলিম, অমুসলিম, ধার্মিক, অধার্মিক সবারই রিজিকদাতা, রক্ষাকর্তা। একথা মোটামুটি সব ধর্মের লোকই বিশ্বাস করে বা মেনে চলে। মুসলমানরা যে মহান সত্তাকে আল্লাহ বলে সম্বোধন করে, অন্য ধর্মের লোকরা সেই একই সত্তাকে ভগবান, ঈশ্বর, গড ইত্যাদি বলে থাকেন।” আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে ওনার এ বক্তব্যে দ্বিমত পোষণ করছি। কারণ আল্লাহ, ঈশ্বর, ভগবান, গড… এক হলে ধর্মও এক হতো, কিন্তু তা তো নয়। কারণ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের ধর্মের প্রথা, রীতিনীতি সর্বোপরি বিশ্বাস একই রকমের নয় (যদিও একটি থেকে অন্যটির বহুকিছুই নকল করা হয়েছে), তাই ধর্মাবতারগণ সৃষ্টিকর্তাদেরকেও (যদি থাকেন) বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে নিজ নিজ কল্পনায় সাজিয়েছে নিজ নিজ চিন্তাধারা অনুসারে। অতএব যিহোবা, ঈশ্বর, ভগবান, গড, আল্লাহ… এরা কখনোই এক সত্ত্বা হতে পারে না। এক সত্ত্বা হলে একই ধর্মে অসুবিধা ছিলো কি? আল্লা, হরি, ভগবান, ঈশ্বর, গড, হিযোবা… ইত্যাদি যতগুলো সৃষ্টিকর্তা আমরা মানুষেরা সৃষ্টি করেছি এরা প্রত্যেকেই একেকজন রাজার ন্যায় সিংহাসনে বসে তাদের নিজ নিজ মন্ত্রী (স্বর্গদূত বা ফেরেস্তা) দ্বারা রাজ্য পরিচালনা করছে! আবার প্রতিটি ধর্মের নিজস্ব রীতিনীতি রয়েছে এবং অন্য ধর্মকে ছোট ভাবা, নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞান করার শিক্ষা দেওয়ার মধ্যমেই এর প্রমাণ মেলে। এমনকি একই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন গোষ্ঠিগুলোও অন্য গোষ্ঠি হতে নিজ গোষ্ঠিকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শিখাচ্ছে। তারা এ নিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। জানি না, পৃথবীর ধর্মজীবিরা যেভাবে বিবাদ করে, সেভাবে মাঝে মধ্যে সৃষ্টিকর্তারাও বিবাদ করে কি-না? প্রকৃতপক্ষে কোনো ধর্মই অন্য ধর্মকে সহ্য করতে চায় না, স্বীকৃতি দিতে যায় না বরং সব সময় গোপনে, মাঝে-মধ্যে প্রকাশ্যেও তীব্র সমালোচনা করে। ধর্মগুলোর মধ্যে কোনো সহনশীলতা নেই। আমরা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এবং রাষ্ট্রের শৃংখলা রাক্ষার্থেই কেবল বিভিন্ন ধর্মালম্বীরা গোজামিল দিয়ে মিলেমিশে থাকি। সত্য যে, এক ধর্ম অন্য ধর্মকে প্রচুর সন্দেহের চোখেই দেখে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাদ দিলে, মনুষ্য সৃষ্ট যেসব যুদ্ধ-বিবাদে আজ পর্যন্ত পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি রক্তপাত ঘটেছে এবং এখনও ঘটে চলছে তা হলো, ধর্মযুদ্ধ, যা প্রায় প্রতিটি ধর্মেই স্বীকৃত এবং গর্বের বিষয়! সৃষ্টিকর্তারা যদি স্বর্গে মিলেমিশেই থাকেন তাহলে পৃথিবীতে তাদের অনুসারীরা কেন মিলেমিশে থাকতে পারে না? আমাদের দেশে রাস্তাঘাটে, লঞ্চে, বাসে, অফিসে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোথায় না ধর্মের পেস্টার, ধর্মের স্লোগান নেই? এমন কোনো টিভি, রেডিও, এমন কোনো সংবাপত্র নেই যেখানে নিয়মিতভাবে ধর্মের বাণী প্রচারিত হচ্ছে না! এমনকি কতোগুলি টিভি, রেডিও, সংবাদপত্র আছে যা কেবলমাত্র ধর্মীয় বাণী প্রচারেই ব্যবহৃত হচ্ছে, ধর্ম প্রচারই তাদের একমাত্র কাজ। তাছাড়াও এ দেশের এমন একটি স্থান ফাঁকা দেখাতে পারবেন না যেখানে ধর্মীয় সাধুজন এবং ধর্মীয় বাণী লেখা নেই! ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে গিজগিজ করছে এদেশ। তারপরও সংবিধানে ধর্মের বাণী না রাখলে চলবে না এমনটা ভাববার কারণ আমার বোধগম্য নয়; তবে হলফ করে বলা যায় যে, এতে জাতির একবিন্দুও উন্নতি হবে না। হতে পারে না, কারণ ধর্ম মানুষকে ধার্মিক করলেও মানুষ করতে পারে না! মাত্র ক’মাস পূর্বে ঢাকার এক গলির মুখে একটি নতুন ইলেট্রিক খুঁটি পোতা হলে, কেউ একজন সেটাতে আর্টিস্ট দিয়ে সুন্দর রং করে একপাশে লিখে রেখেছে- “আসুন আমরা নামাজ আদায় করি।” অন্যপাশে লিখেছে- “সত্য বলি, মিথ্যা বলি-যাকাত প্রদান করি।” ঠিক এই হলো আমাদের ধর্ম- সত্য-মিথ্যা যাই বলি না কেন, ওতে পাপ নেই, লজ্জা নেই, অন্যায় নেই, যাকাত তো ঠিকমতো দেই, ধর্মের বিধান তো মানি…!

ভগবান, ঈশ্বর, গড, আল্লা… ওনারা যে এক নয় তার প্রমাণ বহু ধর্মীজীবিদের ব্যাখ্যায় সব সময়ই পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া ওনারা এক হলে কেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হলো এবং সাম্প্রদায়িকতার শিকার হলো। সারা ভারত জুড়েই লক্ষ লক্ষ মানুষের লাশ! কেন পুরো ট্রেন ভর্তি লাশগুলো পঁচেছিলো? আমাদের একটি বড় সমস্যা হলো ধর্ম পুস্তক আমরা মনের ভুলেও কখনো পড়ি না এবং বিশেষভাবে ধর্মের মধ্যেকার বিভ্রান্তিকর ও কুসংস্কারগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলি না। কারণ এসব আমাদের নিজ নিজ ধর্মপ্রবর্তকগণ সম্পূর্ণরূপে নিষেধ করে দিয়েছে। বিভ্রান্তিকর ধর্মীয় বাণীগুলোর ব্যাপারে বলা হয়েছে, এগুলো তোমরা সাধারণেরা বুঝবে না এতে বিশেষজ্ঞ হতে হবে। আবার বলা হয়েছে, এগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে জাহান্নাম নিশ্চিত! ধর্ম নিজে নিজেকে রক্ষা করার মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে ভয় এবং লোভ! ধর্ম, এর পালনকারীদের উন্নত এবং সুখী জীবনের লোভ দেখাচ্ছে এবং লঙ্ঘনকারীকে দেখাচ্ছে আগুনে ঝলসানোসহ নানারকম যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির ভয়! এটি লঙ্ঘণকারীকে অকথ্য নির্যাতন করা হবে, আগুনে ঝলসানো হবে, বিষাক্ত সাপে কামড়াবে, গরম পানিতে সিদ্ধ করাসহ খেতে দেয়া হবে পুঁজ, রক্ত… ইত্যাদি। আর পালনকারীদের দেয়া হবে সুস্বাদু ও প্রিয় খাদ্যসহ হুর-পরী ইত্যাদি। তবে আমরা ভয়ে কিংবা লোভে যেটাতেই হোক ধর্ম পালনে চির-অভ্যস্ত হয়ে গেছি এতে কোনো সন্দেহ নেই, আমরা শুধু সামাজিকতা রক্ষা এবং যান্ত্রিকভাবেই মনের অজান্তেই ধর্মের আনুষ্ঠানিকতা পালন করে যাচ্ছি এতেও কোনো ভুল নেই। সময় হলে দৌঁড় দেই মন্দির, মসজিদ, পেগোডা, গির্জাতে… এবং যা বলার তা তো আমাদের শিশুকাল থেকেই মুখস্ত ও ঠোঁটস্থ… (মোটেও অন্তরস্থ নয়) তাই বলে ফেলি আর কি! পরদিন আবার নির্দিষ্ট করে দেয়া একই সময়ে, একই মন্ত্র উচ্চারণ করে আসি…। এভাবে একই মন্ত্র, একই গান, একই প্রার্থনা করে পরিতৃপ্ত থাকি এবং জীবনটাকে পার করে দেই কখন তা টেরও পাই না। ধর্মীয় নিয়ম মাফিক দিনের অতি অল্প সময় মুখস্ত ধর্মীয় মন্ত্র উচ্চারণ করে আসি এবং বেশিরভাগ সময়ই না করি এমন কোনো অন্যায় নেই। এসব অন্যায় নিয়ে আমরা যতোটা সোচ্চার না হই, ততোধিক সোচ্চার হই কেউ যদি ধর্মের গায়ে সামান্য আঁচড়ও কাটে। একজন দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী, এমপি, শিল্পপতি… প্রকাশ্যে দুর্নীতি করলেও সমাজের ধর্মজীবিরা একটি কথাও বলে না, অথচ কেউ যদি ধর্মের গায়ে সামান্য আঁচড় কাটে তাহলে তারা মুণ্ডুপাত ছাড়া নিস্তার নেই। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে আমরা এখন মূলত সকলেই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতিবাজ অথবা এর সমর্থক। সম্পদের সীমা নেই তারপরও একদিন ব্যবসায়ে লোকশান হলে আমাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়, প্রতিদিন, প্রতিটি জিনিষে কতো বেশি লাভ করা যায় তা নিয়েই আমরা ব্যস্ত থাকি। সম্পদের ড্রাগ পানে আমরা এখন অভ্যস্ত, এ নেশা থেকে একদিনের জন্যও আমরা মুক্ত হতে পারছি না। কমবেশি আমরা সকলেই এ মারাত্মক ড্রাগে আক্রান্ত। লোভ এবং লাভ এখন আমাদের দেশে জন্মগত ও পেশাগত হয়ে গেছে। আমাদের মগজে এখন লোভ আর লাভ ছাড়া কোনো পদার্থ আছে কি-না সন্দেহ! আমরা প্রায় সকলেই জন্মগতভাবে লোভ এবং লাভের নেশাগ্রস্থ হই। জন্মের পর, যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি তার বাইরে আমরা যেতে পারি না। জন্ম থেকেই পিতাকে দেখেছি, তার বন্ধুদের দেখেছি, আত্মীয়দের দেখেছি… শ্রমিকদের ঠকিয়ে, অত্যাচার করে, দুর্নীতি করে, ঘুষ খেয়ে খেয়ে, ক্ষমতার অপব্যাবহার করে… কিভাবে তাদের সম্পদ বৃদ্ধি করেছে, আমি কি করে এর বাইরে যেতে পারি? জন্ম থেকে দেখেছি অলমাইটি টাকার জন্য সমাজের সর্বত্র, রাষ্ট্রের সর্বত্র কি মল্লযুদ্ধই চলছে! কি মিথ্যচার, কি ভন্ডামো, কতোপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে, কতশত ক্ষমতাবানদের হুমকি-ধামকি চলছে অবিরত… এর বাইরে আমরা যাই কি করে? আর যাবোই বা কেন? এ নিয়ে ভাবা-ভাবির এখন আর কিছু নেই। সমাজে পূর্বে যা অন্যায় ছিলো, তা যে এখন আর অন্যায় নেই, তা এখন সমাজের ন্যায়-কার্যে পরিণত হয়ে গেছে! ধন-সম্পদে আমাদের অতৃপ্ততা, অনীহা নেই, এ যেন পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে। ঐতিহ্য ভুলে গেলে বংশ মর্যাদা থাকে না! বংশের সুনাম রক্ষার্থে ঐতিহ্য একটি সুপ্রাচীন মূল্যবোধ। ঐতিহ্যগতভাবে প্রাপ্ত ধনলিপ্সাও একটি ঐতিহ্যবাহী এবং অত্যন্ত মধুর, অত্যন্ত আরামদায়ক, অত্যন্ত প্রিয়, অত্যন্ত আনন্দদায়ক, অত্যন্ত স্বর্গীয় বিষয় হয়ে গেছে। এরূপ স্বাদের ও এরূপ লোভনীয় ঐতিহ্য কি করে বর্জন করতে পারি? কেনই বর্জন করবো? অমুকে করছে আমাকেও করতে হবে, অমুকে হয়েছে আমাকেও হতে হবে, ন্যায়-অন্যায় বুঝি না, যেমন- সত্য বলি, মিথ্যা বলি যাকাত তো প্রদান করি, নিয়মিত নামাজ, প্রার্থনা তো করি…! কারণ যতো সম্পদ ততো ক্ষমতা, অতএব সাধু সেজে লাভ কি? সমাজে যদি আমার ক্ষমতাই না থাকলো, মানুষে দেখলে সালাম দিয়ে পথ না ছাড়লো, জি হুজুর-জি হুজুর না-ই করলো… তাহলে আমার মানব-জনমই তো বৃথা!

ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে নানা মুনির নানা মত, ধর্মনিরপেক্ষতাকে কোনো কোনো ধর্মীয় নেতারা ধর্মহীনতা বলে থাকে। রাষ্ট্র বলে, কারো ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না। রাষ্ট্র থাকবে এক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ। তা কি আমাদের মতো রাষ্ট্রে দেখা যায়! আমাদের রাষ্ট্র কি সত্যিই ধর্মনিরপেক্ষ? হলে কিভাবে? সংবিধানে ধর্মীয় বাণী থাকুক কিংবা না থাকুক তাতে কিছু আসে-যায় না, কারণ আমাদের রাষ্ট্র কখনোই ধর্মনিরপেক্ষ ছিলো না, হতে পারে নাই এবং পারবেও না। ধর্মনিরপেক্ষতার যথাযথ প্রয়োগ করতে হলে রাষ্ট্রকে হতে হবে অথবা করতে হবে-

ক) রাষ্ট্রীয় সমস্ত কার্যকলাপে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু তাই কি হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রে? কখনো নয়। রাষ্ট্র এখানে ধর্মকে তার একটি প্রধান হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করে থাকে। বিশেষ করে নির্বাচনের সময় প্রতিটি রাজনৈতিক দলই ধর্মকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কোটি কোটি টাকা ঢালছে, বিশেষ করে একটি বিশেষ ধর্মপ্রতিষ্ঠানে। যা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের কার্য হতে পারে না। এখানে রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় সমস্ত অনুষ্ঠানের আগে ধর্মের নাম নিয়ে তারপর অন্য আলোচনা শুরু করা হয়। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রের এরূপ অর্থ ব্যয় করার ফলে মানুষের নৈতিকতার কি উন্নতি হচ্ছে; না-কি দিন দিন নৈতিকতার অবক্ষয়ই হচ্ছে?

খ) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্ম শিক্ষা দেয়া যাবে না, তা শিক্ষা নিতে হবে নিজ নিজ ধর্মালয়ে এবং পাঠ্যপুস্তকেও কোনো ধর্মীয় নেতা বা প্রফেট বা ধর্মগুরুর জীবনী শিক্ষা দেওয়া যাবে না। কিন্তু আমাদের সন্তানেরা তাদের পাঠ্যপুস্তকে এমন এমন ধর্মীয় নেতার জীবনী এবং ধর্মীয় বাক্য শিক্ষা করতে বাধ্য হয় যা তার নিজ ধর্মে স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য নয়।

গ) কোনো ধর্মালয় বা ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কোনো অর্থ যেতে পারবে না। অথচ এদেশে ধর্ম শিক্ষার জন্য লক্ষ লক্ষ ধর্মালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে এবং একটি শিক্ষা বোর্ডও রয়েছে, যেগুলো সরকারি অর্থেই চলছে।

ঘ) কোনো রাজনৈতিক নেতার উচিত নয় ধর্মীয় কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করা, সেখানে অংশগ্রহণ করবে ধর্মীয় নেতারা অর্থাৎ রাজনীতি ও ধর্মকে সম্পূর্ণ আলাদা রাখতে হবে নতুবা রাষ্ট্র কখনো ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারবে না। বাস্তবে তার প্রয়োগ এদেশে নেই।

ঙ) সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মের কোনো বাণী উচ্চারিত হতে পারবে না। ধর্ম প্রচারকগণ সেখানে কোনোরকম ধর্ম প্রচার করতে পারবে না। অথচ আমাদের দেশে তা বেশ জোরেশোরেই এবং প্রতিনিয়তই প্রচারিত হচ্ছে।

চ) কোনো আবেদনপত্র এবং জীবনবৃত্তান্তে ধর্ম লেখা থাকতে পারবে না। রাষ্ট্রের সর্বত্রই চাকুরিতে নিয়োগ বা অন্য কোনো কারণে তার নাগরিককে ধর্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে পারবে না।

ছ) নির্বাচনের সময় কোনো রাজনৈতিক দল ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রচার চালতে পারবে না। অথচ এদেশে এর সবগুলোরই ব্যতিক্রম হচ্ছে এবং হবেও। শাসক শ্রেণী সর্বদাই চায় ধর্মীয় এ বিভাজন থাকুক তাতে ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয়ের লাভ। তারা চায় জনগণ ধর্মীয় দিক থেকে যতো প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখাবে রাষ্ট্রের কাজেও তারা ততো বেশি প্রশ্নাতীত হবে। ধর্ম সম্পর্কে যারা প্রশ্ন করতে জানে না তারা রাষ্ট্রের শাসকবর্গ সম্বন্ধেও প্রশ্ন তুলতে পারবে না, কারণ ধর্ম বলে এবং তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে, রাষ্ট্রের শাসকবর্গ বিধাতার নির্দেশেই ক্ষমতায় আসে। ধর্মের বেলাতে যেমন- “শুধাবে না কেউ কার্যের কারণ, আমাদের কাজ শুধু কর্তব্য সাধান ও শরীর পাতন।”

যদি মানব জাতির পরিত্রাণের লক্ষ্য একটাই হবে তাহলে কেন বিভিন্ন পথ তৈরি করা হয়েছে? আবার আসি আলডাস হাক্সলির কথায়, তিনি কিছু দার্শনিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন- “…তাঁদের ধারণা অলৌকিক শক্তির সাহায্য ব্যতিত ব্যক্তি হৃদয়ের বাঞ্ছনীয় পরিবর্তন সাধন অসম্ভব! তাঁরা বলেন যে, ধর্মের আওতায় ফিরে আসা ব্যতিত কোন গত্যন্তর নেই। দুর্ভাগ্যবশতঃ কোন্ ধর্মমতে ফিরে আসা যে অনিবার্য সে সম্পর্কে তাঁরাও একমত নন। …দরিদ্র ও পদদলিতের দল চিরদিনই স্বপ্ন দেখছে অন্নচিন্তাহীন, স্বাধীন, সুখী ও নির্যাতনমুক্ত এক মানবাদর্শের। কিন্তু এসব বিভ্রান্তিকর অসংখ্য আদর্শের কোনটিই আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। …এসব পরস্পরবিরোধী আদর্শ বিশেষ বিশেষ সামাজিক অবস্থার ফল।” অতএব প্রশ্ন জাগে- বিভ্রান্তিকর এই অসংখ্য আদর্শবান মহান নেতা এবং ধর্মাবতারদের মধ্য থেকে কার আদর্শ মানুষ এককভাবে এবং শ্রেষ্ঠ বা সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে গ্রহণ করতে পারে বা করবে?
ধর্মীয় আদর্শের বেলাতেও একই কথা প্রযোজ্য।

এখানে বহু ঈশ্বর, বহু ধর্মপ্রবর্তক, বহু ধর্মজীবি হওয়াতে মানুষ এক বিভ্রান্তিকর অস্থায় পতিত হয়ে আছে। কার ধর্ম গ্রহণ করবে মানুষ? কোনটা বড়, কোনটা ছোট, কোনটা প্রধান, কোনটা শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ? এসবের কোন মানদণ্ড নেই। নেই কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা! প্রতিটি ধর্মপুস্তক, ধর্মপ্রবর্তক, ধর্মজীবিরাই বলছে এবং কখনো কখনো জোর করছে বা দারিদ্রতার সুযোগ নিচ্ছে অথবা অর্থের লোভ দিয়ে বলছে- আমার প্রচারিত ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ ও চির সত্য; অন্যগুলো মিথ্যা এবং তা পালন করলে নির্ঘাত নরকবাস! আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ এবং তা স্বয়ং ভগবান, ঈশ্বর বা আল্লা কর্তৃক স্বর্গ বা বেহেস্ত থেকেই এসেছে বা নাজেল হয়েছে। তাই একেক ধর্মের একেক ধর্মাবতারদের কথা শুনে প্রশ্ন জাগে- কোনটা সঠিক? কারটা মানি? এখানে ধর্ম সম্পর্কে কবি নজরুলের দু’টি বক্তব্য তুলে ধরছি। তিনি বলেছিলেন- “ওরে মূর্খ ওরে জড়/শাস্ত্র চেয়ে সত্য বড়/চিন্লিনে তা চিনির বলদ/সার হ’ল তাই শাস্ত্র বওয়া।/সৃষ্টিকে তার ঘৃণা করে/স্রষ্টায় পূজিস জীবন ভরে।/নানান মুনির নানান মত যে/মানবি বল সে কার শাসন?/কয় জনার বা রাখবি মন? /এক সমাজে মানলে/করবে আরেক সমাজ নির্বাসন।” ধর্ম যে আমাদের কেবল ভয় দেখিয়ে তা মানতে বাধ্য করাচ্ছে তা-ই শুধু নয়। ভয়ের সাথে লোভ দেখিয়ে বলা হয়েছে বেহেস্ত বা স্বর্গে কি কি পাওয়া যাবে (যা পৃথিবীতে নিষিদ্ধ তাও), তাই তিনি আবার প্রশ্ন করেছেন-
“কোরান হাদীস সবাই বলে-পবিত্র সে বেহেশ্ত নাকি,
মিলবে সেথায় আসল শরাব তম্বী হুরী ডাগর আঁখি?
শরাব এবং প্রিয়া নিয়ে দিন কাটে মোর, দোষ কি তাতে?
বেহেশ্তে যা হারাম নহে – মর্ত্যে হবে হারাম তা কি?”

জাতীয় কবির এ প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে? যা এ পৃথিবীতে হারাম তা কেন বেহেস্ত হারাম হবে না? কেন মানুষকে বিশেষ করে পুরুষদের এরূপ লোভ দেখানো হয়েছে? বেহেস্তের ব্যাপারে নারীদের এরূপ কোনো লোভ দেখানো হয়নি, তার কারণ কি? নারীরা কি সেখানে গেলে সুন্দর সুন্দর পুরুষ নিয়ে নিজের একক সংসার গড়তে পারবে না? তা কেন?

কবি নজরুলের ন্যায় স্বশিক্ষিত এক কৃষক অথচ দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরেরও প্রশ্ন কোনটি সত্য? যেমন তিনি জিজ্ঞেস করেছেন- “একটি ঘটনা যখন দুই রকম বর্ণিত হয়, তখন হয়তো উহার কোন একটি সত্য, অপরটি মিথ্যা অথবা উভয়ই সমরূপ মিথ্যা, উভয়ই যুগপৎ সত্য হইতে পারে না- হয়তো সত্য অজ্ঞাতই থাকিয়া যায়। ধর্ম নানারূপে বর্ণিত হইয়াছে, একই ধর্মেই আবার নানারূপ কুসংস্কার ও মতবাদ বিদ্যমান। জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যে সব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এক কথা বলে না। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হইতে পারে না, সেখান শতাধিক ধর্মে প্রচলিত শতাধিক মত সত্য হইবে কিরূপে? যদি বলা হয় যে, সত্য হইবে একটি; তখন প্রশ্ন হইবে, কোনটি এবং কেন? অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি কি? সত্য প্রমাণের উপায় কি এবং সত্যের রূপ কি? হাজারো মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের নিকট আপন আপন ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ, সনাতন ও ঈশ্বর বা খোদা অনুমোদিত, মুক্তি বা পরিত্রাণের একমাত্র পন্থা। এরূপ ধারণা প্রতিটি ধর্মেই বিদ্যমান। কোন ধর্ম একথা কখনও স্বীকার করে না যে, অপর কোন ধর্ম সত্য অথবা অমুক ধর্মালম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, মুক্তি বা নির্বাণ ঘটিবে। বরং সকল সম্প্রদায়ের ধর্মযাজকেরা একই কথা বলিয়া থাকেন যে, তাহাদের আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্যধর্ম, অন্য কোন ধর্মই সত্য নহে। অন্যান্য ধর্মালম্বী লোকদের স্বর্গপ্রাপ্তি, পরিত্রাণ, নির্বাণ বা মোক্ষলাভ ঘটিবে না। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলেই আপন আপন দধি মিষ্টি বলা।”

আমরা মানতে চাই, কি না চাই, বাস্তব সত্য যে, পৃথিবীর সকল ধর্মমতই প্রশ্নবিদ্ধ তাই সৃষ্টিকর্তা বা সৃষ্টিকর্তারাও প্রশ্নবিদ্ধ। এই সৃষ্টিকর্তারা যদি ইচ্ছা করে তবে নাকি সব সম্ভব! কিন্তু তাদের এ সদ্ইচ্ছেটা কেন নেই যে, পৃথিবীতে তাদের দেওয়া বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে প্রতিদিন যেভাবে মারামারি, তর্কবিতর্ক হচ্ছে এর চেয়ে কেন তারা এক হয়ে যায় না এবং এক ধর্মের প্রবর্তন করে না? আসলেই কি তারা মানবজাতির শান্তি চায় কি-না? চাইলে শান্তি কোথায় দেখা যাচ্ছে? ধর্ম নিয়ে বিরোধ তো ধর্ম সৃষ্টির সময় থেকেই! অন্যদিকে আসলেই কি তারা নিজেরাও শান্তিতে আছে, নাকি তারা শান্তি পছন্দ করে না? এতসব ধর্মমতের কোনটি ঠিক অথবা আদৌ একটিও ঠিক কি-না, এর প্রমাণ পাওয়া আর পায়ে হেঁটে মঙ্গল গ্রহে যাওয়া একই কথা। এসম্পর্কে একটি গল্প বলি। প্রায় বিশ বছর পূর্বে আমাদের গ্রামের সকলের প্রিয় মধুচাচা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তিনি যে মারা গেছেন তা ধ্রব সত্য কথা। আমি তার দুর্ঘনটাস্থল থেকে বহু দূরে। তিনি মারা গেছেন বরিশালে, আর আমি ঢাকাতে। তার মৃত্যুর পরদিন গ্রামের এক ব্যক্তি বরিশাল থেকে রাতের লঞ্চে ঢাকা এসে ভোরবেলাতে জানালো- শুনেছো, করিমচাচা মারা গেছে! বললাম, কিভাবে? বললো দুর্ঘটনায়। কি রকম দুর্ঘটনা? বললো, গাছ চাপা পড়ে মারা গেছে। জিজ্ঞেস করলাম, তুমি নিজে দেখেছো? উত্তরে সে বললো- না নিজে দেখি নাই; তবে লোকমুখে শুনেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকমুখে শুনেই বিশ্বাস করলে? বললো, না-না, তা কেন? আমাদের গ্রামের হুজুরের মুখে শুনে তবেই না বিশ্বাস করেছি যে করিমচাচা গাছ চাপ পড়ে মরেছে! এরপর দুপুরের দিকে গ্রামের অন্য এক ব্যক্তি এসে জানালো- করিমচাচা মারা গেছে জানো তো? বললাম জানি, তবে কিভাবে? সে জানালো, গাড়ি চাপা পড়ে মরেছে! জিজ্ঞেস করলাম, গাড়ি চাপা! তুমি নিজে দেখেছো? সে বললো, না-না আমি তো ঠাকুরের মুখে শুনে এলাম! জিজ্ঞেস করলাম, ঠাকুর কি ঠিক দেখেছে এবং তোমাকে কি ঠিক বলেছে? বললো, আরে হ্যাঁ, তিনি তো খুব খাঁটি লোক, তিনি তো আর মিথ্যা বলতে পারে না! আমি আর কথা বাড়ালাম না। মনে মনে ভাবলাম- একজন শুনেছে হুজুরের মুখে, একজন শুনেছে ঠাকুরের মুখে, কিন্তু ওরা দু’জনই দু’রকম শুনেছে, কিন্তু কেউ দেখেনি অথচ বিশ্বাস করেছে। আর আমি শুনলাম ওদের দু’জনের মুখে দু’রকম এখন আমি কি করি? কোনটা বিশ্বাস করি? একটি ঘটনা দু’জন দু’রকম ব্যাখ্যা করলো, এর মধ্যে কোনটি সত্য তা-ই তো বের করা যাচ্ছে না, অথচ হাজারো ধর্মের মধ্য থেকে কোনটি সত্য তা বের করে, তা পালন করা আর পায়ে হেঁটে মঙ্গলে যাওয়া কি সমান কথা নয়? আমার ভাবনায় হঠাৎ ছেদ পড়লো গ্রামের অন্য এক ব্যক্তির ডাকে। কিরে কি ভাবছো? বললাম, ভাবছি করিমচাচার কথা! আহারে বেচারা কতো ভালো মানুষ ছিলো! সে বললো, হ্যাঁ তা জানো, কি নির্মমভাবে মরেছে বেচারি, মরণ থাকলে নাকি নৌকা কেরায়া (ভাড়া) করে সেখানে যেতে হয়, সেরকম অবস্থা! আমি অবাক হয়ে বললাম, কিভাবে মরেছে? সে বললো, করিমচাচা গ্রামের মেঠো পথ ধরে তার জামাইবাড়ি যাচ্ছিলেন পায়ে হেঁটে। জামাইবাড়ির খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলো, একটা বিশাল মাঠ পার হচ্ছিলো তিনি। মাঠের যখন মধ্যেখানে তখন চারিদিক অন্ধকার করে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেলো এবং বজ্রপাতে তার মৃত্যু হলো! আমি বললাম, তাই নাকি? সে বললে, হ্যাঁ তাই! কেন তোমার কি সন্দেহ, আমি মিথ্যা বলছি? বললাম, না-না, তবে তুমি কি নিজে দেখেছো? সে বললো- না, আমি শুনেছি। প্রশ্ন করলাম, কার মুখে শুনেছো? বললো, পাস্টর বলেছেন। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম, তিনি কি নিজে দেখেছেন তুমি ঠিক জানো তো? সে বললো, তার আমি কি জানি? তিনি তো আর মিথ্যা বলার লোক নয়! আমি চুপ হয়ে থাকলাম। মনে মনে ভাবলাম ধর্মের চিরন্তন সেই বাক্যাটি- “ধন্য যাহারা না দেখিয়া বিশ্বাস করে।” এই না দেখিয়া বিশ্বাস করি বলেই ধর্ম চিরদিনই নিশ্চিন্তে ঘুমায় আর আমরা এটি রক্ষার্থে অস্ত্রশস্ত্র হাতে পাহারা দেই, এ নিয়ে গর্বে বুক ফুলাই, অন্যে কোনো সমালোচনা করলে তার মাথা ফাটাই, তাকে হত্যা করে বেহেস্তের চাবি হাতে নেই…!

যাহোক, এবার পাঠকরাই বলুন- করিমচাচার মৃত্যুর কোন ঘটনাটাকে আমি এখন বিশ্বাস করবো? এখানে যুক্তি বা বিজ্ঞান কোনটা দিয়ে আমি সঠিক ঘটনাটি উদ্ধার করতে পারি, তার তো কোনো উপায় নেই। ওরা কেউই দেখেনি কেবলমাত্র শুনেছে যার যার ধর্মীয় নেতাদের নিকট আর তাতেই ওদের বিশ্বাস জন্মেছে যা চিরন্তন নিয়মেই হয়ে আসছে। সমস্যা এখানেই। ওরা তিনজন একটি ঘটনাকে তিন রকমভাবে আমার নিকট ব্যাখ্যা করেছে, কিন্তু ঘটনা একটিই এবং সত্য অর্থাৎ করিমচাচা দুর্ঘটনায় মারা গেছে। কিন্তু ঘটনা কিভাবে ঘটেছে তার কোনোটাই সত্য নয় অথবা একটি সত্য অন্য দু’টি মিথ্যা অথবা সবগুলোই মিথ্যা। হয়তো করিমচাচা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় মরেছেন। তবে এদের তিনজনের বক্তব্যের কোন দু’টি মিথ্যা এবং কোনটি সত্য তা নির্ণয় করা যায় কিভাবে? যদি এখন বরিশাল গিয়ে তদন্ত করে দেখা যায় তো যে তিন ধর্মীয় নেতা তাদের অনুসারীদের এসব বলেছে তাদের দু’জন মিথ্যাবাদী হবে, একজন সত্যবাদী হবে। এটি অবশ্য করা যায়, কারণ তারা এখনো জীবিত। কিন্তু পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে অরাজকতা সৃষ্টিকারী ধর্মপ্রবর্তকগণ তাদের পাবো কোথায়? তারা তো সব মৃত। তাদেরকে তো আর আমরা পাচ্ছি না। তাই কি করে তাদের নিকট গিয়ে জানতে পারি যে, তারা যে যে ধর্ম প্রচার করে গেছে তার কোনটি সত্য আর কোনগুলো মিথ্যা! কোন ঈশ্বর সত্য, কোন ঈশ্বর মিথ্যা! তারা যেসব ধর্মমত প্রচার করে গেছে তার মধ্যে কেনো এতো বেশি গলদ, কুসংস্কার, কু-প্রথা… ইত্যাদি? ধর্মের এ সমস্যার সমাধান যতোদিন না হবে ততোদিন এর কোন্দলও দূর হবে না। আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ ধর্মের মধ্যে এক বা একাধিক ব্যক্তি আছে যাদের আমরা ধর্মাবতার বা ধর্মপ্রবর্তক বলি, তাদের কথামতই আমরা প্রশ্নহীনভাবে সবকিছু বিশ্বাস করি। যেমন বিশ্বাস করেছে আমার গ্রামের ওই তিন ব্যক্তি এবং তারা প্রত্যেকেই তাদের বিশ্বাস আমার নিকট জোর দিয়ে প্রচার করেছে।

ধর্মকে সংবিধানে রাখা জরুরি কেন তা জানি না, তবে এর চেয়েও জরুরি বিষয় হলো ধর্মগুলোর মধ্যেকার বিভিন্ন প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কুবিশ্বাস, কল্পনাপ্রসূত বিশ্বাস… ইত্যাদি সংস্কার হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়! কারণ প্রতিটি ধর্ম এবং বিশেষ করে ওই ধর্মের প্রবর্তকগণ সে পথ বন্ধ করে রেখে গেছে ভয় দিয়ে! অর্থাৎ তা সংস্কার করতে গেলেই তার বা তাদের জন্য নরক অনিবার্য! নরকের যেসব জ্বালাও-পোড়াও, তেলেভাজা, বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ খাবার ও নানারূপ ভয়াবহ শাস্তির কথা প্রতিটি ধর্মপুস্তকে বর্ণিত হয়েছে তাতে করে মৃত মানুষও ভয়ে কেঁপে ওঠবে! তাছাড়া ধার্মিকগণ তো জিহাদ ঘোষণা করেই রেখেছে! যাহোক, আবার আসি আলডাস হাক্সলির কথায়- “…চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণের ক্ষেত্রে প্রচলিত সংস্কার থেকে অত্যন্ত সার্থকভাবে মুক্তিলাভ করা যায় নিরপেক্ষ গুণাবলীর চর্চা ও পরম সত্যের স্বরূপ সম্পর্কে সহজ অর্ন্তদৃষ্টি দ্বারা। …বুদ্ধিবৃত্তিকে যে কিভাবে প্রয়োগ করতে হবে তা নির্ভর করে ইচ্ছার উপর। ইচ্ছা যদি নিরপেক্ষ না হয় তাহলে আত্মস্বার্থের খাতিরে আবেগ ও কুসংস্কারকে যুক্তিসঙ্গত করে তোলার উদ্দেশ্যে বুদ্ধিবৃত্তিকে নিছক যান্ত্রিকভাবে প্রয়োগ করার প্রবণতা দেখা যায়। …এ কারণেই সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকদের মধ্যেও খুব অল্পসংখ্যক ব্যক্তিই তাঁদের নিজ নিজ দেশ ও কালের সংকীর্ণ সংস্কার থেকে মুক্ত হতে পারেন।” যেখানে সূক্ষ্মদর্শী দার্শনিকরা সংস্কারের কবল থেকে মুক্ত হতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যে কোনকালেই ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের হাত থেকে মুক্ত হবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাছাড়া আমাদের ইচ্ছাও নিরপেক্ষ নয় এবং নিরপেক্ষতার চর্চা আমাদের দ্বারা সম্ভবও নয়।

আলডাস হাক্সলির মতে- আদর্শ মানুষ কারা? “…আদর্শ মানুষ হলো অনাসক্ত মানুষ; তিনি অনাসক্ত তাঁর দৈহিক ভাবাবেগে ও লালসা সম্পর্কে, অনাসক্ত তাঁর ক্ষমতা ও অধিকারের বিষয়ে, অনাসক্ত সমস্ত ক্ষমতার লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে, তাঁর ঐকান্তিক প্রীতি-ভালাবাসা সম্পর্কে। এমনকি বিজ্ঞান, শিল্পকলা, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বপ্রেম ইত্যাদি সম্পর্কেও। এক কথায় সমস্ত বিষয়েই তিনি অনাসক্ত।” তিনি আরো বলেছেন- “…অনাসক্তি চর্চার ফলেই নিশ্চিতভাবে অন্যান্য গুণাবলীর অনুশীলও ঘটে। …অনাসক্তি চর্চার অনিবার্য আনুষাঙ্গিক হিসাবে বুদ্ধিবৃত্তিরও কর্ষণ হয়ে থাকে। কেননা অনুভূতিশূন্য জড়তাই হলো যাবতীয় দোষের মূল কারণ। অনাসক্তি চর্চার সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ঘটে নিঃস্বার্থপরতা ও উদারতার চর্চা। কারণ অতিরিক্ত অর্থলিপ্সু, সম্পত্তির মোহগ্রস্ত লোকেরা নিজেদেরকে তুচ্ছ জিনিষের সঙ্গে একাত্ম ভাবতে বাধ্য হয়। অন্যান্য বিষয়ের সম্বন্ধেও এই একই কথা বলা চলে।” এখন প্রশ্ন হলো, এই অনাসক্তি চর্চা কি আমদের সমাজে একবিন্দুও দেখা যাচ্ছে? মি. হাক্সলি খ্রীস্ট ধর্মের উদাহরণ টেনে অনাসক্ত মানুষকে বলেছেন আদর্শ মানুষ বা ভালো মানুষ। খ্রীস্ট ধর্মের সমবেত প্রার্থনায় বলা হয়- “প্রভু, আমাকে প্রলোভনে পড়তে দিও না।” খ্রীস্ট ধর্মে আরো বলা হয়েছে- ‘কেউ তোমার একগালে চড় মারলে তোমার অন্য গাল পেতে দিও’। তা কি দিচ্ছে কেউ? আবার ‘আমাকে প্রলোভনে পড়তে দিও না’ কিন্তু আমাদের দেশে প্রলোভন কার নেই? ক’জনের নেই? কতজনের প্রলোভন আছে, তার চেয়ে কতজনের নেই তা খোঁজাই বোধকরি সহজ! আসক্তি এবং প্রলোভনে আমরা এখন জর্জরিত। আমাদের বিবেক-বুদ্ধি, চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণটাই প্রলোভন এবং আসক্তিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এখানে ধার্মিকতা ও নৈতিকতার কোনো স্থান আছে বলে মনে হয় না। সমাজে ক’জন অনাসক্ত মানুষ পাওয়া যাবে? আমরা জাতিগতভাবে এখন অতিরিক্ত অর্থলিপ্সু এবং সম্পত্তির মোহগ্রস্ততায় ভুগছি নয় কি? কোন মহৎ চিন্তায় আমরা একে অপরকে সমর্থন দিতে পারি না, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চিন্তা বাদই দিলাম। আমাদের ধর্ম কুসংস্কারের বাইরে ভালো যতোটুকুই শিক্ষা দিচ্ছে, তা আর আমাদের অন্তরে কোনো কাজ করছে না। এ শিক্ষা এখন লোক দেখানো এবং যান্ত্রিক হয়ে গেছে। তাই ধর্মকে সংবিধানের প্রারম্ভে নয় এর পাতায় পাতায় জুড়ে দিলেও কোনো লাভ নেই, কেবলমাত্র মানসিক তৃপ্তি ছাড়া। তাই যদি হতো প্রতিটি রমজান মাসে ঘুষ খাওয়ার হার বেড়ে যেতো না; বেড়ে যেতো না নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষপত্রসহ অন্যান্য সব জিনিষের দাম!

আমাদের জন্ম থেকেই ধর্ম পুরুষানুক্রমে প্রাপ্ত একটি বিশ্বাস, তাই মানুষের নিকট এটি একটি পরম মূল্যবান জিনিষ। অতএব সমাজ ও ব্যক্তিকে এটি সর্বদাই আচ্ছন্ন করে রাখে। মোহগ্রস্থ করে এবং পুরো সমাজকে একাত্ম করে রাখে। এই একাত্মতাই এর অনুসারীদের মনে একধরনের বিশেষ অদৃষ্টবাদের সৃষ্টি করে। মোহগ্রস্ত জাতি পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখে যে অন্য সমস্ত জাতি ও পরিবেশ তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। ফলে এরা অন্য ধর্ম ও জাতি সম্পর্কে সন্দিহান থাকে। তখন তাদের নিকট নিজ নিজ ধর্মজীবিদের উম্মত্ত নীতিগুলোও যুক্তিসম্মত ও নিজ নিজ ধর্মালম্বী জঘন্যতম অপরাধীকেও যথেষ্ট ন্যায় সঙ্গত বলে মনে হয়। যেমন- লাদেন এখনো অনেকের হৃদয়ে হিরো! বেশিরভাগ ধর্ম বিশ্বাসীর নিকট মানুষ বড় নয়, তার নিজ ধর্মই বড়। কিন্তু মানবাতার নিকট আগে মানুষ, তারপর ধর্ম। কারণ প্রায় প্রতিটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে পর্যালোচনা করলে একথার যথার্থতা মিলবে যে, তারা যেসব বিষয় নিয়ে দাঙ্গা করেছিলো এবং এখনও করছে তা অতি সামান্য সমস্যা মাত্র। অথচ এই সামান্য সমস্যাই ধর্মীয় উম্মাদনার নিকট আগ্নেয়গিরি ন্যায় দেখা দেয়। এই উম্মত্ত নীতিগুলোই নিজ নিজ ধর্মানুসারীদের চিন্তা, অনুভূতি, আকাংখার জন্য এক ছাঁচের ন্যায় কাজ করে। এর ফলেই নির্যাতিত মানুষেরা তাদের উপর অত্যাচার হলেও তা কেবল সহ্য করে যায় তা নয়, উম্মাদ ওইসব ধর্মীয় নেতাদের পূঁজাও করে। তারা তাদের জয়গান করে, প্রশংসা করে। তারা মনে করে এদের গোলামি করা অর্থাৎ এদের সমস্ত ধর্মীয় উপদেশ পালন করা স্বর্গীয় আদেশ এবং একান্ত করণীয়। তাদের আদেশ অনুসারে না চললে বেহেস্ত বা স্বর্গে প্রবেশ করা যাবে না। তারা এদের নির্দেশে শুধু যে নিচ অথবা জঘন্য কাজ করতে রাজি হয় বা বরদাস্ত করে তা-ই শুধু নয়, তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং প্রাণ বিসর্জন দিতেও সদা প্রস্তুত। কারণ তাদের এমন সুকঠিন এবং ঐতিহ্যগতভাবে প্রাপ্ত অন্ধবিশ্বাস জন্মেছে যে এর মধ্যেই স্বর্গপ্রাপ্তি, অন্য কোথাও নয়। ওপারেই রয়েছে তাদের জন্য পরম শান্তি, সুস্বাদু খাবার, অপ্সরী, হুরপরী… ইত্যাদি! সেহেতু তারা অসৎ ও অসঙ্গত উপায়ে হলেও কাঙ্খিত ফল অর্থাৎ স্বর্গপ্রাপ্তির লোভে ধর্মীয় নেতাদের আদেশ-নির্দেশকে ঐশ্বরিক আদেশ-নির্দেশ বলে বিশ্বাস করে এবং আত্মহুতি দিতে সদা প্রস্তুত থাকে।

ধর্মীয় অনুশাসনে দেখা যায় রাষ্ট্রের ন্যায় কায়দা-কানুন। যেমন- একজন ধর্মাবতার ছাড়া ধর্ম গঠিত বা সৃষ্টি হতে পারে না। আবার সেই ধর্মাবতারের থাকতে হয় নানা শিষ্য বা মুরিদ। এসব মুরিদদের আবার বহু সহ-মুরিদ থাকে, যারা নিজ নিজ অনুসারীদের হাইকমাণ্ডের সব খবর পৌঁছে দেয় এবং বেহেস্তে বা স্বর্গে যেতে হলে ওই নিুস্তরের নেতাদের বাধ্য থাকা এবং মান্য করা থেকে শুরু করে হাইকমাণ্ড পর্যন্ত অন্ধ আনুগত্য না থাকলে তার বেহেস্ত বা স্বর্গে যাওয়া হবে না। আর যদি কোনো কারণে এরা কেউ একজন বিগড়ে যায় তাহালে তাদের অভিশাপেও সাধারণ অনুসারীদের বেহেস্ত বা স্বর্গে যাওয়া হবে না। এদের সুপারিশ ছাড়া কিছুই হবে না। রাজনীতিতে যেমন নিুস্তরের একজন নেতা তার উর্দ্ধতন, তারপর তার উর্দ্ধতন, তারপর… সুপারিশ করে করে সাধারণদের রাজনৈতিক সুবিধা আদায় করে দেয় ঠিক তদ্রƒপভাবে ধর্মীয় অনুসারীদেরও নিজ নিজ পাতি নেতা থেকে সুপারিশ শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা যদি ধর্মাবতারের কানে পৌঁছে তো এদের স্বর্গবাস হতে পারে, নতুবা নয়।

মি. হাক্সলি অনাসক্তি সম্পর্কে আরো বলেছেন- “…অনাসক্তি এর অনুসারীদের এই জগত সম্পর্কে অত্যন্ত ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে বাধ্য করে। …যীশু খ্রীস্টের সুসমাচার তো মূলতঃ পার্থিব বিষয় সম্পর্কে অনাসক্তির এবং পরমেশ্বরের প্রতি অনুরুক্তিরই এক সুসমাচার। …ইতিমধ্যে নীতিবিদগণ খ্রীস্ট ধর্মের চেয়েও জোরালো অনাসক্তির প্রয়োজনীয়তার কথা ঘোষণা করেছেন।” তিনি বুদ্ধ ধর্মের অনাসক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন- “…বুদ্ধ ধর্মের পরিভাষায় যিনি দুঃখ-যন্ত্রণাকে জয় করতে সক্ষম তিনিই অনাসক্ত মানুষ। …তিনি বিদ্বেষাত্মক ও মূঢ়তার পরিচায়ক কাজকর্ম হতে বিরত থেকে অপরকেও কখনো যন্ত্রণা দেন না। তিনিই পরিতৃপ্ত অর্থাৎ ‘পরম সুখী’ মানুষ এবং সেই সঙ্গে তিনিই একজন ভাল মানুষ। অনাসক্তকে বলা যায়, ‘মনের পরম সুখ’।” সুখ লাভের জন্যই তো আমরা লোভে পতিত হচ্ছি এবং একবার লোভে পতিত হলে সেখান থেকে আর ফিরতে পারছি না। লোভ তখন আসক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। লোভিরা তখন অবৈধ কাজকে বৈধ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়। এরা বলপ্রয়োগ করে অবৈধকে বৈধতা দান করতে বদ্ধপরিকর। সম্পদের লোভ যাদের মধ্যে একবার ঢেকে তারা হিরোইন খোড়দের চেয়েও বেশি নেশাগ্রস্ত এবং ভয়ংকর হয়ে পড়ে। বর্তমানে সমাজে ও রাষ্ট্রে কি আমরা তাই দেখতে পাচ্ছি না? মনের পরম সুখ আমাদের মনে নেই। পরম সুখ খুঁজছি আমরা সম্পদে, ক্ষমতায়, অর্থলিপ্সায় আমরা এখন উম্মাদ। অতএব ধর্ম আমাদের নিকট এখন একটি বাহ্যাবরণ মাত্র। প্রতিদিনকার প্রাকৃতিক ক্রিয়াদির ন্যায় ধর্মও আমাদের কানে ঢুকলেও হৃদয়ে ঢুকে না। মানব সভ্যতার জন্য চরম হুমকি হলো- লোভ। লোভতুর সমাজে কোনোকিছুই মানুষকে সভ্য করতে পারে না। ধর্মও এক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। লোভ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে, তবে কেউ কেউ একে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে এবং কেউ জানে না, তবে অনেকেই ইচ্ছা করেই করে না। এই করে না-র দলেই আমরা বাঙালি জাতি। আমরা নিত্যধর্ম পালন করি কিন্তু লোভ সংবরণ করতে চাই না, অতএব এরূপ ধর্ম পালনে এ জাতির কোনোই উন্নতি হয় না এবং কোনোকালে হবেও না এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ধর্ম মানুষের এ নেশা হতে উদ্ধার করতে একেবারেই অকার্যকর একটি বিষয়। অতএব ধর্ম বিষয়টি কখনোই সংবিধানে বা রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্ত করা জরুরি ছিলো না, এখনও নেই, এটা একটা মামুলি বিষয় মাত্র। মদখোরদের ওষুধ হলো- মদ। আর লোভীর ওষুধ হলো- সম্পদ। এরা সম্পদ সংগ্রহ করতে না পারলে পাগল হয়ে ওঠে, তখন খুন করে যারা তার অবৈধ কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। একজন মানুষের জীবন পার করতে কতো সম্পদের প্রয়োজ হয়? অতি সামান্য, অথচ লোভি এসব মানব আকৃতির কুকুরগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা স্বয়ং ভগবানেরও আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না! লোভী এসব কুকুরগুলোকে পুরো পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ দিয়ে দিলেও এরা অসুখীই থাকবে এবং আরো চাইবে। এরা প্রতিদিনই কি এদের সম্পদ পাহারা দিতে এবং সেই সম্পদকে আরো শতকোটিগুণ বৃদ্ধি করার জন্য লোভের সীমা আরো বাড়িয়েই দিচ্ছে না? আরো শোষণের নতুন নতুন নিয়ম-কানুন বানাচ্ছে না? এরপরও কি বলবো ধর্মই মানুষের জীবনের জন্য অত্যন্ত জরুরি বা প্রয়োজনীয় অন্য সব নীতি-নৈতিকতা, মানবতা নয়? এসব বুলডগগুলো প্রতিদিন গাদা-গাদা মিথ্যা কথা বলছে, শ্রমিকদের সাথে যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে, ওদের অকথ্যভাষায় গালাগাল দিচ্ছে, অসম্ভবভাবে ঠকাচ্ছে, অধিক মুনাফা করে, মজুদ করে, ভেজাল দিয়ে, খাবারে বিষ দিয়ে, আদিম যুগের দাস প্রথার ন্যায় নিরব ও গোপনীয়ভাবে অত্যাচার করে করে সম্পদের হিমালয় গড়ছে তো গড়ছেই এর কোনো বিরাম নেই, এর কোনো অনিচ্ছা নেই, এর কোনো অতৃপ্তি নেই; নেই কোনো সীমানা…। ধর্ম কি এর একটি সীমানা টেনে দিতে পারতো না? যেমন ধর্ম নরকের যে জ্বালার কাহিনীর বর্ণনা দিয়ে সাধারণ মানুষকে এক ভীতির মধ্যে রেখেছে, সেরূপভাবে কি এসব বুলডগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না? তাদের সম্পদের সীমানা এঁকে দিয়ে যদি বলা হতো যে, এর উপরে সম্পদ হলে তা গরিবদের বিলিয়ে দিতে হবে, নতুবা স্বর্গে যাওয়া যাবে না! সেহেতু হয়তো স্বর্গে যাবার লোভে কিছুটা হলেও সম্পদ বিলিয়ে দিতো অথবা দুর্নীতি করে অরো আরো সম্পদের হিমালয় গড়তো না! একটি রাষ্ট্রে যখন কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করা হয় তখন অন্য ধর্মালম্বীরা ভয়ে অথবা লজ্জায় বা দুঃখে বা ভদ্রতার খাতিরে প্রকাশ না করলেও কোনো অবস্থাতেই তাতে খুশি হতে পারে না। গৌতম বুদ্ধের কথাটি এখানে প্রযোজ্য, যিনি বা যারা অনাসক্ত তারা বিদ্বেষাত্মক ও মূঢ়তার পরিচায়ক কাজকর্ম করে না। যেমন, তারা নিজ ধর্মকে মহৎ করতে গিয়ে অন্যদের আঘাত দেন না।

ড. শাহ সাহেব “সংবিধানে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা বজায় রাখাই জরুরি” বলেছেন। আমার মতে বিষয়টি মোটেও জরুরি নয়, অতি নগণ্য। ধর্মীয় বাণী যখন সংবিধানে ছিল না তখন কি আমারা দুর্নীতিমুক্ত ছিলাম? পরে যখন তা যুক্ত করা হয় তারপরও কি আমরা আরো বেশি দুর্নীতিবাজ হই নাই? এটি তো যুক্ত করা হয় দুই স্বৈরাচারের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার সুবিধার্থেই। যখন সংবিধানে তা যুক্ত হলো এরপর প্রায় ৩৬ বছর কেটে গেছে। এতে কি আমরা প্রলোভনহীন, অনাসক্ত, ভদ্র, সভ্য… জাতিতে পরিণত হয়ে গেছি? হয়তো সংবিধানে তা যুক্ত করে ধার্মিক থেকে আরো বেশি ধার্মিক হয়েছি কিন্তু দুর্নীতির শিখরেও উঠেছি সমানতালে! এটি যুক্ত করে জাতির কি কোনো উন্নতি হয়েছে, নাকি জাতি এখন অধঃপতনের সর্বশেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে? সংবিধানে ধর্মীয় বাক্য থাকা অবস্থাতেই তো ২০০১ সালে মিনি ’৭১ ঘটেছিলো? অতএব এটি সংবিধানে রাখলেও মানুষের নৈতিকতার কোনো পরিবর্তন হবে না এবং না রাখলেও হবে না। এদেশের মানুষ যে অধঃপতের স্বাদ পেয়েছে অর্থাৎ ধনাসক্তি, অর্থলিপ্সা, পরশ্রীকাতরতা, ক্ষমতার লোভ… ইত্যাদির স্বাদ পেয়েছে এর হাত থেকে জাতিকে ধর্ম কখনোই উদ্ধার করতে পারবে না। যদি পারতো তাহালে এতোদিনে হয়তো তার একবিন্দু সুফল দেখতে পেতাম। এর হাত থেকে উদ্ধার পেতে হলে জনপ্রতিনিধি, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারি, বিচারক, আইনজীবি, পেশাজীবি, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, এক কথায় দেশের সবাইকে ধার্মিক হওয়ার পূর্বে অবশ্যই সৎ ও নীতিবান হওয়ার কোনো বিকল্প নেই; কারণ আমরা ধার্মিক জাতি হয়েই আছি কিন্তু প্রকৃত মানবতাবাদী কখনোই ছিলাম না এবং এখনো নাই! সংবিধানে ধর্মের বাণী থাকলেও আমরা ধার্মিক থাকবো আর মুছে ফেললেও থাকবো, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে দেশের সাধারণ মানুষ তখনই সৎ হবে যখন দেখবে এদেশের জনপ্রতিনিধি ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তা-কর্মচারিরা সৎ হয়েছে, তারা অত্যাধিক ধার্মিক হোক কি না হোক, নৈতিকতাসম্পন্ন এবং ন্যায়পরায়ন না হলে জাতির নিস্তার নাই। নিজেকে এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে শুধুমাত্র একটি প্রশ্ন করুন- আমরা বাঙালিরা কি অর্থ-সম্পদকে বেশি ভালোবাসি, না-কি নিজ নিজ সৃষ্টিকর্তাদের (আল্লা, ঈশ্বর, ভগবান…) বেশি ভালোবাসি? হাতে গোনা কিছু ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে, যদি প্রমাণ দিতে পারেন যে বাঙালিরা ধর্মানুসারে সম্পদের চেয়ে সৃষ্টিকর্তাদের বেশি ভালোবাসে তাহলে যে কোনো দণ্ড আমি মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত!

২০০১ সালে বাংলাদেশে যে সংখ্যালঘু অত্যাচার হলো, তাতে লুটপাটসহ মা-মাসিদের ধর্ষণে আমরা লজ্জিত, ব্যথিত, অপমানিত হলেও এ নিয়ে মু্িক্তযুদ্ধকালীন সময়ের ন্যায় প্রতিবাদ এবং প্রতিশোধ গ্রহণ করি নাই। কিন্তু ধর্মের গায়ে সামান্য টোকা লাগলেই প্রতিশোধ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন- “পৃথিবীতে কোনো ধর্মই নৈতিকতার উর্দ্ধে নয়।” সেই নৈতিকতার একবিন্দুও কি আমাদের আছে? আমাদের নিকট নৈতিকতার চেয়ে ধর্মই কি বড় নয়? স্বশিক্ষিত দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর যথার্থই বলেছিলেন- “…বিজ্ঞানীরা যখন পদার্থের পরমাণু ভেঙ্গে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন, মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন এবং প্রস্তুতি নিচ্ছেন গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাবার জন্য, তখনো তপস্বীরা গবেষণা চালাচ্ছেন, ‘মার্গ দিয়ে বদবায়ু বেরুলে তাতে ভগবানের আরাধনা চলে কি-না’…।” অত্যন্ত দুঃখের বিষয় মানব জাতি বিজ্ঞানের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে কিন্তু বিজ্ঞানের উপরে ধর্মকে বসিয়ে তার পূঁজো করে। যে বিজ্ঞান ছাড়া জীবন অচল, সেই বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত সত্যকে অস্বীকার করে ধর্মের কুসংস্কারে বিশ্বাসী হয়ে আছি। যেমন- পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস এবং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে… ইত্যাদি। যা বিজ্ঞান প্রমাণ করে দেখিয়ে দিচ্ছে তাতে আমাদের বিশ্বাস জন্মায় না, আমাদের বিশ্বাস জন্মায় যা দেখি না, যা আছে শুধু কল্পনায় ও আজব গল্পে। বিজ্ঞান যেভাবে পৃথিবী ও জীবজন্তু এবং মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস প্রমাণ করে দেখিয়েছে সেটাই যদি সত্য না হয়, তাহলে ধর্মও সত্য হতে পারে না। কারণ ধর্ম কোনোরূপ প্রমাণ দিতে পারে না যে এরকমভাবে সৃষ্টিকর্তা তার সমস্ত সৃষ্টি করেছে; কেবলমাত্র অন্ধবিশ্বাস ছাড়া ধর্মের হাতে কোনো প্রমাণ নেই।

নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে রাখা, নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে জাহির করা সব ধর্মালম্বীদের একান্ত বাসান, কামনা এবং ধর্মের প্রধান ও চরম শিক্ষাই এটা। ধর্মই আমাদের এটি শিখিয়েছে জন্মের পরক্ষণেই যখন একটি শিশু কিছুই বুঝে না, তখনই তার কর্ণমূলে ধর্মের বাণীই প্রথম ঢুকানো হয়। যার যার ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ রাখা এবং সব কিছুর উর্দ্ধে স্থান দিতে যাওয়ার ফলেই সৃষ্টি হয়েছে জিহাদের ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের এবং তা প্রায় সব ধর্মের লোকদের মনে বাসা বেঁধে থাকে আমরণ। এখানে কেহ আঘাত করলে তার প্রতিঘাত করার জন্য ধর্মই আমাদের শিক্ষা দিয়েছে। এরূপ মনোভাব প্রকাশ্যে রূপ নিলেই ঘটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাদ দিলাম, কিন্তু ধর্ম নিজের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সেই শিশুকাল হতেই আমাদের মনে অন্য ধর্ম সম্পর্কে একটি ঘৃণাবোধ ও নিজ ধর্ম সম্পর্কে একটি গর্ববোধ সৃষ্টি করে দিয়েছে যা থেকে বেরিয়ে আসা অতি শিক্ষিতজনদেরও আর সম্ভব হয় না। কারণ ধর্ম সম্পর্কে আমরা সকলেই জিজ্ঞাসবিমুখ ও প্রশ্নহীন দাস।

বিখ্যাত দার্শনিক এ্যান রেন্ড বলেছেন- “ধর্মই মানুষের সর্বনাশের মূল। ধর্মকে আমি মানুষের একটি প্রধান শত্র“ বলে মনে করি। …মানুষের নিজস্ব চরিত্র গঠিত হওয়ার আগেই ধর্ম তা ভেঙ্গে দেয়। শিশু বয়সে তাকে মিথ্যে বলতে শেখানো হয়, যখন সে জানে না মিথ্যে শব্দটি কি। তার চিন্তাশক্তিকে ধ্বংস করে দেয়া হয়, চিন্তাশক্তি সম্পর্কে তার জ্ঞান হওয়ার আগেই। তাকে একজন হিপোক্রেট বানানো হয়, জীবন সম্পর্কে তার কোনো ধরনা হওয়ার আগেই। সুতরাং ধর্ম হচ্ছে- মানুষের চিন্তা শক্তির বিরুদ্ধে এক নম্বর শত্রু!”

বর্তমানে আমাদের ধনাসক্তি, অর্থলিপ্সার এ দেশে জন্ম থেকেই শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা দেওয়া হয়, কর্তভজা (ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্রের… কর্তা) শৃঙ্খলায় যাতে তারা বড় হয়ে উপওয়ালার সাথে অনুগতের ন্যায় এবং অধঃস্তনের সাথে পাষণ্ডের ন্যায় আচরণ করতে পারে। শিশুদের শিখানো হয় মিথ্যা, ছলচাতুরি, অধিক মুনাফা, ভেজাল, ঠকানো, ঋণখেলাপী… ইত্যাদি করে কিভাবে অধিক সম্পদ আহোরণ করা যায়। কিভাবে সমাজের ও রাষ্ট্রের একজন নেতা হওয়া যায়। শিখানো হয় নিজেদের মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করতে, অন্যদের সত্যকে এবং বাস্তব সত্যকে কিভাবে বিকৃত ও মিথ্যা বানানো হয়।

আমরা স্বীকার করি বা না-ই করি, পৃথিবীর সমস্ত ধর্মই মৌলবাদ এবং সন্ত্রাবাদ সমর্থন করে! মৌলবাদ জন্মও নেয় ধর্মের বিভিন্ন কুসংস্কার থেকেই। মৌলবাদ জন্মের এবং সমর্থনের বীজ ধর্মের মধ্যেই প্রথিত রয়েছে। ধর্মের মধ্যে যদি মৌলবাদের বীজ না থাকতো তাহালে তা জন্ম নিতে পারতো না। মৌলবাদীরা এমন এমন ধর্মীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করায় তা কোনো অবাস্তব ব্যাখ্যা নয়, ধর্মের কাহিনী এবং ধর্মপুস্তকের আলোকেই তারা এসব ব্যাখ্যা পায় এবং প্রচার করে। মৌলবাদীরা যা চায় তা ধর্মের বাইরের চাওয়া নয়! যেমন- অন্যায়কারী নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা ধর্মেরই বিধান। নারী নেতৃত্ব হারাম, যা ধর্মেই লিপিবদ্ধ রয়েছে। নারী জাতিকে প্রতিটি ধর্মই পুরুষের পদানত করে রেখেছে, তা মৌলবাদীরা বললে কেন তাদের অন্যায় হবে? নারীকে বোরকা পরিয়ে অথবা গৃহের মধ্যে আবদ্ধ রাখার কাহিনী ধর্মেই স্বীকৃত রয়েছে, পুরুষকে নারীর মস্তক, এমনকি কোনো কোনো ধর্মে পুুরুষদের পায়ের নিচে বেহেস্ত বা স্বর্গ। পুরুষের পা ধোয়া জলপান করার কাহিনীও ধর্মেরই সৃষ্ট! স্বামীকে দেবতা জ্ঞান করাও ধর্মেরই শিক্ষা! ধর্মই তো এসব স্বীকৃতি দিয়েছে। নারীদের চরিত্রের যাবতীয় দোষ ধর্মীয় ব্যাখ্যায় রয়েছে কিন্তু পুরুষের চরিত্রের বেলায় ধর্ম তেমন কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি! নারীর চরিত্রের বদনাম দিয়ে অতি সহজে তালাক দেয়ার ব্যবস্থা তো ধর্মই করে দিয়েছে। বেহেস্তে বা স্বর্গে গিয়ে হুর-পরী বা অপ্সরী পাওয়ার কাহিনী তো ধর্মেই রয়েছে; কিন্তু নারীর জন্য এরূপ কোনো লোভ দেখানো হয়নি! ধর্মীয় পোষাক পড়ার কাহিনী, ধর্মীয় ভাষা ব্যবহার করায় পূণ্যি হয়। সৃষ্টিকর্তাদের ভাষা ব্যবহার করা মঙ্গলজনক বুঝি আর না বুঝি! সৃষ্টিকর্তাদের প্রশংসার সাথে সাথে ধর্মাবতারগণের প্রশংসা অবশ্যই বাধ্যতামূলক। অন্য ধর্মালম্বীদের সাথে বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করা হয়েছে কোনো কোনো ধর্মে এবং তাদের শত্র“ ভাবতেও শিখিয়েছে! কে কতোবড় শত্র“ এবং ঘৃণিত তাও কোনো কোনো ধর্মপুস্তকে উল্লেখ করা আছে। মানুষকে নিজ ধর্মের পথে রাখার জন্য জোর-জবরদস্তি ও ভয়-ভীতি দেখানোর কাহিনীও ধর্মেই বর্ণিত রয়েছে। ধর্মীয় যুদ্ধ এবং ধর্মীয় রাজনীতিও ধর্মেই স্বীকৃত। ধর্মীয় অনুশাসনে রাষ্ট্র পরিচালনার করার নির্দেশ তো ধর্মই করে দিয়ে গেছে। নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ তো ধর্মেরই বিধান। ছবি তোলা, ছায়াছবি দেখা, টিভি দেখা, ছবি তোলা, নাচ-গান-বাজনা… এসবও তো ধর্মের বিধানে নিষিদ্ধ। তাছাড়া, ধর্মের বিধানেই হাতের বদেল হাত, চোখের বদলে চোখ নেয়ার ব্যবস্থা রয়েছে এবং এছাড়াও রয়েছে অজস্র রকমের কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক, ভিত্তিহীন কাহিনী… যেমন- ডাইনি, ভূত-পেত্নি, হুর-পরী… তাদের কর্মকাণ্ড সবই তো ধর্মের মধ্যেই রয়েছে। আরো রয়েছে বহুবিবাহ, বহু সন্তান জন্মদান অর্থাৎ জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা, মুখ দিয়েছে যিনি আহার দেবে তিনি এসবই ধর্মেরই বিধান! অন্য ধর্মের প্রতি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। অন্য ধর্মকে ঘৃণা ও সন্দেহের চোখে দেখে আসছে সব ধর্মগুলো নিজ নিজ জন্মলগ্ন থেকেই! ধর্মীয় একটি বিধান, এমনকি একটি শব্দও কেউ বদলাতে পারবে না বলে ধর্মাবতারগণই তো ফতোয়া জারি করে গেছে! তাই বলা যায় যে, মৌলবাদিদের এসব দাবি পূরণের চেষ্টা ধর্মের বাইরে তো নয়। অতএব যারা বা যে গোষ্ঠি জনসাধারণকে এসব মানতে বা করতে বলছে বা বাধ্য করাতে চাচ্ছে অর্থাৎ যাদেরকে আমার মৌলবাদি বলছি, তাদের দোষ কোথায়? হ্যাঁ, তাদের একমাত্র দোষ, যারা এসব মানতে চায় না তাদের হত্যার জন্য তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দ্বারা ধর্ম শিক্ষা বা ধর্ম বিস্তারের জন্য ধর্মযুদ্ধও ধর্মেই স্বীকৃত! তাহলে এদের দোষ কি? ধর্মীয় নেতারাও তো ধর্মযুদ্ধ করেছে! তাহলে? তারা তো এসব কথা নিজেরা তৈরি করে আমাদের বলছে না, তারা তো রেফারেন্স দিচ্ছে এবং আমরাও জানি এসব ধর্মেরই বিধান। তবে কেন তাদেরকে মৌলবাদী বলা হয়? তারাতো ধর্মপুস্তক ও ধর্মাবতারদের জীবন থেকে নেয়া কর্মকাণ্ডের বাইরে যাচ্ছে না! যা ধর্মে স্বীকৃত তাকে কেন মৌলবাদ বলা হচ্ছে? তারা তো ধর্মপুস্তক অথবা ধর্মীয় নেতাদের পথই অনুসরণ করছে!

বাবরি মসজিদ নিয়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেছে, প্রায় দু’লক্ষ লোক হত্যা করা হলো, এতে কোন ধর্মের কি উন্নতি হয়েছে? ধর্মীয় কারণে পৃথিবীতে এরূপ অনেক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে গেছে এবং এখনও ঘটে চলছে। এমনকি একই ধর্মালম্বীদের মধ্যে প্রতিদিন খুনোখুনি হচ্ছেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো- রামের জন্মস্থান অথবা রহিমের জন্মস্থান না হয়ে যদি সেই স্থানটি আইনস্টাইন বা গ্যালিলিও অথবা ডারউইনের হতো তাহলে কি এরূপ হত্যাযজ্ঞ ঘটতো? কখনোই না। ৯/১১-তে আমেরিকাতে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটালো তথাকথিত ইসলামের সৈন্যরা আবার সেখানে ইসলামিক সেন্টার ও মসজিদ করার জন্য এখন বিতর্ক চলছে, চলছে উত্তেজনা। আমাদের লজ্জা লাগে যখন দেখি ৯/১১ পালন করতে ওরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে মসজিদ করার পক্ষে ও বিপক্ষে শ্লোগান দেয়, প্লেকার্ড বহন করে। ওদের নিকট ধর্ম বড় কিন্তু মানুষ বড় নয়! এতোগুলো মানুষ যেদিন বিনা অপরাধে মারা গেলো সেদিন ওরা মসজিদ হবে না গির্জা হবে তা নিয়ে বিতর্ক ও উত্তেজনার সৃষ্টি করে! প্রশ্ন হলো- কেন বিতর্কিত স্থানেই জোর করে বা লবি করে বা সুপারিশের ভিত্তিতে বা অনুনয় বিনয় করে হলেও ধর্মালয় স্থাপন করা জরুরি বলে মনে করছে এসব ধার্মিকরা। না? এর কারণ কি এই নয় যে, কোনো ধর্মের লোকরাই হার মানতে রাজি নয়, যে করেই হোক আমার নিজ ধর্মের ধ্বজ্জা তুলে ধরতেই হবে। এমন এক হৃদয়বিদারক ঘটনার পর আবার সেখানেই কেন ধর্মালয় করার পরিকল্পনা করছে ধার্মিকরা অন্যত্র ধর্মালয় গড়লে কি তাদের ধর্মের ক্ষতি হয়ে যাবে, তাদের ধর্ম নষ্ট হয়ে যাবে? এ স্থান ছাড়া কি অন্য স্থানে ধর্মালয় তৈরি করলে তাদের সৃষ্টিকর্তা খুশি হবে না, অভিশাপ দেবে? বাবরি মসজিদের ঘটনা আর ৯/১১-এর ঘটনার নেতা, সমর্থক ও অনুসারিরা যতোদিন এ পৃথিবীতে থাকবে ততোদিন ধর্ম নিয়ে বিবাদও থাকবে, রক্তপাতও ঘটবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। ধর্মে যুদ্ধ, বিতর্ক এবং জোর খাটানো মতবাদ কেন থাকতে হবে, তাহলে তা কিসের ধর্ম? ধর্মালয় তৈরি নিয়ে যদি কেউ বিতর্ক তোলে সেখানে না যাওয়াই তো ধার্মিকের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম হওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবে আমরা কি দেখছি? সর্বত্রই এর উল্টোই দেখছি, তাহলে এরা কিসের ধার্মিক?
পৃথিবীর যতো ধর্মপ্রবর্তক ছিলো তারা যে সময়ে জন্মেছে, সে সময়ে যদি তারা জন্ম না নিয়ে আইনস্টাইন, গ্যালিলিও, ডারউইন, মার্কিনী, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু… এরা জন্ম নিতো তাহলে কি মানব ইতিহাস আরো শত-সহস্র বছর এগিয়ে থাকতো না? ধর্ম প্রবতর্কগণ পৃথিবীকে কি দিয়েছে? ধর্ম শিক্ষার বাইরে তারা এমন কি দিয়েছে মানুষকে? অথচ বিজ্ঞান কি-না দিয়েছে? বিজ্ঞান যা দিয়েছে তার এক কোটি ভাগের একভাগও কি ধর্ম দিয়েছে? কক্ষণো না। ধর্ম এবং বিজ্ঞান দু’টোই দুই মেরুতে অবস্থান করছে। বিজ্ঞান যা বলে তা চাক্ষুস প্রমাণ করেই বলে কিন্তু ধর্ম যা বলে তার কোনো চাক্ষুস প্রমাণ নেই সবটাই কল্পনাপ্রসূত এবং অদৃশ্য। ধর্মের মধ্যে আছে অজস্র রকমের কুসংস্কার, মিথ্যা এবং কল্পকাহিনী; যেমন- সূর্য পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে! কিন্তু বিজ্ঞানে তা নেই। বিজ্ঞান হাতে-কলমে দেখিয়ে দেবে এটা না ওটা আবার বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল আজকের আবিষ্কার কালকে আরো উন্নত হতে পারে, পরিবর্তনও হতে পারে কিন্তু ধর্ম পরিবর্তন করা যাবে বলে ধর্ম প্রবর্তকগণ যে ফতোয়া দিয়ে গেছে তা আকড়ে ধরেই আমরা হানাহানি, রক্তারক্তি করেই চলেছি। তাছাড়া প্রতিটি ধর্মের কাহিনীই হলো যুদ্ধবিগ্রহের কাহিনী। কোনো কোনো ধর্মের পুরো ইতিহাসই যুদ্ধের ইতিহাস, সেখানে কখনো সৃষ্টিকর্তা নিজে অথবা তার প্রেরিত স্বর্গদূত বা ফেরেস্তারা এসে যুদ্ধ করেছে! কিন্তু আমার প্রশ্ন, সৃষ্টিকর্তারা তো সর্বশক্তিমান, যা বলে তাই হয়, তাহলে কেন তাদের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো, কেন যুদ্ধ করে তাদের উম্মত বা অনুসারী বানাতে হয়েছিলো অথবা অবাধ্যকে বশে আনতে হয়েছিলো? ধর্ম যদি যুদ্ধ সমর্থন না করতো তাহলে বোধকরি আজকের এসব ধর্মীয় মৌলবাদী যুদ্ধবাজ নেতার জন্ম হতো না। অথবা তারা তথাকথিত এই ধর্মযুদ্ধকে সমর্থন দিতে পারতো না। তাছাড়া কোনো ধর্ম কখনোই অন্যের প্রতি বৈরিতা এবং অন্যের আগ্রাসনের জন্য যুদ্ধ না বাধিয়ে মিমাংসা করাই শ্রেয় মনে করতো। কারণ যুদ্ধ করলে বৈরিতা এবং আগ্রাসনের চাইতে আরো অনেক অনেক বেশি ক্ষতি হয়।

বিজ্ঞান দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মানুষ সৃষ্টি হয়েছে আদম সৃষ্টির প্রায় ৫০ লক্ষ বছর পূর্বে। অথচ ধর্মানুসারে পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র এবং পৃথিবীর যাবতীয় সৃষ্টি হয়েছে মাত্র সাতদিনে। সেই একই সময়ে আদমকেও মাটি দিয়ে তৈরি করেছে আমাদের অদৃশ্য বিধাতা! তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আদামের ও পৃথিবীর বয়স একই, মাত্র ছয়-সাতদিনের ব্যবধান। তাহলে আদমের বয়স কতো? বিশেষজ্ঞদের মতে আদমের বয়স ৬,০১৪ বছর। কারণ ধর্মের দাবি যদি সত্যি ধরে নেই তবে দেখা যায় যে, আদমকে তৈরি করা হয়েছিলো ৪০০৪ খিস্টপূর্বে আর এখন ২০১০ খ্রীস্টাব্দ। (অতএব আদমের বয়স, ৪০০৪+২০১০=৬,০১৪)। পৃথিবী সৃষ্টি ও আদমের সৃষ্টি থেকেই তো ধর্মের উৎপত্তি, যদিও আদমের ধর্ম কি ছিল তা জানা যায় না। অর্থাৎ আদম কি হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান বা মুসলমান ছিলো কিনা? যাহোক ধর্মপুস্তকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আদম তার সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করতো। অথচ বিজ্ঞানের প্রমাণিত সত্য যে, ধর্মের উৎপত্তি যে সময়ে হয়েছিলো তার বহু পূর্বে মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে। আমার যতদূর মনে পড়ে, বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার এটি প্রমাণ করেছে যে, প্রায় ৫০ লক্ষ বছর পূর্বে মানুষ পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে রূপান্তরিত হয়, তবে এখনকার ন্যায় জ্ঞান-বুদ্ধি তাদের ছিল না। অন্যদিকে হিন্দু বা সনাতান ধর্মের ইতিহাস ঘাটলে, শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বার্ষিকী হিসেব করে দেখা যায়, মাত্র ৫ থেকে ৬ হাজার বছর পূর্বে মানুষ প্রকৃতির পূজা এবং বিশেষ করে সূর্য পূজার মাধ্যমে ধর্ম পালন করতে শুরু করেছিলো। সেই ৫০ লক্ষ বছর আগেকার মানুষ এখনকার ন্যায় প্রকৃতির লীলাখেলা বুঝতে পারতো না বলেই এক সময় বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভীত হয়ে এদের দেবতা মনে করে পূজা দিতে শুরু করেছিলো। পরবর্তীতে পূজা পরিচালনা ও ধর্মনেতা হওয়ার প্রলোভন থেকেই জন্ম নেয় একশ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী। অতএব ধর্ম সৃষ্টির পরপরই ধর্ম একটি লাভজনক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান পরিণত হয়েছিলো। ধর্মপুস্তক অনুসারে দেখা যায়, যখন সৃষ্টিকর্তা সব সৃষ্টি করেছিলো তখন তো এরা সকলেই একটি বাগানে ছিলো কিন্তু সে বাগানটি নাকি ছিলো স্বর্গে তবে কিভাবে এতো কোটি কোটি প্রজাতির জীব পৃথিবীতে এলো? তাছাড়া একেক এলাকার একই প্রজাতির জীব দেখতে বিভিন্ন রকমের হলো কিভাবে? যেমন পৃথিবীর সব দেশের মানুষ তো একরকম নয়, সব দেশের বাঘ-ভাল্লুক ইত্যাদিও একই রকমের নয় কেন?

ধর্ম বলছে এ পৃথিবী মাত্র সেদিন সৃষ্টি হয়েছে, অর্থাৎ আদমের বয়সের সমান! অথচ বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলছেন, এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে ১,৬০০ কোটি বছর পূর্বে এবং পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ৪৬০ কোটি বছর পূর্বে। আর পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব ঘটেছে সম্ভবত ৩৫০ কোটি বছর পূর্বে। বিজ্ঞানীদের এসব হিসেব-নিকেশ ভুল বলে ধরে নিলেও তাদের হাতে যে বাস্তব প্রমাণ রয়েছে তাতেও তো সৃষ্টিকর্তাদের পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির ইতিহাস কোনোভাবেই সত্য নয়! কারণ এখনো যেসব ফসিল আবিষ্কৃত হচ্ছে, যেসব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে, তাও আদম জন্মের হাজার হাজার বছরের পূর্বেকার।

ধর্মানুসারে মানুষ বিশ্বাস করে ঈশ্বরই প্রথম মানুষ সৃষ্টি করেছে মাটি দিয়ে যদিও হিন্দুরা মনে করে ব্রহ্মার (সৃষ্টিকর্তার বা ঈশ্বরের) একটি অংশ দিয়ে মনুকে সৃষ্টি করা হয়েছিলো। যাহোক, পরবর্তীতে পিতা-মাতার যৌন মিলনের ফলেই মানুষ সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাও নাকি ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই হচ্ছে! কিন্তু প্রশ্ন হলো- আজকাল পিতা-মাতা তাদের ইচ্ছামত সন্তান নেয় কিভাবে? কারো যখন ইচ্ছা তখন সন্তান নেয়, কিন্তু পূর্বে তা পারতো না, পিতা-মাতারা তখন একেক মায়ের গর্ভে ১০ থেকে ২৫ টি সন্তান জন্ম দিতো বা হয়ে যেতো। ফলে পৃথিবী এখন মানুষে পরিপূর্ণ এবং প্রকট খাদ্যাভাবও একই কারণে। বর্তমানে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ৭’শ কোটির কাছাকাছি, এর মধ্যে ২’শ কোটির উপরে অভুক্ত থাকে। আর যদি বৈজ্ঞানিকরা আজ পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হতো তাহালে বর্তমানে পৃথিবীতে লোকসংখ্যা কতো হতো এবং কতো লোক না খেয়ে থাকতো? তা বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন, তবে আমার মনে হয়, লোকসংখ্যা হতো ২ হাজার কোটির ওপরে এবং অভুক্ত থাকতো ১৫’শ কোটির উপরে। যদি মানুষ আরো পূর্বে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারতো, তাহলে কি এতো বেশি মানুষ জন্ম নিয়া এভাবে কুকুর-বেড়ালের ন্যায় জীবন-যাপন করতো? যেহেতু বর্তমান পৃথিবীতে তিনভাগের দুইভাগ মানুষ একবেলাও খেতে পাচ্ছে না, রাস্তাঘাটে, ডাস্টবিনের মধ্যে বাস করছে, ডাস্টবিনের পচা খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে, তাদের শরীরে সব সময় নোংরা কাদা-ময়লায় মিচমিচে কালো হয়ে রয়েছে। তারপরও কি করে মেনে নিতে পারি যে, সৃষ্টিকর্তারা তাদের সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে এভাবে কুকুর-বেড়ালের ন্যায় জীবন-যাপনে বাধ্য করছে! এতে তাদের গৌরবের কি আছে, তাদের কেন এতো আনন্দ! নিজের সৃষ্টি কষ্ট পাক, নিজের সৃষ্টি খারাপ হোক, নিজের সৃষ্টি অসমাদৃত হোক… তা কোনো সৃষ্টিকর্তাই চাইতে পারে না। তাছাড় প্রশ্ন, এখন কেন পূর্বের ন্যায় সৃষ্টিকর্তারা এক গর্ভে ১০ থেকে ২৫টি সন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ? এটা কি বিজ্ঞানের কল্যাণে নয়? নাকি কি এটা ধর্মের কল্যাণে? যদি বলা হয় ধর্মের কল্যাণে তবে তার প্রমাণ কি? বিজ্ঞান কিন্তু প্রমাণ করেই দিয়েছে! আমরা কি বিশ্বাস করি? দম্পতিরা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেই নিশ্চিন্তে থাকে। কিন্তু যারা এটি গ্রহণ করে না তার কি নিশ্চিন্তে থাকে যে তাদের সন্তান জন্ম নেবে না? প্রায় সব ধর্মই আমাদের উৎসাহ দিয়ে আসছে- বেশি বেশি বিয়ে করো এবং বেশি সন্তান জন্ম দেও, বেশি বেশি পূণ্যি লাভ হবে! বেশি সন্তান সৃষ্টিকর্তারা পছন্দ করে, কারণ এতে তাদের উম্মত বা অনুসারী বৃদ্ধি পায়! ফলে পৃথিবীতে বিশেষ করে ধর্মভীরু দেশগুলোতেই আজ জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত। ক্ষুধার্ত, রুগ্ন, হাড়জিরজিরে, অসহায় মানুষ আর বস্তিতে সয়লাব। অথচ বলা হয় ধর্মাবতারাগণ সব জানতো, তাই যদি জানতো তাহলে তারা বহু বিয়ে এবং বহু সন্তান নিতে বলেছে কেন? কেন তারা জন্মনিয়ন্ত্র পদ্ধতিটা আবিস্কার করে যেতো পারলো না? তাহলে তো পৃথিবীতে আজ এতো মানুষ থাকতো না এবং খাদ্যাভাবও থাকতো না, থাকলেও তা এতোটা প্রকট হতো না। বরং এর বদলে তারা বেশি বেশি জন্ম দিয়ে নিজ নিজ ধর্মানুসরীদের বৃদ্ধি করে নিজেদের ধর্মালম্বীদের শক্তিশালী করতে উৎসাহ জুগিয়েছে এই বলে যে, জন্ম দিয়েছে যিনি আহার দিবেন তিনি! কই আমাদের দেশে অজস্র মানুষ আছে জন্মের পরে জীবন শেষ হওয়া অবধি তারা কোনোদিনও তিনবেলা দূরে থাক একবেলা ঠিকভাবে খাবার পায়নি, যদিও কখনো জুটেছে তাও অখাদ্য এবং অর্ধপেটা। আজীবন কতো লোকই তো অর্ধপেটা এবং অখাদ্য খেয়ে, ডাস্টবিন ঘেটে খেয়ে, ফুটপাথে বাস করে জীবন পার করে দিয়েছে, কেউ কি তার হিসেব রেখেছে! এসব অজস্র মানব সন্তানকে সৃষ্টিকর্তারা সৃষ্টি করে তথা জন্ম দিয়ে কি এমন উপকারে লাগিয়েছে, কি এমন প্রশংসা তাদের প্রয়োজন যে এসব মানুষদের জন্ম দিতেই হবে! অনাহারীদের প্রশংসা না পেলে কি তাদের স্বর্গরাজ্যের বা নিজেরদের কোনো ক্ষতি হতো?
আবার ধর্মাবতারগণ শুধু ধর্মীয় নেতাই নয়, তাদের কাউকে কাউকে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও বলা হয়; অথবা সৃষ্টিকর্তাদের সমকক্ষ বলেও প্রচার করা হয়! প্রতিটি ধর্মই তার নিজ নিজ ধর্মপ্রবর্তকদের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাবতার, সর্বশ্রেষ্ঠ ডাক্তার, সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, অদ্বিতীয়, সর্বজ্ঞ… ইত্যাদি বলে থাকেন। প্রশ্ন হলো- সবই যদি তারা জানতেন তাহলে কোন পৃথবীর এই দুরাবস্থা? এখনকার মতো বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা তাদের মাথায় কক্ষণো ছিলো না কেন? আর সব আবিষ্কারের কথা বাদ দিলাম, কেন তারা জন্মনিয়ন্ত্র আবিষ্কার করে দেন নাই? কেন তারা বেশি বেশি সন্তান জন্ম দিতে নিরুৎসাহিত না করে উৎসাহিত করেছে? তারা যদি সবজ্যান্তা হয় তাহলে এটা কেন জানতো না যে, বেশি বিয়ে এবং বেশি সন্তান জন্ম দেওয়ার কি করুণ ও ভয়াবহ পরিণত হতে পারে? বিজ্ঞানের অন্য সব আবিষ্কার বাদ দিয়ে, যদি তারা এই একটিমাত্র আবিষ্কার করে যেতো তাহালে পৃথিবীতে আজ ২’শ কোটির উপরে মানুষ চিরজীবন অসুখে ভুগে, ডাস্টবিন ঘেটে খেয়ে, ডাস্টবিনের পাশে বাস করে, পচা সুবাসিত বাতাসে যারপর নাই মানবেতর জীবন-যাপন করতো না। যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ঈশ্বর কি তার সৃষ্ট মানুষের ব্যাপারে নিরপেক্ষ? এর একমাত্র উত্তর হতে পারে- না। কারণ আমেরিকা, কানাডা এসব দেশে লক্ষ লক্ষ একর জমি পড়ে আছে বসবাস এবং চাষাবাদ করার লোক নেই, অথচ এদেশে মানুষের সংখ্যা এতো বেশি যে মাথা গোঁজার স্থান নেই। তা কেন? এসব মানুষ কেন তিনি এতোটুকু দেশে জন্ম দিলেন? তিনি যদি নিরপেক্ষ হতেন তাহালে সমস্ত পৃথিবীতেই তো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মানুষগুলোকে রাখতে পারতেন! তবে কি তিনি সেইসব দেশগুলোকে বেশি পছন্দ করেন যেসব দেশের জনগণ আমাদের চোখে নাস্তিক, কাফের ইত্যাদি? তা কেমন করে হয়? তিনি তো তার প্রশংসা ব্যতিরেকে তার সৃষ্ট মানুষকে পছন্দ করতে পারেন না!

যাক সেকথা, মূলতঃ ধর্ম চিরকালই সাধারণ শ্রেণীকে শোষণের একটি মোক্ষম হাতিয়ার। যাদের জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেচনা এমন কি প্রশ্ন করার ক্ষমতাও নেই তারাই এসব খুব সহজেই মেনে নিয়ে তাদের দুর্ভাগ্যের জন্য ধর্মের শিক্ষানুসারে নিজের পাপকেই দায়ী করেন এবং এতে লাভবান হয় ধর্মজীবিরা। তবে ধর্ম যখন শিক্ষিত শ্রেণীকে ধারণ করে রাখে তখন তা আরো মারাত্মক ও নিষ্ঠুর আকার ধারণ করে এবং তখনই তা সবচেয়ে বেশি গোঁড়ামিতে পরিপূর্ণ থাকে; তখন তা আর ধর্ম থাকে না। এখন তো সমস্ত পৃথিবীতে তাই-ই হচ্ছে। বর্তমান পৃথিবী ধর্মীয় গোঁড়িমিকে সামাল দিতেই তো বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে; তা না হলে দরিদ্র মানুষের দারিদ্রতার হয়তো কিছুটা লাঘব হতো। আমরা বিজ্ঞান শিক্ষা করি এবং এর আবি®কৃত সবকিছুর ফলভোগ করি, তবে ধর্ম বিশ্বাসে গা ডুবিয়ে রেখেই তা করি। পাড়ালেখা শেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, বিজ্ঞানী… হই এবং বিজ্ঞানেও থাকি, ধর্মেও থাকি। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সুফল ভোগ ও ব্যবহার করেও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করি না, গ্রহণ করি ধর্মকে। তাই বিজ্ঞান আমাদের অনেকের কাছেই কেবল একটা পেশা হিসেবেই থেকে যায়; যেমন- জমির দালালি, আলু-পটলের ব্যবসা ইত্যাদি। যার ফলে সৃষ্টি হয় গোঁড়ামির। যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’জন শিক্ষকই হিযবুত তাহরির প্রধান হিসেবে এদেশকে ধর্ম রাষ্ট্র বানাবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল এবং তাদের বহু শিক্ষিত অনুসারীরা এখনো দেশে এবং দেশের বাইরে সক্রিয় রয়েছে। তাছাড়াও রয়েছে এরূপ বহু ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন। এই তো ক’দিন পূর্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক শিক্ষকের বাসা থেকে জেহাদি বইপত্র ও খেলানা পিস্তল উদ্ধার করা হলো এবং দু’জন শিবিরের কর্মীকে গ্রেফতার করা হলো। এছাড়াও গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখ সকাল ৭:৩০ মিনিটের বিবিসির খবরে পত্রিকা পর্যালোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক বললেন- “একটি মুসলিম দেশের উচিত হবে না আরেকটি মুসলিম দেশে সৈন্য পাঠানোর।” তিনি এ উক্তিটি করেছেন আমেরিকা বাংলাদেশের নিকট আফগানিস্তানে সৈন্য প্রেরণের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রশ্ন হলো- এই যে আমরা বলছি মুসলিম বিশ্ব, মুসলিম রাষ্ট্র এতে কি সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের অনন্তর্ভূক্তির প্রয়োজন আছে? মোটেও নেই, কারণ এটি জনগণের মনেপ্রাণে গেঁথে আছে যে এটি একটি মুসলিম রাষ্ট্র এতে সংবিধানের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে এরূপ কথা বলা উচিত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ খ্রীস্টান, ইহুদি বা হিন্দু বিশ্ব বলে কেউ বলছে কিনা আমার জানা নেই, কেবলমাত্র মুসলিম বিশ্ব, মুসলিম রাষ্ট্র বলে নিজেদেরকে আমরা আলাদা স্বত্ত্বা, আলাদা জাত-ধর্মের পরিচয় মনে করিয়ে দিচ্ছি, এর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এতে বিশ্বকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। মানুষের বা মানবতার কোনো বিশ্ব থাকতে নেই। মুসলিম বিশ্ব, ইহুদি বিশ্ব, হিন্দু বিশ্ব, খ্রীস্টান বিশ্ব… এসব বলে মানবতাকে অপমান করা হচ্ছে এবং নিজেদেরকে জাহির করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি, যা নি¯েপ্রায়জন এবং হীন্যমনতার পরিচায়কও বটে। আর এমন একটি মুসলিম দেশ দেখাতে পারবেন যে মুসলিম দেশটি অন্য মুসলিম দেশকে বন্ধু মনে করে তার উপর নির্ভর করে, তাকে বিশ্বাস করে? একটিও নেই। প্রতিটি আরবিয়ান দেশ একে অপরকে চরম অবিশ্বাস করে এবং সর্বদাই রণসজ্জা প্রস্তুত রাখে একে অপরের প্রতি, তারপরও মুসলিম উম্মা-মুসলিম বিশ্ব, মুসলিম ভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি বলেই বেড়াচ্ছি আমরা। কিন্তু অন্য ধর্মালম্বীরা তা বলে কিনা এবং নিজেদের বিশ্ব আলাদা করেছে কিনা তা আমার জানা নেই। এ বাস্তবতাকে উপলব্ধি করার জ্ঞান ও ক্ষমতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে আমাদের যে একটি বিশ্ব থেকে নিজেদের আলাদা ভাবলেও আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসের প্রচণ্ড অভাব রয়েছে, তাই একমাত্র ইস্রায়েলের সাথে সমস্ত আরব রাষ্ট্রগুলো কিছুই করতে পারছে না।

মানুষ জ্ঞানে বিজ্ঞানে যতোই উন্নতি করুক না কেন একটি বিষয়ে মানুষ নিরেট মূর্খ এবং তাহলো- তার জন্মগতভাবে প্রাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম! যা সকলেই বিনা বাক্যে এবং প্রশ্নহীনভাবেই মান্য করে। পক্ষান্তরে মানুষকে অনেক কষ্ট করে, অর্থ খরচ করে বিদ্যাবুদ্ধি অর্জন করতে হয় কিন্তু ধর্মকে অর্জন করতে হয় না। ধর্ম সব সময়ই আমরা জন্মগতভাবে প্রাপ্ত হই এবং আমাদের প্রশ্নহীন আনুগত্যতাই ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে। একজন হিন্দু জন্ম নেয় হিন্দু হয়ে, মুসলমান নেয় মুসলমান হয়ে, খ্রীস্টান নেয় খ্রীস্টান হয়ে…। এই জন্মগতভাবে প্রাপ্ত ধর্ম আমাদের মনের গভীরে এমনভাবে প্রথিত থাকে যে উহাতে কোনো খাদ আছে কিনা তা কোনোদিনও প্রশ্ন করে দেখি না, এমনকি প্রশ্ন করার কল্পনা এবং সাহসও করতে পারি না।

ধর্ম সম্পর্কে শওকত বাঙালি ও আসাদ করিম খান প্রিয় সম্পাদিত “বিধ্বস্ত মানবতা” বইটির ১৮১ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- “…‘অহিংসা পরম ধর্ম’ এবং ‘ইসলাম শান্তির ধর্ম’- যারা একথা প্রচারে দশদিক আলোড়িত করে, তারাই তাদের সেই ধর্ম রক্ষা করতে বহু মানুষকে বলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।”
বিধ্বস্ত মানবতা বইটিতে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, তাহলো:-“(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন। বিলোপ করা হইবে।” অর্থাৎ এ ৪টির উত্তরই না। যেমন:- সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা করা যাবে না। রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যদা দান করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না। কোন বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাঁহার উপর নিপীড়ন করা যাবে না। যখন আমাদের দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারটি সংবিধান থেকে তা মুছে দিলো তখন এর উত্তর হ্যাঁ-না কোনটাই আর রইলো না। এ মৌনতাই সম্মতির হ্যাঁ। অর্থাৎ কি দাড়ালো সাম্প্রদায়িকতা যেমন নিষেধ নয়, আবার অন্য ধর্মপালনকারীদের নিধনেও বাধা নেই। রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োতে গিয়ে শ্রেষ্ঠ স্বৈরাচার এটি মুছে ফেললো। পরবর্তীতে আরেক স্বৈরাচার এসে সেখানটায় বসিয়ে দিলো- এখন যা আদালত কর্তৃক অবৈধ ঘোষণা করেছে এবং তা রাখা না রাখার প্রশ্ন উঠছে। তবে ড. শাহ সাহেবের ন্যায় এদেশের বেশিভাগ মানুষের কাছে তা রাখাটাই জরুরি। কিন্তু জরুরি কেন? উপকারটা কি? অপকারটাই বা কি? জরুরি কারণ, এদেশের বেশিরভাগ মানুষই ধর্মভীরু, তাই? উপকারটা কি এই যে এটি সংবিধানে রাখলেই আমরা সৎ হয়ে যাবো? অপকারটা কি যে, এটি না রাখলে ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকবে না অথবা আমরা নষ্ট হয়ে যাবো, আমরা নাস্তিক হয়ে যাবো? আমি মনে করি এর কোনটাই নয়, এটি রাখলেও জাতির কোনোই উন্নতি হবে না; আর না রাখলেও হবে না। জাতির উন্নতি যদি ধর্মে হতো তাহলে উন্নত বিশ্ব আমেরিকা-ইউরোপে ধর্মকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হতো না। আর ধর্মকে বাদ দেওয়ার ফলে তাদের রাষ্ট্রে যে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ পড়েছে তার তো একবিন্দু প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে না। বরং তারা রাষ্ট্র ও ধর্মকে এক করে গুলিয়ে ককটেল বানালেই তা হতো ধর্মীয় কতিপয় রাষ্ট্রের ন্যায় ভয়ংকর।

২০০১ সালে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগারিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এলো সম্মিলিতভাবে এদেশের ইসলামের সাধক, রক্ষক ও পালনকর্তারা। তখন কিন্তু আমাদের কাঙ্খিত জরুরি বিষয়টি, অর্থাৎ সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এবং ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংবিধানে পাকাপোক্তভাবেই ছিলো এবং এখনও আছে। কিন্তু তখন কি এদেশের সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ সর্বশক্তিমান ঠেকাতে পেরেছিলো? আমার নিজ উপজেলা বরিশালের আগৈলঝাড়াতে যা ঘটেছে এর সামান্য কিছু অতি নিকট আত্মীয়দের কাছে শুনেছি। যে দিন “আল্লার মাল আল্লা নিয়ে গেছে” বলে পরিচিত তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগৈলঝাড়া যায় ঘটনা ধামাচাপা দিতে, সেদিন আমার এক নিকট আত্মীয় সেখানে উপস্থিত ছিলো। আমার সেই আত্মীয় বলেছে, অনেক নির্যাতিত মহিলা-পুরুষদের টাকা দিয়ে এবং শিখিয়ে আনা হয়েছিলো যেন তারা বলে যে, তেমন কিছুই হয়নি। কিন্তু দাঙ্গায় সর্বস্বহারা এক মহিলা তাদের কথায় রাজি হয়ে মঞ্চে উঠে ‘হাঁটে হাড়ি ভেঙ্গে’ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কার কি ক্ষতি হয়েছে তা আমি বলতে পারবো না, আমার বাড়ির সব লুট হয়ে গেছে, ভাংচুর করা হয়েছে এবং মায়ের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছে…। তারপরও তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরে বলেছে, তেমন কিছু হয়নি। একাত্তরে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম বর্বর পাকিদের নির্যাতনের কথা গ্রামে তেমন একটা শুনতে পেতাম না। পাশের বাড়ির একটি লক্কর-ঝক্কর রেডিওতে ঝাঁকিয়ে-বাঁকিয়ে কিছুটা শুনতাম। তবে মনে আছে, যেদিন আমাদের গ্রামে বর্বর জানোয়ারগুলো ঢুকেছিলো সেদিন একটি বাড়িও আস্ত ছিলো না, সবক’টি পুড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিরা। আমাদের বাজারটি পুড়িয়ে দিয়েছিলো, সেখানে হিন্দু মন্দিরের এক সাধুকে গুলি করে মেরেছিলো, পরে গিয়ে গ্রামের সকলের সাথে লাশটি নিজ চোখে দেখেছিলাম! পাকিরা গ্রামে ঢোকার পূর্বেই গ্রামের সব লোক বিলের মধ্যে গিয়ে গলাপানিতে আশ্রয় নিয়েছিলো বলে রক্ষা। তখন বাড়ির পাশের খালে প্রায়ই মরা মানুষ এসে কচুরিপানায় আটকে গেলে আমরা ছোটরা লগি-বৈঠা দিয়ে তা স্রোতে ভাসিয়ে দিতাম কারণ গ্রামে কোনো পুরুষ মানুষই থাকতো না। তারা প্রায় সবাই প্রতিদিন বিলের মধ্যে গিয়ে থাকতো, কেউ কেউ পরিবার-পরিজন নিয়ে গিয়ে সেখানে কচুরিপানা দিয়ে ধাপ তৈরি করে থাকতো। পরবর্তীতে বইপুস্তক পড়ে যা জেনেছি তাতে পাকিস্তানীদের আমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট পশু ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। তাদের প্রতি আমার এ ঘৃণা যেমন যাবে না, তেমনি করে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাঙালি পশুরা যা করেছে তাদের প্রতিও আমার ঘৃণা শত ভালো কাজ করলেও যাবে না। বাঙালি এ পশুরা আমাদের এলাকাতেই নয় পুরো দেশেই- মায়ের সামনে মেয়েকে, মা-মাসি-পিসি-মেয়েকে একই সাথে ধর্ষণ করেছে। লুটতরাজ, হত্যা, পিটিয়ে আহত, অগ্নিসংযোগ… করেছে। পাকিদের চেয়ে স্বাধীন দেশের এসব বর্বরা কোনো অংশে কম নির্যাতন করেনি। যদি ওরা মুক্তিযুদ্ধের মতো ৯ মাস ধরে অত্যাচার চালাতে তাহলে পাকিদের চেয়ে বরং বেশিই হতো। আমার প্রশ্ন, তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং বিস্মিল্লাহ থাকা সত্ত্বেও মানবতার এবং মানব জাতির কি উপকারটা হয়েছে? তাই আমি বিশ্বাস করি, এটি সংবিধানে রাখলেও এদেশের হতদরিদ্র, নিষ্পেষিত, নিপীড়িত, ক্ষুধার্ত, ব্যাধিগ্রস্ত এবং সাধারণ জনগণের কোনো মঙ্গলই হবে না। হতে পারে না। কারণ ধর্মকে আমরা সংবিধানের প্রতিটি লাইনে ঢুকিয়ে রেখে আত্মতৃপ্তি পেতে পারি মাত্র, কিন্তু তা যদি আমাদের হৃদয়ে না থাকে, তবে এর কানাকাড়ি মূল্যও নেই। বরং এতে অন্য ধর্মালম্বীদের ছোট করা ছাড়া আর কোনো উপকারেই আসবে না। সংবিধানে ধর্ম সংযোজন করলেই ধর্মের মান-সম্মান বৃদ্ধি পায় এবং সেই ধর্ম শ্রেষ্ঠ হয়ে যায়, একথা বোকা ছাড়া অন্য কেউ বিশ্বাস করতে পারে না। ধর্মের মান-ম্মান বৃদ্ধি পায় কেবল ওই ধর্মের মানুষের নৈতিকতা, আচার-ব্যবহার, সহনশীলতা, সহিষ্ণুতা, সততা, বিশ্বস্ততা, লোভ-লালসাহীনতা, দয়াশীলতা, করুণা, শ্রদ্ধা-ভালোবাসা, প্রেম, সহমর্মিতা, উদারতা, ক্ষমাশীলতা, ভ্রাতৃত্ব, বন্ধুত্ব… এক কথায় মানবিকতা ও নৈতিকতার গুণে। কিন্তু এর একটিও আমাদের চরিত্রে আছে কি? যদি থাকে তবে প্রমাণ কোথায়? আর যদি না থাকে তবে সংবিধানে কেন দেশের সর্বত্রই ধর্মীয় অনুশাসন, ধর্মীয় বার্তা দিয়ে ভরে রাখালেও (যদিও তা রয়েছে) কোনো লাভ হবে না! হতে পারে না, কারণ ধর্মীয় অনুশান চালু আছে এমন রাষ্ট্রের অবস্থা তো আমরা প্রতিদিনই দেখছি, সেখানে কিভাবে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে।
বিধ্বস্ত মানবতা বই থেকে নেয়া, এক মা ধর্ষকদের বলছে- “…বাবারা তোমরা দুই-তিনজন করে এসে, আমার মেয়েটি ছোট, সবাই একেত্রে এলে মেয়েটি বাঁচবে না।” “…রাতের অন্ধকারে টর্চ মেরে পুকুরে ডুব দিয়ে আত্মরক্ষা করতে যাওয়া রাণী দাসকে চুল ধরে টেনে তুলে ধর্ষণ করা হয়।” “…১২ বছরের পূর্ণিমা, ১০ বছরের মালতি কিংবা বানারীপাড়ার বিলের মাঝে আত্মগোপনকারী ১৪-১৫টি কিশোরী-তরুণী কীভাবে সভ্যতার নোংরাতম রূপটি প্রত্যক্ষ করলো।” “…এক পিতা তার সামনেই মেয়েকে ধর্ষণের দৃশ্য সইতে না পেরে হার্টঅ্যাটাকে মারা গেছেন।” উপরোক্ত ঘটনাগুলো ছাড়া আরো অনেক ঘটনাই স্বাধীন বাংলাদেশেই ২০০১ সালে সংঘটিত হয়েছে। তখন তো ইসলামের ধারক, বাহক, রক্ষকরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। ধর্মকে যারা রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনে বসিয়েছে তারই এমন কাণ্ড করতে পেরেছে! তাই আমি মনে করি, ধর্ম মানুষকে ধার্মিক বানাতে পারে, কিন্তু মানুষ বানাতে পারে না। যদি তাই হতো তাহলে আমরা এই ধার্মিকের দেশের মানুষেরাই পৃথিবীর সেরা মানুষ হতাম, আমাদের দৃষ্টিতে নাস্তিক-কাফের আমেরিকা-ইউরোপিয়ানরা নয়! অথচ ওই নাস্তিক-কাফেরদের সাহায্য ছাড়া আমাদের দেশ অচল। “পৃথিবীতে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে যতো রক্তক্ষয় হয়েছে, ধর্মের নামে যুদ্ধে যতো লোক মারা গেছে, অন্য কোনোভাবে এত লোক মরছে কিনা সন্দেহ।” নিজের সম্প্রদায়কে অন্য সম্প্রদায় থেকে শ্রেয়তর এবং নিজের ধর্মকে অন্যের ধর্ম থেকে শ্রেয়তর বলে জ্ঞান করা কি সাম্প্রদায়িকতা নয়? অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা, কেবলমাত্র তা যতক্ষণ প্রকাশ্যে রূপ না নেয় ততক্ষণ নয়। এই নিরব সাম্প্রদায়িকতা প্রতিটি ধর্মের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় রয়েছে। পৃথিবীতে সকলেই নিজ নিজ ধর্মকে অন্য ধর্মের চেয়ে শ্রেয়তর মনে করে। তাই যখন রাষ্ট্র কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয় তখন অন্য ধর্মালম্বীরা মুখে কিছু না বললেও অন্তরে এবং গোপনে নিজেদের মধ্যে এর বহুরূপ সমালোচনা করে। যাক সেকথা, সব ধর্মের মধ্যেই কমবেশি কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ভৌতিক কল্পকাহিনী থাকলেও নিজ ধর্মের এসব ব্যাখ্যায় আমরা কেউ যাই না, কিন্তু অন্য ধর্মের দুর্গন্ধটুকু শুকে বের করি। হয়তো সম্প্রীতি রক্ষার খাতিরে অথবা রাষ্ট্রীয় বিচারের সম্মুখীন হবার ভয়ে তা প্রকাশ করি না, কিন্তু অন্তরে ধর্মের যে বিষাক্ত কণা আমাদের নিজ নিজ ধর্মই শিক্ষা দিয়ে আসছে তা ভুলি কি করে? “…ধর্ম থাকুক যার যার ব্যক্তি জীবনে। রাষ্ট্র যেন কোনো ধর্ম দ্বারা পরিচালিত না হয়। পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোতে এই ব্যাপারটা ফয়সালা হয়ে গেছে। ওরা বেশির ভাগই ধর্ম-কর্ম করে থাকে, কিন্তু ওদের রাজনীতিতে নিজের আচরিত ধর্ম টেনে আনে না। ধর্ম আর রাজনীতি ওখানে আলাদা হয়ে গেছে। …মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি একজনকে রেসিস্ট বলে তাহলে সে লজ্জায় অধোবদন হয়। যদি কাউকে শুয়োরের বাচ্চা বলে গালি দেয়, তাতে সে যতোটা আহত হবে তার চেয়েও বেশি আহত হবে, যদি কাউকে রেসিস্ট বলা হয়। আমাদের দেশে কিন্তু ঘটনা উল্টো, এখানে অমুক সাম্প্রদায়িক বলার সঙ্গে সঙ্গে সে লজ্জিত, অপমানিত হয় না। অথচ সাম্প্রদায়িকত্ব হলো মনুষ্যত্বের অবমাননা। কাউকে সাম্প্রদায়িক বলা মানে তাকে অমানুষ বলা।” আর এর ফলেই ওরা আমাদের চেয়ে হাজার বছর এগিয়ে গেছে এবং থাকবেও।

“আজকের উন্নত ইয়োরোপও একদিন গভীর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতায় নিমগ্ন ছিল। যীশু খ্রীস্টের জন্মস্থানকে মুসলমান বিধর্মীদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য মধ্যযুগে কেবল যে বারবার ক্রসেড (এমনকি শিশুদের ক্রুসেড) পরিচালনা করা হয়েছে, তাই নয়, রোমান ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টরা প্রায় দ্বিশতাধিক বছর একে অন্যের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত অব্যাহত রেখেছিল। অবশ্য যতই ইয়োরোপে …বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে, সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি, যুক্তি ও বিজ্ঞানের প্রসার ঘটেছে, ধর্মীয় কুপমণ্ডুতা ততই সংকুচিত হয়েছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বা ভেদবুদ্ধির অবসান হয়েছে। …একজন নাগরিকের পরিচয় তার রাষ্ট্রসত্ত্বায়, কোন ধর্মে সে জন্মগ্রহণ করেছে তাতে নয়।” অথচ আজো আমার তাদের দেখে কিছুই শিখছি না। আজো আমাদের জীবন-বৃত্তান্তে ধর্মের উল্লেখ করতে হয়। আজো আমরা এক সময়কার ক্যাথলিক-প্রেটেস্ট্যান্টদের ন্যায় শিয়া, সুন্নি, কাদিয়ানি, ওহাবি… মহা হিংস্রতায় উম্মাদ।

“…ধর্মের রুদ্ররূপ যে সমাজ বারবার দেখেছে ও ধর্মকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে ফয়দা লুটেছে তার হাতে ধর্ম আফিম নয় বরং বারুদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ধর্মে ধর্মে শ্রেষ্ঠত্বের যে বিবাদ তা কীভাবে বা কখনো আদৌ মীমাংসিত হবে কিনা জানি না, কিন্তু তার ঝগড়া মেটাতে হবে এবং ঝগড়াটে মনকে ঠাণ্ডা করতে হবে। সে জন্যে ধর্মীয় পরিমণ্ডলে আরো সহিষ্ণু, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক চিন্তার চর্চা শুরু করতে হবে। অধিকতর গোঁড়ামির দিকে যাওয়ার জন্যে নয় আধুনিকায়নের জন্যে সমঝোতা ও সম্মিলনের জন্যে সংস্কারের কাজ হতে হবে।” ধর্মে ধর্মে শ্রেষ্ঠত্বের যে বিবাদ তা সৃষ্টি করেছে কে? কেন সৃষ্টি হয়েছে? এটি সৃষ্টির জন্য ধর্মপ্রবর্তকরা কি দায়ী নয়? তারাই তো নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করেছেন। তারা তাদের নিজেদের ও তাদের প্রচারিত ধর্মকেও শ্রেষ্ঠত্ব জ্ঞানে পূঁজো দিতে বলেছেন! ধর্মের বিভক্তি কেন হয়েছিলো? আদিম ধর্ম কি ছিলো? এখানে যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের কথা বলা হচ্ছে, আদিম মানুষের এমন কোনো ধর্ম ছিলো না। যখন তারা ধর্ম আবিষ্কার করেছে, তারপর থেকেই ধর্মের মধ্যে নানারূপ ঝগড়া-বিবাদ হয়ে বিভিন্ন গোত্রে ও পরে বিভিন্ন নতুন নতুন ধর্মের প্রচলন হয়েছে। এর পুরোটাই লাভ এবং লোভের আশায় হয়েছে।

ধর্মীয় রাষ্ট্র বলেই কি আমাদের দেশে ধর্মীয় উৎসবের পূর্বে খবরের কাগজে এইরূপ হেডলাইন উঠে আসে? যেমন- “বাজার ভর্তি পণ্য তবু দাম নিয়ে শঙ্কা।” “শুল্ক ছাড়ের লাভ যায় ব্যবসায়ীদের পকেটে।” “সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার আহ্বান।” “রমজান মাস ব্যবসায়ীদের স্বর্গবাস।” এ সময়ে বাজারে পণ্যের যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ থাকলেও বাজার দর মাথাচাড়া দেবেই। এছাড়া বাজারদর নিয়ে লঙ্কাকাণ্ড প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবের পূর্বেই আমরা ঘটতে দেখি এবং স্বয়ং যার উদ্দেশ্যে এই ধর্মীয় উৎসব তিনি বা তারা অর্থাৎ সেই সৃষ্টিকর্তাদেরও সাধ্য নেই যে বাজারে প্রচুর পরিমাণ পণ্য থাকলেও এর দাম কমিয়ে রাখে! তাহলে ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করে লাভটা কি?
সব রোজার পূর্বেই বাজার দর নিয়ে এক মহাতঙ্ক সৃষ্টি হয়। এর ব্যতিক্রম আমি আমার পঞ্চাশ বছর বয়সে কখনোই দেখি নাই। কেহই তা থামাতে পারে না। সেদিন পত্রিকায় দেখলাম, ভোজ্যতেল আমদানিকারক সমিতির সভাপতি আসন্ন রমজানে সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন! খবরটির শিরোনাম এরকম- “সহনশীল মাত্রায় ঘুষ খাওয়ার অনুরোধ!” এতে কি প্রমাণিত হয় না যে, ধর্মানুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা ঘুষ খাবোই। এতে কোনো সন্দেহ নাই। তাহলে কি করে বলি, সংবিধানে ধর্ম যুক্ত হলেই আমরা খাঁটি মানুষ হয়ে যাবো, আর তা না হলে ধ্বংস হয়ে যাবো! ধর্ম মানুষের নৈতিকতার উন্নতি ঘটাতে সম্পূর্ণরূপেই ব্যর্থ। মানুষের নৈতিকতার অবক্ষয় যদি কোনো কিছুতে ঠেকাতে পারে তাহলো নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা নয়। যদি ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে মানুষ করতে পারতো তাহালে আমেরিকা-ইউরোপের মতো দেশের মানুষ আমাদের চাইতে সহস্রগুণ বেশি মানবতাপূর্ণ ও নৈতিকতাসম্পন্ন হতে পারতো না। কারণ সেসব দেশের মানুষ ধর্মকে একপাশে সরিয়ে রেখে মানবিকতার গুণেই আমাদের চাইতে কয়েক সহস্র বছর এগিয়ে রয়েছে; ধর্মীয় কারণে মোটেও নয়। সেসব দেশে ধর্ম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না; যদি কারো ইচ্ছা হয় তো ধর্ম পালন করে, না হলে কেউ চিৎকার করে না। তারা বলে না যে ওমুকে ধর্ম পালন করে না, তমুকে নাস্তিক… ইত্যাদি। ধর্ম থাকলো কি থাকলো না তা নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই, কিন্তু মানবতা এবং আইনের শাসন নিয়ে তাদের মাথা ব্যথার এতোটুকু কমতি নেই। যা আমাদের মোটেও নেই। ধর্মের বিরুদ্ধে কেউ প্রশ্ন তুললেই তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে আমাদের বিলম্ব হয় না, অথচ মানবাধিকার লংঘিত হলে টু-শব্দটিও করি না। দুর্নীতিতে যেখানে আমরা প্রতিনিয়তই প্রথম স্থান অধিকার করছি, সেখানে আমেরিকা-ইউরোপের দুর্নীতির মাত্রা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অথচ এ দুর্নীতি নিয়ে একদিনও মিছিল-মিটিং করে না ধর্মজীবিরা! কিন্তু একবার যদি কেউ ধর্মের কোনো কুসংস্কার সম্পর্কে কেউ সমালোচনা করে, তবে তাকে ফাঁসিতে দেওয়ার জন্য হাজার হাজার ধার্মিক রাস্তায় লাফিয়ে পড়ে এবং সরকার পর্যন্ত ভয়ে তাদের কথা মানতে বাধ্য হয়। তর্কের খাতিরে যদি মেনে নেই যে, ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে রাষ্ট্রের এবং এর নাগরিকদের আয়-উন্নতি বাড়ে, এবং আল্লা, ঈশ্বর, গড, ভগবান… যদি একজনই বলে মনে করি, তাহলে বলতে হয়, ওইসব আমেরিকান এবং ইউরোপিয়ানরা যারা আমাদের দৃষ্টিতে নাস্তিক তারা কখনোই আমাদের চাইতে বেশি আশির্বাদ পেতে পারে না। অথচ আমারা চিৎকার করছি, মানবিকতা বা নৈতিকতা বা আইনের শাসন থাকুক আর না থাকুক ধর্ম থাকতেই হবে। ওরা চিৎকার করছে শুধু মানবাধিকার নিয়ে, ধর্ম নিয়ে নয়, তাহলে সৃষ্টিকর্তারা ওদের কেন এতো বেশি আশির্বাদ করছে? ওরা ধর্মকে তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে আমারা ওদের বহু সমালোচনা করি কিন্তু ওরা এর কোনো উত্তর দেবার প্রয়োজন বোধ করে না। তাতে কি ওদের ধর্মের কোনো ক্ষতি হচ্ছে? আমরা রাষ্ট্রের সংবিধান এবং রাষ্ট্রকে ধর্মীয় রাষ্ট্র, ধর্মীয় সংবিধান না রাখলে একে অপরের মাথা ফাটিয়ে দিতে বিলম্ব করবো না, সারা দেশ জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতেও কোনো দ্বিধা করবো না, কিন্তু মানুষের অধিকার লাঞ্ছিত হলে একটি কথাও বলবো না। একটি দিনের জন্যও প্রতিবাদ করবো না। ধর্মের কোনোপ্রকার লাঞ্ছনা হোক তার প্রতি আমরা সদাসতর্ক কিন্তু মানবতা ভূলুন্ঠিত হোক তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমেরিকা-ইউরোপ সম্পূর্ণ উল্টো, তাই তো ওরা আমাদের চেয়ে সহস্র বছর এগিয়ে।

ক’দিন পূর্বের একটি খবর। হেডলাইনটি হলো:- “অপরাধীর স্পাইনাল কর্ড কেটে দেয়ার নির্দেশ সৌদি বিচারকের।” এই তো ধর্মীয় আইন! সামান্য একটু মাংস চুরির অপাধের শাস্তি স্পাইনাল কট কেটে দেয়া! কতই না অমানবিক! একজনের স্পাইনাল কট কেটে না দিয়ে, সারাজীবনের তরে পঙ্গু করে না দিয়ে, তাকে ফাঁসি দেওয়াও বোধ করি এর চেয়ে ভালো। ধর্ম নিজেই তো বুমেরাং। কারণ, একদিকে তা আমাদের শিক্ষা দেয় বিনয়ী, নম্র, ভদ্র… হতে অন্যদিকে প্রচণ্ডভাবে হিংস্রতা লিপ্ত থাকার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। নিজ নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ স্থান দেওয়া, এবং অন্যের দ্বারা সামান্য সমালোচনার উত্তর দিতে যা যা করা প্রয়োজন তার সবটুকুই করতে শিখায়, এমনকি নিজ ধর্মের সমালোচনার জন্য খুন করতেও ধর্ম আমাদের উৎসাহিত করে। আবার এই খুন করার জন্য আমাদের বহুবিধ পুরুষ্কারের লোভ দেখায় ধর্ম। এর মধ্যে হাস্যষ্কর হলো- ধর্মের নামে কাউকে খুন করলে অথবা নিজে শহীদ (তথাকথিত শহীদ) হলে বেহেস্তে বা স্বর্গে যাওয়া নিশ্চিত এবং সেখানে গেলে অজস্র অপ্সরি, হুরপরী, হুরে গেলমাল… ইত্যাদি পাওয়া যাবে! যা মানবতা ধর্মে একেবারেই অকল্পনীয়।
প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশটাকে একটা ধর্মীয় রাষ্ট্র না বানালে কি ধর্মের বিশেষ কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে? আমরা কি দেখতে পাচ্ছি না যে, পৃথিবীর যেসব রাষ্ট্রই ধর্ম এবং রাষ্ট্রকে এক করে গুলিয়ে ককটেল বানিয়েছে, সেসব রাষ্ট্র কখনোই তেমন একটা উন্নতি করতে পারছে না কারণ ধর্মীয় উগ্রবাদ, ধর্মীয় নানা গোষ্ঠি সেখানে জন্ম নেবেই এবং আজ হোক কাল হোক সেই রাষ্ট্রে হানাহানি অনিবার্য। যেমন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরাক, ইরান, সুদান, ইয়েমেন…। কারণ আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, উগ্রবাদিতা সব ধর্মের মধ্যেই রয়েছে। যে কোনো রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় তাদের ধর্মকে রাষ্ট্রের ধর্মে পরিণত করার জন্য মরিয়া থাকে এর মূলে কি ধর্মকে বিশেষ একটি আসনে বসানো? ধর্মের মান-মর্যাদা কি ওই ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করার ফলে বাড়ে? নাকি ধর্মের নির্যাস, ধর্মের ভালো দিকগুলো মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিলে বাড়ে? ধর্ম আমাদের অনেক ভালো কিছু শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি আমাদের এও শিক্ষা দেয় যে, অন্য ধর্ম ভ্রান্ত, অন্য ধর্ম পালন করলে তুমি কাফের হয়ে যাবে, বেহেস্তে বা স্বর্গে যাবে না, নরকে যাবে এবং অচিন্তনীয় এবং অফুরন্ত কষ্টভোগ করতে থাকবে। ধর্ম ভাল কিছু শিক্ষার সাথে সাথে নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ বানাতে গিয়ে অন্য ধর্মকে প্রচণ্ডভাবে আক্রমানাত্মক কথা বলে, যদিও তা প্রকাশ্যে কমই করে, তথাপিও প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের এ শিক্ষা দেয়া হচ্ছেই। অন্য ধর্মে অবিশ্বাস, ঘৃণা নিজ ধর্মের ব্যাপারে চরম গর্ববোধ কখনোই কোনো ধর্মের শিক্ষা হতে পারে না, তথাপি তাই-ই হয়ে আসছে ধর্ম সৃষ্টির কাল থেকে এবং এখন কোনো কোনো রাষ্ট্রে তা আরো প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এমনকি একই ধর্মের মধ্যে বিভিন্ন গোত্রেও এরূপ ঘৃণা এবং অবিশ্বাস অহরহ চোখে পড়ছে।

আলডাস হাক্সলির মতে- “বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্মগুলোর মধ্যে একমাত্র বৌদ্ধ ধর্মই নির্যাতন, পূর্ব-পরীক্ষণ কিংবা বিধর্মী দলনের সাহায্য ছাড়াই বি¯তৃতি লাভ করেছিলো।” অর্থাৎ তার মতে পৃথিবীর অন্যসব ধর্মই কম-বেশি নির্যাতন ও দলনের সাহায্যেই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলো! ধর্মীয় ইতিহাস সিত্যকারভাবে ব্যাখ্যা করলে একথা স্পষ্ট যে, নতুন নতুন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এর ধর্মপ্রবর্তকদের প্রচুর যুদ্ধবিগ্রহ, রক্তপাত ঘটাতে হয়েছিলো। বৌদ্ধ ধর্মেই ক্রোধকে সর্বোতভাবে ন্যাক্কারজনক মনে করা হয়। কিন্তু অন্যান্য ধর্মালম্বীদের মধ্যে ‘ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ’ বলে একটি ক্রোধ আছে। এই ন্যায়সঙ্গত ক্রোধে বিশ্বাস হেতু সব ধর্মই যুদ্ধসহ অন্যান্য জঘন্যতম দুষ্ককর্মগুলো ধর্মীয় অনুমোদিত বলে আখ্যা দিতে দ্বিধাবোধ করে না এবং এ জঘন্য কাজকর্মগুলো ভগবানের মহিমা ও গৌরব বৃদ্ধি করে বলে গর্ববোধ করে এবং যাদের দ্বারা এসব সংঘটিত হয় তাদেরকে ধর্মীয় মহান নেতা, মহান বীর বলে পূঁজো দেয়।
অতএব ধর্ম প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে ধর্মযুদ্ধ করতে প্রস্তুত, কোনো কোনো ধর্ম প্রকাশ্যেই তা চায়। এটি প্রায় প্রতিটি ধর্মেই একটি স্বীকৃত এবং পূণ্যির কর্ম বলে ব্যাখ্যা ও প্রচার করা হয়। ধর্মকে মহিমান্বিত এবং সর্বশ্রেষ্ঠ রাখতেই এরূপ তথাকথিত যুদ্ধ ও রক্তপাত প্রায় সব ধর্মপ্রবর্তকই অনুমোদন দিয়ে গেছে। এমনকি তারা নিজেরাও এসব যুদ্ধ করে গেছে, যা বর্তমানে আমাদের গর্বের ও ঐতিহ্যের বিষয় এবং এর উপরেই আমরা ধর্মে ডক্টরেট ড্রিগ্রি লাভ করি। অর্থাৎ ধর্মে ডক্টরেটগণ ধর্মের ইতিহাসে কতোগুলো যুদ্ধ-বিগ্রহ হয়েছিলো, কতোগুলিতে জয়-পরাজয় হয়েছিলো তাই নিয়েই ডক্টরেট হন! ধর্মপ্রবর্তকগণ তথাকথিত ধর্মযুদ্ধের মহিমা গেয়ে গেছে এবং এর পক্ষে অতি সূক্ষ্মভাবে তার অনুসারীদের শিক্ষা দিয়ে গেছে। তারা ধর্মের শত্র“দের বিরুদ্ধে সজাগ ও সতর্ক থাকতে বলে গেছে, কিন্তু যুদ্ধ বন্ধ বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে নাই; যুদ্ধ ছাড়া ধর্মীয় বিবাদ মিটানোর তেমন কোনো প্রস্তাবও তারা বাতলে দিয়ে যান নাই বরং তারা এতে উৎসাহ জুগিয়ে রেখে গেছে যা আজও চলছে। ধর্ম সংস্কার করা না হলে, তা যতদিন থাকবে ততদিনই চলবে। ধর্মপ্রবর্তকগণ তাদের অনুসারীদের নিজ নিজ শত্র“দের সম্পর্কে হুশিয়ার করে গেছে এবং তাদের হত্যা করতে অনুপ্রাণিত করে গেছে। তাদের শিক্ষা দিয়েছে যে, তাদের অনেক শত্র“ আছে এবং তারা সব সময় তাদের ধর্মকে নষ্ট করার মতলব খুঁজছে ইত্যাদি। অবাক লাগে ধর্মপ্রবর্তকগণ কিভাবে এহেন শিক্ষা তাদের অনুসারীদের দিতে পারে? তবে ধর্মের এই যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের পরিবর্তন দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়। যা সত্য, যা সুন্দর, যাকে বলা হয় জীবন-বিধান, যাকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ বিধান এবং নানা বিশেষণে ও নানা গুণে যাকে ডাকা হয় সেই ধর্মের কেন শত্র“ থাকবে? কোনো খাঁটি এবং সত্যি জিনিষের কি শত্র“ থাকতে পারে? থাকতেও পারে, অবিশ্বাস করি না। কিন্তু যা ঐশ্বরিক তার কেন শত্র“ থাকবে? তথাপিও প্রতিটি ধর্মেরই শত্র“ রয়েছে এমনকি প্রতিটি ঈশ্বরেরও শত্র“ রয়েছে এবং প্রতিটি ধর্ম সৃষ্টির বা তৈরির দিন থেকেই এর অনুসারীদের তাদের শত্র“দের চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে! কে কতোবড় শত্র“ তাও বলে দেওয়া হয়েছে! ইসলামের শত্র“ কারা, খ্রীস্টানের শত্র“ কারা, হিন্দুর শত্র“ কারা, ইহুদির শত্র“ কারা…! এসব শত্র“ সম্পর্কিত শিক্ষা আমাদের জন্মলগ্ন থেকে মরণ পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতিনিয়তই ঘ্যানঘ্যান করে জানিয়ে দেওয়াই যেন ধর্মজীবিদের একমাত্র কাজ!

ধর্মকে একটি লাভজনক ব্যবসা বললে কি ভুল হবে? কারণ প্রতিটি ধর্মেই রয়েছে নানা রকম তীর্থস্থান যেসব স্থানে মানুষ বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ করে তীর্থ করতে যায় এবং পূণ্যি লাভ করে আসে! দেখা যায় যারা সারাজীবন ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায় করে প্রচুর অর্থের মালিক হয়েছে তারাও শেষ বয়সে তীর্থে গিয়ে পূণ্যি করে সকল পাপ খণ্ডন করে আসে। তীর্থে গেলে পূণ্যি হয়, পূর্বের পাপ ক্ষমা হয়, এটি প্রতিটি ধর্মের একটি মহান উপদেশ এবং এটি করা বাধ্যতামূলকও বটে। ভালো কথা, তীর্থে গিয়ে প্রার্থনা বা মোনাজাত না করলে সৃষ্টিকর্তারা কেন শুনবে না? সৃষ্টিকর্তারা যদি সর্বত্রই থাকে তাহালে তীর্থে গিয়ে তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার অর্থ কি? আর তীর্থে না গিয়ে ঘরে বসে একই প্রার্থনা করলে একই পূণ্যি হবে না কেন? খোদা বা ভগবান যদি সর্বত্র থাকে তাহালে এতো অর্থ খরচ করে হজ্জ, মক্কা, মদিনা, গয়া-কাশি, বৃন্দাবন… ইত্যাদি স্থানে যাবার প্রয়োজন কি? ধর্মেই এ বিধান ঠিক করে দিয়েছে যে, অকাজ, কুকাজ করেও পার পাওয়া যায়। মক্কা-মদিনা, জেরুজালেম, পুরি-বৃন্দাবন… দর্শনে পাপ পূণ্যে পরিণত হওয়ার নিশ্চিত গ্যারান্টি রয়েছে। তীর্থস্থান দর্শনে এবং সেখানে গিয়ে প্রার্থনা বা মোনাজাত করলেই পাপ ক্ষমা করার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কেবলমাত্র ব্যবসায়িক স্বার্থেই নয় কি? এই বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা মানুষ নিজ নিজ দেশের গরীবদের কল্যাণে খরচ করলেও কি এর চাইতে বেশি পূণ্যি হতো না? না হলে কেন হবে না?

যখন ধর্মের নামে ধর্মীয় বাক্য উচ্চারণ করে একই ধর্মালম্বী বিভিন্ন গোত্রের লোকজন খুনোখুনি করে তখনও কি একে আমরা ধর্ম বলবো? এটা কি সৃষ্টিকর্তাদের হুকুমে হচ্ছে? আর যদি তাদের হুকুমে না হয়, তাহলে কার বা কাদের হুকুমে হয়? এসব প্রশ্ন করা কি অন্যায়? অন্যায় হলে কেন? যার হুকুম ছাড়া একটি গাছের পাতা নড়ে না, তিনি বা তাদের নাম স্মরণ করে মানুষ যখন মানুষকে খুন করে তখন এর মধ্যে তার নির্দেশ অবশ্যই থাকার কথা! অনেকে হয়তো যুক্তি দেখাবে শয়তানের হুকুমে হয়! কিন্তু শয়তানও তো সৃষ্টিকর্তাদের তৈরি। শয়তান, ভূত-পেত্নি, পরী-জীন… ইত্যাদি কেন সৃষ্টি করা হয়েছিলো? যদিও এগুলোর বাস্তব কোনো প্রমাণ নেই যে এগুলো পৃথিবীতে আছে! তথাপিও সম্ভবত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ছাড়া আর একটি ধর্মও এগুলো অর্থাৎ শয়তান ছাড়া পূর্ণাঙ্গ ধর্ম হতে পারে না!

আমাদের অবস্থা হয়েছে এরকম যে, ধর্ম যেমন অন্ধভাবে বিশ্বাস করি, তেমনিভাবেই তার সামান্য কয়েকটি নিয়মকানুন পালন করেই নিজেদের ধার্মিক মনে করি এবং আমার ধর্মই সর্বশ্রেষ্ঠ তা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি। আমার ধর্মটা যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ সেহেতুই অন্য সবগুলোই ভ্রান্ত! এর কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন নেই কারণ পিতা-মাতা বলেছে, হুজুর-পাদ্রি-ঠাকুর শিখিয়েছে তাই-ই আমারটা সর্বশ্রেষ্ঠ ওদেরটা নয়! যা সর্বশ্রেষ্ঠ তার জন্য এতো চেঁচাচেঁচি কেন করতে হবে? যা সত্য তা এমনিতেই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, তা নিয়ে এতো চিৎকার-চেঁচামেচির প্রয়োজন হয় না। কেউ যদি ধর্মপুস্তক নিবিষ্ট চিত্তে পড়ে, বিশেষ করে এর ইতিহাস, এর জন্ম রহস্য তবে দেখতে পাবে প্রতিটি ধর্মপুস্তুকেই প্রচুর অসংলগ্ন কথাবার্তা, অবৈজ্ঞানিক, ভিত্তিহীন কল্পকাহিনী এবং গল্পরসে ভর্তি। আর যদি এসব নিয়ে প্রশ্ন করেন তবে তো কথাই নাই, এ প্রশ্নের উত্তর নেই। এর উত্তর অতি সহজ হলেও সর্বধর্মের সর্বধর্মজীবিদের মুখস্ত উত্তরটি একই- “ইহা ভগবানের রহস্য ইহা বুঝিবার সাধ্য মানুষের নেই।”

বাল্যশিক্ষা আমদের শিক্ষা দিয়াছে- “সদা সত্য কথা কহিবে, কখনো মিথ্যা কথা কহিবে না।” কিন্তু ধর্মের বেলায় সত্য কথা বলা মহা বিপদের ব্যাপার। ধর্মের মধ্যে যেসব অবৈজ্ঞানিক, অবাস্তব, কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাক্য রয়েছে তা বলা যাবে না। বললে জীবন নাশের হুমিক এবং এ নিয়ে জীবন নাশ অনিবার্য। সত্য বললে ধর্মানুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অপরাধে ধর্মজীবিদের দ্বারা প্রাণ যাবার উপক্রম হয়, প্রাণ না গেলেও শারীরিক ও মানসিক শাস্তি এবং ধর্ম বা রাষ্ট্রের বিচারের মুখোমুখিও হতে হয়। তাহলে কি বলা যাবে না যে, ধর্মও সত্য এবং যুক্তির কথা মানতে নারাজ? ধর্মকে সাধারণেরা সমর্থন দেয় অজ্ঞতা এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কারের বশে, কিন্তু শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত, রাষ্ট্র ও বুদ্ধিজীবিরা… সমর্থন দেয় স্বার্থের বশে, ক্ষমতার লোভে। পৃথিবীর কোনো ধর্মই পরমত সহিষ্ণু নয়, হতেও পারে না। অপর ধর্মের মতকে সমর্থন করলে নিজ ধর্ম ছোট হয়ে যায়। অতএব যতই বলা হোক না কেন পরধর্মে সহিষ্ণু হও, তা বাস্তবে হওয়া সম্ভব নয়।
পৃথিবীর প্রায় সব ধর্মের হাতেই রক্তের দাগ রয়েছে! তা কেন? ধর্ম যদি রক্তপাতে বিশ্বাস করে তবে সেই ধর্ম পালন করা উচিত কি-না? মানুষ যদি মানুষ খুন করে ঈশ্বরের ভজানা করে, তবে তা কোনো ধর্ম হতে পারে না। আবার দেখা যাচ্ছে, ঈশ্বর নিজেও রক্ত পছন্দ করে! তা কেন? ঈশ্বরের কেন রক্তের প্রয়োজন? মানুষ তার উদ্দেশ্যে রক্তপাত ঘটায়! হোক তা পশুর রক্ত! পশুর রক্তে তিনি আনন্দিত হন এটাই বা কেমন কথা! পূর্বে নরবলির প্রথা ছিলো, তা থেকেই কি রক্তপাতে ঈশ্বর খুশি হন, এমন ধরনা আজও প্রচলিত রয়েছে?

ড. শাহ সাহেবের ন্যায় অনেকেই বলেছেন- ঈশ্বর, ভগবান বা আল্লা এরা এক! কি আশ্চর্য কথা! এক হয় কি ভাবে? এক হলে তো তিনি একই ধর্ম প্রচারক পাঠাতো এবং একই ধর্ম থাকতো! কিন্তু তা যখন সত্য নয়, তখন তারা এক হতেই পারে না। অতএব এরা সমষ্ঠিগতভাবে সৃষ্টিকর্তাগণ এবং এরা একেকজন আলদা আলাদা সত্ত্বা। পৃথিবী ও মানুষ সৃষ্টির বিবরণ সনাতন বা হিন্দু ধর্ম যা বলে তা বাদ দিলে ইহুদি, খৃস্টান ও মুসলমানগণ পৃথিবী সৃষ্টির একই ইতিহাসে বিশ্বাসী। যদি আমরা পৃথিবী ও জীব সৃষ্টির ধর্মীয় ইতিহাস বিশ্বাস করি তাহলে বিজ্ঞান অবিশ্বাস করা হয় এবং বিজ্ঞান বিশ্বাস করলে ধর্মকে অবিশ্বাস করা হয়। আমরা একই ঘটনা দু’রকমভাবে বিশ্বাস করতে পারি না, তাহলে কোনটা ঠিক? বিজ্ঞান না ধর্ম? পূর্বেই বলেছি প্রথম মানুষ আদমকে খৃস্টপূর্ব ৪০০৪ সালে সৃষ্টিকর্তাগণ তৈরি করেছিলো। কিন্তু খৃস্টপূর্ব ৪২২১ অর্থাৎ আদম জন্মের ২১৭ বছর পূর্বেই মিশরে পঞ্জিকা তৈরি করেছিলো সেখানকার মানুষ! খৃস্টপূর্ব ৪২৪১ সালে অর্থাৎ আদম জন্মের ২৩৭ বছর পূর্বেই মিশরেই বর্ষ গণনা শুরু হয়েছিলো। এছাড়া সেখানে যেসব প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন পাথরের হাতিয়ার, সোনা, রূপা, তামার জিনিষপত্র তাতে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা এগুলো খৃস্টপূর্ব ৫০০০ বছরের আগেকার। এমনকি খৃস্টপূর্ব ৭০০০ সাল নাগাদ লোকবসতির প্রমাণও রয়েছে তাদের হাতে। সিরিয়াতে ৪০ ফুট মাটির নিচে যে লোকবসতির চিহ্ন পাওয়া গেছে তার বয়স ধরা হয়েছে খৃস্টপূর্ব ৮০০০ সাল। অর্থাৎ আদম জন্মের বহু পূর্বেও মানুষ ছিলো, তাহলে এরা এলো কোথা থেকে? বলা হয় যে, মানুষ ও জীবনজন্তু সৃষ্টিকর্তারা একই সময় সৃষ্টি করেছিলো, তাহলে বিজ্ঞানীরা যে লক্ষ লক্ষ বছর আগেকার জীবজন্তুর ফসিল পাচ্ছে তাই বা এলো কিভাবে? তাই ধর্মপুস্তকের পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য মানি কি করে?
২ সেপ্টেম্বর ২০১০ প্রত্রিকায় প্রকাশিত হলো- “বিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই: হকিং। মহাবিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বে ঈশ্বরের কোন অস্তিত্ব নেই। বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং তার নতুন গ্রন্থে একথা বলেছেন…।”

যাহোক, হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীরা মনে করে আদিম মানুষ মনু থেকেই মানুষ প্রজাতির জন্ম। ভগবান ব্রহ্মার দেহ থেকে এই মনুর জন্ম। হিন্দু ধর্মমতে মানুষ এ পৃথিবীতে এসেছে সত্যযুগে! সত্যযুগ ছিল ১৭,২৮,০০০ বছর। এরপর ত্রেতা যুগ যার স্থায়িত্বকাল ১২,৯৬,০০০ বছর। এরপর দ্বাপরযুগ ৮,৬৪,০০০ বছর। এরপর কলিযুগ, যে যুগ এখন চলছে। অর্থাৎ কলিযুগে আসার আগোই মানুষ পাড়ি দিয়ে এসেছে ৩৮,৮৮,০০০ বছর! কিন্তু বিজ্ঞানীদের তথ্য-প্রমাণে পাওয়া যায় যে, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ এই পৃথিবীতে প্রায় ৫০ লক্ষ বছর পূর্বে এলেও আধুনিক মানুষ এসেছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে। অর্থাৎ এই ২৫ থেকে ৩০ হাজার বছর পূর্বেকার মানুষের ধর্মচিন্তা ছিলো না বা তারা তখনও ধর্ম সৃষ্টি করতে পারে নাই। অতএব বলা চলে হিন্দু শাস্ত্রের এ ব্যাখাও সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং কল্পনাপ্রসূত।
মানুষ বিশ্বাস করে এ পৃথিবী পাপে পরিপূর্ণ হয়ে যাওয়ার ফলেই সৃষ্টিকর্তা বা কর্তারা ধর্মাবতার, পয়গম্বর বা ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছেন। যেন মানুষ পাপ কাজ না করে এবং তার পথে থাকে! সে যাহোক, কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এরা কেন সকলেই ভারতে ও আরব ভূমিতেই জন্ম নিয়েছিলো? অন্য কেথাও কি এর পূর্বে মানুষ ছিলো না? পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিজ্ঞান কিন্তু বলছে প্রথম মানুষ আফ্রিকাতেই বিবর্তনের মাধ্যমে জন্ম নিয়েছিলো, অথচ সেখানে তাদের কোনো ধর্ম ছিলো না কেন? হিন্দুদের উদ্ধারের জন্য এ পর্যন্ত ১০ জন অবতার জন্ম নিয়েছে এবং আশ্চর্যের যে, তারা সকলেই ভারতে জন্ম নিয়েছে। অন্য কোথাও নয় কেন? আদমের জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত পয়গম্বর এসেছে ১ লক্ষ ২৪ হাজার মতান্তরে কম-বেশিও আছে। এরা প্রায় সকলেই জন্ম নিয়েছে আরবেই! ইহুদি, খৃস্টান ও মুসলমান ধর্মের ধর্মপ্রবর্তকগণও জন্ম নিয়েছে আরবেই! তাহলে কি ভারত ও আরবেই কেবল পাপীরা ছিলো, অন্য কোথাও নয় অথবা অন্য কোথাও কি তখন মানুষ ছিলো না? ইতিহাস তো সেকথা বলে না।

ধর্ম মানুষকে চোখ রাঙিয়ে আনুগত্য শেখায় বিধায় বিশ্ব বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক আইনস্টাইন একে বলতেন- “রিলিজিয়ন অফ ফিয়ার।” অর্থাৎ ধর্মের ভয়। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাস, আচার-আচরণ, প্রথা ইত্যাদি বিষয়ে বলেছেন- “এগুলো শুধু ইতিহাস ও মনস্তত্বের দিক থেকে গুরুত্ব দিতে পারি, এ সবের আর কোনও গুরুত্ব আমার কাছে নেই।” তিনি আরো বলেছেন- “মতবাদ যদি নিজে পরিষ্কার আলোর মধ্যে বাঁচতে না পারে কেবল অন্ধকারে গিয়ে লুকায়, তা নিশ্চিতভাবে মানব প্রগতির গণনাতীত ক্ষতি করে।” অর্থাৎ ধর্মীয় মতবাদ যা আলোর মধ্যে বেঁচে থাকে না তা সম্পূর্ণটাই থাকে অন্ধকারে এবং অদৃশ্যভাবেই তা বেঁচে আছে! ধর্মের প্রায় সবটুকুই তো অন্ধকার। ঈশ্বর অন্ধকারে, শয়তানও অন্ধকারে, ফেরেস্তারাও তাই, জীন-পরী, স্বর্গ, নরক, গোরাজব, নরকের শাস্তির কাহিনী, স্বর্গের সুখের কাহিনী, স্বর্গে হুর-পরী নিয়ে মজা করা… ইত্যাদি সবই তো অন্ধকারে, কেবলমাত্র অনুমান আর অনুভব করে কেউ পাপের ভয়ে শঙ্কিত হয় আবার কেউ স্বর্গের হুর-পরীর লোভে উম্মাদ হয় এই যা পার্থক্য, তবে সবই অন্ধকার এবং অদৃশ্য! আইনস্টাইন আরো বলেছেন- “মরাল রিলিজিয়ন” বা ধর্মের নৈতিকতা। এব্যাপরে তার মতামত হলো- “মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শিক্ষা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সহানুভূতির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ধর্মের অনুশাসনের নামে ভয় বা লোভ মানুষকে মানুষ করে তোলে না।” আইনস্টাইনের কথা যদি ঠিক হয়, তাহলে ধার্মিকগণ কখনোই খাঁটি মানুষ হতে পারে না। যার প্রমাণ আমরা বাস্তবে দেখেও এ থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না।
যদি এ প্রশ্ন করা হয় যে, ঈশ্বর বা খোদা বা ভগবান কি পারেন না আমাদের দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করে রাখতে? তিনি বা তারা কি পারেন না পৃথিবীর যে আড়াইশো কোটি মানুষ প্রতিদিন এক বেলা খেয়ে থাকে, আর এক’শ কোটি একবেলাও পায় না (যাদের মধ্যে প্রায় সকলেই এশিয়া এবং আফ্রিকানই) তাদের মধ্যে খাবার বণ্টন করতে? তার খাদ্যমন্ত্রী (যে ফেরেস্তা খাদ্য বণ্টন করে) তাহলে কি করছে?
আবার আমি ডা. লুৎফর রহমান রচনাসমগ্র থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি? তিনি বলেছেন- “অভাবে মানুষের দুঃখ হয় না, রোগ-শোকের যাতানা মানুষ ভুলতে পারে, কিন্তু মানুষের নীচতা দেখে যে দুঃখ হয়, তার তুলনা নাই। মানুষের প্রবৃত্তি যদি পশুর মতোই হবে, যদি তার হীনতায় সে লজ্জিত না হয়, তবে কেন সে পশুর আকার ধারন করে নাই? …যদি রাজ্য হারিয়ে থাক, দুঃখ করো না, যদি তোমার পরম আত্মীয়েরা ত্যাগ করে গিয়ে থাকে তবুও দুঃখ করো না, যদি তোমার প্রবৃত্তি নীচ হয়, যদি ইতর পশুর আত্মার স্বভাবে তোমার আত্মার অবনতি ঘটে থাকে, তাহলেই লজ্জিত হও। তোমার চশমা, তোমার ঢেউ-তোলা চুল, সুবাসিত গন্ধ তেল, তোমার শার্ট, কোঁচকানো ধুতি তোমার গৌরব বর্ধন করবে না।”
“…আমি বলি তার কোন ধর্ম নেই। সে দাড়ি ফেলুক আর না-ই ফেলুক তাতে কী আসে যায়। সে বাঙালি বা আরবি নাম রাখুক তাতেই-বা কী আসে যায়! তার কোন ধর্ম নেই। তার কোন ঈশ্বর নেই। তার রোজা, নামাজ দেখে আমি ভুলি না, তার পূজা-অর্চনা, তার বর্বর যুগের ধর্মশালা দেখে আমি সুখী হই না। …তোমরা কাফের আর কাফেরের মুখ দেখেছ কি? তোমরা মানুষের চোখে-মুখে তার প্রাণের ছবি দেখেছ কি? আমি দেখেছি। ওঃ সেই দুরাত্মার, দানবের সৃষ্টি আমার বুকে ঘৃণার আগুন জ্বলেছে…। সেই কাফের মিথ্যা কথা বলতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করে না। তার চোখে দানবের ভীষণতা সদাই লেগে থাকে। তার দাড়িভরা মুখে পিশাচের কলঙ্ক কালিমা সদাই প্রতিভাত হতে থাকে। সেই শয়তানের বুকে কখনও অনুতাপ জাগে না। পাষাণ গলে, তার হৃদয় গলে না। আল্লাহ্র মন্দিরে প্রবেশ করলে আল্লাহ্র ঘর তাকে দেখে ভয়ে শিউরে ওঠে।”

“মানুষ কি এখনও বোঝে নি, মানুষের ধর্ম কী? মানুষের ঈশ্বর মানুষের কাছে কী চান? স্বার্থান্ধের স্বার্থ-বাসনা জড়িত উপাসনা ও তোষামোদ ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। মানব সংসারের কল্যাণ কামনা ত্যাগ করে যারা নিরন্তর ঈশ্বর উপাসনায় ব্যস্ত থাকে, তারা নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব। হৃদয়কে প্রেম উদ্বুদ্ধ করবার জন্যেই, আত্মার মহাজ্ঞানের আশীর্বাদ লাভ করবার জন্যেই মানুষ ঈশ্বরের উপাসনা করবে। উপাসনার আর কোন বড় স্বার্থকতা নেই। জগতে জীবনের উন্নততর, মহিমান্বিত প্রেমের ব্যবহার ত্যাগ করে নিরন্তর উপাসনার কোনো মূল্য নেই। …গায়ের রং, অর্থসম্পদ, উচ্চ রাজপদের গর্ব ত্যাগ কর। …তুমি কি পশুদের রাজা সিংহের প্রতাপ লাভ করতে চাও? তুমি কি উচ্চস্তরের পশু হতে চাও? …ধন্য সেই- যে মানুষকে কোনো রকম তুচ্ছ ও রূঢ় ব্যবহারে বেদনা দেয় না…।”

মুসলমান জাতি সম্বন্ধে বলেছেন- “…এদের আত্মা যেন ভাবহীন, চেতনা-বর্জিত পাষাণে পরিণত হয়েছে। এরা মনুষ্যত্বের অতি নিুস্তরে নেমে চিত্তকে নাড়া দেয় না। জীবন ও ধর্ম সম্বন্ধে এদের কোনো উন্নত চিন্তা নেই। ধর্ম এদের প্রাণের সঙ্গে স্পর্শহীন আবৃত্তির বিষয়। এদের জীবনে কোনো পাপ-পুণ্যের সংগ্রাম নেই- আত্মার বেদীতে অনুতাপের অশ্র“ নেই- নিষ্পাপ সত্যময় শুদ্ধ নিষ্কলঙ্ক জীবনের কোনো ধারণা এদের নেই। কোনো মহা আদর্শ এদের সম্মুখে নেই। …মানুষকে নিষ্পাপ সুন্দর হবার জন্য কী ধর্মের অনুশাসনের সত্যই প্রয়োজন, এ কাজ তো মানবাত্মার নিজের ধর্ম। …তোরা আপন মনের সহজ ধর্মের অপমান করিস নে। তোদের কণ্ঠস্বর নামা। তোদের কথায় মধু ঝরুক…।”

ডা. লুৎফর রহমান সাহেবের মতো আমিও বলতে চাই- যে দেশের মানুষের নৈতিকতা নেই, যে দেশের মানুষেরা অনুতাপ করতে জানে না, যে দেশের মানুষেরা কেবল অর্থের মধ্যেই সুখ খুঁজে বেড়ায়, যে দেশের মানুষেরা ধমকের সুরে কথা বলাকে গর্বের বিষয় ভাবে, যে দেশের মানুষের বিনয়ী, নম্রতা, ভদ্রতা, শালীনতা বোঝে না, যে দেশের মানুষ বেশভূষা, গাড়ি-বাড়ি দেখে সম্মান করে নতুবা পাত্তা দেয় না, যে দেশের একদল মানুষ কুকুর-বেড়ালের ন্যায় রাস্তায় পড়ে থাকে আর একদল সম্পদের হিমালয় গড়ে সেই দেশে ধর্ম থাকুক আর নাই থাকুক তাতে কিছু যায় আসে না। সেই দেশের মানুষ ধর্মকে শুধু সংবিধানেই নয় সমস্ত রাস্তা-ঘাটে লটকিয়ে রাখলেও (যা আছেও বটে) উহার আসল রূপ কখনোই ফুটে উঠবে না বরং ওই ধর্মকে অপমান এবং আরো বেশি বাণিজ্যিকীকরণই সার হবে। অতএব প্রশ্ন- আমরা কি স্বার্থান্ধের স্বার্থ-বাসনা জড়িত উপাসনা ও তোষামোদ করছি না? আমরা কি মানব সংসারের কল্যাণ কামনা ত্যাগ করে নিরন্তর ঈশ্বর উপাসনায় ব্যস্ত থাকছি না? তাহলে কি আমরা নিকৃষ্ট শ্রেণীর জীব? দিনদিন আমরা কি উচ্চস্তরের পশুই হচ্ছি না? কারণ প্রতিদিনই তো আমরা তুচ্ছ ও রূঢ় ব্যবহারের অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি!

ড. শাহ সাহেব বলেছেন- ‘স্মরণ কর তোমার প্রতিপালক ফিরিশতাদের বলিয়াছিলেন, আমি মানুষ সৃষ্টি করিতেছি কর্দম হইতে, যখন আমি উহাকে সুষম করিব এবং উহাতে আমার রুহ সঞ্চার করিব, তখন তোমরা উহার প্রতি সিজদাবনত হইও। তখন ফেরেশতারা সকলেই সিজদাবনত হইল- কেবল ইবলিস ব্যতীত, যে অহংকার করিল এবং কাফিরদের অন্তর্ভুক্ত হইল’। এখানেও প্রশ্ন ওঠে, ইবলিস যখন কাফিরদের অন্তর্ভূক্ত হলো তখন তো কাফির ছিলো এমন প্রমাণ ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায় না। ইবলিস নিজে এবং সম্পূর্ণ একাই তো সর্বপ্রথম কাফির, পৃথিবী সৃষ্টির ধর্মীয় ইতিহাস তো তাই-ই বলে! তাহলে এখানে কি ভুল বলা হয়েছে? আর কাফির বা শয়তানের কি স্ত্রী লিঙ্গ রয়েছে তা না হলে কাফিরদের বৃদ্ধি ঘটে কিভাবে? কারণ সর্বপ্রথম কাফির একজনই এবং আমাদের ধারনায় সে পুলিঙ্গ…!
গত ১ সেপ্টেম্বর যুগান্তরে আরেক শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ড. আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ সাহেব লিখেছেন- “রমজান মাস ব্যবসায়ীদের স্বর্গবাস” শিরোনামে। যার প্রথম প্যারাটি এখানে তুলে দেয়া হলো। “প্রতিবছর একটি ঘটনার কোন ব্যতিক্রম নেই- রোজা শুরু হওয়ার দু’একদিন আগে থেকে সারা রমজান মাসে প্রয়োজনীয় ও অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। যতই প্রচার হোক না কেন রমজান আÍশুদ্ধির মাস, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের মাস- বিক্রেতা শ্রেণী কানে তুলো দিয়ে হাত ক্রমেই প্রসারিত করতে থাকেন। সরকার নিজের ইমেজ ভালো রাখার জন্য অনবরত প্রচার করে, রমজান মাসে কোন জিনিসের দাম বাড়ানো চলবে না, যদি কেউ এই নিয়ম লংঘন করে তাদের শাস্তি পেতে হবে। এই প্রচারের পর ব্যবসায়ীরা মুচকি হেসে দাম বাড়িয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন, এসব প্রচারে কান দিও না। সব সরকারই এ ধরনের প্রচার করে, এ শুধু প্রচারের জন্য প্রচার, বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য নয়। সিটি করপোরেশন ঈদের আগে মাংসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। বাজারে মাংস কেনার সময় নির্ধারিত দামের কথা বললে বিক্রেতাদের স্পষ্ট ভাষায় উত্তর, করপোরেশন থেকে মাংস কিনুন, এখান থেকে নয়। এখান থেকে কিনলে আমাদের দামে কিনতে হবে। এই হল চিত্র। রমজান মাস এলে ব্যবসায়ীদের চোখে পূর্ণিমার চাঁদের আলোর মতো হাসি ফুটে ওঠে, আর ভোক্তাসাধারণের চোখ অমাবস্যার কালো অন্ধকারে ভরে যায়। তবু এদেশের লোক বেঁচে থাকে দ্রব্যমূল্য প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই বলে অসহায়ের মতো।” এই তো আমাদের ধর্ম পালনের নমুনা! এই তো আমাদের আদর্শ! অথচ ইউরোপ-আমেরিকা যারা আমাদের চোখে কাফের, নাস্তিক এবং ধার্মিক রাষ্ট্র ইরানের মতে- ব্র“নির ন্যায় বেশ্যা…! সেই কাফেরদের দেশে ধর্মীয় উৎসবে দ্রব্যমূল্য আরো কমে যায়। তারা হাজার হাজার কাস্টমার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলেও এক ছটাক জিনিষ দোকানে থাকা পর্যন্ত একই দামে বিক্রি করে। অথচ আমরা সরবরাহের ঘাটতি না থাকলেও মালামাল লুকিয়ে রাখি এবং কাস্টমারদের বলি মাল নাই, আবার তারা যখন অনুরোধ করেন তখন বলি ১০০ টাকার মাল ২০০ টাকা দিলে খুঁজে দেখতে পারি, কাস্টমারের প্রয়োজন তাই সে ডবল দামে তা নিতে বাধ্য হয়! এখানে ধর্ম কি কাজ করছে?
অন্যদিকে, নিজ দেশের রাজাকে হটিয়ে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী ধার্মিক গাদ্দাফি বলেছেন, “ইউরোপীয়দের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা উচিত। …ইসলাম হচ্ছে সর্বশেষ ধর্ম, যদি কোনো একটি ধর্মে বিশ্বাস রাখতে হয় তাহলে ইসলামই সর্বশ্রেষ্ঠ।” ঠিক তদ্রুপ আরেকটা আমেরিকান গর্দভ পাস্টর (চার্চের নেতা) কোরআন পুড়িয়ে ফেলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। দু’একটা কোরআন, বাইবেল, গীতা… ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে ফেললে ধর্মের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু মানুষ তা বুঝতে চাইবে না, কারণ মানুষ এগুলোকে জীবনের চেয়ে বড় মনে করে। ‘ইউরোপীয়দের ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা উচিত!’ এভাবে বলা কোনো নেতার পক্ষে কি করে সম্ভব তা আমার বোধগম্য নয়। উনি যেমন ওনার ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং শান্তির ধর্ম মনে করে; অন্যরাও তো তাদের ধর্মকে ঠিক তাই-ই মনে করে। যদি এর উল্টো ইউরোপিয়ান কেউ লিবিয়াতে গিয়ে বলতো যে, সমস্ত আরবিয়ানদের উচিত খ্রীস্ট ধর্ম গ্রহণ করা, কারণ খ্রীস্ট ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম; শান্তির, প্রেমের, ভ্রাতৃত্বের… ধর্ম। কারণ খ্রীস্ট বলেছেন, “তোমার এক গালে চড় মারলে, আরেক গাল পেতে দাও। অপরের বস্তুতে লোভ করো না, হিংসা করো না, মন্দের বিপরীতে কাহারো মন্দ করো না…।” তাহলে কি গাদ্দাফিরা তাকে আস্তো রাখতো?

আমি যতোগুলো প্রশ্ন করেছি তার প্রায় সবটাই বিশেষজ্ঞদের লেখা থেকে নেয়া, নিজের নয়। কিন্তু ধর্মে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর একটাই, তাহলো- এসবই সৃষ্টিকর্তা বা সৃষ্টিকর্তাদের ইচ্ছা, তার ইচ্ছা, তার কাজকর্ম কেউ জানে না বোঝে না ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞান কোনো প্রশ্নের উত্তর হাতে-কলমে, বাস্তবে না পাওয়া পর্যন্ত স্বীকার করবে না যে তারা তা জানে বা বোঝে না ইত্যাদি। ধর্ম কিন্তু কখনোই তার ভুলগুলো স্বীকার না করে বিভিন্ন অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক, যেনতেন উদাহরণ খাড়া করেই চলেছে। ফলে মানুষ এখন আর ধর্মের কারণে সৎ হয় না, যে সৎ হয় সে কেবলই মানবিকতার কারণে, নৈতিকতার কারণেই হয়।

আমরা সবাই অতিউচ্চাকাঙ্ক্ষী ও অতিউচ্চাভিলাষী। উচ্চাভিলাষ ভাল কিন্তু অতিউচ্চাভিলাষ কখনো সমাজের মঙ্গল করতে পারে না। উচ্চাভিলাষ রোধ করা সম্ভব কিন্তু কোনো প্রকার আইন-কানুন বা যন্ত্র দ্বারা তাকে দমন করা সম্ভব নয়। তাই উচ্চাভিলাষ যাতে ক্ষতিকর হয়ে না ওঠে তার জন্য জন্মলগ্নেই উদার শিক্ষার মাধ্যমে তাকে দমন করা দরকার। আমাদের সমাজের মানুষ অসম্ভব রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং চরম স্বার্থপর। তার কারণ, এ সমাজে উচ্চাকাঙ্ক্ষা একটি গুণ বলে মনে করা হয় এবং এ সমাজে সফলকাম ব্যক্তিবর্গকে সমাজের সাধারণ মানুষ সর্বদাই দেবতা জ্ঞানে সম্মান করে। অতএব যে সমাজের নিকট সমাজের উচ্চমার্গে অবস্থিত চতুর ও সুদক্ষ দস্যুগণ বীরপুরুষ এবং যাদের সম্পর্কে জানার জন্য, তাদের প্রশংসার জন্য সাধারণেরা খুবই কৌতূহলী, উদগ্রীব সে সমাজের জনগণ দিবাস্বপ্নে বিভোর। যেদিন অধিকাংশ মানুষ এ শ্রেণীর দস্যু, তস্কর, কুটনি ও জুচ্চোরদের ঘৃণা করতে শিখবে সেইদনিই এরা সাধারণদের বিভ্রান্তি করা থেকে বিরত হবে। অন্যথায় মানুষ যতোদিন এদের পূজা করবে ততোদিন পর্যন্ত এরা যথাসময়ে আর্বিভূত হয়ে সাধারণদের জীবন দুর্বিসহ করতেই থাকবে। তাই উচ্চাভিলাষী উৎপীড়কদের সম্পর্কে বেকন লিখেছেন- “এরা অনেকটা লাঙ্গুলবিহীন বানরের স্বজাতীয়। যতই তারা উর্দ্ধে আরোহণ করতে ততই তারা তাদের লাঙ্গুলটিকে প্রদর্শন করবে।” আমরা স্বাধীনতার পর থেকে তো তাই দেখে আসছি। এদেশে আমরা সাধারণেরা তাই লাঙ্গুলবিহীন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের লাঙ্গুল প্রদর্শনেই পরিতৃপ্ত আছি।

নিজ নিজ ধর্মকে আমরা প্রকৃত, প্রধান, শ্রেষ্ঠ, সর্বশ্রেষ্ঠ ইত্যাদি বিশেষণ দিয়েই চলেছি। বলা হয়, প্রকৃত খ্রীস্টান, প্রকৃত হিন্দু, প্রকৃত মুসলমান… তাহলে প্রশ্ন জাগে অপ্রকৃত বা অসত্য বা ভ্রান্ত হিন্দু, সুমলমান, খ্রীস্টান আছে নাকি? এর উত্তরে সব ধর্মের লোকেরা একবাক্যে বলবে- অবশ্যই আছে এবং প্রতিটি ধর্মের লোকেরাই নিজেদের মধ্যে বিভক্ত একেকটি গ্র“প নিজেদেরকে প্রকৃত বলে দাবি করে থাকে। যদি এতোসব ভ্রান্তের দল সব ধর্মেই থাকে তবে তাদের নিধন করা যায় না কেন? তাদের নিধন করার আগে ধর্মপুস্তকে যেসব বিতর্কিত নিয়ম-কানুন রয়েছে তা নিষিদ্ধ করা বা পরিবর্তন করা যায় না কেন? ধর্মপুস্তক পরিবর্তন করা অসম্ভব কেন? যতো সমস্যাই হোক না কেন অবশ্যই প্রতিটি ধর্মপুস্তক এবং প্রতিটি ধর্মকে অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। এগুলোকে পরিমার্জন, পরিবর্ধন করে কুসংস্কারগুলো ঝেড়ে না ফেললে কোনো ধর্মই মানুষের জীবন বিধান হতে পারে না। একে জীবন বিধান অথবা একমাত্র জীবন বিধান বলে চিৎকার শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। কিন্তু কিভাবে এটা জীবন বিধান হলো, সে প্রশ্নটি করছি না। এগুলোর যেসব কুসংস্কার রয়েছে তার আংশিক মান্য করা হলেও তা জীবন বিধান না হয়ে জীবন সংহারক হতে পারে। অথচ এসব কুসংস্কার সংস্কারে কেহই হাত লাগাতে রাজি নয়, কারণ এতে জীবন সংহার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। প্রশ্ন এখানেই ধর্ম কেন তাকে নিয়ে প্রশ্ন তুললেই জীবন সংহারক হয়ে ওঠে? একমাত্র বৌদ্ধ ধর্মই এব্যাপারে সহনশীল কারণ তারা আত্মা, ঈশ্বর, স্বর্গ-নরক… এসবে বিশ্বাস করে না। এছাড়া বুদ্ধের অন্যতম সিদ্ধান্ত হলো- “কোনো ধর্মগ্রন্থই স্বঃতপ্রমাণ হতে পারে না। সমস্ত দেশে সমস্ত কালের জন্য ধর্মগ্রন্থের কথা ‘সৎ’ বা শ্বাশত হতে পারে না। ধর্মগ্রন্থের প্রতিটি কথাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেওয়ার অর্থ কার্য-কারণ সম্পর্কে খোঁজ থেকে বিরত থাকা।”

তবে সমস্যা হলো- আমরা যুক্তিকে এড়িয়ে চলতে ভালোবাসি, ভালোবাসি কুসংস্কারের নিকট মাথা নত করতে। চমক লাগানো গল্প শুনতে ও বলতে ভালোবাসি। অপরের মুখে শোনা ঘটনাকে রং-চং লাগিয়ে নিজের চোখে দেখা সত্য ঘটনা বলে জাহির করার তীব্র লোভের শিকার আমরা। এই চমক দেয়া ও তীব্র লোভের স্পৃহা থেকেই জন্ম নেয় বহু অতিরঞ্জিত কাহিনী, যা বহু কথিত হওয়ার ফলে আমরা বিশ্বাসও করে ফেলি। অর্থাৎ একটি মিথ্যা কথা সকলে সত্য বলতে বলতে তা প্রকৃত সত্য হয়ে যায় আমাদের হৃদয়ে। এমনকি যার অস্তিস্ব নেই তাও সর্বদাই আমাদের হৃদয়ে ও আমাদের কল্পনাতে থাকে। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, লেখাপড়া জানা এমনকি যাদেরকে আমরা উচ্চশিক্ষিত বলি তাদের বেশিরভাগই অলৌকিক গাল-গল্পকেই যাচাই-বাছাই না করে অথবা যুক্তি দিয়ে বিচার না করেই নির্বোধের মতো বিশ্বাস করে ফেলেন। কিন্তু এসব অলৌকিক সব ঘটনার পিছনে কোনো না কোনো অজানা কারণ বিদ্যমান। আমরা এসব অজানা কারণ নিয়ে প্রশ্ন তুলি না আবার এই প্রশ্ন না তোলার পিছনেও কারণ বিদ্যমান। প্রশ্ন তুলি না কারণ আমাদের অহংবোধ। …আমরা কি তাহলে ভুল দেখেছি, অর্থাৎ আমরা যেসব অলৌকিক কাণ্ডকারখানা দেখলাম তা কি ভুল? আমরা এবং আমাদের পিতা-মাতা, গুরুজনেরা কি তাহলে ভুল ধর্ম পালন করে আসছে আদিকাল হতে? অধিকাংশে বিশ্বাস করে বলে আমাকেও অন্ধভাবে, প্রশ্নহীনভাবে এসব বিশ্বাস করতেই হবে! আমরা যদি ভুল স্বীকার করি তবে তো আমার অহংবোধ থাকে না। ভূত-পেত্নি, সাধু-সন্ন্যাসী, শয়তান, ধার্মিক এদের কার্যকলাপের ব্যাপারেও ঠিক এরূপ একটা অহংবোধ আমাদের জন্ম থেকেই কাজ করছে। সাধু-সন্ন্যাসী, দরবেশ-পীর, ফকির-আউলিয়াদের যে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, তা আমরা শুধু অবিশ্বাস করতেই সাহস করি না, এমন পাপের প্রশ্ন তুলতেও ভয় পাই। যদি তাদের অভিশাপে আমার সর্বনাশ হয়…। কিন্তু অতি সামান্য একটি প্রশ্ন করলেই এদের ব্যাপারে আপনার আমার মনে সন্দেহ হতে পারে যে, এরা কি সত্যিকারেই অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী? যেমন- এরা নিজেরা প্রায়ই অসুস্থ হয় অথচ এরা অন্যকে বলে বেড়ান এটা না করলে জীবনেও অসুস্থতা আসবে না, ওটা করলে রোগ সেরে যাবে…। কিন্তু ওনারা নিজেরাই নিজেদের রোগ সারাতে পারে না বলে হয় ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হয়। যদি ওদের প্রতি বিশ্বাস এবং পানিপড়া, চালপড়া ইত্যাদিতে রোগই সারবে তাহলে নিত্য নতুন নতুন এতো হাসপাতাল গড়ে উঠছে কেন? প্রশ্নহীন আনুগত্যতার সুযোগ নিয়ে এরা আমাদের কেবল ধোকাই দিচ্ছে। ঈশ্বরে অন্ধ বিশ্বাস ও সব সময় ঈশ্বর দর্শনের আকুতি থেকে মানুষ অনেক সময় আজগুবি স্বপ্ন দেখে এবং তা ঈশ্বরের আদেশ বলে মান্য করে। যেমন, অন্ধবিশ্বা ও স্বপ্নাদেশের ঐশ্বরিক নির্দেশে মানুষ হত্যা করা হয়; এমনকি এসব ক্ষেত্রে নিজ সন্তানকেও অনেকে বলি দেয়। যা সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত ধারনা যে, ঈশ্বর তাকে এসব করতে বলেছে। অন্ধবিশ্বাসে আক্রান্তরা একটি দড়িকেও অনেক সময় মানুষ যেমন সাপ ভেবে ভয় পায়, সেরূপভাবে নিজ মনের কল্পিত ঈশ্বর দর্শনও ঘটে, তবে তা কখনো শুভ ফল বয়ে আনে না। এটা একসময় রোগে পরিণত হয় এবং একবার ঈশ্বর দেখে, আরেকবার শয়তা দেখে, কারণ ঈশ্বর ও শয়তান দুটোরই ভয় আমাদের মনের মধ্যে রয়েছে। তাই আমি মনে করি, ধার্মিক সাজা যায় কিন্তু মানবতাবাদী হতে হয় অর্থাৎ খাঁটি মানুষ হতে হয়, সাজা যায় না। পক্ষান্তরে ধার্মিক হতে হয় না, তা জন্মগতভাবেই আমরা হয়ে জন্মাই। ধর্ম চর্চার মাধ্যমে ধার্মিক হওয়ার প্রয়োজন নেই; এগুলোর কিছু মন্ত্র ঠোঁটের ডগায় রাখলেই ধার্মিক! কিন্তু কঠিন জীবন চর্চার মাধ্যমেই মানবতাবাদী হতে হয়।

কোনো ঘটনা আমাদের নিকট অলৌকিক মনে হলেও তা আমাদের মনে রহস্যের উদ্রেক করে না, আমরা তা প্রশ্নহীনভাবে অলৌকিক এবং ঈশ্বরের কাজ বলে মেনে নেই। কিন্তু পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তার সবগুলোর পিছনেই কোনো কোনো অজানা কারণ থাকে, অলৌকিক বলে কিছুই নেই। একজন সাততলা থেকে পড়েও বেঁচে যায় এবং অন্যজন সামান্য উঁচু বিছানার উপর থেকে বা চেয়ার থেকে পড়েও মরে যায় এর পেছনেও কারণ আছে, কোনোটাই অলৌকিক নয়। এই যে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেওয়া অথবা কার্য-কারণ তলিয়ে না দেখার ফলেই ধর্মীয় নেতা, রাজনৈতিক নেতা, সামাজিক নেতা… এরা সমাজ কাঠামোটা এমন আইন-কানুন দ্বারা গঠিত ও চালিত করে যে আইন মেনেই তারা সাধারণদের শোষণ প্রক্রিয়া চালু রাখতে সক্ষম। এছাড়া আমরা আবেগ সর্বস্ব জাতি। আবেগের বসে আমরা কোনো মহামানবের জীবনের মন্দ দিকটির সমালোচনা শুনতে ও মানতে চাই না। পৃথিবীর কোনো মহামানবই ধোয়া তুলসিপাতা নয়। প্রত্যেকের জীবনেই দু’টি দিক থাকে, মন্দ ও ভালো, এরাও কেউ এর ব্যতিক্রম নয়। এদের মধ্যে কারো কারো জীবনে ভালোর দিকটা হয়তো একটু বেশি। সমস্ত দোষমুক্ত কোনো মানুষ হতে পারে না, সম্ভবও নয়। তাই প্রতিটি মহামানবের চরিত্র সম্পূর্ণরূপে বিশ্লেষণ করলেই জানা যাবে তার চরিত্রে দোষ বেশি না গুণ বেশি। কিন্তু তা না করে শুধু তার গুণ-গান করি আমরা। শুধু গুণেরটুকু শুনি, দোষেরটুকু শুনতে পাই না, চাই না, কারণ তা শোনা ও বলা নিষিদ্ধ। তাদের বহু সুন্দর সুন্দর বাণী আছে যা প্রচারের জন্য রয়েছে বিশাল কর্মীবাহিনী। এসব সুন্দর সুন্দর বাণীর দ্বারা মানুষকে খাঁটি মানুষ বানানো যায় না। কারণ এসব বাণী নীতিশাস্ত্রেও রয়েছে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখ সকাল ৭:৩০ মিনিটের বিবিসির খবর শোনার পর অলসতাবশত আমি আমার রেডিও ঘুরাচ্ছিলাম হঠাৎ বাংলাদেশ বেতারে ঢুকে গেলাম এবং ইরানের রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় আইনে নারী নির্যাতনের এক হৃদয়বিদারক কাহিনী শুনতে পেলাম সম্ভবত লোকটির নাম হাসান মাহমুদ। তিনি বলেছিলেন, কিভাবে নারীরা সেখানে ধর্মের নামে নির্যাতিত হচ্ছে। সবচেয়ে যে লজ্জাজনক বর্বরতার কাহিনী তিনি বললেন তা মানুষ কেন কোনো পশুতেও করতে পারে না অথচ তারা ধর্মের নামে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়েই এসব কাজ কাজ করছে এবং ঘোষণা দিয়েই বীরের বেশে করছে। সত্যিকারের কোনো মানুষ কি এদের ধার্মিক বলতে পারে? আমি মনে করি, যারা এদের ধার্মিক বলে, যারা এদের পশুর চেয়েও ইতর প্রাণী না ভাবে বরং তারাই পৃথিবীর জঘন্যতম ইতর। হাসান মাহমুদ বলছিলেন, কোনো মেয়ে বা নারী যদি ভার্জিন থাকে এবং ইসলামিক আইন ভঙ্গ করে আর তার যদি পাথর ছুড়ে হত্যার হুকুম অথবা অন্য কোনোভাবে মৃত্যুদণ্ডের হুকুম হয় তাহলে সেই মেয়ে বা নারী যাতে বেহেস্তে যেতে না পারে সেজন্য তাকে ধর্ষণ করে ভার্জিনিটি নষ্ট করার পর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়! কারণ তাদের ধর্মে আছে যে, ভার্জিনরা বেহেস্ত যায়, তাই তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার পূর্বে তাকে ধর্ষণ করে ভার্জিনিটি নষ্ট করা হয়। একে আমরা কি ধর্ম বলতে পারি? আমি ব্যক্তিগত একে অত্যন্ত নিকৃষ্টতম ধর্মীয় আইন বলে মনে করি।

এবার অন্য প্রসঙ্গ। প্রতিটি ধর্মের অনেক কমন বিশ্বাসের মধ্যে অন্যতম হলো, শেষ বিচারের পূর্বে সকলে একই ধর্মালম্বী হবে। বেশ ভালো কথা, তা শেষ বিচারের পূর্বে কেন এখন হলে ক্ষতি কি ছিলো? অথবা প্রথম থেকেই এক ধর্মের থাকলে ক্ষতি কি ছিলো? যাহোক তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সব মানুষ এক হয়ে গেলো অর্থাৎ এক ধর্মালম্বী হলো, যদিও এটা কোনোদিনও সম্ভব নয়, কারণ একই ধর্মের মধ্যে যতোগুলো গোষ্ঠি বিদ্যমান তারা নিজেরাও কোনোদিন এক হতে পারবে না। তবে যদি হয় তাহলে কি পৃথিবীর সব ধর্মীয় সমস্যা চলে যাবে?

সবশেষে মাদার তেরেসার পত্রের কিছু সংক্ষিপ্তসার তুলে ধরছি। তিনিও ঈশ্বরের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। তিনি লিখেছেন, “স্বয়ং ঈশ্বর ক্ষুধার্ত, বিবস্ত্র এবং গৃহহীন ছিলেন। তোমার প্রতি ঈশ্বরের বিশেষ ভালবাসা রয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকে আশ্বস্ত করতে চাই, ঈশ্বর নিস্তব্ধ শূন্য। আমি তাকে হাতড়িয়ে বেড়াই, কিন্তু খুঁজে পাই না। তাকে শোনার চেষ্টা করি, শুনতে পাই না। তাঁর জন্য অনবরত প্রার্থনা করি। তাকে ডাকি, কিন্তু সাড়া দেন না। আমি কান্না করি তিনি যেন আমার জন্য প্রার্থনা করেন আমাকে যেন উদার হস্তে মঙ্গল কামনা করেন। মাদার তেরেসাকে একশ’ বছরের মধ্যে ঈশ্বরের অন্যতম নৈকট্য লাভকারী ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত করা হয়। কিন্তু মাদার তেরেসার এই ঈশ্বরের প্রতি ধীরে ধীরে আস্থাহীনতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে মানবসেবায় আত্মনিবেদন করার পর থেকে। ধারণা করা হয় এর অন্যতম কারণ ছিল, দরিদ্র মানুষের জরাক্লিষ্ট অবস্থা, ভোগান্তি, তাদের সামান্য চাওয়া-পাওয়া পূরণে ঈশ্বরের অসমতা ও ব্যর্থতা দেখে। প্রকাশিত বইটিতে মাদার তেরেসার খেলা ৪০টি পত্রে অসংখ্যবার ঈশ্বর সম্বন্ধে নির্দয়, অদৃশ্য, নির্জন এমনকি নির্যাতনকারী হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।”

গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে ‘আমাদের সময়’ পত্রিকার খবরের শিনোমান- ‘পাথর ছুঁড়ে পাকিস্তানে নারী হত্যা।’

“প্রায় ২ মাস আগে পাকিস্তানের তালেবানরা এক নারীকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুবাই ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল আনের কাছে তালেবানদের পাঠানো এক ভিডিও টেপ থেকে এ তথ্য জানা যায়। ভিডিওতে দেখা যায়, হাত বাঁধা অবস্থায় এক মহিলা মাটিতে শুয়ে আছে এবং একদল পুরুষ তার প্রতি পাথর ছুঁড়ে মারছে। …একজন পুরুষের সঙ্গে একা কথা বলতে দেখা যাওয়ায় মহিলাটির এ শাস্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। তালেবানদের আইন অনুসারে, কোনো পুরুষের সঙ্গে একা কোনো মেয়ে দেখা করলে মেয়েটিকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা যাবে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরান ও সৌদি আরবে এ ধরণের বিচার বেড়ে যাওয়ায় তালেবানরাও উৎসাহিত হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।” কি বিভৎস খবর! একজন পুরুষের সঙ্গে একা কথা বলতে দেখা যাওয়ায় মহিলাটির এ শাস্তি হয়েছে। এই তো ধর্মীয় আইন! এ আইন এবং এর প্রবর্তকদের কিভাবে মানুষ শ্রদ্ধা করে এবং এরূপ হত্যাকাণ্ডে দলবেধে যোগ দেয়, তা মানুষের কল্পনাও আসে না। এরূপ হত্যাকাণ্ড ইরান, সৌদিসহ প্রায় সব ধর্র্মরাষ্ট্রে স্বীকৃত কিন্তু দুঃখের বিষয় ধর্মীয় আইন বলেই এর সমালোচনা তেমন একটা হয় না, যারা করে তারা মানবতাবাদী কিন্তু তাদেরকেও এসব ধর্মরাষ্ট্রগুলো বেশ্যা বলে গালি দিতে দ্বিধাবোধ করে না।

চিরদুঃখী, বঞ্চিত, সহজ-সরল, প্রশ্নহীন জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে নিয়তিবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং ঈশ্বরবাদের কোনো জুড়ি নেই। এদেশের বঞ্চিত মানুষের দুর্গতি প্রতিবছরই তো বাড়ছে। দেশে আইন আছে কিন্তু তা তাদের জন্য নয়। ধনী, ক্ষমতাবান, রাজনৈতিক নেতা ও তাদের চেলাচামুন্ডা, তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের… বুটের তলায় আইন। আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশই তো টিকিয়ে রেখেছে অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে অধিকাংশের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, লেখাপড়া… ইত্যাদির সুযোগ নেই; সেখানে সংবিধানে এরূপ মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যবস্থা থাকলেও নিরন্ন মানুষগুলো তা জানেও না। ওরা সমাজের আগাছা হয়ে জন্মায় আগাছা হয়েই থাকে চিরজীবন। যে বয়সে আমাদের সন্তানেরা ফিটফাট হয়ে স্কুলে যায়, সে বয়সে ওরা কালি মেখে গাড়ি সারাবার কাজ শেখে, কুলিগিরি করে, ফেরি করে…। অতএব যে দেশে সর্বোচ্চ পদ থেকে দুর্নীতির স্রোত নেমে আসে, সে দেশে ঘুষখোর, লুণ্ঠনকারী, হত্যাকারী, ছিনতাইকারী, চোর-ডাকাত, ধর্ষক, গুন্ডা-বদমাশ, দুর্নীতিবাজ… রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকার দরুণ শুধু পার পেয়ে যায় না, বরং ওরা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়াবার ছাড়পত্র পায়, নেতা হবার সুযোগ পায়। যে দেশের মানুষ আজন্ম ধর্ম লঙ্ঘন না করে বরং তা পালন করেই দুর্নীতি চালিয়ে যায় অবলীলায়, এই তো সেই দেশ- আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।
এখন প্রশ্ন হলো- ঈশ্বর বা আল্লা বা ভগবান অথবা সৃষ্টিকর্তা যা-ই বলা হোক না কেন (আমি বলি সৃষ্টিকর্তাগণ) কি সত্যিই দরিদ্র মানুষের জরাক্লিষ্ট অবস্থা, ভোগান্তি, তাদের সামান্য চাওয়া-পাওয়া পূরণের কোনো ক্ষমতা আছে? যদি থাকে তাহলে তিনি কেন একজনকে জন্ম দিচ্ছেন ফুটপাতে এবং আমরণ সে ডাস্টবিন ঘেটেই খেয়ে বাঁচে। অন্যজনকে জন্ম দিচ্ছেন সোনার চামচ মুখে দিয়ে এবং সে আমরণ সোনার চামচ দিয়েই পঞ্চামৃত খেয়ে যাচ্ছেন। ধর্ম একথা বিশ্বাস করে যে, একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে থাকে সম্পূর্ণ নিষ্পাপ অথচ এই নিষ্পাপ শিশুকে তিনি কি করে ডাস্টবিনে জন্ম দিতে পারেন? সৃষ্টিকর্তাদের এরূপ আচারণ দেখে, এরূপ অসমতা, ও ব্যর্থতা দেখে আমরা কি তাকে প্রশ্ন করতে পারবো না, তাকে বলতে পারবো না যে হে দয়াময় সৃষ্টিকর্তারা তোমরা ব্যর্থ? কেন তাদেরকে নির্দয়, অদৃশ্য, নির্জন এমনকি নির্যাতনকারী… হিসেবে আখ্যায়িত করা যাবে না? কেবলমাত্র ভূমিকম্প ব্যাতিত পৃথীবির যাবতীয় প্রাকৃতিক দুযোর্গের দিকে লক্ষ্য করলে একটি প্রশ্ন জাগে- কেন এসব দুর্যোগে শতকরা ৯৯% দরিদ্র মানুষের মৃত্যু হয়? প্রতিটি ধর্মই বলে আমাদের দৈন্যতা আমাদের পাপের ফল এরূপ মৃত্যু। তাহলে দরিদ্রদের দারিদ্রতা কি তাদের পাপের ফল? তারাই কি বেশি পাপ করে? ধনীরা তাহলে কম পাপ করে? এসবের উত্তর জনগণের উপরেই ছেড়ে দিলাম।